মে মাস ১৯৭১ -সময়ে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
মে মাস ১৯৭১ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১ মে ১৯৭১ : বিদেশি নেতাদের সমর্থন বাংলাদেশকে
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি জে ডব্লিউ ফুলব্রাইট একাত্তরের এই দিনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) ব্যাপারে নীরব থাকা মানে পাকিস্তানি বর্বরতাকে সমর্থন করা। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জন রোডের চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে তিনি এ কথা বলেন। জন রোড চিঠিতে লিখেছেন, পাকিস্তানিরা জংলি আইন চালাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। তারা হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে খুন করছে। খুন করছে বুদ্ধিজীবীদের। ধ্বংস করছে হিন্দুদের।
রোড তাঁর চিঠি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পেশ করলেও তা গোপন রাখা হয়েছিল। বিষয়টি উল্লেখ করে সিনেটর ফুলব্রাইট বলেন, পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা না করে এবং এসব তথ্য গোপন রেখে পররাষ্ট্র দপ্তর কার্যত ঘটনাগুলো সমর্থন বা অনুমোদন করেছে।
পাকিস্তানকে সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসনের পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ফ্রাংক জাড। এ বিষয়ে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমকে চিঠি দেন।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র প্রাভদা পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান শান্তি হ্রাসে উদ্বেগ জানায়। প্রাভদা লেখে, গৃহীত সামরিক পদক্ষেপ পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে হানিকর হবে। পরিস্থিতি ভারতসহ পুরো এশিয়ার, এমনকি সারা বিশ্বের শান্তির জন্যই বিপজ্জনক। ঢাকা এবং কলকাতায় ভারত ও পাকিস্তানের মিশন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় মিশনের লোকদের রুশ বিমানে নিজ নিজ দেশে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া প্রস্তাব দুই দেশ মেনে নেয়।
এই দিনে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা অক্সফাম এবং ওয়ার অন ওয়ান্ট ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানায়।
ব্রিটেনের উস্টারশায়ারে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিরা আবার বিক্ষোভ করেন। খেলা শুরু হলে প্রায় ৫০০ বাঙালি সেখানে সমবেত হয়ে ‘বাংলাদেশকে স্বীকার করে নাও’, ‘খুনিরা ফিরে যাও’ স্লোগান দেন।
পাকিস্তানে ও ভারতে
ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এ দিন জানায়, স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে তাঁদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে অতিথি শিক্ষক হিসেবে সেখানে সাময়িকভাবে চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পাকিস্তানের তথ্য দপ্তর জানায়, সরকার কিছু নির্বাচিত সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি দেবে। তবে যাঁদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে এর আগে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের এ অনুমতি দেওয়া হবে না।
পাকিস্তানি সেনারা এই দিনও ভারতের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে ও গোলাবর্ষণ করে। তাদের গোলায় পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর রেলস্টেশনের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া একজন শরণার্থী নিহত ও ছয়জন ভারতীয় আহত হয়।
কুমিল্লার লাকসামের বগাদিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে সেতু ধ্বংস হয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২ মে ১৯৭১ : কর্মকাণ্ড চলছে বাংলাদেশ সরকারের
১৯৭১ সালের ২ মে বাংলা-দেশ সরকার একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, শত্রু–সেনাদের সাহায্য করে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, মানুষ তাদের ক্ষমা করবে না। তাদের কাজের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলা-দেশ সরকার আবদুস সামাদ আজাদকে নির্বাচন করে। বিশ্ব শান্তি কমিটি শান্তি সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠাতে বাংলা-দেশ সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল।
সরকার তাদের প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই দিন বেতন দেওয়া হয়। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অনেকেই বেতনের একটি অংশ সরকারের মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে জমা দেন।
বাংলাদেশের পিরোজপুরে সিরাজ শিকদার গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভানেত্রী এবং প্রধান কমান্ডার হন যথাক্রমে স্ত্রী জাহানারা বেগম এবং শাহনেওয়াজ। তাদের আওতাভুক্ত এলাকাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের একটি অংশে সামরিক আইন বলবৎ রেখেও অন্য অংশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে।
কাইয়ুম মুসলিম লীগের প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য শাসনতন্ত্র জারির সুপারিশ করেন।
মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান খুলনায় শান্তি কমিটি আয়োজিত এক সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিমুর্লের কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
এই দিন সকালে পাকিস্তানি সেনারা খাগড়াছড়ির রামগড়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর তীব্র হামলা করে। সারাদিন যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি সেনারা রাতে রামগড়ের দখল নিয়ে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে এলাকায় বিভীষিকা কায়েম করে।
পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরের অদূরে হিন্দু অধ্যুষিত ঈশান–গোপালপুর গ্রামে গণহত্যা চালায়। স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুর থেকে সেখানে আসে। লক্ষ্মী দাসের হাট নামে একটি জায়গায় তাদের যান থামিয়ে ঈশানশঙ্করের বাড়ির দিকে এগোয়। গ্রামবাসী পালানোর সময় তারা ২৯ জনকে আটক একটি জলাধারের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সকাল প্রায় ৮টায় ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর স্টেশন এবং তার আশেপাশে গোলাবর্ষণ করে। গোলায় রাধিকাপুর স্টেশন বিধ্বস্ত এবং কয়েকজন হতাহত হয়। রেল কর্তৃপক্ষ স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া ত্রিপুরার সাবরুমে পাকিস্তানি বাহিনী গোলাবর্ষণ করলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
বাংলাদেশের পক্ষে ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিন বাংলা-দেশ নিয়ে আলোচনার জন্য ৭ মে বিরোধী দলের নেতাদের বৈঠক ডাকেন। তাঁর সরকার বাংলা-দেশ সম্পর্কে কী ভাবছে, সে সম্পর্কে তিনি বিরোধী দলের নেতাদের অবহিত করবেন বলে জানান। শরণার্থীদের প্রসঙ্গও কথা হবে বলে জানানো হয়।
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক কনভেনশন বাংলা-দেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানায়। কনভেনশনে বক্তব্য দেন জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিমলচন্দ মুখার্জি প্রমুখ।
ভারত সরকারি জানায়, সেখানে আগত বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৮। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী জানান, ত্রিপুরায় প্রায় আড়াই লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ক কমিটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সংক্রান্ত উপ-কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার কলকাতায় বলেন, শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানে অতি মাত্রায় বর্বরতা ও গণহত্যা চলেছে। কিছুদিন আগেও এটি পাকিস্তানের ঘরোয়া বিষয় ছিল, কিন্তু পাঁচ লাখ লোক দেশান্তরি হওয়ার পর এটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
৩ মে ১৯৭১ : বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আহ্বান
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক আবদুস সালাম (ওরফে বারীন দত্ত) ৩ মে মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতি আবেদন জানান।
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে এদিন সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের সম্মেলনে গৃহীত বাংলাদেশ–সম্পর্কিত এক প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও একটি মীমাংসার জন্য আলোচনা শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক বন্দীদের অবস্থা সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এদিন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) অবস্থা জানার জন্য জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
টাইম ম্যাগাজিন এই দিনের সংখ্যায় বাংলা-দেশ নিয়ে ‘মৃতের শহর ঢাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় এদিন জানায়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য তারা আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এ আলোচনার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব টাকা কেন্দ্র থেকে দেওয়া হবে।
ভারতের দক্ষিণ–পূর্ব রেলের মহিলা সংস্থা বাংলা-দেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির তহবিলে অর্থসহায়তা দেয়। মুম্বাইয়ের কেন্দ্রীয় ত্রাণ তহবিল প্রতিদিন তিন হাজার বাংলাদেশি শরণার্থীকে খাওয়ানোর জন্য বসিরহাট সীমান্তে লঙ্গরখানা খোলার কথা জানায়।
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা বলেন, বাংলাদেশে যা চলছে তাকে গৃহযুদ্ধ বলা চলে না, এটি মুক্তিযুদ্ধ। সমগ্র জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
বাংলা-দেশ সামরিক আইন প্রশাসক সাতজন ছাত্রনেতাকে ১০ মে সকাল ৮টার মধ্যে ঢাকার উপসামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ছাত্রনেতারা হলেন ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, খায়রুল আনাম খসরু, মোস্তফা মহসীন মন্টু ও সেলিম মহসীন।
চট্টগ্রামের পটিয়ার খারনা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত মুজাফফারাবাদ গ্রামে স্থানীয়দের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচার গণহত্যা চালায়। প্রায় ৩০০ মানুষ গণহত্যার শিকার হন। শিশু থেকে বৃদ্ধ–বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাননি। পাকিস্তানিরা কয়েক শ বাড়িঘরে আগুন দেয়।
উত্তরাঞ্চলের নাটোরের ধলাপাড়া গ্রামের বনপাড়ায় মিশনারি হাসপাতালে পাকিস্তানি সেনারা এই দিন হামলা চালায়। তারা মিশন ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে সেখানে আশ্রিত পরিবারের ৮৬ জন যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষকে আটক করে নারদ নদের পার্শ্ববর্তী খালপাড়ে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার আগে তাঁদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ মাত্র একজনই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
ঝালকাঠির কীর্তিপাশায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে কয়েকটি ভাগে মাদ্রা, শতদল কাঠি, আতা ও ভিমরুলী গ্রামে আলাদা আলাদা ক্যাম্প স্থাপন করেন।
৪ মে ১৯৭১ : কমন্স সভায় আলোচনা বাংলা-দেশ পরিস্থিতি নিয়ে

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় ৪ মে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের উপস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রতি দেশটির সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক হয়। এডওয়ার্ড হিথ নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি নজর রেখে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিরোধের রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তাঁরা যত দূর সম্ভব চেষ্টা ও সাহায্য করবেন। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) অন্তত ছয় লাখ লোক গৃহহীন হয়েছেন। সংখ্যাটি ক্রমশ বাড়ছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বিমানযোগে প্রথম ব্রিটিশ সাহায্য পাকিস্তানে পাঠানো হবে। এ সাহায্যের কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই। তিনি জানান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কূটনেতিক চ্যানেলে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার জন্য পাকিস্তানকে সব রকম সাহায্য বন্ধ করে দিতে কমন্স সভায় দাবি জানান লেবার পার্টির সদস্য মাইকেল বার্নস। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে সেখানে পর্যবেক্ষক পাঠানো যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কসংক্রান্ত কমিটি পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) যুদ্ধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখাসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এদিন অনুমোদন করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এদিন ত্রাণকার্যের জন্য একটি দলকে অবিলম্বে বিমানে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাঠানোর জন্য নিক্সন সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। তিনি দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের সমালোচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্গতি দূর করার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তর এ পর্যন্ত কিছুই করেনি।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এদিন জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। শরণার্থীদের সহযোগিতা নিয়েও তাঁদের কথা হয়।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এদিন রেডক্রস জানায়, বাংলা-দেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য সারা পৃথিবীর রেডক্রস সোসাইটির কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। এই আবেদনে ১৩টি দেশের রেডক্রস সোসাইটি সাড়া দিয়েছে। দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।
মালয়েশিয়ার ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির সম্পাদক ফ্যান ইউ তেন কুয়ালালামপুরে বলেন, বাংলাদেশে কী ঘটছে তা তাঁর দেশের জনসাধারণকে জানানোর জন্য তাঁরা ব্যাপক প্রচার আন্দোলনে নামবেন। তাঁরা চান, বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষকে নির্দয় ও পরিকল্পিতভাবে হত্যা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হোক।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
বাংলা-দেশ সফররত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এই দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পরিদর্শন করেন।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক বিরোধীদলীয় উপনেতা শাহ আজিজুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক বিধি ও জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। পাকিস্তানকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
চাঁদপুরে শান্তি কমিটির উদ্যোগে এদিন এক মিছিল বের করা হয়। সিলেটের পুষাইনগরে হামলা চালিয়ে ১৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
বাংলাদেশের পক্ষে
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তান যদি সীমান্তে শত্রুতা আরম্ভ করে তাহলে সমুচিত জবাব পাবে।
ভারত–বাংলা-দেশ মৈত্রী সমিতির একটি প্রতিনিধিদল দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনেতিক উপদেষ্টা লি টি স্টলের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহার করায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দাবি করে তাঁরা স্মারকলিপি দেন। স্টল জানান, তিনি সমিতির বক্তব্য দ্রুত ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেবেন।
৫ মে ১৯৭১ : পাকিস্তান তথ্য দিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৫ মে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান জানায় যে তিনি জীবিত ও সুস্থ আছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আকবর খান করাচিতে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের আইন অনুসারে বঙ্গবন্ধুর বিচার হবে। সাংবাদিকেরা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাইলেও সে অনুরোধ রাখা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনেটরের কাছে পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ডেভিড অ্যাবশায়ারের লেখা একটি চিঠি এদিন ওয়াশিংটনে প্রকাশ করা হয়। ওই সিনেটরেরা পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠি লিখেছিলেন। অ্যাবশায়ার সিনেটরদের জানান, চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিমান ও ট্যাংক পাকিস্তানকে দেওয়া
হয়েছিল, পাকিস্তান সরকার সেসব অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এম ২৪ ট্যাংক ও এফ ৮৬ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলসের সাক্ষাৎকার এদিন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কার বিরুদ্ধে কী কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, তা না জেনে কাউকে মারণাস্ত্র দেওয়া নির্বুদ্ধিতা। অবিলম্বে দুটি ব্যবস্থা নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দরকার হয়ে পড়েছে: ১. মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের অপব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং অবিলম্বে তাদের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া। ২. এশিয়ায় শান্তি ক্ষুণ্ন করায় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। পূর্ব পাকিস্তানের একটি সশস্ত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বিশাল সংখ্যাগুরুকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করায় যে অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা মীমাংসার জন্য জাতিসংঘের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাঁদের সংস্থা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে তারা স্থায়ী উদ্বাস্তুতে পরিণত হোক, সেটা কারও প্রত্যাশা নয়। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আর কোনো শরণার্থী ভারতে না আসে এবং দেশত্যাগীরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারে।
বাংলাদেশে গণহত্যা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিরোজপুর দখলে নেওয়ার পর মহকুমা প্রশাসক আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান এবং মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদকে এদিন গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আর ফিরে আসেননি। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা।
পাকিস্তানি সেনারা এদিন নাটোর চিনিকলেও গণহত্যা চালায়। গোপালপুর গণহত্যা নামে এই ঘটনাটি পরিচিত। সেনাবাহিনীর দল গোপালপুরে এসে চিনিকলের প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করে। সেনারা প্রথমে চিনিকলের প্রধান কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করে। এরপর কর্মচারীদের চিনিকলের ভেতরে একটি পুকুরের সামনে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। চারজন বাদে সবাই মারা যান।
পাকিস্তানি সেনারা সিলেটের নানিয়াতেও এদিন ২৬ জন নিরীহ মানুষকে নির্যাতনের পর হত্যা করে।
ভারতের ভেতরে
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে এদিন এক বৈঠকে ৭ মে বিধানসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব তোলার সিদ্ধান্ত নেন। বিধানসভার অধিবেশন শেষে মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জয়নাল আবেদিন, বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসু, সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার, সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি, সংযুক্ত বামফ্রন্টের আহ্বায়ক সুশীল কুমার প্রমুখ প্রস্তাবটি তৈরি করেন।
বাংলা-দেশ সমন্বয় কমিটির ডাকে এই দিনকে কলকাতায় ‘বাংলা-দেশ স্বীকৃতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে শহীদ মিনার ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গেয়ে সভার সূচনা করেন। সভায় এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি ও সাহায্য দেওয়া ভারতের অপরিহার্য কর্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ভারতের জাতীয় জীবনে অগ্নিপরীক্ষার মতো। এই অপূর্ব সুযোগ ব্যর্থ হলে ভারতের জাতীয় জীবন ধিক্কৃত হবে। প্রস্তাবটি পাঠ করেন সমর গুহ। সভাপতিত্ব করেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনি সভা চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে সভা পরিচালনা করেন শংকর প্রসাদ মিত্র। প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য দেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, পান্নালাল দাশগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ।
৬ মে ১৯৭১ : সাহায্য পাঠানো বন্ধের প্রস্তাব পাকিস্তানে
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক কমিটি ৬ মে পূর্ব পাকিস্তানে লড়াই বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বিরোধিতা উপেক্ষা করেই প্রস্তাবটি মৌখিক ভোটে সিনেটে অনুমোদিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর সিনেটে চিঠি লিখে যুক্তি দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করে দিলে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সিনেটররা সে যুক্তি উপেক্ষা করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে লড়াই বন্ধ না হলে এবং সেখানে ত্রাণ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে না দিলে পাকিস্তানে সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখা উচিত।
সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পর যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ভীষণ এক দুর্যোগের
মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারের জরুরি পদক্ষেপই লাখ লাখ মানুষকে এ অবস্থায় আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দুই হাজার বাঙালি এদিন যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
দেশ অবরুদ্ধ
সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন ঘোষণা করে যে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ৭ মে ভোর সাড়ে ৪টা থেকে দুই দিনের জন্য ঢাকা শহরের সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হবে।
আখাউড়ায় এদিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের পর্যুদস্ত করে আখাউড়ার পার্শ্ববর্তী গঙ্গাসাগর ও উজানিসরের বিরাট এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। পাকিস্তানি সেনারা আখাউড়া ও কুমিল্লার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগব্যবস্থা চালুর চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত করতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন। বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ চালান। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ও প্রেমতলায় এবং কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটেও যুদ্ধ হয়।
ইন্দিরা গান্ধীর আবেদন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন দিল্লিতে বলেন, বাংলা-দেশ থেকে আসা ২০ লাখের বেশি শরণার্থীর চাপ পড়েছে ভারতের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের ঘটনাধারার প্রতিক্রিয়া শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতে পড়বে। শুধু শরণার্থীদের তদারক করলেই হবে না, যুদ্ধের পর তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানান।
ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকার দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের মতো ভারতে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপারেও জাতিসংঘ দায়িত্ব নিক। এত লোকের ব্যবস্থা করা ভারতের একার পক্ষে সামর্থ্যের বাইরে।
বাংলাদেশি শরণার্থীদের ত্রাণকাজে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের একটি প্রতিনিধিদল দিল্লিতে আসে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধিদলও শরণার্থীদের সমস্যা সরেজমিন দেখার জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে কলকাতায় আসে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা-দেশ সহায়ক সমিতির সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী জানান, বাংলা-দেশ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ের হাজারখানেক শিক্ষক কাজের জন্য তাঁদের কাছে নাম লিখিয়েছেন।
বাংলা-দেশ সহায়ক কমিটি এই দিন নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় শরণার্থীদের জন্য দুটি বড় ভ্রাম্যমাণ অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করে। কমিটির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ রেডক্রসের সাবেক চেয়ারম্যান এস সি রায় জানান, বাংলাদেশের বহু গুলিবিদ্ধ মানুষ সীমান্তবর্তী হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা ভারতের নেই। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে বলে পাকিস্তানের উত্থাপিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
৭ মে ১৯৭১ : ইন্দিরা গান্ধীর ভাবনা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে
‘
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অব্যাহত চাপের মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৭ মে এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। দিল্লিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল হবে না।
বৈঠকে বিরোধী দলের দুজন বাদে বাকি সবাই বাংলা-দেশ ও বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। বিরোধী দলের সব নেতার কথা শোনার পর ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, স্বীকৃতি দেওয়া ব্যাপারে ভারত ভীত নয়।
বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী এই আভাস দেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত তার অভিমত ব্যাখ্যা করে শিগগিরই বিভিন্ন দেশে সাংসদদের প্রতিনিধিদল পাঠাবে। বিরোধী দলের নেতাদের তিনি জানান, ত্রাণকার্য সম্পর্কে কী করা যায়, তা নিয়ে কথা বলার জন্য তিনি আবার তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে বসবেন।
বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক বসেন। বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে তিনি তাঁদের জানান। এ বৈঠকেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা হয়, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে এই দিন দেখা করতে যান সেখানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর। তাঁকে তিনি বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং ভারতে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় রাজ্যের বিধানসভায় এই দিন বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি, অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সাহায্য দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করলে সেটি গৃহীত হয়। প্রস্তাবের ওপর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন দলের ২৭ জন সদস্য বক্তব্য দেন। স্পিকার অপূর্বলাল মজুমদার বাংলাদেশের শহীদদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালনের জন্য অনুরোধ করেন।
কলকাতা পৌরসভাও স্বাধীন বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। পৌরসভার অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করেন মেয়র শ্যামসুন্দর মজুমদার।
ভারতের ৪৪ জন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানুষের আর্ত ক্রন্দনে সাড়া দেওয়ার জন্য বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. রাও, নুরুল হাসান, সাংবাদিক ফ্রাঙ্ক মোরেস প্রমুখ।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পশ্চিমবঙ্গ শাখা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে বলে, বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরি হলে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদেরই বিপদে ফেলা হবে না, ভারতেরও ক্ষতি হবে।
ভারত সফরে আসা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক প্রতিনিধিদলকে এদিন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব টি এন কল জানান, বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারত, কিন্তু মানবিক কারণে করেনি।
তিনটি ব্রিটিশ সংস্থা অক্সফাম, ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং ক্রিশ্চিয়ান এইডের পক্ষ থেকে ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষ বিমান ৫০ হাজার পাউন্ড ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এদিন কলকাতায় আসে।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পাকিস্তানে নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত এয়ার মার্শাল সুতোপো ঢাকায় গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর সরকারের একাত্মতা প্রকাশ করেন।
পাকিস্তানি সেনারা এই দিন রণদাপ্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরের হিন্দুপ্রধান গ্রাম পাঁচগাঁওয়ে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় হানা দেয়। তারা গ্রামের লোকজনকে একটি পুকুরের সামনে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞে ৫৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান সরকার জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতির অবনতি রোধে ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি জারি করা হয়েছে। পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর এবং জনগণের মধ্যে ভীতি, হতাশা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার মতো কিছুর প্রকাশ এখন থেকে নিষিদ্ধ। সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদ প্রকাশের আগে সেন্সর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর বৈধ করিয়ে নিতে হবে। বিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।
সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে কবি শেখ আয়াজকে আটক করা হয়। রাজনৈতিক আবহাওয়া ‘দূষিত করার’ অভিযোগে গোলাম জিলানি ও জি এম সৈয়দকেও গৃহবন্দী রাখা হয়।
বাংলাদেশে সামরিক অভিযান শুরুর পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিশ্বব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন যাত্রা করেন।
৮ মে ১৯৭১ : ভারতের পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব শরণার্থীদের নিয়ে
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ত্রিপুরা ও মেঘালয়—এ পাঁচ সীমান্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়ার প্রাক্কালে ৮ মে মহাকরণে (রাইটার্স বিল্ডিং) এক জরুরি বৈঠকে বসেন। মুখ্যমন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নেন, শরণার্থীদের বিষয়টিকে শুধু সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সমস্যা হিসেবে না দেখে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করার জন্য তাঁরা কেন্দ্রকে অনুরোধ জানাবেন। এ দাবির পাশাপাশি তাঁরা একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব প্রণয়ন করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী উইলিয়ামসন সাংমা প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করে প্রস্তাবটি প্রণয়ন করেন।
প্রস্তাবের বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর বোঝা কমানোর যে আরজি মুখ্যমন্ত্রীরা করেছেন, তিনি তা বিবেচনা করছেন।
ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এক বক্তৃতায় জানান, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি কায়রো, রোম, মস্কো, বার্লিন, নিউইয়র্কসহ জাপান ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য এই দিন থেকে কলকাতায় একটি দপ্তর চালু করে।
ইয়াহিয়া খানঃ সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে কেন্দ্রীয় সিরাত কমিটি আয়োজিত এক সেমিনারে জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযমসহ অন্য বক্তারা বলেন, ভারত তার গুপ্তবাহিনীর সহায়তায় এ দেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষ ও সেনাবাহিনী তাদের বিতাড়িত করেছে।
পাকিস্তানি সেনারা, তাদের কিছু বাঙালি সহযোগী এবং অবাঙালিরা মিলে ফরিদপুরের কানাইপুরে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেনাবাহিনীর অনুগামী বাঙালি ও অবাঙালিদের একটি সশস্ত্র দল গ্রামটির সিকদারবাড়িসহ আরও কয়েকটি বাড়ির ১৮ জনকে গলা কেটে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চলে লুটপাট। অবশেষে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শনে ওসমানী
মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী ৮ মে সন্ধ্যায় ভারত–বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দিনাজপুরের ভজনপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তিনি উদ্দীপনা সঞ্চার করেন। ভারতের কদমতলায় তিনি মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় অধিনায়কদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলা-দেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে সে অনুসারে অধিনায়কদের নির্দেশনা দেন।
বাংলা-দেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব ডা. টি হোসেন এবং বাংলা-দেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. আসহাব–উল হক কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার মুক্তাঞ্চল সফর করে এসে জানান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভেতরে মানুষ অসম্ভব সংকটে দিনযাপন করছে। অনেকে মারা যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও রেডক্রসের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, কলকাতার মিশন অফিস ত্রাণসামগ্রী ও ওষুধপথ্য সাদরে গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকেরা লন্ডনে এক সভায় মিলিত হন। সভায় অ্যাকশন কমিটির কার্যক্রমে গতি আনার লক্ষ্যে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন এবং বাংলা-দেশ আন্দোলনের সাহায্যার্থে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা-দেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফান্ডের বোর্ড অব ট্রাস্টি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সমাজকর্মী ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ এবং কমন্স সভার লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস।
লন্ডনের উত্তরে নর্দাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দুই শ প্রবাসী বাঙালি অবস্থান নিয়ে যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
৯ মে ১৯৭১ : প্রশ্ন ও বিক্ষোভ জাতিসংঘের মন্থরতায়
ভারত সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের উপহাইকমিশনার চার্লস মেস ৯ মে বলেন, বাংলাদেশে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক মানুষ সেখান থেকে পালিয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। জাতিসংঘ বাংলা-দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের যথাসাধ্য সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাঁর বিশ্বাস, সারা বিশ্বও শরণার্থীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
জাতিসংঘ মিশনের ভারতে আসতে এত দেরি হলো কেন, এ প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থী মিশন আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ১০ দিন আগে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ভারতে মিশন পাঠানোর কথা তাঁদের জানান। এরপর তাঁরা ভারতে এসেছেন।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে এদিন বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে শতাধিক মানুষ অংশ নেন। সদ্য পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করা বাঙালি কূটনীতিক এ এইচ মাহমুদ আলীও তাঁদের মধ্যে ছিলেন।
আমেরিকার বাংলা-দেশ লীগের সভাপতি কাজী এম আহমদ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশকে সমর্থনের অনুরোধ জানান।
ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এদিন অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে সকালে ব্রাডফোর্ডে ও বিকেলে বার্মিংহামে সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি সভায় বক্তব্য দেন বহির্বিশ্বে ও জাতিসংঘে বাংলা-দেশ কূটনৈতিক মিশনের বাংলা-দেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
ভারতের রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান পদ্মজা নাইডু বিশ্ব রেডক্রস দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে আশা প্রকাশ করেন, ভারতে অবস্থানরত জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল তাদের পর্যবেক্ষণকাজের জন্য আর বেশি সময় ব্যয় করবে না। ভারতীয় রেডক্রস শরণার্থী ত্রাণের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগেই সাহায্য করছে। কিন্তু এই বিরাট কাজে অন্য দেশকেও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এদিন ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তি ও জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ভারত নৈতিক দিক থেকে বাধ্য।
ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকার আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বাংলাদেশি শরণার্থীদের সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সাহায্য কেন্দ্র থেকে তাদের দেওয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা
কুমিল্লার কটকবাজারে পাকিস্তানি সেনার একটি দলকে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করে। তীব্র যুদ্ধ হয় বগাদিয়ায়। অবশেষে একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।
কক্সবাজারে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
কোটালীপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হেমায়েত উদ্দিনের (পরে বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় হরতকীডাঙ্গা গ্রামের কাছে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গতিরোধ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদলের কাছ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
সামরিক কর্তৃত্বের পাকিস্তানে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি এই দিন সিলেট অঞ্চলে সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময়ে স্থানীয় কমান্ডার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অভিযান সম্পর্কে তাঁকে জানান। নিয়াজি সিলেটের ২২ কিলোমিটার উত্তরে হেমু সীমান্ত পরিদর্শনে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র তাঁকে দেখানো হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঞ্চগড়ের অমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। এর খুব কাছেই ভারতের সীমান্ত এলাকা। যুদ্ধের প্রথম ভাগে মুক্তিযোদ্ধারা অমরখানা ধরে রাখলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে টিকে থাকতে পারেননি। অমরখানা দখল করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। সেখানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, বহু সৈন্য সমাবেশ, দুর্ভেদ্য বাংকার নির্মাণ, পিলবক্স, ট্রেঞ্চ ও অবজারভার পোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করে।
একটি পাকিস্তানি সেনাদল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৩৬০ জন মানুষের ওপর লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড চালায়। গজারিয়ার গোশাইরচর, নয়ানগর, কাজীপুরা, বাঁশগাঁও ও বালুরচরের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, ভোরের আলোয় তাদের জন্য কী বিভীষিকা অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানি সেনারা যাকে যে অবস্থায় পায়, সেভাবেই গুলি করে হত্যা করে। আগুন দিয়ে বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়।
ঢাকার নবাবগঞ্জের বর্ধনপাড়া ও কলাকোপায় পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
নাটোরের কলম ও হাতিয়ান্দহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদিন ২০ জনকে হত্যা করে।
১০ মে ১৯৭১ : ইউরোপ–যাত্রা বাংলা-দেশ সরকারের প্রতিনিধিদলের
বুদাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলা-দেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল এদিন ভারত থেকে হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হয়। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সামাদ আজাদ। ১২ মে থেকে বুদাপেস্টে শুরু হওয়া এই শান্তি সম্মেলন শেষে প্রতিনিধিদলটি বাংলা-দেশ সরকারের বক্তব্য বিশ্বের জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য এশিয়া, পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করবে।
বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার জন্য প্রতিনিধিদলটি বাংলা-দেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি নিয়ে যায়। চিঠিতে পাকিস্তানিদের শোষণ ও অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলন গড়ে ওঠার পূর্বাপর ব্যাখ্যা করা হয়।
হাঙ্গেরি রওনা দেওয়ার আগে প্রতিনিধিদলের নেতা আবদুস সামাদ আজাদ জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টসহ বিশ্বশক্তির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা এবং তাঁর মুক্তির আবেদন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বক্তব্য শুনবেন।
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১০ মে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে বলেন, বাংলা-দেশ আন্দোলনকে সারা বিশ্বের মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিভিন্ন দেশও শিগগিরই বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশবাসীকে আশ্বাস দেন, আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। বাংলা-দেশ সরকার বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করবে। তিনি বাংলাদেশের তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে এবং চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে আবেদন জানান।
মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী ভূরুঙ্গামারীর মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে গার্ড অব অনার দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার লোকের সামনে কথা বলতে পারছি, এ আমার গর্ব।’
কলকাতায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, ক্যালকাটা অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্টস এবং বাংলা-দেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতির টালিগঞ্জ শাখার সদস্যরা বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর সঙ্গে দেখা করেন। সমিতির পক্ষ থেকে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে কয়েকটি ব্যবসাকেন্দ্র খুলে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ফিলিপস ইন্ডিয়া লিমিটেডের কারখানা কর্মচারীরা বাংলাদেশ থেকে আসা দুর্গতদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে অর্থসহায়তা করেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী সে অর্থ গ্রহণ করেন।
প্রবাসে বাংলাদেশের সমর্থন
ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করার জন্য ব্রিটেনের শ্রমিক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আবেদন জানায়।
ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অর্থসহায়তা পাঠায়।
টাইম ম্যাগাজিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘পাকিস্তান: অপমান না যুদ্ধ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে ‘ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে অন্য একটি প্রতিবেদন।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বলেন, সশস্ত্র প্রতিরোধ নির্মূল করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে সন্ত্রাস চললেও তা নির্মূল করতে বেশি লাগবে না।
এই দিন কক্সবাজারের পতন ঘটে। হাতিয়ায়ও মুক্তিবাহিনীর ওপর একটি পাকিস্তানি সেনাদল আক্রমণ করার পর দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে রাজশাহীর চারঘাটে পুলিশ স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই দিন কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোর, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ কয়েকটি এলাকায় শান্তি কমিটির শাখা গঠিত হয়।
ভারত বাংলাদেশের পক্ষে
আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকহারে আসা শরণার্থীদের কারণে আসামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হতে পারে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চ্যাটার্জি এদিন কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আসা শরণার্থীদের ত্রাণের জন্য টাকার অভাব হবে না। শরণার্থীদের জন্য ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ওষুধপত্র মঞ্জুর করেছে। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল চালু করা হবে।
পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে এক সভায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দল সিপিএমের নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব নেন। তিনি এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে কোয়ালিশন সরকারের শরিক দলের আন্তরিকতায় সন্দেহ জানান।
কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রাথমিক শিক্ষক ফেডারেশনের সভায় বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের নীরবতার সমালোচনা করে জাতিসংঘকে সচেতন করে তুলতে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্বের শিক্ষকদের প্রতি আবেদন জানানো হয়।
১১ মে ১৯৭১ : মার্কিন সিনেটর কেনেডির আহ্বান শরণার্থীদের সাহায্য দিতে
পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সহিংসতার কাজে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র ব্যবহার করার কথা জানান দেশটির সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। ১১ মে সিনেটে তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি অংশ নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় তাদের জড়িত হওয়া উচিত নয় বললেও সেখানে জড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব মুখ্যত পাকিস্তানের। এ পরিস্থিতির উত্তরণে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারসহ পাকিস্তান ও বিশ্বনেতাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আবেদন জানান।
বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য বিশ্বের প্রতি ভারতের আবেদনে সাড়া দিতেও মার্কিন সিনেটে এডওয়ার্ড কেনেডি অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা অবজ্ঞা করার মতো বিষয় নয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্তব্য আছে। নিরপরাধ লাখ লাখ আর্তমানবের জীবন রক্ষার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি সরকারের। মানবজাতির স্বার্থেই তা পালন করতে হবে।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম এদিন কমন্স সভায় বলেন, পাকিস্তান গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় অত্যন্ত সামান্য। তিনি জানান, ব্রিটিশ সরকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ সমিতির অংশগ্রহণে রাজি। জাতিসংঘের মাধ্যমে এই সমিতি গড়া যেতে পারে।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও পশ্চিমবঙ্গে অবিরাম শরণার্থী আগমনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।
নুরুল আমিনের সাক্ষাৎ ইয়াহিয়ার সঙ্গে
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রবীণ রাজনীতিক নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান করাচি থেকে তাঁর সঙ্গী হন।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ উপদেষ্টা এম এম আহমদ ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেস এ দিন জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে এক তারবার্তায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও ঐক্যের বিরুদ্ধে ভারতের উসকানিমূলক তৎপরতার প্রতিবাদ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরির কাছে প্রতিবাদ পাঠায়। বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সেক্রেটারি হাসান তাল তারবার্তায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক শান্তির নগ্ন বরখেলাপ এবং ভারত ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
এদিন চট্টগ্রামের শুভপুর সেতুর দুই পাড়ে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়।
হাতিয়া দখল করে এই দিন হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
কুমিল্লার মীরগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদলের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র হামলা চালালে তারা বিপর্যস্ত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরে আসেন।
পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল গোপালগঞ্জের মানিকহার গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির চারদিক থেকে ঘিরে হামলা চালায়।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই দিন শান্তি কমিটির ২৫টি ইউনিয়ন শাখা গঠিত হয়।
ভারতের সহমর্মিতা
ভারতের জলন্ধরের পাঞ্জাব কেশরী ও দৈনিক হিন্দ সমাচার পত্রিকা দুটি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে দুটি তহবিল খুলেছিল। পত্রিকা দুটির স্বত্বাধিকারী লালা জগৎ নারায়ণ এ দিন বাংলাদেশ তহবিলের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে এক লাখ টাকার চেক দেন।
পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতের প্রায় দুই লাখ ব্যাংক কর্মচারী ১১ মে বাংলাদেশ দিবস পালন করেন। কলকাতার ব্যাংক কর্মচারীরা অফিসের পর বাংলাদেশের সমর্থনে স্লোগান দিতে দিতে পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের সামনে সমবেত হন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাংক সমিতির পক্ষ থেকে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর হাতে ৮০ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুশীল ঘোষ জানান, নিখিল ভারত ব্যাংক কর্মচারী সমিতির পক্ষ থেকে এক দিনের বেতন দিতে আবেদন করা হয়েছে।
১২ মে ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে আবেদন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তাঁর জীবন রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১২ মে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টসহ বিশ্বনেতাদের কাছে আবেদন জানায়। সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ আবেদনটি প্রচার করেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানান তারা যেন সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে অনুমতি দেয় যাতে বাংলাদেশের বিষয়টি জাতিসংঘে তুলে ধরা যায়।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।
ব্রিটেনের কমন্স সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বিবৃতি দেওয়ার পর কমন্স সভার সদস্য হিকি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যে পৈশাচিক তাণ্ডব চলছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। তিনি বলেন, শুধু ত্রাণসাহায্য নয়, বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও ট্যাংক ব্যবহার করায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই দিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও ট্যাংক ব্যবহার করায় এদিন পাকিস্তানের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিবেদক ঢাকা সফর শেষে খবর দেন, শকুনের দল এত খেয়েছে যে তাদের আর ওড়ার শক্তি নেই। শকুনের দল মার্চ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালির মৃতদেহ খাদ্য হিসেবে পেয়েছে।
পাকিস্তানে ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান জাতিসংঘকে জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বিশেষ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্যের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তারা তা অবশ্যই নেবে, তবে বিতরণ করবে নিজেদের ব্যবস্থাপনায়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিন এদিন পশ্চিম পাকিস্তানে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী শাসন কোনো উপকারে আসবে না।
এই দিন ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, সুনামগঞ্জের কর্তৃত্ব সেনাবাহিনীর আয়ত্তে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে ১২৪ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
পাকিস্তানি সেনারা সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর সেতু দখলের জন্য ট্যাংক ও কামান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে–বিপক্ষে
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এদিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দেশটিতে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পেগভ। তাঁরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের বিষয়ে আলোচনা করেন। কূটনৈতিক মহলের ধারণা, বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়ন কী কূটনীতি অবলম্বন করেছে, পেগভ হয়তো সে সম্বন্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ফিজ রিলসও একই দিনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, সীমান্ত রাজ্যগুলোতে শরণার্থী পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ইন্দিরা গান্ধী ১৬ মে পশ্চিমবঙ্গে যাবেন।
বাংলাদেশ সাহায্য সমিতির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল এই দিন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর হাতে অর্থ তুলে দেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। এর আগে তাঁরা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরাসরি প্রয়োজনীয় রসদ পৌঁছে দিয়েছিলেন।
১৩ মে ১৯৭১ : বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা জাতিসংঘের সামাজিক পরিষদে
জাতিসংঘের বৈষয়িক ও সামাজিক পরিষদের বৈঠকে ১৩ মে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে ভারত বলে, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক অধিকারের সনদ লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি রিটা হাউজার বলেন, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারটি তাদের ঘরোয়া বিষয় বলে যা বোঝাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে একমত নয়।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন আগের দিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, পাকিস্তান সেখানে লাখ লাখ মানুষকে সামরিকভাবে পিষ্ট করছে।
পাকিস্তান এ ব্যাপারে আপত্তি করলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেন, এখানে যেকোনো প্রতিনিধি মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় নিপীড়িতদের প্রতি সবাই সহানুভূতিশীল। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতে আসা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এরই মধ্যে ২৫ লাখ ডলার মঞ্জুর করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকার্যের জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আগের দিন তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। রিটা হাউজার জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিতে পাকিস্তানকে আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ভারতের আবেদনে যুক্তরাষ্ট্র সাড়া দিয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্য দপ্তরের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দেবীপ্রসাদ চ্যাটার্জি বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য ত্রাণ ভারতে পৌঁছায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকলস্কি জানান, পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টন গম মজুত আছে। বন্দর ব্যবস্থা অনুকূল হলেই তা পাকিস্তানে পাঠানো হবে। রবার্ট ম্যাকলস্কি পাকিস্তানের সমালোচনা করে বলেন, আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ বিতরণ করতে পারেনি। পাকিস্তান সরকার না চাইলে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বণ্টন করতে পারে না। দ্রুত ত্রাণ দিতে না পারলে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে বলে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির আশঙ্কার সঙ্গে তিনি সহমত প্রকাশ করেন।
হরিয়ানার রাজ্য সরকার জানায়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তারা ১০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেবে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ত্রাণ কমিশনার বি বি মণ্ডল জানান, বাংলাদেশ থেকে যে হারে শরণার্থী আসছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। এভাবে চলতে থাকলে এই শরণার্থীদের ত্রাণের কাজে আগামী ছয় মাস-এক বছরে কয়েক শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
লন্ডন টাইমস-এ যুক্তরাজ্যের প্রায় ২০০ জন সাংসদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক ব্রিটিশ সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সব রকম সাহায্য বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ত্রাণ দিতেও অনুরোধ জানান।
বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ
বৃহত্তর সিলেটের জৈন্তাপুর ও তামাবিলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। জৈন্তাপুরে দুই দিন ধরেই যুদ্ধ চলছিল। পাকিস্তানি সেনারা তামাবিলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও মুক্তিযোদ্ধারা তা প্রতিহত করেন।
তেলিয়াপাড়ার সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের বাগসাইর গ্রামে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক কনভয় অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৃহত্তর কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকাতেও মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে তিনজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
বরিশালের পূর্ব নবগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের চার সদস্যের একটি ছোট দলকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের তৈরি বোমা দিয়ে আক্রমণ করেন। কয়েকজন গ্রামবাসীও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। যুদ্ধে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং অমূল্য মল্লিক নামের এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ কর্নেল ওসমানীকে
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে পাকিস্তানের সামরিক বিধির আওতায় তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিতে ২০ মের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। অন্যথায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হবে বলে জানানো হয়।
বৃহত্তর সিলেট জেলার কিছু স্থানে শান্তি কমিটির কয়েকটি শাখা গঠিত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দিন বিক্রমপুরের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী দখল করে।
মৌলভীবাজারের হিলালপুরে পাকিস্তানি সেনারা লন্ডনপ্রবাসী মোহাম্মদ উস্তার ও সিরাজুল ইসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে। সারা শহরে মাইকিং করে এই দুজনকে প্রকাশ্যে মনু নদের ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে তারা হত্যা করে। দুজনের লাশ নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।
১৪ মে ১৯৭১ : ইন্দিরার বার্তা বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসে
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে ১৪ মে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা পড়ে শোনানো হয়। সে বার্তায় ইন্দিরা বলেন, ভারত যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, তাতে তার পক্ষে পূর্ববঙ্গের ঘটনাধারার প্রতি উদাসীন থাকা কঠিন। ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যাশা জানিয়ে বলেন, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ মানবিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হবেন। পূর্ববঙ্গে জনসাধারণের দাবি যেহেতু ন্যায্য, তাই তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই যে তাদের দেশ শাসন করবেন, বিশ্বের মানুষ তাদের এই দাবি নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন।
অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা পড়ে শোনান ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য অমৃত নাহার। অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা কৃষ্ণ মেনন বলেন, পূর্ববঙ্গে কোনো গৃহযুদ্ধ চলছে না, সেখানে গুলি চালিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা হচ্ছে।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী এদিন জাতিসংঘের সামাজিক কমিটিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্ন কোনো আন্তর্জাতিক বিরোধ নয়।
ভারতের আরও সমর্থন ও সহযোগিতা
ভারতের মুম্বাইয়ে আদি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়। সভায় নেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসবে। তারা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে সব রকমের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
পিএসপি নেতা সমর গুহ কয়েক দিনের সীমান্ত এলাকা ভ্রমণ শেষে কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এই চরম মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে শরণার্থী সমস্যার গুরুদায়িত্ব ভারতের ওপরই বর্তাবে। এর ফলে বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর তার পরিণাম ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত ভারতে।
১৪ মে কলকাতায় বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ লাইট হাউস সিনেমা হলে প্রমোদ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘নয়া জমানা’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করে। সংগঠনটি জানায়, এই প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রির টাকার সঙ্গে ছবির নির্মাতা নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অর্থ যুক্ত করে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে প্রদান করবেন। সে অর্থের চেক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী তরুণকান্তি ঘোষের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুই দিন আসামের কাছাড় জেলায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের পরিদর্শন করার পর আসামের শিলচরে এই দিন সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রতিনিধিদলের নেতা চার্লস মেস বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলায় ভারতকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা করা হবে।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে ১৪ মে পূর্ব পাকিস্তানের সহকারী সামরিক শাসক নিযুক্ত করা হয়।
যে দল পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাস করে না, তার সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়—এ ঘোষণা দিয়ে কক্সবাজারে চীনপন্থী ন্যাপের আহ্বায়ক মাহমুদুল হক চৌধুরী সে অঞ্চলে ন্যাপের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয়দের সহায়তায় মৌলভীবাজারের কাগাবালা ইউনিয়নের নড়িয়া গ্রামে হিন্দুধর্মাবলম্বী কয়েকজন মানুষকে হত্যা করে।
এদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, বরিশালের বাকাই গ্রাম, কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর পার, চৌদ্দগ্রাম, রাজশাহীর চারঘাট এবং হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের নলুয়া চা-বাগানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধ হয়।
১৫ মে ১৯৭১ : ভাসানীকে নিয়ে কথা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভায় ১৫ মে ভাসানী ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে আলোচনা হয়। সিপিআইএমের সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার বিধানসভায় আগের দিন অভিযোগ করেছিলেন, ভাসানীকে কলকাতার কোথাও অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। তার জবাবে সরকারি দলের নেতা এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, মাওলানা ভাসানী কোথায় আছেন, তিনি তা জানেন না।
মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পর হরেকৃষ্ণ কোঙার বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী ভারতবর্ষের কোথাও মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেছেন। হঠাৎ তাঁকে না পাওয়া গেলে মানুষের এ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে এখানে কোথাও তাঁকে রাখা হয়েছে।
হরেকৃষ্ণ কোঙার পরে অনাস্থা প্রস্তাবের আলোচনায় আবার ভাসানীর প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভাসানী সাহেবের মতো বিশিষ্ট নেতা কোথায় আছেন, সরকার তা জানে না। তাহলে তিনি কি অন্তর্ধান হলেন? এ ঘটনা কি বাংলাদেশের লড়াইয়ে সহায়ক হবে?
হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আলাদা তিনটি অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা অব্যাহত থাকলে গোটা উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতি ব্যাহত হবে।
একটি অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে তারা যেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে না করে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার যাঁরা হচ্ছেন, তাঁরাও মুসলমান।
অন্য দুই অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য ডা. সারওয়ার আলী ও মাহবুব আলী বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তর মুজিবনগর থেকে এক জানায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির জনসংযোগ অফিস চালু করা হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ে এবং ত্রাণ তহবিলে সাহায্য দিতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এখন থেকে এই অফিসে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়।
কলকাতায় বাংলাদেশের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ফুটবল খেলোয়াড় আলী ইমাম জানান, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা প্রথম ডিভিশনের ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি ফুটবল দল গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই দল পশ্চিমবঙ্গের নামী ফুটবল দলের বিরুদ্ধে প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেবে। তাতে যে অর্থ সংগৃহীত হবে, তা মুক্তিযুদ্ধে ব্যয় করা হবে।
পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখার পরামর্শ ব্রিটেনে
পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখার জন্য ব্রিটিশ কমন্স সভায় এদিন বিরোধী দলের সদস্যরা উপর্যুপরি দাবি জানান। বেসরকারি একটি প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কমন্স সভায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রসঙ্গ নিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে আলোচনা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান। প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলের সদস্যদের সঙ্গে সরকারি দলের অধিকাংশ সদস্যও পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে উদ্বেগ জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম আলোচনায় অংশ নিয়ে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। ব্রিটেন পাকিস্তানের জনগণের বর্তমান সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক সমাধান চায়। আর বাইরে থেকে কেউ সেটা চাপিয়ে দিতে পারে না।
প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর ব্যবধান ছিল। বিরোধী লেবার পার্টির সদস্যরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও সরকারপক্ষের সদস্যরা বিপক্ষে ভোট দেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া দরকার বলে সরকারি দলের সদস্যরা স্বীকার করেন।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামের শিলচরে ও ত্রিপুরার আগরতলায় শরণার্থীদের স্বচক্ষে দেখে এসে আগরতলায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার এখন হয়ে উঠেছে ভারতের একটি সমস্যা। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সমস্যা বিশেষ কোনো রাজ্যের ব্যাপার নয়; কেন্দ্রই এর পূর্ণ দায়িত্ব নেবে।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) কলকাতা জেলার উদ্যোগে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ারে আয়োজিত এক জনসভায় বাংলাদেশ এবং এর সরকারকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সব রকম সাহায্যের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিন ঢাকায় বলেন, প্রদেশের সব জায়গা থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ নির্মূল করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সন্ত্রাস চলছে, তা বিচ্ছিন্ন।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য খুলনার আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জনকে নিয়ে আনসারের বিকল্প একটি বাহিনী গঠন করেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের তিনজন এমপিএ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তাঁরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
হবিগঞ্জের ভবানীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের পাতা মাইনে এবং তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে নালুয়া চা-বাগান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি পাকিস্তানি সেনাদলকে অ্যামবুশ করেন। এতে সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকজন হতাহত হয়।
১৬ মে ১৯৭১ : ইয়াহিয়াকে চ্যালেঞ্জ মাওলানা ভাসানীর
ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির (ন্যাপ) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের দাবি সম্পর্কে কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকলে তাঁরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে গণভোট করে দেখতে পারেন। বাংলার শতকরা ৯৯ জনের বেশি মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাবেন। ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ মে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মাওলানা ভাসানী এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি রাশিয়া ও চীনসহ সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে ইয়াহিয়া সরকারের স্বৈরাচারের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশের যেসব এলাকা সরকারের আওতায় ছিল সেসব জায়গায় বাংলাদেশ সরকার তার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, নওগাঁয় তিনটি পুলিশি থানা চালু করা হয়েছে। সেখানে কাজ চালানোর জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা, তিনজন করে ইন্সপেক্টর, সাব–ইন্সপেক্টর, সুবেদার ও কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি অঞ্চলে থানা স্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ সরকার এই দিন থেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক মানুষের জন্য যুব শিবির কর্মসূচি চালু করে।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতে
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত অন্য দেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্ত এলাকা থেকে শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে স্থানান্তরের ব্যবস্থা হচ্ছে। ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। সমস্যা বিরাট। বিদেশ থেকেও সাহায্য প্রয়োজন, কিন্তু যা আসছে তা পর্যাপ্ত নয়।
ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলেই শরণার্থীরা ফিরে যাবেন। তবে সেটা কবে সম্ভব হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর পুনায় বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ক্রমাগত শরণার্থী আসতে থাকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
কলকাতা সাহিত্য আলোচনা কেন্দ্র বাংলাদেশের সাহায্যার্থে কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোস্টেলে এক মুশেয়ারার আয়োজন করে। মুশেয়ারার উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান, সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত উর্দু কবি সাজ্জাদ জহির। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কাইফি আজমী, ফিরাক গোরকপুরী ও প্রীতিশ নন্দী এতে যোগ দেন। উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের সাহায্যে তাঁরা ২৫ হাজার টাকা দেবেন।
বাংলাদেশের সাহায্যার্থে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে কলকাতায় এই দিন সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিটি প্রদর্শিত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
ঢাকায় ৫৫ জন অধ্যাপক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিক ১৬ মে একটি যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, মার্চ মাসে দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ চলছিল। নির্বাচনে জনগণের কাছ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ম্যান্ডেট পেয়ে চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিতে পর্যবসিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এ সময় শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে অপব্যবহার করা হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার বাঙালিদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক তখনই চরমপন্থীরা জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলল। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিবৃতিদাতারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও নিন্দা প্রকাশ করেন।
একটি পাকিস্তানি সেনাদল এই দিন সকালে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীশো গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামে মিলিটারি আসার খবরে আতঙ্কিত জনগণ জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল। সেনারা লুকিয়ে থাকা লোকদের ধরে যোগীশো প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে হত্যা করে।
পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল রাজশাহীর বোয়ালমারী স্টেশনের কাছে হাসামদিয়া গ্রামে ১৩ জন সংখ্যালঘুকে হত্যা করে। পরে একে একে রামদিয়া, পোয়াইল, ময়েনদিয়া, শ্রীনগর ও রাজাপুর গ্রামেরও আরও ২০ জনকে হত্যা করে।
১৭ মে ১৯৭১ : ছয় মাসের মধ্যে ফিরে যাবে শরণার্থীরা, ভারতের প্রত্যাশা
ভারতে সফররত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য টমাস জামিসন ১৭ মে দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার ছয় মাসের সাহায্য চেয়েছে। ভারত সরকারের বিশ্বাস, ছয় মাসের মধ্যে শরণার্থীদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
শরণার্থী বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দিল্লিতে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বৈঠকে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ভারত ছয়
মাসের জন্য সাহায্য চেয়েছে। তবে কিসের ভিত্তিতে ভারত ছয় মাসের মধ্যে সমস্যাটি মোকাবিলা করবে, সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে ভারত জানায়, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের (আপাতত সংখ্যা ৩০ লাখ ধরে) ছয় মাস পর্যন্ত সাহায্য দিতে ২০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এই দিন জাতিসংঘের সামাজিক কমিটির বৈঠকে বলেন, ভারতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর সমস্যা কেবল ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা ভবনে শরণার্থী সমস্যা এবং ত্রাণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভার সাবকমিটির জরুরি বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর জন্য একটি চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। দ্রুত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার জন্য রাজ্যের তিনজন মন্ত্রী ২০ মে দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় জানান, শরণার্থীদের নিয়ে ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভাবছে।
নরওয়ে রেডক্রসের প্রতিনিধি ফারে ওটারসন কলকাতায় জানান, আহত ও পীড়িত শরণার্থীদের চিকিৎসায় সহায়তার জন্য নরওয়ে থেকে একদল চিকিৎসক ও নার্স শিগগির পশ্চিমবঙ্গে আসবেন।
ভারতের লক্ষ্ণৌতে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে জনমত তৈরির লক্ষ্যে আগামী ৮ জুন সংখ্যালঘুদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য কে ডি মালব্যকে সভাপতি এবং নব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাফরকে সাধারণ সম্পাদক করে কনভেনশনের জন্য একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়।
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প এদিন দেশটির সংসদে জানান, ভারতের হাইকমিশনার অশোক লালকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সহায়তা করতে কানাডা প্রস্তুত।
পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অটো উইনজার বার্লিনে বলেন, ভারতের হাইকমিশনার জি সি আজমানি পূর্ব জার্মানির সরকারের কাছে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য সাহায্য ও সমর্থন চেয়ে অনুরোধ জানালে তিনি তাঁকে এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁরা শরণার্থীদের সব রকম মানবিক সাহায্য দিতে প্রস্তুত।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও বিশেষ দূত জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে পাকিস্তানের ভাষ্য জানান। তিনি জাতিসংঘের কাছে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্যের পাশাপাশি সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জলযান চেয়েছেন।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন এক ঘোষণায় অনুপ্রবেশকারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে সহযোগিতা করতে জনসাধারণের প্রতি নির্দেশ জারি করে।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন উপসামরিক কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেন। এই ক্ষমতাবলে তাঁরা যেকোনো ব্যক্তিকে আটক করে হাজতে পাঠানো, গ্রেপ্তারসহ অপরাধের তদন্ত করতে পারবেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত কোনো আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মেজর জেনারেল (অব.) ওমরাহ খান এদিন ঢাকায় একাধিক ঘরোয়া সভায় বলেন, দেশে এখন দুটি দল—পাকিস্তানপন্থী আর পাকিস্তানবিরোধী। পাকিস্তানবিরোধীদের খুঁজে বের করতে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার আবেদন জানান তিনি। গোলাম আযম, খাজা খয়েরুদ্দিন ও মেজর (অব.) আফসার উদ্দিন প্রমুখ সভায় বক্তৃতা করেন।
১৮ মে ১৯৭১ : বাংলাদেশের প্রতিবাদ পাকিস্তানের অপপ্রচারে
পাকিস্তানের অব্যাহত মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদে ১৮ মে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়। সরকারের তথ্য বিভাগ বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে চলমান ব্যাপক জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দমন করার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছে বলে পাকিস্তান অপপ্রচার চালাচ্ছে। সে অপপ্রচারের ভিত্তিতে বিদেশের কিছু সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানায়।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগ ১৮ মে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অপপ্রচার বিশ্ববাসী বিশ্বাস করেনি। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় অসত্য ভাষণের আশ্রয় নিয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিকৃতভাবে প্রচার করার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নৃশংস আচরণে বাংলাদেশে অন্তত ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ৩০ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়েছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বিদেশি সাংবাদিকেরা ঘুরে এসে এমন কোনো কথা বলেননি যে বাঙালিরা জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছিল। অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেদিকেই গেছে সেদিকেই বাঙালিদের হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের কাজে তারা অবাঙালিদের লেলিয়ে দিয়েছে।
আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ সরকার জানায়, পাকিস্তানের সামরিক চক্র তাদের গণহত্যার পাপ ঢাকার জন্য বিদেশে বলছে যে বাংলাদেশে অবাঙালি মুসলমানদের হত্যা করার কারণেই সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে। এটা মিথ্যাচার। ২৬ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় যে ৪০ জন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন, তাঁরা এমন ঘটনা দেখেননি।
পাকিস্তান বৌদ্ধ পরিষদের সভাপতি জ্যোতিপাল মহাথেরোর নেতৃত্বে পাঁচজন বৌদ্ধ নেতা এক আবেদনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে। অধিকাংশ বৌদ্ধমঠ ধ্বংস এবং কুমিল্লায় ছয়জন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে খুন করা হয়েছে। আবেদনে তাঁরা গণহত্যার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর সহানুভূতি প্রার্থনা করেন।
আমেরিকা ও ইউরোপ
পাকিস্তান প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ফ্রাঙ্ক চার্চ বলেন, নিরপেক্ষ থাকতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে। দেশটির সিনেটে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়ী নেতাদের হত্যা এবং পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয় নয় বলে পাকিস্তান সামরিক সরকার যে যুক্তি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত তা বাতিল করে দেওয়া।
জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটির বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩০ লাখ শরণার্থীর যাওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সরবরাহ করছে না বলে ভারতের উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তবু মানবিক কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
আগা শাহী এই দিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান জে উইলিয়াম ফুলব্রাইটকে এক চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে জনতা লুটতরাজ এবং নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করতে থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরুপায় হয়ে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়।
সুইডেনের স্টকহোম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ডিজেনস নাইটার ১৮ মে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানকে সব রকমের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার আবেদন জানায়। ‘পাকিস্তান ও আমাদের সাহায্য’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানে আর আইনের শাসন নেই। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা বাইরের সাহায্য নিয়ে হত্যা চালাচ্ছে এবং আর্তদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছে। সেই দেশকে সুইডেনের সাহায্যদান অব্যাহত রাখার অর্থ কী?
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারতের ওপর কোনো পরিস্থিতি পাকিস্তান চাপিয়ে দিলে তাঁরা
তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ভারতে শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান হার এ অঞ্চলের শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে উঠছে। এটি অব্যাহত থাকলে ভারত তার জাতীয় স্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
পূর্ববঙ্গে সবকিছু স্বাভাবিক বলে পাকিস্তানের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তা হয়ে থাকলে ভারত থেকে সব শরণার্থীকে পাকিস্তানের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত।
পিটিআই এদিন এক খবরে জানায়, ভারত পশ্চিমা শক্তিগুলোকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে নির্দিষ্ট কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, শিগগির তা ভাবতে হবে। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ভারতের সামাজিক পরিস্থিতির ওপরও এর গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তান ভারতকে চরম বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। কোনো দেশেরই এরূপ করার অধিকার নেই। পরিস্থিতি না বদলালে ভারতকে নির্দিষ্ট পথের কথা ভাবতে হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মচারীদের পত্নী সমিতি দিল্লিতে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটিকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার একটি চেক প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের স্ত্রী উর্মিলা হাকসার চেকটি পদ্মজা নাইডুর হাতে দেন।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ ও পাকিস্তান
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকট পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সংকট। আমলাতন্ত্রে এর সমাধান নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরে আরও বিলম্ব হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এই দিন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় তাঁর এ মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তর বলতে ভুট্টো শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই ক্ষমতা হস্তান্তর বুঝিয়েছেন।
পাকিস্তান সরকার এই দিন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি, পুলিশের আইজি, বিভাগীয় কমিশনার, বেশ কয়েকজন জেলা প্রশাসক ও এসপিসহ প্রাদেশিক সরকারের পদস্থ কিছু কর্মকর্তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে। আর তাদের জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়।
১৯ মে ১৯৭১ : উ থান্টের আবেদন শরণার্থীদের সাহায্যার্থে
জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট ১৯ মে নিউইয়র্কে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে শরণার্থী ভারতে উপস্থিত হওয়ায় জাতিসংঘ খুবই চিন্তিত। এখনো নারী-শিশুসহ দলে দলে শরণার্থী ভারতে আসছে। তাদের আশু সাহায্য প্রয়োজন। উ থান্ট শরণার্থীদের শিগগিরই নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা জানিয়ে বলেন, তার আগপর্যন্ত আপৎকালীন ভিত্তিতে ব্যাপক বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘের সমস্ত সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তারা এই মর্মন্তুদ পরিস্থিতিতে মানবকল্যাণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানাচ্ছে।
ব্রিটিশ কমন্স সভায় বিরোধী দলের সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান নিজ দল লেবার পার্টির এক বৈঠকে বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই যুদ্ধ চালানোর জন্য পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে লাভ হবে না। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে যত দ্রুত এই সত্য উপলব্ধি করাতে পারবে, ততই লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পাবে।
জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক আশাহি শিম্বুন এই দিন পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে কিছুদিন আগে হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের জের এখনো মেটেনি। এখন চলছে সেনাবাহিনীর অত্যাচার। সামনে বর্ষা; দুর্ভিক্ষ, মহামারি অনিবার্য। এ অবস্থাতেও বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে জাতিসংঘ ও রেডক্রসের প্রস্তাব কেন পাকিস্তান অগ্রাহ্য করল, সবার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে।
মিসরে সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কায়রোয় এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আরবদের শুভার্থী হিসেবে ভারত আশা করে এই রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে কার্যক্রম
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সংবিধান ও সংসদবিষয়ক পঠন সংস্থা দেশটির বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ সাবেক বহির্বিষয়ক মন্ত্রী এম সি চাগলা, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেনন, দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল শীতলাবাদ ও সি কে দফতরি এবং এল এম সিংভির লেখা নিয়ে বাংলাদেশের ওপর একটি বই প্রকাশ করে। লেখকেরা বলেন, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
কলকাতা গ্রামোফোন কোম্পানি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘বাংলা আমার বাংলা’ নামে দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশ করে। একটিতে সলিল চৌধুরী রচিত তিনটি গান গেয়েছেন মান্না দে, সবিতা চৌধুরী ও সহশিল্পীরা। অন্য রেকর্ডটি রবীন্দ্রসংগীতের। দুটি গান ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গেয়েছেন মান্না দে। শিল্পীরা এই রেকর্ডের রয়্যালটির টাকা স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা এদিন কলকাতায় এক বৈঠকে মিলিত হয়ে উপাচার্য কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করেন। বৈঠকে সাত বিশ্ববিদ্যালয়—কলকাতা, যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী, কল্যাণী, বিশ্বভারতী, বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের শিক্ষকদের পশ্চিমবঙ্গে পরিদর্শক শিক্ষক হিসেবে সাময়িকভাবে নিয়োগের ব্যাপারটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়।
২০ মে ১৯৭১ : সৈয়দ নজরুলঃ প্রবাসী সরকারই জাতীয় সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২০ মে বলেন, প্রবাসী সরকারই বাংলাদেশের জাতীয় সরকার। বাংলাদেশের জনগণ ৯৮ শতাংশ ভোট দিয়ে যে দলকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁরাই সেখানকার জাতীয় দল। সুতরাং আওয়ামী লীগের বাইরে আর কাউকে নিয়ে সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, সরকার তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে যে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সেটা সরকারেরও কথা।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, যে যুদ্ধ চলছে, তা ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম ইসলামসহ সব ধর্মের মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করার; শোষণমুক্ত, সুষম ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের। বাংলাদেশকে যাঁরা মাতৃভূমি বলে মানেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তাঁদের ধর্ম যা–ই হোক, তাঁরা ভাই।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সোবহান এই দিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে অন্তত আড়াই লাখ লোক নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী যাদের হত্যা করেছে এবং করছে,
তাদের বেশির ভাগই নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষ। সেনারা অনেক গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা নাপাম বোমা ব্যবহার করছে।
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ খান ও সাধারণ সম্পাদক নজমুল হক নান্নু এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বজনমত ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা কেন? বিবৃতিতে তাঁরা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘের কাছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার আবেদন জানান।
উপমহাদেশের বাইরে
জাতিসংঘ মহাসচিবের আবেদনে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে পাঁচ লাখ ডলার দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস বে ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও দূত এম এম আহমেদকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান নতুন কোনো চুক্তি হবে না। পাকিস্তান তার উন্নয়ন পরিকল্পনা সংশোধন না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের নতুন আর কোনো চুক্তি করবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে মিসর সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দেশটির প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন, কিন্তু সাদাত তাঁকে সাক্ষাৎ দেননি। দুই দিনের চেষ্টার পরও সাক্ষাৎ না পেয়ে কায়রো থেকে তিনি ইতালির উদ্দেশে রওনা হন।
ভারতে মানুষের সহায়তা
বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ২০ মে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী জি এম সাদিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দুই লাখ টাকার চেক পাঠান। চেকের সঙ্গে এক চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের সামান্য প্রতীক হিসেবে এ অর্থ পাঠানো হলো।
পশ্চিমবঙ্গে আশ্রিত শরণার্থীদের বিষয়ে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী তরুণকান্তি ঘোষের নেতৃত্বে চার মন্ত্রীর একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা রাজ্য সরকারের বক্তব্য পেশ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর সাম্প্রতিক সীমান্ত এলাকা সফরের বিবরণ দেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সেন জানান, সমিতির পক্ষ থেকে বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন শ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ দ্য ট্রুথ নামে একটি সচিত্র বই পাঠানো হয়েছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং লাখ লাখ নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকাণ্ডের সচিত্র তথ্য বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনটিতে বনগাঁ সীমান্ত লঙ্ঘন করে আবার ভারতীয় এলাকায় গোলা ছুড়লে দুজন সীমান্তরক্ষী আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরের বালুরহাট সীমান্তে ভারতীয় এলাকাতেও এই দিন গোলাবর্ষণ করে।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হাতবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ আরেক ঘোষণায় ১ জুলাইয়ের মধ্যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাজে যোগ দেওয়ার এবং ২ আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু করার নির্দেশ দেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ও তাদের অবাঙালি সহযোগীরা খুলনার ডুমুরিয়ায় চুকনগর বাজারে সমবেত বহু হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করে। সেখানে এই দিন ১০–১২ হাজার মানুষ নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা পাকিস্তানিদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ভারতে যাওয়ার লক্ষ্যে চুকনগরে সমবেত হয়েছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল দেশীয়দের সহায়তায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গালিমপুর গ্রামেও শিশু–কিশোরসহ ৩০–৩২ জন হিন্দুধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে। এরপর তাদের কাছ থেকে সোনা, টাকাসহ অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। শেষে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা গ্রামের দুজন নারীকেও জিম্মি করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দলের আক্রমণে এদিন নলুয়া চা–বাগানে ২০ জন নিরীহ চা–শ্রমিক নিহত হন।
পাকিস্তানি সেনারা এই দিন কুষ্টিয়ার বল্লভপুর মিশনারি গির্জা লুট করে ঘাঁটিতে ফেরার সময় তাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২১ মে ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাইল বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলা-দেশের রাষ্ট্রপতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানিয়ে ২১ মে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), যুক্তরাজ্য ও ভারত এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ আহ্বান করা হয়। বাংলা-দেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সরকারের পক্ষে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে তাঁরা স্থির নিশ্চিত।
বাংলা-দেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেওয়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা এই দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে বৈঠকে বসে বাংলা-দেশ শিক্ষক সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এর সভাপতি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। সমিতির লক্ষ্য বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের একত্র করে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং জনমত গড়ে তোলাসহ শরণার্থী শিক্ষকদের সাময়িক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বাংলা-দেশের কয়েক শ শিক্ষক সভায় যোগ দেন।
ভারতে স্বাধীন বাংলা-দেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান হোসেন আলী এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য করা জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের আবেদনই বাংলা-দেশের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রমাণ। বাংলা-দেশ পাকিস্তানি সেনামুক্ত হলেই শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবে।
বাংলা-দেশে অবরুদ্ধ ও পাকিস্তান
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশত্যাগ করা মানুষের প্রচারণায় কান না দিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরুর জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের পূর্বাংশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আগের দিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তাঁর দৃঢ় ধারণা, দেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। যাঁরা মনে করেন পাকিস্তানের দুই অংশেই একসঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত, তিনি তাঁদের সঙ্গে একমত নন।
দলের সহসভাপতি মাহমুদ আলী কাসুরি বলেন, যাঁরা বিদ্রোহ করেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যরা এখনো জাতীয় পরিষদের সদস্য। ক্ষমতা হস্তান্তর কেবল কেন্দ্রেই হতে পারে। প্রদেশের দায়িত্ব শুধু ক্ষমতায় অংশগ্রহণ।
ঢাকায় নিয়োজিত চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শালদানদী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাদ্য ও রসদবাহী একটি রেলওয়ে ট্রলির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
কুমিল্লার দক্ষিণে গৌরীপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের ওপর ঝটিকা আক্রমণ করলে সেনাদলটির বেশ ক্ষতি হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল এই দিন কুমিল্লার দেবীদ্বার থানা আক্রমণ করে। এ অভিযানে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।
ব্রিটিশ সাহায্য শরণার্থীদের জন্য
ব্রিটিশ সরকার ভারতে আশ্রয় নেওয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় মুদ্রার সমপরিমাণ সাহায্যের কথা ঘোষণা করে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব এদিনের আগের বুধবার যে আবেদন জানিয়েছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে এই সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের সাহায্যের প্রয়োজনের কথা বলেন। এ ছাড়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানান। জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি একই বৈঠকে দেওয়া বক্তৃতায় পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং নারী-শিশুসহ বহু শরণার্থী ভারতে গিয়েছে।
বাংলা-দেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে বাংলা-দেশের ঘটনাবলি তুলে ধরেন।
২২ মে ১৯৭১ : মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন সীমান্ত গান্ধী
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলা-দেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য পাখতুন নেতা সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। সীমান্ত গান্ধীর বিবৃতির অনুলিপি ২২ মে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সাংবাদিকদের কাছে বিলি করা হয়।
আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দেওয়া বিবৃতিতে সীমান্ত গান্ধী বলেন, পাকিস্তান সরকারকে তিনি জানিয়েছিলেন, তারা দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চাইলে শেখ মুজিব ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া করার জন্য মধ্যস্থতা করতে তিনি রাজি আছেন। কিন্তু পাকিস্তানের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি তিনি।
সীমান্ত গান্ধী বলেন, পাকিস্তান ধ্বংস হলে তা হবে ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের ভুল নীতির জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের অপরাধ হলো, তারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। ৬ দফা যদি পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে বিপজ্জনকই হয়, তাহলে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কেন গোড়াতেই এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেনি? তিনি আরও বলেন, বাঙালিরা প্রকৃত মুসলমান। তাদের চেষ্টাতেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন দেশ ভাঙতে চাইবে?
সীমান্ত গান্ধী বলেন, পাকিস্তান সব সময়ই ধর্মের নামে হঠকারিতা করেছে। অযথা বলপ্রয়োগে পরিস্থিতির সুরাহা হবে না। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ভ্রান্ত ও মিথ্যা প্রচার বন্ধ করতে পাঞ্জাবের পুঁজিপতি ও সমর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার কথা জানান তিনি।
বাংলা-দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে এই দিন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বাংলা-দেশের বুদ্ধিজীবীরা বাংলা-দেশ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ নামে নতুন একটি সংগঠন গঠন করেন। এর সভাপতি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক। কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা হলেন সৈয়দ আলী আহসান, খান সারওয়ার মুরশিদ, কামরুল হাসান, রণেশ দাশগুপ্ত, জহির রায়হান, ব্রজেন দাস, মুস্তাফা মনোয়ার, ফয়েজ আহমদ, ওয়াহিদুল হক, মওদুদ আহমদ, অনুপম সেন প্রমুখ।
বাংলা-দেশে অবরুদ্ধ
জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মিয়া তোফায়েল নতুন করে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন দাবি করে একটি বিবৃতি দেন।
শরীয়তপুরে একটি পাকিস্তানি সেনাদল বেশ কিছু গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে নির্বিচার বহু মানুষকে হত্যা করে।
পিরোজপুরে মঠবাড়িয়ার হিন্দু-অধ্যুষিত ভিমনালি গ্রামে এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় সহযোগীরা আক্রমণ করে ১৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং ব্যাপক লুটতরাজ চালায়।
ভারতে বাংলা-দেশের পক্ষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন দিল্লিতে বলেন, পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই। তবে পূর্ব বাংলার চলমান ঘটনায় ভারতের বিশেষ উদ্বেগের কারণ ঘটছে। ভারত পূর্ব বাংলায় এমন অবস্থা চায়, যাতে শরণার্থীরা সেখানে ফিরে নিরাপদ বোধ করে এবং নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম আসামের করিমগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় দুটি এবং হলদিবাড়ীতে একটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। এরপর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পাকিস্তান ভারতীয় এলাকায় গোলাগুলি করতে থাকলে ভারতের পক্ষে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা সম্ভব হবে না। এ সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
দিল্লিতে জনসংঘ তাদের সংসদীয় দলের সভায় বাংলা-দেশ নিয়ে লোকসভায় জানায়, বাংলা-দেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সরকারকে তারা নিন্দা জানাবে। জনসংঘ দলের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়িকে এ ব্যাপারে অন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার ভার দেওয়া হয়।
২৩ মে ১৯৭১ : ভারতের হতাশা আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ২৩ মে দিল্লিতে বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আসতে থাকায় ভারতকে এক গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। শরণার্থীদের চাপ লাঘব করতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে না আসায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শুধু দু-একটি দেশ যৎসামান্য সাহায্য করেছে, তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার চাকুলিয়া এবং চব্বিশ পরগনার পেট্রাপোল সীমান্তে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। এরপর সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ব বাংলার মানুষদের ওপর যে অত্যাচার করছে, তা কলঙ্কজনক। এ বর্বরতা বন্ধের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কর্তব্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনার পর সাংবাদিকদের আরও বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে এখনো বহু শরণার্থী আসছে। মানবতার কারণে ভারতের পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব নয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর এদিন কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলা-দেশি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের আবেদনের পর রাষ্ট্রগুলোর ঔদাসীন্যে ভারত হতাশ ও মর্মাহত।
বাংলা-দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দিল্লিতে সর্বভারতীয় কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ে ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি অব ইন্ডিয়া ফর সলিডারিটি উইথ বাংলা-দেশ নামে একটি ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়। কমিটি গঠনের সভায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। ১৪ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সভাপতি হন ড. মৈত্রেয়ী বসু। সর্বসম্মতভাবে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, ১২ জুন সারা ভারতে বাংলা-দেশ দিবস পালন করা হবে।
বাংলা-দেশে অবরুদ্ধ
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে। চলমান বিশৃঙ্খলার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না।
ইয়াহিয়া খান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান। এ অভ্যুত্থান দেশের পূর্বাংশে অহেতুক দুর্দশা সৃষ্টি করেছে। সেখানে দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছে।
ইয়াহিয়া আরও বলেন, ৬ দফা পাকিস্তানের আদর্শের বিরোধী। পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলা-দেশ করা নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা ছিল এই নয়া নামকরণের অন্তরালে বাংলা-দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। তিনি ২৪টি দিন একটি পাল্টা সরকার পরিচালনা করেছেন।
ইয়াহিয়া আরও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট দুঃখিত হয়েছেন, তবে তিনি সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এ দিন খবর বের হয়, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, খান আবদুল কাইয়ুম খান এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলা-দেশের স্বাধীনতাবিরোধী তিন মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা চলছে।
ইপিআরের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লাতুতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় প্রাণভয়ে স্থানীয় মানুষ একটি মসজিদে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি সেনারা মসজিদে গিয়ে ১৭ জনকে টেনে বের করে এনে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি সবাই শহীদ হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দিন রংপুর সেনানিবাসের পেছনে নিসবেতগঞ্জ হাটে প্রায় ৫০ জন এবং নড়াইলের লোহাগড়ার ইতনা গ্রামে প্রায় ৩৯ জনকে হত্যা করে। ইতনা গ্রামে তারা বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়।
২৪ মে ১৯৭১ : ভারতের লোকসভায় বিতর্ক বাংলা-দেশ নিয়ে
ভারতের লোকসভায় ২৪ মে বাংলা-দেশের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক হয়। বিতর্কের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিবৃতি দেন। এ ছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রপাল সিং লোকসভা সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা তাদের কার্যকলাপে প্রতিবেশীদের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব এবং শান্তি ও মানবতার মৌল নীতিগুলো ধ্বংস করেছে। সমরতন্ত্র বাংলা-দেশ সমস্যার সমাধান নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। এ ব্যাপারে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব আছে। রাজনৈতিক সমাধানে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা যথাযথভাবে শক্তি প্রয়োগ করলেই কেবল উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি আসা সম্ভব।
ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা দেন, বিশ্ব যদি এই সমস্যার সমাধানে কিছু না করে, তাহলে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য ভারতই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, আপ্রাণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভারত সব শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারেনি। অনেকেই এখনো খোলা জায়গায় আছে। প্রতিদিন ৬০ হাজার করে শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসছে। এরা নানা ধর্ম, স্তরের ও বয়সের লোক। অনেকেই আহত। বাংলা-দেশে এমন অবস্থা ফিরে আসা দরকার, যাতে সব শরণার্থী নিজ নিজ বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারে। এ জন্য তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। এ অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি আসবে না। ভারতের ক্ষতি করে পাকিস্তানে এ সমস্যার সমাধান আসবে না।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের দুষ্কর্মের দায় ভারতের ওপর চাপাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান যাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করেছে, তা ভারতেরও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ নাগরিককে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? ভারতকে আরও অনেক বেশি বোঝা বহন করতে হতে পারে। এটি জাতীয় সমস্যা, কিন্তু মূল সমস্যাটি আন্তর্জাতিক। ভারত বিশ্ববিবেক জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের কাছেও আবেদন জানিয়েছে।
শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এই দিন ভারতের রেল কর্মচারীরা তাঁদের এক দিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় জানানো হয়, তাঁরা আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা দেবেন।
বাংলা-দেশে অবরুদ্ধ
পাকিস্তানি সেনারা ঝালকাঠির দৈহারীতে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চাঁদগাজীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন
বাংলা-দেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান জানান, মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়ে যাঁরা অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন, সরকার তাঁদের পুনবার্সনে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে।
ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে বাংলা-দেশের তিন সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল দিল্লিতে লোকসভার স্পিকার জি এম ধীলনের সঙ্গে দেখা করেন। অন্য দুজন ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য নূরজাহান মুরশিদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সসদ্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।
সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলা-দেশের প্রচারণার কাজে এই দিন লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রওনা দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত এনামুল হক তাঁর সফরসঙ্গী হন।
লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফণীভূষণ মজুমদার জানান, বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ এবং বাংলা-দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষকে জানাতে তাঁরা দিল্লি এসেছেন। তিনি জানান, তাঁরা সংসদ সদস্য এবং বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলা-দেশের ঘটনাবলি তাঁদের জানাবেন।
বাংলা-দেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী ভূরুঙ্গামারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেন। তিনি অধিনায়কদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
২৫ মে ১৯৭১ : আবার সম্প্রচার শুরু স্বাধীন বাংলা বেতারের
বাংলা-দেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে ২৫ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক বা দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রচার শুরু হয়। কলকাতার বালিগঞ্জের একটি দোতলা ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বেতার কেন্দ্রের দপ্তর ও স্টুডিও। কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয় সীমান্তবর্তী একটি গোপন স্থানে।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে এর প্রথম পর্যায়ের সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ২৬ মার্চ। ৩০ মার্চ কালুরঘাটে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণের পর এ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে আরও কিছুদিন এর সম্প্রচার চলে।
দিল্লি সফররত বাংলা-দেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ২৩ মেতে দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। ইয়াহিয়া খান সেদিন বলেছিলেন, ছয় দফা পাকিস্তানের আদর্শের বিরোধী। প্রতিনিধিদলের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ইয়াহিয়ার বক্তব্য গ্রাহ্য করি না। বাংলা-দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলা-দেশ সার্বভৌম।’
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরে নোঙর করা এসএল কুইলারা নামে একটি ব্রিটিশ জাহাজের বাঙালি নাবিক আমির আহমেদ জাহাজ থেকে নেমে ভারতে আশ্রয় নেন। জাহাজে আমির আহমেদ ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। আমির আহমেদ জলে ঝাঁপ দিয়ে চিৎকার করতে থাকলে বন্দরের লোকেরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
বাংলা-দেশে অবরুদ্ধ ও পাকিস্তান’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভায় দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তান। ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পি কে আচার্যকে দেওয়া এক চিঠিতে পাকিস্তান বলে, কোনো প্ররোচনা ছাড়াই ইন্দিরা গান্ধী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চান।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক এবং পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের সভাপতি আবদুল মালিককে এক বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা করা হয়। মালিক কিছুদিন আগে লাহোরে এক বক্তৃতায় ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে এই দিন বিবৃতি দেন।
পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মে রাতে রংপুর জেলা শহরের গুপ্তপাড়া এবং তার আশপাশ থেকে প্রায় ৫০ জনকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এই দিন সকাল সাতটার দিকে শ দুয়েক পাকিস্তানি সেনা ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ের ঢালুবাজারে ঢুকে ঘণ্টাখানেক নির্বিচার গুলি চালায়। এ আকস্মিক আক্রমণে ২২ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। তাঁদের মধ্যে নয়জন ছিলেন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য।
আসামের করিমগঞ্জের সুতারকান্দিতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণেও কয়েকজন আহত হন।
গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের
নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু গেরিলা হামলা চালান। নরসিংদীতে তাঁদের হামলায় স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মজিদ নিহত হন। পার্বতীপুর-জয়পুরহাট রেলপথের পাঁচবিবি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করলে রেলের ইঞ্জিন ও বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড হামলায় রাজশাহী শহরে পাওয়ার হাউসের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দল শালদানদীতে অতর্কিত আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন হতাহত হয়।
২৬ মে ১৯৭১ : যুদ্ধদিনে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে স্মরণ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১১ জ্যৈষ্ঠ ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭২তম জন্মজয়ন্তী। প্রবাসী বাংলা-দেশ সরকার কবির জন্মদিন যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করে। কলকাতায় বাংলা-দেশ মিশনের সামনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলা-দেশে পাকিস্তানের শাসক চক্রকে উৎখাতের সংকল্প প্রকাশ করা হয়। এর আগে সকালে কলকাতার বাংলা-দেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী কবিভবনে গিয়ে কবির গলায় মালা পরিয়ে দেন এবং তাঁর সহধর্মিণী কবিকে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সন্ধ্যায় বাংলা-দেশ সরকারের পক্ষ থেকে কবিকে পুষ্পমাল্য পরানো হয়। বাংলা-দেশের বহু লেখক, কবি ও সাংবাদিক কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে কবিভবনে যান।
পশ্চিমবঙ্গ নজরুল একাডেমির সহায়তায় বাংলা-দেশ মিশনের সামনে সকালে কবিকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শুরু হয় গণনাট্য সংস্থার শিল্পীদের গাওয়া ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ দিয়ে। শেষ হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ দিয়ে, পরিবেশন করেন সন্জীদা খাতুন। এ গান পরিবেশনের সময় সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। অনুষ্ঠানে বাংলা-দেশের সাহিত্যিক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
ভারতে বাংলা-দেশের পক্ষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিন লোকসভায় বাংলা-দেশের পরিস্থিতি ও ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ সম্পর্কে বলেন, বাংলা-দেশে যে ভয়ংকর পরিস্থিতি চলছে, তাতে বিশ্বের সব দেশকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব না নিলে পরিণাম বিপর্যয়কর হবে। ওই দেশের জনসাধারণের একেবারে বেঁচে থাকার সমস্যাই দেখা দিয়েছে। ঠান্ডা মাথায় সেখানে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। নারী, বৃদ্ধ, শিশু—কেউই রেহাই পাচ্ছে না।
ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ঘটনাটি ভারত ও সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তির জন্য বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি নিতে তাঁর সরকার ভীত নয়। সরকার এই সমস্যাকে বাংলা-দেশের স্বার্থের দিক থেকে বিবেচনা করে দেখছে। বাংলা-দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করে দেখা হচ্ছে।
ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা দিল্লিতে সাংবাদিকদের জানান, তিন দিন ধরে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার ফলে গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সংযত না হলে গুরুতর পরিণাম ঘটতে পারে।
ব্রিটেনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়ার অন ওয়ান্টের দুজন প্রতিনিধি জন হরগান ও রেভারেন্ড ব্রুসকেন্ট সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে কলকাতায় ফিরে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে আসার আগে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য তাঁরা অনুমতি চাইলেও সরকার অনুমতি দেয়নি।
উপমহাদেশের বাইরে
জাতিসংঘের এক মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর তাণ্ডবে যারা শরণার্থী হয়েছে, তাদের সবাইকেই সাহায্য দিতে যুক্তরাষ্ট্র রাজি আছে। কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সাহায্য দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহির মধ্যে গতকাল আলোচনা হয়েছে।
ব্রিটেনের কেন্টের ক্রিকেট মাঠে এই দিন পাকিস্তান ক্রিকেট দল এবং কেন্ট ক্রিকেট দলের মধ্যে তিন দিনব্যাপী খেলার প্রথম দিনের খেলা শুরু হওয়ার পর ৫০-৬০ জন প্রবাসী বাঙালি প্ল্যাকার্ড হাতে খেলার মাঠে নীরব বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা দর্শকদের মধ্যে প্রচারপত্রও বিলি করেন। প্রতিবাদকারীদের এক নেতা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গণহত্যা বন্ধে ব্রিটেনের মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁদের এই প্রতিবাদ। পরে কয়েকজন প্রতিবাদকারী মাঠে ঢুকে সাইট স্ক্রিনের সামনে দিয়ে সার বেঁধে হেঁটে যান। এ সময় কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ থাকে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলা-দেশে
করাচির চীনা কনস্যুলেট জেনারেল নিয়েই কুন চি বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামে চীন সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন জানাবে। বৈদেশিক আক্রমণ এবং হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় চীন পাকিস্তানিদের পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
একটি পাকিস্তানি সেনাদল ২৬ মে দুপরে স্থানীয়দের সহায়তায় সিলেট জেলার ওসমানীনগরের বুরুঙ্গা এবং তার আশপাশের এলাকার মানুষদের বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে সমবেত করে। সেখান থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আলাদা করে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। সেখানে বেঁচে যাওয়া শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর মতে, ৯৪ জনের মতো মানুষকে সেদিন হত্যা করা হয়।
একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘির পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আকস্মিক আক্রমণ করলে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় এই দিন পাকিস্তানের সহযোগী ও খুলনার সাবেক এমপিএ আবদুল হামিদ এবং বাগেরহাটের মুসলিম লীগ নেতা আবদুস সাত্তার নিহত হন।
২৭ মে ১৯৭১ : অবকাশ নেই রাজনৈতিক আপসের
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত আওয়ামী লীগের একটি বক্তব্য ২৭ মে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূতের প্রস্তাবিত একটি ফর্মুলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন মুখপাত্রের বিবৃতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগ বলে, বাংলা-দেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এ নিয়ে নতুন কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। নতুন কোনো আপসের চেষ্টা হলে বাংলাদেশের মানুষ তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই দিন মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানায়। দলের এক বৈঠকে নেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব দেশপ্রেমী শক্তির সমন্বয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলা উচিত। ফ্রন্টের কর্মসূচি থাকবে ন্যূনতম।
কমিটি আরও কয়েকটি প্রস্তাব নেয়। একটি প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। আরেক প্রস্তাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের ভূমিকায় বিস্ময় ও মর্মাহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে তারা।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক কামারুজ্জামান আনন্দবাজার পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে জানান, বাংলাদেশ থেকে ভারতে
আসা শিক্ষকেরা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে বিদ্যালয় চালাবেন। সমিতি ওই বিদ্যালয়ে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পে ১ হাজার ৫০০ শিক্ষককে নিয়োগ এবং তাঁদের ভাতা দেওয়া হবে।
উপমহাদেশের বাইরে
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীসংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের মানুষ ও ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত পক্ষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য নিজ দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি ওয়াশিংটনে বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে ভারত আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে খ্রিষ্টধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিংস ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহামের বিবরণ প্রকাশ করে।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
দিল্লির স্থানীয় সরকারি মহল থেকে জানা যায়, পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ ফয়সালার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (তৎকালীন), ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানকে চাপ দিতে শুরু করেছে। এর মূলে রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজধানীতে ভারতীয় কূটনীতিকদের তৎপরতা, উপমহাদেশে গুরুতর পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর এবং পূর্ব বাংলার সামরিক পরিস্থিতি। তবে যুক্তরাজ্য আলাদা একটি অবস্থান নিয়েছে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ৫১ নম্বর সামরিক বিধির আওতায় আপত্তিকর বইপত্র, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদি সামরিক দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অমান্য করলে শাস্তি হবে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদানদীর সিঅ্যান্ডবি রাস্তার ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ ও একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
সাতক্ষীরায় ভেড়ামারা বাঁধে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল দুবার আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। দিনব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বেশ ক্ষতি হয়।
কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৮ মে ১৯৭১ : ভিত্তিতে আপস নয় অখণ্ড পাকিস্তানের
বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর অখণ্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে আপস করা আর সম্ভব নয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের কবলমুক্ত হতে বাংলাদেশের ছয় মাস লাগতে পারে, আবার তার বেশিও লেগে যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবেই। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে চিরদিন বেঁধে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিলেন। তাঁদের তিনি এ কথা জানান।
আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানকে জাতিসংঘের সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে তিনি জাতিসংঘকে সতর্ক করেন।
আরও সমর্থন ভারতে
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পৌর করপোরেশন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের স্মরণে সার্কাস অ্যাভিনিউর নাম বাংলাদেশ শহীদ সরণি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। করপোরেশনের অধিবেশনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া মেয়রের ত্রাণ তহবিল থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ভারতের মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত এলাকায় অবিলম্বে ৫০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। ২৪ পরগনা ও নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে সোসাইটি পরিচালিত ১২টি শরণার্থীশিবির ও লঙ্গরখানায় প্রায় আড়াই লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল।
বাংলাদেশের শরণার্থীশিবির ঘুরে কলকাতায় এদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য মাইকেল বার্নস বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহার করা না হলে তারা যেন পাকিস্তানে সব সাহায্য বন্ধ রাখে। সেখানে যা ঘটছে তা মোটেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থী-সমস্যার সমাধান শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই সম্ভব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে যুক্তরাজ্যের জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধীকে রিচার্ড নিক্সন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ২৮ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটা চিঠি লেখেন। তাতে জানান, পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজি করাতে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ইয়াহিয়া খানকে লেখা চিঠিতে বলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি সমর্থন করেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি হেমডিক ফ্যানডং কুষ্টিয়া সফর শেষে ফিরে রিপোর্টে লেখেন, ‘শহরটি যেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বোমায় ধ্বস্ত জার্মান শহরগুলোর মতো।’
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
একটি পাকিস্তানি সেনাদল ভূরুঙ্গামারীতে তীব্র আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এই দিন এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা আসাম সীমান্তের গোলকগঞ্জের সোনাহাট সীমান্তসংলগ্ন মুক্ত এলাকা সোনাহাট এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ সীমান্তে আশ্রয় নেন।
বরিশালের হিন্দুপ্রধান এলাকা কলসকাঠিতে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে। শ খানেক পাকিস্তানি সেনা দুটি লঞ্চে করে এসে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এরপর বাড়ি বাড়ি থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বী পুরুষদের কলসকাঠি বন্দরে একত্র করে প্রায় ৮৭ জনকে হত্যা করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে মনোহরপুর এলাকায় অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আক্রান্ত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা এর আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। পাকিস্তানি সেনারা তখন মনোহরপুর ও পাশের মাগুরা গ্রামে আগুন দেয়।
২৮ মে সকালে একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার দক্ষিণে রাজারমার দীঘিতে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ করে একটি বাংকার উড়িয়ে দেয়। এ অভিযানে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
২৯ মে ১৯৭১ : বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, বললেন তাজউদ্দীন
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৯ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার করার আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয় নিয়েই উভয় সরকারের মধ্যে কথা হতে পারে, অন্য কোনো বিষয়ে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক চিঠিতে সতর্ক করে বলেন, পুরো উপমহাদেশ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। অন্তত ৩৫ লাখ শরণার্থী পূর্ব বাংলা থেকে এরই মধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর চিঠিতে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী এদিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের কাছে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎকারের বিবরণ পেশ করেন। সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
পাকিস্তান ও ভারত
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ২৯ মে দিল্লিতে বলেন, অসংখ্য বাঙালি যখন দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে ঘরোয়া বিষয় বলে দেখাতে চাইছে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ খুবই দুঃখজনকভাবে বাঙালিদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রয়াসী হয়েছে।
ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর এদিন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনপ্রধান হোসেন আলীর কাছে এক লাখ টাকার একটি চেক দেন।
যেসব পূর্ব পাকিস্তানি হুমকিতে বা চাপে পড়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে আহ্বান জানান পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় পিপলস পার্টিই এখন দেশের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। পিপিপি শিগগিরই উভয় অংশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব তাদেরই ওপর অর্পিত হয়েছে।
ভুট্টো আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুদ্ধে ভারতীয় ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভারতীয়দের হাতে পাকিস্তানিরা মার খাচ্ছে। তাদের রক্ষা করা পাকিস্তানের কর্তব্য।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পুনর্বিন্যাসে এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। বাকি সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহর আলী, এ এফ এম আবদুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আবদুল বারী, ড. মকবুল হোসেন ও ড. সাইফউদ্দিন জোয়ারদার এবং জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর পরিচালক ড. হাসানুজ্জামান।
পটুয়াখালীতে জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল বরগুনা জেলখানায় বন্দী ৫৫ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার উত্তরে রঘুরামপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহলরত দলকে অ্যামবুশ করে। দলটির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা সালদা নদীর পশ্চিম শিবপুর, বাজরা ও সাগরতলায় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের মেজর দুররানি নিহত এবং বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানিদের কিছু প্রতিরক্ষা বাংকারও ধ্বংস হয়। লাকসামে মুক্তিযোদ্ধারা রেল যোগাযোগের ক্ষতিসাধন করেন। এ ছাড়া তাঁরা সদর থানার ভাটপাড়া এবং সিঙ্গারবিল এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করেন।
এ ছাড়া এই দিনে আরও কয়েকটি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা হামলা চালান। বৃহত্তর চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা একটি পেট্রলপাম্পে গেরিলা হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করেন। উত্তরবঙ্গের নওগাঁর হরতকীডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে করতোয়া নদীর সেতু ভেঙে দিয়ে অগ্রবর্তী পাকিস্তানি বাহিনী দলকে অমরখানায় আটকে দেন এবং তেঁতুলিয়া থানা মুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
৩০ মে ১৯৭১ : ‘ইয়াহিয়া খানের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়’
বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান বলে পাকিস্তানের করাচিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দেওয়া বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ৩০ মে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় যে মতৈক্য হয়, ইয়াহিয়া খান তা ঘোষণা করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এর বদলে তিনি বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। তাঁর কথা তাই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কামারুজ্জামান বলেন, ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। তাদের সরকারকে প্রশ্ন বা বিচার করার অধিকার মানুষ তাদের দেয়নি।
বাংলাদেশের সমর্থনে
ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এর আগের দিন তিনি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে ফিরে এই সভায় যোগ দেন।
সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালিদের সংগঠন ও কর্মতৎপরতার কথাও উল্লেখ করেন। শ্রোতারা ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
সুইডেনের সব রাজনৈতিক দল যুক্তভাবে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে।
ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকার জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে বাংলাদেশকে সহায়তার আবেদন জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা করতে পারেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ কয়েক প্রভাবশালী সিনেটর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাঁদের সমর্থন ঘোষণা করে এদিন সিনেটে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সাহায্যসম্পর্কিত কমিটিও এই দিন পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলোতে কলেরা রোগ মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সচেষ্ট হচ্ছে।
গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আর আর দিবাকর পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ সীমান্তে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান বিভিন্ন স্থানে
এই দিন মুক্তিবাহিনী বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চৌদ্দগ্রাম-মিয়ারবাজার সড়কে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকিস্তান সেবাহিনীর ২৭ জনের একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। এ অভিযানে তিনজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল কুমিল্লার গোমতী বাঁধের ওপর থেকে বিবিবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আঘাত হানে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর একটি মর্টার প্লাটুন সিঙ্গারবিলের অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের জন্য অভ্যর্থনা শিবির খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার করে বলে, বাংলাদেশ সরকার এবং এর সামরিক হাইকমান্ডের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এরা অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।
পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ৩০ মে দ্বিতীয় দিনের মতো বরগুনা জেলখানায় বন্দী ১৭ জন বাঙালিকে হত্যা করে।
৩১ মে ১৯৭১ : জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ ভারতের
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে সরকারের নীতিনির্ধারণী রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা সভায় বসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং পর্যালোচনায় বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতার ফলে এশিয়া মহাদেশের এই অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। যেকোনো অঞ্চলে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা থাকলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো সদস্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকতে পারে।
পর্যালোচনা সভায় পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র—এই চার দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দেশগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পঞ্চম স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র চীনকে ভারত স্বীকার করে না।
বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় তার প্রতিকারে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন, ১০ লাখ কলেরার টিকা প্রভৃতি পাঠায়। কলকাতার ওষুধের ডিপোগুলোতেও নানা ধরনের ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়।
পশ্চিমবঙ্গের পৌর সংস্থার কাউন্সিলররা মিছিল করে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি জানান। মেয়র শ্যামসুন্দর গুপ্তের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় পৌর ভবন থেকে মিছিল রওনা হয়। রাজভবনে এলে রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান তাঁদের বক্তব্য শোনেন। বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবিতে ২৬ মে পৌর করপোরেশনের বিশেষ অধিবেশনে নেওয়া প্রস্তাবের প্রতিলিপি মেয়র রাজ্যপালের হাতে তুলে দেন।
শ্রীলঙ্কার সংসদে তামিল ফেডারেল পার্টির সদস্য ভি ধর্মালিঙ্গন একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সররকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
এম এইচ উইহেনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের আট সদস্যের প্রতিনিধিদলের ছয়জন পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশে ওয়াশিংটন থেকে রওনা দেন। দলটি পাঠানো হয় পাকিস্তান সাহায্যগোষ্ঠীর পক্ষে পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা সমীক্ষা করে দেখার উদ্দেশ্যে।
‘যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে মীমাংসা সম্ভব নয়’
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান মাওলানা ভাসানী ৩১ মে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা বা মীমাংসা সম্ভব নয়। হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু। তিনি বলেন, কয়েকটি রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছেন, তাতে সময় নষ্ট করলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি।
চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, আলবেনিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করে মাওলানা ভাসানী বলেন, দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলছে না। ভিয়েতনামের জন্য বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন করেছে, কিন্তু তারাও নিশ্চুপ।
মাওলানা ভাসানী আরও বলেন, বর্তমান যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র আমজাদুল হক বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, এরপর যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে আর কোনো আপসরফার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর বাইরে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো অবকাশ নেই। কেউ সে রকমের চেষ্টা করলে তা অগ্রাহ্য করা হবে। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে যে হত্যালীলা চালিয়েছে, তারপর যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোনো আপস অসম্ভব।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, রাজনৈতিক সমস্যার উত্তম সমাধানের জন্য দরকার রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এবং জনগণের আস্থাভাজন রাজনীতিক। তাই দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর জরুরি। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব যে ভুল করেছেন, আমি তা করব না।’
সাতজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল এই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা রেলস্টেশনে অতর্কিতে হানা দিলে দুজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুটি নামে গ্রামেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনাদলের একজন চালক নিহত এবং একটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য আরেকটি দল সিঙ্গাবিলে অ্যাম্বুশ করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেনা নিহত হন।
৩১ মে রাতে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার দক্ষিণে জগমোহনপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হন।
আরও দেখুনঃ