বিংশ শতাব্দী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ যুগ। এই শতাব্দীটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং তার পরবর্তী উন্নয়ন—এই শতাব্দীটি বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলির সাক্ষী।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ
১. ব্রিটিশ শাসন এবং স্বাধীনতার আন্দোলন
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশ ভারতে একটি প্রদেশ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অংশ হয়ে ওঠে। এই সময়ে, বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের জন্য ভাষার অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দাবি জোরালো হতে শুরু করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই আন্দোলনের ফলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ইতিহাস আমাদের মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে প্রতি বছর উদযাপন করা হয়।
২. মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই ভাষণ দেশের মানুষের মধ্যে এক বিপ্লবী ভাবনা ও সংকল্প সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চ রাতে, পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় অভিযান শুরু করে, যা ‘Operation Searchlight’ নামে পরিচিত। এই হামলা ও subsequent যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও তীব্র হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘ এক মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয় এবং একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৩. স্বাধীনতার পরবর্তী বছর
স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে দেশটি একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। শুরুতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকট ছিল তীব্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আবার বৃদ্ধি পায়।

৪. গণতন্ত্র এবং সামরিক শাসন
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তার প্রশাসনের অধীনে, বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই সময়ে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তন শুরু হয়। বাংলাদেশ শিল্প, শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি লাভ করে।
এদিকে, সামরিক শাসনের অভ্যুত্থানও ঘটে। ১৯৮২ সালে, জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে।
৫. অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন
১৯৯০-এর দশক থেকে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়। রপ্তানি ভিত্তিক শিল্প, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময়কালে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতেও উন্নতি হয়। বাল্য বিবাহ, মাতৃমৃত্যু হার, এবং শিশু মৃত্যুহার কমাতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৬. সাম্প্রতিক বছর এবং ভবিষ্যৎ
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও স্থিতিশীল হতে শুরু করে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে, কিন্তু ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, বাংলাদেশ উন্নয়নমূলক প্রকল্প ও সামাজিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হয়েছে।
বিগত দশকে, বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে। এই সময়ে, দেশটির অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল সেবার প্রসার, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলকতা বেড়েছে। বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিংশ শতাব্দী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী সময় ছিল। এটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি উজ্জ্বল ছবি প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, রাজনৈতিক সংগ্রাম, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মিশ্রণ বাংলাদেশের ইতিহাসকে বৈচিত্র্যময় ও গৌরবময় করেছে। ভবিষ্যতে, বাংলাদেশের জন্য উত্তরণ এবং সমৃদ্ধির পথে এই শতাব্দীর অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।
আরও দেখুনঃ