নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১০ নভেম্বর – ফেনীর বিরাট এলাকা মুক্ত
ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ফেনীর বিলোনিয়া অঞ্চলের পরশুরামের বিরাট এলাকা ১০ নভেম্বর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের বিলোনিয়ায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা গোটা এলাকাটি মুক্ত করতে নভেম্বরের শুরু থেকে আক্রমণ বাড়িয়ে দেন। ৭ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনারাও তীব্র পাল্টা আক্রমণ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তাদের জবাব দিতে থাকেন। ৮ থেকে ১০ নভেম্বর দুই পক্ষে কয়েকবার মুখোমুখি যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানিরা অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে চারটি জেট দিয়ে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে পাকিস্তানিদের দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে হটিয়ে দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এ সময় এগিয়ে আসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের তৃতীয় ডোগরা রেজিমেন্ট।
তারা ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঘণ্টার মধ্যে পরশুরামের বিরাট এলাকা দখল করে নেন।
দুই কর্মকর্তাসহ ৭২ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে এককভাবে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
এ যুদ্ধে হতাহত হয় ১৫০ জনের মতো পাকিস্তানি। মুক্তিবাহিনীরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা এ দিন ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে জানান, মুক্তিবাহিনী গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের সাতটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
ঢাকার কাছের মধুপুর জঙ্গল এবং দক্ষিণে সুন্দরবন এলাকা তাদের দখলে রয়েছে।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা অঞ্চলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গ্রিন রোডে রেডিও পাকিস্তানের উপপ্রধান প্রকৌশলীর অফিসে অভিযান চালায়।
তাদের গুলিতে রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্রের আঞ্চলিক প্রকৌশলী বজলে হালিম নিহত এবং দুজন আঞ্চলিক প্রকৌশলী আহত হয়।
ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দলের একটি হলিক্রস কলেজের ভেতরে এবং আরেকটি আজিমপুর গার্লস স্কুলের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পাট করপোরেশনের পাটগুদামে আগুন ধরিয়ে দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের চৌগাছার হাজীপুরে রেঞ্জারস ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করেন। পাল্টাপাল্টি যুদ্ধে কয়েকজন রেঞ্জারস ও রাজাকার হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হন।কলকাতার একটি কূটনৈতিক মিশনের একজন কনসাল জেনারেল এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, সূর্যাস্তের পর ঢাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ওই কনসাল জেনারেল কিছুদিন আগে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা গিয়ে তিন দিন অবস্থানের পর কলম্বো হয়ে ৯ নভেম্বর কলকাতা ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে কোনো বাড়িতে তিনি মানুষ দেখতে পাননি। সেখানে একটি হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে বলেন, সামরিক বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
ইন্দিরা-উইলি ব্রান্ট সাক্ষাৎ
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে বিদেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ দিন তিন দিনের সফরে পশ্চিম জার্মানিতে পৌঁছেই দেশটির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
তাঁরা একমত হন যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
ইন্দিরা গান্ধী উইলি ব্রান্টকে বলেন, ভারতের নিরাপত্তায় শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। উইলি ব্রান্ট ভারতের প্রতি তাঁর দেশের সহানুভূতির আশ্বাস দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, জাতিসংঘ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান বের করতে পারলে ভারত স্বাগত জানাবে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন রাতে পাকিস্তানে ব্রিটিশ অস্ত্র রপ্তানির কথা অস্বীকার করেন।
যুক্তরাজ্যের কিছু পত্রিকায় খবর বেরোয়, গত কয়েক মাসে দেশটি থেকে বিমান, ট্যাংক ও কামান ইত্যাদি পাকিস্তানে গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খবরটি ভিত্তিহীন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভেঙ্কর ১০ নভেম্বর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল আন্দ্রে গ্রেচকোর সঙ্গে আলোচনা করেন।
আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উদ্ভূত যুদ্ধের হুমকি নিয়েই তাঁরা আলোচনা করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে, সে সংকটে তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য ভারত পাবে।
সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মী আলী আহমদ ৯ নভেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি চৌ এন লাইকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন না করতে অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, পূর্ববঙ্গবাসী এ ব্যাপারে চীন ও অন্য সমাজতন্ত্রী দেশের সমর্থন কামনা করে।
ভুট্টোর মন্তব্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে জনসভায় বলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধলে তা শুধু এই দুই দেশের সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি এবং চৌ এন লাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পাকিস্তানকে তাঁরা পুরো সহযোগিতা করবেন।
১১ নভেম্বর – বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে বিচলিত পশ্চিম জার্মানি

পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ১১ নভেম্বর বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও স্থায়িত্বের জন্য বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
এরপরই ভারত থেকে শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন। পশ্চিম জার্মানি সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে দুই দিনের আলোচনার পর এই বক্তব্য দেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে পশ্চিম জার্মানি গভীরভাবে বিচলিত বোধ করছে বলেও উল্লেখ করেন উইলি ব্রান্ট।
একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, জাতিসংঘের উদ্যোগে শরণার্থী ত্রাণে তাঁর দেশ আরও অর্থসহায়তা দেবে।
উপমহাদেশের ঘটনাবলিতে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিম জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে এদিন এক ঘোষণায় বলা হয়, এখনো সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তারা সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এ বিষয়ে চিঠি লিখেছেন।
বন থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর সংবাদদাতা নরম্যান ক্রসল্যান্ডের পাঠানো খবরে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর অনমনীয় মনোভাব থেকে বোঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানায়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওয়াশিংটনের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, পাঁচ হাজার টন অস্ত্রবোঝাই কিছু রুশ জাহাজ ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
৩ নভেম্বর দিল্লিতে অবতরণ করা রুশ পরিবহন বিমানেও ছিল অস্ত্রশস্ত্রের জন্য যন্ত্রাংশ। এর আগেও ১০টি রুশ পরিবহন বিমান দিল্লিতে নামে।
বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ১১ নভেম্বর মুজিবনগরে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের নীতি ও কাঠামো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হবে স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজবাদী রাষ্ট্র।
কলকাতার সল্টলেকে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর আয়োজিত এক শরণার্থী সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা আশা প্রকাশ করেন, সেদিন আর বেশি দেরি নেই, যেদিন শরণার্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
ঢাকায় সফল গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন অবরুদ্ধ ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় অভিযান চালান। তাঁরা সেখানে অবস্থানরত একদল পাকিস্তানি সেনার কাছাকাছি বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
অভিযানে অংশ নেন রাইসুল ইসলাম আসাদসহ কয়েকজন। লুই অ্যান্ড ডুসেলডর্ফ প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর বাড়ি (সিদ্ধেশ্বরী) থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গাড়ি সংগ্রহ করেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় অভিযানের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয়বার গেরিলারা গাড়ি পার্ক করেন বায়তুল মোকাররমের ফ্যান্সি হাউসের সামনে।
সেখানে ছয়জন পাকিস্তানি সেনা কলা কিনছিল। ফ্যান্সি হাউসের ভেতরে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের মেজর ফতেহ মোহাম্মদ মালিকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের লোকজন কেনাকাটা করছিল।
গাড়িটি পার্ক করার পর আসাদ ছাড়া বাকি সবাই নেমে যান। এরপর আসাদ সিগারেট খাওয়ার ভান করে গাড়ির ভেতরে রাখা টাইম বোমার সেফটি ফিউজ জ্বালিয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে যান। দেড় মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সমস্ত এলাকা।
এ অভিযানে তিন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন হতাহত হয়। একজন আহত নারীকে কোলে নিয়ে মেজর ফতেহর ফ্যান্সি হাউস থেকে বেরিয়ে আসার ছবি পরদিন ঢাকার পত্রিকায় ছাপা হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে বলা হয়, বোমা বিস্ফোরণের পর শহরের দোকানপাট ও অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়।
খবরে আরও বলা হয়, গত মার্চে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ছয় হাজার পুলিশের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ স্পষ্ট।
২ নম্বর সেক্টরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা এদিন রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি অবস্থানে আক্রমণ চালান। পরদিন পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা, রেঞ্জার্স ও রাজাকার মিলে ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ হন। একজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন রাতে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে পাহারারত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গোলাবর্ষণ করলে চারজন আহত হয়।
তাদের পাল্টা আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে দামুড়হুদার রঘুনাথপুরে নদীর ঘাটে মাইন পেতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি হতাহত হয়।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবকে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কথা জানান।
লাহোরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে ঢোকার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হয়। তবে তাঁর গায়ে গুলি লাগেনি।
১২ নভেম্বর – প্রচারণার বিরুদ্ধে ভাসানীর চিঠি

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১২ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত) কাছে লেখা এক চিঠিতে ভারত তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছে বলে যে প্রচার চলছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা নিরাপদ বলে মনে করছেন না। চিঠিতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের নিঃস্বার্থ সহায়তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের এই সময় এসে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন করায় চীনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির সমর্থক এবং মাওলানা ভাসানীর কিছুসংখ্যক চীনপন্থী অনুসারী ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রচার শুরু করে। তারা বলে, বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করাই ভারতের উদ্দেশ্য। এই প্রচারণায় তারা ভাসানীর নাম ব্যবহার করে বলে, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি রোধ করতে ভারত ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছে। এ পটভূমিতে ভাসানী চিঠিটি লেখেন।
পাকিস্তানকে চীনের পরামর্শ
দ্য টাইমসকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, চীন পাকিস্তানকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। চীন বলেছে, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ করা উচিত নয়; ব্যাপারটি নিরাপত্তা পরিষদে তোলারও এটা উপযুক্ত সময় নয়। লন্ডনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হোমের আলোচনায় উপমহাদেশের সমস্যাটি বিশদভাবে আলোচিত হয়।
পশ্চিম জার্মানি সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বনে এই দিন এক ভোজসভায় বলেন, পাকিস্তান এবার ভারত আক্রমণ করলে তাসখন্দ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। ১৯৬৫ সালে অধিকৃত কাশ্মীর এলাকা থেকে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলেও তাসখন্দ চুক্তি মেনে ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি।
পশ্চিম জার্মানির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভারতের আগে বা অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। ভারতও যথাসময়ে স্বীকৃতি দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহার্স্টের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় পরিকল্পনা নিয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের একটি দল ১২ নভেম্বর রাতে একটি কাপড়ের কল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে পাকিস্তানিদের সহযোগী চাঁদ মিয়া সরদার নামে একজন নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে এ দিন বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বড় একটি যুদ্ধ হয় যশোরের চৌগাছা ও মাসলিয়ার মাঝখানে। বয়রা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ভারতের ১ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলস এতে সহায়তা করে। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা থেকে সরে গেলে এলাকাটি পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার কৃষ্ণপুর ঘাটে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
প্রতাপপুর ঘাটে তৃতীয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
চতুর্থ যুদ্ধ হয় জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আক্রমণ করেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলা তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়।
মেহেরপুরের ধর্মদহে হয় পঞ্চম যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের ধর্মদহ অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় প্রায় ৫০ জন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন কয়েকজন এবং তিনজন বন্দী হন।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ষষ্ঠ যুদ্ধে গেরিলারা পাকিস্তানিদের অবস্থানে হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৭ জন হতাহত হয়। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। আলমডাঙ্গায় আরেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর একজন রেঞ্জার, কয়েকজন রাজাকার এবং একজন পুলিশ নিহত হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ দিন জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে সিটি অব সেন্ট আলবানস নামে যুক্তরাজ্যের একটি মালবাহী জাহাজ গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশুর নদে ঢোকার মুখে জাহাজটি গোলার মুখে পড়ে। প্রায় ৪০টি আঘাতের চিহ্ন নিয়ে জাহাজটি কলকাতায় ফিরে যায়।
১০ নভেম্বর ওই জাহাজ কলকাতা থেকে চালনা বন্দরের দিকে রওনা হয়ে সেদিনই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে। বন্দরের ছয় মাইল দূরে রাত সাড়ে ১২টায় হঠাৎ দুই দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর দুটি গানবোট এসে গোলাবর্ষণ শুরু করে। জাহাজটি গভীর সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ এদিন রাজস্থান ও পাঞ্জাবের অগ্রবর্তী গোলন্দাজ ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক জনসভায় বলেন, সংসদের শূন্য আসন পূরণের জন্য উপনির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রভাবিত সরকার গঠন করার প্রচেষ্টা তিনি মেনে নেবেন না। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে ৪০ দিনের মধ্যে সে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
১৩ নভেম্বর – যুদ্ধ ছাড়া সমাধানে ইন্দিরার সংশয়
তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর শেষে ১৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শুধু কোনো প্রস্তাব গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করতে পারেন। শেখ মুজিবকে আলোচনায় ডাকা না হলে বাংলাদেশের নেতারা ইয়াহিয়ার সঙ্গে আদৌ কথা বলবেন কি না, তাতে সন্দেহ আছে।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদিও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা বলেছে, তবু তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান আমেরিকার অস্ত্র পাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
ভারতের আসাম রাজে৵র মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ ও শরণার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে স্বার্থসিদ্ধির মতলব আঁটছে স্বার্থান্বেষীরা। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে দেরি হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ দিন প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববঙ্গে যে ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র না দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অতি সামান্য পদক্ষেপ। সেই অস্ত্রে বাঙালিদের ওপর চালানো অত্যাচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও দায়ী।
মাইন বিস্ফোরণে কূটনীতিক নিহত
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের (২ নম্বর সেক্টরের অধীন) একটি দল এ দিন ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর যান চলাচলে বাধা দিতে সোনারগাঁয়ের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মাইন পুঁতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরণে ঢাকার পশ্চিম জার্মান কনস্যুলেটের একজন কূটনীতিক এবং একজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এই সেক্টরে সালদা নদী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরের খানপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপিসিএফ) সেনাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে খানপুর সীমান্তঘাঁটি দখল করেন। অভিযানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে এসে সীমান্তঘাঁটি দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এই সেক্টরের হিলির ভারতীয় অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারাও তার পাল্টা জবাব দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম প্রহরে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোস৴ রেজিমেন্টের প্রায় এক কোম্পানি সেনাসহ রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর আহত হন। তারপরও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই যুদ্ধে ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটি মুক্ত হয়। যু্দ্ধে প্রায় ২০ জন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনায় পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলায় দর্শনা রেলস্টেশনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে
যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণসংক্রান্ত কর্মকর্তারা এদিন ঢাকায় বার্তা সংস্থা এপির প্রতিনিধির কাছে বলেন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এই প্রথম মাইন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যবাহী এই জাহাজে জাতিসংঘের পতাকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ ডলার মূলে৵র খাদ্য নষ্ট হতে বসেছে।
ঢাকা থেকে এ দিন দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনায়ত্ত এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি মনে করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্টের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করে তিনি এ দিন নিউইয়র্কে রওনা হন।
পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগীদের নিয়ে গড়া একটি বিরাট বাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটি৴র সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তান পিপলস পাটি৴র চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগের চেষ্টা না করা হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্য পূর্ব পাকিস্তানের।
১৪ নভেম্বর – ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানের হুমকির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়। মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুপস্থিতিতে দেশে সংঘটিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করতে পশ্চিমা নেতারা কতটা সাফল্য পাবেন, সে ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে।
বৈঠকটি নিয়ে দ্য টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটির সভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করানোর জন্য ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে বিশ্বনেতাদের কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত।
তাঁরা ব্যর্থ হলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ভারতের পক্ষে অসংগত হবে না। ইন্দিরার বক্তব্যে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংকটের অবসান নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।
আগামী সপ্তাহের মধ্যে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। তবে এর আগে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে এক আলোচনা সভায় বলেন, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ভারতে ঘুরে গিয়েছেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে নিরাপত্তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ হয়েছে। ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এন এম পেগোভও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
নিক্সনের নতুন উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তান আকস্মিক সংঘর্ষের শঙ্কা আছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ।
এ দিনের নিউজউইক ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনারা মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলার সংখ্যা এক লাখ।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ১৪ নভেম্বর এক ঘোষণায় জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের সব জেলাতেই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সংযোগ ধ্বংস করে ঢাকা ও কুমিল্লার সঙ্গে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করাই মুক্তিবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। ফেনী, সালদা নদী, নয়নপুর এবং খুলনা জেলার কিছু এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
ঢাকায় পাকিস্তানিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা উত্তরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে রাতে ঢাকা-আরিচা সড়কের ধামরাইয়ের ভায়াডুবি সড়কসেতু ধ্বংস করেন।
রাতের অন্ধকারে রেজাউল করিম মানিকসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর প্রতীক) অন্য গেরিলাযোদ্ধারা নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছান।
তাঁদের আক্রমণে দু-তিনজন নিহত হওয়ার পর বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
গেরিলাযোদ্ধারা তখন সেতু ধ্বংসের কাজ শুরু করেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয় সেখানে এসে তাদের আক্রমণ করে।
প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যেই রেজাউল করিম মানিকসহ কয়েকজন সেতুটি ধ্বংসের কাজ শেষ করেন।
এরপর তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া মর্টারের স্প্লিন্টার তাঁর গায়ে আঘাত করলে তিনি শহীদ হন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সহযোদ্ধারা মানিকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এলে তাঁর মা-বাবা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।
রেজাউল করিম মানিক ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এই সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান ডকইয়াডে৴ অভিযান চালায়। তাঁদের ছোড়া বোমায় ভাসমান ডকইয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে সুনামগঞ্জে একটি সড়কসেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা নদীঘাটের ফেরি ধ্বংস করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ তখন ফেরি দিয়ে নদী পার হচ্ছিল। বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। ফেরিটি ডুবে যায়।
৬ নম্বর সেক্টরের ভূরুঙ্গামারী এলাকার একাংশ এদিন মুক্ত হয়।
এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভূরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানিদের একটি অগ্রবর্তী অবস্থানে আক্রমণ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা খবর নিয়ে জানতে পারেন, কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং শুকনো খাবার ফেলে পাকিস্তানি সেনারা রাতের অন্ধকারে ওই অবস্থান থেকে পালিয়ে গেছে। ভূরুঙ্গামারীর পাশে জয়মনির হাটের একাংশ এ দিন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
১৫ নভেম্বর – ভারত হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৫ নভেম্বর দিল্লিতে বলেন, দ্রুত বা ক্রোধবশত বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত। বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি মাত্রই কথা বলে এসেছেন। সমস্যার বিভিন্ন দিক এবং বিপদের আশঙ্কা তিনি তাঁদের বুঝিয়ে বলেছেন।
এদিন সকালে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ইন্দিরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমেও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাঁর বিদেশ সফরে দেশগুলো বাংলাদেশ সংকট আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদীয় দলের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সব উপায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ সময়ে দেশে ঐকে৵র প্রয়োজন খুব বেশি।
সংসদে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সাম্প্রতিক সফর নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কোনো দেশের নেই। বহু দেশই বুঝেছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের আইনসংগত ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের না করে অন্যদের সমস্যার মীমাংসা করতে গেলে লাভ হবে না। তাঁরা বুঝেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা সেটি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বোঝাতেও চান।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতির সন্তোষজনক সমাধান এবং শরণার্থীর দেশে না ফেরা পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ভারত তার সেনা সরাবে না। ভারত আক্রান্ত হলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানেরই মাটিতে। তিনি আশা করেন, যুদ্ধের পথ ছেড়ে পাকিস্তান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবে।
সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা রংপুরের প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। সাত লাখ অধিবাসীর এই মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হচ্ছে।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, কুষ্টিয়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধে৵ তাঁরা যশোরের আলীগঞ্জ থেকে দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এটি পাকিস্তানিদের বিশেষভাবে কাবু করেছে। এলাকাটি রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিবাহিনীর মুখপাত্র আরও জানান, কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানিরা চরম আঘাত পাবে। এখানে শুধু যে রেল যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন, তা নয়; অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিয়েছে। এতে ওই এলাকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল প্রায় ভেঙে পড়েছে। রাতের বেলা সবাই শিবিরে বন্দী থাকে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, কুষ্টিয়া জেলার বেশ কয়েকটি সীমান্তচৌকি মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। ওই জেলার প্রায় ৯০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও মুক্তিবাহিনীর দখলে। জীবননগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দর্শনা-আলীগঞ্জ এবং আলীগঞ্জ-যশোর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এই দিন প্রকাশিত এক খবরে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর সংবাদদাতা জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে গেরিলারা ঢাকা আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছেন।
২ নম্বর সেক্টরের নারায়ণগঞ্জ এলাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ছুড়ে নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের জকিগঞ্জ দখল করেন। ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেডের সম্মিলিত শক্তি সিলেট দখল করার পরিকল্পনা হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি তাদের সঙ্গে জেড ফোর্স যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। তাদের এই অভিযানের অংশ হিসেবে পথিমধ্যে জকিগঞ্জের পাকিস্তানি অবস্থানটি আয়ত্তে নেওয়াটা জরুরি ছিল। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ দখল করেন।
মুক্তিবাহিনী সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর বিস্তৃত এলাকা দখল করে। যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক মাশরিক–এর ১৪ নভেম্বর সংখ্যায় লন্ডন থেকে তাদের সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, বিশ্বস্ত সূত্রের মতে, চীন পাকিস্তানকে জঙ্গি বোমারু বিমান, অন্তরীক্ষে ক্ষেপণযোগ৵ মিসাইল ও ভারী ট্যাংক সরবরাহ শুরু করেছে। চীনা সামরিক সরঞ্জামের প্রথম চালান একটি সমুদ্রগামী জাহাজে ইতিমধে৵ পাকিস্তানে পৌঁছেছে।
দ্বিতীয় চালানও কারাকোরামের পথে পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় চালানে বিমানবিধ্বংসী কামান ও ট্যাংকবিধ্বংসী রকেটও আছে।
লাহোরে সাতটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটির প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
১৬ নভেম্বর – বাংলাদেশের সমাধান মাস দুয়েকের মধ্যে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ১৬ নভেম্বর কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কর্মসমিতির সভায় বলেন, মাস দুয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
অপহৃত দুই চিকিৎসকের লাশ
ঢাকার মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের দক্ষিণে সার্কুলার রোডের সেতুর নিচ থেকে এদিন হাত-পা বাঁধা ও বিকৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক শহীদ বুদ্ধিজীবী আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবীরের লাশ পাওয়া যায়। ১৫ নভেম্বর একদল আলবদর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসের সামনে থেকে তাঁদের দুজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা এক সংবাদে জানায়, ২৭ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। অধিবেশন ঢাকায় বসবে বলে স্থির হয়ে ছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মহম্মদ খান ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দেশ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার মোকাবিলা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে ওয়াশিংটনে দেখা করার পর তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ভারতের সেনাসমর্থিত গেরিলাদের অভিযানই উত্তেজনার কারণ। পাকিস্তান সংযত বলেই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে না।
অবরুদ্ধ ঢাকার গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক এক বৈঠকে শান্তি সেনা গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি নিশ্চিত, বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যাবে। ভারতে সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা নিরসনে তাঁরা উদ্গ্রীব। যুক্তরাজ্য নিজে অথবা কমনওয়েলথ বা জাতিসংঘের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে ইচ্ছুক।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনাকালে ইন্দিরা গান্ধী দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববঙ্গ সংকট অবসানের দাবি জানান। এর মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে ভারত সমগ্র দেশে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় এ খবর উদ্ধৃত করে বলা হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি পৌঁছেছেন।
শহীদ হলেন জগৎজ্যোতি দাস
বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাস ১৬ নভেম্বর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের বদলপুরে শহীদ হন। এলাকাটি মুক্তিবাহিনীর ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত হলেও এখানে কিছু যুদ্ধ ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব-সেক্টর থেকে পরিচালিত হতো। ১৫ নভেম্বর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট থেকে নৌকায় রওনা দিয়ে ১৬ নভেম্বর সকালে বদলপুরে পৌঁছান। তাঁরা জানতে পারেন, রাজাকাররা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে বসে চাঁদা আদায় করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। জগৎজ্যোতি দাস কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন।
অদূরে জলসুখা গ্রামে ছিল জগৎজ্যোতির বাড়ি। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেদিকে রওনা হন; একটি দলকে পাঠান পিটুয়াকান্দি, আরেকটিকে আজমিরীগঞ্জে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জগৎজ্যোতি জলসুখার বদলে পিটুয়াকান্দি চলে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
জগৎজ্যোতি তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা তাঁদের গুলি করে। তিন সহযোদ্ধা শহীদ হন। জগৎজ্যোতির বাঁ পাঁজরে গুলি লাগে। আহত জগৎজ্যোতিকে পাকিস্তানিরা নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। পরে আজমিরীগঞ্জ বাজারে তাঁর লাশ খুঁটিতে বেঁধে বিক্ষত করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জগৎজ্যোতিকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়ার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। আকাশবাণীতেও প্রচারিত হয় তাঁর বীরত্বগাথা। স্বাধীনতার পর তাঁকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়।
এদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়, মুক্তিবাহিনী গত কয়েক দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রংপুর ও যশোরের বিপুল এলাকা মুক্ত করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করেছে।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের গোয়াইনঘাটসংলগ্ন রাধানগর কমপ্লেক্সকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা।
৭ নভেম্বর লুনি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৮-২০ জনের একটি টহল দল আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেখানে গেলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ৮-৯ নভেম্বর লুনি গ্রাম, ১১ নভেম্বর ঘোরা গ্রাম, ছাত্তারগাঁ, দুয়ারীখেল, ১৫ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রাম, ১৬ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও দুয়ারীখেল, ১৮ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
১৭ নভেম্বর – ইয়াহিয়াকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র লন্ডনে ১৭ নভেম্বর জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লন্ডন সফরের পর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ মন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গত মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড একই দিনে দিল্লিতে বলেন, পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তাঁর সরকার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এদিন এক খবরে বলা হয়, ভারত সফররত ব্রিটিশ মন্ত্রী রিচার্ড উড মুম্বাই পৌঁছানোর পর বলেন, পূর্ববঙ্গের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হবে। তাঁর ধারণা, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথের পক্ষে কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব নয়।
ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য হবেন
নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত এবং শেখ মুজিবের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে জানায়, চার সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলখানার আদালতকক্ষে উদাস ও শীর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে।
পত্রিকাটি জানায়, পাকিস্তানের দুই অংশের মধে৵ মীমাংসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বাংলাদেশের নেতারা তাতে বিক্ষুব্ধ। রেহমান সোবহান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম জার্মানি এ দিন দুই হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, বিপুল পরিমাণ শীতবস্ত্র এবং ওষুধ পাঠায়। এসব সাহায্যসামগ্রী কলকাতায় রেডক্রস, ইউনিসেফসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ১৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। ঢাকা শহরে সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করায় প্রমাণিত হচ্ছে যে ঢাকা শহর তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এ দিন ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। তারা ঢাকার সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাতে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বলা হয়, কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শহরকে দুষ্কৃতকারী মুক্ত করতে ১৭ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গী বাজারে ১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের অভিযানে এ দিন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহার চৌধুরী নিহত হন।
১১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে চালানো অভিযানে ঈশ্বরগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুল গণি নিহত হয়।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান পেশোয়ারে বলেন, দেশে যখন আগুন জ্বলছে, তখন কিছু লোক ক্ষমতার কথা বলছেন। তিনি প্রায় চার মাস বিদেশ সফরের পর এ দিন দেশে ফেরেন। দেশের গভীর সংকটে নেতাদের উদাসীনতায় তিনি আক্ষেপ করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত দক্ষিণপন্থী জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিরোধ করার চেষ্টা করায় ওই জোটের শরিক দলগুলোর সমালোচনা করেন। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে পুতুল সরকার গঠন করা হলে বিপ্লব অনিবার্য।
পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র চলছে। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র সফল হলে পশ্চিম পাকিস্তানও কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হবে।
পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাব্বিশা গ্রামে ৩২ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ থেকে যমুনা নদী পার হয়। এরপর দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল ছাব্বিশার পশ্চিম পাশে শালদাইর সেতুর কাছে এবং আরেক দল ছাব্বিশার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নেয়।
ছাব্বিশার পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তখন ছাব্বিশা গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়।
১৮ নভেম্বর – জাতিসংঘে বিতর্ক বাংলাদেশ নিয়ে
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাসংক্রান্ত জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ১৮ নভেম্বর সারা দিন বিতর্কের পর নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া ভারত উপমহাদেশে ওই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আলাদা দুটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি, এমন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
তিউনিসিয়ার প্রস্তাবে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার জন্য বিবদমান দুই পক্ষের কাছে আবেদন জানাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিকে অনুরোধ জানানো হয়।
ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে এই দিন বলা হয়, বিদেশি নেতাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ইয়াহিয়ার আশঙ্কা, তাঁকে মুক্তি দিলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস কমন্স সভার অধিবেশনে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ এড়াতে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে কমনওয়েলথের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেজিল্যান্ড মডলিং বলেন, যুক্তরাজ্য তা-ই করছে।
উ থান্টকে ইন্দিরার চিঠি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক চিঠিতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে বলেন, সেখানকার জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি কোনো রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করলে সেটিকে স্বাগত জানানো হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের চিঠির জবাবে ১৬ নভেম্বর তিনি এ চিঠি লেখেন। লোকসভার এ দিনের অধিবেশনে চিঠিটি পেশ করা হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি রাতে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানান, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে না।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাজ্য মনে করে, বাংলাদেশ সমস্যার দায় পাকিস্তানের এবং এর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।
মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সহকারী হাইকমিশনের প্রবীণ বাঙালি কর্মী শাহজালাল মিয়া পালিয়ে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এসে পুলিশের কাছে আশ্রয় চান।
পাকিস্তানে চীনা প্রতিনিধিদল
চীন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী লি সুই চিংয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ৮ দিনের সফরে ১৮ নভেম্বর ইসলামাবাদে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গেও আলোচনা করবেন।
রাওয়ালপিন্ডির এক সংবাদপত্র জানায়, পাকিস্তানে বসবাসরত প্রায় ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরিকল্পনা করেছে। একজন বিদেশি কূটনীতিক বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব। জরুরি নয়, এমন কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারদের অপসারণ করা হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
১৯ নভেম্বর- আবার স্বীকৃতির দাবি ভারতের রাজ্যসভায়
১৯ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ৵সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য নতুন করে আবার দাবি জানানো হয়। রাজ্যসভায় সিপিআই সদস্য জি এম সরদেশাই বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবসংক্রান্ত একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারের উদ্দেশে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন পাঠানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়া।
রাজ্যসভায় এসএসপির সদস্য রাজনারায়ণ অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চাপে বাংলাদেশ উপদেষ্টা কমিটিতে কমিউনিস্টদের গ্রহণ করা হয়েছে। এর উত্তরে সরদেশাই বলেন, এই ধরনের বিবৃতি ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পছন্দ করবে। রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনা করার জন্য কমিশন গঠন করার অধিকার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের কাছে কখনোই এখানে এমন কোনো কমিশন পাঠানোর কথা চিন্তা করছে বলে জানায়নি।
পরে সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য চীনে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর অভিপ্রায় সরকারের নেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মনোভাব চীনের উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের পাকিস্তানকে তাদের দেশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সেনা পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা দিতে অস্বীকার করার সাম্প্রতিক একটি খবরকে সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় স্বাগত জানান।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার দিন খুবই কাছে।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল সাদেক হোসেন খোকার (স্বাধীনতার পর বিএনপি নেতা ও ঢাকার মেয়র) নেতৃত্বে শান্তিনগরে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের অফিসে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলাদের এই দলে আরও ছিলেন রফিকুল হক নান্টু, ইকবাল আহমেদ সুফি ও আমসল লস্কর।
ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের অনুগতদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মতিঝিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্য আরেকটি দল ডেমরায় পাকিস্তানি অনুগত ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্যাকেজিং কারখানায় বোমা হামলা চালায়।
এই সেক্টরের অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার রাজনগরে সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করলে দুজন হতাহত হয় এবং পাঁচ রাজাকার বন্দী হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর দলের সামাদের গ্রুপে ছিলেন কমান্ডো মাহবুব, কাসেমসহ কয়েকজন এবং আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিলেন ১৫ জন। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। রায়গঞ্জ সেতুর কাছে পৌঁছে সামাদের গ্রুপ বুঝতে পারে, তাঁরা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে পড়েছেন। সামাদ সবাইকে শুয়ে পড়তে বলেন। পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে গুলি শুরু করে। চলতে থাকে মরণপণ যুদ্ধ।
এই সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বড়খাতায় পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা হাতীবান্ধায় পিছু হটে। বড়খাতা পাকিস্তানি মুক্ত হয়।
ইয়াহিয়া-নুরুল আমিন সলাপরামর্শ
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনের ব্যাপারে সলাপরামর্শ করেন।
নুরুল আমিনসহ দক্ষিণপন্থী সাত দলের যুক্তফ্রন্টের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে আগের দিন বলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য দলকে যদি সরকার গঠন করতে বলা হয়, তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হবে না, এমন হুমকি দেওয়ার অধিকারও কারও নেই। বিবৃতিতে স্পষ্ট যে ভুট্টোর ঘোষণার জবাবেই এ কথা বলা হয়েছে।
২০ নভেম্বর – স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই
নিউইয়র্ক টাইমস ২০ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমৃত্যু সংগ্রাম করে হলেও বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে ঘুরে সামগ্রিকভাবে এই ধারণাই হয়। করাচি থেকে ম্যালকম ব্রাউন এই প্রতিবেদন পাঠান।
প্রতিবেদনে ব্রাউন বলেন, হোটেল, ব্যাংক, দোকান, বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বিদেশি কনস্যুলেট অফিস—সর্বত্রই রয়েছে মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জলাভূমি বেশি। সেখানে সেনাদের পক্ষে ঢোকা কঠিন। পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ভিয়েতনাম থেকে কিছু শেখেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গেরিলারা সর্বত্র রাস্তা, সেতু ও জলপথ ধ্বংস করছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ঘরের বাইরে আসা প্রায় বন্ধ।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটিতে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনাকালে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে বি অ্যান্ডারসন পূর্ববঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান।
শহীদ হলেন আশফাকুশ সামাদ
আশফাকুশ সামাদ ২০ নভেম্বর কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার রায়গঞ্জ দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। ১৯ নভেম্বর রাতে আশফাকুশ সামাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁদে পড়ে যান। এ বিপর্যয়ে বিচলিত না হয়ে সামাদ সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করেন। একপর্যায়ে একটি গুলি তাঁর মাথা ভেদ করলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শাহাদাতবরণ করেন। এ যুদ্ধে আরও শহীদ হন কবীর আহমেদ (ইপিআর সিপাহি), আবদুল আজিজসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বামনিতে রাজাকারদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। রাজাকারদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা অহিদুর রহমান অদুদ শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি এবং ভারতীয় বাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড যৌথভাবে সিলেট দখলের পরিকল্পনা করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি জেড ফোর্স তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের জালালপুর থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। এরপর তারা চারগ্রামে আগের অক্ষে ফিরে এলে পাকিস্তানি বাহিনী জকিগঞ্জ পুনর্দখল করে। জকিগঞ্জ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত করতে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার জকিগঞ্জে আক্রমণ করেন। রাতভর যুদ্ধ চলতে থাকে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সাতক্ষীরার দেবহাটার বিরাট একটি অঞ্চল মুক্ত করেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি বাহিনী সাতক্ষীরা শহরের দিকে পিছু হটে। দেবহাটার মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে সাতক্ষীরার দিকে এগিয়ে যান।
সাতক্ষীরার তালা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এ ছাড়া কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। দিনটি কালিগঞ্জ বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ঈদের দিন
১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল ঈদ। বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের জামাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ঈদের দিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা, ইকো এবং ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির সৈন্যদের নিয়ে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগরকে ঘিরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি।…নতুন জামাকাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিল।’
২০ নভেম্বর বেলা একটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নুরুন্নবী খানদের ছাত্তার গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ভয়ংকর হামলা চালায়। সুবেদার আলী আকবর ছিলেন এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। নুরুন্নবী খান বাংকারে বসে ঈদের খিচুড়ি খাচ্ছিলেন। তিনি দ্রুত সুবেদার বদি এবং তাঁর প্লাটুনের দুটি সেকশনকে সঙ্গে নিয়ে আলী আকবরের অবস্থানে পৌঁছান। বাইনোকুলারে দেখতে পান, পাকিস্তানিদের বিশাল দল তাঁদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করলে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে।
ঈদের রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে বন্দী ৩৮ জন স্বাধীনতাকামীকে শহরের পৈরতলা খালপাড়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা, তাঁর ছেলে কামাল, দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার শহিদ নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল রাজাকাররা। তাঁদের অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
২১ নভেম্বর – চীনের মন্তব্যে হতাশা

জাতিসংঘে চীন সরকারের প্রতিনিধির করা মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ২১ নভেম্বর মুজিবনগরে বলেন, শরণার্থীদের ব্যাপারে সামান্য সহানুভূতিও প্রকাশ করেনি চীন। শরণার্থীদের সাহায্যের কথা না বলে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন চীনের প্রতিনিধি। তবে বাংলাদেশের মানুষ একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেটি হলো মাতৃভূমির মুক্তি।
জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি পাকিস্তানি নীতিকে সমর্থন করায় ভারতের আহমেদাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্তের ঘটনাবলি সম্পর্কে এবং বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা প্রশ্নে ভারত তার সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে।
প্রসঙ্গত, ১৯ নভেম্বর চীনের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তব্য দেন।
জাতিসংঘের সমালোচনা
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রধান সম্পাদকীয়তে অভিমত ব্যক্ত করা হয়, ভারত উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাইলে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেওয়া উচিত। আরও বলা হয়, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেই কেবল জাতিসংঘ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে সফল হবে। জাতিসংঘ এ পর্যন্ত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এড়িয়ে গিয়েছে।
পূর্ববঙ্গে যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, কেবল ত্রাণে তার সুরাহা হবে না বলে মনে করেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানসহ জাতিসংঘের একাধিক কর্মকর্তা। তাঁদের অভিমত হলো, সমস্যার মূলে যেতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিতে হবে। তবেই সংঘর্ষ বন্ধ হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটেনের পার্লামেন্ট লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস এদিন লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা দেন। সেখানে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন তাদের এক সংবাদ নিবন্ধে ক্রেমলিনের অভিমতের পুনরাবৃত্তি করে বলে, পূর্ববঙ্গে সামরিক সরকারের অমানবিক উৎপীড়নের কারণেই জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এর দায় ভারতের ঘাড়ে চাপানো যায় না। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান রাজনৈতিক মীমাংসা।
পাকিস্তান অধিকৃত ঢাকা থেকে এদিন একটি বার্তা সংস্থা জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানিরা দিশেহারা। দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বিস্তীর্ণ পল্লি অঞ্চল মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। তাদের অভিযানের তীব্রতায় প্রশাসন বেসামাল। পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হতে পারে, এই আশঙ্কায় তারা সন্ত্রস্ত।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী এদিন জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ৬ জন সেনা, ২ জন পুলিশ ও ২৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার বেনাপোল, নাভারন, শার্শা শহরসহ চৌগাছার গরিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক ও কামান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। ভয়াবহ যুদ্ধে দুই পক্ষেই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এদিন সকালে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে কামান ও আর্টিলারি দিয়ে আঘাত হানে। বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা পাঁচ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে চলে যায়। এরপর শহীদ আশফাকুস সামাদসহ অন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ উদ্ধার করে জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর সামাদকে বীর উত্তম খেতাবে সম্মানিত করা হয়। স্থানীয়রা জয়মনিরহাটের নাম রাখেন সামাদনগর।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন করাচিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সম্প্রতি যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে তাঁর সেখানে যাওয়ার আর কোনো আবশ্যকতা নেই।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, গণতন্ত্রই শুধু দেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে। একনায়কতন্ত্র বা স্থায়ী সামরিক শাসন কোনো সমাধান হতে পারে না।
২২ নভেম্বর – যশোর অভিমুখে মুক্তিবাহিনী
যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চৌগাছায় ২২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী চৌগাছার বিরাট এলাকা মুক্ত করে যশোর শহরের দিকে এগোয়। পাকিস্তানি বিমান যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বয়রায় আসামাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে ওড়ে। বিমানযুদ্ধে তিনটি পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুই পাইলট খলিল আহমদ খান ও পারভেজ মেহেদি কোরেশি ভারতে বন্দী হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩টি ট্যাংক, ৩টি বিমান এবং বেশ কিছু সেনা হারিয়ে শার্শার নাভারনে আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পিছু নিয়ে শার্শা সদর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে।
২ নম্বর সেক্টরে রাতে কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় হামলা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে ছিল। চন্দ্রপুরের লাগোয়া লাটুমুড়া পাহাড়ে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখান থেকে তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ভারতীয় বাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর, তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড কর্মকর্তাসহ ৪৫ জন সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলামসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) ২২ জন শহীদ হন। আহত হন প্রায় ৩৪ জন। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে চন্দ্রপুর দখল করলেও পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর পুনর্দখল করে নেয়।
এই সেক্টরে ঢাকা শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল বনগ্রাম এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে ঘটনাটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রামপুরায় আরেক দলের হামলায় একজন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সহযোগী গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রাম-কানাইঘাট-চরখাই-সিলেট অক্ষ বরাবর অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন তারা সুরমা নদীর তীর ধরে এগিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছায়। দলটির আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি সুরমার দক্ষিণ তীরে এবং চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নেয়।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গৌরীপুরে পৌঁছালে কানাইঘাটে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সামনের দিকের দুটি কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নিয়েছিল।
সিলেট শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেন শক্তিক্ষয় না হয়, সে জন্য ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সেক্টরের একটি কোম্পানি দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে অবস্থান নিতে বলা হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানিদের শক্তি সঞ্চয়ে বাধা দেওয়া এবং কানাইঘাট থেকে পাকিস্তানিদের পিছু হটতে না দেওয়া। বাকি দুই কোম্পানি সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি আলাদা দল অমরখানা ও জগদলহাটে আক্রমণ করে। ভারতীয় আর্টিলারিও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ এবং ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে যায়। অমরখানা ও জগদলহাট মুক্ত হয়।
খুলনা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সীমান্তের বসন্তপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করের আরও এগিয়ে যায়।
নুরুল আমিন স্থায়ীভাবে লাহোরে
পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদপত্রের বরাতে ইত্তেফাক জানায়, কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে স্থায়ীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরেই বাস করতে পারেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শিয়ালকোটে সীমান্ত অঞ্চল এবং লাহোরে নিয়োজিত সেনাদল পরিদর্শন করেন। শিয়ালকোটে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনাবাহিনীর স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থার আন্তজেলা কোচ সার্ভিস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ঢাকা ও মফস্বল শহরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অভ্যন্তরীণ সার্ভিসও বাতিল করা হয়।
মানুষের প্রতি মানুষের অমানুষিক ব্যবহার
ভারতে সফররত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ রাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেন। ভারত সরকারের সামনে যে কঠিন কর্তব্য রয়েছে, তা শান্তিপূর্ণভাবেই তা সম্পন্ন হবে বলে সেখানে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দিল্লি থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক খবরে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯ নভেম্বর এক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ভারত তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনে গ্রহণ করবে। ইন্দিরা বলেন, আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে শেখ মুজিবকে প্রথমে মুক্তি দেওয়া উচিত।
২৩ নভেম্বর – জরুরি অবস্থা জারি করলেন ইয়াহিয়া
ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ নভেম্বর সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান আক্রমণের শিকার হতে পারে, এ আশঙ্কায় ইয়াহিয়া খান দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই সীমান্তে প্রচুর সেনা সমাবেশ করায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন।
এর আগে ১২ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। এর পরই তাঁর নিদে৴শে পশ্চিম সীমান্তে বিপুল সেনার সমাবেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গ সীমান্তেও সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। সীমান্ত থেকে ভারতের ভেতরে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চলছে।
ভারত সরকার খবর পেয়েছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকা তাদের আকাশসীমায় হানা দিতে পারে। এসব তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ভারতও সীমান্তে সেনাসমাবেশ করেছে।
ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিকও রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচিতে আসেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি এই দিন জানায়, ঢাকায় সবার ধারণা ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। সাংবাদিকদের যশোরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে যুদ্ধ চলছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইলে শেখ মুজিবসহ পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে, বিশ্ব সংস্থার উচিত সেটিকে সমর্থন করা।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এর সংবাদদাতার রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাঠানো খবরে এক সামরিক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, যশোর ও সিলেটের ছোট ছোট এলাকা ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতার খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এটি তাঁদের জীবনমরণ যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ভারত থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সিনেট ও কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সে পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, প্রতিনিধি সভা যে সংশোধন অনুমোদন করেছে, এই প্রস্তাবে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরার আলোচনা
পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত তাঁর শীর্ষস্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। পাকিস্তান একদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে তাদের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এসবের প্রেক্ষাপটে সবার সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো দুঃসাহস দেখালে এবার ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হবে পাকিস্তানের। এবার যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের মাটিতেই হবে এবং তার ফয়সালাও হয়ে যাবে।
তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন বেতার ভাষণে বলেন, নানা দিক থেকে সাফল্য এসেছে। স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটতর হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
২ নম্বর সেক্টরে কসবার চন্দ্রপুরের যুদ্ধে শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আবার আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এই সেক্টরে মন্দভাগ অবস্থান পুনর্দখল করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী জায়গাটির কাছে একত্র হলে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন হতাহত হন। এখানে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদীর সন্নিকটে একটি রেলসেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালায়। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর একটি বাংকার ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনী প্রবল পরাক্রমে প্রতিরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তারা বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন এবং চারজন আহত হন।
মুক্তিবাহিনীর নৌযোদ্ধারা চালনা বন্দরের মুখে মাইন দিয়ে ‘এসএস রাইজোভেলান্ডু’ নামের একটি মালবাহী গ্রিক জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এতে চালনা বন্দরে জাহাজ ঢোকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
২৪ নভেম্বর – বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ নভেম্বর দেশটির আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে বৈঠকে করেন। বিরোধী নেতা গোরে মারারি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ৬ ডিসেম্বরের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ, ইয়াহিয়া খান সে দিন পাকিস্তানের নতুন সংবিধান চালু করবেন।
পরে লোকসভায় মুক্তিবাহিনীর সাফলে৵র কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা বলেন, বর্ষার পর মুক্তিবাহিনীর সাফল্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সব পরিকল্পনা স্পষ্টত বানচাল করে দিয়েছে।
এ দিন ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের ১৪ জন নাবিক আশ্রয় নেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার এদিন সশস্ত্র বাহিনীর সবাইকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সামরিক কার্যালয়ে হাজির হতে নির্দেশ দেয়। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি চীনা প্রতিনিধিদল এদিন পাকিস্তানে পৌঁছেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করে।
আলোচনার বিষয় অজানা থাকে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের আক্রমণের প্রসঙ্গ তাড়াহুড়া করে নিরাপত্তা পরিষদে নিতে সরকারকে বারণ করেন। করাচি থেকে লাহোরে পৌঁছে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বের একমাত্র অধিকার তাঁর। কারণ, তিনি জননেতা। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার ওপর বিপুল দায়িত্ব। এই সংকটময় মুহূর্তে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।
একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রেখেছেন।
ওয়াশিংটন থেকে রয়টার্স জানায়, যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে চলায় যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ৩০০ মার্কিন নাগরিককে স্থানান্তর করার কথা ভাবছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরে আবার সান্ধ্য আইন জারি করে। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ঢাকায় দুবার সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বা কারণ জানানো হয়নি।
জাতিসংঘের বৈঠক ডাকার আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের কিছু সদস্য ভারত-পাকিস্তান সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানান।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এদিন ভারত উপমহাদেশের সংকট নিয়ে সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে আলাপ করে। আলোচনার বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি।
ভারত ও পাকিস্তানকে সামরিক উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার জন্য এই দিন আহ্বান জানায় ফ্রান্স।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রে রেখে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
পাকিস্তানিরা পালানোর পথ খুঁজছে
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ২৪ নভেম্বর বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে পাকিস্তানি সেনারা দুটি পন্থা নিয়েছে: ১. নির্বাচিত চার-পাঁচটা সেনানিবাসে আত্মরক্ষার জন্য ঘাঁটি গড়ে তোলা। ২. বাংলাদেশ থেকে দ্রুত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কিছু সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া। বিমানবাহিনীর কিছু বিমানও তারা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকাকে প্রধান ঘাঁটি করে ঢাকা বিমানবন্দর রক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর যশোর, সিলেট, দিনাজপুর প্রভৃতি শহর থেকে তারা পিছু হটছে।
পলায়নপর্বের জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের আরও দু-তিন সপ্তাহ সময় দরকার। তাদের সেনাবাহিনী প্রাণপণ লড়ে ওই সময়টুকু পাওয়ার চেষ্টা করবে।
মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দিকে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় দ্রুত এগোচ্ছে। যশোর বিমানবন্দর ক্ষতবিক্ষত। সাতক্ষীরা-নাভারন এবং চৌগাছা-কালিগঞ্জ হয়ে মুক্তিবাহিনীর আরও দল ক্ষিপ্রগতিতে সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে চলেছে। আরেকটি দল যশোর-খুলনার পথে গোলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী অর্থ ও সম্পদ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত।
নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে এদিন চট্টগ্রাম বন্দরে এক হাজার টন তেলবাহী জাহাজ, মেঘনায় চীনের বাণিজ্য জাহাজ, চাঁদপুরের কাছে চারটি বড় স্টিমার এবং পাকিস্তান নৌবহরের একটি গানবোট ডুবে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর জরুরি সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চাঁদপুরের জাহাজ চলাচল বন্ধ।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্স দখলের লক্ষ্যে জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘোরা, দুয়ারীখেল, ছাত্তারগাঁ, লুনি, জাফলং চা-বাগান, কাফাউড়া ও বাউরবাগ থেকে উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক দিয়ে রাধানগর ও ছোটখেল অবরোধ অভিযান শেষ করেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চৌগাছা মুক্ত করেন।
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাঁটি অবরোধ করে মূল বাহিনী থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
২৫ নভেম্বর – আন্তর্জাতিক বিশ্বে হঠাৎ উত্তেজনা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পৃথকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে তাঁদের দুই দেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে ২৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার খবর পাওয়ার পর দুই দেশের কূটনীতিকদের ডেকে আনা হয়। ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনার সময় উইলিয়াম রজার্স উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমনে কোনো নতুন প্রস্তাব দেননি।
তবে তিনি দুই দেশকেই সংঘর্ষে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পূর্ব খণ্ডে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েনেরও কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ব্যক্তিতভাবে আবেদন জানাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ভারত উপমহাদেশের সমস্যা বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানানোর বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, তার জন্য প্রভাব খাটাতে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। সেখানকার পাকিস্তানি হাইকমিশনার মহম্মদ ইউসুফ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি পৌঁছে দেন।
মস্কোর একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব দল আন্দোলন চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের কাছে একটি নোট পাঠিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিকে জটিল ও সংকটজনক করে না তোলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে আবার অনুরোধ করেছে। পাকিস্তান যুদ্ধের পথই বেছে নিলে তাকে সর্বনাশা পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চীনের সরকারি পত্রিকায় বলা হয়, ভারত পূর্ববঙ্গে আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়েও যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিচ্ছে চীন। কারণ, তারা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়। নিউ চায়না এজেন্সি পরিবেশিত আরেক খবরে বলা হয়, বেইজিংয়ে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক পরিস্থিতিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি চৌ এন লাইকে দেন কায়সার।
শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিন আবার ঘোষণা করে, কলম্বো হয়ে বিমানে পূর্ববঙ্গে সেনা ও অস্ত্র পাঠানোর জন্য পাকিস্তানকে তারা কখনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানিরা তাদের নাগরিকদের এক অংশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রীতিমতো ভুল করেছে। ৮০ লাখ থেকে এক কোটি আক্রান্ত নাগরিককে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা তাদের কৌশলগত ভুল। এতে ভারত গুরুভার বহন করতে বাধ্য হয়। ভারত আশ্রয় ও সামরিক শিক্ষা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান তার সংকীর্ণতার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়ান্ত্র ব্যবহার করে। পরিণামে এ যুদ্ধ।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ কলকাতা থেকে পাঠানো সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, পূর্ববঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ভারতের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল এবং নিরাপস। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও তারা মেনে নিয়েছে। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা শনবার্গকে বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না। তবে পাকিস্তান শুরু করলে তারা নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব করবে।
চীন–পাকিস্তান বন্ধুত্ব
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন তক্ষশীলায় চীনের সাহায্যপুষ্ট একটি কারখানার উদ্বোধনীতে বলেন, পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে উপমহাদেশের শান্তি বিনষ্ট করেছে ভারত। তবে বিদেশি আক্রমণ হলে চীন পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন জানাবে।
অনুষ্ঠানে চীনা প্রতিনিধি লি সুই চিং বলেন, চীন–পাকিস্তানের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর হচ্ছে। দুই দেশেই অপর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরোধী।
মুক্তিবাহিনীর যশোর দুর্গ দখলের লড়াই
মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় যশোরের ঝিকরগাছা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে তাদের ঘাঁটিগুলো দখল করে। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায়। যশোরের অনেক এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়।
ঝিকরগাছা দখলের পর যৌথ বাহিনী যশোর শহরে পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক থেকে অবরুদ্ধ করে।
তাদের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কুষ্টিয়া-খুলনা যোগাযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুলনা–উত্তরবঙ্গ রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যশোর বিমানক্ষেত্রও হয়ে পড়ে অকেজো। একটি বিমান পাকিস্তানি সেনা নিয়ে এসেও যৌথ বাহিনীর কারণে নামতে পারেনি।
বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র রাতে জানায়, এক সপ্তাহ যুদ্ধের পর রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরার কয়েকটি থানা মুক্ত।
কুষ্টিয়ার অনেক এলাকা এদিন মুক্ত হয়। মেহেরপুর দখল নিয়ে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের মহেশপুর মুক্ত করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করে ৯টি গ্রামে বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে। ভেড়ামারা থেকেও পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত। দর্শনা থেকে তারা পালাচ্ছে। জীবননগর মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত।
পাকিস্তান সেনারা দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়েছে। পঞ্চগড় ও কানপুর মুক্ত।
তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর বসিরহাট দখল করেছে; ছিনিয়ে এনেছে ফুলগাজী, আনন্দপুর আর চাঁদগাজী বাজার। পরশুরাম এলাকা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা দখলে নিয়েছে।
২৬ নভেম্বর – গৌরীপুরে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ লড়াই

সিলেটের কানাইঘাটের দুই মাইল দূরে গৌরীপুরে ২৬ নভেম্বর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট দখলের লক্ষ্যে ২২ নভেম্বর গৌরীপুরে পৌঁছান। কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তখন তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে এসে সুরমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সামনের চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে ডেল্টা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়।
তারা একই সঙ্গে সুরমার দক্ষিণে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ওপরও আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু
করে। ডেল্টা কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে পাকিস্তানিরা বারবার তাঁদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে।
এই অবস্থায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির মাঝখানের প্লাটুনের অধিনায়ক সুবেদার মুসা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক এবং অন্য প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর বাঁ পাশে ছিল সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক ও মেজর) নেতৃত্বাধীন প্লাটুন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানেন। এই সুযোগে প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা বুকে হেঁটে দ্রুত পাকিস্তানিদের ৫০ গজের মধ্যে চলে আসেন।
দুই পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ওয়াকার হাসানের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সারওয়ারসহ ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা এদিন নিহত হয়। ২৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ১৭।
যশোর শহরের উপকণ্ঠে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই এদিন অব্যাহত ছিল। হিলিতে চলে ট্যাংক লড়াই। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলস্টেশন এলাকায় প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। কুষ্টিয়ার রসুলপুর ঘাটের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা রাজাপুরের দিকে পিছু হটে যায়। খুলনা জেলার বসন্তপুরের এদিন পতন হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৬ নভেম্বর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময়ে আর কেউ ছিলেন না। পরে তাঁদের সহকারীরা এসে যোগ দেন। আলোচনার বিষয় ছিল ভারতের আক্রমণের আশঙ্কা। ভুট্টো পরে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা এটা নিয়েই উদ্বিগ্ন, অসামরিক সরকার গঠনের বিষয়ে তাঁরা এখন ভাবছেন না।
পশ্চিম পাকিস্তান সফররত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।
গোটা পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারির তিন দিন পর এদিন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের দুই অংশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ওয়ালি) কার্যক্রম বেআইনি ঘোষণা করেন। এর পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকজন ন্যাপ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া নিষিদ্ধঘোষিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মাস্টার খান গুলকে পেশোয়ারে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক এবং খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যশোর সফর করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির আহ্বান
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালদের বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যুদ্ধের হুমকি সত্ত্বেও আক্রান্ত না হলে ভারত যুদ্ধে জড়াবে না। ভারতের বিমানবাহিনী ক্ষুদ্র ন্যাট বিমান দিয়ে পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর জেট বিমান যেভাবে ঘায়েল করেছে, সেখান থেকেই তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সংবাদদাতা কেভিন রেফার্টি কলকাতা থেকে পাঠানো খবরে বলেন, অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, শিগগিরই বাংলাদেশ নামে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হবে। যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো সমাধানের কথা কেউ ভাবতে পারছেন না। সবার ধারণা, দ্রুতই যুদ্ধ শুরু হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এই দিন পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের উত্তেজনা কমাতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবার ভারতকে অনুরোধ করেন। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে এই খবর দিয়ে বলেন, ইসলামাবাদে পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গেও এমন আলোচনা চালানো হচ্ছে।
২৭ নভেম্বর – মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছেন

দিনাজপুর অঞ্চলের হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণ ২৭ নভেম্বর তীব্র আকার ধারণ করে। হিলিতে তীব্র লড়াই হয়। রংপুর সেনানিবাস থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাকে বিচ্ছিন্ন করতে যৌথ বাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তাদের কামানের গোলায় পাকিস্তানিদের পাঁচটি ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৮০ জন হতাহত হয়। যৌথ বাহিনীরও ২০ জন হতাহত হন।
সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেক্স মুক্ত করার জন্য এদিনও থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানে আক্রমণ করে। ছোটখেলে তাদের সঙ্গে ছিল জেড ফোর্সের ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির একটি প্লাটুন। নেতৃত্বে ছিলেন ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাদের দায়িত্ব ছিল গোর্খা সেনাদের বেরোনোর পথ নিরাপদ রাখা এবং দক্ষিণ দিকের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা।
আর্টিলারির গোলাবর্ষণের পর গোর্খা রেজিমেন্টের সেনারা সরাসরি আক্রমণ শুরু করেন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তাঁরা ছোটখেল দখল করেন। গোর্খা রেজিমেন্টের অন্য যে দুটি কোম্পানি রাধানগরে আক্রমণ করেছিল, তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। তাদের ৪ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পদের ৬৭ জন সেনা শহীদ হন। আহত হন শতাধিক।
ছোটখেল দখল করলেও পুনঃসংগঠিত পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় তা গোর্খা সেনাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। গোর্খা সেনারা নুরুন্নবী খানের প্লাটুনের সহায়তায় পিছু সরে আসেন। শহীদ হন ৩৬ জন।
নুরুন্নবী খানের অধীন ডেল্টা কোম্পানির অবস্থান ছিল লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, ছাত্তারগাঁ ও শিমুলতলা গ্রামে। পাকিস্তানিরা এসব অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে হিমশিম খান। পরে কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে প্রতিহত করেন।
সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল রহিমপুরের কাছে বিরাট এলাকা মুক্ত করে। দুজন কর্মকর্তাসহ ২৩ জন পাকিস্তান সেনা বন্দী হয়। ১৮৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
ফেনী দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। স্থলযুদ্ধে মার খেয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে। তবে মুক্তিবাহিনী অবস্থান ধরে রাখে।
৭ নম্বর সেক্টরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিন মাইল দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিবাহিনী মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একসঙ্গে পোড়াগ্রাম আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের একটি সূত্র এদিন জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ টেলিফোনে কথা বলেছেন। নিয়মমতো আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হলেই নিরাপত্তা পরিষদ মাথা ঘামাতে পারে। বর্তমান সংকটে পাকিস্তান যাতে ভেঙে না যায়, সে উপায় খুঁজে বের করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা করতে পারে।
তবে ভারত-পাকিস্তান সংকটে নিরাপত্তা পরিষদের এগিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা নেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করতে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে এতে টেনে আনতে চাইছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি তাদের ঢাকা সংবাদদাতার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানায়, ঢাকায় আবার কয়েকটি বিস্ফোরণের এবং কয়েকটি পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সড়ক, জলপথ ও রেল পরিবহন বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পরিখা খনন করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র দং এ লিবো এদিন জানায়, উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। অস্ত্রবোঝাই একটি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোর খবর সরকারিভাবে সমর্থিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি ভারত সরকারকে জানিয়েছে।
বাজপেয়ীর সমর্থন
জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ী এদিন বলেন, ভারতের ওপর পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে জনসংঘ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানাবে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আফ্রো-এশিয়া সংহতি কমিটির এশীয় আঞ্চলিক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৭২ সালের ১০ থেকে ১৫ জানুয়ারি মিসরের রাজধানী কায়রোয় অনুষ্ঠেয় পঞ্চম অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে তারা আলোচনা করবে। সে অধিবেশনে যাতে বাংলাদেশ যোগ দিতে পারে, তার জন্য কায়রো অধিবেশনের প্রস্তুতি কমিটিকে জানানো হবে।
রেডিও পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি
রেডিও পাকিস্তান এদিন এক খবরে স্বীকার করে, যশোরের কাছেই প্রচণ্ড লড়াই চলছে। যশোর বিপন্ন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বিভিন্ন এলাকা সফরের অংশ হিসেবে এদিন হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
২৮ নভেম্বর – নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে বিতর্ক
মুজিবনগরে একটি মহল ২৮ নভেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমা কিছু দেশ তৎপর। ভারত উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার যে প্রস্তাব তুলতে চায়, তাতে ইতালি যোগ দিয়েছে। জাপানকেও তারা টানতে চাইছে। কিন্তু জাপান চায়, বৃহৎ শক্তিরা নেপথ্যে তৎপর হয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুক।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সমস্যার অজুহাতে বৃহৎ শক্তিদের অথবা নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ানোর চেষ্টা করা হলে তারা বিরোধিতা করবে। তারা বারবার বলেছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং এর দুই পক্ষ হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য কয়েকটি দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সপ্তাহব্যাপী মুক্তাঞ্চল সফর শেষে মুজিবনগরে ফিরে বলেন, তিনি সেখানে প্রশাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগের তালিকা কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্সের ছোটখেল এলাকায় এদিন জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানির কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধা ভোরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করেন। প্রথাগত যুদ্ধের নিয়মে আক্রমণে তিন গুণ যোদ্ধা প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সতীর্থদের লাশ ফেলে দ্রুত রাধানগরের দিকে চলে যায়।
সকালে পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) আহত হন। পাকিস্তানিদের উপর্যুপরি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবের কয়েকটি স্থান ও জয়পুরে দেওয়া ভাষণে বলেন, কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এর আগে ভারত তিনবার পাকিস্তানের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবে বলেনি যে ভারত আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কাছে সুবিচার আশা করা যায় না।
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য জ্যোতি বসু কানপুরে বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তাঁর দল সরকারকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাবে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন। পূর্ব বাংলার বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জ্যোতি বসু চীনের এই অভিমতের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ কলকাতায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে পূর্ব বাংলায় যা চলছে, তাতে পাকিস্তান সেটিকে হারাতে বাধ্য হবে। পাকিস্তানের উভয় অংশের ঐক্য আর কল্পনাও করা যায় না। শরণার্থীরা জন্মভূমিতে ফিরে গেলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
পশ্চিমা মনোভাবের নিন্দা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মনোভাবের তীব্র নিন্দা করে। প্রাভদার অভিযোগ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার উপেক্ষা করে পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে। প্রাভদায় আরও বলা হয়, পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং সংরক্ষিত সেনাবাহিনীকে তলব করে গোটা পরিস্থিতি জটিলতর করে তোলা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্সের খবরে এদিন বলা হয়, পাকিস্তানকে তার স্বীকৃত অন্যায় থেকে বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তানকে এক কোঠায় ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আবার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভারত, পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে অভিন্ন বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে; পূর্ব বাংলায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনা সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে এবং সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সেনা সরিয়ে নিতে হবে।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন আবার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। গত তিন দিনে এ নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া দুবার বৈঠক হয়। ভুট্টো জানান, প্রেসিডেন্ট তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ অবহিত করেছেন।
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র এদিন প্রথমবারের মতো স্বীকার করে। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে বলে একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন। যদিও পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের গণযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না বলে সেই মুখপাত্র মন্তব্য করেন।
২৯ নভেম্বর – ইন্দিরাকে নিক্সনের বার্তায় প্রতিক্রিয়া

ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ২৯ নভেম্বর সকালে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি দেন। নিক্সন ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানকে চিঠিতে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনকেও নিক্সন এক চিঠিতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়েছেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর দিল্লি সংবাদদাতার খবরে বলা হয়, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো প্রস্তাব করা হয়নি বলে নিক্সনের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান উপেক্ষা করা হবে বলে ধারণা করা হয়।
ভারত সরকারের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানই প্রথম সেনাসমাবেশ শুরু করেছে বলে দিল্লি তার মনোভাব বদলায়নি। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বেলজিয়ামের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার প্রস্তাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও দ্বিধায়। প্রস্তাবের ব্যাপারে ভারত বেলজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
দিল্লি থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর বিশেষ সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বেলজিয়ামের প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, পরিষদের অধিবেশনে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
পাশ্চাত্যের দেশ সফরকালে ইন্দিরা বলেছেন, উপমহাদেশের বর্তমান সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে লাভ নেই। পাকিস্তান এ পর্যন্ত তিনবার ভারত আক্রমণ করলেও নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্ট ভাষায় তা কখনো বলেনি।
রাধানগরের যুদ্ধ
সিলেটের রাধানগরে দুপুর থেকে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা ও আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সদস্যসহ রাধানগরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ করার কথা ছিল। তা না হওয়ায় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) তাঁর কোম্পানি এবং আলফা ও গণবাহিনী সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ করেন। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে যায়।
রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা ছোটখেলে তীব্র আক্রমণ করে বসে। প্রবল আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণের পর রাত ১২টায় পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগরের দিকে এগিয়ে যান। রেডিও পাকিস্তান রাতের খবরে রাধানগর কমপ্লেক্সের পতনের কথা স্বীকার করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের ভারত সীমান্তবর্তী সামরিক গুরুত্বপূর্ণ নাভারন মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোয় আক্রমণ করে একটু একটু করে এগোতে থাকেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান এদিন পূর্ব পাকিস্তানে ভারত সীমান্ত বরাবর পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে নোট পাঠায়। ইয়াহিয়া খান স্বাক্ষরিত নোটটি সকালে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির হাতে দেন।
পাকিস্তানে সফররত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান ওলেকজাস রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বলেন, প্রয়োজনে তুরস্ক পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।
অধিকৃত বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে শেখ মুজিবকে মার্জনা করতে তারা এক তারবার্তায় ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়। বিচার সম্পকে৴ কমিশন পাকিস্তানকে কিছু প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট উত্তর দিতে বলে।
পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সংসদে নীতিসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে কি না, তা এখনো ঠিক হয়নি।
জাতিসংঘের একটি সূত্র জানায়, ভারত বা পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ না জানালে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসার সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লিয়েন আলবেনিয়া সফরকালে এক অনুষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তান-ভারত বিরোধ মীমাংসা করার আহ্বান জানান।
৩০ নভেম্বর – ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস: ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩০ নভেম্বর শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে সেনা ফিরিয়ে নিতে বলেন। তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফর নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শেষে ইন্দিরা প্রস্তাবটি দেন। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস। ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের তাঁরা নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারেন না।
ইন্দিরাকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক চিঠি নিয়ে এদিন মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে আলোচনা হয়। নিক্সনের যুক্তি খণ্ডন করে দ্রুত চিঠির জবাব পাঠানো হবে।
চিঠিতে নিক্সন অভিযোগ করেছেন, সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাসের প্রস্তাবে ভারত অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। নিক্সন ভারতকে সংযত হতে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিতে বলেন।
রাতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ববঙ্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে
জাপানের টোকিও রেডিওতে বলা হয়, চীন পাকিস্তানকে আবার অস্ত্র দিতে শুরু করেছে। বেইজিং থেকে তারা এ খবর পেয়েছে। পিকিং থেকে পাকিস্তানে সামরিক বিমান সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে এদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দুটো দাবিই নাকচ করে দেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনার জন্য পূর্ববঙ্গের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিনকে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর রণকৌশলে বদল
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এখন রণকৌশল পাল্টেছেন। হিট অ্যান্ড রান বা আক্রমণ করেই ফিরে আসার কৌশল ছেড়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দখল করে সেখানেই অবস্থান নিচ্ছেন। এরপর পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুত হচ্ছেন। সব সেক্টরেই এই নীতি চলছে।
বলা হয়, অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে দ্রুত সেনা নিয়ে এসে সেনানিবাস ও গ্যারিসনে সমবেত করছে। জেলাগুলোর বহু এলাকা কার্যত মুক্ত। ঢাকা-বরিশাল নদীপথে যোগাযোগ এবং ঢাকা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যশোর শহরের দিকে অভিযান এদিনও অব্যাহত থাকে। ভারতীয় সেনা সহায়তায় পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতে বোমা ফেলে তারা চাপ সৃষ্টি করে।
সিলেট অঞ্চলে নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর মুক্ত করে বিজয় উদ্যাপন করেন।
টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি নাগরপুর দখলের উদ্দেশ্যে ২৯ নভেম্বর কেদারপুরে সমবেত হন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা শান্তিবাগে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের ওপর অভিযান চালালে দুজন নিহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরে যৌথ বাহিনী পঞ্চগড়ের বোদার উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। পথে ময়দান দিঘির কাছে পুটিমারীতে পাকিস্তানি সেনাদের বাধার মুখে পড়লে সেখানেই প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে।
সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে পাঁচ মাইল দূরে লুবাছড়া চা-বাগান এলাকায় সমবেত হন। ২৬ নভেম্বর রাতে তাঁরা সেখানে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পরের রাতে বড় চাতলাপুর গ্রামাঞ্চলে অগ্রাভিযান শুরু করেন। এখানে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেন। গ্রামের সামনে ও পেছনে দুইদিকেই তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেন, যাতে কানাইঘাটের পাকিস্তানি সেনারা পালাতে না পারে, আবার বাইরে থেকে নতুন সেনারা এসে যুক্তও না হতে পারে।
পাকিস্তানি সেনারা কামান দিয়ে তাঁদের আক্রমণ শুরু করে। প্রবল আক্রমণের মুখেও তাঁরা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান ধরে রেখে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ১৮টি স্থানে অভিযান চালিয়ে আজ রংপুর ও পঞ্চগড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড় ত্যাগে বাধ্য হয়।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ভারতীয় আক্রমণের চাপে পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে পাকিস্তান সেনারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ আজ স্বীকার করে। এক সরকারি মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫ বর্গমাইল এলাকা এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খানকে তাঁর বাসভবনে নজরবন্দী এবং তাঁর গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিচ্ছে।