ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
ডিসেম্বর ০১: জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো নিয়ে উত্তেজনা
নিউইয়র্কে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা ১ ডিসেম্বর জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য পাকিস্তানের অনুরোধটি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের জন্য পাঠিয়েছেন। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, উ থান্টের অনুরোধে তাঁর কাছে লেখা ইয়াহিয়ার চিঠির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, এটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের রক্ষা করার অপপ্রয়াস। কারণ, ইয়াহিয়া খান যখন সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সবাই নীরব দর্শক হয়ে ছিল।
রাজনৈতিক মীমাংসা তিরোহিত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে বলেন, মুক্তিবাহিনী যশোরের দোরগোড়ায়। যশোরের পতন হলে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়তিনির্ধারক পথে মোড় নেবে।
ভারত সরকারের একটি সূত্র জানায়, ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা নিক্সনের চিঠির কারণে রাজনৈতিক মীমাংসার অবশিষ্ট সুযোগ শেষ। কারণ, চিঠিটি ইসলামাবাদের একগুঁয়ে মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাবটিকে দিল্লির রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘকে জড়ানোর কৌশল বলে ভাবছেন। এর পেছনে তারা ওয়াশিংটনের হাত আছে বলে মনে করছে।
মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন শমশেরনগর শহর ও তৎসংলগ্ন বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রংপুরের কুড়িগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাগেশ্বরীর দখল নিয়ে নেয়। এরপর তাঁরা ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রাম দখলের জন্য লড়াই চালাতে থাকে। পঞ্চগড়ের বোদায় তুমুল যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
খুলনার কালীগঞ্জ মুক্ত
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সাংসদ ফণীভূষণ মজুমদার, তোফায়েল আহমেদসহ বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব কে এ জামান ও পুলিশের আইজি আবদুল খালেক এদিন মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির ঢাকা অফিসে বিস্ফোরণ ঘটান।
শান্তিবাগে গেরিলাদের অভিযানে মুসলিম লীগের দুজন নেতা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
বিদেশি গণমাধ্যমের মন্তব্য
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান-এর এক সংবাদে এদিন বলা হয়, ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও জাতিসংঘের ১৩১ সদস্যদেশের একটিও এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ঢাকা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন আরও একজন উপাচার্য, আওয়ামী লীগের আটজন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং দুজন রাষ্ট্রদূত।
দ্য টাইমস ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এক খবরে বলে, ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন পূর্ণ স্বাধীনতা। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের এ মনোভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী রিচার্ড উড লন্ডনে বলেন, তাঁর ধারণা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। তবে তারা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।
সংবাদ সংস্থা এবিসির হংকং ব্যুরোর প্রধান বাংলাদেশ থেকে এক প্রতিবেদনে জানান, কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা শহরের কাছে এক গ্রামে নির্বিচার প্রায় ৭৫ জন নরনারীকে হত্যা করে। কারণ, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তিনি নিজেও পরে ঘটনাটি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা যত্রতত্র গ্রামবাসীদের হত্যা করছে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জিনজিরার লোকেরা সংবাদদাতাকে জানান, ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যা থেকে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৮৭ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অগণিত মৃতদেহ।
২ ডিসেম্বর: মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা রুখতেই পর্যবেক্ষক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে চায়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন ব্যবস্থা নিতে চায়। ভারতকে আক্রমণকারী বললে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে পাঠানো এক নোটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নোটটি কবে পাঠানো হয়েছে তা বলা হয়নি।
মুজিবনগরে একটি সূত্র জানায়, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অবশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান সম্প্রতি বদলি হয়ে ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের রিয়াজ রহমানই একমাত্র কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
৩ ডিসেম্বর – পাকিস্তানের আক্রমণ, সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ভারতে একতরফা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এই দিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের পাকিস্তানি অবস্থানগুলো ঘিরে ফেলার জন্য সীমান্তের সাতটি এলাকা দিয়ে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে।
ইন্দিরার বেতার ভাষণ
ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু করার সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। রাতেই দিল্লিতে ফিরে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাতে বেতার ভাষণে বলেন, এই যুদ্ধ বাংলাদেশের এবং একই সঙ্গে ভারতের। ভারতবাসীকে তিনি দীর্ঘ কৃচ্ছ্রতা ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের কাছে তিনি একটি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ বন্ধ করার সমাধান চেয়েছিলেন। এ জনগোষ্ঠীর একমাত্র অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটদান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
ফরাসি যুবকের বিমান ছিনতাই
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে ৩ ডিসেম্বর সকালে জঁ ক্যা নামে এক ফরাসি যুবক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বোয়িং-৭২০ বিমানটি ৩ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে যাত্রা করে। প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে এটির করাচি যাওয়ার কথা ছিল।
প্যারিস থেকে এটিতে পাঁচজন যাত্রী ওঠেন। নিরাপত্তাব্যূহ পেরিয়ে তাঁদের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যাও বিমানটিতে উঠে বসেন। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পাইলট বিমান চালু করতেই জঁ ক্যা পিস্তল বের করে তাঁকে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্দেশ না মানলে বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধরত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দেওয়ার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি হাজির হয়। চারজন পুলিশ গাড়ির স্বেচ্ছাসেবকের পোশাকে বিমানে ঢুকে রাত আটটায় জঁ ক্যাকে আটক করেন। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর বক্তব্যে অনুপ্রাণিত জঁ ক্যা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার উপায় খুঁজতে গিয়ে জুন মাসে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিলো ফ্লাইটের সফল অভিযান
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা ভারতের কৈলাস বিমানঘাঁটি থেকে ৩ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান চালান। রাত ২টায় ৩০০ ফুট উঁচুতে উড়ে শামসুল আলম (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও আকরাম আহমদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি বিমান চট্টগ্রাম তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেয়। আবার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে সুলতান মাহমুদ ((স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও বদরুল আলমের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি হেলিকপ্টার।
সিলেটে ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে কানাইঘাটের পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে সকাল সাতটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। সাড়ে আটটায় কানাইঘাট মুক্ত হয়। যুদ্ধে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।
৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার শমশেরনগরও মুক্ত করেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ঠাকুরগাঁও শহর দখল করেন। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁওয়ে আশ্রয় নেয়। ৩০ নভেম্বর সেনারা ভুল্লি সেতু উড়িয়ে দেয়। যৌথ বাহিনী সেতু সংস্কার করে ১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরের কাছে পৌঁছে যায়। ২ ডিসেম্বর রাতে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। সকালে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করেন।
যেকোনো সময় স্বীকৃতি
মুজিবনগর, কলকাতা ও দিল্লিতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভারত যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে এবং একই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ কারণে তিনি ডেনমার্কে চলমান সফর সংক্ষিপ্ত করতে পারেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পুরো ক্ষমতা দাবির শর্তে অসামরিক যৌথ মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে তিনি রাজি আছেন।
৪ ডিসেম্বর – নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকতে ৪ ডিসেম্বর উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ জরুরি বৈঠক ডাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিয়নের রাষ্ট্রদূত ইসমাইল টেলর কামারাকে চিঠি দেয়।
চিঠিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়া। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পরিষদের সভাপতির কাছে বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক প্রতিবেদনে নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ডেনমার্ক সফররত সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সংঘর্ষ এড়াতে তাঁরা সাধ্যমতো সব চেষ্টা করেছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করে এ সংকট ডেকে আনা হয়েছে। ডেনিস সংবাদ সংস্থা তাঁর এক সফরসঙ্গীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে জানায়, এ যুদ্ধে এখনই হস্তক্ষেপ করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে না।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণই লক্ষ্য
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণই তাঁদের লক্ষ্য। ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার স্থাপনে সহায়তা করতে চায়।
দিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিশেষ অধিবেশনে জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছে। তারা বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বড় ফাটল ধরিয়েছে। কয়েকটি শহরের পতন হয়েছে।
চীন-ভারত সীমান্তের পূর্ব বা পশ্চিমে চীনা সেনা সমাবেশের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণশীল মনোভাবের অভিযোগ এনেছে চীন। ভারতকে সমর্থন জানানোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করে চীন। একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
যুদ্ধ ঘোষণার পরে
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন ছিলেন মুক্তাঞ্চলে।
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের প্রথম দিনই মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চারদিক থেকে যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা দখল এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের যুদ্ধেই বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অর্ধেকের বেশি বিমান এদিন বিধ্বস্ত হয়।
২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার দেবীদ্বার মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী দেবীদ্বারসহ কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেছিল। ভারতের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় অভিযান চলে। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংকবহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানিরা রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে চার ঘণ্টা লড়াই করে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দর্শনার ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে তারা পিছু হটে গেলে ৪ ডিসেম্বর দর্শনা শহর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী এই সেক্টরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার জীবননগরও মুক্ত করে। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেলে জীবননগর চূড়ান্তভাবে মুক্ত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী মুক্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ফুলবাড়ীর বেতদিঘী, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রানী, আমড়া ও রানীনগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে শহরের পশ্চিম পাশে ছোট যমুনা নদীর ওপর লোহার সেতুর পূর্ব অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে শালচূড়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। আহমদনগর হেডকোয়ার্টারের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাতেই ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শক্রমুক্ত হয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে পতাকা ওড়ান।
১১ নম্বর সেক্টরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কামালপুর সীমান্তঘাঁটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৩ ডিসেম্বর কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। বকশীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) সে চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যান। চিঠি পেয়ে ক্যাম্পের অধিনায়ক আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। বশীরের ফিরতে দেরি হওয়ায় আরেকটি চিঠি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জুকে পাঠানো হয়। অবশেষে বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবিসহ ১৬২ জন সেনার একটি দল ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। শত্রুমুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর।
৫ ডিসেম্বর : যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সোভিয়েত ভেটো
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় বাংলাদেশসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
এই প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ প্রস্তাবটি পেশ করে বলেন, এ সমস্যা সমাধানে পরিষদ বলপ্রয়োগের নীতি নিতে পারে না।
সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য বলে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব আনেন।
সে প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার আগে বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের অত্যাচার বন্ধের দাবিও তোলা হয়।
সোভিয়েত বলে, অবস্থার অবনতির কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার।
বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব করে। তীব্র আপত্তি জানিয়ে চীনা প্রতিনিধি বলেন, এতে জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে।
ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বিষয়টি যথাযথ পটভূমিতে বিবেচনা করতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।
পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, পাকিস্তানকে টুকরো টুকরো করতে ভারত পাকিস্তানে হামলা করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে ভোট দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি, আর চীন ভোটে অংশ নেয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরি অধিবেশন বসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি রাষ্ট্রের অনুরোধে। স্থির হয় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা বিতর্কে অংশ নিলেও তাঁদের ভোটাধিকার থাকবে না।
চীন তাদের খসড়া প্রস্তাবে বলে, পাকিস্তানি এলাকা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে হবে।
পাকিস্তানকেও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রস্তাবে ভারতীয় আক্রমণ রুখতে সংগ্রামে লিপ্ত পাকিস্তানি জনগণকে সমর্থন করতে সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব নিয়ে সোভিয়েত ও চীনের প্রতিনিধির মধ্যে বাগ্যুদ্ধ হয়। চীনের প্রতিনিধি বলেন, এ প্রস্তাব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সমতুল্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এদিন বিশ্বশক্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। সতর্কবাণীতে বলা হয়, সোভিয়েত সীমান্তের কাছে যে অবস্থা চলছে, তাতে তাদের নিরাপত্তা-স্বার্থ জড়িত। তারা এতে উদাসীন থাকতে পারে না।
চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সানডে টাইমস পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ওয়াশিংটনে তাঁর প্রধান সহকর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁরা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের সোভিয়েত ভেটোর নানা দিক বিচার করেন।
ওয়াশিংটন থেকে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র এদিন এক সরকারি বিবরণ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, উইলিয়াম রজার্স তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করেছেন।
তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে একটি স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সত্যের অপলাপ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত।
বাংলাদেশের আকাশ মুক্ত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এদিন ভারতীয় বাহিনীর বিমানগুলো ঢাকাসহ বাংলাদেশের আকাশ দখল করে নেয়। সেগুলো আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ঢাকার তেজগাঁওসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটি ও বন্দর অচল করে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে।
ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা-রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর-রাজশাহীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ অটুট ছিল।
একটি বড় যুদ্ধ হয় লাকসামে, আরেকটি ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুই লড়াইয়েই পাকিস্তানি বাহিনী বিধ্বস্ত অবস্থায় পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। পাকিস্তানি বাহিনী একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে।
কিছু পাকিস্তানি সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালায়। এখানে প্রায় ১৬০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত হয়।
সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলোফ্লাইট এদিন সিলেট অঞ্চলে বোমা ফেলে কয়েকটি পাকিস্তানি বাংকার উড়িয়ে দেয়। জামালপুরে বিমান হামলায় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
বাংলাদেশের সত্তা স্বাধীন
ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, একটি আলাদা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ভারত স্বীকার করে নিয়েছে।
এখন বাকি আছে শুধু সরকারের স্বীকৃতি। শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এর জবাব পাওয়া যাবে।
৬ ডিসেম্বর – বাংলাদেশকে ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি:
বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সংসদে এ ঘোষণা দেন।
পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে চিঠি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা দেন, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে বলেন, বিরাট বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের মন পড়ে রয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে।’
পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
স্বীকৃতির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডকেও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শাহীন সামাদ, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলা মোমেন, শারমিন মুরশিদ প্রমুখ শিল্পী ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেন।
আবার সোভিয়েত ভেটো
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করে।
প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে।
রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়।
জর্জ বুশ ভারতকে পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক বলেন, শান্তির জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার নীতির ভিত্তিতেই এই প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তদনুসারে প্রস্তাবটি অবিলম্বে বিচার করে দেখতে হবে। ভারতের প্রস্তাবটি তিনি ভোটে দিতে চাইলে ভারত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ যুদ্ধের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত একটা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি থাকে। আবার অধিবেশন শুরু হলে বর্তমান বিরোধের মানবিক দিক সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট একটি বিবৃতি পেশ করেন।
এরপর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি, বিপক্ষে ১১টি। ১০টি রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। কয়েকটি দেশ অনুপস্থিত থাকে। সাধারণ পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩১।
ভারতের আক্রমণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে চীন আরেকটি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি প্রস্তাব আনে। কোনোটিই ভোটে দেওয়া হয়নি।
এর আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই মর্মে দাবি জানায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণ নিয়ে আনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হলে তা বলবৎ করা যাবে না।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা শুরু হয়। আর্জেন্টিনা প্রস্তাব উত্থাপন করে দুই দেশকে অস্ত্র সংবরণ করে সীমান্তের দুই দিকে তাদের সেনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলে।
নিরাপত্তা পরিষদেও অনুরূপ প্রস্তাব তোলা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিলে প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের প্রস্তাবে বলা হয়, বিষয়টি সাধারণ পরিষদের বিচার্য হতে পারে কি না, সেটা পরিষদের কার্য পরিচালনা কমিটিতে তা বিচার করে দেখতে বলা হোক।
যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যশোর-সিলেট
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত যশোরের এদিন পতন হয়। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরাও মুক্ত হয়। পতন হয় সিলেটেরও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।
যৌথ বাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। বয়রা ও বেনাপোল থেকেও যৌথ বাহিনী যশোরের দিকে এগোয়। ততক্ষণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা যশোর থেকে পালিয়েছে। শ দুয়েক সেনা ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করে।
ঝিনাইদহ ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ঢাকার দিকে, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার দিকে।
সিলেটের পতন হয় যশোরের কিছুক্ষণ পর। যৌথ বাহিনী প্রথমে শালুটিকর বিমানবন্দর দখল করে। সেখানে যৌথ বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর চারদিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তান সেনারা পিছু হটে মেঘনা নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়।
এদিন আরও মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা, শেরপুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, বাগেরহাটের মোংলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দিরাই।
ভুটানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র সংবাদটি প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।
ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান, তিনি কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। এর প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রধান নুরুল আমিন। সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।
চীনের প্রতি সোভিয়েত সতর্কবাণী
পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভাষণে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ডাক দেন। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, তিনি বাইরের শক্তি বলতে চীনকেই বুঝিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা কলকাতা থেকে পাঠানো এক খবরে বলেন, ভারতীয় সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন, অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করাই তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাঁর বক্তব্য প্রচারপত্র হিসেবে পাকিস্তান সেনা-অধ্যুষিত এলাকায় বিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেন, ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য দুনিয়ায় সমস্ত দেশের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী দেশগুলোর কাছে আবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসভবনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ জাতীয় পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সুচিত্রা মিত্র ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গান। বক্তব্য দেন অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।
মুজিবনগরে একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে স্থির হয়েছে, ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ সরকার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর জঙ্গিশাহির নির্যাতন এবং ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার চীনের সরকারি নীতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে, তারাই একেবারে চুপ করে আছে, এটি বড়ই দুঃখের বিষয়।
৮ ডিসেম্বর : যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানবে না ভারত
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র ৮ ডিসেম্বর বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কোনো চাপের মুখেই ভারত মানবে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত একটি বৈধ সরকার বলে মনে করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বৈঠকে সবাই একমত হন যে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে কোনো যুদ্ধবিরতি মানা সম্ভব নয়।
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন নতুন কোনো প্রস্তাব করেছিলেন বলে ভারতের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশকে ভারত বারবার বলেছে, রাজনৈতিক সমাধান করার একমাত্র উপায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচিত সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁকে আলোচনা করতে দেওয়া।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে দেশটির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সহকারী প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্কের পথে রওনা দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের অনুরোধে এদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহিও উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন। উ থান্ট ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানান। জাতিসংঘের লোকজন ও বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য দুই দেশের সরকারকেও অনুরোধ জানানো হয়।
মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা এদিনও অব্যাহত থাকে। বিমানঘাঁটিসহ কুমিল্লা শহর এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনামুক্ত। মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এদিন শুরু হয় ময়নামতি সেনানিবাস দখলের লড়াই। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা এখন স্বাধীন। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ করা হয়। চট্টগ্রামের রামগড় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।
যশোর শহর থেকে যৌথ বাহিনী চতুর্মুখী অভিযান চালায়। একটি দল ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা দখল করে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসংযোগ মুক্তিবাহিনীর অধিকারে আসে। যৌথ বাহিনীর তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সেনারা মাগুরা থেকে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যায়।
যশোর থেকে একটি দল এগোয় নড়াইলের দিকে। আরেকটি দল সাতক্ষীরা ও কলারোয়া দখল করে। যশোর-কালীগঞ্জ খণ্ডে খুলনার পথে লেবুতলা যৌথ বাহিনীর দখলে। কুষ্টিয়া এখনো অবরুদ্ধ।
পদ্মার উত্তর তীরে রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে মুক্তিবাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজশাহী ও পাবনার সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাটের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। চুয়াডাঙ্গা অবরুদ্ধ। মেহেরপুর মুক্ত করে যৌথ বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় গোলাবর্ষণ করে। খুলনা শহরে গোলাবর্ষণ অব্যাহত। ঝিনাইদহের কাছে পিছু হটার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি সেতু ধ্বংস করে যায়। এখানে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে রংপুর শহরের পতন আসন্ন। পীরগঞ্জ এখন মুক্ত। সৈয়দপুরের উত্তরে একটি পাকিস্তানি ঘাঁটি যৌথ বাহিনীর দখলে।
রাতের মধ্যে মুক্ত হয় সিলেটের শ্রীমঙ্গল, রংপুর-দিনাজপুরের দুর্গাপুর ও বাদুড়িয়া এবং যশোর-খুলনার রূপদিয়া ও লেবুতলা।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ জন সেনা এদিন মুজিবনগরে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী তাঁদের স্বাগত জানান। এই সেনারা লাহোরে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় চারজন কর্মকর্তাসহ ওই সেনারা অস্ত্রশস্ত্রসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এদিন মুক্ত কুমিল্লা পরিদর্শন করেন। সকালে যৌথ বাহিনী বিমানবন্দরসহ কুমিল্লা শহর দখল করে।
অরোরা বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা লাগিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছালে জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। ভারতীয় বাহিনীর পদস্থ কোনো কর্মকর্তা হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফর করলেন।
বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের কাছে এক ধন্যবাদ বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ-ভুটান বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেন, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন। ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রজ্ঞায় বাঙালি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি অন্ধতার পরিচায়ক। চীনও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ।
৯ ডিসেম্বর – ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড

দিল্লিতে ৯ ডিসেম্বর রাতে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কী রণকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েক দিন আলাপ-আলোচনার পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি সামরিক যুদ্ধ কমান্ড গঠিত হয়েছে।
ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণায় আরও বলা হয়, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একযোগে কাজ করছে। এ চুক্তিতে দুই বাহিনীর সমঝোতার আইনগত ভিত্তি দেওয়া হলো। দুই বাহিনী পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। দায়িত্ব থাকবে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের অপসারণের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে বিদেশি বিমান নির্বিঘ্নে অবতরণের সুবিধা দিতে ভারত সম্মতি দেয়। এ জন্য ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকা বিমানবন্দরে কোনো আক্রমণ না চালাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দিল্লির সরকারি একটি সূত্র জানায়, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে তোলা প্রচারণার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে জোর চেষ্টা চালাতে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে শক্তিশালী করার জন্য পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এবং সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি পার্থসারথীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাউল প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংও নিউইয়র্ক যেতে পারেন।
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাঁচতে চাইলে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন
দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিশন। বাংলাদেশের পতাকা তুলে উদ্বোধন করেন মিশনপ্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ভারতকে কৃতজ্ঞতা জানান।
বাংলাদেশের জনগণের হাতে ধরা পড়া পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এদিন বাংলাদেশ সরকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, ধৃত পাকিস্তানিদের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করা হবে এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ লাখ বাঙালিকে নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে।
মুজিবনগরে এদিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার এদিন সেনানিবাস বাদে মুক্ত কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করে। ৯ মাস পর সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসে। বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে কুমিল্লায় এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ৯ মাস যাঁরা পাকিস্তানি বেয়নেটের মুখে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিবাহিনী পুলিশের দায়িত্ব নেয়।
ঢাকার দ্বারপ্রান্তে চূড়ান্ত লড়াই
বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই এ সময় রাজধানী ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। একটি দল ঢুকছে আশুগঞ্জ দিয়ে ভৈরব বাজার হয়ে। আশুগঞ্জে যুদ্ধে নতি স্বীকার করে মেঘনার বিরাট রেলসেতু ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়েছে। আরেকটা দল এগোচ্ছে দাউদকান্দির দিক দিয়ে।
সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়েছে। উত্তর দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এগোচ্ছেন জামালপুর হয়ে। পশ্চিমে যৌথ বাহিনী মধুমতীর তীরে। সেটি পেরোলেই পদ্মা। কুষ্টিয়ার দিক থেকে আরেকটি বাহিনী এগোচ্ছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে মিত্রবাহিনীর সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী। চূড়ান্ত লড়াই শুরুর প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর গানবোট পদ্মা ও মেঘনায়।
চুয়াডাঙ্গা ও চাঁদপুর শহরে এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ঝিনাইদহকে পাশ কাটিয়ে যৌথ বাহিনী পৌঁছে যায় কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে। যৌথ বাহিনী এগিয়ে চলেছে রংপুরের দিকেও। দিনাজপুরে শহরের ১০ মাইল দূরে লড়াই চলছে। কুমিল্লার সন্নিহিত ময়নামতি পাকিস্তানি সেনাদের দখলে, কিন্তু তাদের পালানোর পথ রুদ্ধ। ঢাকার উত্তর-পূর্বে আশুগঞ্জ ফেরিঘাট যৌথ বাহিনীর দখলে। যৌথ বাহিনী খুলনার দিকে এগোচ্ছে। যৌথ বাহিনী জামালপুর ঘিরে রেখেছে। পতন যেকোনো মুহূর্তে।
১০ ডিসেম্বর : ভারতকে চীনের প্রচ্ছন্ন হুমকি
চীন ১০ ডিসেম্বর ভারতকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতির আবেদন মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলে, তা না হলে ভারতকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হবে। বেইজিং বেতার থেকে খবরটি প্রচার করা হয়। চীনের সরকারি মুখপত্র পিপলস ডেইলিতেও এক সংবাদভাষ্যে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বিশ্বের মতামত উপেক্ষা করে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকলে তার পরিণতি লজ্জাকর পরাজয়। পত্রিকাটি বলে, চীন পাকিস্তানের সংগ্রাম দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
সোভিয়েত বার্তা সংস্থা তাস-এর এক প্রতিবেদনে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে একপেশে বলে ভারতবিরোধী বলে উল্লেখ করা হয়।
শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন

বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর গানবোটগুলো মংলা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছায়। এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গি বিমান। শত্রুবিমান ভেবে মো. রুহুল আমিন সহযোদ্ধাদের সেগুলো প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। তাঁদের বহরে থাকা একটি ভারতীয় গানবোট থেকে জানানো হয়, ওগুলো ভারতীয় বিমান।
বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কেউ কেউ অক্ষত থাকেন। রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। বোমার স্প্লিন্টার লেগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সহযোদ্ধা তাঁকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন।
আহত রুহুল আমিন কোনোমতে সাঁতার কেটে নদীর পুব পারে পৌঁছান। সেখানে ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও অনেক রাজাকার। তারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। নদীর তীরে পড়ে থাকে তাঁর বিক্ষত মরদেহ। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা নদীর তীরের একটি স্থানে তাঁকে সমাহিত করেন।
চূড়ান্ত যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নোয়াখালী শহর উদ্ধার করে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর শহর পতনের মুখে।
ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলা কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। জামালপুরে বিকেল চারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে পাঠিয়ে উত্তর দেয়, অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করেন।
ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
ঢাকায় তৎপরতা
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের একটি প্রস্তাব তাঁর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী খানের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা হয়। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্ত ছিল এ রকম:
১. পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে;
২. বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হবে না;
৩. প্রায় এক লাখ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে;
৪. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; এবং
৫. জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে অধিকৃত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি পরিকল্পনার সূচনা হয়।
১১ ডিসেম্বর : মুক্তাঞ্চলে সরকারের প্রথম জনসভা

যশোর সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল চারটি হলো মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে পৌঁছালে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায় বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন: ১. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। ২. ফেলে যাওয়া জমি ও দোকান ২৫ মার্চের আগের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চাষ হয়ে থাকলে চাষি বর্গাদার হিসেবে অর্ধেক ফলন পাবেন। ৩. যেকোনো ধর্মের যেকোনো নাগরিকের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর সাজা দেওয়া হবে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে তাঁর দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী এবং অন্য দল ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একযোগে স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করে তোলার নির্দেশ দেন।
চীন যুদ্ধে জড়াবে না
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বেইজিংয়ের কূটনৈতিক মহল বলছে, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারত আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সিনেটর ফ্র্যাংক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য পাকিস্তান অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
১২ ডিসেম্বর : ঢাকা দখলের লড়াই

মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত।
আগের দিন ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা ঢাকার আশপাশে মুক্ত কিছু এলাকায় নেমে পড়েন। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলছিল।
ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। ঢাকা মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে।
আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমশ ঢাকার দিকে আগুয়ান। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা।
হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলেও মোটেই রুখতে পারেনি।
যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার উপকণ্ঠে পৌঁছায়। হিলি থেকে এগিয়ে তারা বগুড়া শহর থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থান নেয়।
বগুড়ার পতন আসন্ন। চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় সেনানিবাস ও শহরের আশপাশে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে।
কক্সবাজারে ধ্বংস হয় একটি গানবোট ও দুটি জাহাজ। রাঙামাটিতে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনারা মিয়ানমারের দিকে পালাতে থাকে।
নুরুল আমিনের তৎপরতা
নুরুল আমিন এদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।
উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীন সরকারকে জানাতে তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান।
নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।
ইন্দিরার সাবধানবাণী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক জনসভায় চলমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি যেন কাজে লাগানোর চেষ্টা না করা হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এদিন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে আপসরফা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছেন।
দিল্লি ও মুজিবনগরের সূত্রগুলো এদিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
ভারত মহাসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর রওনা হওয়ার খবর জানাজানি হলে দিল্লি ও মুজিবনগরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা ১৩ ডিসেম্বর জানান, সপ্তম নৌবহরের পরমাণুশক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ আরও কয়েকটি জাহাজ, ডেস্ট্রয়ারসহ ১০ ডিসেম্বর সায়গনের দরিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
হংকং উপসাগরে এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে কর্তব্যরত বিমানবাহী জাহাজ কন্সটেলেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এন্টারপ্রাইজ এবং তার সহযোগী সব জাহাজকে সিঙ্গাপুরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এন্টারপ্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী জাহাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অপসারণের ব্যাপারে তাঁর দেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এন্টারপ্রাইজের ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করার খবরটি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। ঢাকায় আটকে পড়া কয়েক শ নাগরিককে উদ্ধার করার জন্য এই শক্তি প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয়। সপ্তম নৌবহর যাত্রা করে থাকলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্যই তা করা হচ্ছে।
আবার সোভিয়েত ভেটো
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দিনের শেষে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও রাতে সেই বিতর্ক শুরু এবং এদিন আরেকটি মার্কিন প্রস্তাবের সমাধি ঘটে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তাবটি আনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
ভেটো প্রয়োগের আগে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্ক শুরু হওয়ার পরপরই ইয়াকব মালিক বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংও একই অনুরোধ করেন। এতে আপত্তি জানিয়ে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি বলেন, এ ধরনের কাজে বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি হবে এবং বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এরপর ইয়াকব মালিকের অনুরোধ নাকচ করে দেন নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি।
নিউইয়র্ক টাইমস ওয়াশিংটন থেকে আরেক খবরে জানায়, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সাহায্যার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানোর অনুমতি তৃতীয় দেশকে দিতে পারেন। খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সম্প্রতি ইরান, তুরস্ক, জর্ডান, সৌদি আরব ও লিবিয়ার কাছ থেকে অবিলম্বে অস্ত্রাদি চেয়েছে।
প্রথম চারটি দেশে বিপুল মার্কিন অস্ত্র মজুত আছে। কংগ্রেসকে না জানিয়েই প্রেসিডেন্ট এই অস্ত্র হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারেন। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র অবশ্য এভাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের কথা অস্বীকার করেন।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং ভারতের সমস্যা উপলব্ধি না করায় জাতিসংঘের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ এবং অন্য দেশগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা না করলে উপমহাদেশের ঘটনা গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
পাল্টা সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ
নিউইয়র্ক টাইমস ওই খবরে ওয়াশিংটনের একটি খবর উদ্ধৃত করে আরও বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তি জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারত মহাসাগরে একটি রাশিয়ান নৌবহর সমবেত হয়েছে। প্রায় এক ডজন যুদ্ধজাহাজ এবং আণবিক শক্তিচালিত ১০টি সাবমেরিন এ নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে
ঢাকায় তিন দিক থেকে বেষ্টিত দখলদার পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কামানের আওতায় চলে আসে। ভারতের ছত্রী বাহিনী সুসংগঠিত। মুক্তি বাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান যোদ্ধারা নরসিংদী পেরিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে।
আরেক দল টাঙ্গাইল-মির্জাপুর হয়ে ঢাকার কাছে। তাঁরা এদিন জয়দেবপুর মুক্ত করেন। চাঁদপুরের দিক থেকে আসা যৌথ বাহিনী মেঘনা পেরিয়ে দাউদকান্দিতে। তারা শীতলক্ষ্যা নদী পেরোনোর চেষ্টা করছে। যমুনা নদীর বাধাও অতিক্রান্ত। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানান, ভারতীয় সেনারা ঢাকা থেকে মাত্র ১১ থেকে ১২ মাইল দূরে।
ইয়াহিয়ার মনোবল চাঙা করার চেষ্টা
মুজিবনগরে একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় সুনিশ্চিত বুঝতে পেরে রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে আদেশ দিয়েছেন, তাদের একাংশ যেন এখনই বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। ওয়াশিংটন মস্কোকে আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে এটাও চায় না যে পাকিস্তান ভেঙে পড়ুক।
এদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে শত্রুমুক্ত জেলাগুলোয় অবিলম্বে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১৪ ডিসেম্বর – বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ:
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন আলবদর বাহিনীর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।
২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সূচনা। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখকে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে দৈহিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এ ধরনের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ কয়েকটি এলাকায়। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়।
ঢাকা অভিমুখে সাঁড়াশি অভিযান
মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢাকায় অগ্রসর হয়। একটি বড় দল ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতী নদী অতিক্রম করে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর জন্য দলের দুটি ব্রিগেড পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান এড়িয়ে দুই ভাগে নদী পার হয়।
যৌথ বাহিনীর একটি ব্রিগেড মানিকগঞ্জকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে সাভারের দিকে এগিয়ে আসে। আরেক দল ঢাকার উত্তর দিকে তুরাগ নদের পারে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। পশ্চিম-উত্তর সীমানা বরাবর চন্দ্রা-সাভার-মিরপুর অঞ্চল ধরে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথ বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড।
ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ডেমরায় যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরোধব্যূহে আঘাত হানে। আরেকটি দল শীতলক্ষ্যা পার হয়ে রূপগঞ্জ মুক্ত করে।
মুক্তি বাহিনীর কে ফোর্সের অধিকাংশ দল মুড়াপাড়া পৌঁছে যায়। শীতলক্ষ্যা পার হয়ে তারা বালু নদের পারে অবস্থান নেয়।
হেলিকপ্টারে করে যৌথ বাহিনী গোমতী নদী পার হয়ে মেঘনাতীরবর্তী বৈদ্যেরবাজারে অবস্থান নেয়।
যৌথ বাহিনী কুমিরা অতিক্রম করে চট্টগ্রামের পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়। ভারতীয় রণতরি থেকে বিমান এসে চট্টগ্রামে আক্রমণ চালায়। কক্সবাজারেও হামলা চলে। পাকিস্তানি সেনাদের জলপথে পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
উত্তরাঞ্চলের বগুড়ায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তর ও সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। যৌথ বাহিনী বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যৌথ বাহিনীর ট্যাংক আস্তে আস্তে শহরে এগোয়। পাকিস্তানি সেনারা শহরে অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়।
যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের নতুন সূত্র
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের জন্য এদিন নতুন প্রস্তাব তোলে। পরিষদের সভাপতি বলেন, বিকেলের আগে অধিবেশন শুরু হবে না। তারপরও ঢাকার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালাতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের ছয় থেকে সাতটি জাহাজ মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে যায়।
ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনাকালে সদস্যরা এ নিয়ে সরকারকে ভীত না হওয়ার পরামর্শ দেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু আজোরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে বৈঠককালে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি ঠিক নয়।
মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর দীর্ঘ আলোচনা করেন।
মালিকসহ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ
ঢাকার প্রতিরক্ষাবেষ্টনী যৌথ বাহিনীর চাপে ভাঙতে শুরু করলে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন।
এর আগে সকালে গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) মালিক মন্ত্রিসভা ও প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শুরু হয়। খবর পেয়ে ভারতীয় তিনটি জঙ্গি বিমান সেখানে হামলা চালায়। মালিক দৌড়ে এয়ার রেইড শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই পদত্যাগপত্র লেখেন। এরপর তাঁর পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস-ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।
নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের সাতজন নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা সাহায্য করতে সামান্য বিলম্ব করলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর’র আগে পাঠানো বার্তার জবাবে দুপুরের পরে আসা এক বার্তায় ইয়াহিয়া খান যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দেন। নিয়াজি সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লেখেন।
ঢাকার উপকণ্ঠে যৌথ বাহিনী
মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন ঢাকার দুই মাইলের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনভর পাল্টা জবাব দেয়। মেঘনার দক্ষিণ তীরে দাউদকান্দি থেকে যৌথ বাহিনী নদী পেরিয়ে এসে চারদিক থেকে ঢাকা নগরীকে এঁটে ধরে।
মুক্তিবাহিনী সাভার মুক্ত করলে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে এসে ঢাকার প্রবেশপথ মিরপুর সেতুতে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। রাতে ভারতীয় বাহিনী সাভার থেকে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল থেকে আসা একটি দল পথে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। দিবাগত রাত দুইটার দিকে মীরপুর সেতুর কাছে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। তারা সেতু দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ওপাশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে।
ঢাকার বাসাবোতে মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। যৌথ বাহিনীর আরেক দল চট্টগ্রামের পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে এসে পৌঁছায়।
আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বিকেলে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে।
সপ্তম নৌবহর মোকাবিলায় সোভিয়েত রণতরি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৫ ডিসেম্বর পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়। বহরে ছিল আক্রমণক্ষম হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ত্রিপোলিসহ কয়েকটি রণতরি। ত্রিপোলিতে ছিল ২৩টি হেলিকপ্টার, অন্য জাহাজে ছিল ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলে অবতরণের উপযোগী জলযান।
সপ্তম নৌবহরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এদিন ২০টি সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা বলেন, ৯ ডিসেম্বর জাপানের দক্ষিণতম প্রান্ত এবং কোরিয়া উপদ্বীপের মধ্যবর্তী সুসিমা প্রণালির ভেতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত ফ্রিগেড এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণক্ষম ডুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরে রওনা দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে সপ্তম নৌবহর তার দিক পরিবর্তন করে।
ভারতের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, প্রথমে বলা হয়েছিল মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতে নৌবহর আসছে। তবে এখন বলা হচ্ছে, রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিদের অপসারণের জন্যই ওই নৌবহর আসছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর নাটক
পাকিস্তানের কোয়ালিশন সরকারের সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান ও জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন নাটকীয়ভাবে সব কয়টি খসড়া প্রস্তাব ছিঁড়ে সদলবল নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যান। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।
আগের দিন নিরাপত্তা পরিষদের স্বল্পস্থায়ী এক বৈঠকে পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশ দিতেও বলা হয়।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জেনেভা থেকে বিবৃতিতে জানায়, লড়াইয়ে অংশ নেননি, এমন যে কারও ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে।
বাংলাদেশ সরকার একতরফাভাবে ঘোষণা করে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য না হলেও এর সনদ এবং জেনেভা চুক্তিকে সম্মান দেবে। মানবিক অধিকারসংবলিত সনদকেও বাংলাদেশ পূর্ণ মর্যাদা দিচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর – মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধে বহুপ্রত্যাশিত বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনতা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম দেয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের। হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঢাকায় আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
এর আগে নিয়াজির নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনী ভোর পাঁচটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু করে। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশনাল অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে নিয়ে একটি সামরিক জিপ ঢাকার মিরপুর সেতুর কাছে এসে থামে।
নিয়াজির জন্য নাগরার বার্তা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জিপে রওনা দেন ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন সেনা কর্মকর্তা। বার্তাটিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’
এর আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়।
বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন। নিয়াজির প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে নাগরা নিয়াজির অফিসে পৌঁছান। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর বিদেশি বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর হাজার হাজার মানুষ মুক্তির উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকায় বেলা ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বত্র আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধাদের।
বেলা একটার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ, অন্য পক্ষে জ্যাকব ও নাগরা। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর দিতে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল, একাত্তরের ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিকেল পৌনে চারটায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও পরাজিত সেনারা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল চারটা। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের এক পাশে দুটি চেয়ার। অরোরা বসেন ডান দিকের চেয়ারে, বাঁয়ে নিয়াজি। অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজিকে। নিয়াজির কাছে কলম ছিল না। ভারতীয় এক কর্মকর্তা তাঁর কলম এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।
ঢাকা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাঠানো এক খবরে বলা হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার সময় নিয়াজি অশ্রুসিক্ত ছিলেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, তাঁদের সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
‘ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী’
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।