অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১ অক্টোবর ১৯৭১ – বাংলাদেশ প্রশ্নের ফয়সালার আশ্বাস পদগোর্নির
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ১ অক্টোবর দিল্লিতে বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশ প্রশ্নের ফয়সালায় তাঁর দেশ সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে। ভারত উপমহাদেশের বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির দিকে সোভিয়েত জনগণ বিশেষভাবে নজর রেখেছেন। তাঁর সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির দেওয়া ভোজসভায় তিনি এ কথা বলেন। ভারত উপমহাদেশের জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে একটি যুক্তিযুক্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতার প্রস্তাবও তিনি দেন।
ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আরও শরণার্থী আগমন বন্ধ করা একান্ত দরকার। পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বকে পাশ কাটিয়ে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাতে শুধু পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটেই করা হবে।
নিকোলাই পদগোর্নি হ্যানয় যাওয়ার পথে এক দিনের সফরে দিল্লি এলে তাঁকে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মিশনের কর্মী ও সমর্থকেরাও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছে। তবে দিল্লির কূটনৈতিক মহল মোটামুটি এই মত পোষণ করে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দিয়ে কাজ হবে না।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের আবদুশ শহীদ নামে আরেকজন বাঙালি কর্মী এ দিন হাইকমিশনের
দেয়াল টপকে পালিয়ে বাংলাদেশ মিশনে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং এ দিন ঢাকায় চীনের ২২তম বার্ষিক দিবস উপলক্ষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, বাইরের কোনো শক্তি পাকিস্তান আক্রমণ করলে তার দেশ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যোগ দেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স নিউইয়র্কে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের ক্রমাবনতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোমের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভারতে ব্যাপক হারে বাংলাদেশি শরণার্থী আসার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা দুজনই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা এ দিন ভারতে আসা শরণার্থী ও বাংলাদেশের দুঃসহ পরিস্থিতি নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। এ ছাড়া সোভিয়েত শান্তি কমিটির গতকালের বিবৃতি এবং সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়ন ও কারখানার শ্রমিকদের একটি বিবৃতিও প্রাভদা প্রকাশ করে। বিবৃতিতে তারা পূর্ব বাংলার জনগণ এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানায়। মস্কোর কূটনৈতিক মহল জানায়, এ থেকে স্পষ্ট যে সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে গণমাধ্যমে পালিত সতর্কতা থেকে তারা সরে এসেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর এ দিন মস্কো থেকে লন্ডন যাত্রা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত সফর–সম্পর্কিত ব্যবস্থা করার জন্য গত সপ্তাহে তিনি মস্কো যান। ইন্দিরা গান্ধী চলে যাওয়ার পরও তিনি সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মস্কো থেকে যান। লন্ডন যাত্রার আগে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ রাশিয়া বিভাগের মন্ত্রী এ এ কোমিভের সঙ্গে আলোচনা করেন।
বাংলাদেশ প্রশ্নের মীমাংসায় তিন শর্ত
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনীর অপসারণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সমাধানই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতিসংঘের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আবু সাঈদ চৌধুরী আরও বলেন, এই তিনটি শর্ত নিয়ে কোনো আলোচনা চলতে পারে না। এই শর্তগুলোতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন কি না সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো আশা নেই। তবে বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে বলা যায় যে এই তিন শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সমাধানই হবে না।
মুক্তিবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল নৌ কমান্ডো এই দিন চট্টগ্রাম বন্দরে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি গ্রিক ট্যাংকার ডুবিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে নৌ গেরিলাদের জোর তৎপরতায় বিদেশি জাহাজের নাবিকেরা চট্টগ্রাম বন্দর ও খুলনার চালনা বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলারা একটি পাকিস্তানি জাহাজের বেশ ক্ষতি করে। ঢাকাতেও পাকিস্তানি সেনারা দল না বেঁধে বাইরে যেতে পারছে না।

সোভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। তারা একই সঙ্গে গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধ করার দাবি জানায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিশ্ব জানে যে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে জাতীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ভারত-সোভিয়েত যৌথ বিবৃতির সমালোচনা
সিপিএম পলিটব্যুরো এ দিন এক বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সোভিয়েত-ভারত যৌথ বিবৃতির সমালোচনা করে বলে, এটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আশা করা গিয়েছিল, সোভিয়েত-ভারত চুক্তির পর বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস পাবে। কিন্তু তা হয়নি।
৩ অক্টোবর ১৯৭১ -যুক্ত বিবৃতিকে স্বাগত বাংলাদেশ সরকারের
বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে ৩ অক্টোবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে একটি বিবৃতি দেয়। মুজিবনগরে দেওয়া এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকার অভিমত প্রকাশ করে যে ক্রেমলিন বাংলাদেশ সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার মর্যাদা দেওয়ার এবং তাদের অনপনেয় ও আইনানুগ স্বার্থরক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষে৵ উপনীত হওয়ার সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন রয়েছে। ২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি পর্যালোচনা করা হয়।
নেপালের পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিক ও দূতাবাসের দ্বিতীয় প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান এ দিন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করেন। কাঠমান্ডুতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর এ সিদ্ধান্ত জানান। বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা শুরু হওয়ার পর তিনিই দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন।
১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে ফেনীর ছাগলনাইয়ার আমজাদহাটে পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটির পাশে অ্যামবুশ পাতেন। তাঁরা ২ অক্টোবর গভীর রাতে ঘাঁটির রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। ৩ অক্টোবর ভোর পাঁচটার দিকে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাংকার থেকে বের হওয়া মাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করলে দুজন মারাত্মক আহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পরশুরাম, অনন্তপুর, বিলোনিয়া ও ফুলগাজী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। একটি দল মুহুরী নদী পার হয়ে পরশুরামে অবস্থান নিলে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। অনন্তপুরে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েন। কয়েকজন পাকিস্তানিও হতাহত হয়। প্রায় একই সময়ে বিলোনিয়া সীমান্তে এবং ফুলগাজীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। বিলোনিয়া সীমান্তে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আরও সমর্থন
সোভিয়েত আফ্রো-এশীয় সংহতি কমিটি আরও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে এ দিন একযোগে বাংলাদেশে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। প্রাভদায় প্রকাশিত এ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর বিচারকে প্রহসন বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সংহতি কমিটি ঘোষণা করে, তারা চায় শান্তিকামী লোকদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হোক। বন্ধ হোক পূর্ব বাংলার প্রগতিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের বিচার। শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করা হোক।
জাপানের মাইনিচি ডেইলি নিউজ জানায়, বাংলাদেশের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক বাহিনীতে জাপান যোগ দেবে। জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সংস্থা এই বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য দুজন প্রতিনিধি পাঠাবে।
শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরছে না
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির সদস্য কংগ্রেসম্যান পিটার ফ্রেলিং গুসেন কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত মাচে৴ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি জঙ্গি শাসকদের আক্রমণের পর যাঁরা প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের স্থাপিত কেন্দ্রে একজন শরণার্থীও তাঁর নজরে পড়েনি। শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ঘটনায় ভারতের পূর্ব জার্মানির মিশন দেশটির জাতীয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ৭ অক্টোবর দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও মাদ্রাজে অনুষ্ঠেয় এ বছরের অনুষ্ঠানটি পূর্ব জার্মান সরকার এ দিন বাতিল করে। দিল্লিতে পূর্ব জার্মানির কনসাল জেনারেল এইচ ফিশার সাংবাদিকদের কাছে এ ঘোষণা দেন। ওই উৎসবের জন্য বরাদ্দ অর্থ শরণার্থী ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সকালে বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় বেলগাছিয়া গ্রামে হামলা করলে ১০ জন গ্রামবাসী নিহত হন। পাকিস্তানি সেনারা কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে প্রায় ৫০০ গ্রামবাসী প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের শিকারপুরে চলে যান। খবর পেয়ে শিকারপুরে অবস্থানরত একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেলে গ্রামবাসী আবার বেলগাছিয়া চলে যান।
৪ অক্টোবর ১৯৭১ – যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির নিন্দা
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি পাকিস্তানের নিন্দা করে দলের জাতীয় সম্মেলনে গ্রহণের জন্য ৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগের কারণে পাকিস্তান নিন্দনীয়। কারণ, তারা পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে দুভাবে। প্রথমত, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সেনাদের অত্যাচার বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের সব জনপ্রিয় নেতাকে মুক্তি দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা। কারণ, শেখ
মুজিবের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করেছিল। জনগণের ইচ্ছানুযায়ী তাদের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘকে প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার কারণে এশিয়ায় বিঘ্নিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনটি উদ্যোগের কথা বলেন। ১. উপমহাদেশে সংযম রক্ষা করা; ২. দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য কর্মসূচি প্রসার করা; ৩. কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করা। উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতকে তিনি সমভাবে দায়ী করেন।
৫ অক্টোবর ১৯৭১ – শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অনশন

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় পার্লামেন্ট হাউসের সামনে ৫ অক্টোবর তিনজন অনশন শুরু করেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার অন্তত এক কোটি ডলার জরুরি সাহায্য না দিলে তাঁরা অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান। অনশনকারীরা হলেন ইন্দোনেশীয় লেখক পল পেয়ার নোমো, পল ইভান ও মেলবোর্নের স্টিভ রুনি।
ইতালির বিশপ সম্মেলন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এই দিন এক আবেদনে ১০ অক্টোবর রোববার সারা দেশে অনশন পালনের দিন স্থির করে। ৪ অক্টোবর ষষ্ঠ পোপ পলের এমন একটি আবেদনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশপ সম্মেলন এ সিদ্ধান্ত নেয়। ভ্যাটিকানের সংবাদপত্র লোসার-ভাতোর রোসাত শরণার্থীদের দুর্দশার কাহিনি জানিয়ে ৪ অক্টোবর তিন পৃষ্ঠার একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে।
৬ অক্টোবর ১৯৭১ – চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে দুঃসাহসিক অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা ৬ অক্টোবর এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস করেন। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উত্তরে, হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল তিনটি বড় আকারের ট্রান্সফরমার। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এটির মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া প্রায় ১০০ জনের একটি দল।
মুক্তিযোদ্ধারা আগেই রেকি শেষ করে লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও বিমানবাহিনীর প্রধান) নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এ দিন রাতে উপকেন্দ্রটির কাছে অবস্থান নেন। পরিকল্পনামতো মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উপদল গোলাগুলি করে উপকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখে।
এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল উপকেন্দ্রের ট্রান্সফরমারের কাছে অবস্থান নিয়ে সেটিকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে। এতে ট্রান্সফরমারে আগুন ধরে যায় এবং তিনটি ট্রান্সফরমারই ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অভিযান শেষে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। একটি গুলি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের পেটে লাগে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বেস ক্যাম্পে রওনা হন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই অভিযানের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার এবং খবরের কাগজে ব্যাপক প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এটি ছিল একটি বড় ঘটনা।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন গেরিলা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আরেকটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ফেনীর সীমান্তরেখার কাছে তাঁরা দেখতে পান, পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র নামাচ্ছে। তাঁরা তখন হামাগুড়ি দিয়ে কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে গাড়ি দুটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। একজন পাকিস্তানি সেনাও আহত হয়।
৭ অক্টোবর ১৯৭১ – পাকিস্তানের নিন্দায় লেবার পার্টি
ব্রিটেনের ব্রাইটনে দেশটির লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে এদিন বাংলাদেশের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ ও ভীতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত জরুরি মানবিক সাহায্য ছাড়া বিশ্বের সব দেশকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়।
ওই প্রস্তাবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে এবং পাকিস্তান সরকারকে জরুরি মানবিক কর্মসূচির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানানো হয়। বাংলাদেশে অবিলম্বে সামরিক উৎপীড়ন বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বলা হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো প্রস্তাবটি পেশ করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সাবেক মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট, ব্রুস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউসসহ আরও কয়েকজন বক্তব্য দেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন ‘পূর্ববঙ্গে লাখ লাখ লোকের ট্র্যাজেডি’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের কাজে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ ও ভর্ৎসনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের বিবৃতিও প্রাভদায় প্রকাশিত হয়। এসব বিবৃতিতেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাজের সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দপ্তরের চেয়ারম্যান ডা. কার্ল টেলর দেশটির প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংক্রান্ত কমিটির কাছে বলেন, জাহাজ বোঝাই অস্ত্র পাকিস্তানকে সরবরাহ করায় যারা যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করছে, তারা ঠিকই করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে নতুন শরণার্থী স্রোত আসছে। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে আগামী দিনে অনেক লোককে অনাহারে কাটাতে হবে। সুতরাং আরও কয়েক লাখ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে আসার চেষ্টা করবে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার এদিন ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করে বলে, এর ফলে ভারত এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণামূলক কাজে উৎসাহ পাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের জঙ্গি সরকারের নির্যাতনের নিন্দা করে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র তা অগ্রাহ্য করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফরকালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় কোসিগিন ওই বিবৃতি দেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক তাঁর মন্ত্রিসভায় আরও তিন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁরা হলেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) এ কে মোশারফ হোসেন ও জসিম উদ্দিন আহমদ এবং কাইয়ূম মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বক্তব্য সমর্থন
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান শেষে এদিন দিল্লি ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের এর আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার পথ প্রশস্ত করতে পারে। ভারতের এই বক্তব্যের বিপুল সমর্থন মিলেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে সামরিক উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে, সেটাকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে ধামাচাপা দেওয়ার পাকিস্তানি অপচেষ্টা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী খারিজ করে দিয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এদিন ফেনী মহকুমার বিলোনিয়া-ছাগলনাইয়া সড়কে দুটি পৃথক স্থানে অভিযান চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল টহলরত পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর আঘাত হানলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। তবে তারা শক্তি সঞ্চয় করে কিছুক্ষণ পর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল এই সড়কের একটি সেতু ধ্বংস করে। বিলোনিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি অংশকে ছাগলনাইয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এই সেতু ধ্বংস করেন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার রাধানগর তহশিল অফিস ও মোকামিয়ায় পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করেন। এতে দুই পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
আরেক বাঙালি কূটনীতিকের পদত্যাগ
লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি রাজনৈতিক কাউন্সেলর রেজাউল করিম এদিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরে তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেন। লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে তখন পর্যন্ত যেসব বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন, তাঁদের মধ্যে রেজাউল করিমই সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
৮ অক্টোবর ১৯৭১ – রণাঙ্গনেই সমস্যার চূড়ান্ত ফয়সালা

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের নবীন সেনা কর্মকর্তাদের পাসিং আউট হয় ৯ অক্টোবর। টানা কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে পাসিং আউটের মাধ্যমে কমিশন্ড লাভ করেন ওয়ার কোর্সের ক্যাডেটরা। ৬১ জন তরুণ যোদ্ধা এই প্রশিক্ষণ নেন। ভুটান সীমান্তসংলগ্ন মূর্তি শিবিরে ১ জুলাই থেকে দিনরাত ১৪ সপ্তাহের দীর্ঘ প্রশিক্ষণে তৈরি হয় ফার্স্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স। সামরিক যুদ্ধের নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই বাহিনীকে সামরিক এবং গেরিলাযুদ্ধের বিভিন্ন শিক্ষায় পারদর্শী করে তৈরি করা হয়।
পাসিং আউট অনুষ্ঠানে ছিলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এই তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। পরে তাঁদের রণনৈপুণ্যে মুক্তিযুদ্ধে গতি আসে।
১০ অক্টোবর ১৯৭১ : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাভদার অবস্থান
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। প্রতিবেদনে প্রাভদা বলে, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তামাশা করছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে।
প্রাভদা জানায়, ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েত জনগণ বিক্ষুব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনেরও দাবি করছে।
আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানান। বুয়েনস এইরেসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ঘোষণা দিয়ে বলেন, তাঁর আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পদ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র এ দিন জানান, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা এখন মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। মুক্তাঞ্চলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে
মন্ত্রিসভার এক বিশেষ বৈঠকে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার কাছে যুদ্ধের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বর্ণনা দেন।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এ দিন প্রকাশিত এক বুলেটিনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর কামদেবপুরের কাছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০ জন নিহত হয়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা ও কোটচাঁদপুরের মধ্যে রেলের কয়েকটি সেতু ধ্বংস করেন। একই দিন গেরিলারা কামরাইলের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন নিহত হয়।
৬ অক্টোবর দুধগুঁড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ৬ ও ৭ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ফুলবাড়ী, রাজশাহী ও ভূরুঙ্গামারী অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ও টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। এক স্থানে গেরিলারা মাইন দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ উড়িয়ে দিলে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া গেরিলারা ঢাকায় বোমা ছুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থারও কিছু ক্ষতি করেন।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কূটনৈতিক মহল সাংবাদিকদের জানায়, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি বলেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উক্তি এই মামলাকে প্রভাবিত করছে। ব্রোহীসহ অন্য কৌঁসুলিরা ঢাকায় মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দেন, তা উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। তাঁর এই অপরাধের শাস্তি হবেই। ব্রোহি বলেন, প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য সামরিক আদালতে মামলাকে প্রভাবিত করছে।
রেডিও পাকিস্তান এ দিন জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকেও ৩০ সেপ্টেম্বর একজন প্রতিনিধি মারফত এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মজুমদারহাট ও ফেনীর পরশুরামে এই দিন ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত আলাদা দুটি অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
কুমিল্লা সার্কিট হাউস ছিল পাকিস্তানিদের আঞ্চলিক মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার। ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা শহরের ভেতরে অবস্থিত এই সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষণ করলে পাকিস্তানিদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও পুলিশ হতাহতও হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অভিযানের খবর রেডিও পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সংবাদপত্র ভারতীয় আক্রমণ হিসেবে ফলাও করে প্রচার করে।
একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণে রাজগঞ্জেও পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। এই সেক্টরের অন্য আরেকটি দল বাঞ্ছারামপুর থানার দক্ষিণ পশ্চিমে উজানচর-আসাদনগরে অ্যামবুশ রচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টারের সাহায্যে চুয়াডাঙ্গা ও সাঞ্চাডাঙ্গা, চৌগাছা ও মাসলিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। এ ছাড়া খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের বিবৃতি
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে বর্ণনা করে। বিবৃতিতে তারা এ সম্পর্কে ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই সমস্যার মূল বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করেন। বিবৃতিতে একবার শুধু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে বাকি সব স্থানেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
অপারেশন ওমেগা দলের দুজন সদস্য জেমস স্কারলেট ও স্টিফেন রিভার মুর কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের জন্য পাকিস্তানি প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে তাঁরা জেনেছেন, যাঁরা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কথা জানাচ্ছেন, শুধু তাঁদেরই ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
মিসরের সংবাদপত্র আল আহরাম-এ ১২ অক্টোবর এক নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে বিচারের ফল যা-ই হোক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হবে না। পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নিবন্ধ লেখক ড. ক্লোভিমা ম্যাক সাঈদ বিশ্বাসযোগ্য একটি পাকিস্তানি সূত্র থেকে এ তথ্য পেয়েছেন বলে জানান।
ইয়াহিয়া খান এই দিন এক বেতার ভাষণে ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। অধিবেশনের পরপরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবেন এবং পরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তিনি বলেন, ভারত শিগগিরই পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে। তবে তাঁর বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক রয়েছে।
দুঃসাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক কঠোর সেনা প্রহরা পেরিয়ে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খানের ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাঁকে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ মোনেম খান রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঘটনাটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোনেম খানের বনানীর বাড়ি পাহারার দায়িত্ব পড়ে বালুচ রেজিমেন্টের একটি দলের ওপর। বাড়ির মুখে বাংকার বানিয়ে তারা পাহারা দিত।
১৪ অক্টোবর : ছাতকে দুঃসাহসী সম্মুখযুদ্ধ
১৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ছাতকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি দলের সঙ্গে সাহসিকতাপূর্ণ এক সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন।
ছাতকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পশ্চিম তীরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। নদীতীরে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। ছাতক শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে সিলেট শহর। ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই পুরো এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। সঙ্গে ১২ আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স (একেএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) এবং রাজাকারদের দুই কোম্পানি শক্তিসমান জনবল।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাতকে আক্রমণ করার জন্য গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্প থেকে ১১ অক্টোবর ছাতকের ঠিক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে বাঁশতলায় আসে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর।
তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল)। তিনি আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। গাইড ও সহযোগী হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ৫ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের। এ ছাড়া রৌমারীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট কোম্পানিকে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির রিইনফোর্সমেন্ট ও রিয়ার প্রটেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অভিযান চলাকালে দোয়ারাবাজার থেকে এবং সড়কপথে সিলেট শহর থেকে গোবিন্দগঞ্জ হয়ে ছাতক শহরে যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে, সে জন্য চার্লি ও ডেলটা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাট অফ পার্টি হিসেবে চার্লি কোম্পানি দোয়ারাবাজারে এবং ডেলটা কোম্পানি ছাতক ও গোবিন্দগঞ্জের মাঝামাঝি মাধবপুর ও হাসনাবাদ এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে।
১৪ অক্টোবর সকাল থেকেই মূল আক্রমণকারী দল আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি এবং একটি এফএফ কোম্পানির সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দিনভর প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল এগিয়ে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাছাকাছি টিলার উঁচু স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়। আলফা কোম্পানি একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের সম্মুখবর্তী অবস্থানের ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে যায়।
পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ছাতক শহরে চলে যায়।
মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির রিকোয়েললেস রাইফেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের অনেক বাংকার ধ্বংস হয়। সন্ধ্যার মধ্যেই আলফা কোম্পানি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় ঢুকে পড়ে। ব্রাভো কোম্পানিও ওই পর্যায়ে আলফা কোম্পানির কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের আরেকটি কোম্পানি সেনারা বিকেল থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। পাকিস্তানিদের এই দলের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
১৩ অক্টোবর সন্ধ্যার পর লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে ডেলটা কোম্পানি মাধবপুর ও হাসনাবাদের উদ্দেশে রওনা করেছিল। সুরমা নদীর উত্তর তীরে পারকুল গ্রামে তাঁদের পৌঁছাতে ১৪ অক্টোবর ভোর হয়ে যায়। তাঁরা হাসনাবাদ ও মাধবপুর এলাকায় রেল ও সড়কপথ অবরোধ করে অবস্থান নেন।
সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতক শহর থেকে এসে ডেলটা কোম্পানির ওপর হামলা চালায়। তাঁরাও পাল্টা হামলা অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তানিরা বারবার চেষ্টা করেও ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে সরাতে পারছিল না। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তানিদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদী পার হয়ে পারকুল গ্রামে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা আর্টিলারি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে পারকুল গ্রামটি ঝাঁঝরা করে দেয়।
এ যুদ্ধ ১৬ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৫ অক্টোবর সকাল থেকে পাকিস্তানিরা তিনটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর মেশিনগানের গুলি চালায়।
ছাতক যুদ্ধে দুই পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। তাদের একজন কর্নেলসহ বহু সেনা, একেএফ, ইপিসিএএফ এবং রাজাকার হতাহত হয়। ৪০-৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং অনেকে আহত হন।
ছাতকের যুদ্ধে যে পাকিস্তানিরা যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সে কথা স্বীকার করেন। এই অভিযানের খবর বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য প্রচার পেয়েছিল।
সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটি ১৪ অক্টোবর রাতে দিল্লিতে ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ নিয়ে পর্যালোচনা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বোম্বাই থেকে দিল্লিতে ফিরে আসার অল্প সময়ের মধ্যে এই রাজনৈতিক কমিটির বৈঠক বসে। কমিটিকে জানানো হয়, ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা ভারতের পূর্ব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তেও পাকিস্তান ট্যাংক, কামান ও সেনা জড়ো করছে। বৈঠকের পর একজন কর্মকর্তা বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না, তবে আক্রান্ত হলে জবাব দেবে।
ভারতে সফররত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও গ্রন্থকার জন গ্রিগ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত ভালো। তবে যুক্তরাজ্য সরকার কী করবে, তা নির্ভর করছে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর। তাঁর আগামী সফরে ব্রিটিশ নেতাদের ঠিকমতো বোঝাতে পারলে যুক্তরাজ্য একাই বহু কিছু করতে পারে। গ্রিগ আরও বলেন, এখানে সফরের আগে তাঁর ধারণা অন্য রকম ছিল। কিন্তু এখন তিনি জানেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে শরণার্থীরা দেশে ফিরবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা রবার্ট জে ম্যাকলস্কি সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধে যুক্তরাষ্ট্র কারও ব্যাপারেই মধ্যস্থতায় রাজি নয়।
১৫ অক্টোবর : সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার ইয়াহিয়ার
ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সফররত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কুর সঙ্গে তেহরানের পারসি প্যালেসে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। তাঁরা সবাই উৎসবে যোগ দিতে তেহরানে যান। নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে ইয়াহিয়া প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করেন। পদগোর্নির কাছে তিনি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, আত্মরক্ষার জন্যই তিনি এসব করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এই দিন সাংবাদিকদের জানান, সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের পরিমাণ পুরোপুরি কমিয়ে দিতে ভোট দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের সামনে ঘোষণা করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সব বিদেশি সাহায্য নিষিদ্ধ করার পক্ষে কমিটি ভোট দিয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ঢাকা থেকে পাঠানো এক খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সেনা নামিয়ে যে সন্ত্রাসের সূচনা করেছিলেন, বাংলাদেশে তা এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা সুদূর।
ভারতে নিয়োজিত উত্তর ভিয়েতনামের কনসাল জেনারেল নুয়েন থাট ভু এদিন দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর ভিয়েতনামের জনসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সংগ্রামে ভিয়েতনামের পূর্ণ সহযোগিতা আছে।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ১৫ অক্টোবর ফেনীর ছাগলনাইয়া, গুতুমা, পরশুরাম, চিতলিয়া, বল্লভপুর, দারোগাহাটসহ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করে। এসব আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকাররা হতাহত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি বাংকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার দক্ষিণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে বারচর গ্রামে অ্যামবুশ পাতেন। এক ঘণ্টা পর একদল পাকিস্তানি সেনা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফেরার পথে অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ এদিনও অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী তিনটি হেলিকপ্টার দিয়ে এই দিন সকাল থেকে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে মেশিনগানের গুলি করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, সেনাপ্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এই দিন সুনামগঞ্জের বালিউরায় এসে যুদ্ধ পরিদর্শন করেন।
৭ নম্বর সেক্টরের বগুড়া অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া-সান্তাহার রেললাইনের একটি সেতুর কাছে অতর্কিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, সেনাপ্রধান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল) নেতৃত্বে চুয়াডাঙার দামুড়হুদার ধোপাখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালান। দুই পক্ষের মুখোমুখি যুদ্ধে সেনা ও রাজাকার মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার আবদুল গফুর ও নায়েক শহীদ আলী শহীদ হন। আহত হন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের ঝিকরগাছা থেকে দশতিনামুখী সড়কে রাজাকারদের অ্যামবুশ করেন। ঝিকরগাছায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রতিরক্ষা অবস্থান। রাজাকারেরা এদিন পাকিস্তানি সেনাদের জন্য দশতিনা থেকে কয়েকটি গরুর গাড়িতে করে খাদ্যসামগ্রী ও রসদ নিয়ে ঝিকরগাছা যাচ্ছিল। পথে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এমন আকস্মিক আক্রমণ রাজাকাররা প্রতিরোধ করতে পারেনি। অতর্কিত আক্রমণে তিনজন রাজাকার আহত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়ার চাতুর্য
স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে রাজনৈতিক চাতুর্য শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তিনি দেখাতে চাইছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ তাঁর দয়ার ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া হত্যা করবেন না, এমন তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
মিসরের আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে ক্লোভিমা ম্যাক সাউদ লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে নাকি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এই দিন বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পদযাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ৩৬ জন ছাত্র-যুবক ভোরে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কালীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে এই পদযাত্রা শুরু করেন। একনাগাড়ে ১০ মাইল হেঁটে তাঁদের সাড়ে তিন মাসব্যাপী পদযাত্রার প্রথম দিন গোকর্ণে শেষ হয়। ৩০ জানুয়ারি গান্ধী প্রয়াণদিবসে দিল্লির রাজঘাটে গান্ধীর সমাধিতে এর সমাপ্তি হবে। অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডলের সহায়তায় এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
১৬ অক্টোবর : মুক্তিবাহিনী এখন ভীষণ মারমুখী

মুজিবনগরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র ১৬ অক্টোবর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের জানান, মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভীষণ মারমুখী। শুধু গেরিলা লড়াই, অ্যামবুশ বা চোরাগোপ্তা গুলি চালানো নয়, সম্মুখসমরের জন্যও তাঁরা তৈরি। প্রতিটি সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিরা হারছে। মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিচ্ছেন রেললাইন ও সেতু। পাকিস্তানি সেনাবাহী ট্রেনের ওপর নিয়মিত আঘাত হানছে। বিভিন্ন স্থানে এতটাই তাঁদের সফলতা যে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে চড়তে ভয় পাচ্ছে। রাতে কোনো ট্রেন চলছে না।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও দুটি খবর দেওয়া হয়। একটি হলো বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নৌবহর সংগঠিত হয়েছে। আপাতত তাতে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া পাঁচটি মোটর বোট। দ্বিতীয়টি হলো, বাংলাদেশের বিমান সেনা ও বৈমানিকদের নিয়ে বিমান ইউনিট গঠন। আগে এঁরা পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইউনিটের জন্য বিমান সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন চলছে প্রশিক্ষণ।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করেন। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনী নদীর পূর্ব তীরে চট্টগ্রামের পশ্চিম অলিনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দলকে অ্যামবুশ করেন। দুই হামলায় কিছু সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ১৬ অক্টোবর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যায়।
৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর সূচিত হওয়া যুদ্ধ ১৬ অক্টোবরও অব্যাহত থাকে। এ দিন সকালে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিতে শুরু করে। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্রাভো কোম্পানি আলফা কোম্পানিকে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। সন্ধ্যার মধ্যে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির দখলে চলে আসে।
তবে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলাগুলোতে দিনভর পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ আলফা অধিনায়ককে চিন্তিত করে রাখে। সন্ধ্যার পরই তিনি সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে পৌঁছান। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির সঙ্গে চার্লি ও ডেলটা কোম্পানির কোনো যোগাযোগ ছিল না। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় তারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সহায়তায় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গলাপানি পার হয়ে পেছনে বালিউরার উদ্দেশে রওনা দেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভারত সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর অভিযান চালায়।
৮ নম্বর সেক্টরভুক্ত এলাকার ভারত সীমান্তের কাছে সাজালিতে একটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিছুদিন আগে সাজালি গ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা মুক্ত ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। খবর পেয়ে সেনা ও রাজাকারের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল এই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাজালি ক্যাম্পে আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
আক্রমণের জন্য ভারত প্রস্তুত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ১৬ অক্টোবর নব কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় বলেন, পাকিস্তান মরিয়া হয়ে গেরিলা আক্রমণ করলে ভারতও সমুচিত জবাব দিতে পুরোপুরি তৈরি। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও কয়েকজন মন্ত্রী এবং নব কংগ্রেসের সভাপতি সঞ্জিবায়া উপস্থিত ছিলেন।
ভারত সীমান্তে বিপুল পাকিস্তানি সেনা সমাবেশের খবরটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন সাংবাদিকদের জানান। গত কয়েক দিন সীমান্ত পেরিয়ে যাঁরা ভারতে এসেছেন তাঁরা জানান, সীমান্তের দিকে প্রতিদিন বহু ট্রেন ভারী সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছে। অসামরিক গাড়িগুলোও সেনা বহনের কাছে লাগানো হয়েছে।
১৭ অক্টোবর : সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর হুঁশিয়ারি

দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র ১৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো হঠকারী সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। তেহরানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বৈঠকের সময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা তেহরানে গিয়েছিলেন।
ভারতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এই দিন বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আহ্বান জানান, যাতে শরণার্থীরা দ্রুত নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারেন। তাঁর সম্মানে দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি আয়োজিত ভোজসভায় তিনি এ অভিমত জানান। তিনি বলেন, এই গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে পুরো উপমহাদেশে, এমনকি তার বাইরেও শান্তির পক্ষে বিপদ দেখা দিতে পারে।
ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, কেবল স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গের জনগণের মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসা না হওয়া অব্দি সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাবে না। এ ব্যাপারে ভারত কোনো আন্তর্জাতিক চাপ গ্রাহ্য করবে না।
দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ৵ সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ২৪ অক্টোবর থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি—ইউরোপের এই পাঁচ দেশ সফর করবেন। এই সফরে তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পাবে। তাঁর বক্তব্য হবে, ‘বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। পাকিস্তানের মতান্ধতা ও অপকৌশল এশিয়া ও বিশ্বের শান্তি বিপন্ন করে তুলেছে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান চাই, শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা চাই।’
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল এই দিন ফেনীতে ভারত সীমান্তবর্তী আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল পাকিস্তানি সেনাদলকে দেবপুরে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও গুরুতর আহত হন। দ্বিতীয় দলটি ভোরে পূর্ব দেবপুরে আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি জগন্নাথ সোনাপুর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা রাত আটটার দিকে ঢাকায় মতিঝিলের কাছে নটর ডেম কলেজসংলগ্ন সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। এ সময় টহলরত একটি ছোট পাকিস্তানি সেনাদল সেখানে হাজির হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপরও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
একই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কুমিল্লার রমজানপুরে আরেকটি টহল দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
৫ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা টানা কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের পর সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে এদিন ভোরে পর্যায়ক্রমে বালিউরায় এসে একত্র হন। মুক্তিবাহিনীর এফএফসহ আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি অবস্থান ছেড়ে গেছে দেখে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ধাওয়া করতে জোড়াপানি-মৌলা হয়ে ভারত-সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। তখন আলফা, ব্রাভো ও এফএফ কোম্পানি বালিউরায় অবস্থান নিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিন বিকেল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। ২৫-৩০ জন মারাত্মক আহত হন। আহতদের বহু কষ্টে বাঁশতলায় পাঠানো হয়। সেখানে তাঁদের সমাহিত করা হয়। বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতকের দিকে ফিরে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের আলাদা দুটি স্থানে এদিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন দশাতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিচক্ষণতার সঙ্গে সে হামলা মোকাবিলা করে নিরাপদ স্থানে সরে যান। তবে এর আগে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত ছিলেন। গোলন্দাজ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।
ভারত সীমান্তবর্তী বিশাহারীতে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও ভারী অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হন, অবশ্য বড় কোনো ক্ষতি তাঁদের হয়নি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়ার দম্ভ – ১৮ অক্টোবর
বিখ্যাত ফরাসি দৈনিক লা মঁদ পত্রিকায় ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনগণ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য মার্জনা চায়, তাহলে তিনি তা মঞ্জুর করবেন। লা মঁদ-এর সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, যে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গোপনে শেখ মুজিবের বিচার করছে, তারা যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তাঁর মার্জনা করার অধিকার প্রয়োগ করবেন কি না। প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহিয়া ওই কথা বলেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে নিরপরাধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানকে হুমকি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ নিয়ে টিটো-ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটিতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দিল্লিতে আলোচনাকালে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো অভিপ্রায় ভারতের নেই। তবে ভারত আক্রান্ত হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা মোকাবিলা করবে। টিটোর সঙ্গে ইন্দিরার প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনায় মুখ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশ।
আলোচনায় মার্শাল টিটো কিছু বিষয়ে ইন্দিরার সঙ্গে একমত হন। ১. বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। ২. বাংলাদেশে শরণার্থীদের নিরুদ্বেগে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। ৩. প্রত্যেক মানুষেরই উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার আছে। ৪. দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার ভারতের আছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ১৮ অক্টোবর আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান চালান। প্রথম দল ফেনীর গুতুমা সীমান্তঘাঁটিতে, দ্বিতীয় দল গুতুমা নদী এলাকায় এবং তৃতীয় দল মাতুয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করে। তিন স্থানেই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মিলে কয়েকজন হতাহত হয়। গুতুমা সীমান্তঘাঁটির যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। একজন পরে মারা যান।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী দল মর্টার ও রিকোয়েললেস রাইফেলের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর চৌদ্দগ্রামের বাডিসা ঘাটের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। প্রায় একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাসার দীঘির অবস্থানে হামলা করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দু-তিনজন হতাহত এবং কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউশে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চাপিতলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের পেছন দিকে অ্যামবুশ পাতে। ভোর চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি দল তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে এসে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ২৫টি নৌকায় করে গৌরীনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণের উদ্দেশে রওনা দেয়। তারা গৌরীনগরের কাছাকাছি এলে পাকিস্তানি বাহিনী গৌরীনগর থেকে তাদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। অকস্মাৎ এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ছয়জন গুরুতর আহত হন।
এই সেক্টরের সুনামগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী সংঘবদ্ধ হয়ে ছনখাইড় এলাকায় এসে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরা আর এগোতে না পেরে ছাতকের দিকে ফিরে যায়। তবে পাকিস্তানি সেনারা ছনখাইড়, রাজারগাঁও, মৌলা, জয়নগর, জোড়াপানি, নোয়ারাই ইত্যাদি গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি দল ঝিনাইদহের ফতেহপুর ও ধেনকিপাতায় পাকিস্তানি বাহিনীর আলাদা দুটি দলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সাদীপুরে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে।
১৯ অক্টোবর ১৯৭১ : ইয়াহিয়ার সঙ্গে মীমাংসা নয়

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসবে না। একজন বাঙালি জীবিত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বড় শক্তিগুলোর দান হিসেবে নয়, বাঙালিরাই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তাতে তিনি খুবই আশাবাদী। মুক্তাঞ্চলে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য বাছাই করা গেরিলা এবং বাংলাদেশ বাহিনীতে সম্প্রতি কমিশন পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের নায়ক ও রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি রাষ্ট্রের নেতাকে আটকে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
মুজিবনগরে ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সকাল ১০টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শপথ নিয়ে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিবেদন করা যোদ্ধা ও দেশবাসীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ জন সদস্য তাঁর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বক্তব্য দেন।
সভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি একাধিক প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ২১ অক্টোবর।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাড়াতে সভায় আলোচনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও আলোচনা হয়।
মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনের বৈঠক শেষে ২২ অক্টোবর এক প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এই প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সব দেশ ও জাতিসংঘকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানানো হয়।
শরণার্থীদের ব্যাপারে এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ সব শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয়, এতে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনব্যাপী সভা ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভা পরিচালনা করেন। কমিটির ৫৪ জন সদসে৵র মধে৵ ৪২ জন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও সভায় ছিলেন।
জাপানি পত্রিকায় ইয়াহিয়াকে ভর্ৎসনা
জাপানের জনপ্রিয় দৈনিক আসাহি সিম্বুন এবং ইয়োমিউরি সিম্বুন–এ এদিন পূর্ব বাংলায় অব্যাহত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে। কাগজ দুটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন—এই তিন বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আসাহি সিম্বুন বলে, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ইয়োমিউরি সিম্বুন বলে, উপমহাদেশে শক্তিসাম৵ বদলে যাওয়ার শঙ্কায় বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গের গণহত্যা দেখতে চাচ্ছে না।
দিল্লি অভিমুখে শান্তিপদযাত্রা
বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জনমত গঠনে দিল্লির দিকে এদিনও শান্তিপদযাত্রা চলে। যাত্রীরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের স্বাগত জানান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্রসংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে পদযাত্রার জন্য দলটি গঠিত হয়। নেতৃত্ব দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল খালেক। ১৪ অক্টোবর তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকির পটভূমিতে দিল্লিতে সন্ধ্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ফিরুবিনের আকস্মিক দিল্লি সফরের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি। তিনি ভারতকে সংযত থাকার অনুরোধ জানাবেন। পাকিস্তানকেও তাঁরা একই কথা বলছেন।
ভারতের ১১ জন সাংসদ এক খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং কংগ্রেসের সদস্যদের প্রতি
এক আবেদনে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সমবেত চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে কামান আক্রমণ চালান। প্রায় ১০ মিনিট গোলাবর্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।
এই অভিযানের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান কসবায় বোমাবর্ষণ করে। এই বিমান আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতাহত না হলেও বহু বেসামরিক লোক নিহত হন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা হরিসরদার বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা গভর্নর হাউসের (বর্তমানে বঙ্গভবন) কাছে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড (তখন এর অবস্থান ছিল বঙ্গভবনের সামনের পার্কের পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ পাশে) এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং কয়েকজন সাধারণ নাগরিক আহত হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিলির ভারতীয় অংশে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করলে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ৬ নম্বর সেক্টরের হিলির মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এরপর পাল্টা বোমা বর্ষণ করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় তাঁর দল এখন শুধু পাকিস্তানের বৃহত্তম দল নয়, জাতীয় পরিষদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।
২৩ অক্টোবর ১৯৭১ : মুক্তিযুদ্ধে গোপনে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র

লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ২৩ অক্টোবর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করতে গোপনে ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার যে প্রবল আশঙ্কা তারা করছে, সেটি এড়ানো। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আসন্ন চীন সফর বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকানো।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন।
এটি ছিল ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পকে৴ ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ–হুমকি নিয়ে কথা বলা। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ইন্দিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা বিদেশি নেতাদের বোঝাতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে বলবেন।
তবে পশ্চিমা মহল মনে করছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের নেতাদের সমাধানে আসতে রাজি করাতে ইন্দিরা গান্ধী সক্ষম হবেন। তাঁরা এ–ও ভাবছিলেন, ইন্দিরা এ ধরনের ভূমিকা নেবেন না কিংবা বাংলাদেশের সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবেও দেখাতে দেবেন না।
জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সরকারকে বাধ্য করতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি পত্রিকা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক দখলদারি রাজত্বের নিন্দা করা হয়।
লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, ৯০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের জীবনধারণের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইন্দিরার তিন সপ্তাহের বিশ্ব সফরকালে চলবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না–ও হতে পারে। বিশ্বশান্তি অক্ষুণ্ন রাখতে হলে শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনী
মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় মোজাফফরপন্থী ন্যাপ অভিমত প্রকাশ করে, বাংলাদেশের একমাত্র সমাধান পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সমর্থন জানিয়ে সভায় সর্বস্তরে এমন কমিটি গঠনের প্রত্যাশা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
৮ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার সাদীপুর, তীতুদহ ও বেড়াশুলাসহ কয়েকটি স্থানে এদিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল সকাল ১০টার দিকে ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাদীপুরের অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করেন। এরপর দুই পক্ষে বহুক্ষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
চুয়াডাঙ্গার সদর থানার তীতুদহ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সেনা ও কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঝিনাইদহ মহকুমার সদর থানার অন্তর্গত বেড়াশুলা গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে প্রায় ১১ জন রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে মিসরের রাজধানী কায়রোয় রওনা হন। ভুট্টো মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। দুই দিন কায়রোয় অবস্থানের পর তিনি জেনেভায় যাবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে রাত আটটায় ভারতের ত্রিপুরা রাজে৵র রাজধানী আগরতলায় গোলাবর্ষণ করলে পাঁচজন বেসামরিক লোকসহ ২০ জন আহত হয়। সেখানে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলাকালে শহর ও আশপাশে কতগুলো গোলা পড়ে। এই প্রথম কোনো রকম প্ররোচনা ছাড়াই পাকিস্তানিরা আগরতলা শহরে গোলাবর্ষণ করে। প্রায় ১০ মিনিট গোলা বর্ষিত হয়। করিমপুরেও পাকিস্তানিরা গোলাবর্ষণ করে।
২৫ অক্টোবর – বেলজিয়াম ইতিবাচক বাংলাদেশ নিয়ে

বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।
বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই
করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
২৬ অক্টোবর ১৯৭১ সোভিয়েত-কানাডা যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আট দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। বাংলাদেশ সমস্যার জরুরি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দুই দেশ আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত হতে অনুরোধ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে সংগত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশে৵ গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।
দুজন নোবেল বিজয়ীসহ ফ্রান্সের ৮০ জনের বেশি বিশিষ্ট নাগরিক এই দিন দেশটির সরকারের কাছে এক ইশতেহারে পাকিস্তানকে অবিলম্বে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার আহ্বান জানান। নোবেল বিজয়ীরা হলেন পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রে কাস্তলে এবং অণুজীববিজ্ঞানী আঁদ্রে লোফ। লেখক, সাংসদ ও ধর্মীয় নেতারা এই ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন।
বেলজিয়াম সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলসে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব শান্তিতে আগ্রহী বিশ্বের সব দেশের। তিন দিনের বেলজিয়াম সফর শেষে অস্ট্রিয়ায় যাত্রার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ইন্দিরা বলেন, ভারত আলোচনার ওপরই জোর দিচ্ছে। তবে আলোচনায় কিছু ভিত্তি থাকা দরকার। পূর্ববঙ্গে কিছু ঘটনার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অথচ কষ্ট ভোগ করছে ভারত।
মিসরের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসা পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক ফজলুল করিম লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতির প্রতিবাদে তিনি কাজে ইস্তফা দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে কয়েকটি স্থানে এই দিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সীমান্তবর্তী কসবা ছাড়াও কায়েমপুর, সালদা নদী, নয়নপুর ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায় মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২৭ অক্টোবর ইত্তেফাক ‘কসবায় ভারতীয় গোলাবর্ষণ অব্যাহত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন সীমান্ত এলাকার গোয়ান ও রাউত গ্রামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংসের অভিযানে যান। সেতু দুটি পাহারায় ছিল রাজাকারদের একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররা আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। দু-তিন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।
এই দিন ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলে কিছু রাজাকার অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৭ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা দর্শনা থেকে সাত মাইল দূরে আন্দুলবাড়িয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় পাকিস্তানিদের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরিত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরে আরও কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন। একটি দল যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছার গদখালী-নাভারন অংশে সড়কের পাশে টেলিফোন লাইন ধ্বংস করলে যশোর–বেনাপোল টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে। আরেকটি দল বাগআঁচড়ায় আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ঝিনাইদহের বেথুলী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৬৫ জনের দলটি অ্যামবুশের আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণও করে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই দিন কিছু রাজাকার চীনা অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৮ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এক বুলেটিনে এই দিন বলা হয়, কয়েক দিন আগে একদল নৌ মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনের কয়রায় বিস্ফোরকের সাহায্যে পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশনের লানশিয়া নামে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। রংপুর অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা লালমনিরহাট-মোগলহাটের মধ্যবর্তী এলাকায় রেললাইন তুলে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে।
২৮ অক্টোবর ১৯৭১ শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটি দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। আগের রাতে পাকিস্তানিদের অবস্থানের প্রায় ৬০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই উপদলের একটি বাঁ দিক আর অন্যটি ডান দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। হামিদুর রহমানের দলটি থাকে মাঝখানে।
ব্রিটেন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তাঁরা দুজনই আলোচনায় একমত হন যে পাকিস্তানের শাসক এবং বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতাদের নিয়েই বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। এ জন্য কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানকে রাজি করাতে হিথ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আশ্বস্ত হতে চান।
আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা, ভারতে শরণার্থীদের বোঝা, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের নেতাদের ধারণা এখন অনেকটা স্পষ্ট।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশ সংকটের জরুরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইন্দিরা ও হিথ দুজনই পুরোপুরি একমত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য মনে করছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে দেরি করলে পাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বালিসিয়ামে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলবে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট নাকচ করে দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচি বহাল রাখতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তিনি উপদেষ্টাসহ রিপাবলিকান নেতাদের সঙ্গে আলাপে কর্মসূচিটি বহাল রাখার জোরালো দাবি জানান।
যুক্তরাজ্যে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেনও ছিলেন। আবদুল মোমেন বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সমর্থন দিতে আবদুর রাজ্জাককে অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগোলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে থাকলেও তাঁর দলের মুসলিম সদস্যদের বিরোধিতার ফলে তা পারেননি।
অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী সম্মুখসমরের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে হানাদার বাহিনীকে উচ্ছেদ করাই এই প্রস্তুতির লক্ষ্য। শত্রুর জেল থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব শিগগির ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হবে না।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর গুতুমা সীমান্তঘাঁটির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে অতর্কিতে হামলা করেন। তাঁদের ছোড়া গ্রেনেডে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার সাদিকপুরে অ্যামবুশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অপেক্ষায় থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল অ্যামবুশের আওতায় এলে তাঁরা আক্রমণ করেন। অতর্কিত এ হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল আমানগান্ধা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করে। এখানে তাঁদের কয়েকজন হতাহত হন। সালদা নদীতেও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দশাতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিতে হামলা করলে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই দিন এক ঘোষণায় ৭৬ নম্বর সামরিক বিধি তুলে নিয়ে ৯৪ নম্বর সামরিক বিধি জারি করেন। এ আদেশে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা বা আদর্শের পক্ষে ক্ষতিকর প্রচার কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
ইসলামাবাদে এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন এ দিন আবার পিছিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, পরবর্তী মাসের আগে শূন্য আসনগুলোর নির্বাচন শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন জানায়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৭৮টি আসন এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ১০৫টি আসনে মনোনয়ন পেশ করার শেষ দিন ছিল ২০ অক্টোবর। দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের ৮৮টি প্রাদেশিক পরিষদের মনোনয়ন পেশ করার শেষ দিন ১ নভেম্বর। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের সদস্যপদ খারিজ করে ওই সব আসনে উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ অক্টোবর মুলতানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তাঁর দলে ভাঙন সৃষ্টি করার জন্য প্রেসিডেন্ট সরকারি তহবিল থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন। প্রেসিডেন্ট তাঁর দলের ক্ষতি করার জন্য দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে উসকানি দিচ্ছেন। তারা গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
বিদেশি শক্তিকে ভারত গ্রাহ্য করবে না
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিমলার কৈলাসনগরে নিখিল ভারত নব কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কী করা উচিত, সে সম্পর্কে কোনো বিদেশি শক্তির নির্দেশ তাঁরা গ্রাহ্য করবেন না। তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, সোভিয়েত-ভারত চুক্তি বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে ভারতের ব্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতায় কোনোক্রমেই হস্তক্ষেপ করেনি। দেশের জাতীয় স্বার্থের কথা মনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সিদ্ধান্ত নেবে। ছোট হোক, বড় হোক, সরকার কোনো বিদেশি শক্তিকে ভারতের নীতির ব্যাপারে নাক গলাতে দেবে না।
ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করে বলেন, সীমান্তের দেশ একটি গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন। বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকার যে পন্থাই নিক না কেন, জনসাধারণকে আর্থিক ও অন্য নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। এই অসুবিধাগুলো জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করতে হবে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম সিমলার কৈলাসনগরে নিখিল ভারত নব কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। কিন্তু ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের কোনো অপচেষ্টা হলে ভারত সমুচিত জবাব দিতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান সাফল্যে পাকিস্তানি শাসকদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মাঝেমধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।