অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

Table of Contents

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ১ অক্টোবর দিল্লিতে বলেন, ভারতের সঙ্গে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশ প্রশ্নের ফয়সালায় তাঁর দেশ সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে। ভারত উপমহাদেশের বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির দিকে সোভিয়েত জনগণ বিশেষভাবে নজর রেখেছেন। তাঁর সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির দেওয়া ভোজসভায় তিনি এ কথা বলেন। ভারত উপমহাদেশের জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে একটি যুক্তিযুক্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতার প্রস্তাবও তিনি দেন।

২ অক্টোবর ১৯৭১ - শেখ মুজিবুর রহমানই নির্বাচিত প্রতিনিধি

সোভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। তারা একই সঙ্গে গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধ করার দাবি জানায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিশ্ব জানে যে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে জাতীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

ভারত-সোভিয়েত যৌথ বিবৃতির সমালোচনা

সিপিএম পলিটব্যুরো এ দিন এক বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সোভিয়েত-ভারত যৌথ বিবৃতির সমালোচনা করে বলে, এটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আশা করা গিয়েছিল, সোভিয়েত-ভারত চুক্তির পর বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস পাবে। কিন্তু তা হয়নি।

বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে ৩ অক্টোবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে একটি বিবৃতি দেয়। মুজিবনগরে দেওয়া এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকার অভিমত প্রকাশ করে যে ক্রেমলিন বাংলাদেশ সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার মর্যাদা দেওয়ার এবং তাদের অনপনেয় ও আইনানুগ স্বার্থরক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষে৵ উপনীত হওয়ার সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন রয়েছে। ২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি পর্যালোচনা করা হয়।

নেপালের পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিক ও দূতাবাসের দ্বিতীয় প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান এ দিন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করেন। কাঠমান্ডুতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর এ সিদ্ধান্ত জানান। বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা শুরু হওয়ার পর তিনিই দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন।

১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে ফেনীর ছাগলনাইয়ার আমজাদহাটে পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটির পাশে অ্যামবুশ পাতেন। তাঁরা ২ অক্টোবর গভীর রাতে ঘাঁটির রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। ৩ অক্টোবর ভোর পাঁচটার দিকে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাংকার থেকে বের হওয়া মাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করলে দুজন মারাত্মক আহত হয়।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পরশুরাম, অনন্তপুর, বিলোনিয়া ও ফুলগাজী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। একটি দল মুহুরী নদী পার হয়ে পরশুরামে অবস্থান নিলে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। অনন্তপুরে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েন। কয়েকজন পাকিস্তানিও হতাহত হয়। প্রায় একই সময়ে বিলোনিয়া সীমান্তে এবং ফুলগাজীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। বিলোনিয়া সীমান্তে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 

৪ অক্টোবর ১৯৭১ - যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির নিন্দা

 

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি পাকিস্তানের নিন্দা করে দলের জাতীয় সম্মেলনে গ্রহণের জন্য ৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগের কারণে পাকিস্তান নিন্দনীয়। কারণ, তারা পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে।

প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে দুভাবে। প্রথমত, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সেনাদের অত্যাচার বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের সব জনপ্রিয় নেতাকে মুক্তি দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা। কারণ, শেখ
মুজিবের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করেছিল। জনগণের ইচ্ছানুযায়ী তাদের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘকে প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার কারণে এশিয়ায় বিঘ্নিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনটি উদ্যোগের কথা বলেন। ১. উপমহাদেশে সংযম রক্ষা করা; ২. দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য কর্মসূচি প্রসার করা; ৩. কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করা। উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতকে তিনি সমভাবে দায়ী করেন।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় পার্লামেন্ট হাউসের সামনে ৫ অক্টোবর তিনজন অনশন শুরু করেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার অন্তত এক কোটি ডলার জরুরি সাহায্য না দিলে তাঁরা অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান। অনশনকারীরা হলেন ইন্দোনেশীয় লেখক পল পেয়ার নোমো, পল ইভান ও মেলবোর্নের স্টিভ রুনি।

ইতালির বিশপ সম্মেলন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এই দিন এক আবেদনে ১০ অক্টোবর রোববার সারা দেশে অনশন পালনের দিন স্থির করে। ৪ অক্টোবর ষষ্ঠ পোপ পলের এমন একটি আবেদনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশপ সম্মেলন এ সিদ্ধান্ত নেয়। ভ্যাটিকানের সংবাদপত্র লোসার-ভাতোর রোসাত শরণার্থীদের দুর্দশার কাহিনি জানিয়ে ৪ অক্টোবর তিন পৃষ্ঠার একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে।

 

৬ অক্টোবর ১৯৭১ - চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে দুঃসাহসিক অভিযান

 

১ নম্বর সেক্টরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা ৬ অক্টোবর এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস করেন। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উত্তরে, হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল তিনটি বড় আকারের ট্রান্সফরমার। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এটির মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া প্রায় ১০০ জনের একটি দল।

মুক্তিযোদ্ধারা আগেই রেকি শেষ করে লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও বিমানবাহিনীর প্রধান) নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এ দিন রাতে উপকেন্দ্রটির কাছে অবস্থান নেন। পরিকল্পনামতো মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উপদল গোলাগুলি করে উপকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখে।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ব্রিটেনের ব্রাইটনে দেশটির লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে এদিন বাংলাদেশের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ ও ভীতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত জরুরি মানবিক সাহায্য ছাড়া বিশ্বের সব দেশকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়।

ওই প্রস্তাবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে এবং পাকিস্তান সরকারকে জরুরি মানবিক কর্মসূচির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানানো হয়। বাংলাদেশে অবিলম্বে সামরিক উৎপীড়ন বন্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বলা হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো প্রস্তাবটি পেশ করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সাবেক মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট, ব্রুস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউসসহ আরও কয়েকজন বক্তব্য দেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন ‘পূর্ববঙ্গে লাখ লাখ লোকের ট্র্যাজেডি’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের কাজে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ ও ভর্ৎসনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের বিবৃতিও প্রাভদায় প্রকাশিত হয়। এসব বিবৃতিতেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাজের সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের নবীন সেনা কর্মকর্তাদের পাসিং আউট হয় ৯ অক্টোবর। টানা কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে পাসিং আউটের মাধ্যমে কমিশন্ড লাভ করেন ওয়ার কোর্সের ক্যাডেটরা। ৬১ জন তরুণ যোদ্ধা এই প্রশিক্ষণ নেন। ভুটান সীমান্তসংলগ্ন মূর্তি শিবিরে ১ জুলাই থেকে দিনরাত ১৪ সপ্তাহের দীর্ঘ প্রশিক্ষণে তৈরি হয় ফার্স্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স। সামরিক যুদ্ধের নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই বাহিনীকে সামরিক এবং গেরিলাযুদ্ধের বিভিন্ন শিক্ষায় পারদর্শী করে তৈরি করা হয়।

পাসিং আউট অনুষ্ঠানে ছিলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এই তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। পরে তাঁদের রণনৈপুণ্যে মুক্তিযুদ্ধে গতি আসে।

১০ অক্টোবর ১৯৭১ : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাভদার অবস্থান

 

১০ অক্টোবর

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। প্রতিবেদনে প্রাভদা বলে, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তামাশা করছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে।

প্রাভদা জানায়, ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েত জনগণ বিক্ষুব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনেরও দাবি করছে।

 

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

মিসরের সংবাদপত্র আল আহরাম­-এ ১২ অক্টোবর এক নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে বিচারের ফল যা-ই হোক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হবে না। পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নিবন্ধ লেখক ড. ক্লোভিমা ম্যাক সাঈদ বিশ্বাসযোগ্য একটি পাকিস্তানি সূত্র থেকে এ তথ্য পেয়েছেন বলে জানান।

ইয়াহিয়া খান এই দিন এক বেতার ভাষণে ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। অধিবেশনের পরপরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবেন এবং পরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তিনি বলেন, ভারত শিগগিরই পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে। তবে তাঁর বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক রয়েছে।

দুঃসাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক কঠোর সেনা প্রহরা পেরিয়ে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খানের ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাঁকে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ মোনেম খান রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঘটনাটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোনেম খানের বনানীর বাড়ি পাহারার দায়িত্ব পড়ে বালুচ রেজিমেন্টের একটি দলের ওপর। বাড়ির মুখে বাংকার বানিয়ে তারা পাহারা দিত।

১৪ অক্টোবর : ছাতকে দুঃসাহসী সম্মুখযুদ্ধ

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ছাতকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি দলের সঙ্গে সাহসিকতাপূর্ণ এক সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন।

ছাতকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পশ্চিম তীরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। নদীতীরে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। ছাতক শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে সিলেট শহর। ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই পুরো এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। সঙ্গে ১২ আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স (একেএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) এবং রাজাকারদের দুই কোম্পানি শক্তিসমান জনবল।

 

১৫ অক্টোবর : সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার ইয়াহিয়ার

 

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সফররত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কুর সঙ্গে তেহরানের পারসি প্যালেসে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। তাঁরা সবাই উৎসবে যোগ দিতে তেহরানে যান। নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে ইয়াহিয়া প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করেন। পদগোর্নির কাছে তিনি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, আত্মরক্ষার জন্যই তিনি এসব করেছেন।

১৬ অক্টোবর : মুক্তিবাহিনী এখন ভীষণ মারমুখী

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

মুজিবনগরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র ১৬ অক্টোবর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের জানান, মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভীষণ মারমুখী। শুধু গেরিলা লড়াই, অ্যামবুশ বা চোরাগোপ্তা গুলি চালানো নয়, সম্মুখসমরের জন্যও তাঁরা তৈরি। প্রতিটি সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিরা হারছে। মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিচ্ছেন রেললাইন ও সেতু। পাকিস্তানি সেনাবাহী ট্রেনের ওপর নিয়মিত আঘাত হানছে। বিভিন্ন স্থানে এতটাই তাঁদের সফলতা যে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে চড়তে ভয় পাচ্ছে। রাতে কোনো ট্রেন চলছে না।

মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও দুটি খবর দেওয়া হয়। একটি হলো বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নৌবহর সংগঠিত হয়েছে। আপাতত তাতে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া পাঁচটি মোটর বোট। দ্বিতীয়টি হলো, বাংলাদেশের বিমান সেনা ও বৈমানিকদের নিয়ে বিমান ইউনিট গঠন। আগে এঁরা পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইউনিটের জন্য বিমান সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন চলছে প্রশিক্ষণ।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র ১৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো হঠকারী সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। তেহরানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বৈঠকের সময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।

ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা তেহরানে গিয়েছিলেন।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বিখ্যাত ফরাসি দৈনিক লা মঁদ পত্রিকায় ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনগণ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য মার্জনা চায়, তাহলে তিনি তা মঞ্জুর করবেন। লা মঁদ-এর সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, যে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গোপনে শেখ মুজিবের বিচার করছে, তারা যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তাঁর মার্জনা করার অধিকার প্রয়োগ করবেন কি না। প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহিয়া ওই কথা বলেন।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে নিরপরাধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানকে হুমকি দিচ্ছে।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসবে না। একজন বাঙালি জীবিত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বড় শক্তিগুলোর দান হিসেবে নয়, বাঙালিরাই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তাতে তিনি খুবই আশাবাদী। মুক্তাঞ্চলে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য বাছাই করা গেরিলা এবং বাংলাদেশ বাহিনীতে সম্প্রতি কমিশন পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের নায়ক ও রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি রাষ্ট্রের নেতাকে আটকে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

মুজিবনগরে ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সকাল ১০টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শপথ নিয়ে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিবেদন করা যোদ্ধা ও দেশবাসীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ জন সদস্য তাঁর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বক্তব্য দেন।

সভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি একাধিক প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ২১ অক্টোবর।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাড়াতে সভায় আলোচনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও আলোচনা হয়।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনের বৈঠক শেষে ২২ অক্টোবর এক প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এই প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সব দেশ ও জাতিসংঘকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানানো হয়।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ২৩ অক্টোবর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করতে গোপনে ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার যে প্রবল আশঙ্কা তারা করছে, সেটি এড়ানো। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আসন্ন চীন সফর বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকানো।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন।

এটি ছিল ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পকে৴ ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্‌গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ–হুমকি নিয়ে কথা বলা। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ইন্দিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা বিদেশি নেতাদের বোঝাতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে বলবেন।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।

বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই
করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।

ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আট দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। বাংলাদেশ সমস্যার জরুরি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দুই দেশ আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত হতে অনুরোধ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটি দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। আগের রাতে পাকিস্তানিদের অবস্থানের প্রায় ৬০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই উপদলের একটি বাঁ দিক আর অন্যটি ডান দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। হামিদুর রহমানের দলটি থাকে মাঝখানে।

ব্রিটেন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তাঁরা দুজনই আলোচনায় একমত হন যে পাকিস্তানের শাসক এবং বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতাদের নিয়েই বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। এ জন্য কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানকে রাজি করাতে হিথ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আশ্বস্ত হতে চান।

আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা, ভারতে শরণার্থীদের বোঝা, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের নেতাদের ধারণা এখন অনেকটা স্পষ্ট।

Leave a Comment