মার্চ মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

১৯৭১ সালের মার্চ মাস—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উত্তাল অধ্যায়। এই মাসে ঘটে যাওয়া প্রতিটি দিনের ঘটনা ক্রমশ জাতিকে নিয়ে গিয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের দমননীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

বাঙালির দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, গণঅভ্যুত্থানের চেতনা এবং পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধের সূচনা হয়। এর মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র—গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তান–কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে নিরস্ত্র জনগণের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা চালায়। লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করা। একই সঙ্গে তারা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের স্পষ্ট বিজয়কে অস্বীকার করে এবং দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।

অবশেষে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয় এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

মার্চের সকল ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আজকের আয়োজন।

 

Table of Contents

মার্চ মাস ১৯৭১ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

মার্চ মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১ মার্চ ১৯৭১ : ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল সন্ধ্যায় হঠাৎ কারফিউ

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় হরতালের ডাক দেন।

২ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অচল ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। জনতা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়—স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনও আপস নেই।

  • সকাল থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।

  • সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীরা যোগ দেননি।

  • রেল ও বিমান যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে।

  • হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে নেমে আসে।

ছাত্র আন্দোলন
  • সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর আহ্বানে ছাত্র সমাবেশ হয়।

  • বিকেলে বায়তুল মোকাররম ও পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

কারফিউ ঘোষণা

সন্ধ্যায় হঠাৎ সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ চালু হয়।

  • রেডিওতে ঘোষণার পর জনতা রাস্তায় নেমে ব্যারিকেড দেয়।

  • গভীর রাত পর্যন্ত কারফিউ ভেঙে মিছিল চলে, স্লোগানের পাশাপাশি গুলিবর্ষণও শোনা যায়।

  • নির্বিচার গুলিতে শতাধিক হতাহত হয়, হাসপাতালগুলোতে বুলেটবিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

  • রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও ছাত্ররা দমে যাননি; উল্টো আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।

 

২ মার্চ ১৯৭১ : মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন

আহত ও নিহত

কারফিউর রাতে ও ভোরে বহু আহতকে বিভিন্ন সংবাদপত্র অফিস ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

  • ইত্তেফাক অফিসে ২ জন, দৈনিক পাকিস্তান অফিসে ৩ জন, মর্নিং নিউজ অফিসে ২ জন, সংবাদ অফিসে ২ জন, ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ৬ জন।
  • ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন আরও ২৫ জন।
  • এদিনে প্রাণ হারান ৮ জন। (সূত্র: মোহাম্মদ হান্নান, “বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: ১৮৩০–১৯৭১”)
ছাত্রদের প্রতিরোধ
  • বিকেলে মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে ছাত্ররা একটি রেলগাড়ি আটকে বগি টেনে নিয়ে ব্যারিকেড গড়ে।
  • এসময় গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ফারুক ইকবাল। তাঁকে ট্রাফিক আইল্যান্ডের ওপরই সমাহিত করা হয়।
জাহানারা ইমামের বর্ণনা

জাহানারা ইমাম একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে লিখেছেন:

“একটাও গাড়ি, রিকশা, স্কুটার, এমনকি সাইকেলও নেই রাস্তায়… আজকের কাঁচাবাজারও বসেনি। শেখ মুজিবসহ সব ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পূর্ণ সমর্থনে হরতাল পালিত হয়েছে।”

 

বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি ও ঘোষণা

রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করেন। তিনি ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন:

১. ৩–মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল।
২. মার্চ জাতীয় শোক দিবস।
৩. রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে জনতার সংবাদ প্রচার না করলে বাঙালি কর্মচারীদের তা নাকচ করার আহ্বান।
৪. মার্চ বিকেল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক সমাবেশ।
৫. শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল উপায়ে সংগ্রাম চালানোর নির্দেশ।

তিনি বলেন:

“বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।”

 

মানচিত্রখচিত পতাকার উন্মোচন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ-সোনালি পতাকা।

  • উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন।
  • এই পতাকাই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে কার্যত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়।
  • প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও একে জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করে।
    (সূত্র: নূরে আলম সিদ্দিকী, “পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ”)

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
  • করাচিতে ভুট্টো : পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, “অধিবেশন স্থগিত রাখায় তেমন ক্ষতি হয়নি। সমঝোতা হলেই অধিবেশন হবে।”
  • ভারতের দুঃখপ্রকাশ : ভারতের সরকার ইয়াহিয়া খানের ভারত-বিরোধী মন্তব্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিত্তিহীন” বলে দুঃখ প্রকাশ করে।

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

৪ মার্চ ১৯৭১ : জনজোয়ারে মিশে গেলেন শিক্ষক–শিল্পী–সাংবাদিক

হরতাল অব্যাহত ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল অব্যাহত থাকে। আন্দোলনের জোয়ারে এবার যোগ দেন শিক্ষক, শিল্পী ও সাংবাদিকরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন—

“চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির মুক্তি আসে না। যেকোনো মূল্যে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”

তিনি ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের আহ্বান জানান।

  • তবে যেসব অফিস–আদালতের কর্মচারীরা তখনও বেতন পাননি, তাঁদের সুবিধার্থে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দেন।

ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার করা হলেও খুলনা ও রংপুরে তা বহাল থাকে।

সহিংসতা প্রাণহানি
  • টঙ্গীর শিল্প এলাকায় সেনাদের গুলিতে ৩ শ্রমিক নিহত, ১৫ জন আহত।
  • খুলনার খালিশপুরে অবাঙালি বাড়ি থেকে বোমা হামলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জনতা অস্ত্রাগার লুট করে। সেনাদের গুলিতে ৬ জন নিহত।
  • চট্টগ্রামে গুলিতে আগের দিনের সঙ্গে মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে

হরতালে পুরো প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়ে। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাস্তায় টহল দেয়। ঢাকার সঙ্গে বাইরের স্থল, জল ও আকাশপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানার ইপিআর ব্যারাকে বাঙালি জওয়ানরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে জনতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।

 

শহীদদের স্মরণ ও শোকমিছিল

আগের তিন দিনে সেনাদের গুলিতে নিহতদের স্মরণে বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

  • জানাজা শেষে শোকমিছিল শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়।
  • ছাত্র ইউনিয়নের সমাবেশে মতিয়া চৌধুরী ঘোষণা করেন—

“বাংলার মানুষ আজ এক দফার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত—সেই দফা স্বাধীনতা।”

চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের গণসমাবেশে জেলা সভাপতি এম আর সিদ্দিকী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

 

অভূতপূর্ব সংহতি : শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিল্পী
  • সাংবাদিকদের অবস্থান : পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেসক্লাবে জরুরি সভায় যোগ দিয়ে ঘোষণা করে—সরকার সংবাদ প্রকাশে বাধা দিলেও সাংবাদিকরা তা মানবেন না।
  • শিক্ষকদের প্রতিবাদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন শিক্ষক পাকিস্তান অবজারভার–এর ভূমিকার প্রতিবাদে বিবৃতি দেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ প্রমুখ।
  • শিল্পীদের ঘোষণা : ওয়াহিদুল হক, আতিকুল হক, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, গোলাম মুস্তাফা, জাহিদুর রহিম, লায়লা হাসান, হামিদা আতিক, অজিত রায়সহ বহু শিল্পী সেনাদের বর্বরতার প্রতিবাদে বেতার–টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন।

ঢাকা বেতার টেলিভিশনের ঐতিহাসিক অবস্থান
৪ মার্চ বেতার ও টিভির কর্মীরা প্রথমবার পাকিস্তানি পরিচিতি বাদ দিয়ে নিজস্বভাবে ঘোষণা দেন—

  • রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র → ঢাকা বেতার কেন্দ্র
  • পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা → ঢাকা টেলিভিশন

এদিন থেকেই প্রচারিত হয় জয় বাংলা” গান। বাংলা সংবাদ দিনে দুইবার বাড়িয়ে তিনবার প্রচার করা হয়। শিল্পীরা ঘোষণা দেন—

“যতদিন জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন আমরা বেতার ও টেলিভিশনে অংশ নেব না।”

 

বাঙালি নেতাদের তৎপরতা
  • মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খান সবুর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডিতে সাক্ষাৎ করেন।
  • মাওলানা ভাসানী একদিন ঢাকায় থেকে এদিন সন্তোষে ফিরে যান। ঢাকায় থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ন্যাশনাল লীগের আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান।
  • ঢাকায় বাংলা জাতীয় লীগের জরুরি সভায় সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়।
  • পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিন ১০ মার্চের ইয়াহিয়ার সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।

 

পাকিস্তানি নেতাদের কর্মকাণ্ড
  • জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে জানান—পিপিপি যতটা সম্ভব ৬ দফার কাছাকাছি যেতে চায়। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে সমঝোতায় আশাবাদী এবং প্রয়োজনে ঢাকায় আলোচনার জন্য আসতে প্রস্তুত।
  • ন্যাপ (ওয়ালি)–র বেলুচিস্তান শাখা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ১২ মার্চ হরতালের ডাক দেয়।
  • এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান করাচি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন—

“দেশের সংহতি রক্ষায় অবিলম্বে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।”

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

৭ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্ত ভাষণে বাঙালি পায় নির্দেশনা

একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এই ঘোষণা বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

সেদিন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। মুহুর্মুহু স্লোগান ছিল—‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। এটুকু সময়ের ভাষণেই তিনি বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। তারপর বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু ১ মার্চেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বক্তব্য দেবেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য সকাল থেকেই দেশের দূরদূরান্তের মানুষ দলে দলে পায়ে হেঁটে, বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে নারী-পুরুষে সয়লাব হয়ে যায় বিশাল ময়দান।

বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি আর চোখে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে নেতার নির্দেশ শোনার জন্য উপস্থিত হন। বেলা সোয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরে শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানান।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম-দুস্তর পথের প্রান্তে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্মৃতিফলক বসিয়ে দেন। সংগ্রামে উন্মুখ জাতির কাছে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার মন্ত্রণা। লাখ লাখ মুক্তিসংগ্রামীর উদ্দেশে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।

আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়,…আমি যদি হুকুম দিবার না–ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।…এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’

 

৮ মার্চের সকাল শুরু হয় ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে আগের দিন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সম্প্রচার দিয়ে। বেতারে সেটি সম্প্রচার করা হয় সকাল সাড়ে আটটায়। অন্যান্য বেতারকেন্দ্র থেকেও সেটি পুনঃপ্রচার করা হয়। ভাষণটি রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি প্রচার না করার প্রতিবাদে আগের দিন বিকেল থেকে ঢাকা বেতারকেন্দ্রের বাঙালি কর্মীরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। এটি প্রচারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বেতারকর্মীরা সকালে কাজে যোগ দেন।

কিন্তু ভাষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ করা হয়। ছাত্রলীগের এ সভায় জেলা থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং সিনেমা হলে উর্দু ছায়াছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য তৎপরতা দেখা যায়।

ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের নিরস্ত্র বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কালো পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানায়। পাড়ায় পাড়ায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওঠানো হয়।

সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং মোটরগাড়ি কালো পতাকা লাগিয়ে চলাচল করে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক অফিসের কাজ বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–কর্মচারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য এক দিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন।

 

৯ মার্চ ১৯৭১ : স্বাধীনতা মেনে নিন, ইয়াহিয়াকে ভাসানী

আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই দিনেও রাজনীতির উত্তাপ অব্যাহত ছিল। দিনের আলোচিত ঘটনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বৈঠক এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় ভাসানীর বক্তৃতা।

আওয়ামী লীগ ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী এই দিন সচিবালয়সহ সারা দেশে সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দেন, কেবল সেসব চালু থাকে।

সারা দেশে ব্যাংকিং কাজকর্ম চলে। বাস, মোটরগাড়ি, রিকশা ও অন্য যানবাহন চলাচল করে। দোকানপাট ও হাটবাজার খোলা থাকে। লঞ্চ ও ট্রেন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করে। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, ভবন ও যানবাহন এবং বাসগৃহে কালো পতাকা ওড়ানো হয়।

মুক্তি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

রাজশাহী শহরে প্রতি রাতে রাত নয়টা থেকে আট ঘণ্টা অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আওয়ামী লীগ এক বিবৃতিতে বলে, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাজশাহীতে হঠাৎ কারফিউ জারির কারণ বোধগম্য নয়।

এর জন্য নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

‘স্বাধীন বাংলাদেশ’: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যানটিনে সকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

আরেক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর ওপর স্বাধীনতা আন্দোলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

ছাত্রলীগের জেলা ও শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখার সভাপতিকে আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং ৯ জন সদস্য নিয়ে মোট ১১ জনের সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যও প্রস্তাব আনা হয়।

পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর পরিবর্তে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহার করারও প্রস্তাব গৃহীত হয়।

বামপন্থী দলের তৎপরতা

পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, কিছু তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলছে ধর্মঘট বা অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির প্রয়োজন নেই। বরং তারা গ্রামে গ্রামে কৃষিবিপ্লব শুরু করার এবং জোতদারদের গলা কাটার আওয়াজ তুলছে। কোনো কোনো নেতা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে’ বলে ধ্বনি তুলে চলমান গণসংগ্রামের উদ্দীপনা ও সংকল্পে ভাটা এনে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এক বিবৃতিতে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করে সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

 

আন্দোলনের বিপক্ষে হক-তোয়াহা

আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) তাদের বিলি করা এক প্রচারপত্রে গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং পূর্ব বাংলার তথাকথিত দরদি বিশ্বাসঘাতক নেতাদের পরামর্শদাতা হলো কুখ্যাত নরপশু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড।…গত কিছুদিন যাবৎ ঘন ঘন পূর্ব বাংলায় এসে এখানেও ব্যাপক হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বের মেহনতি মানুষের বড় দুশমন এই হিংস্র জানোয়ারদের সঙ্গে যেসব তথাকথিত বাংলার দরদি নেতারা বৈঠক করে, ষড়যন্ত্র করে এবং লাঞ্ছিত, শোষিত মানুষকে শান্ত থাকতে উপদেশ দেয়, তারা গরিব কৃষক-শ্রমিকের বন্ধু হতে পারে না।’

 

টিক্কা খান সামরিক প্রশাসক

গভীর রাতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে এক ঘোষণায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক বিমানে ঢাকায় এসেছিলেন। ৯ মার্চ তাঁর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।

 

মার্চ মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১০ মার্চ ১৯৭১ : দেশজুড়ে কালো পতাকা, কর্মচারীদের কাজ বর্জন

আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি একাত্তরের ১০ মার্চও সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে সারা দেশে সরকারি ও আধা সরকারি অফিসের কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িগুলোও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলাচল করে। অনেক বাড়িতেও বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল।

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১১ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ১৪টি নির্দেশ জারি করেন। মূলত সরকারি অফিস, ব্যাংক–বিমা ও অন্যান্য সংস্থা কীভাবে চলবে এবং কী কী বিধিনিষেধ মেনে চলবে—বিবৃতিতে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২৩ মার্চের পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

দেশ উত্তাল। সরকারি-বেসরকারি সব কাজকর্ম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলা অব্যাহত ছিল। চলমান অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালতসহ সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা।

ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে দিনভর অবিরাম চলে সভা-শোভাযাত্রা। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এই দিনেও গড়ে উঠেছে সংগ্রাম কমিটি।

সকালে ঢাকার রমনা পার্কে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে বের হয় দীর্ঘ নৌ মিছিল।

চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব ও পদক বর্জন করেন।

স্বাধীনতার দাবিতে সারা বাংলা উত্তাল। বিক্ষোভ–সমাবেশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে।

সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নম্বর নির্দেশের প্রতিবাদে দেশ রক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সকালে ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। সরকারি কর্মচারী সমন্বয় কাউন্সিলের বিবৃতিতে সামরিক নির্দেশ কার্যকর না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

১৫ মার্চ ১৯৭১ : ভুট্টোর নতুন দাবি, ইয়াহিয়া ঢাকায়

আগের দিনের ছড়ানো গুজবকে সত্যি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে স্বাগত জানান। কোনো সাংবাদিক বা বাঙালিকে বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) জুলফিকার আলী ভুট্টো আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন সরকারের দাবি জানান।

১৬ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে এই দিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হয়।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আজ ১৫তম দিবস। বেলা ১১টার কিছু আগে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনের (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) বৈঠকে যোগ দেন। তাঁর পরনে ছিল সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা গলাবন্ধ কোট। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে পৌঁছালে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানান। রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুরু হয় একান্ত আলোচনা। চলে আড়াই ঘণ্টা।

আলোচনা শেষে ইয়াহিয়া বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত এসে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে পৌঁছালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে, আরও হবে। কাল সকালে আরেকটি বৈঠক। আপাতত আর বেশি কিছু বলার নেই।’

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ

একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। দিনটি আর দশটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। আগের দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক কোনো পরিণতির দিকে এগোয়নি। আজ সেই অসমাপ্ত বৈঠকের দ্বিতীয় দফা। একদিকে বৈঠক চলছে, আরেক দিকে সারা দেশ উদ্বেলিত হয়ে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। শহরগুলো মিছিলের নগরী।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুহুর্মুহু মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে আসে। বাসভবনের সামনের রাস্তা লোকারণ্য হয়ে যায়। তাঁরা বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানান। তাঁদের শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে মিশে ছিল মুক্তির জন্য আকুল বার্তা।

শেখ মুজিবের বাসভবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। রাত পর্যন্ত দলীয় কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শুভেচ্ছা সাক্ষাতে মিলিত হন। বায়তুল মোকাররম মসজিদে বাদ আসর মিলাদ শেষে শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু কামনা করে বিশেষ মোনাজাত হয়। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ

বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর পরবর্তী আর কোনো আলোচনার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। এ নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা জন্মায়। অবশেষে রাতে ঘোষণা করা হয়, তৃতীয় দফা বৈঠক হবে কাল বেলা ১১টায়।

১৮ মার্চও ঢাকার রাজপথে দিনভর ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মিছিল চলতে থাকে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাসংগ্রামের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য শপথ নেয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শহীদ মিনারে সাবেক বিমানসেনাদের শপথ গ্রহণ। ঢাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।

সারা দিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে উৎকণ্ঠিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে তাঁর বাসভবনে ভিড় করে। বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বৈঠক থেকে উঠে গিয়ে সমবেতদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি সবাইকে চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তোমাদের ওপর আঘাত এলে তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হানো।’

 

১৯ মার্চ ১৯৭১ : ইয়াহিয়া-মুজিব তৃতীয় বৈঠক

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ

 

এক দিন বিরতির পর ১৯ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা বসে প্রেসিডেন্ট ভবনে। একান্ত এ আলোচনায় তৃতীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে দেড় ঘণ্টা কথা হয়।

বৈঠক শেষে শেখ মুজিব নিজ বাসভবনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পরদিন সকালে আবার বৈঠক হবে। তবে সে বৈঠক একান্ত হবে না। দলের শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে থাকবেন। এর আগে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় বসবেন।

 

আরও দেখুনঃ

24 thoughts on “মার্চ মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ”

Leave a Comment