সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য
বার্তা সংস্থা এএফপি করাচির ওয়াকিবহাল মহল সূত্রে ১ সেপ্টেম্বর খবর পরিবেশন করে, পাকিস্তানে বন্দী বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ১১ আগস্ট তাঁর বিচার শুরু হলেও কোনো ঘোষণা ছাড়াই সেই বিচার বন্ধ রাখা হয়। কয়েক দিন পর জানানো হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহির সাহায্য পাবেন। তবে ব্রোহি রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনার জন্য এলে তাঁকে বিচার কবে শুরু হবে, তা জানানো হয়নি।
করাচির ডেইলি নিউজ পত্রিকায় ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মুজিবের বিচার হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহি ৩১ আগস্ট দেশে আস্থা বাড়াতে পাকিস্তান সরকারের নতুন পদক্ষেপগুলো জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে অবহিত করেছেন। এরপর তিনি নিউইয়র্কে সংবাদদাতাদের বলেন, পদক্ষেপগুলো আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ হৃত সম্পত্তি ফিরে পাবেন শরণার্থীরা

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া সব শরণার্থীকে সসম্মানে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার খুব ভালো করেই জানে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সব সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখলে নিয়েছে। তাই শত্রুসেনার কবলমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরণার্থীরা তাঁদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন।
যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ে সফরকালে এদিন সকালে দেশটির প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের আমন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বিচারপতি পিয়ের অল্ড সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তাঁর কক্ষে আসার অনুরোধ জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী সংক্ষেপে তাঁদের বাঙালির স্বাধীনতা কামনার মূল কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতিরা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন।
একই দিনে আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনাকালে বাঙালিদের দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এরপর আবু সাঈদ চৌধুরী অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিনের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে কথা বলেন। ট্রাইব্যুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রণয়ন করা। এ সম্পর্কে আলোচনার পর অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনালের সদস্যপদ গ্রহণ করতে রাজি হন।
ফারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করলেন না বঙ্গবন্ধু
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় একটি কূটনৈতিক সূত্র পাকিস্তান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২ সেপ্টেম্বর জানায়, পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সূত্রটি জানায়, শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত দূত হেনরি কিসিঞ্জার যখন ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন, তখন প্রথম ফারল্যান্ড ওই প্রস্তাব শেখ মুজিবকে পাঠান। দ্বিতীয়বার একই প্রস্তাব পাঠান চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। কিন্তু শেখ মুজিব বলেন, যাদের অস্ত্রে বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
ভারত সফররত পশ্চিম জার্মানির সংসদ এবং সরকার প্রেরিত প্রতিনিধিদলের নেতা ড. গুয়েনভার রিনসাচি দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। তিনি বলেন, তাঁদের সরকার শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো কাজ যেন তিনি না করেন।
পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখতে এই দিন ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ১৬টি দেশের মিলিটারি অ্যাটাশে সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছান। ১৬টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপাইন, লেবানন, মিসর, ইরান ও ঘানা প্রভৃতি দেশ।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের গজারিয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি প্রতিরক্ষাচৌকিতে হামলা করে কয়েকজন ইপিকাফ সেনাকে হতাহত এবং একজনকে বন্দী করে।
৬ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা তিস্তা নদীসংলগ্ন শঠিবাড়ি বন্দর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করে। পাকিস্তানি সেনারা শেল ও রকেটের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। সারা দিন আক্রমণ অব্যাহত থাকে।
৭ নম্বর সেক্টরের অধীন বগুড়া জেলার গাবতলীতে মুক্তিযোদ্ধারা জাতহলিদা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালান। দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা পাঁচজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চালনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা নৌকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী তাদের অ্যামবুশ করে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহীর কয়েকটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়। গুলিতে কয়েকজন হতাহত হয়।
৩ সেপ্টেম্বর – চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্ব প্রতিরক্ষা বাহিনীর: ইন্দিরা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অধিনায়কদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তার কোনো বিকল্প নজির নেই। পৃথিবীর আর কোথাও জনগণ এভাবে সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ভারত এখন এক কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অন্যদিকে ভারতে বহিঃশত্রুর হুমকি। এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতকে তৈরি থাকতে হবে। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সেই দায়িত্ব বিশেষভাবে নিতে হবে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির সাংসদ কেনেথ বেকার পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী পরিদর্শনের পর দিল্লি রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের উদ্যোগ যাতে বন্ধ হয়, সে জন্য তাঁদের সরকার পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব এবং প্রধানমন্ত্রী কীর্তিনিধি বিস্তা কাঠমান্ডুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার সরণ সিংয়ের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের ব্যাপারে নেপাল ভারতকে সমর্থন জানাবে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী কবির জন্য পাকিস্তান সরকারের আবার মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, লাখ লাখ মানুষের রক্তমাখা টাকা তিনি স্পর্শ করবেন না। পাকিস্তান কবিকে ভাতা দেওয়া বন্ধ করলে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কবিকে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর পাকিস্তান আবার কবিকে মাসিক ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কাজী সব্যসাচী এদিন দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন, কবিকে নতুন করে মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য।
আলোচ্যসূচি থেকে বাংলাদেশ বাদ
প্যারিসে আন্তসংসদীয় সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি আলোচনার জন্য সদস্যদের ভোটে আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও বিষয়টি স্ট্যান্ডিং অর্ডারের বিধিবহির্ভূত বলে সম্মেলনের চেয়ারম্যান ফ্রান্সের অ্যাকিলি পেরেসি রায় দেন, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে না। এর আগে সম্মেলনের আলোচ্যসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৪৯৮-৭৪ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ১৯৫ জন ভোটদানে বিরত থাকেন। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন ভারতের প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং ভারতের লোকসভার স্পিকার ড. জি এস ধীলন। আপত্তি করেছিলেন মূলত আরব ও মুসলমান সাংসদেরা।
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন অসলোর মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। মেয়র বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান। আবু সাঈদ চৌধুরীকে অসলো শহরের আলোকচিত্র–সংবলিত একটি বই উপহার দেওয়ার সময় তাঁকে তিনি বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন।
আবু সাঈদ চৌধুরী বিকেলে নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকা এদিন দেশটির সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতা পিটার ডেভিড শোরের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পিটার শোর বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আবার বাণিজ্যিক বা আর্থিক সাহায্যের সূচনা করা যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত হবে না। পাকিস্তানের সরকারকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। সেখানে ক্ষমতা থেকে তাদের সরে আসতে শুরু করতে হবে। যুক্তরাজ্য সরকার এ পর্যন্ত একটি সন্তোষজনক সীমারেখা গ্রহণ করেছে। তবে অক্টোবরে আবার বাণিজ্য সুবিধা শুরু করার ঔচিত্য নিয়ে ভাবতে হবে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নতুন গভর্নর
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এদিন শপথ নেন। শপথবাক্য পাঠ করান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীসহ উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তান জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। ধামরাইয়ের গ্রামের বাড়ি থেকে ১৪ জুন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ৩ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালান। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধারা হামলা করলে কয়েকজন সশস্ত্র রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ভোমরা সীমান্তঘাঁটিতে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করেন। তাঁদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
ভালুকার ভরাডুবা গ্রামে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের ওপর হামলা করলে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ খন্দকার মোশতাক কথা বলবেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে
পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কলকাতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে তাঁরা জানিয়ে রাখতে চান যে ইয়াহিয়া তাঁর সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করতে রাজি। ফারল্যান্ডের এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়াও রাজি হন।
যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মোশতাকের এই গোপন যোগাযোগের খবর তখনই প্রকাশ পায়। এ ব্যাপারে মূলধারা ’৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান লিখেছেন: ‘কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা প্রকাশের আগে অবধি এই ঘটনার কথা অবিদিত থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভিতরে ভিতরে চলছিল, তা সেই সময়ের আর একটি সূত্র থেকে প্রকাশ পায়।’
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের সচিবালয় থেকে ৪ সেপ্টেম্বর এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়, দেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাঁরা অপরাধ করেছেন বা যাঁদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই ক্ষমা কার্যকর হবে এবং এটি সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসারসহ সবার প্রতি প্রযোজ্য হবে।
আবার বাংলাদেশে যাবে অপারেশন ওমেগা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ৪ সেপ্টেম্বর অপারেশন ওমেগা দলের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, ৫ সেপ্টেম্বর আবার তাঁদের চারজন স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশে যাবেন। ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে যশোর রোড ধরে তাঁরা হেঁটে এগিয়ে যাবেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু খাদ্যসামগ্রী থাকবে। তাঁদের উদ্দেশ্য পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ অমান্য করে দুর্গত মানুষের সেবা করা। এর আগে ১৭ আগস্ট এই দলের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক সীমান্ত অতিক্রম করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে গেলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের এক দিন আটক রেখে আবার ভারতে ফেরত পাঠায়।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বকেয়াসহ মাসিক ভাতার একটি চেক এ দিন কবি-পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। পাকিস্তান সরকার কবির মাসিক ভাতা মার্চ থেকে বন্ধ করে দিয়েছে জানার পর বাংলাদেশ সরকার কবিকে প্রতি মাসে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কবির বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে বকেয়াসহ আগস্ট পর্যন্ত ভাতা পরিশোধ করা হয়।
গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দুই দিক থেকে আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালান। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সময় কিছু বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে ঝটিকা আক্রমণ চালালে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা তিস্তা নদীসংলগ্ন শঠিবাড়ি বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দিনব্যাপী যুদ্ধ করেন। আগের দিন থেকে চলা এই যুদ্ধ সকাল থেকে তীব্র আকার নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে শঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারে আক্রমণ করেন। যুদ্ধ সারা রাত অব্যাহত থাকে।
৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধারা বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির ফুলবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানি অনুগত ছয়জন পুলিশের ওপর আক্রমণ চালান। এতে দুজন পুলিশ নিহত এবং বাকি চারজন পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মেহেরপুরের ইছাখালী সীমান্ত ঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ করেন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
বিদেশি পত্রিকায় বাংলাদেশ
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এ দিন তাদের সংবাদদাতা মার্টিন উলাকটের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে খবর প্রকাশ করে, খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেছেন, শিগগিরই ঐক্যবদ্ধ মুক্তি ফ্রন্ট গঠিত হতে চলেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
ব্রিটেনের মর্নিং স্টার পত্রিকায় আরেকটি খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সাহায্য ও সমর্থন দেওয়ার লক্ষ্যে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরে একটি সলিডারিটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক দল, ওয়েলস জাতীয়তাবাদী দল, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড এবং ইয়াং কনজারভেটিভদের প্রতিনিধি রয়েছেন। কমিটি গঠনের সভায় কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, অবিলম্বে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত দূত সুলতান মোহাম্মদ খান সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এ দিন মস্কো যান। পাকিস্তানে সরকারিভাবে বলা হয়, মস্কোর আমন্ত্রণেই তিনি সেখানে গেছেন, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এমন বলা হয়নি।
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর আট নম্বর সেক্টরের অধীন সুতিপুর প্রতিরক্ষার অগ্রবর্তী এলাকা যশোরের শার্শায় গোয়ালহাটিতে ৫ সেপ্টেম্বর নিয়োজিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পেট্রল দল। দলের অধিনায়ক ছিলেন ইপিআরের সাবেক সদস্য নূর মোহাম্মদ শেখ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দলের অবস্থান টের পেয়ে যায়। তারা দ্রুত তিন দিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নূর মোহাম্মদ সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন, পাকিস্তানি সেনাদের সামনে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা পিছু হটতে চেষ্টা করেন। এ সময় সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে কাঁধে নিয়ে নূর মোহাম্মদ গুলি করতে করতে পেছনে সরে আসছিলেন। হঠাৎ দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে তাঁর ডান পায়ের হাঁটু চুরমার হয়ে যায়।
বিপর্যয়কর এই অবস্থায় নূর মোহাম্মদ শেখ সহযোদ্ধা মোস্তফা কামালকে নির্দেশ দেন, আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে করে নিয়ে পেছনে সরে যেতে। আর তাঁদের কাভার করার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে। মোস্তফা কামাল তাঁকে ফেলে যেতে রাজি ছিলেন না। নূর মোহাম্মদ জোর করে তাঁদের ফেরত পাঠান। এর পর একাই লড়াই করতে করতে নূর মোহাম্মদ শেখ শহীদ হন। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের মুক্তিযোদ্ধারা পরে এসে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করেন। স্বাধীনতার পর নূর মোহাম্ম শেখকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়।
ক্ষমতার ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৫ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে একটি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচারকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেন। জলে-স্থলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য সাফল্যের বিবরণ দিয়ে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতার ভিত্তিতে ভাঙন ধরেছে এবং বাংলাদেশে সামরিক শাসকচক্রের মুষ্টিমেয় নিরাপদ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে।
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এর নবতম প্রমাণ ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। যেসব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনোভাব দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে এখন সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তা বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করছে।
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এমএনএ ও এমপিএরা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আবার অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন। জনপ্রতিনিধিদের বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাঁদের বিষয়সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস-তাঁদের প্রতিজ্ঞা টলাতে পারবে না।
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার, জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলার সব ধরনের চেষ্টা বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ করেছে। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তাদের কাছে তিনি আবার আবেদন জানান।
তাজউদ্দীন বলেন, তিনি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়—ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের ওপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী।
পাকিস্তানের অপতৎপরতা
পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয়, মামলায় অভিযুক্ত এমএনএ, এমপিএ এবং সরকারি কর্মকর্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য হবে না।
ইসলামাবাদে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দিন ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একটি নোট দেয়।
আবারও অপারেশন ওমেগার অভিযান
অপারেশন ওমেগা দলের স্বেচ্ছাসেবকেরা এই দিন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে গেলে আবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের আটক করে। এর আগে ১৭ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী এই ত্রাণ সংস্থার সদস্যদের আটক করে এক রাত আটক রেখে পরদিন ভারতে ফেরত পাঠিয়েছিল। অপারেশন ওমেগা ত্রাণসংস্থা ত্রাণসামগ্রীসহ চার সদস্যের আরেকটি দলকে এ দিন বাংলাদেশে পাঠায়। দলের দুজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এবং দুজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। চারজনের দুজন ছিলেন নারী।
অপারেশন ওমেগার স্বেচ্ছাসেবকেরা এবারও পেট্রাপোল সীমান্ত হয়ে সড়ক পথে দলটি বাংলাদেশের বেনাপোলে প্রবেশ করে। ৪০০ মিটার যাওয়ার পর তিনজন পাকিস্তানি সেনা তাদের পথরোধ করে। কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর তিন সেনা ফিরে যায়। দলটি আরও এগিয়ে গেলে কয়েকজন পাকিস্তানি এসে দলটিকে ঘিরে ফেলে। ঘন্টাখানেক বিতর্কের পর সেনারা তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।
নেপাল সফর শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং কাঠমান্ডুতে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে ভারত অবশ্যই বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জাতিসংঘের কোনো সংস্থায় তুলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে ভারতের মনোভাব তিনি নেপালের রাজা ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছেন। নেপালের কাছ থেকে ভারতের অভিমতের পক্ষে আরও বেশি সমর্থন পাওয়া গেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম মুঙ্গেরে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দারুণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে কোনো অপচেষ্টা শুরু করলে তা অঙ্কুরেই শেষ করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া আছে।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র ৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের জানায়, কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর পদবি বদলে হাইকমিশনার এবং মিশনের নাম বদলে করা হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সেলের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডি পি ধর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর মিশনপ্রধানের পদবি ও মিশনের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার
জন্য মুজিবনগরে আসবেন। তাঁর হঠাৎ আসার বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মহলটি জানায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকার যাতে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারে, সে জন্য তাদের কোনো দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার আশা করছিল, ভারত সরকার সবার আগে তাদের স্বীকৃতি দেবে। সরকার আরও একটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছিল, তা হচ্ছে কমনওয়েলথভুক্ত হওয়া।
অপারেশন ওমেগা দলের যে চারজন স্বেচ্ছাসেবক ৫ সেপ্টেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে আসেননি।
প্রবাসে আবু সাঈদ চৌধুরীর জনসংযোগ
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন সকালে অসলোতে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। সন্ধ্যায় তিনি অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে এক ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য দেন। নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাত্রদের সংগঠন পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করে। ব্যঙ্গচিত্রটিতে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে দেখানো হয়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত দূত সুলতান মহম্মদ খান এই দিন মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান মহম্মদ খান সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদায় বলা হয়, পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রদর্শন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি।
ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত: ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা কোনো দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিলে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি তার বিরুদ্ধে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তারা (পাকিস্তান) তখন এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে হয়তো নিবৃত্ত হবে। জম্মু থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী রাজৌরিতে এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
আইএনটিইউসির কার্যনির্বাহক কমিটি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানায়। দিল্লিতে এদিন আইএনটিইউসির দুই দিনব্যাপী বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন ৪৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
এক নম্বর সেক্টরের অধীন একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে পোলো গ্রাউন্ডের প্রবেশমুখে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালালে দু-তিনজন হতাহত হয়।
ফেনীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের সিলোনিয়া নদী অতিক্রমের সময় আক্রমণ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।
শরীয়তপুর জেলায় ২০ জনের একটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল পালং থানার রাজগঞ্জের কাছে নদীর পারে অ্যামবুশ পাতে। পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়লে গেরিলারা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের ৩০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মোগলহাট রেললাইনের ওপর অ্যান্টি–ট্যাংক মাইন, গ্যালাটিন ও পিইকে বসিয়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহী একটি ট্রেন অগ্রসর হলে মাইন বিস্ফোরণে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা মক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেমতলী অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ সরকার ও টি এন কাউল সাক্ষাৎ

ভারত সরকারের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ৭ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। সকালে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছেই তিনি সরাসরি মুজিবনগরে যান।
প্রথমে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনা করেন; সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেন। তাঁরা টি এন কাউলকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কর্মকাণ্ডের বিশদ প্রতিবেদন দেন।
বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের চেষ্টা চলছিল। টি এন কাউল বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়েও কথা বলেন।
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতের টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করেন।
মাহবুবুল আলম চাষীর দিল্লি সফর ছিল রহস্যজনক। এ ব্যাপারে মঈদুল হাসান তাঁর মূলধারা ’৭১ বইটিতে লিখেছেন, ‘প্রস্তাবিত ঐক্যফ্রন্টকে দুর্বল “উপদেষ্টা কমিটি” পরিণত করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর ভূমিকা ছিল খোন্দকার মোশতাকের। আওয়ামী লীগের “নিরঙ্কুশ অধিকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে” বহুদলীয় কমিটি গঠন করার ফলে আওয়ামী লীগের যে অংশ ক্ষুব্ধ হয়, তাদেরকে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার ক্ষেত্রেও মোশতাক সক্রিয় ছিলেন।
অথচ নিজের নিউইয়র্ক যাওয়া যাতে সম্ভব হয়, এ জন্য সংশ্লিষ্ট বৈদেশিক মহলের জন্য তাঁর বাহ্যিক ভূমিকা ছিল অন্য রকম। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ার পাঁচ দিন আগে, যখন এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন প্রবাসী নেতৃত্ব গোপনীয়তা বজায়ের চেষ্টা করছিলেন, এমনকি ভারতীয় পত্রপত্রিকায়ও দৃশ্যত যখন এ বিষয়ের কোনো হদিস পায়নি, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে ঘোষণা করেন যে শীঘ্রই “ঐক্যবদ্ধ মুক্তিফ্রন্ট” গঠিত হতে চলেছে এবং “এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন লাভ সম্ভব হতে পারে।” ৫ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষীকে তিনি দিল্লি পাঠান মুখ্যত তাঁর প্রত্যাশিত ভ্রমণ সম্পর্কে ভারতের সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে।
গেরিলা অভিযান
৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন পঞ্চগড়ের জগদলহাটে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটলে মুক্তিযোদ্ধারা জগদলহাট দখল করে নেন। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি বাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল তিন দিনব্যাপী যুদ্ধের পর এই দিন তিস্তা নদীর তীরবর্তী শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত করে।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সাতক্ষীরায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঝাউডাঙা অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন পাঞ্জাবি পুলিশ হতাহত হয়। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল মধুখালী-দোসাতিনা সড়কে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রেঞ্জারদের সম্মিলিত একটি দলকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল গোয়াল গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর তিনজন গুরুতর আহত ও পাঁচজন নিখোঁজ হন।
আবু সাঈদ চৌধুরীর জনসংযোগ
যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন নরওয়ে থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে যান। সুইডেনে পাকিস্তান দূতাবাসের সাবেক বাঙালি কূটনৈতিক কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। আবদুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।
স্টকহোমে পৌঁছে আবু সাঈদ চৌধুরী নোবেল–বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের সঙ্গে দেখা করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণের অনুরোধ করলে মিরডাল রাজি হন।
আবু সাঈদ চৌধুরী বিকেলে ক্ষমতাসীন সুইডিশ সোশ্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টির মহাসচিব স্টেন অ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর অ্যান্ডারসন বলেন, তাঁর পার্টির সমর্থন আছে। তবে বাংলাদেশকে আসল সাহায্য করতে হলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিতে হবে। তিনি তাঁদের পার্টির মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, এ ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। এই গণহত্যা সংঘটনে যারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, তারাও গণহত্যাকারীর মতো সমান অপরাধে অপরাধী। তাই নিক্সন ও তাঁর সরকারও একই অপরাধে অপরাধী। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি হায়দরাবাদে রোটারি ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে, অনেক দেশ তা জেনেও মুখ খুলছে না। এটা খুবই দুঃখের কথা যে বাংলাদেশের এই মর্মন্তুদ ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমাজের বিবেক যথেষ্টভাবে জাগ্রত হয়নি।
ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন জামসেদপুরে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ভারত সমর্থন করে যাবে। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে মনে করিয়ে দেন, ভারত এখন আগের থেকে বেশি শক্তিশালী এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত ও সক্ষম।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল কলকাতায় দুই দিনের সফর শেষে বলেন, জাতিসংঘের আগামী সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে ভালোভাবে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশের মানুষের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই কেবল শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে পারে।
ওমেগার সদস্যরা আটক
ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশনারের সূত্রে এদিন জানা যায়, অপারেশন ওমেগার চার সদস্যকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করেছে। তাঁরা যশোর জেলে বন্দী আছেন। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা ভারতের পেট্রাপোল দিয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ঢোকেন।
অপারেশন ওমেগা দলের সংগঠক রজার সোদি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁদের কাছে পাঠানো বার্তায় জানিয়েছে, অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে ওমেগা দলের চার সদস্যের বিচার হবে। তিনি বলেন, ওমেগা দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অপারেশন ওমেগার সমর্থকেরা লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে ৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে।
সুইডেনে আবু সাঈদ চৌধুরী
সুইডেন সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন সকালে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমার এবং বিকেলে সুইডিশ পার্লামেন্ট হাউসে লিবারেল পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন। ইয়ান স্টিফেনসন আশ্বাস দেন, লিবারেল পার্টি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে। আবু সাঈদ চৌধুরী সুইডেনের খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভনিং ডেইলি পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামানবার্গের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। হ্যামানবার্গও বাংলাদেশ আন্দোলন সমর্থন করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন।
দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন দিল্লি প্রেসক্লাবে বলেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কমনওয়েলথে যোগ দিতে চাইবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে। পুরো স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্ন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী এই দিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধরের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশনে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে কথা বলেন। ডি পি ধরের সঙ্গে দেখা করার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
মাহবুবুল আলম চাষীর অযাচিত দিল্লি সফর ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। কারণ, ইতিমধ্যে ভারতের গোয়েন্দারা জেনে ফেলছিল, খন্দকার মোশতাক আহমদ, চাষী এবং তাঁদের আরও কয়েকজন সহযোগী বাংলাদেশ সরকারের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক সরকারকে না জানিয়ে তাঁকে দিল্লি পাঠিয়েছেন।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধারা এদিন চট্টগ্রামে আদালত ভবনে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানটি চট্টগ্রাম শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই অভিযানের খবর প্রচার করে। খবরে বলা হয়, চট্টগ্রামে আদালত ভবনের তিনতলায় একটি টাইমবোমার বিস্ফোরণে কয়েকজন হতাহত হয়। তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সেনেরহাটে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সেনেরহাট অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালান। সারা দিন ব্যাপক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ ও আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল যশোরের সদর থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর বারিনগর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের গণসংযোগ বিভাগের যুদ্ধ বুলেটিনে বলা হয়, বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এদিন ১১৯ জন শত্রুসেনাকে হত্যা করেছে।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পাঁচদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন
বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য মুজিবনগরে ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগসহ পাঁচটি দলের আটজন সদস্য নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। নবগঠিত এই কমিটি মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে ভাসানী ও ওয়ালিপন্থী দুই ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী), বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটিটি গঠিত হয়। দুই দিন ধরে যৌথ বৈঠকের পর সর্বসম্মতভাবে এই কমিটি গঠিত হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে যাঁরাই লড়াই করছেন, তাঁদের সবার মধ্যে একাত্মতা গড়ে তোলা এই কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য।
১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ উপদেষ্টা কমিটিকে ভারতের স্বাগত
বাংলাদেশের পাঁচটি দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনকে ভারতের সরকারি মহল ১০ সেপ্টেম্বর স্বাগত জানায়। তারা বলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে এটি নতুন অধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ও পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এ দিন প্রথম প্রকাশ্যে জানান, বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।
তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের রাজনৈতিক মূল্য
অপরিসীম। জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি উঠলে এই কমিটির বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে কথা বলার পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি কীভাবে তোলা হবে, তা নিয়েও বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে ডি পি ধর ও টি এন কাউলের আলোচনা হয়।
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে একটি কূটনৈতিক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, সিংহল সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এ দিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করা হলেও সূত্রটি জানায়, যেসব প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে, যেমন বাংলাদেশ, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির তাৎপর্য এবং ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। শ্রীলঙ্কার কাছে বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অথচ ভারত একে আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে মনে করছে। সোভিয়েত-ভারত চুক্তি সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার মনোভাব হচ্ছে, বৃহৎ শক্তির উপস্থিতির ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনাই শুধু বাড়বে।
নেপাল সফররত তিন সদস্যের বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদল এই দিন কাঠমান্ডুতে সংবাদ সম্মেলনে বলে, তারা নেপালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তবে কূটনৈতিক কারণে সেসব কথা তারা প্রকাশ করেনি।
অঁদ্রে মালরোর চিঠি
প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও ভাবুক অঁদ্রে মালরো পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণকে ভিয়েতনামের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের মতো জবাব দিতে বলেন। দিল্লিতে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে লেখা চিঠিতে তিনি এ কথা বলেন। চিঠিটির ভাষ্য এই দিন প্রকাশ করা হয়।
উপমহাদেশের বাইরে
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স দেশটির কংগ্রেসকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারকে বলেছে, বাংলাদেশের শরণার্থীরা যাতে নিজেদের দেশে ফিরতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সব রকম চেষ্টা করতে হবে। তিনি কংগ্রেসে আবেদন জানান, কংগ্রেস যেন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
সুইডেন সফররত যুক্তরাজ্য এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত আবু সাঈদ চৌধুরী দেশটির অ্যাফটনব্লাডেট পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ফ্রেডারিকসন স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশকারী অপারেশন ওমেগা দলের চারজন সদস্যকে কারাদণ্ড দিয়ে যশোর জেলে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন থেকে তাদের কাছে এই সংবাদ পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ এ দিন রাষ্ট্রদ্রোহ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা অভিযোগে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এমপিএকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
ফেনীর বিলোনিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী মুহুরী নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চালায়। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সারা দিন যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে মর্টারের আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। কিছু বেসামরিক লোকও হতাহত হয়।
এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল নয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান ছেড়ে পেছন দিকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের দুই দিক থেকে আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কয়েকটি নৌকায় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ভালুকার দিকে এগোলে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অবস্থান নিলেন অস্ট্রেলিয়ার বুদ্ধিজীবীরা

অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৫০০ শিক্ষাবিদ, সাংসদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও ধর্মীয় নেতা ১১ সেপ্টেম্বর এক আবেদনে দেশটির সরকারকে অবিলম্বে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অর্থসাহায্য বাড়িয়ে ৫০ লাখ ডলার করার অনুরোধ করেন তাঁরা। স্বাক্ষরকারীরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বক্তব্য প্রচার করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নিতে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে আহ্বান জানান।
অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্টজনেরা তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা এবং টানা অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেনা সরিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহ দিতে তাঁরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে অনুরোধ জানান।
অনুরোধ প্রত্যাখ্যান বেগম মুজিবের
বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত খবরে এ দিন বলা হয়, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন চায়, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁদের ধানমন্ডির বাড়িতে বসবাস করুন। কিন্তু বেগম মুজিব এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের জানিয়েছেন, পাকিস্তানি লুটেরারা বাড়িটির যেসব আসবাব নষ্ট বা লুট করেছে, তার হিসাব তিনি আগে চান।
ওই বাড়িটির কিছু দূরে আরেকটি বাড়িতে বেগম মুজিবকে সপরিবার থাকতে দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ জন সেনা দিনরাত বাড়িটির পাহারায় নিয়োজিত ছিল। বাড়িটির ফটক এবং বাড়িটি যে রাস্তায়, তার দুই মুখই বন্ধ করে রাখা হয়। বেগম মুজিবের দুই ছেলে ভারতে। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা, ছোট ছেলে রাসেল এবং জামাই ও নাতি তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
ভারত-শ্রীলঙ্কা একমত
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান যে অত্যন্ত জরুরি, সে ব্যাপারে ভারত ও শ্রীলঙ্কা একমত হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের তিন দিনের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে এ দিন প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আসায় ভারতে উদ্ভূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়টি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক লক্ষ করেছেন। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা মনে করে, পাকিস্তান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে চললে শরণার্থীদের ফেরার সুযোগ হতে পারে।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে তিনি মনে করেন না। ৮৫ লাখ লোক যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তাকে তখন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা চলে না। তাঁর ধারণা, যত দিন পূর্ব বাংলার মানুষ স্বশাসনের অধিকার না পাচ্ছেন, তত দিন তাঁরা দেশে ফিরে যেতে ভরসা পাবেন না।
ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকও এ দিন সল্টলেকে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। জিগমে ওয়াংচুক কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে গেলে সরকারি মহলে কিছুটা বিস্ময় দেখা দেয়।
ক্ষমতা চাইলেন ভুট্টো
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এ দিন বলেন, মার্চ মাসের যে ঘটনাবলি পূর্ব পাকিস্তানকে নাড়া দিয়েছিল, জাতির প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পশ্চিম পাকিস্তানেও সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তিনি বলেন, পূর্ণ রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতাই সমাধানের একমাত্র পথ।
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের একজন মুখপাত্র এ দিন স্বীকার করেন, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে মাইন পুঁতে রাখছে। তারা রাজাকার ও অন্য আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কাছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। এতে ট্রেনের চালকসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কসবার বগাবাড়ির কাছে অ্যামবুশ করলে সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সেক্টরের অধীন মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল ফেনীর পরশুরামের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
অন্য একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার কামানদি চরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। কেউ কেউ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্পে আটকে রাখা কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেন।
১২ সেপ্টেম্বর – সোভিয়েত সফরে যাবেন ইন্দিরা

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করবেন। সে সময় তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
আলোচনার বিষয় নিয়ে মুখপাত্র কিছু বলেননি। তবে দিল্লির কূটনৈতিক ও সামরিক মহল জানায়, এ মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হবে, সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রধান স্থান পাবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ বিপদ সম্পর্কে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী কথা বলবেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক ১২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে এখন আপসের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, প্রায় এক কোটি মানুষ আজ শরণার্থী এবং কয়েক লাখ লোক নিহত।
দিল্লিতে এদিন ভারত–বাংলা মৈত্রী সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে নেওয়া একটি সিদ্ধান্তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আরও দেরি হলে সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে এবং গণতন্ত্রবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ভারত ও বাংলাদেশ—দুই জায়গাতেই প্রবল হয়ে উঠবে। ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে ভারত সরকারের তিনজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবন, মইনুল হক চৌধুরী ও সিদ্ধার্থ শংকর রায় এবং দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের আমজাদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের একটি প্যাট্রল দলকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯ রাজপুত ব্যাটালিয়নের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। পাকিস্তানি প্যাট্রল দলের কয়েকজন আহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার উশখাইল গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় একজন সহযোগীকে অভিনব কৌশলে শাস্তি দেয়। আবদুল হাকিম নামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওই সহযোগী স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল ও তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। এদিন তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বরপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বরপক্ষের ছদ্মবেশে মিষ্টির হাঁড়িসহ তার বাড়িতে হাজির হন। বরপক্ষকে অভ্যর্থনা জানাতে আবদুল হাকিম বাড়ির বাইরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল ফেনীর ছাগলনাইয়ায় একটি সড়কে মাইন পুঁতে রাখে। সে মাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার গোমতী নদীতে টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা জগন্নাথ দীঘিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য আরেকটি দল শালদায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করে।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সাতক্ষীরা জেলার ভোমরায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
পাকিস্তানি দূতের প্রত্যাবর্তন
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহসভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে এই দিন ঢাকা আসেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইউরোপের গণমাধ্যমগুলোতে একই সুরে এই প্রচার চলছে যে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা দলটিকে ক্ষমতা না দিয়ে সেনাবাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের দাবি নস্যাৎ করতে চায়। তিনি বলেন, ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যা ঘটবার ঘটেছে। এখন যারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাদের নেতার সঙ্গে আপস করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর সপ্তদশ কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও কয়েকজন প্রতিনিধি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এবং সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমলি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। কারণ, তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক এবং সেখানকার জনগণের পক্ষে কথা বলার অধিকারী। আর্থার বটমুলি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, ব্রিটেন ইতিহাস থেকে শিখেছে, জননেতাকে কারাগারে পাঠাতে নেই।
ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নয়, বরং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার যুদ্ধের সমস্যা।
নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি টেম্পেল্টন তাঁর দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন।
রয়টার্স জানায়, অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য বিরোধী দল লেবার পার্টি যুক্তরাজ্য সরকারকে চাপ দেবে। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি যে শান্তির জন্য বিপজ্জনক, জাতিসংঘে এ যুক্তি তোলার জন্য তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক হোমকেও অনুরোধ জানাবে।
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন দেশটির কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিনল্যান্ডের এক প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে তাঁর সরকারের সমর্থন আদায়ের আশ্বাস দেন। এরপর তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ফিনল্যান্ড সরকার সজাগ রয়েছে। সন্ধ্যায় বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র সুয়োম্যান সোসিয়লি ডেমোক্রাতের সম্পাদকসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিওসারিয়োর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথাসম্ভব সাহায্য করার আশ্বাস দেন।
মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার্থে কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাফরুল্লাহ চৌধুরী এদিন মুজিবনগরে আসেন। তিনি জানান, মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসায় তাঁরা মুক্তাঞ্চলে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন।
দিল্লি সফররত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি মঈদুল হাসান এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন ধর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
ভারতের সীমান্ত রাজ্যে হুঁশিয়ারি
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গসহ সীমান্ত রাজ্যগুলোকে সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। রাজ্যের মুখ্য সচিব এদিন সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা দেশে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। বর্ষণ থেমেছে। যেকোনো সময় তারা ভারতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সম্ভাব্য এই আক্রমণ মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশের গোয়েন্দা ও বিশেষ বিভাগ ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
পাকিস্তানে ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান সংকট নিয়ে ইরানের শাহের সঙ্গে আলোচনা করতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৪ সেপ্টেম্বর ইরান সফরে যান। পাকিস্তানের বর্তমান ঘটনাবলি সম্পর্কেও ইয়াহিয়া ইরানের শাহকে অবহিত করবেন।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ফেনীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মর্টার আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি বাহিনী কামান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষে দুই ঘণ্টা গোলা বিনিময় হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করেন। এতে একটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েসপুরে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কসবা এলাকায় অতর্কিতে আক্রমণ করলে দুজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা আলফাপুর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন নিহত হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাঙালি কূটনীতিকদের সরকারের নির্দেশ

চাকরিসূত্রে বিদেশে কর্মরত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাঙালি কূটনীতিকদের প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১৫ সেপ্টেম্বর একটি নির্দেশ জারি করে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে নির্দেশে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে আনুগত্য প্রকাশ না করলে তাঁদের বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করা হবে। বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও বড় শহরে নির্দেশটি পাঠানো হয়। চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত বাঙালি কায়সার চৌধুরীর কাছেও নির্দেশটি পাঠানো হয়।
দিল্লিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাতিসংঘগামী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে যাবেন। ডি পি ধর এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। দলে নবগঠিত উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য ওয়ালী ন্যাপের নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা ফণীভূষণ মজুমদার থাকবেন। ১৮ সেপ্টেম্বর দলটি নিউইয়র্ক রওনা দেবে।
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মুজিবনগরে দফায় দফায় বৈঠক

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। যদিও প্রতিনিধিদের তালিকা এ দিন চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ দিন বলেন, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সে দিন সামরিক একনায়ক আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সময় বহু যুবক ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে পাকিস্তানি মিশনে নিয়োজিত বাঙালি কূটনীতিকদের কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কচ্ছেদ করবেন বলে প্রকাশিত খবর এ দিন বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সমর্থন করেন। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি এ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করার উদ্দেশ্যে ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পাঁচটি দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে পরামর্শক কমিটি গঠনকে তিনি স্বাগত জানান।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ এখন এক বাস্তবতা: ডি পি ধর
‘বন্ধু নয়, ভাই। ভাই বিপদে পড়েছে। ভাইয়ের পাশে ভাই আছে এবং চিরকাল থাকবে।’ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য মন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে দুই দিন ধরে দফায় দফায় বৈঠকের পর ডি পি ধর ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা, এই সত্য সব দেশের মেনে নেওয়া উচিত। ডি পি ধর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ডি পি ধর জানান, তিনি রাতেই দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থে প্রয়োজন দেখা দিলেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এ দিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক সভায় নিরপেক্ষ গোষ্ঠীকে জানান, বাংলাদেশের শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে এই গোষ্ঠী সুস্পষ্ট মতামত জানাতে না পারলে ওই সব নিরপেক্ষ দেশের মন্ত্রী সম্মেলনে ভারত যোগ না-ও দিতে পারে। নিরপেক্ষ দেশগুলোর দ্বিতীয় অধিবেশনে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কঠোর
মনোভাব জানাতে তিনি এই আলোচনায় অংশ নেন। এক সপ্তাহ পর নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হওয়ার কথা।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক সমাজের বিবেককে জাগাতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের পথ সন্ধান শিগগিরই পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে লোকসভার সদস্য প্রবোধ চন্দ্রের বাংলাদেশ রক্তস্নান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে ইন্দিরা কয়েকজনকে বইটি উপহার দেন। প্রবোধ চন্দ্র বলেন, বই বিক্রির অর্থ বাংলাদেশের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
ভারতের লোকসভার সদস্য এবং বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সমর গুহ দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের জন্য ডি পি ধর ও টি এন কাউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, সোভিয়েত সমর্থন লাভের নামে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
দিল্লিতে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহল এ দিন সাংবাদিকদের জানায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক যত এগিয়ে আসছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ তত বাড়ছে। ওই মহল আরও বলে, এটা খুব অস্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজার সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি আচমকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানান। ভারত নিউইয়র্কে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে বাংলাদেশ প্রশ্নে একমত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির প্রশ্নও আছে। কুয়ালালামপুর ও প্যারিসে আন্তর্জাতিক সংসদীয় সম্মেলনে ভারত এ বক্তব্য নিয়ে অনেকটা সফলও হয়েছে। পাকিস্তান সেখানে সুবিধা করতে পারেনি।
ফরাসি লেখক ও ভাবুক অঁদ্রে মালরো প্যারিসে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে গিয়ে তিনি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন। রওনা হওয়ার তারিখ তিনি শিগগিরই ঘোষণা করবেন। তাঁর এই বিবৃতি বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ৬৯ বছর বয়সী মালরো দ্য গলের সরকারে সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন।
গেরিলা অভিযান
মানিকগঞ্জের শিবালয়ে এ দিন পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালান। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর মাসলিয়া ঘাঁটি আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের পরাগপুর অবস্থানে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাপুর সীমান্তঘাঁটিতে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত সরকার নিয়ন্ত্রিত ইমরোজ পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয়, একজন সরকারি চিকিৎসক প্রতিদিন শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
অপারেশন ওমেগা দলের সদস্যদের এ দিন জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার ব্রিটিশ উপহাইকমিশন জানায়, শিগগিরই তাঁরা লন্ডন ফিরে যাবেন বলে আশা করছেন।
পাকিস্তানি অনুগত বেসামরিক প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের ১০ জন মন্ত্রীর ৯ জন এ দিন শপথ নেন। এর আগে সকালে গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করেন। আব্বাস আলী খান, অংশু প্রু চৌধুরীসহ কয়েকজন মন্ত্রী হন। অংশু প্রু চৌধুরী ছাড়া বাকিরা শপথ নেন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে রাজাকারদের বলেন, মুসলিম জাতীয়তায় পূর্ণ বিশ্বাসীরাই পাকিস্তানের জন্য জীবন দান করতে পারে।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সম্পর্কে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত
মিলিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা এবং সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এ প্রস্তাব করেন।
এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকেরা পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান। তাঁরা বাংলাদেশের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সমর্থন করেন। সম্মেলনে নেওয়া এক সর্বসম্মত প্রস্তাবে শেখ মুজিবের গোপন বিচারের নিন্দা এবং এ কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রগোষ্ঠীর কাছে আবেদন জানানো হয়।
২৪টি দেশের প্রতিনিধি উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। পাকিস্তানের ঘটনাবলির পটভূমি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের নেতারা দায়ী নন, দায়ী পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকেরা।
দ্য ইন্ডিয়া নিউজ–এ এক খবরে বলে, এ সপ্তাহের প্রথম দিকে ভারতীয় পার্লামেন্টারি দপ্তরের মন্ত্রী রাজ বাহাদুর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। চিলি সফরকালে প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে তাঁকে বলেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য ভারত-পাকিস্তান বিরোধ দায়ী নয়। সামরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামই বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচার সম্পর্কে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নুরুল আমিন এ দিন করাচিতে আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি।
রেডিও পাকিস্তানের খবরে এ দিন বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করেছেন। ইতিমধ্যে পিপিপি আর পিডিপির সভাপতি নুরুল আমিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন।