সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

Table of Contents

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বার্তা সংস্থা এএফপি করাচির ওয়াকিবহাল মহল সূত্রে ১ সেপ্টেম্বর খবর পরিবেশন করে, পাকিস্তানে বন্দী বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ১১ আগস্ট তাঁর বিচার শুরু হলেও কোনো ঘোষণা ছাড়াই সেই বিচার বন্ধ রাখা হয়। কয়েক দিন পর জানানো হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহির সাহায্য পাবেন। তবে ব্রোহি রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনার জন্য এলে তাঁকে বিচার কবে শুরু হবে, তা জানানো হয়নি।

করাচির ডেইলি নিউজ পত্রিকায় ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মুজিবের বিচার হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহি ৩১ আগস্ট দেশে আস্থা বাড়াতে পাকিস্তান সরকারের নতুন পদক্ষেপগুলো জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে অবহিত করেছেন। এরপর তিনি নিউইয়র্কে সংবাদদাতাদের বলেন, পদক্ষেপগুলো আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া সব শরণার্থীকে সসম্মানে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার খুব ভালো করেই জানে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সব সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখলে নিয়েছে। তাই শত্রুসেনার কবলমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরণার্থীরা তাঁদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন।

যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ে সফরকালে এদিন সকালে দেশটির প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের আমন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বিচারপতি পিয়ের অল্ড সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তাঁর কক্ষে আসার অনুরোধ জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী সংক্ষেপে তাঁদের বাঙালির স্বাধীনতা কামনার মূল কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতিরা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অধিনায়কদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তার কোনো বিকল্প নজির নেই। পৃথিবীর আর কোথাও জনগণ এভাবে সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ভারত এখন এক কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অন্যদিকে ভারতে বহিঃশত্রুর হুমকি। এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতকে তৈরি থাকতে হবে। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সেই দায়িত্ব বিশেষভাবে নিতে হবে।

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কলকাতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে তাঁরা জানিয়ে রাখতে চান যে ইয়াহিয়া তাঁর সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করতে রাজি। ফারল্যান্ডের এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়াও রাজি হন।

যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মোশতাকের এই গোপন যোগাযোগের খবর তখনই প্রকাশ পায়। এ ব্যাপারে মূলধারা ’৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান লিখেছেন: ‘কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা প্রকাশের আগে অবধি এই ঘটনার কথা অবিদিত থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভিতরে ভিতরে চলছিল, তা সেই সময়ের আর একটি সূত্র থেকে প্রকাশ পায়।’

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের সচিবালয় থেকে ৪ সেপ্টেম্বর এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়, দেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাঁরা অপরাধ করেছেন বা যাঁদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই ক্ষমা কার্যকর হবে এবং এটি সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসারসহ সবার প্রতি প্রযোজ্য হবে।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর আট নম্বর সেক্টরের অধীন সুতিপুর প্রতিরক্ষার অগ্রবর্তী এলাকা যশোরের শার্শায় গোয়ালহাটিতে ৫ সেপ্টেম্বর নিয়োজিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পেট্রল দল। দলের অধিনায়ক ছিলেন ইপিআরের সাবেক সদস্য নূর মোহাম্মদ শেখ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দলের অবস্থান টের পেয়ে যায়। তারা দ্রুত তিন দিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।

অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নূর মোহাম্মদ সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন, পাকিস্তানি সেনাদের সামনে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা পিছু হটতে চেষ্টা করেন। এ সময় সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে কাঁধে নিয়ে নূর মোহাম্মদ গুলি করতে করতে পেছনে সরে আসছিলেন। হঠাৎ দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে তাঁর ডান পায়ের হাঁটু চুরমার হয়ে যায়।

বিপর্যয়কর এই অবস্থায় নূর মোহাম্মদ শেখ সহযোদ্ধা মোস্তফা কামালকে নির্দেশ দেন, আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে করে নিয়ে পেছনে সরে যেতে। আর তাঁদের কাভার করার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে। মোস্তফা কামাল তাঁকে ফেলে যেতে রাজি ছিলেন না। নূর মোহাম্মদ জোর করে তাঁদের ফেরত পাঠান। এর পর একাই লড়াই করতে করতে নূর মোহাম্মদ শেখ শহীদ হন। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের মুক্তিযোদ্ধারা পরে এসে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করেন। স্বাধীনতার পর নূর মোহাম্ম শেখকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র ৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের জানায়, কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর পদবি বদলে হাইকমিশনার এবং মিশনের নাম বদলে করা হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সেলের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডি পি ধর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর মিশনপ্রধানের পদবি ও মিশনের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারত সরকারের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ৭ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। সকালে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছেই তিনি সরাসরি মুজিবনগরে যান।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, এ ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। এই গণহত্যা সংঘটনে যারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, তারাও গণহত্যাকারীর মতো সমান অপরাধে অপরাধী। তাই নিক্সন ও তাঁর সরকারও একই অপরাধে অপরাধী। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

 

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য মুজিবনগরে ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগসহ পাঁচটি দলের আটজন সদস্য নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। নবগঠিত এই কমিটি মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেবে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে ভাসানী ও ওয়ালিপন্থী দুই ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী), বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটিটি গঠিত হয়। দুই দিন ধরে যৌথ বৈঠকের পর সর্বসম্মতভাবে এই কমিটি গঠিত হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে যাঁরাই লড়াই করছেন, তাঁদের সবার মধ্যে একাত্মতা গড়ে তোলা এই কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

বাংলাদেশের পাঁচটি দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনকে ভারতের সরকারি মহল ১০ সেপ্টেম্বর স্বাগত জানায়। তারা বলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে এটি নতুন অধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ও পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এ দিন প্রথম প্রকাশ্যে জানান, বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করছেন।

তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের রাজনৈতিক মূল্য
অপরিসীম। জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি উঠলে এই কমিটির বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে কথা বলার পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রশ্নটি কীভাবে তোলা হবে, তা নিয়েও বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে ডি পি ধর ও টি এন কাউলের আলোচনা হয়।

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৫০০ শিক্ষাবিদ, সাংসদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও ধর্মীয় নেতা ১১ সেপ্টেম্বর এক আবেদনে দেশটির সরকারকে অবিলম্বে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অর্থসাহায্য বাড়িয়ে ৫০ লাখ ডলার করার অনুরোধ করেন তাঁরা। স্বাক্ষরকারীরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বক্তব্য প্রচার করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নিতে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে আহ্বান জানান।

অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্টজনেরা তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা এবং টানা অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেনা সরিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহ দিতে তাঁরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে অনুরোধ জানান।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করবেন। সে সময় তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

আলোচনার বিষয় নিয়ে মুখপাত্র কিছু বলেননি। তবে দিল্লির কূটনৈতিক ও সামরিক মহল জানায়, এ মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হবে, সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রধান স্থান পাবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ বিপদ সম্পর্কে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী কথা বলবেন।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর সপ্তদশ কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও কয়েকজন প্রতিনিধি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এবং সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমলি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। কারণ, তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক এবং সেখানকার জনগণের পক্ষে কথা বলার অধিকারী। আর্থার বটমুলি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, ব্রিটেন ইতিহাস থেকে শিখেছে, জননেতাকে কারাগারে পাঠাতে নেই।

ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নয়, বরং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার যুদ্ধের সমস্যা।

নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি টেম্পেল্টন তাঁর দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ১৪ সেপ্টেম্বর মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির স্বার্থেই বাংলাদেশ সংকটের আশু সমাধান দরকার। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তিকে তিনি এশিয়া ও বিশ্বে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন।

রয়টার্স জানায়, অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য বিরোধী দল লেবার পার্টি যুক্তরাজ্য সরকারকে চাপ দেবে। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি যে শান্তির জন্য বিপজ্জনক, জাতিসংঘে এ যুক্তি তোলার জন্য তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক হোমকেও অনুরোধ জানাবে।

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

চাকরিসূত্রে বিদেশে কর্মরত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাঙালি কূটনীতিকদের প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১৫ সেপ্টেম্বর একটি নির্দেশ জারি করে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে নির্দেশে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে আনুগত্য প্রকাশ না করলে তাঁদের বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করা হবে। বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও বড় শহরে নির্দেশটি পাঠানো হয়। চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত বাঙালি কায়সার চৌধুরীর কাছেও নির্দেশটি পাঠানো হয়।

দিল্লিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাতিসংঘগামী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে যাবেন। ডি পি ধর এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। দলে নবগঠিত উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য ওয়ালী ন্যাপের নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা ফণীভূষণ মজুমদার থাকবেন। ১৮ সেপ্টেম্বর দলটি নিউইয়র্ক রওনা দেবে।

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ১৬ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। যদিও প্রতিনিধিদের তালিকা এ দিন চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ দিন বলেন, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সে দিন সামরিক একনায়ক আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সময় বহু যুবক ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে পাকিস্তানি মিশনে নিয়োজিত বাঙালি কূটনীতিকদের কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কচ্ছেদ করবেন বলে প্রকাশিত খবর এ দিন বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সমর্থন করেন। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি এ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করার উদ্দেশ্যে ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পাঁচটি দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে পরামর্শক কমিটি গঠনকে তিনি স্বাগত জানান।

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

‘বন্ধু নয়, ভাই। ভাই বিপদে পড়েছে। ভাইয়ের পাশে ভাই আছে এবং চিরকাল থাকবে।’ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য মন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে দুই দিন ধরে দফায় দফায় বৈঠকের পর ডি পি ধর ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা, এই সত্য সব দেশের মেনে নেওয়া উচিত। ডি পি ধর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত।

ডি পি ধর জানান, তিনি রাতেই দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থে প্রয়োজন দেখা দিলেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা

পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত সরকার নিয়ন্ত্রিত ইমরোজ পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয়, একজন সরকারি চিকিৎসক প্রতিদিন শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।

অপারেশন ওমেগা দলের সদস্যদের এ দিন জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার ব্রিটিশ উপহাইকমিশন জানায়, শিগগিরই তাঁরা লন্ডন ফিরে যাবেন বলে আশা করছেন।

পাকিস্তানি অনুগত বেসামরিক প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের ১০ জন মন্ত্রীর ৯ জন এ দিন শপথ নেন। এর আগে সকালে গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করেন। আব্বাস আলী খান, অংশু প্রু চৌধুরীসহ কয়েকজন মন্ত্রী হন। অংশু প্রু চৌধুরী ছাড়া বাকিরা শপথ নেন।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে রাজাকারদের বলেন, মুসলিম জাতীয়তায় পূর্ণ বিশ্বাসীরাই পাকিস্তানের জন্য জীবন দান করতে পারে।

 

 

সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সম্পর্কে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত
মিলিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা এবং সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এ প্রস্তাব করেন।

Leave a Comment