মার্চ মাস ১৯৭১ – সময়ে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
মার্চ মাস ১৯৭১ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১ মার্চ ১৯৭১ : ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল সন্ধ্যায় হঠাৎ কারফিউ
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেছিলেন। ২ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালে অচল ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। জনতা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেয়, স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস নেই।
সকাল থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকার সব দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানেই কর্মচারীরা কাজে যোগ দেননি। রেল ও বিমান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে নেমে আসে।
বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর আহ্বানে ছাত্র সমাবেশ হয়। বিকেলে বায়তুল মোকাররম ও পল্টনে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সন্ধ্যায় ক্লান্ত-শ্রান্ত জনতা ঘরে ফেরে। কিন্তু সন্ধ্যার পর হঠাৎ শহরে কারফিউ জারির ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ জনতা আবার রাজপথে নেমে আসে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন কারফিউ জারি করেছিল রাত নয়টা থেকে পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। রেডিওতে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনে বিভিন্ন এলাকায় জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে ব্যারিকেড দেয়। গভীর রাত পর্যন্ত কারফিউ ভেঙে মিছিল করে। মিছিলে স্লোগানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে শোনা যায় গুলিবর্ষণের আওয়াজ। রাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণে শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর হাসপাতালগুলোতে বুলেটবিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কারফিউ জারির পর রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলেও ছাত্ররা মোটেই দমে যাননি। উল্টো আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সারা রাত বিক্ষোভ চলতে থাকে পাড়ায় ও মহল্লায়। বিভিন্ন স্থানে টহলদার সামরিক বাহিনী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু তাতেও মিছিল থেমে যায়নি।
২ মার্চ ১৯৭১ : মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন
মানুষ পত্রিকা অফিসগুলোয় গুলিবিদ্ধ আহত মানুষদের পৌঁছে দিতে থাকেন। ইত্তেফাক অফিসে বুলেটবিদ্ধ দুজনকে, দৈনিক পাকিস্তান কার্যালয়ে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে, মর্নিং নিউজ-এ দুজনকে, সংবাদ অফিসে দুজন, ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ছয়জনকে আহত অবস্থায় মিছিলকারীরা রেখে যান। আহত আরও ২৫ ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিন আট ব্যক্তি প্রাণ হারান। (সূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: ১৮৩০ থেকে ১৯৭১, মোহাম্মদ হান্নান।)
বিকেলে মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতা একটি রেলগাড়ি আটকে তার বগি তিন-চার জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। মালিবাগ মোড়ের ট্রাফিক আইল্যান্ডের কাছে কয়েকজন ছাত্র ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। এ সময় একটি সামরিক যান থেকে গুলি চালানো হয়। গুলিতে প্রাণ হারান ফারুক ইকবাল নামের একজন। তাঁকে ওই ট্রাফিক আইল্যান্ডের ওপরই সমাহিত করা হয়।
জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে এদিনের ঢাকার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘সকালে নাশতা খাওয়ার পর সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মাঝখান দিয়ে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। একটাও গাড়ি, রিকশা, স্কুটার এমনকি সাইকেলও নেই আজ রাস্তায়।…হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের দিকে চলে গেলাম। কী আশ্চর্য! আজকের কাঁচাবাজারও বসেনি। চিরকাল দেখে আসছি হরতাল হলেও কাঁচাবাজারটা অন্তত বসে। আজ তাও বসেনি। শেখ মুজিবসহ সবগুলো ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সর্বত্র যানবাহন, হাটবাজার অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে, সবাই সেটা মনেপ্রাণে মেনে নিয়েই আজ হরতাল করেছে।’
প্রতিদিন হরতাল:
রাতে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করেন। এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তিনি ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বাংলাদেশে হরতালের আহ্বান জানান। ৩ মার্চ জাতীয় শোক দিবস পালনের ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধু জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এই সংকটের সন্ধিক্ষণে সরকারি কর্মচারীসহ সর্বস্তরের প্রত্যেক বাঙালির পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে অসহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশগুলো হলো:
১. ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন।
২. ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সেই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন।
৩. রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বাঙালি জনতার কর্মতৎপরতার বিবরণী বা বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের চেষ্টা নাকচ করে দেওয়া।
৪. ৭ মার্চ বেলা দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা।
৫. সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম চালানোর আহ্বান।
মানচিত্রখচিত পতাকা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র সমাবেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হঠকারী ঘোষণার প্রতি ধিক্কার জানানো হয়। সেখানে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল, সবুজ, সোনালি—এই তিন রঙের পতাকা।
তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সেখানে উত্তোলিত পতাকাই কার্যত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপ লাভ করে।
প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও এই পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিল। (সূত্র: পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, নূরে আলম সিদ্দিকী)
করাচিতে ভুট্টোর সংবাদ সম্মেলন: করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
দেশের দুটি প্রধান দল শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানোমাত্রই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে কোনো বাধা থাকবে না। অধিবেশন স্থগিত রাখায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, সত্যিকার ফেডারেশনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হওয়া উচিত। তারা আপসহীন কোনো অবস্থান নেয়নি।
ভারত সরকারের দুঃখ প্রকাশ: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ বেতার বিবৃতিতে জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত রাখার অন্যতম কারণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনাকর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করায় দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ মন্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন।
৪ মার্চ ১৯৭১ : জনজোয়ারে মিশে গেলেন শিক্ষক-শিল্পী-সাংবাদিক
১৯৭১ সালের ৪ মার্চও ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল অব্যাহত থাকে। দেশজুড়ে আন্দোলনের এই জোয়ারে শিক্ষক, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে নানামুখী তৎপরতায় একাত্ম হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি যেকোনো মূল্যে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।

লাগাতার হরতালের মধ্যে ৬ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। দুপুরে বেতার ভাষণে তিনি বলেন, ‘এ দেশকে রক্ষার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি বাসিন্দার জন্যে আমার দায়িত্ব রয়েছে। আমি তাদের হতাশ করব না।’
ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তান শাখার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারেন না।
এই দিনটিতেও ঢাকাসহ সারা বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ঢাকা টানা পঞ্চম দিনের মতো গর্জে ওঠে। সারা বাংলা ছিল সভা-সমাবেশ ও মিছিলে উত্তাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সকাল থেকে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসের কর্মচারী বেতন পাননি, সেসব অফিস বেতন দেওয়ার জন্য খোলা থাকে।
বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে নারীরা লাঠিসোটা ও কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন। একই সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে সাংবাদিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), গণ শিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
রাজশাহীতে মিছিলের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে একজন নিহত এবং ১৪ জন আহত হন। সেখানে ওই দিন সান্ধ্য আইন জারি ছিল। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাও গুলিবর্ষণে ১৮ জন নিহত এবং ৮৬ জন আহত হন।
বেলা ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগারের গেট ভেঙে এই দিনে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যান। এ সময় পুলিশের গুলিতে সাতজন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ৬ মার্চ জানান, ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ধরনের বিমান চলাচলে এখন থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
দিনপঞ্জির পাতা থেকে
জাহানারা ইমাম একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে এ দিনের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: ‘আজ দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।…প্রেসিডেন্ট কী বলেন, তা শোনার জন্য সকলেই চনমন করছি।
এক তারিখের ঘোষণায় তো লঙ্কাকাণ্ডবেধে গেছে। এখন আবার কী বলেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। আগামীকাল রেসকোর্সের গণজমায়েতে শেখ কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই।…এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শয়ে শয়ে লোক নিহত।
এর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি এ দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকালের মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।’
টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান আগের দিন ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁকে পাঠিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করে। তাঁর শপথ নেওয়ার দিন ধার্য্য করা হয়েছিল এই দিনে। গণ–আন্দোলনের তীব্রতা দেখে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিক টিক্কা খানের শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, তাঁর দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়। অধিবেশনের আগে তিনি দেশের সংহতির স্বার্থে আরেকবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত বলে জানান।
পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম) প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান পেশোয়ারে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেন।
ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান পিডিপির পশ্চিম পাকিস্তান শাখার প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা।
কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) নূর খান লাহোরে এক সমাবেশে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতির অবনতির জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।
গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
লাহোরে আওয়ামী নেতারা আটক
বিকেলে লাহোরে আওয়ামী লীগের পাকিস্তান শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাব প্রদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৭ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্ত ভাষণে বাঙালি পায় নির্দেশনা
একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এই ঘোষণা বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। মুহুর্মুহু স্লোগান ছিল—‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। এটুকু সময়ের ভাষণেই তিনি বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। তারপর বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু ১ মার্চেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বক্তব্য দেবেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য সকাল থেকেই দেশের দূরদূরান্তের মানুষ দলে দলে পায়ে হেঁটে, বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে নারী-পুরুষে সয়লাব হয়ে যায় বিশাল ময়দান।
বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি আর চোখে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে নেতার নির্দেশ শোনার জন্য উপস্থিত হন। বেলা সোয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরে শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানান।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম-দুস্তর পথের প্রান্তে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্মৃতিফলক বসিয়ে দেন। সংগ্রামে উন্মুখ জাতির কাছে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার মন্ত্রণা। লাখ লাখ মুক্তিসংগ্রামীর উদ্দেশে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।
আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়,…আমি যদি হুকুম দিবার না–ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।…এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’
ঢাকা বেতার স্তব্ধ
ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেন। বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ এ ভাষণ বেতারে প্রচার করা হবে।
এ ঘোষণার পর সারা বাংলার শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারে দেশাত্মবোধক রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ পরিবেশন করা হয়। গানটির পরিবেশনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করার মুহূর্তেই হঠাৎ ঢাকা বেতারের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধের প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করে দেন বেতার কর্মীরা। অচল হয়ে পড়ে কেন্দ্র। পরে বেতার কর্মীদের দাবির মুখে গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দেয়।
বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি
৭ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার ওপর ব্যাপকভাবে গুলি চালানো হয়েছে। গত সপ্তাহে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা শহীদ হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যাকে ‘সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ’ বলেছেন, তাতেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হতে পারে, তাহলে তাঁর অভিহিত ‘পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগ’–এর অর্থ কি ‘আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাব’?
বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি আন্তরিকভাবে মনে করেন, জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম সংস্থা হিসেবে জাতীয় পরিষদকে কার্যকর করা উচিত, তাহলে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ অবিলম্বে প্রতিপালিত হতে হবে: ১. সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে সেনাছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া।
২. বেসামরিক জনতার ওপর অবিলম্বে গুলিবর্ষণ বন্ধ করা। ৩. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে বিপুল সংখ্যায় সামরিক বাহিনীর লোক আনা বন্ধ করা। ৪. বাংলাদেশে সরকারি প্রশাসনের ওপর সামরিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং সরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া। ৫. আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার সম্পূর্ণভাবে পুলিশ বা বাঙালি ইপিআরের ওপর ন্যস্ত করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নেওয়া।
ঢাকায় আসগর খানের সংবাদ সম্মেলন
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান। তিনি সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদাত্ত আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করার অধিকার আছে। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান নিয়ে আওয়ামী লীগপ্রধান আজ যে শর্তগুলো দিয়েছেন, তা ন্যায়সংগত ও বৈধ।
বিদেশিদের অপসারণ
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের অপসারণের জন্য এই দিন দুটি বিদেশি বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। কূটনৈতিক মিশনগুলো তাদের নাগরিকদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশের কাছে এর আগে খবর পাঠিয়েছিল।
৭ মার্চ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কোনো নির্ধারিত ফ্লাইট ছিল না। পাকিস্তান বিমানবাহিনী শুধু কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট চালু রেখেছিল।
লন্ডনে বিক্ষোভ
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে ‘ভুট্টোর বিচার চাই’ স্লোগান দেন।

৮ মার্চের সকাল শুরু হয় ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে আগের দিন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সম্প্রচার দিয়ে। বেতারে সেটি সম্প্রচার করা হয় সকাল সাড়ে আটটায়। অন্যান্য বেতারকেন্দ্র থেকেও সেটি পুনঃপ্রচার করা হয়। ভাষণটি রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি প্রচার না করার প্রতিবাদে আগের দিন বিকেল থেকে ঢাকা বেতারকেন্দ্রের বাঙালি কর্মীরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। এটি প্রচারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বেতারকর্মীরা সকালে কাজে যোগ দেন।
কিন্তু ভাষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ করা হয়। ছাত্রলীগের এ সভায় জেলা থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং সিনেমা হলে উর্দু ছায়াছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য তৎপরতা দেখা যায়।
ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের নিরস্ত্র বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কালো পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানায়। পাড়ায় পাড়ায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওঠানো হয়।
সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং মোটরগাড়ি কালো পতাকা লাগিয়ে চলাচল করে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক অফিসের কাজ বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–কর্মচারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য এক দিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন।
তথ্য বিজ্ঞপ্তি নিয়ে পাল্টাপাল্টি
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রে তথ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে, শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চ সকাল থেকে পূর্ণ হরতাল পালন শুরু হয়। বিক্ষোভরত জনতা লুট, অগ্নিসংযোগ, ছুরিকাঘাত ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়েছিল। গোলযোগের সময় ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮ জন আহত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ রাতেই সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি পাঠিয়ে এই তথ্য বিজ্ঞপ্তির নিন্দা করেন। তিনি বলেন, প্রেসনোটে লুট ও আগুন লাগানোর যে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত। স্বাধিকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে চলা বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা যা দেখানো হয়েছে, সেটি অত্যন্ত নগণ্য। নিরস্ত্র মানুষের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অপরিমেয় ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে গত ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমান যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সকল শ্রেণির মানুষ তা সক্রিয়ভাবে কার্যকরী করেছেন।’
৯ মার্চ ১৯৭১ : স্বাধীনতা মেনে নিন, ইয়াহিয়াকে ভাসানী
আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই দিনেও রাজনীতির উত্তাপ অব্যাহত ছিল। দিনের আলোচিত ঘটনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বৈঠক এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় ভাসানীর বক্তৃতা।
আওয়ামী লীগ ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী এই দিন সচিবালয়সহ সারা দেশে সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দেন, কেবল সেসব চালু থাকে।
সারা দেশে ব্যাংকিং কাজকর্ম চলে। বাস, মোটরগাড়ি, রিকশা ও অন্য যানবাহন চলাচল করে। দোকানপাট ও হাটবাজার খোলা থাকে। লঞ্চ ও ট্রেন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করে। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, ভবন ও যানবাহন এবং বাসগৃহে কালো পতাকা ওড়ানো হয়।
মুক্তি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
রাজশাহী শহরে প্রতি রাতে রাত নয়টা থেকে আট ঘণ্টা অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আওয়ামী লীগ এক বিবৃতিতে বলে, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাজশাহীতে হঠাৎ কারফিউ জারির কারণ বোধগম্য নয়।
এর জন্য নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।
ভাসানীর জনসভা –
পল্টনের জনসভায় ভাষণ দিতে মাওলানা ভাসানী ৯ মার্চ সকালে সন্তোষ থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে টেলিফোন করেন। ফোনে দুই নেতার আলোচনার পর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন।
পল্টন ময়দানের জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বলেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমতো ২৫ মার্চের মধ্যে কিছু না করা হলে শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করবেন।
মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে, শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব অবিশ্বাস করার মতো লোক নন। তিনি বলেন, ‘তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি।’
৯ মার্চ সরকারিভাবে জানানো হয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান সফর করবেন।
‘স্বাধীন বাংলাদেশ’: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যানটিনে সকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
আরেক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর ওপর স্বাধীনতা আন্দোলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
ছাত্রলীগের জেলা ও শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখার সভাপতিকে আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং ৯ জন সদস্য নিয়ে মোট ১১ জনের সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যও প্রস্তাব আনা হয়।
পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর পরিবর্তে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহার করারও প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বামপন্থী দলের তৎপরতা
পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, কিছু তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলছে ধর্মঘট বা অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির প্রয়োজন নেই। বরং তারা গ্রামে গ্রামে কৃষিবিপ্লব শুরু করার এবং জোতদারদের গলা কাটার আওয়াজ তুলছে। কোনো কোনো নেতা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে’ বলে ধ্বনি তুলে চলমান গণসংগ্রামের উদ্দীপনা ও সংকল্পে ভাটা এনে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এক বিবৃতিতে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করে সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
আন্দোলনের বিপক্ষে হক-তোয়াহা
আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) তাদের বিলি করা এক প্রচারপত্রে গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং পূর্ব বাংলার তথাকথিত দরদি বিশ্বাসঘাতক নেতাদের পরামর্শদাতা হলো কুখ্যাত নরপশু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড।…গত কিছুদিন যাবৎ ঘন ঘন পূর্ব বাংলায় এসে এখানেও ব্যাপক হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বের মেহনতি মানুষের বড় দুশমন এই হিংস্র জানোয়ারদের সঙ্গে যেসব তথাকথিত বাংলার দরদি নেতারা বৈঠক করে, ষড়যন্ত্র করে এবং লাঞ্ছিত, শোষিত মানুষকে শান্ত থাকতে উপদেশ দেয়, তারা গরিব কৃষক-শ্রমিকের বন্ধু হতে পারে না।’
টিক্কা খান সামরিক প্রশাসক
গভীর রাতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে এক ঘোষণায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক বিমানে ঢাকায় এসেছিলেন। ৯ মার্চ তাঁর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।
১০ মার্চ ১৯৭১ : দেশজুড়ে কালো পতাকা, কর্মচারীদের কাজ বর্জন

আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি একাত্তরের ১০ মার্চও সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে সারা দেশে সরকারি ও আধা সরকারি অফিসের কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ে।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িগুলোও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলাচল করে। অনেক বাড়িতেও বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল।
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা বাংলাদেশের সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ভীতসন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করছে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে তারই স্বীকৃতি মেলে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত, কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, যে হুমকি আজ উদ্যত, সেটি গণহত্যার। সে হুমকি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর। ধ্বংসকারী যত অস্ত্রেই সুসজ্জিত থাকুন না কেন, কোনো শক্তিই আর বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে সকালে কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের গুম-খুন-হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে তখন পর্যন্ত যেসব বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা ওড়ানো হয়নি, ছাত্রলীগ নেতাদের এক বিবৃতিতে সেখানে তা ওড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।
ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাদের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্য আরেকটি বিবৃতিতে বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়।
অন্য দিনগুলোর মতো এদিনও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ও কুচকাওয়াজ করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে মিছিল বের করা হয়।
বিকেলে প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) ওয়ালী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় পথসভা।
‘লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল বায়তুল মোকাররম থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায়। ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জনসমাবেশের আয়োজন করে।
সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা সভায় মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেন। চলচ্চিত্র প্রদর্শকেরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা নৈশ কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়।
নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্বিচার হত্যা ও অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান। নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য তাঁরা জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান।
বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু:
সকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করার সময় এসেছে। বাঙালি চায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কোনো আপস করব না।’
চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ:
পাকিস্তানের সমরাস্ত্র নিয়ে আসা জাহাজ ‘এম এল সোয়াত’ এই দিন চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙর করে। জাহাজ থেকে নামিয়ে সমরাস্ত্রগুলো বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পাঠানোর জন্য বন্দরের বাইরে ওয়াগন প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকেরা এসব সমরাস্ত্র জাহাজ থেকে নামানোর নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন। সামরিক বাহিনীকে দিয়ে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানোর ব্যবস্থা করতে গেলে উপস্থিত জনতার প্রতিরোধে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।
পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা:
লাহোরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহ্বানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের এক সভায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু যে পূর্বশর্ত দিয়েছেন, তার প্রতি নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।
লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অবিলম্বে ঢাকায় গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত।
করাচিতে কাউন্সিল মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জেড এইচ লারি বলেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার যে দাবি করেছে, তা অবিলম্বে পূরণ করা উচিত। কিন্তু শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সাপেক্ষে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরসম্পর্কিত দাবি দুটির বিবেচনা স্থগিত রাখা উচিত বলে তিনি বিবৃতি দেন।
১১ মার্চ ১৯৭১ : আন্দোলনরত জনতাকে তাজউদ্দীনের নির্দেশ
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১১ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ১৪টি নির্দেশ জারি করেন। মূলত সরকারি অফিস, ব্যাংক–বিমা ও অন্যান্য সংস্থা কীভাবে চলবে এবং কী কী বিধিনিষেধ মেনে চলবে—বিবৃতিতে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অন্যান্য দিনের মতো এই দিনও স্টেট ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারিতে স্বাভাবিক লেনদেন চলে। বাংলাদেশের ভেতরে ডাক, তার ও টেলিফোন যোগাযোগ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকে। বিপণিগুলো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খোলা থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় সভা, সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
সংগ্রামী জনতা ঢাকায় সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িকে বাধা দেওয়া হয়। যশোর ও অন্য এলাকাতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া ন্যাপের (ওয়ালি) প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, আওয়ামী লীগের পাঞ্জাব শাখার সভাপতি এম খুরশিদ এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন আলাদাভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ না করানোর মতো সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ১৬ জন আইনজীবী ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীকে অভিনন্দন জানান।
‘ভিনটেজ হরাইজন’ নামে গমবাহী একটি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ হাজার টন গম নিয়ে আসছিল। সেটিকে গতিপথ বদল করে করাচি বন্দরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৪ নির্দেশনা:
পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত গণমানুষের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতিতে ১১ মার্চ নতুন করে ১৪টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে যেকোনো অঙ্কের অর্থ জমা হিসেবে গ্রহণ ও আন্তব্যাংক ক্লিয়ারেন্সসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কাজ করতে পারবে। ধান, পাটবীজ, সার ও কীটনাশক সংগ্রহ, পরিবহন ও বিতরণ অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার এবং চাল গবেষণা কেন্দ্রের কাজ চালু থাকবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজ চলবে। সেনাবাহিনীর চলাচল অথবা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, এমন সামগ্রী খালাসের ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করা যাবে না। ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ইপিআইডিসি) সমস্ত কলকারখানায় কাজ চলবে এবং উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়দুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ সব সাহায্য, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজ চলবে। পল্লি অঞ্চলে উন্নয়নকাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও কর্মচারীর মজুরি ও বেতন পাওনা হলে তা পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য হিসাব নিরীক্ষণ অফিসে আংশিক কাজ চলবে। জেলখানার ওয়ার্ডে ও অফিসে কাজ চলবে। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত শাখাগুলো চালু থাকবে।
স্বাধীনতাসংগ্রামে ভাসানীর সমর্থন:
টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল ময়দানে এক জনসভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো রকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এখন সাত কোটি বাঙালির নেতা। তিনি বলেন, ‘নেতার নির্দেশ পালন করুন।’
জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের জোর করে কৃত্রিম সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
শেখ মুজিবকে ভুট্টোর তারবার্তা:
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি বলেন, পাকিস্তান এক বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য তাঁদের উভয়েরই অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
তারবার্তায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে আরও বলেন, ‘আমি শিগগির আবার ঢাকায় গিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করে উদ্ভূত সমস্যার একটি সমাধান বের করার জন্যও তৈরি আছি। ইতিহাস যেন বলতে না পারে এ কাজে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম।’
গণ ঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান করাচিতে সাংবাদিকদের বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান সকালে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন।
এই দিন করাচি শিল্প ও বণিক সমিতি জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি তারবার্তা পাঠায়। তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন। দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪ নম্বর আদেশ জারি করে বলে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণে বা সেনাবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে তাদের কর্মকাণ্ড আক্রমণাত্মক বলে গণ্য হবে। সামরিক বিধি অনুযায়ী তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
১২ মার্চ ১৯৭১ : প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২৩ মার্চের পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
সরকারি-আধা সরকারি কর্মচারীরা এই দিনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মস্থল বর্জন অব্যাহত রাখেন। সারা বাংলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে উড়ছিল কালো পতাকা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য শপথ নেওয়া হয়।
ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তিসংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আবার তাঁর সমর্থন জানান।
আর্টস কাউন্সিলে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে চারু ও কারুশিল্পীদের এক সভায় মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল করা দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী স্কেচ বিতরণ, পোস্টার ও ফেস্টুন প্রচার, পোস্টার-ফেস্টুনসহ মিছিল আয়োজন করার কর্মসূচি নেয়। ১৬ মার্চ বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করারও সিদ্ধান্ত হয়।
জাতীয় পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন ১১ মার্চ এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব বর্জন করেন। রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের বাংলা সংবাদপাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি:
রেডিওতে প্রচারিত একটি খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবের কাছে পাঠানো পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর একটি চিঠি পরীক্ষাধীন এবং পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের নেতা খুরশীদ শেখ মুজিবের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি চিঠি নিয়ে এসেছেন। এ প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, এই অসত্য সংবাদ প্রচারে তিনি দুঃখিত।
আওয়ামী লীগের নেতা ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য পাঠানো খাদ্যবোঝাই মার্কিন জাহাজের গতিপথ বদল করে করাচি অভিমুখে প্রেরণের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা জানান।
ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি নেতারা:
রাতে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৩ মার্চ করাচি থেকে ঢাকা পৌঁছাবেন। খবরে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্টের একটি প্যাকেজ ডিলের প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই প্রাদেশিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা আছে।
লারকানা থেকে লাহোর যাওয়ার পথে মুলতান বিমানবন্দরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, পিপিপি এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চায়, যাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। তাঁরা চান জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য আমার দল সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, দোষ করা হলো লাহোরে, কিন্তু বুলেট বর্ষিত হলো ঢাকায়। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য এখন মাত্র একটিই পথ খোলা রয়েছে, আর তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানর সঙ্গে বৈঠকে বসুন।’
লাহোরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
১৩ মার্চ ১৯৭১ : শিল্পী-রাজনীতিকদের খেতাব বর্জন

দেশ উত্তাল। সরকারি-বেসরকারি সব কাজকর্ম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলা অব্যাহত ছিল। চলমান অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালতসহ সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে দিনভর অবিরাম চলে সভা-শোভাযাত্রা। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এই দিনেও গড়ে উঠেছে সংগ্রাম কমিটি।
সকালে ঢাকার রমনা পার্কে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে বের হয় দীর্ঘ নৌ মিছিল।
চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব ও পদক বর্জন করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে উমরতুল ফজলের সভাপতিত্বে চট্টগ্রামে নারীদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বাংলাদেশের মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাসদ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ভৈরবে এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলা এখন বস্তুত স্বাধীন। জাতি একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের অপেক্ষায় আছে।
কূটনীতিকদের মধ্যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছিল। ঢাকার জাতিসংঘ দপ্তর ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
সামরিক আদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি
পূর্ব পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে হুমকি দিয়ে বলা হয়, যারা কাজে যোগ দেবে না, তাদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।
সামরিক নির্দেশ জারির পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের দাবির কথা ঘোষণা করার পর নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি করা,
পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেওয়ার শামিল। সামরিক কর্তৃপক্ষের এই সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত, জনগণ সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। সামরিক সরকারের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না। সামরিক কর্তৃপক্ষকে বঙ্গবন্ধু উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
পাকিস্তানি নেতাদের তৎপরতা
লাহোরে জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ পাঁচটি দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা একটি সভায় মিলিত হয়ে দ্রুত সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
ওয়ালি ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খান এবং ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেনজো সকালে করাচি থেকে বিমানে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে ন্যাপপ্রধান জানান,
সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খোলা মন নিয়ে আলোচনা করার জন্য এসেছেন। তিনি বলেন, ‘সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত মুজিবুর রহমানের দাবির প্রশ্নে আমি তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।’
১৪ মার্চ ১৯৭১ : স্বাধীনতার দাবিতে সারা বাংলা উত্তাল

স্বাধীনতার দাবিতে সারা বাংলা উত্তাল। বিক্ষোভ–সমাবেশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে।
সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নম্বর নির্দেশের প্রতিবাদে দেশ রক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সকালে ঢাকায় বিক্ষোভ করেন। সরকারি কর্মচারী সমন্বয় কাউন্সিলের বিবৃতিতে সামরিক নির্দেশ কার্যকর না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ হয়। ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে সমাবেশ করেন টিভি নাট্যশিল্পীরা। সভায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
লেখক সংগ্রাম শিবিরের উদ্যোগে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় লেখক সমাবেশ। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) জনসভা ও মিছিল করে বায়তুল মোকাররম এলাকায়। সদরঘাটে ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে জনসমাবেশ এবং সন্ধ্যায় পল্টন ময়দানে কথাশিল্পী সম্প্রদায়ের কবিতাপাঠ ও গণসংগীতের আসর ছাড়াও আরও অনেক সংগঠন অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে মিছিল-সমাবেশ করে।
রাতে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশে ছুটিতে অবস্থানকারী কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি কর্মচারীদের পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে নিজ নিজ এলাকার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান।
ওশান এন্ডুরাস নামে সমরাস্ত্রবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ নম্বর জেটিতে নোঙর করে। বাংলাদেশের জন্য মন্টেসেলো ভিক্টরি নামে খাদ্যশস্যবাহী চট্টগ্রাম অভিমুখী জাহাজটি গতিপথ বদলে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এমন সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছেন। একাত্তরের ১৪ মার্চ এমন গুজবে সংশ্লিষ্ট মহলে কিছুটা হইচই পড়ে যায়।
সকালে ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালি খানের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনের আঙিনায় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, প্রেসিডেন্ট কি ঢাকায় এসেছেন? প্রশ্নকর্তা জবাব দেন, না। বঙ্গবন্ধু তখন আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে দেখা হবে কীভাবে? প্রশ্নকর্তা নিরুত্তর। এরপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আমি রাজি আছি।’
রাতে দীর্ঘ এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিয়েছেন, আত্মসমর্পণ নয়, তাঁরা আত্মত্যাগের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ভুট্টোর প্রস্তাব:
করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এক জনসভায় দলের প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেন।
তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ চায়, দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলই একসঙ্গে কাজ করুক। তিনি বলেন, ছয় দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দাবি করছে।
করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিরা প্রেসিডেন্টের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির স্বার্থে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নিতে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন।
তাঁরা বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রতিক অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সমুদয় অর্থ বাংলাদেশে আটকা পড়ে গেছে। এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়বে। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বাজার বাংলাদেশ।
১৫ মার্চ ১৯৭১ : ভুট্টোর নতুন দাবি, ইয়াহিয়া ঢাকায়

আগের দিনের ছড়ানো গুজবকে সত্যি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে স্বাগত জানান। কোনো সাংবাদিক বা বাঙালিকে বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) জুলফিকার আলী ভুট্টো আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন সরকারের দাবি জানান।
এই দিনও দেশজুড়ে পূর্ণ কর্মবিরতি চলে। ভবনে ভবনে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকাও তোলা হয়। দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সামরিক নির্দেশ উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাঁরা নাখালপাড়ায় একটি সভা করেন। সভাশেষে রাজপথে বের করেন বিক্ষোভ মিছিল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে। ১৪ মার্চ যেসব নির্দেশ জারি করা হয়েছে, তিনি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা মেনে চলার অনুরোধ জানান।
সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকেরা সমাবেশ-শোভাযাত্রা করেন। সন্ধ্যায় বেতার-টিভির শিল্পীরা সেখানে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। বিকেলে তোপখানা রোডে সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় নারী সমাবেশ। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা ট্রাকে চড়ে নগরীর নানা স্থানে গণসংগীত ও পথনাটক পরিবেশন করেন।
নতুন সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ছাত্র জমায়েত করে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
রাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্ট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। বাংলা থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত চেকপোস্টের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় প্রত্যাহার করা হয়। তবে কোনোক্রমেই যেন সম্পদ পাচার হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার অনুরোধ জানানো হয়।
খেতাব বর্জন:
দেশজুড়ে সরকারি খেতাব বর্জন করতে শুরু করেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন তাঁর দুই খেতাব ‘সিতারা-এ-খিদমত’ ও ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ বর্জন করেন। নাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীও পরিত্যাগ করেন তাঁর ‘সিতারা-এ-ইমতিয়াজ’ খেতাব। নাটোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাক্তার শেখ মোবারক হোসেন তাঁর ‘তমঘা-এ-কায়েদে আজম’ খেতাব বর্জন করেন।
ভুট্টোর দাবি:
করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নতুন দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। তাঁর দাবি, কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে অবশ্যই তা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে করতে হবে। দেশ শাসনের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইচ্ছার মূল্য দিতে হবে।
ভুট্টোর নতুন দাবিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। প্রবীণ রাজনীতিক আবুল হাশিম বলেন, জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর স্থান বিরোধী দলের আসনে। তাঁর কথামতো প্রেসিডেন্ট চললে পাকিস্তানের বিভক্তি অনিবার্য। ঢাকায় পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন বলেন, একই পরিষদে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকতে পারে না। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগই একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।
করাচিতে এক সভায় কয়েকজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা বলেন, ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে অনেক কথাই বলছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন তাঁর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এই অঞ্চলে ৩৮ শতাংশ ভোটও পায়নি। ক্ষমতা লাভের জন্য আওয়ামী লীগই একমাত্র দল।
করাচিতে জমিয়তে ওলামায়ের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ পিপিপি প্রধানের প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশে দুটি নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মাত্র একটি; আর সেটি আওয়ামী লীগ। তাই শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। ভুট্টোর দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক।
১৬ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে এই দিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হয়।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আজ ১৫তম দিবস। বেলা ১১টার কিছু আগে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনের (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) বৈঠকে যোগ দেন। তাঁর পরনে ছিল সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা গলাবন্ধ কোট। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে পৌঁছালে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানান। রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুরু হয় একান্ত আলোচনা। চলে আড়াই ঘণ্টা।

আলোচনা শেষে ইয়াহিয়া বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত এসে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে পৌঁছালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে, আরও হবে। কাল সকালে আরেকটি বৈঠক। আপাতত আর বেশি কিছু বলার নেই।’
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দলের শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। বিকেল পর্যন্ত বৈঠক চলে। রাত আটটায় সহকর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আবার আলোচনায় বসেন। বৈঠক চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
দুই দফা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে বিকেলে বঙ্গবন্ধু কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন।
অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৬ মার্চও অফিস-আদালত ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবন ছাড়া সর্বত্র কালো পতাকা ওড়ে। সারা দেশে চলে সভা ও শোভাযাত্রা।
মিছিল আর সমাবেশ:
মুহুর্মুহু মিছিলে ঢাকা উত্তপ্ত হতে থাকে। ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের সমাবেশ হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা ও মিছিল করেন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা। মিছিলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী মুর্তজা বশীর নেতৃত্ব দেন।
একই জায়গায় বিকেলে শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা কবিতাপাঠ ও গণসংগীত পরিবেশন করেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিল্পীরা দেশের গান পরিবেশন করেন ধানমন্ডিতে। বিকেলে ডাক বিভাগের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ ও রাজপথে শোভাযাত্রা করেন।
টঙ্গীতেও দীর্ঘ ও সুশৃঙ্খল জঙ্গি মিছিল বের করেন শ্রমিকেরা। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ডকইয়ার্ড শ্রমিকদের নৌ মিছিল বের হয়।
ময়মনসিংহে এক জনসভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
ভারতের প্রতিক্রিয়া:
ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দিল্লিতে বলেন, বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাসী মানুষ ও সরকারের উচিত শেখ মুজিব এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া। তিনি বলেন, উপমহাদেশে গান্ধীর পর শেখ মুজিবুর রহমানই এতটা বিশাল আয়তনে অহিংস শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা দেখাতে পারলেন।
পূর্বাঞ্চলে সেনা পরিবহন বন্ধ করার জন্য ভারত সরকার তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি উড়োজাহাজের চলাচল নিষিদ্ধ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে মিছিলের ঢেউ

একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। দিনটি আর দশটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। আগের দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক কোনো পরিণতির দিকে এগোয়নি। আজ সেই অসমাপ্ত বৈঠকের দ্বিতীয় দফা। একদিকে বৈঠক চলছে, আরেক দিকে সারা দেশ উদ্বেলিত হয়ে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। শহরগুলো মিছিলের নগরী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুহুর্মুহু মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে আসে। বাসভবনের সামনের রাস্তা লোকারণ্য হয়ে যায়। তাঁরা বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানান। তাঁদের শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে মিশে ছিল মুক্তির জন্য আকুল বার্তা।
শেখ মুজিবের বাসভবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। রাত পর্যন্ত দলীয় কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শুভেচ্ছা সাক্ষাতে মিলিত হন। বায়তুল মোকাররম মসজিদে বাদ আসর মিলাদ শেষে শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু কামনা করে বিশেষ মোনাজাত হয়। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাসভবনে পৌঁছানোর পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন।
একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, এই জন্মদিনে তাঁর সবচেয়ে বড় কামনা কী? শেখ মুজিব বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী!’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি। আমি যখন আলোচনা করি, অবশ্যই আমার দাবির কথাও বলি।’ তিনি বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে নাকি নিরর্থক হচ্ছে, বলা যাচ্ছে না। শুধু বলা চলে, আলোচনা চলছে। তবে এর পাশাপাশি আন্দোলনও চলছে। মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ঢাকায় দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেন। আলোচনা শুরু হয় সকাল ১০টায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) রুদ্ধদ্বার কক্ষে। চলে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী। আলোচনায় শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এলে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী শেখ মুজিবকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। তবে পরবর্তী বৈঠকের সময়ও ঠিক করা হয়নি। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ সময় তাঁকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
দিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিবস। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দিনও বন্ধ ছিল। ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সভা ও শোভাযাত্রা করে। হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনারে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতাসংগ্রামকে সফল করার শপথ নেন। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
‘পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন’
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ভাসানী ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, একটি সর্বজনীন দাবিতে মানুষের মধ্যে এখনকার মতো এমন একতা ও সহযোগিতা এর আগে আর কখনো তিনি দেখেননি। রাতে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুকে এক তারবার্তায় চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে সরেজমিনে অবহিত হওয়ার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানোর পরামর্শ দেন।
পাকিস্তান দিবস নয়, প্রতিরোধ দিবস
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২৩ মার্চ সকাল ছয়টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহীদদের মাজার জিয়ারত, শহীদ মিনারে ফুলের মালা দেওয়া, ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভায় কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকেও তিনি ঢাকায় ডেকে পাঠান। সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস সকালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস ই এম পীরজাদার সঙ্গে বৈঠক করেন।
লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি কয়েকজন রাজনীতিক আলাদা আলাদা বিবৃতিতে ভুট্টোর দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন হয়েছে সমগ্র দেশের জন্য, দুই অংশের জন্য আলাদাভাবে নির্বাচন হয়নি। তাই জাতীয় পরিষদে একটিমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র।
১৮ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার বৈঠক নিয়ে উৎকণ্ঠা

বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর পরবর্তী আর কোনো আলোচনার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। এ নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা জন্মায়। অবশেষে রাতে ঘোষণা করা হয়, তৃতীয় দফা বৈঠক হবে কাল বেলা ১১টায়।
১৮ মার্চও ঢাকার রাজপথে দিনভর ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মিছিল চলতে থাকে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাসংগ্রামের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য শপথ নেয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শহীদ মিনারে সাবেক বিমানসেনাদের শপথ গ্রহণ। ঢাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।
সারা দিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে উৎকণ্ঠিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে তাঁর বাসভবনে ভিড় করে। বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বৈঠক থেকে উঠে গিয়ে সমবেতদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি সবাইকে চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তোমাদের ওপর আঘাত এলে তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হানো।’
বিপুল সংখ্যায় দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। বাসভবনের সামনে জনতার ঢল দেখিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা, দেখুন, আমার দেশের মানুষ আজ মুক্তির প্রতিজ্ঞায় কী অটল-অবিচল। কার সাধ্য আছে এই উত্তাল জনসমুদ্রকে রোখে?’
রাতে শেখ মুজিব সেনাবাহিনী তলব-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমার উত্থাপিত দাবির পরিপূরক নয়। তাই আমি এই কমিশন মেনে নিতে পারি না।’
শ্রমিকদের ওপর সেনা-হামলা:
সকালে সেনাসদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। তারা নিরস্ত্র ট্রাক আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে তাদের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। এর প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা ও দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়রানির শিকার লোকজনের প্রতি সমবেদনা ও সেনাসদস্যদের প্রতি নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।
ইয়াহিয়ার আহ্বানে ভুট্টোর অস্বীকৃতি:
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার ঢাকায় যেতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো জবাব না পাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী আরেকটি জাহাজও এই দিন চট্টগ্রামের বদলে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯ মার্চ ১৯৭১ : ইয়াহিয়া-মুজিব তৃতীয় বৈঠক
এক দিন বিরতির পর ১৯ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা বসে প্রেসিডেন্ট ভবনে। একান্ত এ আলোচনায় তৃতীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে দেড় ঘণ্টা কথা হয়।
বৈঠক শেষে শেখ মুজিব নিজ বাসভবনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পরদিন সকালে আবার বৈঠক হবে। তবে সে বৈঠক একান্ত হবে না। দলের শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে থাকবেন। এর আগে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় বসবেন।
একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, মানুষকে সব সময় ‘জয় বাংলা’ বলে সম্ভাষণ জানানোর কারণ কী। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি মুসলমান। সকালে ঘুম থেকে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করার পরই আমি জয় বাংলা বলি। মৃত্যুর সময় আমি আল্লাহর নাম নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ইহধাম থেকে বিদায় নিতে চাই।’
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের সে বৈঠকটি বসে। তাতে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন।
সংঘর্ষ-গুলি, নিহত ২০, জয়দেবপুরে কারফিউ
একদিকে বৈঠক অব্যাহত রয়েছে, অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনও চলছে। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে এই দিনে জয়দেবপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। স্থানীয় মানুষ খবর পায়, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সেনা জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজবাড়ির সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে আসবে। খবরে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বেলা আড়াইটার দিকে হাজার বিশেক মানুষ জয়দেবপুর রেলগেটের কাছে গাড়ি এবং অন্য ভারী জিনিসপত্র ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
অন্যান্য সড়কেও জনতা ব্যারিকেড দেয়। এ সময় জয়দেবপুর এবং আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। ঘটনার পর সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
এ খবর ঢাকায় এসে পৌঁছালে নগরবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা ও বর্শা-বল্লম নিয়ে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিকেলে বিক্ষুব্ধ জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে সমবেত হয়। শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, শক্তিই প্রয়োগ করে বাঙালির দাবি নস্যাৎ করা যাবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা অস্ত্রের জোরে বাঙালিদের শাসন করতে চেয়ো না। শক্তি প্রয়োগ করে আর বাঙালি জাতিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান চাই।’
অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত:
এই দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা ওড়ানো অব্যাহত থাকে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশজুড়ে স্বাধীনতার দাবিতে সভা-শোভাযাত্রা চলে। বায়তুল মোকাররমসহ সারা দেশে মসজিদে মসজিদে বাদ জুমা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত হয়।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে অযথা সময় নষ্ট করছেন। তাঁর বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার মনে রাখা উচিত, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার তাঁর নেই।
ভুট্টোর হুমকি:
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি গণ-আন্দোলন শুরু করার লক্ষ্যে তাঁর দলের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। ভুট্টো বলেন, পিপলস পার্টিকে ক্ষমতার হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র হলে তিনিও চুপ করে বসে থাকবেন না।

২০ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধু–ইয়াহিয়ার চতুর্থ দফা বৈঠক
সকাল ১০টায় আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সহকর্মীদের নিয়ে বের হয়ে আসেন। তাঁকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে আসার পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কাল আবার বৈঠক হবে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলব না। সময় এলে আমি অবশ্যই সবকিছু বলব।’
সাংবাদিকেরা জানতে চান, এ আলোচনা আর কত দিন চলবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। তাঁরা একটি সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
জয়দেবপুরে নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঘটনাটির প্রতি তিনি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন।
রাতে শেখ মুজিব একটি দীর্ঘ বিবৃতি দেন। তাতে বলেন, মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। জনগণের প্রতি তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের আন্দোলন প্রতিটি গ্রাম, শহর, নগরের নারী-পুরুষ, শিশুকে বাংলাদেশের দাবির পেছনে সুসংগঠিত করেছে। বাংলাদেশের জনগণ সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের হৃদয় জয় করেছে।’
সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী গঠনের আহ্বান
দিনটি ছিল অহিংস আন্দোলনের ১৯তম দিবস। সারা দিন সভা-সমাবেশে ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল ছুটে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নৌবাহিনীর সাবেক সৈনিকদের সমাবেশ। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক বাঙালি নৌসেনাদের সমাবেশে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সেনাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশ শেষে বাঙালি নৌ সেনারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে যান।
বিভিন্ন সংগঠন শহীদ মিনারে সমাবেশ ও শপথ অনুষ্ঠানের পর একে একে শোভাযাত্রা নিয়ে শেখ মুজিবের বাসভবনে গিয়ে সমবেত হয়। তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠ ভাষণে ঘোষণা করেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনো শক্তিই রুখতে পারবে না। যত বাধাই আসুক, বাংলার মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম চলবে।
পাকিস্তানি নেতাদের তৎপরতা
কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা এবং জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে আলাদা বৈঠকে মিলিত হন। সকালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি করাচি থেকে ঢাকায় আসেন।
সন্ধ্যায় ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, জমিয়াতে ওলামায়ে নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদ, পাঞ্জাবের কাউন্সিল লীগ প্রধান সরদার শওকত হায়াত খান, বালুচ ন্যাপের প্রধান গাউস বক্স বেজেঞ্জো, পীর সাইফউদ্দিন প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ঘরোয়া বৈঠকে বসেন।
করাচিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা মানবেন না। ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালি খান ও মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা লন্ডনে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে যে লন্ডন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন,
সেটাই সবাইকে মানতে হবে। ভুট্টো আরও জানান, তিনি আগামীকাল ঢাকায় আসছেন। তাঁকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়ার কাছে তিনি যে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, ঢাকা থেকে সে সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব আসায় তিনি ঢাকা বৈঠকে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জয়প্রকাশ নারায়ণের বক্তব্যের প্রতিবাদ
শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রশংসা করে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন। ইউএনআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়,
একটি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ নেতৃত্বের প্রশংসা করে সম্প্রতি সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সংক্ষিপ্তসার ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছে।
শেখ মুজিবকে সমর্থনের জন্য জয়প্রকাশ মুক্তিপ্রেমিক জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন। দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন ভারতের বহির্বিষয়ক দপ্তরের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, এতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
২১ মার্চ ১৯৭১ : মুজিব-ইয়াহিয়া হঠাৎ বৈঠক
অসহযোগ আন্দোলন আজকের তারিখে ২০তম দিবসে পৌঁছায়। কিন্তু সারা দেশের মানুষের আন্দোলনের জোয়ারে বিন্দুমাত্র ভাটা তো পড়েইনি, জোয়ার বরং উত্তাল হয়ে উঠছিল। সভা-সমাবেশ আর শোভাযাত্রার মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রামের কর্মসূচির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রকাশ ২১ মার্চও সমান উৎসাহে ঘটতে থাকে। সরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভবনগুলোর শীর্ষে শীর্ষে কালো পতাকা। হাজার হাজার মানুষের অসংখ্য মিছিলে ঢাকা যেন আরও অগ্নিগর্ভ।
‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর নারী-পুরুষ-কিশোরদের সম্মিলিত মিছিল এগিয়ে চলে শহীদ মিনারের দিকে। সেখান থেকে মিছিল যায় ধানমন্ডির দিকে। সারা দিন ধরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাসভবনের সামনে একের পর এক মিছিল আসতে থাকে। কোনো মিছিলকেই বঙ্গবন্ধু উপেক্ষা করেননি। ব্যস্ততার মধ্যেও বারবার এসে মিছিলগুলোকে স্বাগত জানিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
বক্তৃতাগুলোতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলেন, মৌলিক প্রশ্নে কোনো আপস হতে পারে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি। প্রয়োজন হলে চরম ত্যাগ স্বীকার করব। তবু দাবি আদায় করে ছাড়ব। জনতার জয় অবধারিত।’

এই দৃশ্যপটের ভেতর সকালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনির্ধারিত বৈঠক হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। পঞ্চম দফার এ বৈঠক চলে দেড় ঘণ্টা।
বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু জানান, বৈঠকটি আকস্মিক ছিল না। আগের আলোচনার রেশ ধরে কিছু বিষয় স্পষ্ট করার জন্য এ বৈঠকের প্রয়োজন ছিল।
ভুট্টো ঢাকায়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক:
বিকেলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সদলবল করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ভুট্টো ও তাঁর দলকে সামরিক বেষ্টনী দিয়ে বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আনা হয়। রাস্তার দুই পাশের পথচারীরা এ সময় ভুট্টোবিরোধী স্লোগান দেন। হোটেলের সামনে অপেক্ষমাণ জনতা হোটেলে প্রবেশের সময় ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ভুট্টো লাউঞ্জে প্রবেশের পর সেখানেও একদল বিক্ষোভকারী প্ল্যাকার্ডসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁর কাছে সাংবাদিকদের যেতে দেওয়া হয়নি।
ভুট্টো যখন হোটেলে ঢোকার সময় ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়ছিল। সেনারা সে পতাকা নামিয়ে ফেলে। কিন্তু জনতার প্রতিবাদের মুখে আবার তারা কালো পতাকা ওড়াতে বাধ্য হয়।
সন্ধ্যায় কড়া সেনা পাহারায় ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে দুই ঘণ্টার বেশি আলোচনা চলে। বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আর কিছু তিনি বলেননি। এরপর ভুট্টো তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
করাচি থেকে আসা বিশিষ্ট আইনজীবী এবং আগরতলা মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি সকালে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনার সময় তিনি অভিমত দিয়ে বলেন, সামরিক আইন প্রত্যাহার ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত কোনো বাধা নেই।
সন্ধ্যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ খান মোহাম্মদ দৌলতানার কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা বৈঠক করেন। এর আগে সকালে মিয়া মমতাজ দৌলতানা পিডিপি প্রধান নুরুল আমিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২১ মার্চ ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপের ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়।
ভাসানীর পরামর্শ, জনতার কর্মসূচি:
চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউন্ডে বিকেলে এক বিশাল জনসভায় ভাসানী ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা করেন, আলোচনায় ফল হবে না। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে শাসন ও সংবিধান প্রণয়নের সব দায়িত্ব অর্পণের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান।
মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মগবাজারে অনুষ্ঠিত নারী সমাবেশে সেনাবাহিনীর সাবেক বাঙালি সেনাদের নিয়ে একটি প্যারামিলিটারি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ লেখক ও শিল্পীরা আয়োজন করেন একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নারায়ণগঞ্জে নারীরা একটি নৌ মিছিল বের করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ থেকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্য বর্জন সপ্তাহ’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
২২ মার্চ ১৯৭১ : মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠকে ভুট্টো
সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ২২ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের ষষ্ঠ বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও যোগ দেন।
প্রেসিডেন্টের ভবন এলাকায় ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটে। প্রধান ফটকের অদূরে জনতা শেখ মুজিবের সমর্থনে ও ভুট্টোর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন বঙ্গবন্ধুর এক ঘণ্টা আগে। ভুট্টো সন্ধ্যায় আবার নিজের উপদেষ্টাদের নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর বৈঠক চলাকালেই ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনের মুখপাত্রের ঘোষণায় বলা হয়, পাকিস্তানের দুই অংশের নেতাদের মধ্যে আলোচনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের পরিবেশ সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য প্রেসিডেন্ট এ অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালি আন্দোলনে আছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর নির্ধারিত বৈঠকে ভুট্টোও ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরের বৈঠক কবে হবে, তা আমি জানি না। আগামীকাল বা পরশু হতে পারে। তবে আজ বা আগামীকাল আমার দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে আরেক দফা বৈঠক হতে পারে।’
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবেন না। সে অনুসারেই প্রেসিডেন্ট পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মানুষের ঢল:
অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম এই দিনেও বিভিন্ন সংগঠনের সভা-সমাবেশ-মিছিল চলতেই থাকে। পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে, তাতে সাবেক সৈনিকেরা আর সাবেক হিসেবে বসে থাকতে পারে না।
এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ। তাতে বক্তব্য দেন কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানীসহ অন্যরা। সাবেক বাঙালি সেনাদের বক্তব্য শোনার জন্য পল্টন ময়দানে বিপুল জনসমাগম ঘটে। সভা শেষে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনারা কুচকাওয়াজ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান।
সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর। সব মিছিল আর শোভাযাত্রার গন্তব্য ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বেশ কয়েকবার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘সাত কোটি মানুষের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রামে আমরা অবশ্যই জয়ী হব।’
ভুট্টোর হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন:
রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের লাউঞ্জে সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগ প্রধান একটি সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছেছেন। তবে পিপলস পার্টির কাছে এ মতৈক্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারে না।
ভুট্টো জোর দিয়ে বলেন, দেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে অবশ্যই সমঝোতা ও মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। পিপলস পার্টি এ কারণেই আওয়ামী লীগের চার দফা পূর্বশর্ত বিবেচনা করছে এবং স্থায়ী ব্যবস্থার কথা মনে রেখে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা চিন্তাভাবনা করছে।
রাতে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ খান মোহাম্মদ দৌলতানা, ওয়ালি ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও সর্দার শওকত হায়াত খান এবং জমিয়তে উলামায়ের মহাসচিব মাওলানা মুফতি মাহমুদ প্রেসিডেন্ট ভবনে যান।
তাঁরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠক করেন। গভীর রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের এই নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য এদিন মুসলিম লীগ সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান ও জমিয়তে উলামায়ের প্রধান মাওলানা শাহ আহমদ নুরানিকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান।
২৩ মার্চ ১৯৭১ : পাকিস্তান দিবসে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা

২৩ মার্চ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’। কিন্তু একাত্তরের এই দিনে সারা বাংলায় উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়েনি। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ পালনের নামে প্রকৃতপক্ষে দিনটিকে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে।
ঢাকায় সচিবালয়, হাইকোর্ট ও জাতীয় পরিষদ ভবন, ইপিআর ও পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও প্রদেশের মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ঢাকার ব্রিটিশ উপহাইকমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার উপদূতাবাসে প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা তোলা হয়। পরে জনতা সেসব নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। মার্কিন কনস্যুলেটে কোনো পতাকাই তোলা হয়নি।
সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় সমবেত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকাকে অভিবাদন জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। সূর্যাস্তের সময় স্বেচ্ছাসেবকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা নামিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের শীর্ষে যথারীতি কালো পতাকাও ওড়ে।
সকাল থেকে রাত অব্দি ঢাকার রাজপথ সংগ্রামী জনতার মিছিলে প্রকম্পিত হয়। মিছিলে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ-শিশু সবার হাতে ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মানুষ সুশৃঙ্খল মিছিল করে শেখ মুজিবের বাসভবনের সামনে আসতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ দিবসটি ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে। বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিউমার্কেট থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত পুরো এলাকা মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায়।
শেখ মুজিবের বাসভবন এলাকা থেকে শুরু করে প্রশস্ত মিরপুর সড়ক উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুক্তিকাতর জনতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে পতাকা হাতে নেয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা আন্দোলিত করে তাদের অভিনন্দিত করেন।
ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করে। আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত শেষে শহীদ মিনারে ফুলের মালা দেয়। সকাল সোয়া নয়টায় আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রছাত্রী ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া।
হাজার হাজার মানুষের করতালির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকাকে অভিবাদন জানান। এ সময় রেকর্ডে বাজছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এরপর তারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান।
নানামুখী তৎপরতা:
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাঁর যাওয়া-আসার সময় পথের দুই পাশে জনতা বিক্ষোভ জানায়।
আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন এদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এম এ আহমেদের সঙ্গে দুপুরে ও সন্ধ্যায় দুই দফা বৈঠকে মিলিত হন।
সকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গেও বৈঠক করেন। ভুট্টো প্রায় সারা দিন দলীয় উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করেন।
মুসলিম লীগের নেতা খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৩ মার্চ করাচি থেকে ঢাকায় এসেই ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বিকেলে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও আলোচনা করেন। কাইয়ুম খান সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের মানুষকেই বলতে হবে, দেশকে অখণ্ড রেখে তারা কতটুকু স্বায়ত্তশাসন আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কতটুকু সম্পর্ক রাখতে চায়। যদিও ভোটের মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিয়েছে, তাদের প্রত্যাশা সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
সন্ধ্যায় খান আবদুল ওয়ালি খান, মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, মুফতি মাহমুদ, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, শাহ আহমদ নুরানি ও সরদার শওকত প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে মুফতি-ওয়ালি-বেজেঞ্জো যৌথ বিবৃতিতে বলেন,
দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর জনসাধারণ যখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন থেকেই প্রতারণাপূর্ণ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
এদিন করাচিতে ভুট্টো সমর্থকেরা বাঙালি কলোনিতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ও লুটতরাজ করে। বেশ কয়েকজন বাঙালি এতে হতাহত হয়।
পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ২৩ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি সামরিক বিমানে করে গোপনে ঢাকা সফর করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম খান। ফারল্যান্ড সেদিনই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান।
২৪ মার্চ ১৯৭১ : স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবে: বঙ্গবন্ধু
সরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দিনেও হরতাল পালিত হয়। দেশজুড়ে বাড়িতে বাড়িতে উড়ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও। সারা বাংলায় লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকারের লোকজন বোমাবাজি ও হামলা শুরু করে। ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখে তারা ঢাকার মিরপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটায়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অভিমুখে ছিল মিছিল আর মিছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি চূড়ান্ত সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। স্বাধীনতা আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।’
চট্টগ্রামে জনতা-সেনাবাহিনী সংঘর্ষ হয়। সৈয়দপুরে সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে অবাঙালিরা বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। গুলিবর্ষণে অনেক মানুষ হতাহত হয়। আগের রাত থেকে সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে হত্যাকাণ্ড চালায়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী ও অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। নিরস্ত্র বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করে।
রংপুর হাসপাতালের সামনে জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনারা রংপুর সেনানিবাস এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এতে অনেকে হতাহত হয়।
সন্ধ্যায় ঢাকার মিরপুরে সেনাবাহিনীর সাদাপোশাকধারী লোকদের সহযোগিতায় অবাঙালিরা জোর করে বাঙালিদের বাড়ির ছাদ থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন দেয়। এরপর পাকিস্তানের পতাকা তোলে। কিছু জায়গায় বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়।
ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে পাহারারত সেনারা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বৈঠক ও বিবৃতি:
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা দেওয়া বাকি। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা দীর্ঘ করতে আর রাজি নয়।
চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর ও মিরপুরের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তাজউদ্দীন আহমদ গভীর রাতে বিবৃতি দেন। সরকারকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।
রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, আলোচনা করে আর কালক্ষেপণ নয়। আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে মতামত দেওয়ার পরও সরকার গড়িমসি করে কালক্ষেপণ করছে। এতে পরিস্থিতি ক্রমে সংকটের গভীরে চলে যাচ্ছে। সরকারকে অবিলম্বে অবস্থান জানাতে হবে।
ঢাকায় সাংবাদিকেরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক:
পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা। কিন্তু তাঁর একটি জাতীয় দায়িত্বও রয়েছে। পাকিস্তান অখণ্ড রাখতে তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত।
বিকেলে ওয়ালি ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রধান কাইয়ুম খান, জমিয়তে ইসলামের নেতা মাওলানা শাহ আহমদ নুরানি ও মাওলানা মুফতি মাহমুদ, লীগ নেতা সরদার শওকত হায়াত খান এবং পিপলস পার্টির এ এইচ কারদার, মমতাজ ভুট্টো, গোলাম মোস্তফা জাতোই, হায়াত মোহাম্মদ খানসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পিআইএর একই ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন।
করাচি রওনা হওয়ার আগে ওয়ালি খান গাউস বক্স বেজেঞ্জোকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন।
চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাসে বাধা:
বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে যায়। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ বন্দরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে।
জনতা জেটি থেকে কদমতলী পর্যন্ত চার মাইল পথের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে। সেসব অস্ত্র ট্রাকে তুলে নতুনপাড়া সেনানিবাসে আনার সময় ডবল মুড়িং রোডে একটি ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে জনতা তাদের পথরোধ করে। রাতে সেনারা গুলিবর্ষণ করলে বহু শ্রমিক-জনতা নিহত হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১: ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার সূচনা

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা তড়িঘড়ি করে ঢাকা ত্যাগ করছিলেন। খবরটি দিনভর নানা জল্পনার জন্ম দেয়। রাত আটটায় ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ছাড়লে গুজবের সঙ্গে যুক্ত হয় আশঙ্কা।
শহর থমথমে হয়ে পড়ে। মানুষ আঁচ করতে পারছিল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ভারী অস্ত্রে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালাবে, বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেবে—তা ছিল কল্পনার বাইরে।
সকালে পাকিস্তানি নেতাদের কর্মকাণ্ডে সেই নির্মমতার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না। ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক হয়। এর আগে সকালে সংবাদপত্র থেকে মানুষ জানতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ নেতা আগের দিন তাড়াহুড়ো ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
দুপুর থেকে গুঞ্জন ছিল, সামরিক আইন প্রত্যাহার করে কেন্দ্রে আপাতত ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠন করা হবে, প্রদেশগুলোয় নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে, পার্লামেন্টের বাইরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা আলাদাভাবে মিলিত হয়ে ৬ দফার প্রেক্ষাপটে সংবিধানের জন্য সুপারিশ করবেন ইত্যাদি।
ইয়াহিয়া খানের প্রস্থানের খবর শুনে রাত নয়টার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করবে, এই অনুমানে ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করে।
খবর পেয়ে রাত নয়টার পর আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছেন। এর মাধ্যমে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন। রাত ১০টায় তিনি কিছু নির্দেশ জারি করে জনতাকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
২৫ মার্চ বিভীষিকার রাত:
রাত সাড়ে ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শুরু করে তাদের গণহত্যা-মিশন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ব্যাপক নিধনযজ্ঞের প্রস্তুতি নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় ফার্মগেটের কাছে।
প্রতিরোধকারীদের তারা হত্যা করে। সেনাবাহিনী লাউড স্পিকারে গোটা ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারির ঘোষণা দিয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। সাঁজোয়া যানের আওয়াজ, গুলির শব্দ, গোলার বিস্ফোরণ আর মানুষের আর্তচিৎকারে ঢাকা বিভীষিকার শহরে পরিণত হয়।
সেনাবাহিনী পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধ্বংসী হামলা চালায়। রাত আনুমানিক একটায় তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
খুঁজে খুঁজে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। পিলখানায় এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি সেনা ও পুলিশরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। সেনাবাহিনী রাত দুইটার পর ইপিআর হেডকোয়ার্টার এবং ভোরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টার, ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকসহ আবাসিক এলাকা ও বস্তির বাসিন্দাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সেনাবাহিনী নজিরবিহীন গণহত্যার সূচনা করে। তারা নির্মমভাবে হত্যা করে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে। ট্যাংকের গোলায় বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঢাকা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তারা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লাঞ্চার, মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে। তাদের নির্মম আক্রমণে ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) অসংখ্য ছাত্র নিহত হয়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা বাসায় গিয়ে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করে। তারা অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ও তাঁর পালিত কন্যা রোকেয়া সুলতানার স্বামীকে হত্যা করে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে হত্যা করে তাঁর ছেলে ও আত্মীয়সহ।
তাদের গুলিতে গুরুতর আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। তিনি পরে হাসপাতালে মারা যান। নিহত হন জগন্নাথ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হয়েছিলেন ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুকতাদির। সে রাতে জগন্নাথ হলে ৩৪ জন ছাত্র শহীদ হয়।
পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ নম্বর নীলক্ষেতের বাড়িতে অধ্যাপক ফজলুর রহমানকে তাঁর দুই আত্মীয়সহ হত্যা করে। ঢাকা হলে হত্যা করা হয় গণিতের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম এবং অধ্যাপক শরাফত আলীকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। মধ্যরাতের আগেই ছাত্রলীগের প্রায় সব নেতা-কর্মী হল ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেই রাত থেকে পরের সারা দিনরাত ওই হলে প্রচণ্ড আক্রমণ চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে এ মুনিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, শুধু সেখানেই প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হন।
২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয়, তা থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাসে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাস এবং মধুদার ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দের বাড়িতে হামলা করে তাঁকে হত্যা করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে।
২৩ নম্বর নীলক্ষেত আবাসের ছাদে আশ্রয় নেওয়া নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি পুলিশ, প্রেসিডেন্ট হাউস (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) প্রহরারত বাঙালি ইপিআর এবং নীলক্ষেত রেলসড়ক বস্তি থেকে আগত প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়।
চট্টগ্রামে ইপিআরের বিদ্রোহ:
রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের (পরে মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। রফিকুল ইসলাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারের বাঙালি সেনাদের নিয়ে সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেন তাঁরা রাত পৌনে ১১টার মধ্যে।
২৬ মার্চ ১৯৭১ : স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে আটক
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে—২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টার পর—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) জেড এ খান।
আটক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ২৬ মার্চের এক প্রতিবেদনে এ ঘোষণার উল্লেখ করা হয় এভাবে, ‘পাকিস্তানে আজ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুই অংশের পূর্বাঞ্চলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলি ছোড়া হয়, তখন রেডিও পাকিস্তানের একটি তরঙ্গে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো আগে রেকর্ড করা বাণী, যেখানে শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’
ওয়্যারলেসে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজ থেকেও শোনা যায়। এই দিনটিতে পূর্ব বাংলার ইতিহাস নতুন দিগন্তের দিকে মোড় নেয়। সূচনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের।
চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা:
২৬ মার্চ বেলা ২টা ১০ মিনিট এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পাঠ করা হয়। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতা এম এ হান্নান ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে নিজ নামে এ ঘোষণা পাঠ করেন।
এরপর রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। ঘোষণাটি পাঠ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে।
রাত ১০টায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইংরেজিতে একটি আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার এবং মুক্তিকামী জনগণকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব:
২৬ মার্চ সারা দিন ও রাতে সান্ধ্য আইন জারি করে পাকিস্তানি সেনারা দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন, বস্তি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আক্রমণ করে। গোলাগুলি করে এবং আগুন লাগিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়। সকালে এলিফ্যান্ট রোডে আগরতলা মামলার ২ নম্বর অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁর লাশ নিয়ে যায়।
সেনারা দুপুরে পুরান ঢাকার হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গোলাগুলি করে লোক হত্যা করে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চলে।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে ২৬ মার্চ দিনরাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনারা শত শত লাশ মাটি চাপা দেয়। পুরান ঢাকার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে।
বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়। তাঁদের বাইরে আসতে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং কয়েকটি পত্রিকা অফিস পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্কের গোলায় ধ্বংস করে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর ২৮ মার্চ সংখ্যা জানায়, দ্য পিপল অফিস পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সাংবাদিকেরা এ দৃশ্য দেখেন।
দিনটি শুক্রবার হলেও ঢাকার কোনো মসজিদে এই দিন জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়নি।
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ:
চট্টগ্রামে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। রেজিমেন্টের পাকিস্তানি ও অবাঙালিদের বন্দী করা হয়। জিয়াউর রহমান রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-পুলিশ-ইপিআর ও বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী নগরীর কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। রাতে কুমিরায় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সেনারা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
বগুড়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ:
সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রংপুর থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া শহর আক্রমণ করে। কালীতলাহাট পার হওয়ার পর অকস্মাৎ কিছু প্রতিরোধযোদ্ধা এসে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে। প্রতিরোধ দমন করে পাকিস্তানি সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে চলে। বড়গোলায় তারা বড় প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ঝাউতলায় যুদ্ধে শহীদ হন আজাদ নামে এক প্রতিরোধযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ।
এদিনের যুদ্ধে আরও তিনজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তুমুল প্রতিরোধের মুখে দুপুর সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে শহর ছেড়ে সুবিলের (করতোয়ার একটি খাল) উত্তর পারে এক ডাকবাংলো ও মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। এরপর বগুড়া শহর পাকিস্তানি সেনা থেকে বেশ কিছুদিন মুক্ত থাকে।
ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ:
রাত আটটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচি থেকে বেতার ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে আবার সরকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ তিন সপ্তাহ ধরে আইনসংগত কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছেন।
তাঁরা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন, পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও জাতির জনকের ছবির অবমাননা করেছেন এবং আইন অমান্য করে সমান্তরাল সরকার গঠনের প্রয়াস চালিয়েছেন। শেখ মুজিব দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। এর শাস্তি তাঁকে অবশ্যই পেতে হবে।
ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, সেনাবাহিনীকে তিনি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। নিষিদ্ধ করা হলো আওয়ামী লীগকে। প্রচারমাধ্যমের ওপরও সেন্সরশিপ বলবৎ করা হলো।
২৭ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ
২৭ মার্চ সকালে তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষ বের হয় শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। কাতারে কাতারে মানুষ যেতে থাকে গ্রামের দিকে। শহরের অনেক রাস্তার পাশে পড়ে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের লাশ। মানুষ বুঝতে পারে, কী বিভীষিকা শহরে ঘটে গেছে।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চের মতো এই দিন দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠানে দুবার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। প্রথমবার তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে ঘোষণাটি দ্বিতীয়বার পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর নামে।
জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ প্রথমবার স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তার মূল কপিটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর নামে যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ তিনি করেন, সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র-এর তৃতীয় খণ্ডে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা
২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুকে আটকের ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ‘কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।’
দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে (শেখ মুজিবুর) রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইজ প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে তাঁর বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।
যুক্তরাজ্যের আরেক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান-এ বলা হয়, ‘২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অন্য একজন পড়ে শোনান।’
নিউইয়র্ক টাইমস-এ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশে লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক’।
বার্তা সংস্থা এপির খবর ছিল, ‘ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করার এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’
এর বাইরেও ভারতের আরও কয়েকটি পত্রিকা এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস হেরাল্ড-এর একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বেঙ্গলি ইনডিপেনডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।’
ভারতের প্রতিক্রিয়া
২৭ মার্চ ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অংশ নেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে লোকসভায় নেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়:
১. পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে নিদারুণ মনঃকষ্ট ও গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছে এই আইনসভা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালিয়েছে এবং এই হামলা চালানোর উদ্দেশ্য হলো তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ দমন করা।
২. পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার যে নির্ভুল প্রতিফলন ঘটেছে, সেটিকে শ্রদ্ধা করার বদলে পাকিস্তানের সরকার জনগণের ম্যান্ডেটকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।
৩. পাকিস্তানের সরকার শুধু যে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে, তা নয়, বরং বিতর্কিতভাবে জাতীয় গণপরিষদের ন্যায্য ও সার্বভৌম ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণকে দমনের জন্য বলপ্রয়োগের নগ্ন দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করা হয়েছে।
৪. ভারতের জনগণ ও সরকার সব সময় পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী এবং এ লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চায়। অন্যদিকে উপমহাদেশের জনগণের সঙ্গে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শতাব্দীপ্রাচীন বন্ধন রক্ষা করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সীমান্তের সন্নিকটে ঘটে যাওয়া এমন ভয়ংকর বিয়োগান্ত ঘটনায় এই আইনসভার পক্ষে উদাসীন থাকা সম্ভব নয়। নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষের ওপর চলা অভাবিত মাত্রার এমন হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পুরো দেশের জনতা নিন্দা জানিয়েছে।
৫. গণতান্ত্রিক পথ বেছে নেওয়া পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আইনসভা গভীর সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করছে।
৬. আইনসভা প্রতিরক্ষাহীন মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ ও নৃশংসতা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে এবং বিশ্বের সব মানুষ ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যেন গণহত্যার শামিল হত্যাযজ্ঞ বন্ধে পাকিস্তান সরকারের ওপর জরুরি ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
৭. এই আইনসভা বিশ্বাস করে, পূর্ব বাংলার মানুষের এই ঐতিহাসিক উত্থান বিজয়ে রূপ নেবে। তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে।
বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার
সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসা প্রায় ৫০ জন বিদেশি সাংবাদিক ২৫ মার্চ রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটক ছিলেন। ২৭ মার্চ কড়া সেনা পাহারায় তাঁদের হোটেল থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে বিশেষ বিমানে করাচি পাঠানো হয়।
পরে জানা যায়, তখন দুজন সাংবাদিক পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে হোটেলে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন সাইমন ড্রিং। কারফিউ শিথিল হলে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। পরে তাদের পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম (স্বাধীনতার পর কর্নেল) চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা-কর্মকর্তা ও সেনাদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। রেজিমেন্টের পাকিস্তানি ও অবাঙালি সদস্যদের বন্দী করা হয়। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম (পরে মেজর জেনারেল)। তিনি এই রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন।
ঠাকুরগাঁওয়ে ইপিআর শাখার বাঙালি সেনারা রাতে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। চট্টগ্রাম শহরের চারদিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত লড়াই চলে। কুমিরায় তুমুল যুদ্ধ হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালিরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৮ মার্চ ১৯৭১ : স্থানে স্থানে বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৫ মার্চের গণহত্যা আর ২৬ ও ২৭ মার্চের উপর্যুপরি স্বাধীনতার ঘোষণার যুগপৎ প্রভাব এই দিনে লক্ষ্য করা যায়। মানুষের মনের গভীরে অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুভীতি। ২৮ মার্চ ঢাকায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়।
হাজার হাজার সন্ত্রস্ত মানুষ আগের দিনের মতোই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ছাড়তে শুরু করে। এর পাশাপাশি দেশের নানা স্থানে বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালায়। এই দিনেও শহরের রাস্তার পাশে পড়ে ছিল নিহতদের লাশ।
রাতে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য আবারও বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পাকিস্তানি নৌবাহিনী চট্টগ্রামের নানা অঞ্চলে এই দিন প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। শুভপুর ব্রিজে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সারাদিন যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানিরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নৌবন্দর এলাকায় পাকিস্তানি নৌবাহিনী বাঙালি নৌসেনাদের নিরস্ত্র করে হত্যা করে।
পিটিআই জানায়, নিউইয়র্কে বাঙালিরা পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তানের কনস্যুলেট ও জাতিসংঘের মিশন ছিল পাশাপাশি বাড়িতে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বাঙালিদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন।
পাকিস্তানে মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান গণহত্যার সাফাই গেয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি এবং সুস্পষ্টভাবে দেশদ্রোহী প্রস্তাব। ঢাকা সম্প্রতি যা ঘটেছে তা উন্মুক্ত বিদ্রোহ। সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ অত্যন্ত সঠিক, সময়োপযোগী ও ন্যায়সংগত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল
জয়দেবপুরে মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, পর মেজর জেনারেল, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রদূত ও সাংসদ) নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকেরা ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী রকিব উদ্দিন।
অধিনায়ক হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ। কে এম সফিউল্লাহ ছিলেন উপ–অধিনায়ক। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে কে এম সফিউল্লাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কাজী রকিব শেষ অব্দি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, কিন্তু যোগ না দিয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষাও করতে পারেননি। পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক ও হত্যা করে।
কে এম সফিউল্লাহরা ময়মনসিংহে ব্যাটালিয়ন সমাবেশের পরিকল্পনা করেন, যাতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যায়। সে জন্য তাঁরা একটি লোকদেখানো পরিকল্পনা নেন। অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর ছলে সৈনিক এবং উদ্বৃত্ত অস্ত্রসহ সামরিক সম্ভার তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যান।
পেছনে রেখে যান জয়দেবপুরে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) ডেল্টা কোম্পানি, গাজীপুরে মেজর আমজাদ লতিফের ব্র্যাভো কোম্পানি এবং রাজেন্দ্রপুরে আলফা কোম্পানির একটি প্ল্যাটুন। রাতে ময়মনসিংহে গিয়ে আবার একত্র হওয়ার জন্য রেখে যাওয়া সৈন্যদের গোপন নির্দেশ দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহে পাকিস্তানি সেনারা পরাস্ত
ময়মনসিংহের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) শাখার বাঙালি সেনারা এই দিন বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। আগের দিন সহকারী উইং কমান্ডার পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কামার আব্বাস বাঙালি সেনাদের বিশ্রাম করার নির্দেশ দিয়ে সব পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালি সেনাদের দায়িত্ব দেন। এটি বাঙালি সেনাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। তারা অস্ত্র জমা না দিয়েই ব্যারাকে ঘুমাতে যান।
গভীর রাতে, ঘড়ির কাঁটায় যখন ২৮ মার্চ, পাকিস্তানি ও অবাঙালি সেনারা নিঃশব্দে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সদর দপ্তরের ছাদে নিয়ে এসে জড়ো করে এবং যানবাহনের হেডলাইট বাঙালিদের ব্যারাকের দিকে মুখ করে রাখে। মাঝরাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাতে একসঙ্গে অস্ত্র গর্জে ওঠে।
বাঙালি সেনারা আগে থেকেই অস্ত্র নিয়ে ছিল সতর্ক অবস্থায় ছিল। দ্রুত অবস্থান নিয়ে তারাও প্রত্যুত্তর দেয়। দুই পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। রাত পেরিয়ে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে। বাঙালি সেনাদের অদম্য সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনাদের ছয়জন আটক ও বাকিরা নিহত হয়।
পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে: ভুট্টো
ঢাকা থেকে করাচি বিমানবন্দরে নেমে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আল্লার মেহেরবানীতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। এর বেশি কিছু এখন তিনি বলবেন না। পিপিপির করাচির দপ্তরে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন। পিপিপির অন্য সদস্যরাও ভুট্টোর সঙ্গে করাচি ফেরেন।
পিপিপির করাচির দপ্তরে সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন ফ্যাসিস্ট ও বর্ণবৈষম্যবাদী সরকার কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
২৯ মার্চ ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে স্থানান্তর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা হয়েছিল ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে। বস্তুত তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় তাঁকে সেনানিবাস থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে এনে রাতে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রতিরোধযুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে এসে দিনভর মেডিকেল কলেজ এবং আশেপাশের পাহাড়ে সমবেত হয়ে সন্ধ্যায় আক্রমণ শুরু করে। ইপিআর সেনাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী সে আক্রমণ প্রতিহত করে।
পাবনায় ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একদল পাকিস্তান সেনাকে আক্রমণ করে। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইশফাকসহ ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা তাতে নিহত হয়। জীবিতরা রাজশাহীর দিকে যাওয়ার পথে জনতার হাতে প্রাণ হারায়।
লালমনিরহাটে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআর সেনাদের মধ্যে যুদ্ধে লুৎফর রহমান শহীদ হন।
সুনামগঞ্জে ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। যুদ্ধে ইপিআর সেনা আবদুল হালিম পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে শহীদ হন।
প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে আটক প্রায় ১০০ জন বাঙালি ইপিআর সদস্যকে তিন ভাগে রাতের বেলা রমনা কালীবাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের হত্যা করে।
যুক্তরাজ্যের কমন্সসভায় বিতর্ক
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় এই দিন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। দেশটির পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম সেখানে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলেন, কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে এবং স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশায় আশা করি, হাউজের সবাই পাকিস্তানের প্রাণহানির জন্য আমার সঙ্গে দুঃখ প্রকাশে একাত্মতা জানাবেন।
ময়মনসিংহে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের শপথ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর কে এম সফিউল্লার নেতৃত্বে ২৮ মার্চ জয়দেবপুরে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা দেয়। ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা টাউন হলে এক সমাবেশে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন।
সকালে ময়মনসিংহের রাবেয়া মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে ইপিআর বাহিনী এবং হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
দিনাজপুরে ইপিআরের বিদ্রোহ
রাতে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের বাঙালি ইপিআররা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। বিদ্রোহে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ এম আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, কুঠিবাড়িতে দিনাজপুরে ইপিআর সেক্টরের অবাঙালি কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কোরেশি। ২৯ মার্চ আবদুর রহিম কয়েকজন বাঙালি ইপিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। যোগাযোগের পরে বিদ্রোহ করে। তারা গোলাগুলি শুরু করলে পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা পাল্টা হামলা চালায়। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা এর পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে। বিদ্রোহে তাঁদের নেতৃত্ব দেন ইপিআর বাহিনীর প্রবীণ বাঙালি সুবেদার মেজর এ রব।
রাতের অন্ধকারে সেখানকার সার্কিট হাউস থেকে পাকিস্তানি সেনারাও পালিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়।

৩০ মার্চ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানিদের বোমাবর্ষণ

৩০ মার্চ রাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ওপর বোমা বর্ষণ করে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা নিরাপদ স্থানে চলে যান। সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও পিছু হটে যান। বোমা বর্ষণের আগে সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে আবারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবেদন জানানো হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর কামান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে। রাতে নগরীর আশপাশে ছত্রী সেনা নামায়। ভোর পর্যন্ত ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।
বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে এই দিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনী দেশজুড়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করছে।
বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন
২৭ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে বের করে দিলেও কৌশলে থেকে গিয়েছিলেন ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং। তিনি ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাদের হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ দেখতে পান। ব্যাংককে গিয়েই তিনি তা নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী প্রথম বিশদভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা সম্পর্কে জানতে পারে। প্রতিবেদনটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তানে ট্যাংক আক্রমণ: ৭,০০০ নিহত, ঘরবাড়ি ভস্মীভূত’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা এখন ধ্বংস ও আতঙ্কের নগরী। ২৩ ঘণ্টা ধরে অবিরাম শেল বর্ষণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় সাত হাজারের বেশি লোক হত্যা করেছে। সেনা অভিযানে ঢাকাসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে।
সাইমন ড্রিং লেখেন, হাজার হাজার লোক শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে, ঢাকার রাস্তাঘাট জনশূন্য। প্রদেশটির বিভিন্ন অংশে নিধনযজ্ঞ চলছে। সেনাবাহিনীই প্রধান জনপদগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সেনাবাহিনী এখনো গুলি চালাচ্ছে এবং নির্বিচারে দালানকোঠা ধ্বংস করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়ায় যুদ্ধ
চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালি সেনাকর্মকর্তা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। কুষ্টিয়ায় অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাদলকে আক্রমণের জন্য ২৭ মার্চ ইপিআরের ফিলিপনগর কোম্পানি কুষ্টিয়া শহরের সুনির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়েছিল। দলটির নেতা ছিলেন বাঙালি সুবেদার মুজাফফর আহমেদ (পরে অনারারি লেফটেন্যান্ট)।
২৮ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যে সীমান্তে নিয়োজিত ইপিআরের সব কোম্পানি সমবেত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। একটি কোম্পানি সেনা ঝিনাইদহে যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল। আরেক কোম্পানি সেনা বিকেলে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে পোড়াদহে যায়। পরিকল্পনা ছিল, আক্রমণ হবে একই সময়ে তিন দিক থেকে। আক্রমণের সময় ছিল ২৯ মার্চ ভোর চারটা। সব আয়োজন শেষ হওয়ার পরও পরিকল্পনা পাল্টিয়ে আক্রমণের নতুন সময় স্থির করা হয় ৩০ মার্চ ভোর চারটা।
৩০ মার্চ ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা হতচকিত হয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশ লাইনস ও ওয়্যারলেস কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে জেলা স্কুলের দিকে তাদের সদর দপ্তরে পালিয়ে যায়। কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
জেলা স্কুল এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া গোটা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
যশোরে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অর্ধেক বাঙালি সেনা মহড়া শেষে ২৯ মার্চ গভীর রাতে যশোর সেনানিবাসে ফিরেছিল। বাকি অর্ধেক ছিল ছুটিতে। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) এবং লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন (বীর উত্তম) ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পাকিস্তানি। প্রত্যন্ত সীমান্ত অঞ্চলে মহড়ায় থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর তারা পাননি।
সেনানিবাসে ফেরার পর ৩০ মার্চ তাঁদের প্রায় নিরস্ত্র করা হয়। তাঁরা লক্ষ্য করেন, নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের ঘিরে রেখেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনারা। তাঁদের বুঝতে বাকি থাকে না, কী ঘটতে চলেছে। রেজাউল জলিল কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে বাঙালি সেনারা হাফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। তারা অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে আসে। এই সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ বহু বাঙালি সেনা শহীদ ও আহত হয়। আর প্রায় ২০০ জন বাঙালি সেনা বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিপর্যয়
উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দিন বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ব্যাটালিয়নের তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক সরকার তখন ছিলেন দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটে।
রফিক সরকার একদিন আগে জানতে পেরেছিলেন, ৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সামরিক কনভয় রংপুর থেকে বগুড়ার উদ্দেশে যাত্রা করবে। তিনি এক প্লাটুন সেনা নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে বেলা ৩টার দিকে কনভয়টিকে অ্যামবুশ করেন।
দুই পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। রফিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। পাকিস্তানিরা তাঁকে রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর ১ এপ্রিল তাঁকে হত্যা করে।
সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সিরাজুল ইসলামকে রংপুর সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়। ৩০ মার্চ রংপুর সেনানিবাসে পৌঁছানোমাত্র ১০ জন বাঙালি সৈনিকসহ তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এত বিপর্যয়ের পরেও এই দিন দিবাগত রাতে তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের (বীর প্রতীক, স্বাধীনতার পর মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
মার্চ ৩১ : তাজউদ্দীন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে ৩০ মার্চ সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে থেকে তাঁরা স্থানীয় বিএসএফের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে একটি বার্তা পাঠান।
বার্তায় তাঁরা জানান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতা হিসেবে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার করার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করতে রাজি আছেন।
বার্তা পাঠানোর পর ঘণ্টা কয়েক পর স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার এসে তাঁদের বিএসএফের ছাউনিতে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যান কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে।
গভীর রাতে তাঁরা যখন কলকাতায় গিয়ে পৌঁছান, তখন ৩১ মার্চের প্রথম প্রহর। সেখানে বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। তিনি তাঁদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামের পতন
পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের অধিকাংশ সেনানিবাস ও ছাউনি ৩১ মার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সরে যান। এই দিনটিতেও বহু জেলা ও মহকুমা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিপুল সংখ্যায় মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।
৩০ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে মুহুর্মুহু আক্রমণ করতে শুরু করে। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের তীব্র আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
ভারতের একাত্মতা ও সংহতি
দিল্লিতে লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের, ভারতের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ডের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চালানো হচ্ছে, আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা না জানিয়ে পারে না।’
বিবৃতিতে ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি জানান। এ জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সারা বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
ভারতের লোকসভা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনায় লোকসভা গভীরভাবে দুঃখিত ও উদ্বিগ্ন। ভারতের সীমানার এত কাছের ন্যক্কারজনক বিয়োগান্ত ঘটনায় লোকসভা উদাসীন থাকতে পারে না। নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চলছে, ভারতের জনগণ দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য পূর্ববঙ্গের জনগণের সূচিত সংগ্রামের প্রতি লোকসভার অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। গণহত্যার শামিল এ সুপরিকল্পিত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য লোকসভা বিশ্ববাসী ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানায়।
লোকসভা আশ্বাস দিয়ে বলে, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহৃদয় সহানুভূতি পাবে।
বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে হরতাল
বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ৩১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়। কোনো ট্রেন চলেনি। বিমানও নয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটিকে শোক দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।
সকালে ও বিকেলে অনেক মিছিল বের হয়। যুব কংগ্রেস পালন করে অনশন।
কুষ্টিয়ায় বীরত্বপূর্ণ জয়
কুষ্টিয়ায় আগের দিন শুরু হওয়া যুদ্ধ এই দিনও অব্যাহত ছিল। দিনভর যুদ্ধ শেষে জীবিত পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা ছিল ৪০-৪৫। রাতের আঁধারে তারা দুটি জিপ ও একটি গাড়িতে করে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপার সেতুর গোড়ায় গর্ত খুঁড়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তাদের প্রথম দুটি জিপ সেই গর্তে পড়ে মেজর শোয়েবসহ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। বাকিরা আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ জনতা শত্রুসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে। তাদের হাতিয়ার মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়।
রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ঝিনাইদহে পাঠানো হয়। পরদিন ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি যোদ্ধাদের প্রথম এই গুরুত্বপূর্ণ বীরত্বগাথা নিয়ে ড্যান কগিন ১৯ এপ্রিল সংখ্যা টাইম ম্যাগাজিন-এ প্রচ্ছদকাহিনি লেখেন।
যশোরের সালুয়া বাজার ও চৌগাছায় প্রতিরোধযুদ্ধ
মাছলিয়া সীমান্ত ক্যাম্পের একমাত্র বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদের নির্দেশনায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ও ইপিআর সেনারা প্রথমে সালুয়া বাজার এবং পরে চৌগাছায় যশোর সেনানিবাসের দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক তারা রাস্তাঘাট অচল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সুবেদার আহাম্মেদ উল্লাহ তাঁর দল নিয়ে যশোর-কুষ্টিয়া সড়কের হজরতপুর সেতু উড়িয়ে দেন।
কুষ্টিয়া ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক বাঙালি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে দেন। তিনি তাদের দুটি সামরিক জিপ, কয়েকটি হেভি মেশিনগান, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান এবং গোলাবারুদও জোগাড় করে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলে, ইসলামাবাদে দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, তাঁরা জানতে পেরেছেন যে মার্কিন সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের বৈধ কার্যক্রমে অসংগতভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে।
আরও দেখুনঃ
24 thoughts on “মার্চ মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ”