জুলাই মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

জুলাই মাস ১৯৭১ – সময়ে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

Table of Contents

জুলাই মাস ১৯৭১ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

“জুলাই মাস ১৯৭১ ১”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১ জুলাই ১৯৭১ : ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

 

ইয়াহিয়া খানে

 

ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা এবং লেবার পার্টির সাংসদ ও সাবেক কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রী আর্থার বটমলি ১ জুলাই দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব বাংলার জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়েই সংকটের সমাধান করতে হবে, নয়তো কোনো মীমাংসা হবে না। বটমলির বক্তব্যের সঙ্গে প্রতিনিধিদলের অন্য দুই সদস্য লেবার পার্টির সাংসদ রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস ও কনজারভেটিভ পার্টির সাংসদ টবি জেসেলও একমত পোষণ করেন।

বাংলা-দেশে ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে ভারতীয় ইন্ধনের পাকিস্তানি রটনা খারিজ করে দিয়ে বটমলি বলেন, তিনি পূর্ব বাংলার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে এসেছেন। সেটা করতে হলে ভারতীয় সেনাদের পূর্ব বাংলার অনেক গভীরে ঢুকতে হতো।

প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এই দিন কলকাতা থেকে দিল্লিতে আসেন। তাঁরা ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে দেখা করে বলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলা-দেশের অবস্থা বিপজ্জনক। দ্রুত সমাধান না হলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে।

পশ্চিম জার্মানির বিচারমন্ত্রী ড. ই হইনসেন এবং দুজন সাংসদ এস ভিউগেন সাইন ও ড. রলফ মাইন শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখার
জন্য এই দিন কলকাতায় এসে পৌঁছান। তাঁরা সরেজমিন বারাসাত, বনগাঁ ও সল্টলেক এলাকায় শরণার্থীশিবিরগুলো দেখে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে কলকাতায় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও যুব সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসব সংগঠন কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভের পর স্মারকলিপি দেয়।

লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন পরিকল্পনা পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলবে।

বাংলা-দেশের শরণার্থীদের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ৩ হাজার ৫৭৬ টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ এদিন কলকাতা বন্দরে পৌঁছায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন শরণার্থীদের জন্য ৫০ হাজার টন চাল সাহায্য করেছে।

মুজিবনগর থেকে বিবৃতি

বাংলা-দেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মুজিবনগরে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলে, ইয়াহিয়া খান তাঁর সাম্প্রতিক বেতার ভাষণে গত নির্বাচনে জনসাধারণের রায়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন এবং বাংলা-দেশের ওপর গণবিরোধী সংবিধান চাপিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন স্থায়ী করে রাখতে চাচ্ছেন। তিনি যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যেতে চান, এই বেতার ভাষণে তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত।

বাংলা-দেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (সাবেক ওয়ালী ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ মুজিবনগর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্রকে শুধু হত্যাই করেননি, ভয় দেখিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

বাংলা-দেশ সরকারের কূটনীতিক প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন, সামরিক জান্তাকে সাহায্য প্রদান ইসলামাবাদের জঘন্য কার্যকলাপকে সরাসরি প্ররোচনা দেওয়ারই শামিল হবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানান।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন চট্টগ্রামের দেবীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন শহীদ হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার দক্ষিণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

২ জুলাই ১৯৭১ : পাকিস্তান করতে পারেনি বাংলা-দেশের জনগণের শক্তি ও দৃঢ়তা উপলব্ধি

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ২ জুলাই দিল্লিতে এক বৈঠকে বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতিটি বাংলা-দেশের জন্য পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছে। তিনিই বাংলা-দেশকে পৃথক করে দিচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানের দেওয়া বক্তব্য বাংলা-দেশের জনগণ নাকচ করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা-দেশের জনগণের শক্তি ও দৃঢ়তা উপলব্ধি করতে পারেনি।

ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে এদিন তুমুল বিতর্ক হয়। বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠলেও সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমান অবস্থায় বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া বিজ্ঞোচিত কাজ হবে না। বিতর্কে অংশ নেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, ভারত সরকার বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী নয়। উপযুক্ত সময় হলে বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে ভারত।

ভারত সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে যাওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ২ জুলাই দেখা করে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা শেষে বেরিয়ে দলনেতা আর্থার বটমলি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার ব্যাপারটি তিনি অনুমোদন করেন না।

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের ভারত সফর সামনে রেখে সিপিআই নেতা হীরেন মুখোপাধ্যায় এদিন এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বলে আবেদন জানান যে ভারত সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিক, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্য বন্ধ না হলে কিসিঞ্জারের ভারত সফরও অনভিপ্রেত বলে বিবেচিত হবে।

ওয়ালি খানের সমালোচনা পাকিস্তানে

পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ওয়ালি) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর সম্পর্কে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে দলের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এই ভ্রমণের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন কোয়েটায় বলেন, তাঁর দল পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে অন্য দলের সাহায্য ছাড়াই এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে কোয়ালিশন সরকার গড়তে পারবে।

আফগানিস্তানে অবস্থানকারী সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান সর্বোদয় সাধনা পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান শাসনের একমাত্র লক্ষ্য পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ও আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। তিনি বলেন, বাংলা-দেশের জনগণের একমাত্র অপরাধ, তাঁরা বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।

সংবিধান তৈরি করবে বাংলা-দেশ সরকার

আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এদিন মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ইয়াহিয়া খানের বাহিনী বাংলা-দেশ থেকে অপসারিত হলে বাংলা-দেশের প্রজাতন্ত্রী সরকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার মতো সংবিধান তৈরি করবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাতুমুড়ায় অতর্কিত আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।

চাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল মতলব থানা আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি অনুগত পুলিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানি রেঞ্জার হতাহত হয়। সংঘর্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।

সুনামগঞ্জ শহরের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ চালায়। অতর্কিত এই আক্রমণে পাকিস্তানি টহল দলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

রাজনৈতিক সমাধান জরুরি

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী জেনো ফক ২ জুলাই দেশটির পার্লামেন্টে বলেন, বাংলা-দেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সব মানুষ এবং সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর চার্লস এথিয়ান ও সিনেটর বেডফোর্ড মোর্সে পাকিস্তানে নতুন করে সমরাস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স প্রদান বন্ধ এবং মঞ্জুরিকৃত লাইসেন্স বাতিলের জন্য দেশটির সিনেট ও কংগ্রেসে প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

৩ জুলাই ১৯৭১ : বাংলা-দেশের জন্য সংগীতানুষ্ঠান কলকাতায়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় ৩ জুলাই থেকে বাংলা-দেশের সাহায্যার্থে দুই দিনব্যাপী সংগীতানুষ্ঠান শুরু হয়। বাদল সত্ত্বেও রবীন্দ্রসদনের এই অনুষ্ঠানে অসংখ্য শ্রোতা আসেন। বাংলা-দেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সুচিত্রা মিত্র। তিনি বাংলা-দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।

সমিতির অন্যতম সম্পাদক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন। দুই বাংলার শিল্পীদের পরিবেশিত রবীন্দ্র, নজরুল ও অতুলপ্রসাদের গান এবং লোকসংগীত শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানে সন্‌জীদা খাতুনের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তী কবিদের রচনার ভিত্তিতে রূপান্তরের গান পরিবেশিত হয়। এসব গানের ভেতর দিয়ে ১৯৪৭ থেকে পূর্ব পাকিস্তান কীভাবে ১৯৭১ সালে দুর্জয় বাংলা-দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, তার ইতিহাস তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাসও তিনটি গান পরিবেশন করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লক্ষ্ণৌয়ে শাসক দল নব কংগ্রেসের দুদিনব্যাপী অধিবেশনের প্রথম দিনে বক্তৃতাকালে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলা-দেশ সংকট আন্তর্জাতিক সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। শরণার্থীরা দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলা-দেশ সমস্যার সমাধান হয়েছে বলা যাবে না।

ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ি উদয়পুরে দলের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সাফল্যের জন্য সব ধরনের সাহায্য দেওয়া ভিন্ন ভারতের গত্যন্তর নেই। এর জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সে জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জানা গেছে শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ। ভারত ও বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলোর উচিত তাদের প্রতিনিধিদের শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের কাছে দাবি করা।

অবরুদ্ধ বাংলা-দেশ ও ভারত সফর শেষে লন্ডনে ফিরে ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ও সাবেক কমনওয়েলথমন্ত্রী আর্থার বটমলি বলেন, বাংলা-দেশের ঘটনার জন্য টিক্কা খান সম্পূর্ণত দায়ী। অন্য সদস্য রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস বলেন, সেখানে সমস্যার সামরিক সমাধানের চেষ্টা মারাত্মক ভুল হয়েছে।

ভারত সফররত পশ্চিম জার্মানির তিন সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধিদল বাংলা-দেশের শরণার্থীদের দেখে কলকাতায় ফিরে আসেন। দলের সদস্য ড. সাইন ভিহগেনস্টাইন সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের প্রকৃত পন্থা বা সমাধান নয়। জার্মানির মতামত বরাবরই জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পক্ষে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজশাহী শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে চোরাগোপ্তা হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

কুষ্টিয়া জেলার মহিষাকুণ্ডিতে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়। অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার ছোড়া বোমায় চুয়াডাঙ্গা থানা ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সিরিয়া–ইরান–গাম্বিয়া পাকিস্তানের পাশে

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল–আসাদ ও গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্যার দাউদা জাওয়ারা পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানান। ইরানের রাজধানী তেহরানে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাহেদি পাকিস্তানি সাংবাদিককে বলেন, ইরান পাকিস্তানের আপদকালে সব সময় পাশে থাকবে।

লন্ডনের রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটির সুযোগ–সুবিধা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে পাকিস্তান ৩ জুলাই সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে সোসাইটির সহসভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। পাকিস্তান হাইকমিশনের এক মুখপাত্র বলেন, রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটি ব্রিটেনের রানির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এর সহসভাপতিদের মধ্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথমন্ত্রীও রয়েছেন। সোসাইটির কার্যকলাপে ব্রিটেনের সরকারি নীতির প্রভাব উল্লেখযোগ্য।

৪ জুলাই ১৯৭১ : সংকটপূর্ণ দিন পাকিস্তানের সামনে

 

আটকের পর ছবি প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর
বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ আটকের পর (১২ এপ্রিল ১৯৭১)

 

তেহেরিক ইশতিকলাল পার্টির আহ্বায়ক এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান অবরুদ্ধ বাংলা-দেশে এক সপ্তাহের সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে দীর্ঘ এক বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে এখন কে সরকার গঠন করবে, সেটি বড় সমস্যা নয়; সমস্যা হচ্ছে দেশে আদৌ গণতন্ত্র টিকে থাকবে কি না এবং আসলেই কোনো সরকার গঠন করা যাবে কি না। সরকারকে জনগণের ন্যায্য দাবিদাওয়া অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে আগামী তিনটি মাস অত্যন্ত ক্রান্তিকাল ও সংকটপূর্ণ।

৪ জুলাই পাকিস্তান যুক্তরাজ্যের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, রেডিও ও সংবাদপত্রে বাংলা-দেশের পক্ষে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদলিপিতে তারা ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, লন্ডনে বাংলা-দেশ অ্যাকশন কমিটির মাধ্যমে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে দায়িত্বপূর্ণ ব্রিটিশ নাগরিক ও বাঙালিরা কার্যকলাপ চালাচ্ছে। বাংলা-দেশে পাঠানোর জন্য যুক্তরাজ্যে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে।

প্রতিবাদলিপিতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের ২৩ জুনের বিবৃতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়। ডগলাস হোম বিবৃতিতে বলেছিলেন, রাজনৈতিক সমাধানের দিকে প্রকৃত উন্নতির জোরালো প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন করে কোনো ব্রিটিশ সাহায্য দেওয়া হবে না।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

অবরুদ্ধ বাংলা-দেশের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল ফেনী থেকে বেলুনিয়া যাওয়ার পথে শালদাবাজারে সাময়িক অবস্থান নেয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দল পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।

কুমিল্লার কোটেশ্বরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। দু-তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। তাদের বেশ ক্ষতিও হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরে মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর কাঞ্চন সেতু ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টা তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। পঞ্চগড়ের আট মাইল উত্তরে অমরখানায় পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্তঘাঁটির ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। দুই পক্ষে তীব্র যুদ্ধ হয়।

ঠাকুরগাঁওয়ের ১৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ছোট ক্যাম্পের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালান। এ ছাড়া রংপুরের গড্ডিমারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

বাংলা-দেশের সমর্থনে গণসত্যাগ্রহ

ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি অটলবিহারি বাজপেয়ি উদয়পুর দলের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বাংলা-দেশ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে ঘোষণা দেন, বাংলা-দেশকে স্বীকৃতি এবং স্বাধীন বাংলা-দেশ সরকারকে সামরিক সাহায্যসহ সব রকম সাহায্য দিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য জনসংঘ ১ আগস্ট থেকে দিল্লিতে গণসত্যাগ্রহ শুরু করবে।

বাজপেয়ি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলা-দেশকে যুক্ত করার দাবি জানানো তাঁদের অভিপ্রায় নয়। তবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অনুসারীরা যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা খুশি হবেন। কারণ, তাঁরা অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেন। তবে বাংলা-দেশের ভবিষ্যৎ সম্পকে৴ সেখানকার জনগণই সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁরা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই থাকতে চাইলে তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা হবে।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সভাপতিত্বে দিল্লিতে বাংলাদেশের অনুকূলে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিশ্বের নানা স্থানের ১২০ জনকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল এবং বাংলাদেশের কয়েকজন নেতা এ সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে জানানো হয়।

ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সাংসদ ও প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের নেতা সমর গুহ কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অবিলম্বে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দিলে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে অবাঞ্ছিত যুদ্ধ এড়াতে পারবে এবং বিশ্বের অনেক দেশই তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এতে বাংলাদেশের মানুষের মনোবল বাড়বে এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিজ শক্তিতেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেন।

আগরতলায় বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত শরণার্থী একাদশ দল ত্রিপুরা একাদশের সঙ্গে ফুটবল খেলায় অবতীর্ণ হয়। আসাম রাইফেলস মাঠে অনুষ্ঠিত এ খেলায় বাংলাদেশ ১-২ গোলে হেরে যায়। শরণার্থী একাদশের অধিনায়ক ছিলেন মোহামেডানের কায়কোবাদ। অন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মোহামেডানের আইনুল, ভিক্টোরিয়ার এনায়েত ও নওশের, ওয়াপদার সুভাষ, দিলকুশার নিহার, ফায়ার সার্ভিসের সীতাংশু, চট্টগ্রাম রেলওয়ের বিমল, ওয়ারীর অমল, কুমিল্লা মোহামেডানের তপন ও মন্টু এবং নরসিংদীর মাহমুদ। খেলার টিকিট থেকে প্রাপ্ত অর্থ মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দেওয়া হয়।

৫ জুলাই ১৯৭১ : গণপ্রতিনিধিদের বৈঠক মুজিবনগরে

মুজিবনগরে ৫ জুলাই বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের অধিবেশন শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন। দিনভর তাঁরা পূর্বনির্ধারিত কার্যসূচি নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করেন। অধিবেশনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা যোগ দেন।

মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করেন। কয়েকটি জায়গায় বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ময়মনসিংহের ভালুকার ভাউলিয়াবাজুর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। নেত্রকোনা জেলার নাজিরপুর বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাজমুল হক, জামাল উদ্দিনসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ছাড়া কুমিল্লার মনোরা সেতু এলাকায় এবং সুনামগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

চাপ দিয়ে সিদ্ধান্ত নয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে শাসক দল নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কর্মপরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, যথাযথ সময় বুঝেই তাঁর সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। ভারত একেবারেই এটা চায় না, কেউ দোষারোপ করুক যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে।

কর্মপরিষদে এদিনের আলোচনায় মনোভাবের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রায় সবাই বলেন, এখনই এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির লড়াই সে দেশের জনগণকেই চালাতে হবে। তবে তাদের সমর্থনে জনমত সংগঠনে ভারতকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যেতে হবে। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যাশিত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ভারত সরকার কোনো সাড়া পাচ্ছে না। তবে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং অন্যান্য পদক্ষেপও নেওয়া হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, একজন ব্রিটিশ এমপি সুপারিশ করেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধে অপরাধী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হোক।

ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পেগভ দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করে জানান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্রশস্ত্র বা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেনি।

সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনের পর কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্যাপারে দলের নীতির ব্যাখ্যা করা হয়। নীতি ব্যাখ্যা করেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু ও হরেকৃষ্ণ কোঙার। তাঁরা বলেন, সিপিএম বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। তবে সিপিএম চায় ভারত সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের সব শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সাহায্য দিক।

বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর গণহত্যার বিচারে কলকাতায় জনতার অভিনব গণ-আদালত বসে। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার ২০টি গুরুত্বপূর্ণ পথের মোড়ে একই সঙ্গে এই বিচারসভা বসে। এর আয়োজন করে ভারতের শাসক দল নব কংগ্রেসের কলকাতা কমিটি। আদালত ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডিত করে এবং অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি করে। এই রায় ঘোষণার পর বিচারক আরেকটি রায় ঘোষণা করে বলেন, ঘুমন্ত বিশ্ববিবেকের পরিবর্তে নতুন বিশ্ববিবেকের জন্ম হবে। এরপর আদালত ঘুমন্ত বিশ্ববিবেককে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেন। রায় ঘোষণা মাত্র ঘুমন্ত বিশ্ববিবেকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

লন্ডনে ২১ জুন যুক্তরাজ্য ও ভারতের যুক্ত বিবৃতির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে পাকিস্তান ইসলামাবাদে ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি নোট দেয়। নোটে উল্লেখ করা হয়, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজস্ব পছন্দমতো একটি রাজনৈতিক সমাধান চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সে বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যও ভারতীয় ফর্মুলাকেই সমর্থন জানিয়েছে। এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অযথা হস্তক্ষেপ। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া পাকিস্তানের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাক-ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিদৃষ্টে তিনি চিন্তিত। ভারতীয় হুমকি থেকে থাকলে দেশের বর্তমান সংকট অবস্থার সমাধানকল্পে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছেই দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়া উচিত।

৬ জুলাই ১৯৭১ : হেনরি কিসিঞ্জার বিক্ষোভের মুখে

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো অ্যাগ্নিউ এবং প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ৬ জুলাই ভারতে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। হেনরি কিসিঞ্জার দুই দিনের ভারত সফরে এদিন দিল্লিতে আসেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা শেষে পাকিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এসেছিলেন। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি কালো পতাকাধারী সমবেত মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে পড়েন।

প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিলেন। কিসিঞ্জার বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আসামাত্র তারা স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘মৃত্যুর কারবারি কিসিঞ্জার, ফিরে যাও, ফিরে যাও’, ‘পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো, বন্ধ করো, বন্ধ করো’। পথের দুই পাশে পথচারীরাও এই ধ্বনি তোলে। এ বিক্ষোভের আয়োজন করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।

কুয়েত যাওয়ার পথে মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেছিলেন স্পিরো অ্যাগ্নিউ। তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছালে প্রায় দুই হাজার লোক জড়ো হয়ে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ডক ও বন্দর শ্রমিক, সিপিআই, পিএসপি ও এসএসসি প্রভৃতি সংগঠন সম্মিলিতভাবে এ বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন নিখিল ভারত বন্দর ও ডক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এস আর কুলকার্নি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে বিমানবন্দরের দিকে এগোলে ১০০ মিটার দূরেই পুলিশ তাদের গতিরোধ করে।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া স্পষ্ট করে জানিয়েছে, ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানকে তারা কোনো অস্ত্র দেয়নি, আর দেবেও না। তিনি বলেন, ফরাসি সরকার জানিয়েছে পাকিস্তান বাংলাদেশে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর তারা পাকিস্তানের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে নতুন কোনো চুক্তি করেনি। পুরোনো চুক্তিমতো অস্ত্র পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন জানিয়েছে, তারাও ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্র দেয়নি। তবে চীন, ইরান ও তুরস্ক পাকিস্তানকে প্রচুর অস্ত্র দিয়েছে।

ভারত সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য অ্যান্ড্রু ব্রেউইন, হিথ নেলসন ম্যাককোয়ারি ও রজেস লেচনাস দিল্লিতে বলেন, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়া তাঁরা সমর্থন করেন না। বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা সবার জন্যই উদ্বেগজনক।

৪ জুলাই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে সরকারের পক্ষে ওই দেশকে অস্ত্র সাহায্যসহ নানাভাবে সাহায্য করার সুবিধা হবে। প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে আরও বলা হয়, সিপিআই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। সশস্ত্র আক্রমণ ছাড়াই বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা।

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির বৈদেশিক বিষয়সমূহের মুখপাত্র কোনারড কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশের ঘটনাকে মানবতার চরম বিপর্যয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের জরুরি অধিবেশন ডাকার দাবি জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য এ অধিবেশন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে বিপদ আরও ঘনিয়ে আসবে।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে পরিষদ ভারতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন দেশের জাতীয় কমিটির সদস্যদের নিয়ে এই প্রতিনিধিদল গঠন করা হবে। নিজ নিজ দেশে সংহতি আন্দোলন জোরদার করার জন্য তারা ভারতে এসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখবে।

ভারত সরকার জানায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারজন বাঙালি কর্মকর্তা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ছামর অঞ্চলে এসে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁদের একজন মেজর ও তিনজন ক্যাপ্টেন। তাঁরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য মুজিবনগরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো দলের পাঁচ সদস্য নিয়ে এদিন করাচি থেকে ইরানের রাজধানী তেহরানে যান।

পাকিস্তানের প্রতিবাদ যুক্তরাজ্যের অগ্রাহ্য

ব্রিটেনের সরকারি সূত্র জানায়, কমন্সসভা, সংবাদপত্র, বিবিসি ও অন্য প্রচারমাধ্যমে পাকিস্তানের সমালোচনা হওয়ায় দেশটি এর প্রতিবাদ করে। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের এই প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করবে। তারা পাকিস্তানকে জানিয়ে দেবে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অবাধ মতামত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার অবস্থান থেকে সরে আসার সম্ভাবনাও তাদের নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চালর্স ব্রে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পাকিস্তান বিগত শরতে তাদের কাছে বেশ কিছু বি–৫৭ বোমারু বিমান চেয়েছিল, কিন্তু কোনো বিমান সরবরাহ করা হয়নি।

 

৭ জুলাই ১৯৭১ : মুক্তি এখন যুদ্ধে, আর আলোচনায় নয়

একাত্তরের ৭ জুলাই ছিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের বৈঠকের সমাপনী দিন। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এদিন বলেন, পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোনো প্রস্তাব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার, সব সৈন্য প্রত্যাহার করার এবং যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চারটি শর্ত তাঁরা দিয়েছিলেন। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খান যে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, তাতে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কূলে যুদ্ধের মাধ্যমে।

বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ, ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা বৈঠকে স্থির করেছেন, মুক্তিসেনাদের আক্রমণ আরও জোরদার করা হবে। যতটা সম্ভব বর্ষার আগেই এলাকা থেকে মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। একেক মুক্ত এলাকার দায়িত্ব নেবেন একেক গণপ্রতিনিধি। এলাকায় থেকেই তাঁরা সবকিছু পরিচালনা করবেন।

ফ্রান্সের পাকিস্তান দূতাবাসের দুই বাঙালি কূটনীতিক মোশাররফ হোসেন ও শওকত আলী এদিন ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাতে এক বেতার সাক্ষাৎকারে তাঁরা বলেন, দূতাবাসে তাঁদের দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাঁদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করা হচ্ছিল।

সাহায্য দেবে না পশ্চিম জার্মানি

পশ্চিম জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী ড. ব্রাহার্ড এপলার এক বেতার সাক্ষাৎকারে বলেন, সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শর্ত না মানলে তাঁর দেশ পাকিস্তানকে আর উন্নয়ন সাহায্য দেবে না। নানা শর্তের মধ্যে একটি ছিল সব পক্ষের জন্য সন্তোষজনক পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের একটি রাজনৈতিক মীমাংসা।

টাইমস পত্রিকায় বিদেশে প্রচারিত বাংলাদেশে চলমান নৃশংসতার কাহিনি প্রত্যাখ্যান করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলীর একটি দীর্ঘ পত্র প্রকাশিত হয়। বুদ্ধিজীবীদের গণহারে হত্যার সত্যতা অস্বীকার করে তাঁরা বলেন, গত ২৫-২৬ মার্চ ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলের আশপাশের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র নয়জন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। যে ভবনে তাঁরা বাস করতেন, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সশস্ত্র ব্যক্তিরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে ওই ভবনগুলো ব্যবহার না করলে তাঁরা নিহত হতেন না।

পাকিস্তান ডেমেক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এদিন লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধ মোকাবিলায় জনমত সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে জনসভা করার অনুমতি দেওয়া উচিত। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশা করেন।

ইন্দিরা-কিসিঞ্জার বৈঠক

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধী কিসিঞ্জারকে বলেন, বাংলাদেশে এমন মীমাংসা দরকার, যাতে শরণার্থীদের এই বিশ্বাস জন্মায় যে ফিরে গেলে সেখানে তাঁদের জীবন ও স্বাধীনতা নিরাপদ। নইলে শরণার্থীরা ফিরে যাবে না। কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিক্সনের একটি চিঠি দেন।

হেনরি কিসিঞ্জার এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও পরিকল্পনামন্ত্রী সুব্রাহ্মনিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশ সংকটের কারণে উদ্ভূত ঘটনা থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ নিয়ে তাঁরা কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করেন।

ভারত সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদের তিন সদস্যের সবাই কলকাতায় রাজভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে মন্তব্য করেন, পূর্ব পাকিস্তান নামে আর কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে বলে তাঁদের মনে হয় না। বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। তিন প্রতিনিধিই জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে সিপিআই নেতা ভুপেন গুপ্ত এবং নব কংগ্রেস সদস্য শশিভূষণের নেতৃত্বে ২০ জন সাংসদ দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের সমর্থনে স্লোগান দেন এবং দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি জমা দেন।

৮ জুলাই ১৯৭১ : ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার রুদ্ধদ্বার বৈঠক

 

তাজউদ্দীনের আহ্বান

 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ৮ জুলাই ভারত থেকে পাকিস্তানে পৌঁছেই সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ ও পররাষ্ট্রসচিব এস এস খানের সঙ্গেও আলোচনা করেন।

মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য এবং ডেমোক্রেটিক সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এদিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্ত্র পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে অস্বীকার করেছেন। নিক্সন প্রশাসন দক্ষিণ ভিয়েতনামে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে নয়। চার্চ আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছেন। অথচ এই ইয়াহিয়ার জন্যই ভারতে ৬৫ লাখ শরণার্থী গেছে এবং ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রেও সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, নতুন লাইসেন্সের চুক্তি নিয়ে তাঁর সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আরও সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠানো হতে পারে।

কানাডার সংসদীয় দল

ভারতে সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের বলেন, এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। বিষয়টি শুধু কানাডায় নয়, বিশ্ববাসী, বিশেষ করে কমনওয়েলথ দেশগুলোর কাছে তাঁরা তুলে ধরবেন।

প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। তাঁরা যেসব শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন, সবখানেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়ার বিরুদ্ধে শরণার্থীরা স্লোগান দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য কানাডা সরকারের হস্তক্ষেপ চান।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করেনি। আর্থিক সাহায্যও বিবেচনাধীন।

ইন্দো-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং ভাইস কনসালকে একটি স্মারকলিপি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দুটি কুশপুত্তলিকাও দাহ করা হয়।

মালন শরণার্থীশিবির কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে কলেরায় এক হাজার শরণার্থী মারা গেছে এবং দৈনিক গড়ে প্রায় ৪০০ জন কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ হলে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মযহারুল ইসলাম দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদারদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্ব উগ্রপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত যেভাবে সাহায্য করছে, সে জন্য তিনি ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক বিভাগ এক বিবৃতিতে ফ্রান্সের পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন বাঙালি কর্মীর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানায়। দুই বাঙালি কর্মী মোশাররফ হোসেন ও শওকত আলীকে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফরাসি সরকারের কাছে আবেদনও জানানো হয়।

বাংলাদেশ সরকারের দিল্লির কূটনৈতিক প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন এক বিবৃতিতে ফ্রান্সের পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন বাঙালি কূটনীতিক ফ্রান্সের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করায় তাঁদের অভিনন্দন জানান।

ভুট্টোর তৎপরতা

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরানের রাজধানী তেহরানে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ সংগত নয়। শরণার্থীসহ যাবতীয় সংকট সমাধানের জন্য দেশে বেসামরিক শাসনব্যবস্থা অপরিহার্য। বেআইনিঘোষিত আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পিপিপির নেতা হিসেবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি সম্মত নন।

পিপিপির তথ্য সম্পাদক মাওলানা কাওসার নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, ভোট গ্রহণ নিশ্চিতভাবে সুষ্ঠু হলে পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে তাঁরা অংশ নেবেন। পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা পাবে বলে তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস।

৯ জুলাই ১৯৭১ :  রহস্যময় অসুস্থতা হেনরি কিসিঞ্জারের

পাকিস্তান সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার ৯ জুলাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। জানানো হয়, বিশ্রাম নিতে সকালে তিনি নাথিয়াগলি গেছেন। তাঁর অবশিষ্ট সফরসূচি বাতিল করা হয়। পরে জানা যায়, তিনি নাথিয়াগলি থেকে কঠোর গোপনীয়তায় এক দিনের সফরে চীনের রাজধানী বেইজিং গেছেন। চীন থেকে ফিরে নির্ধারিত সময়ের ২৪ ঘণ্টা পর তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করেন।

বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেনারেল ইয়াহিয়াকে সামরিক অস্ত্র পাচার করাই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বর্তমান নীতি। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন আশা করে, এতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গোলামাল মিটে যাওয়ার পর ব্যাপকভাবে পাকিস্তানের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান বর্তমানে তার প্রয়োজনের বেশির ভাগ অস্ত্র পাচ্ছে চীন থেকে। চীনের ওপর পাকিস্তানের এই নির্ভরতা যাতে স্থায়ী রূপ না নেয়, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার তৎপর। পাকিস্তানকে সামরিক ও অন্য সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে হেনরি কিসিঞ্জার ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে।

১০ জুলাই ১৯৭১ : পাকিস্তানের একমাত্র সমাধান বিভক্তিই একমাত্র সমাধান

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প অটোয়ার গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে ১০ জুলাই বলেন, পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মনে হলেও, সেটাই বাংলাদেশ সংকটের একমাত্র সমাধানের পথ। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য কানাডা সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কিছু সৎ মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল।

মিচেল শার্প বলেন, তাঁর মতে পাকিস্তানে সম্পূর্ণ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সর্বাপেক্ষা উত্তম সমাধান। তিনি লেখেন, জাতিসংঘের সনদের আওতার বাইরে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁর দেশ সজাগ দৃষ্টি রেখেছে।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট এই দিন যুক্তরাজ্যের লিস্টারে ৭৭ স্টার্লিং পাউন্ডে বিক্রি হয়। ভারতীয় ক্রিকেট দল এখানে খেলতে এলে লর্ড বিশপের তহবিল এই র‌্যাফলটির ব্যবস্থা করে। খেলার প্রথম দিন দশর্কদের মধ্যে র‌্যাফলের টিকিট বিক্রি করেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, আবিদ আলী, বিষেণ সিং বেদী, কেনিয়া জয়ন্তীলাল ও সৈয়দ কিরমানি।

পশ্চিম পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন–এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে পত্র বিনিময়টি যুক্তরাজ্য–পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে উদ্ভূত ভুল–বোঝাবুঝির এবং তিক্ততা দূর করার একটি প্রচেষ্টা। ভারত-ব্রিটেন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও ব্রিটেনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান বিচারপতি নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেশ সফর শেষে এই দিন ঢাকায় ফেরেন। রেডক্রসের সাহায্যের ব্যাপারে আলোচনার জন্য কয়েক দিন আগে তিনি জেনেভা যান। পরে প্যারিস, স্টকহোম, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও লন্ডন সফর করে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালান।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী এলাকার ঝিকুরায় সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম) নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাবোঝাই একটি স্পিডবোট অ্যামবুশ করেন। এ হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও কুমিল্লার জল্লাদ হিসেবে পরিচিত বোখারীসহ লেফটেন্যান্ট কর্নেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন।

শালদা নদী এলাকার সাগরতলায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যায়।

ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর একদল গেরিলা ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের মোড়ে একটি টহল পুলিশের গাড়ির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।

উত্তরাঞ্চলের নওগাঁয় একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মধইল এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অতর্কিত আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

১১ জুলাই ১৯৭১ : মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের সম্মেলন

মুজিবনগরে ১১ জুলাই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীর সেক্টর অধিনায়কদের প্রথম সম্মেলন শুরু হয়। সাত দিনব্যাপী এ সম্মেলন চলে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

সভার শুরুতে সেক্টর অধিনায়কদের মধ্যে কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে নতুন নেতৃত্ব বা কমান্ড কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ওয়ার কাউন্সিলে সাতজন সামরিক সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। সেক্টর অধিনায়কদের কয়েকজন এ প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন, খালেদ মোশাররফ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং সি আর দত্ত নিরপেক্ষ থাকেন। ওয়ার কাউন্সিলের প্রস্তাবকে ওসমানী তাঁর নেতৃত্বের জন্য হুমকি মনে করে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যান। এতে সম্মেলনে কার্যক্রম কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত থাকে।

খালেদ মোশাররফ ওয়ার কাউন্সিল গঠনের বিরোধিতা করে বলেন, এই কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি থেকে অপসারণের যেকোনো প্রচেষ্টা তিনি সর্বতোভাবে প্রতিরোধ করবেন। প্রধানমন্ত্রী সভা থেকে বেরিয়ে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করানোর জন্য ওসমানীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। ওয়ার কাউন্সিলের প্রস্তাবকেরা ওসমানীর পদত্যাগ, তাঁর প্রতি সরকার প্রধানের সমর্থন এবং সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্তি—এসব বিবেচনা করে তাঁদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে যান।

সম্মেলনের কার্যক্রম প্রথম দিন স্থগিত থাকে। পরে এ নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। ওসমানীর পদত্যাগপত্রও প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেননি।

সম্মেলনে সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম এ জি ওসমানী, এ কে খন্দকার, এম এ রব, এম কে বাশার, কাজী নূরুজ্জামান, সি আর দত্ত, জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মীর শওকত আলী, আবু ওসমান চৌধুরী, নাজমুল হক, এ আর আজম চৌধুরী, এম এ জলিল, রফিকুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল খুব সকালে নওহাটায় ছোট বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। সেখানে দুটি পাকিস্তানি হেলিকপ্টার ছিল। গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টার দুটির পাইলট ইঞ্জিন চালু করে বিমান অবতরণক্ষেত্র থেকে চলে যান। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল কুমিল্লার মিয়াবাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এরপর দুই পক্ষে চার ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।

খুলনা জেলায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে পাইকগাছা থানার কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিবাহিনীর শালদা নদী অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ভারী কামান ও মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধা তাজুল মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক মারাত্মকভাবে আহত হন। এ ছাড়া দুজন বেসামরিক লোক নিহত ও আটজন বেসামরিক লোক আহত হন।

জাতিসংঘে এখনই নয়

ভারতের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর কলকাতায় রাজভবনে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, পৃথিবীর সব বড় শক্তিই ভারত-পাকিস্তান শক্তিসাম্য রক্ষা করতে চায়। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান হঠকারীর মতো ভারতকে আক্রমণ করে বসতে পারে। বিষয়টি ভারত সতর্কতার সঙ্গে বিচার–বিবেচনা করে দেখছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এখনো যথেষ্ট নয়। সে কারণে ভারত এখনই প্রসঙ্গটি জাতিসংঘে নিয়ে যেতে চায় না।

ভারতে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত উজামা জয়পুরে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকার যে মনোভাব গ্রহণ করেছে, তা খুবই ঠিক। বহু মিত্রদেশ তা সমর্থন করে।

বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট

১১ জুলাই নিউইয়র্কে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনসে একটি কনসার্ট করতে রাজি হয়েছেন। বিটলসের জনপ্রিয় গায়ক জর্জ হ্যারিসন ভারতের প্রখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্করের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে কনসার্টের আয়োজন করছেন। অনুষ্ঠান থেকে আয় করা অর্থ বাংলাদেশের শরণার্থী, বিশেষত শিশুদের জন্য জাতিসংঘের তহবিলে দেওয়া হবে। জর্জ হ্যারিসন আর রবিশঙ্কর ছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও কয়েকজন জনপ্রিয় শিল্পী যোগ দেবেন।

লন্ডনের সানডে টাইমস এই দিন বাংলাদেশ নিয়ে পুরো পাতার নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বলা হয়, ‘পূর্ববঙ্গ শান্ত’ পাকিস্তানের এই দাবি অসত্য। মারে শেলির লেখা সে রিপোর্টে বলা হয়, শরণার্থীদের ছেড়ে যাওয়া একটি এলাকায় তিনি ঘুরে দেখেছেন। সেখানে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সেনাবাহিনী হিন্দু ও মুসলমানদের নির্বিচার গুলি করে মেরেছে। তিনি পাকিস্তানি একটি শরণার্থী শিবিরেও গিয়েছিলেন। সেখানে কোনো লোক ছিল না।

১২ জুলাই ১৯৭১ : মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

মুক্তিবাহিনীর সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনের প্রথম দিনের অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে ১২ জুলাই কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অধিবেশনের শুরুতেই একটি আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন এবং যাঁরা বেসামরিক নানা কাজে যুক্ত আছেন সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজই পরিপূরক। তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্য ও সমঝোতা বজায় রাখার আহ্বান জানান। ভাষণের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল, নেতৃত্বের বিভিন্ন ধাপ, এলাকা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়। সেক্টর অধিনায়কেরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন সাফল্য, সমস্যা ও পরিকল্পনার কথা বলেন। সম্মেলন শুরুর আগে জুনের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি নীতিনির্ধারণী চিঠি সেক্টরগুলোতে পাঠানো হয়েছিল। কয়েকজন সেক্টর অধিনায়ক চিঠি না পাওয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হলেও তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, আলোচনা ভোরবেলা শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। উপস্থিত সব সেক্টর কমান্ডারই তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন।

বাংলাদেশ সরকার এই দিন মুজিবনগরে এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাজারে যেসব প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড ছেড়েছে, সেসব না কিনতে বাংলাদেশের জনগণকে অনুরোধ জানায়। এ ছাড়া পোস্টাল জীবন বীমার প্রিমিয়াম বাবদ অর্থও না দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

ভারতের প্রতিরক্ষা দৃঢ়তর

ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রায় এদিন দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের সর্বত্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সতর্ক প্রহরা জোরদার করা হয়েছে। ভারতের ভূখণ্ডে যে–ই প্রবেশ করুক, তাদের রুখে দিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশের এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থায়িত্বের ওপর পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য দেওয়ার নীতির বিপজ্জনক। তাঁরা এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে লিখিত উত্তরে তিনি জানান, ৮ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ১৯ জন শরণার্থী ভারতে এসেছেন। এই সংখ্যাই প্রমাণ করে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা উপমন্ত্রী অমিয়কুমার কিস্কু লোকসভায় জানান, ৪ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি বুলেট বা অস্ত্রের আঘাতে আহত ১ হাজার ১৪০ জনেরও বেশি শরণার্থীর মধ্যে ৪২ জন মারা গেছেন।

ভুট্টোর মন্তব্যে পাকিস্তানে ঝড়

ইরানে অবস্থানকালে পাকিস্তান সরকারকে বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন বলে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি প্রচারিত একটি খবর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমির আবুল আলা মওদুদী সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি ভুট্টোর ইরানে দেওয়া ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মীমাংসার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বেআইনি ঘোষিত দলের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিত’—এই মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভুট্টোর কথা বলা সংগত হয়নি। এ ছাড়া পাকিস্তান সরকারকে তিনি এমন একজনের সঙ্গে মীমাংসা করার পরামর্শ দিয়েছেন, যিনি পাকিস্তানের ঘোরতর একটি শত্রুদেশের যোগসাজশে পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।

বাল্টিমোরে সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ

যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ পদ্মার আসার খবর বন্দরের ডকে শতাধিক মানুষ সকাল থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই জাহাজের পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধ করতে তাঁরা বিক্ষোভে অংশ নেন। ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সিজের ম্যানেজার ওয়াল্টার স্পাইয়েকার বিক্ষোভকারীদের বলেন, বাল্টিমোরে পদ্মা জাহাজে কোনো সামরিক মালপত্র তোলার কথা নয়। তিনি আশ্বাস দেন, জাহাজে কোনো সামরিক সম্ভার ওঠাতে দেখা গেলে তিনি তা বিক্ষোভকারীদের দিয়ে দেবেন।

বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকার ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটির লোকেরাও। বিক্ষোভকারীদের মুখপাত্র বিল ময়ার বলেন, স্পাইয়েকারের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও পরদিন পদ্মায় গোলাগুলি ওঠানো হবে। জাহাজটির কাল এখানে পৌঁছানোর কথা।

জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি শরণার্থীদের আস্থার মনোভাব নিয়ে দেশে ফেরার পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জাতিসংঘের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষের প্রকৃত রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই যে শুধু সে পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে ভারত মনে করে, তিনি তা–ও বুঝিয়ে বলেন।

১৩ জুলাই ১৯৭১ : বাংলাদেশের ছবি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপি ১৩ জুলাই জানায়, বিশ্বব্যাংক মিশনের এক গোপন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অতি করুণ ছবি ফুটে উঠেছে। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাসের রাজ্য সৃষ্টি করেছে। মানুষ আতঙ্কিত। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ। বিশ্বব্যাংকের এই মিশনের নেতৃত্ব দেন ব্রিটেনের নাগরিক পিটার এস কারগিল। দলে নয়জন সদস্য ছিলেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে পাকিস্তানি সেনাদের সরিয়ে সেখানে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ইয়াহিয়ার সংবিধান

পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদক জেড এ সুলেরি জানান, পাকিস্তানের সংবিধান তৈরির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। প্রস্তাবিত সংবিধানে বর্তমানের যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তে ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ পুনরুদ্ধারের জন্য পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা থাকবে। মুসলমান প্রার্থীরা যাতে অমুসলিম ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল না থাকেন, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। সংবিধানে দুই সভার ফেডারেল সরকার গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। দুই সভার সদস্যসংখ্যা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে প্যারিটির ভিত্তিতে। প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তেমন বেশি থাকবে না।

বার্তা সংস্থা পিপিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ব্যবসায় মন্দার কারণে পাকিস্তানি শিল্পপতিরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ছাঁটাই শুরু করেছেন। কিছু প্রতিষ্ঠান সরাসরি ভিত্তিতে নিযুক্ত কর্মচারীদের লে-অফ করতে শুরু করেছে। অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে লে-অফ করার কৌশল নিয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল মর্টারের সাহায্যে মন্দভাগ বাজার ও নাক্তের বাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের চারজন আহত হন।

কুমিল্লার দাউদকান্দির উত্তরে গোমতী নদীতে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল স্পিডবোটকে আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল দর্শনায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

আয়ারল্যান্ডের মধ্যস্থতার প্রস্তাব

আইরিশ পার্লামেন্টের সদস্য স্যার অ্যান্থনি চেলস এসমন্ড ও ড. উইলিয়াম লাউনাগে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে তাঁর দেশের মধ্যস্থতার প্রস্তাব এখনো বহাল আছে। এ নিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির কার্যকরী কমিটি দিল্লিতে এক সভায় ৮ আগস্টকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটির সভাপতি ড. ত্রিগুণা সেন ভারতের সব রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক সংস্থাকে দিনটি পালনের আহ্বান জানান। ওই দিন সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী জানান, সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যা সম্পর্কে একটি ছবির অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ব জনমত তৈরি করতে বিভিন্ন দেশে এই অ্যালবাম পাঠানো হবে।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, সরকারি হিসাবে পশ্চিম দিনাজপুরের মালন শিবিরে ৩৩ হাজার ১৫২ জন শরণার্থী কলেরা ও উদরাময়ে আক্রান্ত হন। মারা গেছেন ৪ হাজার ৫০৫ জন। সরকারি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত শরণার্থী এসেছেন ৫২ লাখ ২৫ হাজারের মতো।

যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) এদিন রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে। শরণার্থী সমস্যায় ভারতকে সাহায্য করার জন্য অতিরিক্ত ১৭ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব বৈঠকে অনুমোদিত হয়। বৈঠকে ৪১ জন প্রতিনিধি যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে পাকিস্তানকে জাহাজবোঝাই সমরাস্ত্র পাঠানো বন্ধ করার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট নিক্সন অবশ্য বলেছেন, পাকিস্তানকে অস্ত্রের জন্য নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স দেওয়া হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে আহ্বান জানিয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি বিধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো ফর্মুলা দেয়নি। তবে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা হ্রাস এবং অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা না হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা এদিন জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার কথা মনে রেখে ইয়াহিয়া খান নতুন করে উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব তাঁরা পেশ করেননি বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দেশটির সরকারের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়, অবিলম্বে নতুন করে খাদ্য পাঠানো না হলে পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যাবে। পূর্ব বাংলার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের সম্যক জ্ঞান নেই। ত্রাণ কর্মসূচির মধ্যেও নেই সমন্বয়।

১৪ জুলাই ১৯৭১ : ব্রিটিশ প্রতিনিধি দেখা পাননি বঙ্গবন্ধুর

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর
বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ আটকের পর (১২ এপ্রিল ১৯৭১)

 

সদ্য ভারত এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান সফর করে যাওয়া ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা আর্থার বটমলি ১৪ জুলাই বিবিসির অনুষ্ঠান আউটলুকে বলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, তাঁর এই অনুরোধের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভয়ানক। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান এতে খুবই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া তাঁর কাছে শেখ মুজিবকে অপরাধী বলে বর্ণনা করেন।

বিবিসির প্রচারিত সংবাদে এদিন বলা হয়, ব্রিটেনের এই সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস তাদের বলেছেন, পূর্ব
পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে কয় মাস ধরে সেখানে অবাধ সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, এককথায় বললে শেখ মুজিবুর রহমান।

যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল থেকে এ অভিমত জানানো হয় যে পাকিস্তানের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার তাদের গৃহীত নীতিকে সঠিক বলেই মনে করছে। ব্রিটিশ সরকার আরও মনে করে, বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো দমনমূলক নীতিই তাদের সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রজার পি ডেভিস ১৪ জুলাই সিনেটে জানান, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিস্থিতির দরুন সাহায্য কর্মসূচিতে কঠিন সব সমস্যা দেখা দিয়েছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনা অবধি উন্নয়নের জন্য সাহায্য দেওয়া যায় না।

নিউইয়র্ক টাইমস এদিন পাকিস্তানকে জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কঠোর সমালোচনা করে। পত্রিকাটি বলে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে যে উৎপীড়ন চালাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে আরও অস্ত্র দেওয়াটাই অমার্জনীয় কাজ।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

ভারতের শাসক দল নব কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য কমিটির সভায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের দাবি জানানো হয়।

সারা ভারত বন্দর ও ডক ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি এস আর কুলকারনি মুম্বাইয়ে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউিনয়ন, জার্মানি, জাপানসহ ১৩টি দেশের পরিবহনকর্মী সংস্থার কাছে অনুরোধ জানান, তাদের কর্মীরা যেন পাকিস্তানগামী সামরিক সম্ভারপূর্ণ বিমান বা জাহাজের কাজে হাত না লাগান। আবেদনে তিনি আরও বলেন, প্রতিটি দেশের প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রধান কর্তব্য ওই সব দেশের সরকারের ওপর পাকিস্তানের শাসকদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে বিরত থাকতে নৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।

সামরিক অভিযান

নরসিংদীর বেলাবতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনাদের বেলাব আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বেলাবর নিকটবর্তী এলাকা টোকের কাছে অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে লঞ্চের বদলে নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করে। পরে একটি খালি লঞ্চ ওখানে এলে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা পেছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। দুই পক্ষের প্রবল যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবুল বাশার, সিপাহি আবদুল বারী, সিপাহি নূরুল ওহাব, সিপাহি সোহরাব হোসেন, সিপাহি মমতাজ উদ্দীন, সিপাহি আবদুল হক ও সিপাহি আবদুস সালাম শহীদ হন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

কুড়িগ্রামে একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড়খাতা অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তাদের বেশ ক্ষতিসাধন করেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী শহীদ হন।

ড. মালিক প্রেসিডেন্টের মূল ব্যক্তি

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের মূল ব্যক্তি এবং রিলিফ ও পুনর্বাসনে তাঁর বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। তাঁর সদর দপ্তর ঢাকায় থাকবে।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামাবাদে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে এবং বহিরাক্রমণের আশঙ্কা মোকাবিলায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সুস্পষ্ট রায় মোতাবেক জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আবার দৃঢ় দাবি জানান। ভুট্টো বলেন, নির্বাচনের পর ইতিমধ্যে বহু সময় নষ্ট হওয়ায় জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে।

তেহেরিকে ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান কোয়েটায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তাতে সামগ্রিকভাবে শুধু দেশেরই ক্ষতি হয়নি, কাশ্মীর সমস্যারও ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানে সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল যশোরের ঝিকরগাছা ও খুলনা পরিদর্শন করেন। সেখানে ১৭ জন অমুসলিমসহ ৫৬ জন ফিরে আসা শরণার্থী উপস্থিত ছিল।

১৫ জুলাই ১৯৭১ :  শপথ গ্রহণ সেক্টর অধিনায়কদের

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে ১৫ জুলাই মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরের অধিনায়কেরা বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ নেন। এর মধ্য দিয়ে সাত দিনব্যাপী পরিকল্পিত সেক্টরের অধিনায়কদের সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।

ভাসানী ন্যাপ এবং চীনঘেঁষা আটটি বাম দল এদিন বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে একটি নতুন ফ্রন্ট গঠন করে। ফ্রন্ট গঠনের পর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত অন্য সব শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে কমিটি এ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হলো কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, শ্রমিক কৃষক কর্মী সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (হাতিয়ার গোষ্ঠী), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ফ্রন্ট গঠনের সংবাদে মুজিবনগর থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনযুদ্ধের এই সময় নির্বাচনে কোনো আসন না পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং চীনকেই শক্তিশালী করবে। তিনি তাদের বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মৌলভীবাজারের শাহবাজপুরে একদল মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা অভিযানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

ব্রিটেনকে নিয়ে বিরূপ

ইসলামাবাদে এক সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বাঞ্ছনীয়তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্রিটেনের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কমনওয়েলথের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখা সংগত কি না, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়। হ্যান্ডআউটে আরও বলা হয়, ব্রিটেনের নজির অনুসরণ করে কমনওয়েলথের আরও কয়েকটি দেশও পাকিস্তানের ব্যাপারে অবাস্তব মনোভাব গ্রহণ করেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হয়ে উঠেছে।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশ সফররত কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম শহরের প্রধান বৌদ্ধমন্দির পরিদর্শনের পর চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশ নাগরিক এবং কানাডার মিশনারিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর তাঁরা শহরের কয়েকটি এলাকা দেখে ঢাকায় ফিরে করাচির পথে রওনা দেন।

পাকিস্তানকে সাহায্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি আর্থিক বছরে পাকিস্তানকে ১১ কোটি ৮ লাখ ডলার সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব করলে কমিটি ১৭-৬ ভোটে তা বাতিল করে দেয়। সিনেটের প্রভাবশালী সদস্যরা পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার বিরোধিতা করেন। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ও উইলিয়াম স্যাক্সবি সামরিক সাহায্যদানের বিরোধিতা করে আনা সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতি ৩২ জন সিনেটর সমর্থন জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবোঝাই জাহাজগুলোকে কী করে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর ছেড়ে যেতে দেওয়া হলো, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। কম্পট্রোলার জেনারেল এলমার স্ট্যাটনকে তিনি ঘটনাটি অনুসন্ধান করে দেখার অনুরোধ জানান।

খবর এসেছিল, পদ্মা জাহাজ পাকিস্তানের জন্য সমরসম্ভার বয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোরে আসছে। ১৪ জুলাই পদ্মা বাল্টিমোরে এসে পৌঁছায়। বাল্টিমোর বন্দরে কয়েকজন নৌকায় বোঝাই হয়ে জাহাজটি থামাতে যায়। পুলিশ তাদের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর কর্মী ইউনিয়ন পদ্মায় কিছু না তোলার জন্য বন্দর কর্মীদের অনুরোধ জানায়।

ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ওম মেহতা ক্রেমলিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিসেস বাগদার নাসসুদ্দনোভার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। মিসেস বাগদার তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন, পাকিস্তানকে সোভিয়েত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে না।

১৬ জুলাই ১৯৭১ : বন্দী শেখ মুজিবের বিচারের খবর

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ১৬ জুলাই তাদের সংবাদদাতা মার্ক টালির বরাতে জানায়, পশ্চিম পাকিস্তানে শোনা যাচ্ছে যে কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের জন্য আদালতে হাজির করা হতে পারে। তবে পাকিস্তানের সরকারি মহল কোনো মন্তব্য করেনি।

যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের চীনা দূতাবাসের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। সেখান থেকে একটি মিছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যায়।

বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মতিউর রহমান বলেন, পাঁচ লাখ গাঁট কাঁচা পাট বিক্রির জন্য সরকার আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজছে। বাংলাদেশের চা ও তামাক বিক্রি করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার যাতে বিদেশি মুদ্রা অর্জন না করতে পারে, তার জন্যও বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থা নেবে।

ভারত ও পাকিস্তানে

ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন। তিনি আসামে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করে এদিন কলকাতায় আসেন। তিন দিন কলকাতায় অবস্থান করে তিনি বিভিন্ন শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করবেন। সাংবাদিকেরা কিটিংকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করেন, তবে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো জানান, অবিলম্বে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। জাতি ভয়াবহ সংকটে। দেশের ভবিষ্যৎ কোনো না কোনোভাবে তাঁর ওপরই নির্ভরশীল।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার এক হ্যান্ডআউটে জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও কৃষ্টি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল বারীকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জয়দেবপুরের পূর্ব পাকিস্তান রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আমিরুল ইসলামকে ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

গোপন চীন সফর কিসিঞ্জারের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গত সপ্তাহে পাকিস্তান থেকে গোপনে গোয়েন্দা কায়দায় চীনের রাজধানী বেইজিং সফরে যান বলে এদিন জল্পনা শোনা যায়। সে সময়ে প্রচার করা হয়েছিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অসুস্থতার খবর প্রচার করে কিসিঞ্জার চুপি চুপি বেইজিং পাড়ি দেন। গোপনে কিসিঞ্জারের বেইজিং সফরের ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অনেক কূটনীতিকই বিস্মিত হন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র স্বীকার করেন, বাল্টিমোরে নোঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মায় মাল তুলতে ডকশ্রমিকেরা অস্বীকার করেছেন। জাহাজে বিমানের জন্য যন্ত্রাংশ, সামরিক যান, আর্টিলারি সরঞ্জামসহ ১২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮ ডলার মূল্যের সরঞ্জামাদি ও গুলি রয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে এক আলোচনায় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধে৵ তীব্র বাদানুবাদ হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের রিপোর্টের উল্লেখ করে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, শরণার্থীরা ফিরে এলে তাদের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের দায়িত্ব পাকিস্তান নেবে। উত্তরে ভারতীয় প্রতিনিধি নটরাজন কৃষ্ণণ বলেন, গণহত্যার জন্যই শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।

১৭ জুলাই ১৯৭১ : নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফর

 

ইন্দিরা ও নিক্সনের বাংলাদেশ সংলাপ, জুলাই মাস ১৯৭১ ২

 

বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৭ জুলাই মুজিবনগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফর নিয়ে একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি এই বলেন, বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক কৌশলে পালাবদল এলে শান্তিকামী ছোট দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের স্বাধীনতার জাতীয় স্পৃহা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভারতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী এ ব্যাপারে কলকাতায় বলেন, নিক্সনের চীন সফরের ফলে বিশ্বশক্তির ভারসাম্য পাল্টে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যাতে ছোট রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতির আশঙ্কা আছে। তবে এর ফল যা–ই হোক, বাংলাদেশ আজ বাস্তব এবং লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর জয় হবেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো মীমাংসায় আসতে হলে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমেই তা সম্ভব।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে বাংলাদেশে ত্রাণকার্যে বা শরণার্থীদের তদারকির কাজে নামানোর প্রস্তাব দুরভিসন্ধিমূলক। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে আগে স্বীকৃতি দিক, তারপর ওই ধরনের সাহায্য দিক। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের জনগণের কাছে আবেদন জানান।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল মর্টারসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী রেলস্টেশনের দক্ষিণে মনোরা রেলসেতুর কাছে একদল পাকিস্তানি সেনার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এতে কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের শালদা নদী ঘাঁটিতে ফিরে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কিছু পাকিস্তানি সেনাকে লাতুমুড়া থেকে চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে অ্যামবুশ করেন। অ্যামবুশে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে পুটিয়া গ্রামের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কের আশিকাটি গ্রামের কাছে একদল পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল হাজীগঞ্জের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর নরসিংপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে যান।

উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী জেলার শাহপাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

অ্যালেন গিন্সবার্গের সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটির কাছে পাঠানো ২০০ ডলারের একটি চেক এই দিন কমিটির কাছে পৌঁছায়। চেকটির সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ একটি চিঠিও পাঠান। চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রপূর্ণ জাহাজ পাঠানোর বিরুদ্ধে জনমত এখনো ততটা জোরদার হয়ে ওঠেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে যে বিশ্বের অন্য দেশে চলমান অন্যায়–অবিচারের দিকে তাকানোর অবকাশ তাদের হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম কমিটির একজন মুখপাত্র লন্ডনে সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা আশঙ্কা করছেন, ইরান ব্রিটিশ কারখানায় ট্যাংকের যে ক্রয়াদেশ দিয়েছে, তা সম্ভবত পাকিস্তানের হাতে গিয়ে পড়বে অথবা ইরান ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছে তার পরিবর্তে এই নতুন অস্ত্র পাঠাতে পারে। এ ব্যাপারে কমিটির নেতারা ব্রিটিশ সরকার ও লন্ডনের ইরানি দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনার কথা ভাবছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর ডক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা আগের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ঘোষণা করেন, পাকিস্তানগামী জাহাজে অসামরিক মালপত্র তুলতে তাঁরা রাজি। আন্তর্জাতিক বন্দর কর্মী সমিতির স্থানীয় ইউনিটের প্রথম সহসভাপতি চার্লস জোনস বলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন জাহাজে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর বলেন, বাংলাদেশ থেকে এক কোটি শরণার্থী আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন শরণার্থী বাবদ খরচ আরও অনেক বাড়বে। এই হিসাবের মধ্যে প্রশাসনিক খরচ ধরা হয়নি।

ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেক ও বারাসাতে তিনটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার পর সাংবাদিকেরা তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে কিটিং কোনো মন্তব্য করেননি। এরপর তিনি মহাকরণে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং মুখ্য মচিব এন বি সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। সে সাক্ষাতের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বেইজিং যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সময়োচিত পদক্ষেপ।

 

জুলাই মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১৮ জুলাই ১৯৭১ : হঠাৎ কলকাতায় ভারতীয় সেনাপ্রধান

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৮ জুলাই হঠাৎ বিকেলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় আসেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ তাঁর কলকাতা আগমনে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মানেকশ ফোর্ট উইলিয়ামে দীর্ঘ বৈঠক শেষে রাতে সরাসরি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করবেন বলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হুমকিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এদিন মুজিবনগর থেকে একটি বিবৃতি দেন। শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন বন্ধ করে তাঁর জীবন রক্ষার জন্য তিনি জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে আবেদন জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিচার করার আইনগত কোনো অধিকার ইয়াহিয়ার নেই।

গেরিলা অভিযান ঢাকায়

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এলাকার গ্যানিজ এবং ভোগ বিপণিকেন্দ্রে বিকেলে একটি অভিযান পরিচালনা করে। অবাঙালি মালিকানাধীন এই দুই বিপণিকেন্দ্রে পাকিস্তান অনুগত পুলিশ ও রাজাকার অবস্থান করছিল। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড ও ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ করলে দোকান দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া পুলিশ, রাজাকার ও দোকানের কয়েকজন কর্মচারী আহত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শালদানদী এলাকার মনোরা সেতুর দিকে একদল পাকিস্তানি সেনা অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা মর্টার ও কামানের সাহায্যে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন হতাহত হয়। তারা পিছু হটে মনোরা সেতুর উত্তরে অবস্থান নেয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) নেতৃত্বে কসবার উত্তরে কাসিমপুর সেতুর কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তারা অবস্থানটি ত্যাগ করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম) নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদলের বেশ ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

শরীয়তপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাদল গোসাইরহাট থানার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করলে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায় এবং ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাঁচটি রাইফেল, একটি ওয়্যারলেস সেট ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

ময়মনসিংহে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন রাতে টেলিফোন লাইন কেটে দেয়।

বৃহত্তর রংপুর জেলার বড়খাতা ও চৌইলাদি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি বড় সংঘর্ষ হয়।

জিজ্ঞাসাবাদ মিশনের কর্মীদের

সুইজারল্যান্ডের মধ্যস্থতায় কলকাতায় সাবেক পাকিস্তানি উপহাইকমিশনের কর্মীদের আনুগত্য প্রশ্নে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ হয়। জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় সবাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিচল আনুগত্যের কথা জানান। এই সংবাদে খন্দকার মোশতাক আহমদ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী ও মিশনের কর্মীদের অভিনন্দিত করেন।

সুইস মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ৬৭ জন কর্মীর মধ্যে ৬৪ জনই আলাদাভাবে জানান যে তাঁরা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। তিনটি জায়গায় অতি গোপনে এ জিজ্ঞাসাবাদ হয়। সুইস দূতাবাসের কাউন্সেলর ড. বোনার্ড, সাবেক পাকিস্তানি উপহাইকমিশনার মেহেদি মাসুদ ও ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের যুগ্ম সচিব অশোক রায় এই জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ছিলেন।

তবে দুজন অবাঙালি কর্মী পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একজন অসুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাঁর বাড়িতে গেলে তিনিও পাকিস্তানে যেতে চান না বলে জানান।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রংমহলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ছিল আলোচনা, সংগীত ও নাট্য পরিবেশনা। এর উদ্বোধন করেন সত্যেন সেন। আলোচকেরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। সংগীত পর্বে একক ও সমবেত কণ্ঠে ১৫টি প্রতিরোধের গান পরিবেশিত হয়। পরিবেশন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৬ জন শিল্পী। নাট্যানুষ্ঠানে পূর্ণেন্দু পাল রচিত ‘বিদ্রোহী বাংলা’য় অভিনয় করেন গণসংস্কৃতি সংঘের শিল্পীরা।

ব্রিটেনপ্রবাসী প্রায় দুই হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাঁরা লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে মিছিল করে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা দূতাবাসে প্রতিবাদপত্র দেন। মিছিলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা স্মারকলিপি নেন। চীনা দূতাবাসের দরজা বন্ধ থাকায় স্মারকলিপিটি তাদের ডাকবাক্সে জমা দেওয়া হয়।

১৯ জুলাই ১৯৭১ :  এক দিনে তিন অভিযান ঢাকায়

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্র্যাক প্লাটুন ১৯ জুলাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দখলে থাকা রাজধানী ঢাকার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে। তারা উলুন পাওয়ার স্টেশন, খিলগাঁও পাওয়ার সাবস্টেশন এবং গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে অভিযান চালায়।

রাত ৯টার দিকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা রামপুরা–সংলগ্ন উলুনে শহরের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ২০ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর ও ফিউজ দিয়ে অল্প কয়েকজন গেরিলা সফলতার সঙ্গে অভিযানটি সম্পন্ন করেন। সেখানে পৌঁছে তাঁরা পুলিশ ও গার্ডদের ফাঁকি দেন। একই সময় একজন কমান্ডো টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেন। তাঁরা ১৭ পুলিশকে বন্দী করে অপারেটরকে তাদের ট্রান্সফরমার রুমে নিয়ে যেতে বাধ্য করেন। গেরিলারা এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেন। বাকি দুটি দল প্রায় একই সময়ে খিলগাঁও সাবস্টেশন ও গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন বিস্ফোরক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেন।

উলুন অপারেশনে অংশ নেন গাজী গোলাম দস্তগীর (বীর প্রতীক), মতিন এক ও মতিন দুই, নীলু, জিন্নাহ ও হাফিজ (দস্তগীর ছাড়া বাকি সবাই পরে শহীদ হন)। খিলগাঁও ও গুলবাগ অপারেশনে অংশ নেন পুলু, সাইদ, জুয়েল (পরে শহীদ ও বীর বিক্রম), হানিফ, মূখতার, মোমিন, মালিক ও বাসার। খিলগাঁও অপারেশনে তাঁদের সহযোগিতা করেন নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম (পরে শহীদ)।

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করার প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের নাম এখন থেকে ‘মুক্তিবাহিনী’। ব্যাপক আক্রমণের জন্য মুক্তিবাহিনীর বিমান ও নৌবাহিনী গঠনের চেষ্টা চলছে।

মুজিবনগরে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ফুটবল একাদশ ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদীয়া জেলা দলের সঙ্গে চ্যারিটি ম্যাচ খেলবে। এ খেলা থেকে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে দেওয়া হবে।

রবিশঙ্কর–হ্যারিসনের যৌথ উদ্যোগ

বিটলসশিল্পী জর্জ হ্যারিসনের ম্যানেজারের একজন মুখপাত্র নিউইয়র্কে সাংবাদিদের জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি গান রেকর্ড করেছেন। গানটিতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা রয়েছে। ২৩ জুলাই গানটি বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে বাজানো হবে। বাজারে বিক্রি হবে ২৬ জুলাই থেকে। সেদিন একই সঙ্গে সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করেরও রেকর্ড প্রকাশিত হবে। এসব রেকর্ড বিক্রির টাকা যাবে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বিশেষ ত্রাণ তহবিলে। ইউনিসেফের মাধ্যমে সে অর্থের বিলি–ব্যবস্থা করা হবে। শরণার্থী শিশুদের জন্য একটি তহবিল গড়ে তোলার জন্য তাঁরা ১ আগস্ট একটি কনসার্টেরও আয়োজন করছেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানোয় পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ করে বলেন, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত অস্ত্র সরবরাহ ভারতের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।

রাজ্যসভার সদস্যরাও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকায় গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। সরদার শরণ সিং বলেন, এভাবে অস্ত্র জোগানোর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যাকে ক্ষমার চোখে দেখছে।

বঙ্গবন্ধুর বিচার, ইয়াহিয়ার হুমকি

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে ইয়াহিয়াকে উদ্ধৃত করে বিবিসির খবরে বলা হয়, শিগগিরই সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হবে। শেখ মুজিব উকিলের সাহায্য পেতে পারেন, তবে বিদেশি কোনো উকিল নয়। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। এ মামলার রায় পর্যালোচনা করার একমাত্র ক্ষমতা ছিল প্রেসিডেন্টের।

ভারত বাংলাদেশের কোনো অংশ অধিকার করতে চাইলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ ঘোষণা করবেন বলেও বিবিসি জানায়। এ ধরনের যেকোনো চেষ্টাকেই পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ বলে মনে করা হবে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে উদ্ধৃত করে বিবিসি আরও জানায়, বিদেশি বিভিন্ন সরকারের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নাকি ইয়াহিয়া খান যেকোনো দিন যেকোনো স্থানে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ইন্দিরা তাতে সম্মত হননি।

২০ জুলাই ১৯৭১ : নির্যাতনের শিকার হিন্দু-মুসলিম সবাই

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২০ জুলাই দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে এক সমাবেশে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীর ওপর উৎপীড়ন করছে। কিন্তু কিছু লোক পরিস্থিতির অপব্যাখ্যা করে বলছে, শুধু হিন্দুদের ওপরই অত্যাচার হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজন মিলিতভাবে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলা করা।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের কিছু অংশ মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি কবলমুক্ত করতে পারলে সেই সাফল্যকে পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অছিলা হিসেবে কাজে লাগায়, তাহলে আমরাও আত্মরক্ষায় প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি বলেন, বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে, তাহলেই কেবল বর্তমান সংকটের মোচন হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা হবে পাগলের কাণ্ড।

সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান ভারতের গুজরাটের রাজ্যপালের কাছে এক চিঠিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতার নিন্দা করে মন্তব্য করেন, এটা খুবই দুঃখের যে বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে তামাশা মনে করছে। তাদের নীরবতাই এর প্রধান সাক্ষ্য। বাংলাদেশের অসহায় নিপীড়িত জনগণের প্রতি রাষ্ট্রগুলোর কোনো আন্তরিক সহানুভূতি নেই।

ভুট্টোর ছলচাতুরী

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দল ২৮ জুনের পর থেকে চার মাসের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে অপেক্ষা করতে রাজি আছে। এরপর আবার কোনো প্রকার ছলচাতুরীর মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর দীর্ঘায়িত করা উচিত হবে না।

ভুট্টো আরও বলেন, কিছু লোক ক্রমাগত বলছেন যে তিনি কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৃহত্তর জোটের কথা বলেন, আবার কখনো আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিন্দা করেন। এটা করে তারা তাঁকে শেখ মুজিবের সমপর্যায়ে আনার চেষ্টা করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব যখন সত্যিকার ফেডারেশনের প্রস্তাব করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে জোটের কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে শেখ মুজিব ছয় দফার ভিত্তিতে কনফেডারেশনের দাবি উত্থাপন করলে তিনি বৃহত্তর জোটের অবস্থান থেকে সরে এসে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ধারণা দেন।

পাকিস্তান সফররত ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমান করাচিতে বলেন, ১৭ জুলাই তাঁর সঙ্গে আলাপে ইয়াহিয়া খান আশ্বাস দিয়েছেন যে শরণার্থীরা বিনা শঙ্কায় পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারে। তিনি আরও জানান, ২১ জুন থেকে ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তান সফরে পাঁচ সদস্যের একটি মিশনের তিনি নেতৃত্ব দেবেন। তবে এই মিশন কোনোভাবেই রাজনৈতিক নয়।

তেহেরিকে ইশতিকলাল পার্টির আহ্বায়ক এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, যেসব রাজনৈতিক দলের জাতীয় বৈশিষ্ট্য নেই, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত। দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলিক বিষয়ের ব্যাপারে মতৈক্য হওয়া উচিত।

গেরিলা অভিযান

একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালান। আজাদ স্কুল, গোয়ালপট্টি এবং সাধনা ঔষধালয়, কালীবাড়ি ও সদর মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) অফিসের কাছে সেসব গোলা বিস্ফোরিত হয়। এতে পাকিস্তানি সেনারা সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে।

উত্তরাঞ্চলে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে ফুদকিপাড়ায় অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। নাটোরে মুক্তিযোদ্ধারা লালপুর থানা রেড করে। এতে কয়েকজন অবাঙালি পুলিশ হতাহত হয়।

বৃহত্তর সিলেটে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দিলখুশা চা–বাগানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পথপ্রদর্শক শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

২১ জুলাই ১৯৭১ : বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে তারবার্তা

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২১ জুলাই মুজিবনগর থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার কাছে পাঠানো এক তারবার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য তাঁদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেন, ভারত, কানাডা, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারবার্তায় তিনি এ আবেদন জানান।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মুক্তাঞ্চল থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জেলে বন্দী শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়া খানের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিশ্বের ছাত্র ও যুবসমাজের কাছে আবেদন জানায়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করায় তাদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এখন স্বতন্ত্র দুই রাষ্ট্র। কেবল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল যোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শালদা নদী অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ছেড়ে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যান।

একদল মুক্তিযোদ্ধা চাঁদপুর থেকে আশিকাটির দিকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় টহল দলকে আক্রমণ করে। তাদের অ্যামবুশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ির যথেষ্ট ক্ষতি এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা চালিয়েও প্রচণ্ড গুলির মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ছেড়ে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
আরেক দল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ঠাকুরগাঁয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

পাকিস্তানে নানা কাণ্ড

ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান চার দিনের সফরে করাচি থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী এবং সাহায্য ও পুনবার্সনকাজ পরিচালনা সম্পর্কিত প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আবদুল মোত্তালিব মালিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান। টুংকু আবদুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন জর্দানের রাষ্ট্রদূত কামাল আল শরিফ, পাকিস্তানে কুয়েত দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সোলায়মান আবু গাউস, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রেজা তাকাভি এবং মহাসচিবের বিশেষ সহকারী আলী বিন আবদুল্লাহ।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরসংক্রান্ত পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন। ২৮ জুন প্রচারিত প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এর এক অংশে রয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা; আরেক অংশে প্রেসিডেন্টের নিজের মতামত। পরিকল্পনার কিছু বিষয়ে তাঁদের ভিন্নমত আছে; কিছু বিষয়ে তাঁরা একমত। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর মতামত সম্পর্কে আলোচনা চলছে।

জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভারতের না

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এই দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ সীমান্তের দুই পাশে জাতিসংঘের উদ্যোগে পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ভারত অগ্রাহ্য করেছে। ভারত সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলেছে, ভারতে শরণার্থীশিবিরগুলোতে এবং বাংলাদেশে সীমান্তের দিকে তথাকথিত পাকিস্তানি অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে কিছু পর্যবেক্ষক বসিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করা যাবে না। বরং বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে দুনিয়ায় আত্মতৃপ্তির মনোভাব গড়ে তোলা হবে।

ভারতীয় মুখপাত্র আরও বলেন, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সাহায্য এবং প্রয়োজনে অস্ত্রও দেবে। মুক্তিবাহিনীর জন্য ভারত তার সমর্থন কখনো লুকায়নি, এখনো লুকানোর কারণ নেই।

ভারত সফররত অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির এমপি ম্যানফেড ক্রস কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, সব দেশেরই পাকিস্তানকে সব রকম অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া বাংলাদেশের দুস্থ মানুষদের জন্য সব রকম সাহায্য আন্তর্জাতিক তদারকিতে পাঠানো দরকার।

বাংলাদেশের অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পাকিস্তানি সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইসরায়েল এই দিন বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে আবেদন জানায়।

২২ জুলাই ১৯৭১ : তাজউদ্দীনের আবেদন বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধে

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২২ জুলাই মুজিবনগর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বিচারের হুমকি ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন, সে বিচার হলে তা প্রহসন ছাড়া আর কিছু হবে না। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কর্তব্য নিজ নিজ সরকার এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এ প্রহসন বন্ধ করা এবং ইয়াহিয়াকে তাঁর চক্রান্ত পরিত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন শুধু বাংলাদেশের অধিবাসীদের জন্যই নয়, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থায়িত্বের জন্যও প্রয়োজনীয়।

তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে সমবেত কিছু জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সমস্ত পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য দেশ উদ্ধার।

একদল মুক্তিযোদ্ধা এই দিন টাঙ্গাইলের বাশাইল থানার কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে আক্রমণ করলে কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

অবরুদ্ধ বাংলাদেশ সফররত ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান ঢাকায় সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের সাহায্য ও শরণার্থীবিষয়ক প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে জর্ডান, ইরান, কুয়েত ও আফগানিস্তানের প্রতিনিধিরা ছিলেন। টুংকু আবদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ঢাকা শহরের কিছু এলাকা পরিদর্শন করেন।

রাজাকারদের যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন একটি সামরিক আদেশ জারি করে।

আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য গোলযোগে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের আসন বাতিল করে সে জায়গায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে দাবি জানান।

‘বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা কোনো দলীয় বা ধর্মীয় সমস্যা নয়। এটি এখন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত একটি দেশ। তাদের সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, কোনো দেশ যদি নিজেদের বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ থাকে, তাহলে তার সমাধান হবেই। আর কোনো দেশ এর আগে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি।

দিল্লিতে সরকারিভাবে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৬ জুলাই বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বসবেন। ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার যে হুমকি দিয়েছেন, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় বাংলাদেশ তথ্যানুসন্ধান কমিটির সম্পাদক শৈবালকুমার গুপ্ত জানান, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে নিরপেক্ষ প্রতিবেদন তৈরির জন্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে একটি অরাজনৈতিক তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে।

নিউইয়র্কে কনসার্ট

রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এই দিন এক কনসার্টে সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং বিটলশিল্পী জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার অংশ নেন। এই কনসার্টের জন্য ১০ ঘণ্টায় ৩৬ হাজারের বেশি টিকিট বিক্রি হয়। উপচে পড়া ভিড়ে উদ্যোক্তারা জানান, ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে বৃহত্তর আকারে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে পাঠানো এক গোপন বার্তায় ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের সম্ভাবনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

একই দিনে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করেন।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এই দিন সাংবাদিকদের জানায়, পাকিস্তান শরণার্থী প্রত্যাবর্তন–সংক্রান্ত জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এই প্রস্তাবে শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে ভারত ও পাকিস্তানে দুই দেশে জাতিসংঘের বেসামরিক লোক মোতায়েনের কথা বলা হয়েছে।

কানাডার রাজধানী অটোয়ায় সফররত পাকিস্তানি প্রতিনিধি হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাঁদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। হামিদুল হক চৌধুরী পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি এবং মাহমুদ আলী পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সহসভাপতি। সংবাদ সম্মেলনে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়নি। সুসংঘবদ্ধ কয়েকটি দল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করছে।

২৩ জুলাই ১৯৭১ : বাংলাদেশ প্রশ্নে তপ্ত মার্কিন সিনেট

এডওয়ার্ড কেনেডি, হিরাম ফং এবং চার্লস মেথিয়াসের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীসংক্রান্ত জুডিশিয়ারি উপকমিটিতে ২৩ জুলাই বাংলাদেশ নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে সিনেটর হিরাম ফংয়ের একটি বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন আর উইন বলেন, পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত এলাকায় সামরিক তৎপরতা ও গেরিলা হামলা পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব ভারত গ্রহণ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ লাখ শরণার্থীর যে হিসাব ভারত দিচ্ছে, জাতিসংঘের পক্ষে তা সঠিকভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আস্তে আস্তে অনেক জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর স্টুয়ার্ট সিমিংটন অভিযোগ করে বলেন, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাঠানো বাতিলের আইনি অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেটি না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মচারীরা পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিকে জানিয়েছিল, ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র দেওয়া হয়নি। পরে তারা স্বীকার করে, অস্ত্রবাহী কিছু জাহাজ পাকিস্তানে যাচ্ছে। বারবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রায় দেড় কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দিতে ইচ্ছুক। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনকে চাপ না দেওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত তথ্য পেশ করার কোনো চেষ্টাই করে না।’

পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের বিষয় নিয়ে তিনি সম্প্রতি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন নিরাপত্তা পরিষদে লেখা চিঠিতে অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের ভারত বিরোধিতা সমানে চলছে।

সুইডেনের স্টকহোমে এক কূটনৈতিক সূত্র এই দিন জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপারে তীব্র মতবিরোধের জেরে দেশটিতে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ইকবাল আতাহার পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেধেছিল। বন্ধুবান্ধবের কাছে তিনি বাংলাদেশে সামরিক অভিযান ও অত্যাচারের সমালোচনা করেন।

আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী পাকিস্তানি বিমানকে গুলি করে নামানোর নির্দেশ

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদে সাংসদদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন, ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী যেকোনো পাকিস্তানি বিমানকে গুলি করে নামানোর জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ও বিশিষ্ট সংবিধানবিদ সুব্রত রায়চৌধুরী কলকাতায় বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে গোপনে বিচার করা হবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও আন্তর্জাতিক আইনের রীতিনীতির বিরোধী। ১৯৪৯ সালে সম্পাদিত জেনেভা চুক্তিতে পাকিস্তান অন্যতম স্বাক্ষরকারী। এ ধরনের বিচার জেনেভা চুক্তির ৩ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার জমি এবং অন্যান্য সম্পত্তি ২৫ জুলাই নিলামে তোলার ঘোষণা দেয়। ৭ জুন সামরিক আদালতে আওয়ামী লীগ নেতাদের তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়। আদালত তাঁদের ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি কমান্ডো দল কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা করলে বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল কল্যাণ সাগরের কাছে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একজন দালাল নিহত হয়।

২৪ জুলাই ১৯৭১ : বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে

ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার পিএসপি দলীয় সাংসদ সমর গুহ ২৪ জুলাই দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি আসন্ন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়ন সতর্ক থাকায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত আটকে ছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন হঠাৎ বন্ধু হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত সমর্থক অন্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। ভারতের একা হয়ে যাওয়ার উদ্বেগও দূর হবে।

পাকিস্তানকে উদ্ধারে চীনের সেনাবাহিনী এগিয়ে আসবে না বলে দিল্লিতে এই দিন সাংবাদিকদের বলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতা পি সুন্দরিয়া। তিনি মনে করেন, ভারত চীনের ভয়ে নয়, বরং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভয়েই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে সিপিএমের পলিটব্যুরোর নেওয়া প্রস্তাব সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা করেন।

সিপিএমের প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে আরও সক্রিয়ভাবে সাহায্য দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সুন্দরিয়া বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে বলে তিনি মনে করেন না। চীনের সেনাবাহিনীও পাকিস্তানকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে না।

ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় দলের এক সভায় বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ভারত আরও দেরি করলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়
পক্ষেই ক্ষতির কারণ হবে। বাংলাদেশের উগ্রপন্থীদের প্রভাব তাতে বাড়বে এবং পিকিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। বাংলাদেশ আরেকটি ভিয়েতনাম হয়ে উঠলে ভারতের পূর্বাঞ্চলও হারাতে হবে।

নেতাদের সম্পত্তির নিলাম

তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের তিন নেতার অস্থাবর সম্পত্তি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা এদিন জানা যায়। এই তিনজনের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এর আগেই বাজেয়াপ্ত করা হয়।

১৩ জুলাই পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে ভারত যে অভিযোগ এনেছিল, পাকিস্তান তা এই দিন অস্বীকার করে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে দেওয়া নোটে ভারতের এই দাবিকে ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে অভিহিত করা হয়।

ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান অবরুদ্ধ বাংলাদেশে চার দিনের সফর শেষে ব্যাংককের উদ্দেশে এই দিন ঢাকা ত্যাগ করেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল নরসিংদী জেলার পশ্চিমে অহিনাশপুরের রেলপথে অ্যান্টি–পার্সোনাল মাইন দিয়ে একটি ট্রেনের চারটি বগি ধ্বংস করে। গেরিলারা রেলস্টেশনের সিগন্যাল বোর্ড ও টেলি সরঞ্জামও ধ্বংস করে।

কুমিল্লার কোটেশ্বর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঘণ্টা যুদ্ধ করে একদল পাকিস্তানি সেনাকে পিছু হটতে বাধ্য করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন হতাহতও হয়।

হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়।

টাঙ্গাইলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা শহরের একটি সিনেমা হলে হাতবোমা ছুড়লে পাকিস্তানি সমর্থকেরা আহত হয়।

বরিশালে পেয়ারাবাগানেও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।

এডওয়ার্ড কেনেডিকে নিয়ে উষ্মা

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর এবং সিনেটে শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডির অভিযোগের জবাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, সিনেটর কেনেডি যদি গোপন কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস এবং প্রশাসনের প্রতি দোষারোপ করে যেতে থাকেন, তাহলে পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষে তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি গোপন কূটনৈতিক তারবার্তা প্রকাশ করে পররাষ্ট্র দপ্তরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন গোটা বাংলাদেশ সমস্যাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে চার্লস ব্রে বলেন, গোপন কূটনৈতিক তারবার্তাটি কী করে সিনেটর কেনেডির হাতে পড়ল, তা তিনি জানেন না।

শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে বাংলাদেশ লিগ অব আমেরিকা এই দিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে লেখা একটি চিঠি পাঠায়। পত্রে তারা উল্লেখ করে, ইয়াহিয়া খান বলেছেন, শেখ মুজিবের বিচার হবে গোপন আদালতে। এতে তাঁর মানবিক অধিকার খর্ব করা হবে। বর্তমানে তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কাও আছে।

২৫ জুলাই ১৯৭১ : দেশের পতাকা উড়ল ফুটবল ম্যাচে

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন ও অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে ২৫ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ফুটবল দল ও নদীয়া জেলা একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশ না হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণনগর মাঠে উড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বাজানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। খেলায় জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ছিলেন যথাক্রমে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক। মাঠ উপচে পড়া দর্শক টিকিট কেটে খেলাটি দেখেন।

দারুণভাবে সাড়াজাগানো ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়। খেলার আয়োজক বাংলাদেশ ফুটবল সমিতি। তারা জানায়, প্রদর্শনী খেলা থেকে পাওয়া অর্থ বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে জমা হবে।

কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৬ জুলাই একটি প্রদর্শনী করে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিট দেখানো হবে। মিশনপ্রধান এম হোসেন আলী এই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। মুজিবনগর থেকে তাঁকে ডাকটিকিট পাঠানো হয়।

সোহাগপুরে গণহত্যা

শেরপুরে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও নির্দেশে এই দিন সকালে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর ও বেনুপাড়া গ্রামে গিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ড চালায়। গ্রাম দুটিতে ২৪৫ জনকে হত্যা করা হয়। সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জনকে হত্যা এবং ১৭০ জন নারীকে নির্যাতন করা হয়। ৫৯টি গণকবরের সেই সোহাগপুর গ্রাম পরে ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঢাকার ধানমন্ডির বাসগৃহ বাদে অস্থাবর সম্পত্তি প্রকাশ্যে নিলাম করে। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান এবং পিপল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমানের সম্পত্তিও নিলামে বিক্রি করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদের স্থাবর সম্পত্তি যেমন একটি দোতলা বাড়ি এবং প্রচুর কৃষিজমি ২৮ জুলাই নিলাম হবে। দুই মাস আগে এই তিনজনকে ঢাকার সামরিক আদালতে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়। অনুপস্থিতির দায়ে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলা বহাল আছে।

সর্বভারতীয় সাহিত্যিকদের একাত্মতা

কনটেমপোরারি ইন্ডিয়ান লিটারেচার সাময়িকপত্রের বাংলাদেশ বিশেষ সংখ্যা এদিন প্রকাশিত হয়। ভারতের বিভিন্ন ভাষার লেখক ও পণ্ডিতেরা এ সংখ্যায় প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধে তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে ভারত ও অন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানানোর জন্য আহ্বান জানান এবং বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা নিহত হয়েছেন প্রবন্ধে তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এতে লেখেন মুলকরাজ আনন্দ, হিন্দি ঔপন্যাসিক যশপাল, তামিল লেখক সোমোলয়, মহিশুরের বিশিষ্ট পণ্ডিত ড. হিরন্ময়, কেরালার লেখক ড. এন আর এলিডম প্রমুখ।

ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যাবর্তনেচ্ছু শরণার্থীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি জানান, তাঁর মিশন ইসলামিক সেক্রেটারিয়েট ও জাতিসংঘের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রচারিত মার্ক টালির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোতে এবং যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি হতে পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেসব স্থানে লোকবল নিয়োগ করার মতো অবস্থায় নেই। সেনাবাহিনী এখন বড়সড় আঘাতের প্রচণ্ডতা অনুভব করছে।

ঢাকার আশপাশে গেরিলা কর্মকাণ্ড

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আশপাশে এই সময়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিক্ষিপ্ত তৎপরতা বেড়ে যায়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ২৩ জুলাই রাতে ঢাকার মূল গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিলে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। গেরিলারা বিদ্যুৎ টাওয়ারে আক্রমণ চালালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এসব কর্মকাণ্ডের প্রচ্ছন্ন প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠান দুটির ২৪ জুলাইয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দুটি ২৫ জুলাই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এপিপির বরাত দিয়ে ইত্তেফাক জানায়, অনিবার্য কারণে গ্যাস সরবরাহ অবিলম্বে বন্ধ করা হবে বলে কোম্পানির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু করার সঠিক তারিখ পরে জানানো হবে। আরেক খবরে বলা হয়, কাল সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত লেন ও বাইলেনসহ কদমতলী ও দক্ষিণ বাসাবো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। মেরামতকাজের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

কুমিল্লায় একদল কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা ছাতুরার কাছে এক রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা ও ৬ জনকে আহত করে। স্থানীয় রাজাকাররা ভীত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ এবং মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার অঙ্গীকার করে।

আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার নরসিংহের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছয়জন সহযোগীকে বন্দী করে তাদের কাছ থেকে ১৪ পাউন্ড বিস্ফোরক ও তিনটি গ্রেনেড হস্তগত করে।

একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার অদূরে পুবাইলের কাছে বিস্ফোরক দিয়ে ট্রেনলাইন উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণে ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত এবং আগুন লেগে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনের আরোহী ৩০-৩৫ জন পাকিস্তানি পুলিশ হতাহত হয়।

ময়মনসিংহে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মল্লিকবাড়ি ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যান।

 

জুলাই মাস ১৯৭১ ৪, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

২৬ জুলাই ১৯৭১ : সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে তাহের-মঞ্জুর

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারজন বাঙালি কর্মকর্তা সীমান্ত অতিক্রম করে ২৬ জুলাই ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁরা হলেন মেজর আবু তাহের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও কর্নেল), মেজর এম এ মঞ্জুর (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও কর্নেল) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারি (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাঁদের মধ্যে মেজর মঞ্জুর আসেন সপরিবার।

বাংলাদেশ নীতিতে যুক্তরাজ্য অটল

পাকিস্তানি হাইকমিশনারের অনুরোধে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম এদিন পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁদের উন্নয়ন সাহায্য পেতে হলে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁদের নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

জেনেভার কূটনৈতিক মহলের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শরণার্থী গ্রহণ কেন্দ্রে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নিয়েছে। পর্যবেক্ষক দলের কাজ হবে বেশি সংখ্যায় শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার দিকে নজর রাখা এবং তাদের উৎসাহ দেওয়া।

এক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানের কাছে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাব দিলে পাকিস্তান তা বিনা শর্তে মেনে নেয়। তবে ভারত তার মনোভাব জানায়নি।

বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তে এবং যুক্তরাজ্যের সংসদ কমন্সসভায় লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউসের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চেষ্টায় ২৬ জুলাই লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট উন্মোচন করা হয়। কমন্স সভার হারকোর্ট রুমে সাংবাদিকদের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট উন্মোচন করেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

কলকাতার বাংলাদেশ মিশনেও এক অনুষ্ঠানে নতুন ডাকটিকিট দেখিয়ে সাংবাদিকদের জানানো হয় যে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। জানানো হয়, ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ডাকটিকিট জনসাধারণের কাছে বিক্রির জন্য বাংলাদেশ মিশনে একটি কাউন্টার খোলা হবে। মিশন প্রধান এম হোসেন আলী জানান, বাংলাদেশের এবং বাইরের ডাক চলাচলে ডাক যোগাযোগে এখন থেকে নতুন এই ডাকটিকিট ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশ সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নানা রঙে মোট আট রকমের টিকিটের নকশা আঁকেন বাঙালি গ্রাফিক ডিজাইনার বিমান মল্লিক।

আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে বাংলাদেশের সব বামপন্থী দল নিয়ে ন্যাপ (ভাসানী) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করছেন বলে কয়েক দিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, ২৬ জুলাই একটি বিবৃতি দিয়ে ভাসানী তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বাম, ডান বা মধ্যপন্থী, সবার একমাত্র লক্ষ্য এখন স্বাধীনতা। কিছু লোক ব্যক্তিস্বার্থে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বাম শক্তিসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।

উ থান্টের চিঠির মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। গত সপ্তাহে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে যে গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তার পরই এই বৈঠক হলো। উ থান্ট ওই বার্তায় বাংলাদেশ সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্ভাব্য সংঘর্ষের আশঙ্কা জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলোর কাছে এ ব্যাপারে অভিমত জানতে চেয়েছেন। এ সংঘর্ষ এড়াতে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কর্তব্যের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি পত্রটির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের এবং ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধির কাছে পাঠিয়ে দেন।

ভারতের সংসদে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং উ থান্টের এই চিঠির কথা বলেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা কে কী মনে করছেন, তা জানার জন্য ভারত সরকার সক্রিয় রয়েছে বলে জানানো হয়। উ থান্টের প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে সমান কাতারে রাখায় নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলের নেতাদের বলেন, সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নীতি স্থির করেনি। জাতীয় এবং বাংলাদেশের স্বার্থে যখনই প্রয়োজন হবে, তখনই এই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন সাংবাদিকদের বলেন, উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো বার্তা সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছেন। সমর সেন মহাসচিবকে তা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো সম্পর্কে সমর সেন বলেন, মহাসচিবকে তিনি বলেছেন যে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৪০ হাজার করে শরণার্থী ভারতে আসছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা কী করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।

পাকিস্তানি দূত আগা শাহি উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের কাছে লিখিত পত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিস্তৃতভাবে তিনি জানতে চেয়েছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা শান্তির জন্য বিপজ্জনক। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।

২৭ জুলাই ১৯৭১ : বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ, উ থান্ট নীরব

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র ২৭ জুলাই জানায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের একটি ঘরোয়া বৈঠক ডাকবেন। এ জন্যই তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর অভিমত জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। সূত্রটি জানায়, উ থান্টের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে ভারতের অবস্থান এবং নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উঠলে ভারতের প্রতিনিধির নীতি কী হবে, তা স্থির করার জন্য দিল্লিতে ভারত সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে।

উ থান্টের প্রস্তাবিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটিতে আলোচনা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব প্রস্তাব করেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা চাইলে
বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা যাবে।

চার মাস ধরে বাংলাদেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি করা বিভীষিকা নিয়ে উ থান্টের প্রস্তাবে কিছু না থাকায় ভারত সরকার বিস্ময় প্রকাশ করে। রাজনীতিবিষয়ক কমিটি উ থান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী শুধু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার বিরোধী। সরকারের এ অভিমত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। কারণ, সরকার মনে করে, বাংলাদেশ ও ইসলামাবাদের সামরিক চক্রের বিরোধই আসল বিষয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশি শরণার্থীদের ভারত থেকে দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে পাকিস্তানের করা অভিযোগকে ভাঁওতা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার একাধিকবার সুস্পষ্টভাবে বলেছে, শরণার্থীরা শিগগির সম্ভব দেশে ফিরে যাওয়াটাই তাদের কাম্য। দিল্লিতে ২৭ জুলাই কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ফোরাম আয়োজিত সমাবেশের বক্তৃতায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সমাবেশে যোগদানকারীরা এর আগে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারতবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনবিদ শন ম্যাক্সব্রাইড পাকিস্তানে যাবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার এবং তাঁর প্রাণদণ্ডের আশঙ্কা রোধ করাই তাঁর পাকিস্তান সফরের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর মক্কেল শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় কি না, সেটি উদ্বেগের সঙ্গে সবাই লক্ষ করছিলেন।

অবরুদ্ধ দেশে মুক্তির অভিযান

মৌলভীবাজার জেলায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছোটলেখা চা-বাগানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। দুই পক্ষে তুমুল সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুরুতর আহত হন।

সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

শেরপুর জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নালিতাবাড়ী থানার তন্তর ও মায়াঘাসিতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মেজবাহ উদ্দিন গুরুতর আহত হন।

বৃহত্তর চট্টগ্রামে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হেঁয়াকু ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

চীনের সমালোচনা

সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রতি চীনের মনোভাব বিপর্যয়কর ও বেদনাদায়ক। অতীতে চীন সর্বত্রই জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা অত্যাচারীর পক্ষ নিয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী এই দিন সোনামুড়া নামে ভারতের উত্তর-পূর্বে একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ করলে তিন ব্যক্তি নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।

এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসামের সীমান্ত গ্রাম লাতুর ওপরও মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। এতে তিনজন নারীসহ আটজন আহত হন। বেশ কিছু বাড়িঘর ধ্বংস হয়।

২৮ জুলাই ১৯৭১ : মার্কিন অস্ত্র সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন পাকিস্তানে

 

মাওলানা ভাসানী

 

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটা থেকে নির্বাচিত সিনেটর জর্জ ম্যাকগভার্ন ২৮ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে লেখা এক চিঠিতে প্রশ্ন করেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চীন সফরে সহায়তা করার বখশিশ হিসেবেই কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ইয়াহিয়া খানকে দেড় কোটি টাকা দামের অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য করছে? পাকিস্তানকে আর অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে না বলে ১৫ এপ্রিল পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণার পরও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাঠানোর উদ্যোগে এ প্রশ্ন ওঠে। তিনি বলেন, মানবিক সাহায্য ছাড়া পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনোভাবেই জড়িয়ে পড়া উচিত নয়।

বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের প্রচেষ্টা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো কিংবা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা এড়ানো সম্ভব হবে না। সমস্যা সমাধানে যেসব পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে, তা হলো এক. শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া; দুই. নিরাপত্তা পরিষদের একযোগে ব্যবস্থা নেওয়া; তিন. বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীর দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের মনে বিশ্বাস ও নিরাপত্তার মনোভাব ফিরিয়ে দেওয়া।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিনারের প্রতিনিধি জন কেলি জেনেভা থেকে ইসলামাবাদে আসেন। ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর সফরের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ইসলামাবাদে নিয়োজিত ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র দপ্তরে তলব করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেপরোয়া কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসূচক নোট দেয়। নোটে বলা হয়, ২৬ জুলাই কুমিল্লা শহরে ভারতের ছুড়ে মারা শেলে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।

করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্লিফটন হাউসে দলের শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভুট্টোর সভাপতিত্বে বৈঠকে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে দলের প্রস্তাব ও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

দিনাজপুরে স্থানীয় সামরিক প্রশাসন ঘোষণা করে, যারা বাড়িঘর ত্যাগ করেছে, তারা আর এক দিনের মধ্যে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে না এলে বাড়ির মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। আরেক ঘোষণায় পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়।

গেরিলা অভিযান মুক্তিবাহিনীর

মুক্তিবাহিনীর একটি দল এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদানদী এলাকায় বিধ্বস্ত সেতুর কাছে পাকিস্তানি অনুগত পুলিশের ক্যাম্পে হামলা করলে দুজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হরিমঙ্গলে একটি সেতুর দুই পাশ উড়িয়ে দেয় এবং আনন্দপুরের কাছে পাকিস্তানিদের একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় আক্রমণ করে। বিজনা সেতু এলাকায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল কায়েম গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।

মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ইছামতী নদীর তীরে পাকিস্তানি বাহিনীর উস্কা ঘাঁটির কাছে একটি খুঁটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারপাশে অ্যান্টিপারসোনাল মাইন পুঁতে কাছের ধানখেতে ওত পাতেন। পাকিস্তানি সেনারা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পতাকাটি দেখে নামানোর জন্য এগোলে মাইন বিস্ফোরণে তারা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্র নিয়ে ঘাঁটিতে ফিরে যান।

পঞ্চগড় জেলার প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা চাওয়াই নদের তীরে তাদের মূল ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে সেদিন ওই এলাকায় যায়। দুই পক্ষের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি সেনারা তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

কুমিল্লার হোমনা থানার সাঘুটিয়া লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়।

বাঙালি সেনা কর্মকর্তা পালিয়ে ভারতে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরও পাঁচ বাঙালি কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে এসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছেড়ে ভারতে চলে আসা বাঙালি কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়াল ১৩।

ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, একাত্তরের মার্চের পর ভারতের সীমান্ত বরাবর চীনা সেনাবাহিনীর বড় রকমের সমাবেশের খবর সরকারের গোচরে আসেনি। ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ভারত এখনই নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে না। অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলতে পারে কি না এবং তুললে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে। বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে।

২৯ জুলাই ১৯৭১ : নতুন ষড়যন্ত্র ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর

পাকিস্তান পিপলস পার্টির একটি প্রতিনিধিদল তাদের চেয়ারম্যান ভুট্টোর নেতৃত্বে ২৯ জুলাই করাচিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করে। আলোচনার বিষয়বস্তু কোনো খবরে প্রকাশ করা হয়নি। ভুট্টো শুধু সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে তিনি এখনই কিছু বলবেন না। কারণ, সমস্যা তাতে আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খর্ব করতে ইয়াহিয়া খান নতুন ষড়যন্ত্র করছেন। জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের সদস্য হওয়ার অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করে সেসব শূন্য পদে উপনির্বাচন করতে ইয়াহিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে নির্দেশ দিয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকা থেকে করাচি ফিরে পাকিস্তান সফররত তুর্কি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা কাসিম গুলেক করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্য জাতীয় পরিষদের বহু সদস্যকে অযোগ্য ঘোষণা করে তাদের আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। পাকিস্তান সরকার নির্বাচন বাতিল করেনি।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুকুন্দপুর-হরশপুর রেলস্টেশন এলাকা, কুমিল্লার দেবীদ্বারের জাফরগঞ্জ, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের সাচনা, হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া ও চুনারুঘাট, সাতক্ষীরার ভোমরা এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতি সাধন করে। ভালুকায় মুক্তিবাহিনীর আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর গুপ্তচরদের অ্যামবুশ করলে তাদের তিনজন সহযোগী নিহত হয়।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক

জাতিসংঘের কূটনৈতিক মহল ২৯ জুলাই সাংবাদিকদের জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের উদ্যোগকে সমর্থন করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। এ মাসের গোড়ায় নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ফ্রান্সের জাক কোসসিউস্কো মরিসের কাছে পাঠানো এক গোপন স্মারকপত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মানবিক ও রাজনৈতিক দিক, গেরিলা লড়াই, বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি, সেখানে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে উ থান্ট তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ভারত ইতিমধ্যেই পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছে। তবে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে উ থান্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে কি না, তা জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সমগ্র বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্য বিতর্কের পক্ষপাতী নয়। কোনো রকম প্রকাশ্য বিতর্ক ছাড়া পরিষদে ঘরোয়াভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাজি করানোও সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থী বিচার বিভাগীয় উপকমিটির চেয়ারম্যান ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ঘনিষ্ঠ মহল থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যাপার পর্যবেক্ষণের জন্য এডওয়ার্ড কেনেডি আগামী মাসে ভারত ও পাকিস্তান সফর করবেন। তিনি ভারতের ভিসা পেয়েছেন। পাকিস্তানের কাছেও ভিসার আবেদন করেছেন।

উপকমিটির আরেক সদস্য রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর চার্লস ম্যাসিকাসও ভারত-পাকিস্তান সফরের কথা ভাবছেন। এই উপকমিটির সদস্যরা প্রথমে ঢাকা এবং পরে ভারতে যাবেন বলে জানানো হয়েছে।

পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড হোয়াইট হাউসে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তান-ভারত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।

ব্রিটেনের মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা ইতিমধ্যে ঢাকায় দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে চারটির মধ্যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হন। তাঁরা সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের বাসভবনও আক্রমণ করেন।

ব্রিটেনের বিভিন্ন পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয়, অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে ১ আগস্ট একটি গণসমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ’ নামে জর্জ হ্যারিসনের নতুন রেকর্ডটি বেলা দুইটার সময় ট্রাফালগার স্কয়ারের সমাবেশে বাজিয়ে শোনানো হবে। একই সময় নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে রেকর্ডটির উদ্বোধন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

অ্যাকশন বাংলাদেশের একজন মুখপাত্র বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে এই জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। লন্ডনের বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলো এদিন সংহতি দিবস পালন করে বন্ধ রাখবে। সমাবেশে বাংলাদেশের পশ্চিমা সমর্থকেরা বক্তব্য দেবেন।

৩০ জুলাই ১৯৭১ : জল্পনা উ থান্টের প্রস্তাব নিয়ে

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ৩০ জুলাই সরকারি একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখার প্রস্তাব করেছেন। এই বিচার–বিবেচনা আনুষ্ঠানিক, না ঘরোয়া হবে, তা স্থির করার ভার তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে লেখা একটি চিঠিতে উ থান্ট এ কথা বলেন। পরিষদের সব সদস্যরাষ্ট্রকে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়।

রয়টার্স জানায়, জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সভাপতি জাক কোসসিউস্কো সপ্তাহখানেক আগে
পাওয়া ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের গোপন স্মারকলিপির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের ব্যাপারে ১৫ জাতি পরিষদের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করেছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে জড়িয়ে মহাসচিবের প্রস্তাবে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা মনে করে, এ উদ্যোগ মূল বিষয় থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব বলে তুলে ধরার অভিসন্ধি। সমস্যাটিকে ভারত–পাকিস্তানের বিরোধ হিসেবে তুলে ধরার কোনো প্রচেষ্টাতেই ভারত যুক্ত হতে অসম্মতি জানায়।

ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজসভায় জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এ বছরের বাজেটে বরাদ্দ করা ৬০ কোটি ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। আরও টাকা দরকার। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থী আসার সম্ভাবনা ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, শরণার্থী শিবিরগুলো দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত বিদেশিদের বদলে এখন সেখানে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার ২৬ জন প্রতিনিধিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চলে যাওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এমন বিদেশি কর্মী প্রায় ৪৮ জন। বাকিদেরও চলে যাওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে।

সফল গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর একটি দল ইমামুজ্জামানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চার মাইল দক্ষিণে নানকরায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত এবং একজন আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।

কুমিল্লার শ্রীমন্তপুর, কোটেশ্বর আনন্দপুর ও নারায়ণপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল আশুগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ লাইনে সরবরাহকারী বৈদ্যুতিক গ্রিডের দুটি থাম ধ্বংস করলে আশুগঞ্জ-ঢাকা বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এই মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ভৈরব-নরসিংদী-ঘোড়াশাল বাইপাস আশুগঞ্জ-ঢাকা লাইনের ১০০০ কিলোওয়াট গ্রিডের একটি থামও ধ্বংস করে এবং ভৈরব-ঢাকা টেলিফোন লাইনের দুটি করে মোট চারটি থাম ধ্বংস করে উপড়ে ফেলে।

বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘পূর্ববঙ্গে গণহত্যা’ শিরোনামে এদিন আধা পৃষ্ঠার একটি বিজ্ঞাপন ছাপে। বিজ্ঞাপনে ঢাকার রাস্তায় তিন তরুণের মৃতদেহের একটি ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘ছবিটি আপনার ছেলেমেয়েদের দেখান এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে ১ আগস্টের জনসমাবেশে যোগ দিন।’ অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ অন্য বক্তাদের নাম এবং বার্মিংহাম, ব্র্যাডফোর্ড, কেমব্রিজ, কার্ডিফ, কভেন্ট্রি, গ্লাসগো, লিডস, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, পোর্টসমাউথ ও শেফিল্ড থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য টেলিফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়। গণসমাবেশে যোগ দিতে অসমর্থদের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানো হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে এদিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করা হয়। সিনেটে প্রস্তাব পেশ করেন সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল; প্রতিনিধি পরিষদে ডোনাল্ড ফ্রেজার। দুজনই ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য। বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর জেমস পিয়ারসন সিনেটে বলেন, পররাষ্ট্র দপ্তর যদি পাকিস্তানকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে না পারে যে বাংলাদেশের মানুষকে বর্বরভাবে হত্যা করাটাকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমার চোখে দেখছে না, তাহলে সিনেট আইন করে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তান ব্যবস্থা না নিলে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ উভয়েই পাকিস্তানকে এ সাহায্য বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর ইউজিন ম্যাককার্থি লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে তিনি সমর্থন করেন। নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও তিনি স্বাধীন বায়াফ্রার দাবি সমর্খন করেছিলেন। তিনি মনে করেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি অধিকতর যুক্তিসংগত।

ব্রিটেনের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির নেতারা ইউজিন ম্যাকার্থীকে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে এই দিন তিনি ডরচেস্টার হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন।

৩১ জুলাই ১৯৭১ : ভয়াবহ যুদ্ধ কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে

ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও মেজর) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের (শহীদ, স্বাধীনতার পর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত) নেতৃত্বে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তিবাহিনীর দুটি দল ৩১ জুলাই জামালপুর জেলার কামালপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটিতে (বিওপি) আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দুটি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত। কিছুটা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিটিও ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং আর্টিলারি ও ভারী মর্টারে সজ্জিত।

মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলে পাকিস্তান সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষে কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ৫৯ জন নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৩১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে শহীদ হন। আহত হন ৬৫ জন যোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘কামালপুর যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত এবং অসম্ভব আলোচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর এটি ছিল প্রথম প্রথাগত আক্রমণ। ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নির্দেশে এবং মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) অধীনস্থ ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানির পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে অংশ নেন।

১১ নম্বর সেক্টরভুক্ত মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল এই দিন লেফটেন্যান্ট এস আই নুরুন্নবী খানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি সেনা–অবস্থানে অতর্কিতে হামলা চালায়। দুই পক্ষের এক ঘণ্টা স্থায়ী তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাবারুদ ভর্তি একটি বার্জ পানিতে ডুবে যায়। বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কসবার একটি ঘাঁটি আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণের চাপে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।

কুমিল্লায় একদল পাকিস্তানি সেনা চৌদ্দগ্রাম থেকে এবং আরেকটি দল জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে নানকারার কাছে এলে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আরও নজরদারি

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় জানায়, ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জানমাল রক্ষায় নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সিগুলো দিবারাত্রি গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখবে।

ঢাকার ১ নম্বর সামরিক আইন সাবসেক্টর থেকে সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বার, অভিনেত্রী কবরী, মন্নু ওরফে দলিলউদ্দিন, খসরু ওরফে কামরুল আনাম খান, মন্টু ওরফে মোস্তফা মহসীনসহ ১৯ ব্যক্তিকে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিতে তলব করা হয়। তাঁরা নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হাজির হতে ব্যর্থ হলে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হবে বলে জানানো হয়।

পাকিস্তান সফররত পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তুল মাশায়েখের প্রেসিডেন্ট ও শর্ষিনার পীর এদিন লাহোরে বলেন, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বাইরে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।

রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হলে পাকিস্তান তাকে স্বাগত জানাবে।

পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ

ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত এই দিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনকে মুহিত বলেন, একটি আত্মহননকারী সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা অসম্ভব ব্যাপার।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর দলের কর্মী সমাবেশে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা মোকাবিলায় বিরোধী দলের নেতারা তাঁর হাত শক্ত করতে চান বলে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কয়েকটি দল এখন বাধা সৃষ্টি করছে। অনেকে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, শরণার্থীরা চিরকাল থাকবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো দেশ ভারতকে কিনতে পারবে না। এ ব্যাপারে ভারত কারও নির্দেশও শুনবে না।

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য ভারতের কংগ্রেস দলীয় সদস্য প্রণব মুখার্জি এদিন রাজ্যসভায় একটি বেসরকারি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের সমর্থনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন সি চাগলা জোরালো যুক্তি দেখিয়ে ভারত সরকারকে সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। রাজ্যসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং উপস্থিত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি।

বাংলাদেশে গণহত্যায় নেপাল সরকারের ঔদাসীন্যে দুঃখ প্রকাশ করে নেপালের জাতীয় পঞ্চায়েতের কয়েকজন সদস্য বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় উদ্ভাবনে নেপালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে তাঁরা গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment