জুন মাস ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

জুন মাস ১৯৭১ ৪ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা-দেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

Table of Contents

জুন মাস ১৯৭১ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

“জুন মাস ১৯৭১ ১”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১ মে ১৯৭১, বিদেশি নেতাদের সমর্থন বাংলাদেশকে

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি জে ডব্লিউ ফুলব্রাইট একাত্তরের এই দিনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) ব্যাপারে নীরব থাকা মানে পাকিস্তানি বর্বরতাকে সমর্থন করা। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জন রোডের চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে তিনি এ কথা বলেন। জন রোড চিঠিতে লিখেছেন, পাকিস্তানিরা জংলি আইন চালাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। তারা হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে খুন করছে। খুন করছে বুদ্ধিজীবীদের। ধ্বংস করছে হিন্দুদের।

রোড তাঁর চিঠি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পেশ করলেও তা গোপন রাখা হয়েছিল। বিষয়টি উল্লেখ করে সিনেটর ফুলব্রাইট বলেন, পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা না করে এবং এসব তথ্য গোপন রেখে পররাষ্ট্র দপ্তর কার্যত ঘটনাগুলো সমর্থন বা অনুমোদন করেছে।

পাকিস্তানকে সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসনের পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ফ্রাংক জাড। এ বিষয়ে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমকে চিঠি দেন।

পাকিস্তানে ও ভারতে

ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এ দিন জানায়, স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে তাঁদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে অতিথি শিক্ষক হিসেবে সেখানে সাময়িকভাবে চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পাকিস্তানের তথ্য দপ্তর জানায়, সরকার কিছু নির্বাচিত সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি দেবে। তবে যাঁদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে এর আগে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের এ অনুমতি দেওয়া হবে না।

পাকিস্তানি সেনারা এই দিনও ভারতের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে ও গোলাবর্ষণ করে। তাদের গোলায় পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর রেলস্টেশনের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া একজন শরণার্থী নিহত ও ছয়জন ভারতীয় আহত হয়।

কুমিল্লার লাকসামের বগাদিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে সেতু ধ্বংস হয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

জুন মাস ১৯৭১ - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রঃ অল ইন্ডিয়া রেডিওকে তাজউদ্দীন

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২ জুন মুজিবনগরে অল ইন্ডিয়া রেডিওকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। জনগণ যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে রক্ষা করবে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে, বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতেও বিশ্বাসী।

অন্যদিকে অসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দেওয়া প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির জবাবে এই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত চলবে। তিনি বাংলাদেশ ইস্যুর কোনো রকম রাজনৈতিক মীমাংসা বা বোঝাপড়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।

মাওলানা ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রধান লক্ষ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া। এ জন্য তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবে। হয় বিজয়, নয় মৃত্যু।

মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে সব রকম সাহায্য বন্ধ ইত্যাদির জন্য একটি সর্বদলীয় কমিটি করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তানের ভেদনীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেন।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ছুটিতে থাকা বা ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তাতে বলা হয়, যাঁরা যোগ (১৫ দিনের মধ্যে) দেবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এক সামরিক আদেশে বলেন, ঘোষিত তারিখের পর ১৫ দিনের মধ্যে শিক্ষকেরা কাজে যোগ না দিলে তাঁদের চাকরিচ্যুত এবং সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।

আরও সমর্থন বহির্বিশ্বে

পোপ ষষ্ঠ পল এদিন ভ্যাটিকান সিটি থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ভাগ্যহত মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা জানান।

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কানাডা দেড় কোটি ভারতীয় মুদ্রার সমমূল্যের খাদ্য ও ওষুধ সাহায্য দেবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিও শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ২৫ লাখ ডলারের খাদ্য পাঠাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশি শরণার্থীদের অবিলম্বে সাহায্য দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং শরণার্থীদের অভাবের মধ্য দিয়ে এক মহাদুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবী আর কত দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি দেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখবে?

অ্যাকশন বাংলাদেশ এই দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনে একটি সভার আয়োজন করে। সভায় ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন সদস্য জন স্টোনহাউস, পিটার শোর ও মাইকেল বার্নস বক্তব্য দেন।

জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, তিনি শান্তিবাদী হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র যুদ্ধের নিন্দা করতে মোটেই সম্মত নন। যুদ্ধের জন্য ভারতের দ্রুত তৈরি হওয়া উচিত।

সভায় মাইকেল বার্নস বলেন, পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডি পাকিস্তানের ঘরোয়া বিষয় নয়। বাঙালিদের রক্ষায় বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।

ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ও এএসপি নেতা রাজনারায়ণ সরকার এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিবাদে রাজ্যসভার অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। এর আগে তিনি রাজ্যসভায় বলেন, বাংলাদেশের আইনসভার সদস্যরা অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো সত্ত্বেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।

এই দিনে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য পাঞ্জাব রাজ্যের মন্ত্রিসভা ১৫ লাখ টাকা মঞ্জুর করে।

পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জেলা শাসক সাংবাদিকদের জানান, সেখানকার শরণার্থীশিবিরগুলোতে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ৪ দিনে প্রায় ১ হাজার ৫০০ শরণার্থী কলেরায় মারা গেছে। আক্রান্ত দুই হাজার শরণার্থী হাসপাতালে ভর্তি আছে। নদীয়া জেলাকে অবিলম্বে মহামারিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসক পাঠাতে রাজ্য সরকারের কাছে তিনি আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান, সৎকারের জন্যও লোকের অভাব রয়েছে।

 

জুন মাস ১৯৭১ - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ আটকের পর (১২ এপ্রিল ১৯৭১)

 

৩ জুন ১৯৭১: সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে উ থান্ট

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ৩ জুন জাতিসংঘে কর্মরত সাংবাদিকদের দেওয়া এক মধ্যাহ্নভোজ সভায় যোগ দেন। এ সময় বাংলাদেশ নিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি এবং সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার মানবেতিহাসের চরম এক বিয়োগান্ত ও বিষাদময় ঘটনা। মানুষের ইতিহাসে এই জঘন্যতম কলঙ্কের তুলনা নেই।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিপীড়নে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অসংখ্য শরণার্থী পালিয়ে চলে এসেছে। তারা এখন ভারত সরকারের সামনে বিরাট এক সমস্যা। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রয়োজন। শরণার্থীদের নিয়ে ভারত যে সমস্যায় পড়েছে, ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই।

জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লেখা একটি চিঠি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাতো পেয়েছেন। ১ জুন জাপানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ভিনসেন্ট কোরেলো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠিটি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিচি আইদি ইসাইদের হাতে দেন।

ইন্দিরা গান্ধী সে চিঠিতে বাংলাদেশের ঘটনাবলিসহ শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, ভারত এর জন্য আদৌ দায়ী নয়। চিঠিতে তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এদিন লন্ডনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত বাঙালিদের বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ সাংসদদের সঙ্গে আলোচনা করেন। হাউস অব কমন্সে এ আলোচনা সভায় জয়প্রকাশ নারায়ণ ব্রিটিশ এমপিদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশে অবস্থার উন্নতির জন্য আপনারা পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন।

পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার সাংবাদিকদের জানান, কলকাতা ও এর আশপাশে ইতিমধ্যেই ৪০-৫০ হাজারের মতো শরণার্থী এসে পড়েছে। কল্যাণীতেই চার শিবিরে প্রায় এক লাখ শরণার্থী। এ ছাড়া কলকাতার উপকণ্ঠে সল্ট লেক এলাকায় প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। পাঁচ-ছয় দিন আগে দমদম বিমানবন্দরসংলগ্ন গৌরীপুর মাঠে প্রায় ২০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করেছে।

ব্রিটেনের বামপন্থী সাপ্তাহিক নিউ স্টেটসম্যান ৩ জুন সংখ্যায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাহায্যের আবেদনে যারা সাড়া দেবে, তারা স্বার্থপর। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করলেও মানুষের দুর্দশার অবসান হবে না, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অবসান হতে পারে মাত্র

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এস এম সোলায়মান পশ্চিম পাকিস্তানে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তাঁরা জানান, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সমমনা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

ঢাকায় এক সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি অবৈধ ও গোপন আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান দিলে বা উদ্ধার করে দিলে কিংবা জমা দিলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।

নারী শিল্পপতি লায়লা খালেদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পপতিদের একটি প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

দক্ষিণবঙ্গের ঝালকাঠিতে পাকিস্তানি সেনারা এদিন অনুগত পুলিশের সহায়তায় সুধীর দত্তসহ ১১ জনকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

কয়েকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা ঢাকায় যুক্ত বিবৃতিতে মুক্তিবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পূর্ব পাকিস্তানের অনুগত নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশীয় সহযোগী সমন্বয়ে গড়া বড় একটি দল নিয়ে কয়েকটি নৌকাযোগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া এবং পয়সার হাটের খাল দিয়ে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটালীপাড়া ঘাঁটি আক্রমণ করতে রওনা হয়। পথে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা খালের দুপাশ থেকে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কয়েকজন পুলিশ সদস্য এবং এদেশীয় সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ইব্রাহিম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

একটি পাকিস্তানি সেনাদল মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাব-সেক্টরের অধীন একদল মুক্তিযোদ্ধার ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম পর্যায়ে ভারত সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি দখল করে নেয়। পরে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আবার পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে ঘাঁটি দখল করে নেন। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

৪ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা অব্যাহত যুক্তরাজ্যে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যুক্তরাজ্যে গঠিত অ্যাকশন কমিটির লন্ডন শাখা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব ভ্রমণরত ভারতীয় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানে ৪ জুন লন্ডনে এক চা-চক্রের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অ্যাকশন কমিটির পক্ষে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষে শেখ আবদুল মান্নান বক্তব্য দেন।

সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশের ঘটনাবলি জানাতে লন্ডনে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমনওয়েলথ রিলেশনস অফিসের ভারত উপমহাদেশের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল অ্যান্থনি কেরশার।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালি নারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে মিছিলের আয়োজন করে। প্রায় ২০০ নারী ও শিশু সেন্ট জেমস পার্ক থেকে মিছিল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যায়। অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যার অবসান এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিসংবলিত পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড হাতে শাড়ি পরা নারীদের মিছিল পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পশ্চিমা চিন্তাধারায় সমাধান নেই

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এম আমীর-উল ইসলাম ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ৪ জুন বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো মীমাংসা করতে গেলে সেখানকার জনগণের নৈতিক ও আইনগত অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। দিল্লি প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিল্লি সফররত বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের তিন সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, নূরজাহান মুরশিদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।

এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চিন্তাধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক মীমাংসায় সম্মত নয়। তিনি আরও বলেন, সামরিক বা রাজনৈতিক মীমাংসা নয়, প্রয়োজন নৈতিক ও আইনি অধিকার। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জয় সুনিশ্চিত।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র জয় বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ ব্যাপারে অন্য কোনো ফয়সালার সুযোগ নেই।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ইসমত কিতানি এই দিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মুহাম্মদ।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি নেতা মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি ও আবদুল হাফিজ কারদার ঢাকা থেকে ৪ জুন পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে বলেন, আওয়ামী লীগ ও অন্য বাম দলগুলো না থাকায় এটিই পিপিপির জন্য পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার উপযুক্ত সময়।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশের দলত্যাগী সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলে, স্বেচ্ছায় এলে সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে।

একটি পাকিস্তানি সেনাদল স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে ৪ জুন রাতে নাটোরের ছাতনীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে হানা দিয়ে নিদ্রিত লোকদের ঘুম থেকে তুলে পিছমোড়া করে বাঁধে। প্রায় ৫০০ গ্রামবাসীকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় ঝালকাঠির পাঁজিপুথিপাড়ায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

ভারতে বাংলাদেশ

ভারতের লোকসভায় এই দিন বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে বিতর্ক হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, শরণার্থীদের দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। শরণার্থীস্রোতের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় নিয়ে সরকার ভাবছে।

বনগাঁ ও দমদমে শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে এসে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বিদেশবিষয়ক কমিটির এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স উপকমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলায় ব্যাপক গণহত্যা ও লাখ লাখ মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের তথ্য এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।
সিকিম সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য তহবিলের জন্য তিন লাখ টাকার চেক পাঠায়। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা প্রশাসন এই দিন জানায়, নদীয়া জেলায় গতকাল পর্যন্ত কলেরায় আক্রান্ত ২ হাজার ৫৫০ জন শরণার্থী মারা গেছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদানদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা আবার সেখানে আক্রমণ চালিয়ে অক্ষত অবস্থায় ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার রাজাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি করে।

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

৫ জুন ১৯৭১ : শুধু স্বীকৃতিতে লাভ নেই: ইন্দিরা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির একটি প্রতিনিধিদল ৫ জুন কলকাতায় সফরে আসা দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধিদলকে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি তাঁরা সব সময় বিবেচনা করে দেখছেন। তবে শুধু স্বীকৃতিতেই বিশেষ কোনো লাভ হবে না। প্রতিনিধিদলে ছিলেন জয়নাল আবেদীন, অমিয় দাশগুপ্ত, নির্মল বসু প্রমুখ। তারা শরণার্থীদের সাহায্য এবং অন্য ব্যবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একটি উপকমিটি গঠন করে কলকাতায় তার প্রধান কার্যালয় করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্দিরা গান্ধী এই দিন রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাদাভাবে বৈঠক করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

আলোচনা শেষে ইন্দিরা বলেন, শরণার্থীদের সব দায়িত্ব কেন্দ্রের। এই গুরুতর ঘটনার ফলাফল গুরুতর হতে বাধ্য। সারা বিশ্বের এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনো পর্যাপ্ত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ভারতের সরকারি মুখপাত্রের তথ্য থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও মালদহ জেলায় এর প্রকোপ প্রচণ্ড। ৩ জুন পর্যন্ত ৩ হাজার শরণার্থী কলেরায় মারা গেছেন।

সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এক বিবৃতিতে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের বিপ্লবী নেতা তারিক আলী বাংলাদেশের বিপ্লবকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাব্য দিক নিরূপণের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং বিপ্লবী মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ইয়াহিয়া খানকে চীনের সমর্থনের বিষয়ে প্রকাশ্যে নিন্দাও করেন তিনি।

বিশ্বমঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ

৫ জুন ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় রেহমান সোবহানের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে তিনি মুজিব–ইয়াহিয়া আলোচনার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত ১ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে পূর্ববঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আগের দিন প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেহমান সোবহান পাকিস্তানে বিদেশি সাহায্য বন্ধ রাখার পক্ষে যুক্তি দেন।

নিউইয়র্ক টাইমস এই দিন সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সিডনি শনবার্গ লেখেন, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হিসাবে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৬০০ হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি সম্ভবত ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিনের খেলা শুরুর আগে প্রায় তিন হাজার প্রবাসী বাঙালি এজবাস্টন মাঠে বিক্ষোভ করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা উপলক্ষে এই দিনের বিক্ষোভ ছিল বৃহত্তম। বিক্ষোভে অনেক নারীও ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে রক্তরঞ্জিত কুশপুত্তলিকা হাতে নিয়ে মাঠের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই প্রতিবাদ দর্শক ও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

জাতিসংঘ জানায়, পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের ত্রাণদলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজি হয়েছেন। আগের দিন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ইসমত কিতানি রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনার সময় ইয়াহিয়া খান তাঁর সম্মতির কথা জানান।

নেদারল্যান্ডস ও অস্ট্রেলিয়া ওষুধ, ত্রাণসামগ্রীসহ পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য অর্থসাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন ২৩ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে। এ আদেশে ঘোষণা করা হয়, কোনো সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির চাকরির শর্তে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বা প্রাদেশিক সরকার দেশ কিংবা দেশের বাইরে যেকোনো স্থানে তাকে পাঠাতে পারবে।

মাগুরায় শ্রীপুরবাহিনী বা আকবর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থানার রামদিয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়িতে অভিযান চালায়। তাঁরা চাঁদ খাঁ এবং তার সহযোগীদের খতম করতে সক্ষম হন। পরদিন (৭ জুন) স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর এই সফল অভিযানের খবরটি প্রচার করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বাধা দিতে লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে জমজমা রেলওয়ে সেতু ধ্বংস করে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

মহামায়া বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনীর সড়কপথে চাঁদপুর-কুমিল্লা যাতায়াত বিচ্ছিন্ন করে।

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

৬ জুন ১৯৭১: চার পূর্বশর্ত ঘোষণা রাজনৈতিক সমাধানে

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৬ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেওয়া এক ভাষণে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চারটি পূর্বশর্ত ঘোষণা করেন। শর্তগুলো হলো: ১. বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আটক সব গণপ্রতিনিধির অবিলম্বে মুক্তি; ২. বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপসারণ; ৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি; এবং ৪. মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণে বাংলাদেশের অধিবাসীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এসব দাবি পূরণ হলেই কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে, নইলে নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব বাঙালি একসঙ্গে লড়েছেন। বুকের রক্ত ঢেলে সবাই প্রমাণ করেছেন, তাঁরা অসাম্প্রদায়িক।

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে সৈয়দ নজরুল বলেন, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যে মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন, জাতি তাতে গর্বিত। শহীদ ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।

ভারতে অব্যাহত সমর্থন

ভারতের লক্ষ্ণৌয়ে সংখ্যালঘুদের জাতীয় সম্মেলনে বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ফণীভূষণ মজুমদার এবং সদস্য নূরজাহান মুরশিদ বক্তব্য দেন।

নূরজাহান মুরশিদ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখার প্রশ্ন আর উঠতে পারে না।

সংখ্যালঘু সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে লোকসভার সহকারী নেতা জি জি সোহেল বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, ঐক্য ও শান্তিশৃঙ্খলা যেন রক্ষা করা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে তাড়াহুড়া করে কেবল স্বীকৃতি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, কেন্দ্র বা সেনাবাহিনী শরণার্থীর ভার নিতে অনিচ্ছুক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেক শ কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শরণার্থীদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর অজয় মুখার্জি এ কথা বলেন।

বিশ্বনেতাদের সঙ্গে জনসংযোগে ভারত

বাংলাদেশের বিষয়ে বিশ্বনেতাদের জানাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ছয়টি দেশ সফরের প্রথম পর্যায়ে ৬ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) রাজধানী মস্কো পৌঁছান। ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যাবেন। সেখান থেকে লন্ডন হয়ে তাঁর ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও এই দিন লন্ডনে ব্রিটেনের রাজনীতিবিদ ও সরকারি প্রতিনিধিদের বলেন, বিশ্বসমাজ পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তাড়াতাড়ি কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারলে পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ভারত চরম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে পারে।

হাঙ্গেরিতে রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য একটি বেসরকারি তহবিল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশটির শ্রমিকেরা এই তহবিলে এক দিনের পারিশ্রমিক দেওয়ার ঘোষণা দেন।

যুক্তরাজ্যের টাইমস পত্রিকা এই দিন সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যত দিন না সুবুদ্ধি হয়, তত দিন পর্যন্ত বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখার জন্য আবেদন জানায়। নিবন্ধে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে নিবৃত্ত রাখার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

পাকিস্তানকে সামরিক ঋণ দিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে অনুরোধ করেছেন, তা মঞ্জুর না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে গার্ডিয়ান পত্রিকা।

পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে

করাচির কূটনৈতিক মহল জানায়, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ১০ জুন ওয়াশিংটনে চলে যাচ্ছেন। তিনি আর ফিরবেন না। যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশনার ফ্রাঙ্ক সার্জেন্টও সপ্তাহখানেক পর লন্ডনে ফিরে যাবেন। দুজনের কার্যকালের মেয়াদ তখনো শেষ হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাত থেকে গণহত্যা শুরু করলে আর্চার ব্লাডের পাঠানো দাপ্তরিক চিঠি উদ্ধৃত করে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সভাপতি উইলিয়াম ফুলব্রাইট বিবৃতি দিয়েছিলেন। আবার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ নেওয়ার সময় মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক সার্জেন্ট অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে এই দুজনকে নিয়ে পাকিস্তানে বিতর্ক শুরু হয়।

জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদি মুসলিম বিশ্বের নেতা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে বলেন, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মুসলিম বিশ্বে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তকর তথ্য পরিবেশন করছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করছে বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে চাঁদগাজীতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ মোকাবিলা করেন। সেখানে যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা লাকসাম-নোয়াখালী সড়কে অ্যামবুশ করলে একটি পাকিস্তান সেনাদলের বেশ ক্ষতি হয়।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

৭ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের পক্ষে ভারতীয় নেতাদের বিশ্বময় জনসংযোগ

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ৭ জুন মস্কোতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের বিষয়ও উঠে আসে। আন্দ্রে গ্রোমিকোকে তিনি বলেন, ভারতের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা চান তিনি।

বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি করার উদ্দেশ্যে একই দিনে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ চার দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে পৌঁছান। সেখানে সরকারি কর্মকর্তা, সিনেট ও কংগ্রেসের সদস্য এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি এক চিঠিতে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে বলেন, ভারত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে বাধা না দিলে সমস্যার তাড়াতাড়ি সমাধান হবে। তাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জন্য পাকিস্তান উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করতে পাকিস্তান ও জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতার আহ্বান জানান আগা হিলালি।

ইউনিসেফের একজন মুখপাত্র এই দিন জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৩২ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে ভাড়া করা একটি বিমান কলকাতায় রওনা হবে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ছাড়াও প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, ইনজেকশন দেওয়ার সুচ ও সিরিঞ্জও থাকবে।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জাপান ৩০ লাখ ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই অর্থ দিয়ে জাপান থেকে চাল কেনা হবে।

ভারত ও পাকিস্তানের বিপরীত চিত্র

ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টোয়েনস গার্ভে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমান্ত এলাকার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণ কমিশনার বি বি মণ্ডল। স্যার গার্ভে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জির সঙ্গে দেখা করলে তিনি শরণার্থী সংকটকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে অনুরোধ করেন।

পাকিস্তান সরকার এদিন ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে। ঘোষণায় বলা হয়, এসব নোট ৭ জুন মধ্যরাত থেকে অচল বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান অর্থসংক্রান্ত একটি সামরিক বিধি জারি করেন।

পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্যসামগ্রী বণ্টন করার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকার এই দিন পরিত্যাগ করার ঘোষণা দেয়।

ভাসানী: স্বাধীনতা আসবে রক্তস্নানের পথে

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ আজ লাখ লাখ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত। এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে অবশ্যই বাংলার স্বাধীনতা আসবে। কেউ সাহায্য করুক বা না করুক, বাংলাদেশের মানুষ লড়াই চালিয়ে যাবে।

মাওলানা ভাসানী আরও বলেন, এই সংকট মুহূর্তেও ইয়াহিয়া খান সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা প্রচার করছে, ভারতের টাকা এবং পূর্ব বাংলার হিন্দুদের সহযোগিতায় কিছু দুষ্কৃতকারী পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। তিনি এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান।

বাংলাদেশ সংসদীয় দলের নেতা ফণীভূষণ মজুমদার এদিন লক্ষ্ণৌয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন নিয়ে ভারতের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁরা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের আশঙ্কায় তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন। এই সংকটজনক সময়ে তাঁর জীবনের নিরাপত্তাই অত্যন্ত জরুরি।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান এদিন আগরতলা মামলার সরকারপক্ষের কৌঁসুলি টি এইচ খানকে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

পূর্ব পাকিস্তানের (‘খ’ অঞ্চল) সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এদিন সামরিক বাহিনীকে আরও আক্রমণাত্মক করার জন্য সামরিক সেক্টরগুলোকে পুনর্গঠিত করে ১৫০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে।

মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, যেকোনো মূল্যে আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে পাকিস্তানি পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের দাবি এবং ইসলামি ও পাকিস্তানি আদর্শে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল এই দিন ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা থানা ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে শ্রীপুরের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। নিদ্রিত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দোহা কাজল, নাজমুল আবেদীন, নারায়ণচন্দ্র ধর ও আবুল কালাম শহীদ হন। পুনর্গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল এই দিন ফেনীর ভান্দুরা রেলস্টেশনের পাশের সেলোনিয়া নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে অতর্কিতে আক্রমণ করে। তারা সারা দিন ও রাত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে।

 

নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

৮ জুন ১৯৭১: লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তব্য স্বাধীনতার সমর্থনে

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ৮ জুন লন্ডনের রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ এই দূত বলেন, অর্থনৈতিক শোষণে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত পূর্ব বাংলার জনগণ। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের কথা মনে রেখেই। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভোট দিয়েছেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পরও সরকার গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সামরিক সরকারের প্রধান ইয়াহিয়া খানের নানা ফন্দিফিকির, নিরীহ মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ পুরো পরিস্থিতি সবিস্তার বর্ণনা করেন আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের জয়কে ইয়াহিয়ার মন্ত্রণাদাতারা ভালো চোখে দেখেননি। তারই ফল ২৫ মার্চের রাতের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ।

বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতার আওয়াজ তুলেছে। বাংলাদেশ নামে নতুন এক দেশের অভ্যুদয় হয়েছে। কারও পক্ষেই বাংলাদেশকে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন রাখা আর সম্ভব নয়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও ভাষায় পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী আলাদা। জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার তাদের আছে। তারা অবশ্যই স্বাধীনতা চায়।

মে মাসে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করে দিল্লিতে ফিরে এসে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান আবদুস সামাদ আজাদ এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতাদের সবাই বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞে উদ্বিগ্ন।

নেতাদের সামরিক আদালতে শাস্তি

ঢাকায় ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান ও তোফায়েল আহমেদ এবং দ্য পিপল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন এবং তাঁদের সম্পত্তির শতকরা ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে এই বিচার করা হয়।

উপমহাদেশের বাইরে

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে এই দিন তৃতীয় দফা অনির্ধারিত বৈঠকে বসেন। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতা এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের সঙ্গেও দেখা করেন সরদার শরণ সিং। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকোর সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য তিনি সিসকোর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এরপর তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশবান্ধব সভায় বক্তব্য দেন এবং টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সিসকো বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রসচিব স্যার আলেক ডগলাস হোম কমন্স সভায় বলেন, নতুন অর্থনৈতিক সাহায্য প্রকল্পে রাজি হওয়ার আগে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্রিটেন পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক সমাধান যুক্তরাজ্য চাপিয়ে দিতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে ভারত তা একা সমাধান করতে পারবে না। এর জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা প্রয়োজন।

বাংলাদেশি অধ্যাপকদের নিয়োগে

ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অধ্যাপকদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর্থিক অনুদানের জন্য যে আবেদন করেছেন, সরকার তা বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ জন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক ও ৭০০ জন কলেজশিক্ষকের চাকরির বিষয়ে উপাচার্যের কাছে আবেদন এসেছে।

৯ জুন ১৯৭১: উদ্বেগ প্রকাশ সোভিয়েত সরকারের

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিন ৯ জুন রাজধানী মস্কোতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীকে তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার উদ্বিগ্ন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সম্পর্কে জার্মানির নেতাদের জানাতে মস্কো থেকে ৯ জুন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে পৌঁছান।

ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপারে বনে এক রেডিও সাক্ষাৎকারে সরদার শরণ সিং বলেন, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের তাণ্ডবের শিকারে পরিণত হওয়া শরণার্থীদের দায়িত্ব বিশ্ববাসীকে বহন করতে হবে। পাকিস্তান সরকারের নীতিই ব্যাপক শরণার্থী পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচার খুন করা হচ্ছে। ভারতে শরণার্থী আগমন অব্যাহত থাকলে তা বন্ধের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ভারত বাধ্য হবে।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নিউইয়র্কে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ বিষয়ে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, আরও নেবে।

এদিন ব্রিটেনের কমন্স সভায় বিরোধী লেবার পার্টির সাংসদেরা সরকার পক্ষকে নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি পরিবর্তনে বাধ্য করে চার ঘণ্টা ধরে বিতর্ক করেন। লেবার পার্টির সদস্যরা শরণার্থীদের জন্য গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ এবং পাকিস্তান সরকারের নীতির সমালোচনা করেন। লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুডিথ হার্ট শরণার্থীদের জন্য ব্রিটেনের সাহায্যের পরিমাণ এবং তা পাঠানোর ক্ষেত্রে গড়িমসিতে হতাশা প্রকাশ করেন।

ব্রিটেনের বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উড বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ব্রিটেন ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে
চিঠি বিনিময় হয়েছে। চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়েছে।

পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ইয়র্কশায়ারের বার্ডফোর্ড মাঠের বাইরে প্রবাসী বাঙালি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সালাম এই দিন ৭২ ঘণ্টার জন্য অনশন শুরু করেন। মাঠে ইয়র্কশায়ার দলের সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের তিন দিনব্যাপী খেলা চলছিল। মোহাম্মদ সালাম অনশন শুরুর আগে প্রায় ২০০ ছাত্র মাঠের বাইরে উপস্থিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এবং পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের প্রতিবাদে তিনি দুই রাত ও তিন দিন পানি ছাড়া আর কিছু খাবেন না এবং সেখান থেকে নড়বেন না।

সালাম পড়াশোনার জন্য এক বছর আগে ইংল্যান্ডে যান। গত তিন মাস তিনি তাঁর বাড়ির কোনো খবর পাননি।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাংক চার্চ ও উইলিয়াম স্যাক্সবি যৌথভাবে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য সিনেটে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা কেবল ভারতের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, এর ফলে সে ভূখণ্ডে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব এবং তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাখা উচিত।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এসে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছিলেন কংগ্রেসের সদস্য কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার। ওয়াশিংটনে ফিরে ৯ জুন তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আরও সাহায্য দিলে তা হত্যা ও মহামারিকেই সাহায্য করবে। এখন বিশ্বের প্রধান কর্তব্য শরণার্থীদের জায়গা দিতে ভারতকে সাহায্য করা। শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যাই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারের প্রমাণ।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারতকে অতিরিক্ত দেড় কোটি ডলার সাহায্য মঞ্জুর করে।

ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক অর্গানাইজেশনের মহাসচিব এইচ এইচ মাজুর্কি জাতিম এদিন জাকার্তায় এক বিবৃতিতে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের সাহায্য করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভারত ও পাকিস্তানে

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান এদিন শিলিগুড়িতে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন।

দিল্লিতে আদি কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির সাধারণ পরিষদের সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়ে এদিন আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকার লক্ষ্যহীন নীতি অনুসরণ করে চলেছে। সভার সভাপতি ছিলেন পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারম্যান মোরারজি দেশাই।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে শিগগির ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। প্রতিনিধিদলে থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক এবং আনিসুজ্জামান। প্রথমে তাঁরা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। পরে যাবেন দিল্লি, আগ্রা, আলিগড়, লক্ষ্ণৌ ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি খাজা খয়েরুদ্দিন ও সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংহতি ও আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলন আয়োজনের পরামর্শ দেন।

১০ জুন ১৯৭১:  বিশ্বকে ভাগ করে নিতে হবে শরণার্থীদের দায়িত্ব

ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় ১০ জুন বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্গতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। লোকসভার কয়েকজন সদস্য শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে বলেন, কেন্দ্রীয় বাজেটে শরণার্থীদের জন্য মাত্র ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই টাকা যথেষ্ট নয়।

আলোচনায় ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবন বলেন, বাংলাদেশের জন্য ভারতও যে সাহায্য করতে পারে, এ অর্থ তারই প্রতীক। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকেও এ দায়িত্বের ভাগ নিতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে শরণার্থীরা যাতে সম্মানের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, সে জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত।

আলোচনায় ভারতের ত্রাণ ও পুনর্বাসন উপমন্ত্রী বালগোবিন্দ ভার্মা লোকসভায় জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি—এই সাত দেশ শরণার্থীদের ত্রাণকাজে সাহায্য দিতে চেয়েছে। ফাও, ইউনিসেফ ও ইউএনএইচআর—জাতিসংঘের এই তিন সংস্থা এবং নরওয়ের শরণার্থী পরিষদ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতি ও ডেনমার্কের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা—এই চার বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও সাহায্য দেবে।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে ৪ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৩০৯ জন কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার এবং তাদের মধ্যে ৮ হাজার ৮৩৪ জন মারা যাওয়ার খবর আসে।

শরণার্থীদের মধ্যে কলেরার মহামারি নিয়ে রাজ্যসভার সদস্য এন জি গোরে এবং ভূপেশ গুপ্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। ভূপেশ দত্ত মহামারির কবল থেকে শরণার্থীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসতে কেন্দ্র ও সব রাজ্যকে আহ্বান জানান।

পশ্চিমবঙ্গের ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন এদিন শরণার্থীদের সাহায্যে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির কাছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৯ টাকার একটি চেক দেয়। পশ্চিমবঙ্গের
২৮২টি প্রেক্ষাগৃহের এক দিনের টিকিট বিক্রি থেকে এই অর্থ সংগৃহীত হয়। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাতে চেকটি দেওয়া হয়।

শরণার্থীদের চিকিৎসার্থে লন্ডন থেকে ওয়ার অন ওয়ান্টের পাঠানো ৪০ শয্যার ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের সরঞ্জাম এদিন উড়োজাহাজে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এই হাসপাতালে একজন ভারতীয়সহ চারজন চিকিৎসক ও ১১ জন নার্স কাজ করবেন। শরণার্থীদের জন্য আরও তিনটি উড়োজাহাজে এদিন ত্রাণসামগ্রী কলকাতায় পৌঁছায়।

আরও সাহায্য, আরও যোগাযোগ

বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থীদের বিষয়ে জানাতে বিভিন্ন দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার শিলের সঙ্গে আলোচনা করেন।

পশ্চিম জার্মানি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ১.২৫ কোটি রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) সাহায্য মঞ্জুর করে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান, সামরিক ঘোষণা

সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়া যেকোনো নাগরিক দেশে ফিরে এলে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।

প্রদেশের অবস্থা স্বাভাবিক দাবি করে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১০ জুন সান্ধ্য আইন পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি দল ফেনীর বিলোনিয়ায় মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটিতে দুই দফা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা দুবারই তা প্রতিহত করেন।

পিরোজপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মঠবাড়িয়া থেকে ১০ জন ছাত্রকে ধরে এনে বলেশ্বর নদের তীরে গুলি করে হত্যা করে।

মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। একদল মুক্তিযোদ্ধা হেয়াঁকু-রামগড় সড়কে রামগড়গামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ির ওপর আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু সময় যুদ্ধ করার পর পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।

মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাদল সাতক্ষীরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাদের পর্যুদস্ত করে। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল বসন্তপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান।

মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং সিলেটের জৈন্তাপুরে ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেন।

 

“জুন মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১১ জুন ১৯৭১: ওকাম্পো ও বোর্হেস বাংলাদেশের সমর্থনে

আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল ১১ জুন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইস মারিয়া দে পাবলো পার্দোর সঙ্গে দেখা করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তারা ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জরুরি সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে যাঁরা সই করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, প্রখ্যাত গল্পকার হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং ফাদার ইসমাইল কুলিস। আর্জেন্টিনার জাতীয় পত্রিকায় স্মারকলিপির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ১২ জুন প্রকাশিত হয়।

যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় ১১ জুন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে বিতর্ক হয়। বিরোধী লেবার পার্টির সদস্য পিটার শোর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করে বলেন, রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে পাকিস্তান ব্রিটেনের বন্ধুত্ব আশা করতে পারে না। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সাহায্য যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করতে পারে না পাকিস্তান।

যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এই দিন ৫৮ লাখ ৪০ হাজার ভারতীয় রুপির সমপরিমাণ অর্থ সাহায্য দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের রেডক্রস সোসাইটি শরণার্থীদের জন্য অবিলম্বে চিকিৎসাসামগ্রী, কলেরা ও টাইফয়েডের টিকা, খাদ্য ও তাঁবু পাঠানোর ঘোষণা দেয়। বেলজিয়াম সরকার শরণার্থীদের জন্য ২০ মিলিয়ন বেলজিয়াম ফ্রাঙ্ক এবং কানাডার কানাডিয়ান ক্যাথলিক কনফারেন্স ও কানাডিয়ান ক্যাথলিক অর্গানাইজেশন অ্যান্ড পিস শরণার্থীদের জন্য ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলার সাহায্যের ঘোষণা দেয়।

মুক্তিবাহিনীর অপারেশন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার উত্তরে চানলায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনারা ইয়াকুবপুরের দিকে পালানোর পথে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণের মুখে পড়ে। দুই অভিযানে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।

কুমিল্লার লাকসামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়িতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, সিলেটের এনায়েতপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় ও নোয়াখালীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গুলিবিনিময় হয়।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের আবেদন

বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ ১১ জুন দিল্লি থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে একটি আবেদন পাঠান। সে আবেদনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়া হোক। কারণ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সামরিক সরকার বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করছেন এবং ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গণহত্যা বন্ধে বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করতে পাকিস্তানের ওপর অবরোধ আরোপের জন্যও বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি আবেদন জানান।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুক্তাঞ্চলে চার দিনব্যাপী সফরের পর এই দিন মুজিবনগরে ফিরে আসেন। মনসুর আলী জানান, শিবিরসমূহে তিনি তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অদম্য মনোবল ও অনমনীয় দৃঢ়তা প্রত্যক্ষ করেছেন।

আরও সমর্থন, আরও দাবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দিন আসামে শরণার্থীশিবির পরিদর্শনকালে বলেন, শরণার্থীদের অনুকূলে বিশ্বে জনমত গড়ে উঠেছে। পৃথিবীজুড়ে পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারের কাহিনি প্রচারিত। পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তা শুধু পাকিস্তানের ব্যাপার নয়। ভারত সরকার ব্যাপারটি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখছে।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও শরণার্থী সমস্যা বিশ্বনেতাদের জানাতে বিভিন্ন দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এই দিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুর সঙ্গে দেখা করেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর দেশটি এই দিন সরকারি ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ভারত একা শরণার্থী সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। ভারত উপমহাদেশে শান্তি ও স্থায়িত্ব অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে জার্মানি তার আগ্রহের কথাও জানায়। ইশতেহারে বলা হয়, পরিস্থিতির দিকে তাঁরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ রাখছেন এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তার পক্ষে যে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে সম্পর্কেও তাঁরা সচেতন।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এদিন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমাহানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও শরণার্থীদের বিষয়ে অবহিত করেন। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ভূমিকা রাখতে তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পিয়েত দে জংয়ের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং এ নিয়ে ভারতের মনোভাব তাঁকে জানান।

লন্ডনের উইক এন্ড টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্য পেশ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নিউইয়র্কে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল অশান্ত হয়ে পড়বে। বক্তব্যের শুরুতে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ, শরণার্থীদের ভারতে আগমনের কথা বর্ণনা করেন।

 

নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১২ জুন ১৯৭১: ভারতীয় নৌ ও বিমান সেনাদের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আহ্বান

ভারতের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ ১২ জুন বেঙ্গালুরুতে বৈমানিক ও নাবিকদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের দিক থেকে যেকোনো চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৌ ও বিমানসেনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, দেশ এখন খুব সংকটজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শান্তি ও অগ্রগতির পথে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জন্য
দেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত।’ যেকোনো সময় এই চ্যালেঞ্জ চলে আসতে পারে। তার মোকাবিলা করা সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামের কাছাড় জেলা সফর শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, সেটাকে কোনোমতেই পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলা যাবে না। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে পৃথিবী ক্রমেই সজাগ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হয়তো হবে না। তারপরও কিছু বলা যায় না, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য ও কনজারভেটিভ দলের এমপি জে কিসপেডার এদিন ইসলামাবাদে বলেন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সুগম করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্যই স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা একান্তভাবে আবশ্যক। ব্রিটিশ জনগণ ও সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ব্রিটেনের জনগণ খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লায় মুক্তিবাহিনীর কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।

সিলেটের এনায়েতপুরে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। এ ছাড়া নওগাঁয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়।

উপমহাদেশের বাইরে

লন্ডনের উত্তরে সেন্ট অ্যালবান্স শহরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এদিন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বক্তব্য দেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বর্তমান গণহত্যার পর দেশের দুই অংশের একসঙ্গে থাকার আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পূর্ব বাংলার জনগণের সামনে এখন একমাত্র সমাধান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তিদান এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে দেওয়া। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিষয় এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী সমস্যা বিশ্বনেতাদের জানাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় ৫০ মিনিটের স্থায়ী বৈঠকে তাঁরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্ব ভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ জাতিসংঘ ভবনের সামনে এদিন এক জনসমাবেশে বলেন, এখনো সময় আছে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে বিশ্বের নেতারা এগিয়ে না এলে উপমহাদেশজুড়ে সৃষ্ট অশান্তি সারা বিশ্বকে অস্থির করে তুলবে। ‘বাংলাদেশ বাঁচাও’ কমিটির উদ্যোগে হাজারখানেক নর–নারী নিউইয়র্ক শহর থেকে মিছিল করে এসে এ সমাবেশে যোগ দেন। আসার সময় পাকিস্তানি মিশনের সামনে তাঁরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। উত্তেজনা দুই দিক থেকেই বেড়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর জোর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো বলেন, শরণার্থী আসা বন্ধ করতে এবং তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন।

লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটি হিন্দুকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। পাকিস্তান যদি তার মতলব না ছাড়ে, তবে নয়াদিল্লির অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে।

দ্য টাইমস–এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নির্বিচার গণহত্যা করছে। পূর্ব বাংলা থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের পাঠানো একটি চিঠিতে হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ বিবরণ রয়েছে। চিঠিতে তিনি বলেন, পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে নারী ও শিশুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

১৩ জুন ১৯৭১: বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৩ জুন মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলোকে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের পক্ষে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান।

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই দেশের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

সৈয়দপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের আশ্রয়শিবির থেকে কিছু অবাঙালি হিন্দু পরিবারকে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে একটি ট্রেনে তোলে। ট্রেনটি সৈয়দপুর রেল কারখানার উত্তর পাশে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছালে ট্রেন থামিয়ে দরজা–জানালা আটকে দেওয়া হয়। এরপর দুই-তিনজন করে নামিয়ে গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাদের হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞে ৩৩৮ জন নিহত হয়। ৬৫ জন পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।

মৌলভীবাজারের শেরপুরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্র হস্তগত করেন।

টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাসাইল থানা আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানিদের একজন সহযোগী ও একজন দারোগা নিহত হয়। প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

কুমিল্লার রাজাপুর রেলস্টেশনের পাশে পাঁচড়া গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

বাংলাদেশের পক্ষে–বিপক্ষে

লন্ডনে ১৩ জুন সন্ধ্যায় এক টিভি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ
সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলেই এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে।

লন্ডনের যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বাংলাদেশ যুব সংঘের উদ্যোগে হাজারখানেক প্রবাসী বাঙালি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভ শেষে তাঁরা দূতাবাসে স্মারকলিপি দেন। এই স্মারকলিপিতে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র বাংলাদেশের জনগণকে দমনে এবং গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটেও স্মারকলিপি দেন।

যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস–এর এই দিনের সংখ্যায় ‘দুঃখের মিছিল’ শিরোনামে শরণার্থীদের মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী একটি কর্দমাক্ত শহর বারাসাত। জনসংখ্যা ২১ হাজার। দেড়-দুই লাখ লোক বানের জলের মতো এই বারাসাত শহরে ঢুকে পড়েছে। শহরের চারদিকে ধানি জমিতে তারা গিজগিজ করছে। স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল এবং পতিত জমিতে এদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।

১৪ জুন ১৯৭১: বিশ্বের নেতাদের ভারতের বার্তা

বাংলাদেশের ঘটনাবলি জানাতে এবং ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সংগ্রহে ছয়টি দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ১৪ জুন কানাডার অটোয়ায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল শার্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে অবিলম্বে কিছু একটা করতে হবে। নইলে ভারতকে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

১৪ জুন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া ভোজসভায় সরদার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশের বিষয়টি কেবলই ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। পাশ্চাত্য দেশগুলো শরণার্থী সমস্যাই বড় করে দেখে আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সামনে এখন যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা শুধু টাকাপয়সা দিয়েই সুরাহা করা যাবে না।

ভোজসভায় কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল শার্প পূর্ব পাকিস্তানে শিগগিরই অসামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত এবং দেশটির কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এই দিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল রাজাক হুসেনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কুয়ালালামপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যথাসময়ে পূর্ব বাংলার শরণার্থী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাতে ভারতকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এত বিরাট শরণার্থী সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এখন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন করাচিতে বলেন, বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ তৈরি। তিনি বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন সমাধানের আগে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তে কিছু সেতু উড়িয়ে দিয়েছে এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করছে।

ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষ হিন্দু ব্যক্তিদের নামে দেওয়া শহরের দুই শরও বেশি রাস্তা, গলি ও উপগলির নাম বদল করে নতুন নাম দেয়। লালমোহন পোদ্দার রোডের নাম হয় আবদুর করিম গজনবী রোড, হরিচরণ রোডের নাম হয় মোহাম্মদ বিন কাশেম রোড। এভাবে শাঁখারীবাজার হয়ে যায় গুলবদন, কিষান ব্যানার্জি হয় আলীবর্দী, নবীন চাঁদ হয় বখতিয়ার খিলজি আর কালীচরণ রোড হয় গাজী সালাউদ্দিন রোড।

পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এদিন সিলেট জেলার বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গ্রামে এসে পুরো গ্রাম ঘিরে রাখে। এরপর লাউডস্পিকারে ঘোষণা দিয়ে গ্রামের পুরুষদের আদিত্যপুর সরকারি স্কুলের সামনে সমবেত করে। পাকিস্তানি সেনারা সমবেত পুরুষদের বেঁধে গুলি চালালে ৬৩ জন নিহত হন। মৃতের ভান করে দুজন বেঁচে যান। এরপর পাকিস্তান সেনারা নারীদের ওপর অত্যাচার চালায়।

আরেক দল পাকিস্তানি সেনা সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দের ভদ্রঘাট গ্রাম ঘেরাও করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা করে ১৯ জনকে। এটি ভদ্রঘাট ও ধামকোল গণহত্যা নামে পরিচিত হয়।

পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল কুমিল্লা থেকে চৌদ্দগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে একদল মুক্তিযোদ্ধা নয়াবাজারের কাছে তাদের অ্যাম্বুশ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর চলবল ঘাঁটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি দল মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট এই তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চালায়। বান্দাবাড়ি খালের কাছে মুক্তিবাহিনীর হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল শহীদ হন এবং হেমায়েত আহত হন। এ যুদ্ধের পর হেমায়েত বাহিনী কোদালধোয়া গ্রামে তাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করে।

১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার অন্য একটি দল কুমিল্লার বুড়িচং থানায় আক্রমণ চালায়।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির একজন মুখপাত্র মুজিবনগরে এই দিন সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের একটি ফুটবল দলকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলার জন্য পাঠানো হবে। প্রদর্শনীতে ফুটবল খেলা থেকে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ব্যয় করা হবে।

ভারতের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং এদিন লোকসভায় বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকারের নৃশংস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে চীন ভারতের প্রতি শত্রু মনোভাব অবলম্বন করেছে, ভারত তার প্রতিবাদ জানায়নি। তবে পূর্ব বাংলার ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাব চীনের দূতকে জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান এদিন পাকিস্তান থেকে দিল্লি পৌঁছান। দিল্লিতে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভারতের সংযুক্ত সমাজবাদী দলের নেতা রাজনারায়ণ বারানসিতে ১৪ জুন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করাটা ভারত সরকারের বিরাট ভুল। এতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ভুল সংশোধনের জন্য তিনি অনশন করতে সংকল্পবদ্ধ।

ভারত সরকার এদিন শরণার্থী শিবিরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয় সামরিক কর্মকর্তাদের। এ জন্য তিনজন ব্রিগেডিয়ার, ২০ জন কর্নেলসহ শতাধিক সামরিক কর্মকর্তাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংযুক্ত করা হয়। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের পশ্চিমবঙ্গের কার্যালয় থেকে ক্যাম্প পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দিয়ে তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতের অন্য রাজ্যে স্থানান্তরের জন্য এদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম বিমানটি কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। আরেকটি সোভিয়েত বিমান ১৫ জুন কলকাতায় আসবে। বিমান দুটি শরণার্থী পরিবহনের কাজ করবে।

১৫ জুন ১৯৭১: ‘রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনা কমছে’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৫ জুন সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং শরণার্থী–সংকট নিয়ে তিন ঘণ্টা বিতর্কের উত্তর দেন। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিলে সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক মীমাংসার আশা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান মানে বাংলাদেশের সংহার নয়। গণতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়ছে, তাদের বিনাশ করা যায় না। যারা আজ দমিত, রাজনৈতিক সমাধান তাদের সঙ্গেই করতে হবে।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শরণার্থীদের ভারতে চিরকাল রাখার ইচ্ছা সরকারের নেই। কিন্তু জোর করে তাদের বাংলাদেশে অগ্নিকুণ্ডের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। সদস্যদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে ভারতীয় দূতেরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাননি। তাঁরা গেছেন বিশ্বসমাজকে সচেতন করতে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদদের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে সাতজনের একটি বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে দিল্লির শিক্ষাবিদদের ওয়াকিবহাল করার জন্য আলীগড় থেকে দিল্লি যান। প্রতিনিধিদলের সাতজনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশ এবং চারজন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ ও বয়রা সীমান্তে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ–দুর্দশা নিজ চোখে দেখেন। বনগাঁয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে একটি স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহৃত না হলে শরণার্থীদের ঘরে ফেরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।

শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে ফেরার পরে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান সাংবাদিকদের বলেন, শরণার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে আদৌ নিরাপদ থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তবে শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি শিগগিরই হয়তো তৈরি হবে, যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। অনুকূল পরিবেশ পাকিস্তানকেই সৃষ্টি করতে হবে। বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে এ কাজ কষ্টসাধ্য।

সর্বভারতীয় সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কেন্দ্রের উচিত শরণার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণে সব রাজ্যকে বাধ্য করা। কারণ, এটি একটি জাতীয় সংকট।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখতে ঢাকায় আসেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মিসেস জিল নাইট, জেমস কিলফেডার ও জেমস টিন। বিশ্বব্যাংকের এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিল এবং আইএমএফের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের পরিচালক গাম্বারও রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে তাঁর বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তা ভ্রান্ত। এ বিষয়ে একমাত্র প্রেসিডেন্টই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ইসলামাবাদে সরকারি সূত্র জানায়, চীন পাকিস্তানকে এক বছরের বেশি সময়ের জন্য ৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য সাহায্য দেবে। এ–সংক্রান্ত ঋণ চুক্তিটি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে নিজেদের স্বার্থে আপত্তিকর পুস্তক–পুস্তিকা, পোস্টার ও প্রচারপত্র নিকটবর্তী সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আপত্তিকর পুস্তকের একটি তালিকাও কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করে।

জাতিসংঘে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন। বৈঠকের পর সরদার শরণ সিং সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির মৌলিক বিষয়গুলো এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ভারত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তা তিনি মহাসচিবের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। সমস্যাটি শুধু ভারত-পাকিস্তানের নয়, বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে বাংলাদেশের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কুয়ালালামপুরে বলেন, যুক্তিগ্রাহ্য সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা না হলে ভারত নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ব বাংলায় দ্রুত প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান চাই। সেখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্নিনান্দ ই মার্কোস ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির জবাবে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিবাদের ফলে সেখানকার বাঙালি জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় ফিলিপাইন সরকার ও জনগণ গভীরভাবে মর্মাহত।

দ্য ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ–এ ‘পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের খবর ফাঁস হচ্ছে। একের পর এক পাওয়া তথ্য-প্রমাণে দেখা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ঠান্ডা মাথায় বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করছে, যারা প্রকৃতপক্ষে একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ

শাহাজিবাজারের কাছে একটি রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধারা সেনাবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। এতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত ও ট্রেনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়ার একটি দল সুনামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর ধর্মপাশা ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। ধর্মপাশা সদর দখল করে তারা ধর্মপাশা বাজার পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই।

এ ছাড়া ভূরুঙ্গামারী, বৃহত্তর কুষ্টিয়ার হিজলী ও বৈদ্যনাথতলা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, যশোরের বেনাপোলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

১৬ জুন ১৯৭১: ভারতের মনোভাব জানানো হলো নিক্সনকে

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের ঘটনাবলি ও শরণার্থীসংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হোয়াইট হাউসে নিক্সনের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব সবিস্তার জানান।

শরণ সিং নিক্সনকে জানান, পাকিস্তানের কার্যকলাপে ভারত মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার জন্য সম্মিলিত আন্তর্জাতিক প্রয়াস প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ভারত উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়। বিশ্ববাসী অবিলম্বে কিছু না করলে নিজ স্বার্থ রক্ষায় ভারত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ১৬ জুন বিবৃতি দিয়ে জানান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের সংকট এতটাই গুরুতর যে তিনি আফ্রিকান সংহতি সংস্থার সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আদ্দিস আবাবা সফর বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি মনে করছেন, এই বিরাট সংকট মোকাবিলায় তাঁর এখন
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। উ থান্ট বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আবারও আহ্বান জানান।

ব্রিটেনের কমন্স সভার ১২০ জনের বেশি সদস্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এক আবেদনে বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপদের কারণ বলে বিবেচনা করা হোক। এই আবেদনে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার নিন্দা করে বলা হয়, তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সব অধিকার পদদলিত করেছে।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এক বিবৃতিতে পরিষদ বিশ্বের সব দেশের শান্তি পরিষদের শাখা কমিটিগুলোকে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানায়। শান্তি পরিষদ বাংলাদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানায়।

ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালি নারীদের সংগঠন মহিলা সমিতির নেতা-কর্মীরা লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সভা করেন। পাকিস্তানে আমেরিকার সমরাস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে এই সভা আয়োজিত হয়। এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির আবদুল হাই খান ও রাজিয়া চৌধুরী দূতাবাসের সামনে অনশন পালন করেন।

ব্রিটেনের ডেইলি মিরর পত্রিকা খ্যাতনামা সাংবাদিক জন পিলজারের ‘একটি জাতির মৃত্যু’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জন পিলজার পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন লেখেন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নির্বিচার বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনের ভীতিজনক এক বিবরণ দেওয়া হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত এলাকায় অগণিত শরণার্থী এসে ভিড় করায় অবস্থা সঙিন হয়ে উঠেছে। ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে কিছু শরণার্থী দেশের ভেতরে নিতে চাইছে। সেখানে সাহায্য সরবরাহ করা সহজ হবে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ জাহেদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নীতিকে সমর্থনসংক্রান্ত ইরানের শাহের একটি বার্তা নিয়ে এদিন করাচি আসেন।

পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি এবং পিডিপি নেতা মাহমুদ আলী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাওয়ালপিন্ডি যান।

ঝালকাঠির বৈশাইল থানা এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে শতাধিক মানুষ নিহত হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরও সাফল্য

টাঙ্গাইলের বাশাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নর্থখোলা খেয়াপারে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল ট্যাংক, আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের চাঁদগাজী ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল সে আক্রমণ মোকাবিলা করেন। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কিছু ক্ষতি হয়, পাকিস্তানি বাহিনীও পিছু হটতে বাধ্য হয়।

ফেনীর বিলোনিয়ায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী বিমানবাহিনীর সহায়তায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চিতলিয়ায় চলে আসেন।

উপমহাদেশের বাইরে

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ভোজসভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায় না। যে সার্বভৌমত্বের জন্য তারা এত মূল্য দিচ্ছে, সেটাই তাদের কাছে বড়। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন বা এ-জাতীয় প্রশ্নের সুরাহা কেবল ইসলামাবাদ ও ঢাকাই করতে পারে, আর কেউ নয়।

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র এদিন জানান, ঢাকা থেকে ভারতীয় এবং কলকাতা থেকে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে উদ্ভূত অচলাবস্থা নিরসনে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নিয়েছে। ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের পাকিস্তান আটক রেখেছে অভিযোগ করে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে তাঁর প্রভাব কাজে লাগানোর জন্য গত সপ্তাহে ভারত উ থান্টের কাছে দাবি জানিয়েছিল। উ থান্টকে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি জানান, তাঁর প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নিতে প্রস্তুত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রও জানায়, অচলাবস্থা দূর হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।

তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান প্রকৃত ও আন্তরিক রাজনৈতিক মীমাংসায় না আসা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখুক। নীতিগতভাবে সাহায্যের মধ্যে শর্ত আনা অনুচিত। যে সরকার তার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, তারা সাহায্য ঠিকভাবে লাগাবে কি না, তাতে সন্দেহ আছে।

পত্রিকাটি আরও বলে, প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গভীর সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সংসদে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হয়, সে সংযমেরও একটা সীমা আছে। অবস্থা তাঁরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্যারিসে সহায়ক দেশগুলোর যে বৈঠক বসেছে, তাতে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখাই উচিত।

অবরুদ্ধ দেশে

পাকিস্তান সফররত তিন সদস্যের ব্রিটিশ সংসদীয় দলের সদস্য জেমস টিন ঢাকায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে ব্রিটিশ পত্রিকায় একপেশে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এ খবর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ভারতের একতরফা প্রচারের কারণে বিদেশি পত্রিকায় সঠিক খবর আসছে না। দলের আরেক সদস্য মিসেস জিল নাইট বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারী দমনে অত্যন্ত দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এর দরকার ছিল।

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ

 

১৮ জুন ১৯৭১: দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান ঢাকায়

১৮ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে ঢাকায় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাম্প্রতিক একটি দুঃসাহসিক অভিযানের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ঢাকা তখন পাকিস্তানি সেনাদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাজালে বেষ্টিত। অভিযানটি এর মধ্যেই সফলভাবে সম্পন্ন হয়। খবরে বলা হয়, ১৭ জুন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের একটি দল খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। একজন মার্কিন ও দুজন ব্রিটিশের এই দল যখন ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে তাদের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় আকস্মিকভাবে তিনটি বোমা গাড়ির কাছে বিস্ফোরিত হয়। একটি বোমা গাড়ির কাছেই বিস্ফোরিত হওয়ায় ওই সদস্যরা সামান্য আঘাত পান।

প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র একটি দল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই গেরিলা অভিযান চালিয়েছিল আরও আগে। নিউইয়র্ক টাইমস ঘটনাটি ১০ জুন ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে পরবর্তী সময়ে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের স্মৃতিচারণায় বলেছেন, এই অভিযান তাঁরা চালিয়েছিলেন ৯ জুন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল সে সময় ঢাকায় ছিলেন। অভিযানের সময়টিতে তাঁরা হোটেলে ফিরেছিলেন। রাজধানীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করে এমন অভিযান সামরিক প্রশাসনকে হতভম্ব করে দেয়।

সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক), হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম), কামরুল হক স্বপন (বীর বিক্রম)। তাঁরা যে গাড়িতে করে এসে অভিযানে অংশ নেন, সেটি চালিয়েছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর শ্যালক এফডিসির আলোকচিত্রগ্রাহক মুনির আলম মির্জা।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল রাতে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াত বিঘ্নিত করার জন্য কুমিল্লা-লাকসাম রেলপথের বিজয়পুর রেলসেতু ও কুমিল্লা-বাগমারা সড়কের একটি সেতু উড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি বিজয়পুর ও মিয়াবাজারের কাছে ইলেকট্রিক টাওয়ার উড়িয়ে দিয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দুটো দল কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে সায়দাবাদে এবং মিয়াবাজারের দক্ষিণে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আরেকটি দল খিলা রেলস্টেশনের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপকে অ্যামবুশ করে।

নিক্সনকে কেনেডির অভিযোগ

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দেখা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা যে এখন সারা বিশ্বের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেওয়ার আগে তিনি এ সাক্ষাতে মিলিত হন।

এডওয়ার্ড কেনেডি প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি নিযে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যে নীরবতা অবলম্বন করা হচ্ছে, তাতে মানুষের মর্মান্তিক বিপর্যয়কে চাপা দেওয়া হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ত্রাণকার্যে ও যুদ্ধজর্জরিত পাকিস্তানে শান্তি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ও প্রতিরক্ষা উৎপাদনমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা বার্নে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিয়েরে গ্লাবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, শরণার্থী সংকটে ওই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক শক্তিগোষ্ঠীকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

‘জনযুদ্ধে জনতার জয় সুনিশ্চিত’

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান প্রায় ২৫ দিন ধরে মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ১৮ জুন মুজিবনগরে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, তিন-চার মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনী তৈরি হবে।

কিসের ভিত্তিতে তিনি এ কথা বলছেন, সে প্রশ্নের জবাবে কামারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে, তা জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে সংঘবদ্ধ জনতার জয় সুনিশ্চিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তিন মাস ধরে বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশে অসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করতে পারেনি।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় সরকারি চারুশিল্প কলেজের গ্রন্থাগারে দুই বাংলার শিল্পীদের সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী কামরুল হাসান। সমাবেশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আগামী আগস্টে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবে। সেখানে ছবি বিক্রির সব টাকা মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যয় করা হবে।

সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী চিন্তামনি কর ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা চিত্রশিল্পীদের ছবি আঁকার জন্য তিনি বিনা মূল্যে রং, তুলি ও ক্যানভাস দেবেন। এ ছাড়া দুজন শিল্পীকে এবং সোসাইটি অব কনটেম্পরারির একজন শিল্পীকে স্টুডিওতে কাজ করতে দেবেন।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান দিল্লিতে ভারতের শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ত্রাণের দিকটি দেখবে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে মাথা ঘামাবে না।

পাকিস্তানের আর্থিক কর্মসূচিগুলো বিবেচনার ব্যাপারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক। ভারত এতে সন্তোষ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ ঘটনাকে ভারত তাদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচারের সাফল্য হিসেবে দেখে।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সফররত ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য জেমস টিন ঢাকা থেকে করাচি ফিরে বলেন, পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করা খুবই ভুল হবে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বিবৃতিতে দেশত্যাগীদের স্বদেশে ফিরে আসার জন্য আবারও আহ্বান জানিয়ে বলেন, সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসন ও পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাঁর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে এই দিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, বিচারপতি নূরুল ইসলাম, পিডিপির সহসভাপতি মাহমুদ আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী দীন মোহাম্মদ সাক্ষাৎ করেন।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম লাহোরে বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের জন্য একটি জাতীয় পরিষদ দরকার। দেশে জাতীয় পরিষদের অবর্তমানে কোনোমতেই বেআইনি ঘোষিত ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।

ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে কৈখোলা দখল করে। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পুনর্গঠিত হয়ে কৈখোলায় পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টা তীব্র যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কৈখোলা আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

একদল পাকিস্তানি সেনা স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে বাগেরহাট সদরের কান্দাপাড়া বাজারে ১৮ জন যুবক, ৩ জন বৃদ্ধ ও ২ জন শিশুকে হত্যা করে।

 

জুন মাস ১৯৭১ ৩, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১৯ জুন ১৯৭১: স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা-দেশই সমাধান

বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলা-দেশের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক ১৯ জুন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে একটিমাত্র রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। আর তা হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা-দেশ। তিনি বলেন, বাংলা-দেশে বড় বড় শহর পাকিস্তানি সেনাদের অধীনে থাকলেও গ্রামে প্রশাসনের চিহ্নমাত্র নেই। সরকারি অফিস অচল। যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন।

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায় পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটি লাঠিটিলায় আক্রমণ করে। তুমুল যুদ্ধের পর লাঠি
টিলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর একজন হাবিলদার এবং একজন সেপাই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগের কাছে পাকিস্তানের এক প্লাটুন সেনাকে অ্যামবুশ করে।

জম্মু ও কাশ্মীর সফরে গিয়ে এই দিন এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলা-দেশে যা ঘটছে, তা জাতীয় বিপ্লব।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ দিন জানান, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলা-দেশের নাগরিকদের জমির দলিলপত্র নষ্ট করে অন্যদের মধ্যে জমি বণ্টন করছে। দিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সাজ্জাদ হায়দারের কাছে ১৮ জুন দেওয়া একটি
নোটে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত জানায়, এটি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করবে।

ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলো ১৯ জুন দেশজুড়ে বাংলা-দেশ সংহতি দিবস উদ্‌যাপন করে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় এ উপলক্ষে এক যৌথ সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং স্বাধীন বাংলা-দেশ সরকারকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি দাবি করা হয়।

পাকিস্তানে, অবরুদ্ধ দেশে

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিন করাচিতে জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের চারটি প্রধান সেতুর ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় প্রচারণার মুখোশ খুলে দিতে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলকে বিদেশে পাঠানো হবে। প্রতিনিধিদলে থাকবেন পিডিপির সহসভাপতি মাহমুদ আলী, বিচারপতি নুরুল ইসলাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাজ্জাদ হোসায়েন।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনা হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করা যেত না।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল এই দিন মুক্তিবাহিনীর চৌদ্দগ্রাম ঘাঁটিতে প্রবল হামলা চালায়। সারা দিন যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিটি ছেড়ে দেন। যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং চারজন আহত হন।

পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল চট্টগ্রামের চাঁদগাজীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে চাঁদগাজী দখল করে নেয়।

বহির্বিশ্বে তৎপরতা

বাংলা-দেশের ঘটনাবলি জানতে বিভিন্ন দেশ সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ১৯ জুন লন্ডনে পৌঁছান। বাংলা-দেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী সংকট নিয়ে ব্রিটেনের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করাই তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য।

ভারতের কমিউনিস্ট নেতা ভূপেন গুপ্ত এই দিন পূর্ব বার্লিনে সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে বাংলা-দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। অধিবেশনে উপস্থিত ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কমিউনিস্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গেও একই বিষয়ে তিনি আলাপ করেন। সবাই বাংলা-দেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানান।

নিউইয়র্ক টাইমস এই দিন জানায়, আইএমএফের সমীক্ষাদল পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোকে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে বলেছে। নিক্সন প্রশাসন এবং কংগ্রেস নেতাদের কাছে একই আবেদন জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন রওনা হওয়ার পরই সমীক্ষাদল এ পরামর্শ দেয়।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউ টাইমস-এ এদিন সংবাদ ভাষ্যকার এ উলানস্কির এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান গায়ের জোরে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রায় অস্বীকার করেছেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ। অসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার নামে ইয়াহিয়া ভুট্টোকে ক্ষমতা দিলে তা হবে খুব খারাপ।

এ উলানস্কি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মনোভাব প্রকাশ করেন, যাতে মনে না হয় যে পাকিস্তানের ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করছে।

২০ জুন ১৯৭১:  পাকিস্তানি শাসকদের হত্যা-পরিকল্পনা

ব্রিটেনের সানডে টাইমস ২০ জুন তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলা-দেশ নিয়ে পাঁচ কলামব্যাপী সংবাদ নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ যাঁকে যাঁকে বিপজ্জনক মনে করছে, তাঁদেরই হত্যা করছে। সাদা, ধূসর ও কালো—এ রকম তিনটি তালিকা সামরিক কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে।

সাদা তালিকার লোকেরা বেকসুর। ধূসর তালিকার লোকেদের জেলে পোরার পরিকল্পনা হচ্ছে। আর কালো তালিকার মানুষদের হত্যা করা হবে। পত্রিকাটি লেখে, এই নীতির প্রয়োগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। নাৎসি গেস্টাপোর মতো পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বাংলা-দেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্সও সানডে টাইমস–এর এই প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রচার করে।

পাকিস্তানের সঙ্গে আপস নেই

যুক্তরাজ্যে সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাংলা-দেশের রাষ্ট্রদূত এবং বহির্বিশ্বে বাংলা-দেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়েলসের কার্ডিফে বাংলা-দেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে আয়োজিত সভায় বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলা-দেশের আপসের সম্ভাবনা আছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ গুজব পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, বাংলা-দেশ স্বাধীন হবেই এবং জনগণের প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবেন।

লন্ডনে ঘোষণা করা হয়, ব্রিটেন থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানে ১০ দিন ধরে সফর করবেন। এ দলে কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টি থেকে দুজন করে মোট চারজন এমপি থাকবেন। ২১ জুন তাঁরা যাত্রা করবেন। বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তান সরকার তাদের পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।

ফিলিপাইনের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস বাংলা-দেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি একাত্মতা জানায়। তারা পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজ থেকে মালামাল না নামানোর জন্য ফিলিপাইনের শ্রমিক সংগঠনগুলোকে আহ্বান করে। বাংলা-দেশে গণহত্যার প্রতিবাদে সংগঠনটি ম্যানিলায় পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনেরও ঘোষণা দেয়।

প্যারিসে ১৪ রাষ্ট্রের ভারত সহায়ক সমিতির প্রতিনিধিরা দুই দিনব্যাপী বৈঠক শেষে বাংলা-দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাঁরা বলেন, শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করাই সমস্যার একমাত্র সমাধান।

বাংলা-দেশের স্বীকৃতি বা পাকিস্তানে হামলা এখনই নয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাশ্মীর সফর শেষে ২০ জুন দিল্লি ফেরার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলা-দেশে হত্যাকাণ্ড থামালেই কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত এ ব্যাপারে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনায় বসতে পারে। বাংলা-দেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের পক্ষে কী ভালো, সেটা বিবেচনা করে স্থির করবে সরকার। কিছু লোকের দাবিতে নীতি নির্ধারণ করা যায় না।

মার্ক্সবাদী নেতা জ্যোতি বসু ২০ জুন বলেন, বাংলা-দেশের সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া তাঁর দল সমর্থন করে না। তাঁর দল মনে করে, আক্রমণ করলে পাকিস্তান ভারতে হামলা করার একটি অজুহাত পেয়ে যাবে।

নব কংগ্রেসের সভাপতি ভি সঞ্জিবায়া ইন্দোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত যদি বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে যে ফাঁদ সে এড়াতে চায়, সেই ফাঁদেই সে পড়বে। শুধু ভারতের স্বীকৃতিতে কিছু হবে না। বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলা-দেশ সরকারকে স্বীকার করলেই কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

দিল্লি সফররত বাংলা-দেশের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক দিল্লিতে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার শুধু বাংলা-দেশের নয়, পাকিস্তানিদেরও শত্রু। তারা যেদিন এ কথা বুঝতে পারবে, সেদিন স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়ের জন্য তারাও এদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলা-দেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারে চোখ বুজে আছে। বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলো একদিন বুঝবে যে ন্যায় আমাদের পক্ষে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, পাকিস্তান ভারতের পূর্বাঞ্চলে বারবার সীমান্ত লঙ্ঘন করছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পাকিস্তানে বিরোধিতা

রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে বিনা প্ররোচনায় গুলিবর্ষণের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে তাদের হাইকমিশনে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে। প্রতিবাদে বলা হয়েছে, এই সামরিক হস্তক্ষেপে প্রাণ ও সম্পদহানির জন্য পাকিস্তান ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানিরা রাজনৈতিকভাবে অনুভব করেন, প্রশাসনে তাঁদের সমানাধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। পাকিস্তান আদর্শের বিরোধীরা এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েছে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা ছিল, যদিও তিনি কখনো তা প্রকাশ করেননি।

২১ জুন ১৯৭১: যুক্তরাজ্য ও ভারতের যুক্ত বিবৃতি

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলা-দেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ২১ জুন লন্ডনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে দেখা করেন। ডাউনিং স্ট্রিটে এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁকে বাংলা-দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব সবিস্তার জানান। তিনি তাঁকে বাংলা-দেশ থেকে
শরণার্থী আগমন বন্ধ করা এবং তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে ব্রিটেন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। আলোচনা শেষে যুক্তরাজ্য ও ভারত একটি যুক্ত বিবৃতি দেয়।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করেন। সরদার শরণ সিং সে ভোজসভায় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করেন। পরে স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমের সঙ্গে বৈঠক করেন। সরদার শরণ সিং তাঁর সঙ্গে বাংলা-দেশের জনগণের বর্তমান সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র খুঁজে বের করার ব্যাপারে আলোচনা করেন। করণীয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্যও হয়।

এ আলোচনার পরে সরদার শরণ সিং লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১৫ দিন ধরে তিনি যেসব দেশ সফর করেছেন, তাদের সরকারেরা পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দেওয়া স্থগিত রাখার কথা ভাবছে। তবে ঘরোয়াভাবে শোনা সেসব বক্তব্য তিনি প্রকাশ করবেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাকিস্তান নিজের দোষে নিজের অর্থ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাই অর্থনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া নিরর্থক এবং এর মানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে লঘিষ্ঠ অংশকে মদদ দেওয়া।

ব্রিটেন ও ভারত এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলা-দেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানায়। শরণার্থীদের দ্রুত স্বদেশে ফেরার মতো অবস্থা সৃষ্টি এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়ার জন্যও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবেদন জানান।

পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলো এবং জাপানের প্রতিনিধিরা ২১ জুন স্থির করেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখা না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন করে সাহায্য দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা স্থগিত থাকবে। ১২টি দেশের সদস্য নিয়ে গঠিত পাকিস্তানকে সাহায্যকারী কনসোর্টিয়াম এর আগে স্থির করেছিল যে ভবিষ্যৎ সাহায্য সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এদিন একটি তারিখ স্থির করা হবে।

পাকিস্তানকে সাহায্যদাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা কয়েক দিন আগে পাকিস্তান সফর করে যাওয়া বিশ্বব্যাংকের এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিলের কাছ থেকে পাকিস্তানের পরিস্থিতির বিবরণ শুনেছিলেন।

শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেশ পাল সিং সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সরকার বন্ধু ও বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য সরকার ওই দেশগুলোকে অনুরোধ করেছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী আর কে খাদিলকর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বলেন, ভারত ও পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সফরকালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের করা উক্তি থেকে ধারণা হয়েছে যে তিনি পক্ষপাতমুক্ত নন। এ ধারণা ও আশঙ্কা জানিয়ে ভারত সরকার এরই মধ্যে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তাঁর বক্তব্যের আগে রাজ্যসভার বিভিন্ন দলের সদস্যরা প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলো পরিদর্শন করতে দেওয়ায় সরকারকে ভর্ৎসনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ বাংলা-দেশের শরণার্থীদের সম্পর্কে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ২১ জুন দিল্লি আসেন। কেলাগ দিল্লি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, এই শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অন্যতম মর্মন্তুদ ঘটনা। কেলাগ কয়েকটি শিবির পরিদর্শন করবেন।

ভারত এই দিন পাকিস্তানের কাছে দাবি করে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। বাংলা-দেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ নিলামে বিক্রি করছে অথবা তাদের অনুগত সহযোগীদের কাছে বন্দোবস্ত দিচ্ছে—ভারত সরকার এ বিষয়টি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের নজরে আনে।

বাংলা-দেশ সরকার

বাংলা-দেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে বলেন, ছয় দফাই বাংলা-দেশের জনগণের মুক্তির একমাত্র সনদ।

যুক্তরাজ্যে বাংলা-দেশের রাষ্ট্রদূত এবং বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনের অংশ হিসেবে ২১ জুন নেদারল্যান্ডস সফরে যান। তিনি লন্ডন থেকে বিমানযোগে দেশটির বিমানবন্দরে পৌঁছালে সাংবাদিকেরা তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। রাতে দুজন সাংসদ হোটেলে এসে তাঁর সঙ্গে বাংলা-দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলা-দেশে

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার বিজয়পুর সেতুর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়িকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে গাড়ি দুটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনী-নোয়াখালী সড়কে বোগাদিয়া নামের স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্রাককে অ্যামবুশ করলে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া নোয়াখালী-ফেনী সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা বজরা নামক স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি দল আখাউড়া-সিলেট রেলপথে তেলিয়াপাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর মনতলা অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যান।

২২ জুন ১৯৭১:  পাকিস্তানি জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র

সুন্দরবন ও পদ্মা নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস–এ ২২ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুই জাহাজের একটি ৮ মে নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করে। ২১ জুন সেটি করাচি বন্দরে পৌঁছানোর কথা। দ্বিতীয়টি ছেড়েছে ২১ জুন। সেটি পৌঁছাবে আগস্টের মাঝামাঝি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী জাহাজ দুটিতে ছিল আটটি জঙ্গিবিমান, প্যারাস্যুট, কামান, ট্রাকের যন্ত্রপাতিসহ নানা সামরিক যন্ত্রাংশ। অস্ত্রবাজারের দরের চেয়ে অনেক সস্তায় পাকিস্তানকে এসব দেওয়া হয়। এগুলো দেওয়া হয় বিমানবাহিনীর মাপনাই স্টোরস থেকে।

নানা প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সতর্কবার্তার পরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ হয়নি।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ছয়টি দেশে সফর শেষ করে এই দিন দিল্লি ফেরেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকেরা নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়ে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করা হবে।

যুক্তরাজ্যের আরেকটি সংসদীয় দল

বাংলা-দেশের অবস্থা সরেজমিন অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাজ্যের চার সদস্যের আরেকটি ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল জেনেভা থেকে এই দিন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এসে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের দুজন লেবার পার্টির সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমলি ও রেজিনল্ড প্রেন্টিস এবং কনজারভেটিভ পার্টির দুজনের একজন সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী জেমস র‌্যামডেন ও অন্যজন টবি জেসেল। করাচি বিমানবন্দরে আর্থার বটমলি সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করার সুযোগ বিষয়ে জানতে তাঁরা এসেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন বলেও জানান। এরপর তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে যাবেন।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো কোয়েটায় বলেন, কনসোর্টিয়ামের সাহায্য বন্ধের হুমকি একটি বৈদেশিক চাপ। এ ধরনের চাপ শুধু মারাত্মক ও ক্ষতিকরই নয়, বরং অপমানজনকও।

কাইয়ুম মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান শক্তিশালী কেন্দ্রের গ্যারান্টি দিয়ে প্রেসিডেন্টকে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা সমর্থনকারী সব দল বা গোষ্ঠীর প্রতিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানান।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানের আদর্শ সব জাতিরই প্রেরণার উৎস এবং ইসলামই কেবল দেশের দুই অংশকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে পারে।

নেজামে ইসলামী পার্টির প্রধান মওলানা এ কে শামসুল হক সামরিক শাসন আরও দীর্ঘায়িত করার সুপারিশ করেন।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের ঢাকার প্রশাসক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্লোগান, দেয়াললিখন, নির্বাচনী প্রতীক মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক

বাংলা-দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে দিল্লিতে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের সাধারণ পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কয়েকজন সাংসদ সরকারকে বাংলা-দেশ সমস্যার সমাধানে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখতে অনুরোধ করেন।

কাশ্মীরের সৈয়দ আহমদ আগার বলেন, পাকিস্তানের ভাগাভাগি মুসলিমবিরোধী নয়। পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বাংলা-দেশকে মুক্ত করতেই হবে।

অন্ধ্র প্রদেশের পি ভেঙ্কট সুদ্বিয়ার প্রশ্ন করেন, বিশ্বশক্তিগুলো এমন কিছু করতে চায় না, যাতে ভারত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় কি ভারত যুদ্ধ করে বাংলা-দেশের নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে? তিনি প্রস্তাব দেন, কোনো চরম ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সরকারের উচিত সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা।

বৈঠকে আরও আলোচনা করেন টি পার্থ সারথি (তামিলনাড়ু), আকবর আলী খান, সি এম স্টিফেনস, মহিতোষ পুরকায়স্থ, এস বি সাবন্ত ও লস্কর দেও। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শোনেন। আলোচনা অসমাপ্ত থাকে।

আদি কংগ্রেসের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল বাংলা-দেশের শরণার্থী ও সীমান্ত পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে দলের নেত্রী সুচেতা কৃপালনি বলেন, ভারত সরকার যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় এখন প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। তিনি জাতিসংঘের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত বড় গণহত্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের কেউ নিন্দা করেননি।

চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি এদিন এক বেতার ভাষণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। এ সুযোগে নানা স্বার্থান্বেষী মহল স্থানীয় বাসিন্দা ও শরণার্থীদের মধ্যে ভেদ–বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। শরণার্থী আগমনের কারণে কিছু অসুবিধা হলেও তাদের দিকে সেবার হাত প্রসারিত রাখার জন্য তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন।

তাজউদ্দীনের ভাষণ

বাংলা-দেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া এবং পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভাষণে তিনি ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

নেদারল্যান্ডস সফররত যুক্তরাজ্যে বাংলা-দেশের রাষ্ট্রদূত ও বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দেশটির সংসদের পার্লামেন্টের স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাংলা-দেশের ঘটনাবলি জানান।

বিকেলে তিনি সংসদীয় কমিটির বিদেশবিষয়ক সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদেরও তিনি বাংলা-দেশের ঘটনাবলি সবিস্তার জানান। সব শুনে কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমন হত্যাযজ্ঞের পর বাংলা-দেশ আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলা-দেশের মুক্তিসংগ্রামকে তাঁরা আদর্শগতভাবে সমর্থন দেবেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাপুর ঘাঁটিতে গোপনে প্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই অভিযানে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অন্যদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি পৃথক দল খুলনার বৈকরি এবং যশোরের বেনাপোলে পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্তঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এ ছাড়া বগুড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচবিবি ক্যাম্পে আক্রমণ চালান।

২৩ জুন ১৯৭১:  পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়ায় তোলপাড়

পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর ২৩ জুন আলোচনা-সমালোচনায় মুজিবনগর, দিল্লি ও ওয়াশিংটন উত্তাল হয়ে ওঠে। বাংলা-দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এক তারবার্তা পাঠান। সেই তারবার্তায় তিনি বলেন, পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর সংবাদে তাঁরা মর্মাহত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অবিলম্বে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করার আহ্বান জানান।

ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র জেরি ফ্রিড হাইস স্বীকার করেন, আমেরিকার অস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তান যাত্রা করেছে। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ হোয়াইট হাউস পাকিস্তানে সমরাস্ত্র পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগেই ওই সব অস্ত্রশস্ত্রের লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয়েছিল। তবে ওই অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ৮টি জঙ্গিবিমান নেই বলে তিনি দাবি করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গলেন স্টোনকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করে। তিনি দুবার
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে প্রথমবার যুগ্ম সচিব নরেন্দ্র সিং এবং দ্বিতীয়বার পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, গণহত্যায় সম্পৃক্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের পরিণাম গুরুতর হবে। ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ লাখ শরণার্থী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তানকে আবার অস্ত্র দিলে ভারতের বোঝা বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর স্টুয়ার্ড সিমিংটন এক বিবৃতিতে পাকিস্তানে দুই জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর সমালোচনা করে বলেন, মনে হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয় কিছু জানে না, কিংবা সব জেনেবুঝেও না জানার ভান করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কৈফিয়ৎ দাবি করে তিনি পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে কংগ্রেসকে ভেবে দেখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ২৩ এপ্রিল সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটিকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে পাকিস্তানকে সমর-সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসন যে কংগ্রেসকে ধাপ্পা দেয়, এ ঘটনা তার এক দৃষ্টান্ত।

নিউইয়র্ক টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠিয়ে বাঙালি-নিধনে ইয়াহিয়াকে মদদ জোগানোর ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে ধিক্কার জানায়।

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে দেখা করে বলেন, নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবরটিকে তিনি সঠিক বলে মনে করেন না।

শরণার্থীদের ব্যাপারে কেলাগ জানান, তাদের জন্য ছয় মাসের কথা চিন্তা করে তিনি ৩০০ কোটি টাকার একটি বাজেট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সম্পর্কে ভারত সরকার অবিলম্বে বিশদ পরিকল্পনা পাবে। কেলাগ আরও বলেন, বিশ্বের দেশগুলো পাকিস্তানের ওপর চাপ দিক। নয়তো এই এলাকা গেরিলাযুদ্ধের কেন্দ্র হয়ে পড়বে। বাংলা-দেশের অবস্থা ভারতের গণতন্ত্রের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

ভারতীয় সংসদের সর্বদলীয় সাংসদদের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে গিয়ে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র দেয়। দূতাবাসের বাইরে তারা ‘দুমুখো খেলা বন্ধ কর’, ‘অস্ত্রবোঝাই জাহাজ দুটি পাকিস্তানে পৌঁছানো বন্ধ কর’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।

বাংলা-দেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে এক বিবৃতিতে বাংলা-দেশ প্রশ্নে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্যদানকারী কনসোর্টিয়ামের পাকিস্তানকে পরবর্তী সাহায্য ও ঋণ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।

ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের একটি বার্তা দেন। রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কিছু সময় আলোচনাও করেন। সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এর আগে পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করে বলেন, পাকিস্তানের গতিবিধি যা-ই হোক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন করে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এবং ব্রিটেনের হাইকমিশনারও টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করেন। ভারতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রেজা আমীর তৈমুর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে ইরানের শাহের একটি বার্তা পৌঁছে দেন।

বাংলা-দেশে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদেশে জনমত গঠনের জন্য দ্য ন্যাশনাল ফেডারেশন অব বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনালস উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ক্লাব ইন্ডিয়ার সভানেত্রী আভা মাইতি কয়েকটি রাষ্ট্র সফরের ঘোষণা দেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কানাডার এডমন্টনে তিনি এই ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, আরবের কয়েকটি দেশ ও থাইল্যান্ডে যাবেন।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো কোয়েটায় বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পিপলস পার্টি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে কিছু সুপারিশ পেশ করেছে।

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সহসভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে বিদেশ সফরে জেনেভায় রওনা হন।

পূর্ব পাকিস্তান সফররত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ আবদুল হামিদ খান ভারত সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী এলাকায় নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাদল ও তাদের স্থাপনা পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক এ এ কে নিয়াজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।

পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ

ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম কমন্সসভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সুস্পষ্ট অগ্রগতি না হওয়া অবধি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কোনো সাহায্য দেবে না।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ভারতে আসা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করতে পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান দরকার। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেভায় ফিরেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নানা স্থানে সফরকালে তিনি সাম্প্রতিক সংঘর্ষের বহু চিহ্ন দেখেছেন। ভারত সরকার শরণার্থীদের জন্য যে কাজ করছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

২৪ জুন ১৯৭১:  পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদ

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহতভাবে চলছিল। একাত্তরের এদিন দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি দেন বিক্ষোভকারীরা। এতে বলা হয়, অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহিত করছে।

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ এদিন বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বয়রায় শরণার্থীশিবির দেখতে যান। এ সময় শরণার্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে আটটি স্থানে তাঁর বিরুদ্ধে এমন বিক্ষোভ হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ফ্রাংক এল কেলাগকে একটি স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুমুখো নীতি বন্ধ করে একটি সঠিক ভূমিকা নেওয়া এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র উপঢৌকন বন্ধ রাখার দাবি জানানো হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ভারতের পূর্ব সীমান্তের ঘটনাবলি উল্লেখ করে বলেন, ভারত বিরাট এক সংকট ও বিপজ্জনক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্য জোরদার করতে তিনি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আবেদন জানান।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন কুমিল্লার পূর্বে বিবিরবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কসবার উত্তরে লাতুমুড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। দুই অভিযানে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

ভারতের জলপাইগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল এদিন বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের থুকরাবাড়ি, চাউলহাটি, সোনারহাট ও হেমকুমারী এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিটি দলের সদস্যসংখ্যা ছিলেন ৯০। এখান থেকে তাঁরা শুরু করেন পরবর্তী গেরিলা যুদ্ধাভিযান।

উপমহাদেশের বাইরে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে স্বীকার করেন, তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিইউয়র্ক থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সুন্দরবন ও পদ্মা নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানে যাত্রা করেছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস যে খবর প্রকাশ করে, পররাষ্ট্র দপ্তর তার সত্যতা স্বীকার করে। অস্ত্রবোঝাই তৃতীয় জাহাজটির নাম কাউখালী। এই জাহাজ ৩ এপ্রিল নিউইয়র্ক ছাড়ে। চার্লস ব্রে আরও বলেন, ২৬ মার্চ পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহের সব লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কয়েক দিন লেগে যায়। তাই তিনি বলতে পারছেন না, এই লাইসেন্স দিয়েই অস্ত্র জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে কি না।

মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফোর্ট জিল ও বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার পরিষদের মহাসচিব ড. রিচার্ডো মলিনা মার্টি এদিন পৃথক বিবৃতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য বিশ্বশক্তির প্রতি আহ্বান জানান।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আববা ইবান এদিন দেশটির পার্লামেন্টে (নেসেট) বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার নীতির দরুন পূর্ব বাংলা থেকে যাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, ইসরায়েল তাঁদের জন্য ভারতকে সাহায্য করতে চায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে এই প্রথম ইসরায়েল সরকারিভাবে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করল। শরণার্থীদের জন্য ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে ইবান বলেন, বিশেষজ্ঞ, ওষুধপথ্য ও সমাজসেবীদের পাঠিয়ে ইসরায়েল ভারতকে সাহায্য করতে আগ্রহী।

২৫ জুন ১৯৭১:  পাকিস্তানে অস্ত্র দেওয়ার লাইসেন্স বাতিল

২৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, ৯ হাজার ডলারের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের জন্য পাকিস্তানের জন্য যে দুটি লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয়েছিল, তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেওয়ার পর ৩১ মার্চ ও ৬ এপ্রিল লাইসেন্স দুটি মঞ্জুর করা হয়েছিল।

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে একদল বাঙালি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন। এর আগে তিনি দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ছিলেন। এই প্রথম তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দিলেন। তাঁর স্ত্রীও এ সময় সঙ্গে ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পক্ষে প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) ডোনাল্ড এক্সহার্ট শেহাবউদ্দিনের কাছ থেকে একটি স্মারকলিপি নেন। স্মারকলিপিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অস্ত্রবাহী জাহাজগুলোকে পাকিস্তানের বন্দরে যেতে না দিতে এবং সমরাস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। জনসংঘের নেতা-কর্মীরাও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাতে নেতৃত্ব দেন এস কে সাদবাতি ও ডা. ভাই মহাবীর। তাঁরাও দূতাবাসে স্মারকলিপি দেন।বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইসলামি সম্মেলন সংস্থার মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমানের কাছে এক তারবার্তায় বাংলাদেশ চলমান গণহত্যা বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের এক সমাবেশে বলেন, ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী শুধু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদেরই হত্যা করছে না, গত ২৩ বছরে বাংলাদেশ যে সম্পদ সৃষ্টি করেছিল, তাও তারা ধ্বংস করেছে। এ আর মল্লিক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেওয়া এবং বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান।

শরণার্থীদের সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য তাঁর সরকার ভারতকে ৭ কোটি ডলার সাহায্য বাড়াবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার মঞ্জুর করেছিল।

পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী উইলি স্যঁপ জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পূর্ব জার্মানি ভারতকে অতিরিক্ত ৬০ লাখ মার্ক মূল্যের সাহায্যসামগ্রী সরবরাহ করবে। জাতিসংঘে নিযুক্ত অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টকে জানান, পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে অস্ট্রিয়া সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ১ লাখ ডলার সহায়তা দেবে। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ২২ জাতি ইসলামি সম্মেলনে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।

ভারত সরকারের অবস্থান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশকে এ মুহূর্তে স্বীকৃতি দিলে কোনো লাভ নেই। স্বীকৃতি দেওয়ার আগে বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ছোট ও মাঝারি সংবাদপত্রগুলোর উদ্যোগে বাংলাদেশ সম্পর্কে দিল্লিতে তিন দিনব্যাপী এক আলোচনাচক্রে যোগ দেওয়া প্রায় ৫০ জন উর্দু সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।

সম্পাদকদের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর পর্বে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা ও সেখানকার অধিবাসীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে। তবে এই চাপের ফল এখনো অস্পষ্ট।

বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং এখন ঘটছে, তাতে ভারতের হাত আছে—এই অভিযোগ অস্বীকার করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থার কারণ পাকিস্তানের শাসকদের ভ্রান্ত নীতি। এ অবস্থার আরেক কারণ পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ব্যাপক গণহত্যা।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দিল্লিতে কংগ্রেস সংসদীয় দলের সভায় বলেন, ভারত অসহায়ের মতো বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দেখে যেতে পারে না। সেখানকার অবস্থা সীমান্ত নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলেছে। ভারতের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া না গেলে ভারত নিজেই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

 

বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস

 

২৬ জুন ১৯৭১:  সিপিবির জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটি ২৬ জুন মুজিবনগর থেকে বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে তারা বাংলাদেশের জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আবেদন জানায়। তারা বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক এবং সংগ্রামী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি ফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এগিয়ে আসার প্রত্যাশা জানায়।

বিবৃতিতে বলা হয়, ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে এমন একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে কমিউনিস্ট পার্টি চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ধরনের চেষ্টা শুধু বাংলাদেশের জনগণকেই আরও অনুপ্রাণিত করবে না, বিশ্বজনমতকেও সংগ্রামের সমর্থক করে তুলবে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে। দুঃখের কথা, চীন প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বও এই সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বাংলাদেশে গণহত্যার হাতিয়ার জোগাতে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র পাঠানোয় প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নও একটি বিবৃতি দেয়। পাকিস্তানকে সাহায্য অব্যাহত রাখায় চীনকেও এ বিবৃতিতে ধিক্কার জানানো হয়।

বাংলাদেশ সরকারের দিল্লির কূটনৈতিক প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গণহত্যা বন্ধ করার জন্য ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে আবেদন জানান।

বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের শান্তি সংসদ এক যুক্ত বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্রবোঝাই দুটি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোর তীব্র নিন্দা করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করার অর্থ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

পাকিস্তানি জাহাজ, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যা

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে জানান, ২২ জুন পদ্মা নামে যে পাকিস্তানি জাহাজটি অস্ত্র নিয়ে রওনা হয়েছে, তাতে ছোট অস্ত্রের উপযোগী গুলি এবং বিমান ও সামরিক যানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ রয়েছে। কাগজপত্রে দেখা গেছে, জাহাজটি দুই হাজারটি ২২ ক্যালিবারের গুলি ও যন্ত্রাংশ নিয়ে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে। ওই জাহাজে গোলাগুলি বলতে আছে শুধু ২২ ক্যালিবারের গুলি।

চার্লস ব্রে আরও জানান, পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি আরও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, জাহাজে কোনো বিমান পাঠানো হচ্ছে না। গত ৬ এপ্রিল অসতর্কভাবে দুটি লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।

পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পদ্মায় বিশেষ ধরনের বিমান থাকতেও পারে। তবে সে বিমান কী কাজে লাগানো হবে, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই।

চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ভারতে আসা বাংলাদেশের নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দ্রুত তাদের সম্মানজনকভাবে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

নেদারল্যান্ডসের উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী বি জে উডনিক জানান, বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত সাহায্য দেওয়া স্থগিত থাকবে। তবে ঋণদানের চুক্তিগুলো এর আওতায় পড়বে না। উডনিক আরও জানান, তিনি গতকাল পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের সাহায্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অন্য দেশগুলো যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাঁরাও সেই একই ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, বিশ্বব্যাংকের বড় বড় ১১টি সাহায্যদাতা দেশ পাকিস্তানকে নতুন অর্থসাহায্য স্থগিত রাখতে রাজি হয়েছে।

আফ্রো–এশিয়া সংহতির পক্ষপাত

আফ্রো–এশিয়া সংহতি সংস্থার ভারতীয় চ্যাপ্টারের সহসভাপতি অরুণা আসফ আলী ২৬ জুন চ্যাপ্টারের সভাপতি কে ডি মালবাকে লেখা এক চিঠিতে জানান, বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে তাঁর বক্তব্য পেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ভারতীয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে নারকীয় পাকিস্তানি অত্যাচার সম্পর্কে যা বলেছে, তা ফলপ্রসূ হয়নি। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে দামেস্ক বৈঠকে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়, তা পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থার কর্ম সমিতি ইচ্ছা করে পাকিস্তানের নিন্দা করা থেকে বিরত থেকেছে।

অরুণা আসফ আলী চিঠিতে উল্লেখ করেন, এ অবস্থায় ভারত ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে থাকবে কি না, তা নতুন করে ভাবা উচিত। সম্প্রতি সিরিয়ার দামেস্কে অনুষ্ঠিত সংস্থার বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাপারে যেভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করা হয়েছে এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তাতে তিনি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ।

দিল্লিতে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে সভাপতি করে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়।

ভারত সফররত ইংল্যান্ডের শিশু ত্রাণ তহবিলের সহসভানেত্রী এবং ব্রিটিশ ভারতের সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জনের মেয়ে লেডি আলেকজান্দ্রা মেটকাফ কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দেন।

 

জুন মাস ১৯৭১ ৪, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

২৭ জুন ১৯৭১ :  দৃঢ় মনোবল শরণার্থীদের

ভারতের শাসক দল নব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হেনরি অস্টিনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল একাত্তরের ২৬ জুন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারীরা অসহনীয় অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করলেও তাদের মনোবল অবিশ্বাস্য রকমের দৃঢ়।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে গঠিত বাংলা-দেশ মৈত্রী পরিষদের সভাপতি বাণীকান্ত গুহ এদিন জানান, বাংলা-দেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তাঁরা রবীন্দ্রসদনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছেন। এতে অংশ নেবেন সুচিত্রা মিত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, রানি চক্রবর্তী, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের শিল্পীরা। বাংলা-দেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে বিজন ভট্টাচার্যের লেখা নতুন নাটকও অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হবে।

ভারতের সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জনের মেয়ে লেডি আলেকজান্দ্রা মেটকাফ সেভ দ্য চিলড্রেনের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং ৫০ শয্যার একটি শিশু হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। এ সময় ব্রিটেনের উপহাইকমিশনার এফ এস মানশস এবং তাঁর সহধর্মিণী উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তান মানবে না ঋণে রাজনৈতিক শর্ত

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ ইসলামাবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সম্ভাব্য বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ হলে সরকারের বিকল্প আছে। ঋণ ও সাহায্যে রাজনৈতিক শর্তারোপ করা হলে তা বর্জন করা হবে।

তেহ্‌রিক ইশতিকলাল পার্টির আহ্বায়ক এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে আসগর খান সাংবাদিকদের বলেন, তিনি কয়েক দিন এখানে অবস্থান করবেন। তিনি বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য এসেছেন।

অবরুদ্ধ বাংলা-দেশ সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুটি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে বরিশাল ও সিলেট পরিদর্শন করেন। আর্থার বটমলি ও জেমস র‌্যামসডেন সিলেট এবং রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস ও টবি জেসেল বরিশাল সফর করেন। সেখান থেকে ফিরে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য জহিরুদ্দিনের দেওয়া ভোজসভায় যোগ দেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এ ভোজসভায় ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল ভারত সীমান্তবর্তী যশোরের বেনাপোলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। একপর্যায়ে তারা ভারতীয় এলাকায় প্রবল গুলিবর্ষণ এবং মর্টার মেশিনগান নিয়ে হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরাও পাল্টা জবাব দেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। সকাল থেকেই দুই পক্ষে তুমুল লড়াই চলে।

সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৮ সদস্যের একটি দলকে কসবা থেকে ইমামবাড়ি যাওয়ার পথে কসবা রেলস্টেশনের কাছে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।

একদল পাকিস্তানি সেনা বান্দুয়ায় যাওয়ার জন্য ফেনী নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানে সেনারা পাঠাননগর রোড দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি দল ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি জাহাজ থেকে মেশিনগান দিয়ে রাজাপুর, গোপালনগর ও মধ্যনগরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে মধ্যনগরে একজন ও রাজাপুরে আরেকজন নিহত হন। একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার খোলাপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

ইন্দিরার চিঠি সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত এবং কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদ সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদেল রহমানের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাংলা-দেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। ফখরুদ্দিন আলী আহমদ তাঁকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি ওই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেন পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার জন্য সিরিয়া একক ও যৌথভাবে চেষ্টা করবে। ফখরুদ্দিন আলী আহমদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি চিঠিও সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট দামেস্কের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা ওয়াশিংটনে বলেন, প্রধান সাহায্যদাতা দেশগুলো পাকিস্তানে নতুন অর্থনৈতিক সাহায্যের বিবেচনা কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখছে না।

২৮ জুন ১৯৭১:  প্রস্তাব ইয়াহিয়ার সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় সরকার গঠনের

পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৮ জুন একটি বেতার ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব জাতীয় পরিষদকে দেওয়ার আগে পূর্বসিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি দিয়ে তিনি শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরির কাজ শুরু করেছেন। চার মাসের মধ্যে তাঁর সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করেছে। তবে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত দেশ সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকবে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সদস্য পদে বহাল থাকবেন। তবে রাষ্ট্রবিরোধী, অপরাধমূলক ও সমাজবিরোধী কাজে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সদস্য পদ থাকবে না। শূন্য আসন উপনির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।

ইন্দিরা গান্ধীঃ যুদ্ধের কথা বলা অনুচিত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সকালে দিল্লিতে লোকসভার বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলা-দেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের কথা বলা অনুচিত। এ ধরনের উক্তি পাকিস্তান নিজের পক্ষে ব্যবহার করবে। যুদ্ধের কথা শুনলে বন্ধুদেশগুলো তাদের আরও বেশি সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবে।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এটি বাংলা-দেশের স্বাধীনতার লড়াই। এ যুদ্ধ মূলত তাদেরই করতে হবে। এমনকি ভারত সরকার অসময়ে তাদের স্বীকৃতি দিলেও কোনো লাভ হবে না। বাংলা-দেশের সমর্থনে প্রয়োজনীয় সবকিছুই ভারত করছে। বিশেষ কোনো ব্যবস্থার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়া উচিত হবে না। ধৈর্য ধরে ঘটনার গতি লক্ষ করতে হবে।

অবরুদ্ধ বাংলা-দেশ সফর শেষে ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিশেষ ব্রিটিশ বিমানে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় পৌঁছে দলের সদস্য টবি জেসেল সাংবাদিকদের বলেন, বাংলা-দেশে যে গণনিধন চলছে, সে প্রমাণ তাঁর কাছে আছে। গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন চলছে। স্থানীয়রা পালিয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর লোকজন মর্জিমতো গুলি চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না শরণার্থীরা ফিরে যান। এখন সেখানে ফিরে যাওয়া বুদ্ধির কাজ হবে না।’

পরিষদের সদস্যরা বসবেন বৈঠকে

মুজিবনগরে বাংলা-দেশ সরকার ঘোষণা দেয়, বাংলা-দেশের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা কয়েক দিনের মধ্যেই একটি অধিবেশনে বসবেন। বাংলা-দেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সে অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, বৈদেশিক সাহায্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করবেন। সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলা-দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

বাংলা-দেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম এক বিবৃতিতে বাংলা-দেশের মুক্তিযুদ্ধ শক্তিশালী করার জন্য সব মুক্তিকামী শক্তিকে নিয়ে সংযুক্ত মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করার আহ্বান জানান। ফ্রন্টে তিনি মুক্তিকামী নারী সংস্থাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানান। এই দিন পরিষদের এক সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

ভাষণের প্রতিক্রিয়া

বাংলা-দেশ সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে বলেন, ইয়াহিয়া খান হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তাঁর বিশেষজ্ঞ কমিটি পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য সংবিধান রচনা করতে পারে। তাতে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের কিছু বলার নেই।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, আওয়ামী লীগের কিছু দলত্যাগী সদস্যকে নিয়ে একটি তাঁবেদার সরকার গঠন করা হলে বাংলা-দেশের জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলা-দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানকে তাঁরা রাজনৈতিক সমাধান মনে করেন।

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইয়াহিয়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করায় তিনি আনন্দিত।

গোলাম আযম এক বিবৃতিতে বলেন, ইয়াহিয়া ঘোষিত কর্মসূচিই জাতির জন্য একমাত্র পথ।

ঢাকায় সামরিক আদালত আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, খায়রুল ইনাম খসরু—এই ছয় ছাত্রনেতাকে তাঁদের অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

২৯ জুন ১৯৭১: সোভিয়েত সমর্থন দেবে জাতিসংঘে

সোভিয়েত ইউনিয়নে তিন বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষ করে ডি পি ধর ২৯ জুন দিল্লিতে ফিরে আসেন। দিল্লিতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘে বাংলা-দেশ কিংবা শরণার্থী সমস্যা-সম্পর্কিত বিষয় উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন দিল্লিতে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠকে বাংলা-দেশ সম্পর্কে অসমাপ্ত আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, বাংলা-দেশের ব্যাপারে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যর্থ হয়নি। ভারত বাংলা-দেশের ব্যাপারে বলিষ্ঠ নীতি অনুসরণ করে চলেছে, তবে অনাবশ্যক কোনো ঝুঁকি ভারত নেবে না। তিনি আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণই প্রমাণ করেছে, পাকিস্তানের শাসকচক্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। সে দেশের প্রকৃত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা-দেশের বক্তব্য তুলে ধরে দিল্লিতে ফিরে এদিন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, বড় রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আশ্বাসের অপেক্ষা না করে ভারতকেই বাংলা-দেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ভারত সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদল শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে গেলে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের মুখে পড়ে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা শরণার্থীদের বলেন, তাদের দাবি যাতে পূরণ হয় সে ব্যাপারে তাঁরা চেষ্টা করবেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন আর্থার বটমলি, টবি জেসেল, রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস ও জেমস র‌্যামসডেন।

পাকিস্তান টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদল বলে, তারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ত্রাসের ভাব লক্ষ করেছে। দলনেতা আর্থার বটমলি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামের পর গ্রাম তারা শূন্য দেখেছেন। সড়ক ও রেলসেতুগুলোও ছিল বিধ্বস্ত। প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য জানান, পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু নিধনের ব্যাপক জ্বলন্ত স্বাক্ষর রয়েছে।

আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিয়ে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ক্রিস টাফার ভ্যান হোলেন দেশটির সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটিকে বলেন, সরকারিভাবে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আছে। তবু কথাবার্তা ২৫ মার্চের আগেই পাকা হয়েছিল বলে কয়েক জাহাজ অস্ত্র সেখানে যাবে। এখন অস্ত্র চালান বন্ধ করলে পাকিস্তানের সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার হানি ঘটবে।

ভ্যান হোলেনের কথায় সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সন্তুষ্ট হননি। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার কোনো দরকার নেই। জাহাজি লাইসেন্স বাতিল করেই পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধ করা যায়। তিনি পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে ২৮ জুন পররাষ্ট্র দপ্তরে অভিযোগ পেশ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এদিন সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, নিউইয়র্ক বন্দরে কাপ্তাই নামে নতুন আরেকটি মালবাহী জাহাজেও অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে। দু-এক মাসের মধ্যে আরও চার-পাঁচটি জাহাজে সমরাস্ত্র বোঝাই করা হতে পারে।

ভাসানীর বিবৃতি

ন্যাপপ্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র পণ—হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, নয়তো মৃত্যু। এর মাঝখানে গোঁজামিলের কোনো স্থান নেই।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন প্রস্তাবের প্রতিবাদে কয়েকজন বাঙালি নাবিক যুক্তরাজ্যের বন্দরে থাকা একটি পাকিস্তানি জাহাজ ছেড়ে চলে যান। নিউইয়র্কের কয়েকজন বাঙালি নাবিকও গত রাতে পাকিস্তানি জাহাজ ছেড়ে চলে যান।

যুক্তরাজ্যের কিছু সংবাদপত্র প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের প্রতি নৈরাশ্য প্রকাশ করে নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব নিতান্তই এক ধাপ্পা। টাইমস বলে, ইয়াহিয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রস্তাবগুলোতে বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।

কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর বলেই তো বাঙালি এত দূর আসতে পেরেছে।

৩০ জুন ১৯৭১:  সমরাস্ত্র রপ্তানির অনুমতি বাতিল পাকিস্তানে কানাডার

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প দেশটির কমন্স সভায় ৩০ জুন জানান, কানাডা পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির সব অনুমতি বাতিল করেছে। পদ্মা জাহাজে যাতে কানাডার কোনো অস্ত্র না তোলা হয়, তার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ পদ্মার মাধ্যমে জঙ্গি বিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ পাকিস্তানে রপ্তানির কথা ছিল। পদ্মা জাহাজ সেসব নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর থেকে রওনা হয়ে যথারীতি মন্ট্রিয়েল বন্দরেও পৌঁছেছিল। শেষ মুহূর্তে রপ্তানিকারককে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এফ-৮৬ স্যাবর জেট জঙ্গি বিমানের জন্য ৪৬টি বাক্সবোঝাই যন্ত্রাংশ পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মায় তোলার আগেই কানাডা সরকারের নির্দেশে আটক করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন আভাস দেন, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক বিধিনিষেধের আগেই পাকিস্তানি জাহাজের অস্ত্রের রপ্তানি লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকলে ওই সব জাহাজের পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধের ব্যাপারে ওয়াশিংটন কিছু করবে না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত এবং দেশটির পর্যটনমন্ত্রী করণ সিং বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে বেলগ্রেডে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি তাঁকে এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেন। সব শুনে মার্শাল টিটো ভারত উপমহাদেশে অবস্থার অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান লন্ডনে এক সাংবাদিক বৈঠকে জানান, জাতিসংঘ এবং অন্য সংস্থাগুলো শরণার্থীদের জন্য এ পর্যন্ত ১৬ কোটি ডলার সাহায্য সংগ্রহ করেছে। তবে শরণার্থীদের জন্য যা প্রয়োজন তার কাছাকাছিও পৌঁছায়নি। তিনি আরও বলেন, একমাত্র রাজনৈতিক সমাধানই শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ইয়াহিয়া খানের ভাষণটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁর শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে একটি নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে কংগ্রেস সেবাদল ক্যাম্পে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের বিষয়ে বলেন, ভারত দরিদ্র দেশ, তবু বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য দিতে ভারতই এগিয়ে এসেছে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গকে ৩০ জুন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়। শনবার্গ বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে’ ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করে। মার্চেও সিডনি শনবার্গ আরেকবার ঢাকা ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রী হাশিমউদ্দিন আহমদ ময়মনসিংহে এক সভায় বলেন, সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অপতৎপরতা গভীর উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment