আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা-দেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

Table of Contents

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারত ও পাকিস্তানের কাছে ২০ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের পাঠানো স্মারকলিপির জবাবে ভারতের বার্তা ২ আগস্ট নিউইয়র্কে তাঁর কাছে পৌঁছায়। চার পৃষ্ঠার ওই জবাবে ভারত জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানায়, বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি ধামাচাপা দেওয়ার বদলে সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের উপযোগী স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা করাও জরুরি। বাংলাদেশের মূল সংকট হচ্ছে, সংখ্যালঘু সামরিক শাসক সেখানে অবাধ নির্বাচনের রায় অস্বীকার করছে। বাংলাভাষী একটি জাতিকে গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। অবাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উপরন্তু মূল সমস্যাটি থেকে বিশ্বজনতার দৃষ্টি যারা অন্যত্র সরিয়ে দিতে চায়, তাদেরই সুবিধা করে দেওয়া হবে।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ সিং দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ভারতীয় এলাকায় এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেসরকারিভাবে প্রস্তাব করেছে। ভারত এ ব্যাপারে তাদের অসম্মতি জানিয়ে দিয়েছে।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে ৩ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৩০ জনের বেশি সদস্য আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানান। আবেদনকারী এমপিরা বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তিই বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ। লেবার পার্টির এমপি রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোমকে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেন। উত্তরে ডগলাস হোম বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য সময়ে যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তা এখন প্রকাশ না করাই ভালো।

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের পাকিস্তানি দূতাবাস এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মিশনের ১৪ জন বাঙালি কূটনীতিকের সবাই ৪ আগস্ট একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিকের সবাই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চান।

পদত্যাগকারী কূটনীতিকেরা হলেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের দুই নম্বর প্রতিনিধি সৈয়দ আনোয়ারুল করিম, ওয়াশিংটনের উপ–মিশন প্রধান এনায়েত করিম, ওয়াশিংটন দূতাবাসের কাউন্সেলর শাহ এ এম এস কিবরিয়া, শিক্ষাবিষয়ক কাউন্সেলর আবু রুশদ মতিনউদ্দীন, দ্বিতীয় সচিব (হিসাব বিভাগ) আতাউর রহমান চৌধুরী, তৃতীয় সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জে৬ম আলী এবং তিন স্থানীয় কর্মকর্তা শরফুল আনাম, শেখ রস্তম আলী, আবদুর রাজ্জাক খান প্রমুখ।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

পাকিস্তান সরকার এদিন পূর্ব পাকিস্তান সংকট নিয়ে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য সাজিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে সবকিছুর জন্য বাঙালিদের দায়ী করা হয়। শ্বেতপত্রে বলা হয়, সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করে।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রকাশিত এই শ্বেতপত্রে বলা হয়: এক. ১ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ লাখখানেক নরনারী–শিশুকে হত্যা করে। দুই. ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা তৈরি করে। তিন. আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে এবং ভারত বিদ্রোহীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।

চার. পরিকল্পনা হয় যে আওয়ামী লীগের নির্দেশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম দখল করে পাকিস্তানি সেনাদের পূর্ব পাকিস্তানে অবতরণ প্রতিহত করবে। একই সঙ্গে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট দখল করে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে খতম করবে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী সেনারা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল করার পর ভারতীয় সৈন্যরা তাদের সাহায্যার্থে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকবে। পাঁচ. ২৫ মার্চ শেখ মুজিব কর্নেল ওসমানীকে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কমান্ডার পদে নিয়োগ দেন।

পাকিস্তান সরকার এই শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বাংলাদেশে তাদের সামরিক বাহিনীর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং আওয়ামী লীগ ও ভারতের ওপর সব দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। তবে আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যমে শ্বেতপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্তা সংস্থা তাস ৬ আগস্ট আকস্মিকভাবে ঘোষণা করে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ভারতের রাজধানী দিল্লি সফরে আসছেন। তাসের ঘোষণার পরপর দিল্লিতেও একই ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, তিনি ৮ আগস্ট বিকেলে দিল্লি পৌঁছাবেন। এ ঘোষণায় বিশ্বের, বিশেষত পশ্চিমা কূটনৈতিক মহল হকচকিত হয়ে পড়ে। এর কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে পিকিং সফর বিশ্বকূটনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বারবার যুদ্ধের হুমকি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য মস্কোতে সদ্য রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা ডি পি ধরকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
জরুরি দায়িত্ব দিয়ে মস্কো পাঠিয়েছিলেন। তারই পরিণতি হিসেবে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি সফরের ঘোষণা আসে। ঘোষণাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে পর্যবেক্ষক মহলে গুঞ্জন ওঠে। এর আগে কোনো সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে আসেননি।

ভারত এদিন মিত্র মুসলিম দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করে, সেপ্টেম্বরে কাবুলে আসন্ন ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশের প্রশ্ন তুলে ভারতবিরোধী প্রচারকার্য চালাতে না পারে। মিসর সরকারের মাধ্যমে মিত্রদেশগুলোকে ভারত এ অনুরোধ জানায়।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এ ৭ আগস্ট পিটার হ্যাজেলহার্স্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর নিবন্ধে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপ পর্যালোচনা করা হয়।

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট লেখেন, মস্কো ও দিল্লির মধ্যে সম্প্রতি নেওয়া কয়েকটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রথমত, সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো অপ্রত্যাশিতভাবে দিল্লি সফরের ঘোষণা দেওয়ায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শিগগিরই শুরু হবে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের রাজনৈতিক মহল মনে করে, এই সফরের ফলে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক নিকটতর বলে প্রমাণিত হবে এবং সম্ভাব্য আক্রমণকারীরা তা বিবেচনায় নেবে।

দ্বিতীয়ত, ভারত সরকারের প্রবীণ কূটনীতিক ডি পি ধরকে গোপন আলোচনার জন্য মস্কো পাঠানো হয়। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা দিল্লি সফরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে
গোপন বৈঠকে করেছেন। এ ছাড়া ১ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল, সাবেক রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এবং দুজন প্রবীণ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভের সঙ্গে গোপনে সভা করেন।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং নতুন যুক্তরাষ্ট্র-চীন মৈত্রীর পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ৮ আগস্ট দিল্লি সফরে আসেন।

বিকেলে দিল্লিতে পৌঁছে রাতেই আন্দ্রে গ্রোমিকো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ৬৫ মিনিট আলোচনা করেন। তাঁরা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সংকটে উদ্ভূত যুদ্ধের হুমকি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১০ আগস্ট তাঁর বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

মস্কো থেকে যুক্তরাজ্যের দ্য অবজারভার পত্রিকার সংবাদদাতা দেব মুরারকা এদিন এক খবরে জানান, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে গ্রোমিকোর ভারত সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে ওঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন অপ্রত্যাশিত এই সফরের ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। পূর্ব বাংলায় অনুসৃত দমননীতি প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাব উপেক্ষা করায় সোভিয়েত নেতারা পাকিস্তানের প্রতি রুষ্ট। হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরে পাকিস্তানি সহায়তায়ও মস্কো উদ্বিগ্ন।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে ৯ আগস্ট দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এ চুক্তি সে সময়ের ভূরাজনীতিতে একটি নিয়তি-নির্ধারক পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বলেন, এটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির চুক্তি।

চুক্তিটির মূল কথা ছিল তৃতীয় কোনো দেশ ভারতকে আক্রমণ করলে বা আক্রমণের হুমকি দিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত শান্তি আর নিরাপত্তার স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আলোচনা করবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ভারত আক্রান্ত হলে বা যুদ্ধের হুমকি পেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। সাহায্যের প্রকৃতি স্থির হবে পারস্পরিক আলোচনায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সংবাদ ঘোষণা করলে সবাই বিস্মিত হন। জনসংঘের ও স্বতন্ত্র সদস্যরা বাদে বাকি সবাই তুমুল হর্ষধ্বনি করে চুক্তিটিকে স্বাগত জানান।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১১ আগস্ট ১৯৭১  ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ

 

ভারত–সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি স্বাক্ষরের পর ১১ আগস্ট ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতামত অভিন্ন। দুই দেশই মনে করে, বাংলাদেশে সামরিক নয়, রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য। ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে ফেরার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেই পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বার্থ এবং অঞ্চলটির শান্তি সুরক্ষিত হবে।

১৯৭০–এর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনসাধারণের অভিপ্রায়ের মর্যাদা দিতে হবে কিংবা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য অন্য কোনো উপায়ে সমাধানে পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যদি স্বাধীনতার দাবিই আঁকড়ে থাকেন, তাহলে সেই দাবির অস্বীকৃতি পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী হবে, অর্থাৎ পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে। বিবৃতিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সই করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের লড়াই জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে গোটা জাতিই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

১২ আগস্ট ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে তাজউদ্দীনের আবেদন

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর জন্য ১২ আগস্ট বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিচার করার আইনগত, সাংবিধানিক বা অন্য কোনো অধিকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেই। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্যই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো দরকার।

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র এই দিন নিউইয়র্কে বলেন, শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্ট নেপথ্যে কূটনৈতিক আলোচনা চালাচ্ছেন। তিনি এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনায় অনিচ্ছুক। মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন ১১ আগস্ট রাতে উ থান্টের হাতে শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি পত্র দিয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলে তার প্রতিক্রিয়া শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই হবে। তাঁর নিরাপত্তার জন্য ভারত বিশ্বের অনেকগুলো দেশকে অনুরোধ করেছে। কয়েকটি দেশ কাজও করছে।

ভারতে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এদিন আগরতলায় বলেন, পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালতে গোপন বিচারের সম্মুখীন শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য সব চেষ্টা করা হবে।

ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দিল্লিতে এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে চেষ্টা করছে, তার সদর্থক প্রভাব ঘটবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালিকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, গোপনে বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হলে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।

ভারতের কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো এক টেলিগ্রামে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। তিনি ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসার আবেদন জানান।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

বঙ্গবন্ধুর অবিলম্বে মুক্তির জন্য উদ্যোগী হয়ে পাকিস্তানের ওপর প্রভাব খাটানোর দাবিতে বাংলাদেশের শরণার্থী বুদ্ধিজীবীরা ১৩ আগস্ট সকালে কলকাতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এর আগে বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আহ্বানে বুদ্ধিজীবীরা কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের সামনে এক সভায় মিলিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থে এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি প্রয়োজন।

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি দেশটির স্বাধীনতার ২৪তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে ১৪ আগস্ট জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের শরণার্থীদের মর্মান্তিক দুঃখ–দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বলেন, অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বা শক্তি–সাম্যের আদিম ধারণা অনুযায়ী বিশ্বের জাতিসমূহের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপরিসীম এবং দীর্ঘ দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে উদাসীনতা অনুচিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় বলেন, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদানের পথরোধ করবে বলে নিউইয়র্ক টাইমস­–এ প্রকাশিত খবরটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ব্রিটেনের সানডে টেলিগ্রাফ-এ ১৫ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ আগস্ট লাহোর থেকে ৮০ মাইল দূরের শহর লায়ালপুরের এক সার্কিট হাউসে পূর্ববঙ্গের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। একজন ব্রিগেডিয়ারকে তিন সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধান কার্যনির্বাহক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৩ আগস্ট মামলার শুনানি দুই দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ভারতের যোগসাজশে তিনি স্বায়ত্তশাসন অর্জনের নির্দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেছেন। গোপন বিচারের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অন্য অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়নি। আগতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগগুলো আবার তোলার আশঙ্কা আছে।

পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের কথা যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি স্বীকার করে বলেন, যুক্তরাজ্য ও ভারত থেকে পাওয়া আইনেই তাঁর বিচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি টেলিভিশনে তিনি বলেন, রায়ের পর শেখ মুজিবকে মার্জনার বা শাস্তি লাঘবের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আছে। বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা ১৬ আগস্ট ভোরে (মতান্তরে ১৫ আগস্ট) চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে অপারেশন জ্যাকপট নামে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা ছিল, সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলোতে একযোগে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য আকাশবাণী কলকাতা থেকে সংকেত হিসেবে গান প্রচার করা হবে। প্রথম গানটি বাজে ১৩ আগস্ট। এর মানে ছিল, আক্রমণ সন্নিকটে। ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে সাতটায় দ্বিতীয় গানটি সংকেত হিসেবে বাজলে নৌকমান্ডোরা রাতে বেরিয়ে পড়েন।

১৬ আগস্ট ভোরে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে কাছাকাছি সময়ে অভিযান পরিচালিত হয়। এতে দেশের বিভিন্ন বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর বহু অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দাউদকান্দি ফেরিঘাটেও আরেকটি অভিযানের কথা ছিল। সময়মতো সেটি পরিচালনা করা যায়নি। ১৭ আগস্ট ভোরে সেটি সম্পন্ন করা হয়।

আগস্ট মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ১৭ আগস্ট এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। ভারত থেকে একদল বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী এদিন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তাঁরা শামিল হন অপারেশন ওমেগা নামের একটি অহিংস অভিযানে।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদার প্রকট অভাব হলেও সামরিক শাসকদের দৌরাত্ম্যে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারছিল না। অপরিসীম জনদুর্ভোগ লাঘব করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে ত্রাণ অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেন লন্ডনের সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী এবং পিস নিউজ পত্রিকার সম্পাদক রজার মোদি। এ অভিযানের নাম তিনি দেন অপারেশন ওমেগা।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১৮ আগস্ট ১৯৭১ ওমেগা দলকে ফেরত পাঠাল পাকিস্তান

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

বাংলাদেশে ত্রাণকাজে যাওয়া অপারেশন ওমেগা দলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক রাত তাঁদের ক্যাম্পে আটকে রেখে ১৮ আগস্ট ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ২৪ ঘণ্টা সেনা-অবরুদ্ধ থাকার পর তাঁরা ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহে ভারত ফিরে যান। দুটি সাদা গাড়িতে বাংলাদেশের দুর্গত মানুষদের জন্য যেসব ত্রাণসামগ্রী তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন, পাকিস্তান সেনারা সেসব ফেরত দিয়ে দেয়। পাকিস্তানের ভেতরে সেনারা তাঁদের গ্রেপ্তার করে চার মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফেরত

পাঠানোর সময়ও চার মাইল হাঁটিয়ে আনে। রাতে তাঁদের খাবার দেওয়া হয়নি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এদিন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশবিষয়ক সব কাজকর্ম সমন্বয় করার জন্য তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দেন।

পাকিস্তানের টুকরো হওয়া রোধ করা যাবে না

পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানের রাজনীতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আর এড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের অধিকার একমাত্র মুজিবেরই আছে। তিনি আরও বলেন, জনগণের রায় মেনে নেওয়া হলে এবং মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলে স্বীকার করা হলে এই অভূতপূর্ব রক্তক্ষয় এড়ানো যেত। সাপ্তাহিক নিউ ওয়েভ-এ ১৮ আগস্ট প্রকাশিত সংখ্যায় সম্প্রতি কাবুলে আশ্রয় নেওয়া ওয়ালি খানের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।

ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি এদিন মস্কোতে দুই পক্ষ থেকে অনুমোদন করে তা কার্যকর করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে প্রথম সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেতসেভ এবং ভারতের পক্ষে রাষ্ট্রদূত কে এস শেলভাঙ্কর চুত্তিতে স্বাক্ষর করেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরও উদ্বেগ

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন জেনেভায় লিগ অব রেডক্রস এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান।

নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ট্র্যায়েগভি ব্রাটেলি বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে ন্যায়সংগত ব্যবহার করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান। নরওয়ের স্থানীয় বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত অ্যাকশন কমিটিও একই দিনে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের বিবরণ-সংবলিত একটি স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাদেশের অধিবাসীদের মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য নরওয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানায়।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সাম্প্রতিক মন্তব্যে ১৮ আগস্ট পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের মতে মহাসচিব তাঁর অধিকারের সীমা ছাড়িয়েছেন। উ থান্ট বলেছিলেন, শেখ মুজিবের বিচারে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহী প্রতিবাদপত্রটি মহাসচিবের দপ্তরে পেশ করেন।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

একদল পাকিস্তানি সেনা এই দিন কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধারা মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে তাদের অ্যামবুশ করে। দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়; একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

বরিশালে পাকিস্তানি সেনাদের গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ পেরোনোর সময় ভোলা নদীর দুই তীর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুন্দরবন এলাকায়ও আরেকটি গানবোট খুলনা যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। উভয় ঘটনায় পাকিস্তান সেনারা হতাহত হয়।

সিলেট শহরের কদমতলী ঝালোপাড়ার কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ অ্যামবুশ করে কয়েকজন সেনাকে হতাহত করে। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানায় হামলা করলে পাকিস্তানি রেঞ্জার, পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।

যুক্তরাজ্যের মর্নিং স্টার পত্রিকায় দিল্লি থেকে রয়টার্স পরিবেশিত খবর উদ্ধৃত করে এদিন বলে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে বলেছেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। অতএব পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মধ্যবর্তী স্থল-যোগাযোগ কেটে দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভারতের পূর্বাঞ্চল দখল করা উচিত।

১৮ আগস্ট সকালে হবিগঞ্জের মাকালকান্দি গ্রামে মনসা ও চণ্ডীপূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। এ সময় বানিয়াচং থানা সদর থেকে বেশ কয়েকটি নৌকায় করে এসে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা গ্রামটিতে হামলা চালায়। এতে ৮৮ গ্রামবাসী প্রাণ হারান। এর মধ্যে ৪৪ জনই ছিলেন নারী। এরপর হামলাকারীরা ব্যাপক লুটতরাজ করে গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।

উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নওগাঁর কুলফতেপুরে হামলা করে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে শহীদ এবং ১২ জনকে আহত করে।

১৯ আগস্ট ১৯৭১ পাকিস্তানের কাঠামোয় আর সমাধান নেই

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ইন্ডিয়া নিউজ-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্প্রতি ঘোষিত চার দফা দাবির পুনরুল্লেখ করেন। দাবিগুলো হলো: ১. অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি, ২. বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ৩. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ, এবং ৪. বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা।

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার জন্য ইসলামাবাদ ও তেহরানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। আমেরিকা ও চীন এ উদ্যোগের সমর্থক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খান ইতিমধ্যে তেহরান এসেছেন।

ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে দুটি ৭০৭ বোয়িং বিমান লিজ দিয়েছে, সেগুলো পাকিস্তান এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহন করা হচ্ছে বলে প্রচারিত সংবাদ সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের জানায়, একটি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পালানো ছয়জন বাঙালি নাবিক ফিলাডেলফিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। জাহাজটি তাঁদের ছাড়াই বন্দর ছেড়ে গেছে। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র রিচার্ড টেইলার বাঙালি নাবিকদের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানিয়েছেন।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটক অপারেশন ওমেগা দলের সদস্যরা ১৯ আগস্ট সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ফিরে এসে কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে দলের সদস্য ড্যানিয়েল গ্রোটা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুমকি অগ্রাহ্য করে কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা আবার বাংলাদেশে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথমবারের যাত্রা সফল হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাঁরা এক ধাপ এগিয়েছেন।’ তিনি বলেন, বেনাপোল থেকে আটক করে ভেতরে নেওয়ার সময় তাঁরা দেখেছেন গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সুলেমান সাইফ এমপি এক বিবৃতিতে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মুসলিম লীগ এবং দেশের ৮ কোটির বেশি মুসলমান দৃঢ়ভাবে সরকারকে সমর্থন করবেন। এ ব্যাপারে লীগের নীতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লীগের সভাপতি মহাম্মদ ইসমাইল এক বিবৃতিতে কড়া ভাষায় পূর্ব বাংলার গণহত্যার নিন্দা করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গভীর সমবেদনা জানান।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদ আয়োজিত এক সভায় গায়ানার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছেদি জগন বলেন, বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিসংগ্রামে জয়ী হবেই। কেননা পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বৈরাচারী শাসন জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রামকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইয়াহিয়া সরকারও পারবে না। তিনি কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন।

নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ শরণার্থী সহায়ক সমিতির সভাপতি হৃষিকেশ শাহ এক বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বিরোধী এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বাধাস্বরূপ। বিবৃতিতে তিনি শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা ও তাঁর বিনা শর্তে মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এক আবেদন জানান। তিনি আরও বলেন, এখন ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে, শেখ মুজিবের সঙ্গে বোঝাপড়ায় না এসে পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা বা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবেন না।

 

২০ আগস্ট ১৯৭১ শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে একাত্তরের ২০ আগস্ট করাচির মাশরুর বিমানঘাঁটিতে বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে একটি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করেন। বিমানটির নবীন পাইলট ছিলেন পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজ। অনুশীলনের জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে তিনি বিমানটি নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে যেতে ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

মতিউর রহমান তখন ফ্লাইট সেফটি কর্মকর্তা। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে রাশেদ মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। রাশেদ মিনহাজ বিমানের ক্যানোপি তুলে মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে? তখন মতিউর রহমান লাফ দিয়ে ককপিটে উঠে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এরপর ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। একপর্যায়ে মিনহাজ বিমানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হলে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে মতিউর রহমান শহীদ হন।

ঘটনার বিভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, মতিউর রহমান পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজকে চেতনানাশক দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর রাশেদ মিনহাজ সংজ্ঞা ফিরে পেলে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ফলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা যান। আরেকটি ভাষ্যে বলা হয়, দুজনের মধ্যে শুরু থেকেই ধস্তাধস্তি চলে এবং বিমানটি আঁকাবাঁকা হয়ে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে।

কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানের পাখা দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে রাশেদ মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। বিমানটি খুব নিচ দিয়ে উড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি কন্ট্রোল টাওয়ারের আড়ালে চলে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার তখন বেস কমান্ডারকে বিষয়টি জানায়। তারা আশঙ্কা করে, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান সেই টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমানের খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু বিমানটির কোনো হদিস তারা পায়নি।

বিকেলের দিকে খবর আসে, ভারত সীমান্তের কাছে তালাহার নামের একটি জায়গায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিমানের দুজন আরোহীই মারা গেছেন। পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজের দেহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং মতিউর রহমানের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে এনে পরদিন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

মতিউর রহমান একাত্তরের প্রথমার্ধ থেকে ছুটিতে বাংলাদেশেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধেও অংশ নেন। পরে বয়োজ্যেষ্ঠদের চাপে সপরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন। ৯ মে করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ করেন বাঙালি কর্মকর্তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাঁকেও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব না দিয়ে দেওয়া হয় ফ্লাইট সেফটি কর্মকর্তার দায়িত্ব। এ অবস্থায় মতিউর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু এর আগে পিআইএর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বাঙালি পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়।

ভারত ও বহির্বিশ্ব

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সুইস নিউজ এজেন্সি ও সুইস বেতারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ দিন বলেন, লাখ লাখ মানুষ পূর্ব বাংলা থেকে কেন চলে এল, তার মূল কারণ সম্পর্কে জাতিসংঘ নীরব। এই শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা পথ বের করতেই হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই শেখ মুজিব বেঁচে থাকুন। তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো খবর নেই।’

সিপিআইয়ের জাতীয় পরিষদ দিল্লিতে সাত দিনব্যাপী বৈঠকের শেষ দিনে গৃহীত এক প্রস্তাবে দাবি জানায়, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যাতে নিজেদের বাহিনীকে দিয়ে মাতৃভূমি মুক্ত করতে পারে তার জন্য ভারত সরকারকে সত্যিকারের কার্যকর ও ব্যাপক সাহায্য দিতে হবে। তবে এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকারকে ভারত ও অন্য দেশের স্বীকৃতিদান। পরিষদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্র দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তীব্র সমালোচনা করে।

ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে এই দিন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে তাঁকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়।

পাকিস্তানে নানা তৎপরতা

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন ঘোষণা করে, ১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ সামরিক আদালতে হাজির করা হয়। পাকিস্তানের আইন মন্ত্রণালয় আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে মুজিবের পক্ষ নিতে অনুরোধ জানালে তিনি কাজের চাপ দেখিয়ে এই মামলা নিতে প্রথমে অক্ষমতা জানান, তবে পরে রাজি হন। শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এদিন সকালে করাচি ত্যাগ করেন। পাকিস্তান সরকারও এদিন ঘোষণা করে যে এ কে ব্রোহি শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করবেন।

দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের অন্যতম বিচারপতি জাফরুল্লাহ খান এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে কথা বলেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আগামী ২৪ আগস্টের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে ফৌজদারি আইনে তাঁর বিচার হবে বলে জানানো হয়। বলা হয়, আদালতে হাজির না হলে তাঁর অবর্তমানেই বিচার হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এদিন আরও ১৩ জন এমএনএকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এঁরা হলেন নূরজাহান মুরশিদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম ওয়ালিউল্লাহ, কাজী জহিরুল কাইয়ুম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, খোরশেদ আলম, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, খাজা আহমদ, নূরুল হক ও মোহাম্মদ হানিফ।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লা শহরের উত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। গেরিলাদের আরেকটি দল রাতে নরসিংদীতে গ্যাসপাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়। ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের চিলমারীর বিরাট এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করেন।

 

২১ আগস্ট ১৯৭১ ইরাকে বাঙালি রাষ্ট্রদূতের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ ২১ আগস্ট লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্যের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে তিনি আর ধৈর্য রাখতে পারেননি। সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। পদে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দিতে তিনি লন্ডনে চলে আসেন।

আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত যেসব বাঙালি কূটনীতিক বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে আবুল ফতেহই ছিলেন সবচেয়ে উচ্চপদস্থ।

আবুল ফতেহ লন্ডনে পৌঁছেই যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। তাঁর এ সিদ্ধান্তের কথা বিচারপতি চৌধুরী তারবার্তা পাঠিয়ে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারকে জানান।

পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আপস নয়

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই দিন লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোনো আপস নেই। বাংলাদেশের মানুষ আজ এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি বৈঠক শুরু হবে বলে গতকাল ডেইলি টেলিগ্রাফে যে সংবাদ বেরিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি এই মন্তব্য করেন।

আবু সাঈদ চৌধুরী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ সরকার যে তিনটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছে, সেসব শর্ত পূর্ণ না হলে কোনোরকম শান্তি আলোচনার প্রশ্নই উঠতে পারে না। শর্ত তিনটি হলো ১. পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কর্তৃক স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি। ২. অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ৩. বাংলাদেশের মাটি থেকে সকল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অপসারণ। তিনি বলেন, আমরা ফিরতে পারি না। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যায় লাখ লাখ প্রাণ কোরবানি হয়েছে। সে ত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। শহীদদের আমরা ভুলতে পারি না।

কানাডার টরন্টো শহরে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে যোগদানকারী ব্রিটিশ, মার্কিন, ভারতীয় ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ২১ আগস্ট পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের জন্য আহ্বান জানান। কানাডার অক্সফাম এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সাংসদ, বুদ্ধিজীবী, সাবেক কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনেরা এ সম্মেলনে যোগ দেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথও এতে অংশ নেন। ১৯ আগস্ট শুরু হওয়া এ সম্মেলন এদিন শেষ হয়।

সম্মেলনের ঘোষণায় বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ রক্ষার জন্য আবেদন জানিয়ে বলা হয়, তাঁর গোপন বিচার আইনের শাসনবিরোধী। তাঁর প্রাণদণ্ড হলে বাংলাদেশ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক পন্থার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। দেশভাগ ছাড়া আর কোনো পথও নেই।

সম্মেলনের গোপন অধিবেশনে বেশ কয়েকজন আমেরিকান প্রতিনিধি পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলেও সম্মেলনে যোগ দেওয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ আটজন মার্কিন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহতভাবে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা করেন। তাঁরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যা করছে, তা আমেরিকার স্বার্থের বিরোধী এবং বিশ্বের নীতিবোধকে ক্ষুণ্ন করেছে।

ভারত ও পাকিস্তানে

ভারত সফররত পূর্ব জার্মানির সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ড. আর জিবার দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছানুযায়ী ওই দেশের মূল রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর স্থায়ী মীমাংসা করতে পারলেই পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিন সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, কলকাতাসংলগ্ন এলাকা এবং সীমান্ত এলাকায় তাঁরা শরণার্থীদের বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ এদিন নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব মাহমুদুল হক ওসমানিকে গ্রেপ্তার করে ছয় মাসের আটকাদেশ দেয়। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলায় তাঁকে আটক করা হয়।

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এদিন আনসার অধ্যাদেশ ১৯৪৮ বাতিল করে রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১ জারি করে। এর মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর অ্যাডজুট্যান্টদের করা হয় রাজাকার অ্যাডজুট্যান্ট। অরডিন্যান্সের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তান সরকার ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। আরও বলা হয়, প্রাদেশিক সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সব রাজাকার অথবা নির্দিষ্টসংখ্যক রাজাকারকে প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ দিতে পারবে।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

জয়বাংলা পত্রিকার ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট সংখ্যার সাম্প্রতিক যুদ্ধ প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর শ্যামনগর অবস্থানের ওপর তিনটি কলামে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন হুদা, লে. বেগ এবং নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিলদার সোবাহানের নেতৃত্বে তীব্র আক্রমণ চালায়। তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

এ সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী চারজন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার ও চারজনকে আহত অবস্থায় বন্দী করে। অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ইলিয়াসসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর একটি দল এদিন কুমিল্লার উত্তরে একটি রেলসেতুর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

চুয়াডাঙ্গার উত্তরে আলমডাঙ্গায় এদিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

২২ আগস্ট ১৯৭১ শরণার্থীশিবিরে আলী হাফিজ

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারত সফররত আরব স্কাউট দলের সভাপতি এবং মিসরের সাবেক উপমন্ত্রী আলী হাফিজ ২২ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁর শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। এরপর কলকাতায় ফিরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর যে নির্মম অত্যাচার হয়েছে, এমন মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা অতীতে তাঁর কখনোই হয়নি। শরণার্থীদের যারা এ পরিস্থিতির মধ্যে টেনে এনেছে, তাদের মধ্যে মানবিকতার লেশমাত্র নেই।

মাদ্রাজে এদিন নিখিল ভারত সংবাদপত্র কর্মচারী ফেডারেশনের পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলনে
অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়। সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তে বলা হয়, এ সম্মেলন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে।

বাংলাদেশ সাহায্য তহবিলের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের খড়গপুরে আইএফএ একাদশ এবং ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের মধ্যে এক প্রদর্শনী ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলা ৩-৩ গোলে অমীমাংসিত থাকে। খেলা দেখার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ স্টেডিয়ামে সমবেত হয়।

ব্রিটেনের বার্মিংহামের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সভাপতি জগলুল পাশা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণকারী অসহায় বাঙালিদের সাহায্যার্থে ৬ হাজার ৬০০ পাউন্ডের একটি চেক যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থের হাতে অর্পণ করেন।

পাকিস্তান পিপল পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন বলেন, জনগণ পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর দেখতে চায়। আওয়ামী লীগ বেআইনিঘোষিত হওয়ার পর তাঁর দল এখন কেবল পাকিস্তানের বৃহত্তম দলই নয়, বরং জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

২২ আগস্ট নোয়াখালী জেলার সেনবাগে কাজীরহাট বাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দলকে আক্রমণ করে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।

ফেনীর সোনাগাজীর রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল অ্যান্টিট্যাংক মাইন পেতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে অ্যামবুশ করে। মাইনের বিস্ফোরণে ও গেরিলাদের গুলিবর্ষণে পাকিস্তানি সেনাদের তিনটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মাইন বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শালদানদী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষাঘাঁটির ওপর হামলা চালান। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

রাজশাহী জেলার চারঘাট থানায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল মীরগঞ্জ সীমান্তঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিঘ্ন চলাচল ব্যাহত করার জন্য শেরপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল মিলে এই দিন নালিতাবাড়ী সেতু ধ্বংস করে।

 

২৩ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দিকে এগোচ্ছে ভারত

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ২৩ আগস্ট দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কীভাবে পেশ করা যায় বা আদৌ পেশ করা যায় কি না, তা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আলাপ শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধারণা, কোনো না কোনো দেশ কোনো না কোনোভাবে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে বা সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোতে তুলবেই।

পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দুই সরকারের মধ্যে আলোচনার ধরনে মনে হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার নিকটতম ধাপে পৌঁছেছে।

ভারতের বাম রাজনৈতিক দল

সিপিএমের পলিটব্যুরো বাংলাদেশে আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে চীনা সমর্থনের সমালোচনা করে বলে, এটি জাতীয় আন্দোলনের প্রতি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা। বেঙ্গালুরু পলিটব্যুরোর আলোচনার পর সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সুন্দরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, একটি জাতীয় আন্দোলন সমর্থনে চীনের ব্যর্থতা খুবই অদ্ভুত।

উ থান্টের হস্তক্ষেপ কামনা

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত এবং আন্তর্জাতিক মানবিক অধিকার কমিশনের সদস্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে মানবাধিকার কমিশনের জরুরি সভা ডাকতে এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার আইনগত অধিকার পাকিস্তানের নেই।

টাইম ম্যাগাজিনের ২৩ আগস্ট সংখ্যায় ‘পাকিস্তান: মুজিবের গোপন বিচার’ (পাকিস্তান: মুজিব’স সিক্রেট ট্রায়াল) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য মুজিবকে অভিযুক্ত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে রক্তগঙ্গা বইতে শুরু করার আগপর্যন্ত তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।

পাকিস্তানি কাণ্ড

রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় একজন অসামরিক বাঙালিকে বসানোর কথা সামরিক সরকার ভেবে দেখছে। এ ব্যাপারে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের কথা ভাবা হচ্ছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা আরও বলেন, এর প্রধান উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানে এমন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা, যাতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তান অনুগত প্রাদেশিক সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সব সদস্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) এবং ৯৪ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের (এমপিএ) বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই সংকট মুহূর্তে অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে তাদের দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। সরকার তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম লাহোরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চরদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রধান শিকার জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (আওয়ামী লীগ) বিরোধিতা করার জন্য সেখানে বহু জামায়াতকর্মী দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) হাতে প্রাণ হারিয়েছে। একমাত্র জামায়াতে ইসলামী প্রদেশের প্রতিটি অংশে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান

কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ এবং বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার হতাহত হয়। বাকি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল এদিন কুমিল্লার জগন্নাথদিঘীতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে।

এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই-তিনটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সেনেরবাজার এলাকায় নৌকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুই-তিনজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং বাকি সেনারা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা নয়নপুর রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার এবং ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেল দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত বাংকার বিধ্বস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে একদল মুক্তিযোদ্ধা কানসাটে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় চার ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ব্যাপক ক্ষতি এবং কয়েকজন হতাহত হয়।

 

২৪ আগস্ট ১৯৭১ জেনেভায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলন

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ২৪ আগস্ট পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের দুই দিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গোপন আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের সরকারি মহলের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে জেড এম ফারুকী বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তার জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। আওয়ামী লীগ ও শরণার্থীদের প্রতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সমর্থনের কারণে পাকিস্তানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারকাজ চালানো সহজ হবে।

পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারাভিযান চালানো হলে সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মত দেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত জামসেদ মার্কার বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বলে তাঁর ধারণা। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তি কেবল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়ার প্রতিপত্তি বাড়াবে। এ চুক্তি যতটা চীনের বিরুদ্ধে, ততটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়।

যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত হাইকমিশনার সালমান আলী বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নয়। বিভিন্ন বাঙালি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের বিরোধিতা করার জন্য তিনি পাকিস্তান সলিডারিটি প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করেছেন বলে প্রকাশ করেন। ব্রিটেনের সংবাদপত্র ইহুদিদের করায়ত্ত বলেই পাকিস্তানবিরোধী। লেবার পার্টি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বানচাল করার জন্য বদ্ধপরিকর।

তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাজ্য সফর এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার সময় দ্য টাইমসসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালি হত্যাসম্পর্কিত পাকিস্তানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান।

চীনে নিয়োজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার বলেন, চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন সন্তোষজনক বলে চীন মনে করে। ভারত-সোভিয়েত চুক্তির খবর চীনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। তারা মনে করে, এ চুক্তি তাদের স্বার্থবিরোধী। চীন আফগানিস্তান, বার্মা, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন কী ধরনের সাহায্য দেবে, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন।

জাতিসংঘে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহী বলেন, জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে সদস্যদেশগুলোর জোরালো সমর্থন পাবে। সেটা এড়াতে হলে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া, বর্তমান খাদ্য সমস্যার সমাধান এবং শেখ মুজিবের বিচার স্থগিত রাখার ব্যাপারে কার্যকর পন্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলো, বিশেষত নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইমনিউজউইক পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন।

যুগোস্লাভিয়ায় নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত আই এ আখুন্দ বলেন, যুগোস্লাভ সরকার পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তারা বাংলাদেশের বিদ্রোহে ভারতের হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করে না।

ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতেরা বলেন, এসব দেশের সরকার বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের বক্তব্য মেনে নেয়নি। পোল্যান্ড ও চেকোস্লাভাকিয়াও পাকিস্তানের সঙ্গে একমত নয়। শুধু ফ্রাংকোর স্পেন পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করছে।

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ডি পি ধরের গোপন বৈঠক

ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ২৪ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে গোপন একটি বৈঠক করেন। ডি পি ধর বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ২৩ আগস্ট দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন।

তিনি বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ও তার প্রভাব, শরণার্থী সমস্যার নানা দিক এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিসহ আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করেন। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে এ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে দিল্লির সরকারি সূত্র জানায়।

মুক্তিবাহিনীর অভিযানমুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও অনারারি ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে কুমিল্লা-সিলেট সড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সীমান্তবর্তী কালামুড়া ব্রিজের দুই মাইল দক্ষিণে মাধবপুর ও মিরপুরের মাঝখানে পাকিস্তানি সেনাবাহী দুটি স্টেট বাস, তিনটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়ি অ্যামবুশ করে। তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তিনজন পাকিস্তানি সেনা এবং একজন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ ধরা পড়ে। ২ নম্বর সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কালামুড়া ব্রিজে অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর হামলা করলে সাতজন আত্মসমর্পণ করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা কালামুড়া ব্রিজ ধ্বংস করেন।

মেহেরপুরে একদল পাকিস্তানি সেনা নাটোদা থেকে মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল বাগুয়ানে এবং আরেকটি দল মানিকনগরে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।

সাতক্ষীরায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা আশাশুনিতে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

 

২৫ আগস্ট ১৯৭১ গেরিলাদের একাধিক দুর্ধর্ষ অভিযান

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ২৫ আগস্ট রাতে আবারও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর দুই নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম, কাজী কামালউদ্দীন, বদিউল আলম, শাফী ইমাম (রুমী) ও কামরুল হক (স্বপন) রাত আনুমানিক সাতটা ২৫ মিনিটে হাইজ্যাক করা একটি মাজদা গাড়িতে করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কে একজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার বাড়িতে পাহারারত কয়েকজন সেনার ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালান। এতে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

এরপর তাঁরা মিরপুর সড়কের চেকপোস্টে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনার ওপর গুলি চালিয়ে এবং পরে ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের পূর্ব প্রান্তে গ্রিন রোডে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপের চালকের ওপর গুলি চালিয়ে নিরাপদে নিজেদের আস্তানায় চলে যান। তাঁদের এই অভিযানের কথা রাতেই মুখে মুখে শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল এদিন কুমিল্লার উত্তরে জামবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করে। আকস্মিক এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নপর পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মর্টারের গোলা ও গুলিবর্ষণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।

বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল কুমিল্লার সিঅ্যান্ডবি
সড়কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ডজ গাড়ি অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং একজন হাবিলদারসহ চার পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ধানদইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি প্যাট্রল দল ধানদইল গ্রামে তাদের অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশের মধ্যে এসে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল সাব-সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর দিলখুশার অগ্রবর্তী ক্যাম্পের ২০০ গজ এলাকাজুড়ে অ্যামবুশ করেন। ভোরে আজানের কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনারা একজন একজন করে বাংকার থেকে বের হতে থাকে। সবাই বের হলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

যশোরের বারিনগর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। রাজাকারদের আরেক অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার আহত এবং বন্দী হয়।

জল-স্থলে শত্রুবাহিনীকে আঘাত

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে এদিন সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিবাহিনী জল, স্থল ও অন্তরিক্ষে শত্রুবাহিনীকে আঘাত করছে। তার প্রমাণ এক দিনে অনেকগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া। মুক্তিবাহিনী অনেক স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলায় অনেক স্থানে রেল চলাচল বন্ধ।

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রবাহী পদ্মা জাহাজ খুলনার বন্দরে ডুবিয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা ১৬ আগস্ট জাহাজটি বিস্ফোরকের সাহায্য ডুবিয়ে দেন। মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা একই দিনে চট্টগ্রাম, মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকটি নদীবন্দরে বেশ কয়েকটি নৌযান ডুবিয়ে দেন।

ইয়াহিয়া-ভুট্টো সাক্ষাৎ

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা ও আলোচনা করেন। এই সময় তৃতীয় কেউ সেখানে ছিল না। পরে ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, কয়েকটি নতুন সমস্যাসহ দেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেসব নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দেশের স্বার্থে তাঁরা সঠিক ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

২৬ আগস্ট ১৯৭১ মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা জানালেন কেনেডি

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের শিবিরগুলো এক সপ্তাহ পরিদর্শন করে ফিরে যাওয়ার পর ২৬ আগস্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানান। সিনেটর কেনেডি বলেন, ‘আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, পূর্ব বাংলায় কী নিষ্ঠুর নির্যাতন চলছে। কী ভয়ংকরভাবে সেখানে নির্বিচার গণহত্যা চলছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য দেওয়া বন্ধ করুন।’

এরপর কেনেডি সাংবাদিকদের কাছে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এ ঘটনা লজ্জাজনক ও দুঃখবহ। সেটা তো হচ্ছেই না, উপরন্তু পাকিস্তানের উদ্দেশে জাহাজে অস্ত্র বোঝাইয়ের কাজ ক্রমাগত চলছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, উত্তেজনা প্রশমন ও শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় যে নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে, তার বহু প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। বাঙালিদের প্রতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান যাতে নরম নীতি গ্রহণ করেন, তার জন্য প্রেসিডেন্টের উচিত জেনারেল ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে এই দিন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশিষ্ট লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং সালভাদর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার কুইয়েসের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতাও আবৃত্তি করা হয়। আয়োজকেরা জানান, সংগৃহীত অর্থ আর্জেন্টিনার রেডক্রসের হাতে দেওয়া হবে। তারা তা ভারতীয় রেডক্রসের কাছে পাঠাবে।

দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন ১৬ আগস্ট মিউনিখের একটি সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত অভিযোগের প্রতিবাদ করে দিল্লিতে এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ইয়াহিয়া খানের দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ নিজেরাই যুদ্ধ করছে। তারা কারও সাহায্য নিচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক ও মানবিক সমর্থন জানাচ্ছে।

ইয়াহিয়ার তৎপরতা

অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন। তিন দিন আগে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে আসার পর এ নিয়ে তাঁরা দুই দফা বৈঠক করেন। পর্যবেক্ষকেরা জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের পরিবর্তে নতুন গভর্নর হিসেবে মালিককে নিয়োগ দেওয়া হবে। গভর্নর হিসেবে মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনে তাঁর কী ভূমিকা থাকবে, সেসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়।

পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের যেসব নির্বাচিত সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে, সেসব আসনে উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চার সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ দলের মধ্যে চার ঘণ্টা ধরে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পিপিপির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা সাংবাদিকদের জানান, আলোচনা শাসনতান্ত্রিক বিষয়ের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানে সফররত পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম এই দিন পেশোয়ারে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের হীন উদ্দেশ্য ও বিদ্রোহীদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন আমজাদহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা মুহুরী নদী পার হয়ে খাদ্যসামগ্রী ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের দুটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছু সময় পর পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এই আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে নিরাপদ অবস্থানে চলে যান।

রাজশাহী জেলার দুর্গাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দলটির ওপর পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল মল্লিকবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

টাঙ্গাইল শহরের তিন মাইল দূরে জলপাই গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং একজনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।

২৭ আগস্ট ১৯৭১ লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের কার্যালয় উদ্বোধনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। ভারতের বাইরে এই প্রথম বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের উদ্বোধন হলো। যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের বেজ ওয়াটার এলাকার নটিংহিল গেটের কাছে ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনসে প্রায় ৩০০ বাঙালি এবং অনেক বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন করেন। মিশন উদ্বোধনের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করে বক্তৃতা দেন।

মিশনের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা হবে। লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালিরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক।

এই স্বাধীন দেশের সরকারি প্রতীক হিসেবে একটি মিশন স্থাপনের জন্য তাদের আগ্রহ ও বাসনা বিচার করে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারের গণসমাবেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন থেকে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনসে মিশনের কাজ যথারীতি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হবে।

বাংলাদেশ মিশনের পতাকা উত্তোলনের পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হল ঘরে উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়ার সময় বিনা আমন্ত্রণে কয়েক কোচবোঝাই পুলিশ মিশনের সামনে এসে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। অনুষ্ঠানের শেষে তাদের সবাইকে প্রীতি অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

২৮ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদপত্রে পুলিশের আকস্মিকভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের কারণ জানা যায়। বাংলাদেশ মিশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে ব্রিটেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলী পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে দেখা করে সালমান আলী বলেন, ব্রিটেন পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র, যার একটি অংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান।

সেটির নাম বদলে বাংলাদেশ নাম নিয়ে লন্ডনে মিশন স্থাপন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর। তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য। জোসেফ গডবার মনোযোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে বলেন, এ ধরনের নাম ব্যবহারে ব্রিটেন সমর্থন করে না। যুক্তরাজ্য সরকারের পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া স্বীকৃতি অব্যাহত রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ মিশনকে কূটনৈতিক মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর।

প্রায় ঘণ্টাকাল আলোচনার পর সালমান আলী তাঁর কূটনৈতিক চাল সফল হয়েছে বলে অনুমান করে পররাষ্ট্র দপ্তর ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে আলোচনার মর্ম অপ্রকাশিত থাকা সত্ত্বেও বোঝা যায়, পাকিস্তানের সমর্থকদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ মিশনের বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পাকিস্তানের ভেতরে

পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের বিশেষ সহকারী ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এ দিন পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকার উদ্দেশে করাচি রওনা হওয়ার আগে ইসলামাবাদে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। তিনি আরও বলেন, গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত ভারত থেকে সরকারিভাবে ১ লাখ ৫৫ হাজার শরণার্থী ফিরে এসেছে। এই হিসাবের বাইরেও আরও কিছু শরণার্থী ফিরে এসেছে।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদার সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে সকালে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে পিপিপির শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের আলোচনা হয়। তাঁদের সঙ্গে পিপিপির শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের এটা ছিল তৃতীয় ও শেষ বৈঠক।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে এপি পরিবেশিত খবরে এ দিন বলা হয়, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন বিমান পাইলট করাচির কাছে গৌরীপুর বিমান ঘাঁটি থেকে একটি বিমান নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সব বাঙালি পাইলটকে নজরবন্দী করা হয়েছে বলে সামরিক মহল সূত্রে জানা গেছে। খবরে বলা হয়, কয়েক দিন আগে ওই বাঙালি পাইলট বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা এ দিন ভোরে খুলনার খালিশপুরে পিপলস জুট মিলের খেয়াঘাট পেরিয়ে সেনহাটি গ্রাম হয়ে দেয়াড়া গ্রামে যায়। ভোর রাতেই বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও অবাঙালি গোটা দেয়াড়া গ্রাম ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। তাঁদের না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদারের বাড়ি থেকে তাঁর বাবা ডা. মতিয়ার রহমানসহ ছয়জনকে ধরে রাস্তায় এনে পিঠমোড়া করে বেঁধে সেখানেই তাঁদের কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।

এরপর তারা ওই গ্রামের আরও অনেককে আটকের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মোট ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এঁদের মধ্যে ৩৮ জনের লাশ তারা ভৈরব নদীতে ছুড়ে ফেলে এবং বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়।

বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী

বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র মিজানুর রহমান চৌধুরী এ দিন মুজিবনগরে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন না করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের প্রতি আহ্বান জানান।

কুমিল্লার শশীদলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরপর দুই দিন আক্রান্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী নয়ানপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের কাছে জমায়েত হয়ে সেনেরবাজারে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। এই সংঘর্ষে দুই পক্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল ফেনী জেলার পরশুরামের কাছে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ফেনী-বিলোনিয়া সড়কে হাসানপুর সেতু ধ্বংস করে।

২৮ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের সহানুভূতি

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতা পিটার শোর ২৮ আগস্ট দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে সেখানকার জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান দরকার। সংকটের সমাধান হলেই জাতিসংঘ সেখানে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সারা বিশ্বে এখন সহানুভূতি জেগেছে।

আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এই অবস্থায় কিছু করা সহজ হতে পারে। ব্রিটিশ সরকার পূর্ব বাংলার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চায় এবং সেখানকার মানুষের দুঃখস্রোত বন্ধ করতে চায়। এ কারণেই সেখানে একটা নীতিগত পালাবদল কাম্য বলে ব্রিটিশ সরকার মনে করে।

ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের সিনেটর চার্লস পার্সি দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে নিজ দেশের সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তারা যেন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আর প্রশ্রয় না দেয় এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো বন্ধুত্ব নষ্ট না করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের চিন্তা করা উচিত এবং অবিলম্বে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান বন্ধ করা দরকার। সিনেটর চার্লস পার্সি এই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন।

যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মিশন বিদ্রোহী

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জোসেফ ২৮ আগস্ট সেখানকার বাংলাদেশ মিশনকে বিদ্রোহী হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ব্রিটেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে স্বীকার করায় বাংলাদেশ মিশনকে স্বীকৃতি দেবে না। ব্রিটেনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলী বাংলাদেশ মিশনের ব্যাপারে অভিযোগ করতে পররাষ্ট্র দপ্তরে গেলে তিনি এই মন্তব্য করেন।

সুইডেনের পাকিস্তানের দূতাবাসের একমাত্র বাঙালি কর্মচারী মহম্মদ শফিউল্লাহ এদিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেন। স্টোকহোমে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, দূতাবাসে তিনিই একমাত্র বাঙালি। নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই সন্তানসহ সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্রোহির সাক্ষাৎ

পাকিস্তানে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২১ আগস্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। তিনি জানান, লায়ালপুরে কড়া প্রহরায় শেখ মুজিব আটক আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্রোহি এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে আসেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

২৮ আগস্ট সকালে নওগাঁর মান্দার প্রত্যন্ত পল্লি পাকুরিয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েক শ গ্রামবাসীকে ধরে এনে স্কুলমাঠে জড়ো করে। এরপর বাড়িঘর লুটপাট করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানিরা স্কুলমাঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ছেড়ে দেয়। তারা চলে গেলে সেনারা বাকি সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলিতে ১২৮ জনকে হত্যা করে।

চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন ভোরে মিরসরাইয়ের কাছে রেললাইনে মাইন স্থাপন করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় বিস্ফোরণে একটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের একটি দল মহেশপুরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা হতাহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের অন্তর্গত হাসনাবাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের একটি দলকে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করেন। জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন কয়েকটি উপদলে বিভক্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।

পাকিস্তানি সেনারা একপর্যায়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং পাকিস্তানিদের দূরবর্তী অবস্থান থেকেও গোলা এসে সেখানে পড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। স্বাধীনতার পর তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

চাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গেরিলা দল ফরিদগঞ্জের রাওয়াল গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তাদের পাল্টা আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।

কুমিল্লায় একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নৌকাযোগে শালদা নদী দিয়ে এগোনোর পথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহী নৌকাগুলো পানিতে ডুবে গেলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি টহল দল এদিন ভোরে মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচা রাস্তায় অ্যামবুশ পেতে পাকিস্তানি সেনাদের অপেক্ষায় থাকে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ ও একটি ট্রাক অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে গাড়ি দুটির ক্ষতি হয়। পাশাপাশি কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাও হতাহত হয়।

মৌলভীবাজারে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের একটি দল বড়লেখার শাহবাজপুর রেলস্টেশন থেকে তাজপুরের দিকে এগোলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

পঞ্চগড়ে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল অমরখানায় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন

২৯ আগস্ট ১৯৭১ ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আটক

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান বেড়ে যাওয়ায় ২৯ আগস্ট রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাঙালি সহযোগীদের তথ্যের ভিত্তিতে আকস্মিকভাবে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। তারা কয়েকটি গোপন গেরিলা আস্তানা ও বাড়িতে হানা দিয়ে গেরিলাসহ তাঁদের কয়েকজন সহায়তাকারীকে আটক করে।

তারা প্রথমে আটক করে ২৫ আগস্ট ধানমন্ডি অভিযানে অংশগ্রহণকারী শাফী ইমাম রুমীকে (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম)। ওই রাতের শেষভাগে (৩০ আগস্ট সকালে) আটক হন সুরকার আলতাফ মাহমুদ ও আবুল বারক আলভী। পরে আটক হন আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম), মোহাম্মদ বদিউল আলম বদি (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম), মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, বকর, হাফিজ, চুন্নু, বেলায়েত প্রমুখ। ২৯ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ক্র্যাক প্লাটুনের বহু গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।

রুমীর সঙ্গে তাঁর বাবা শরীফ ইমাম এবং ভাই সাইফ ইমাম জামীকেও পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায়। নির্যাতনের পর তাঁদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু রুমী আর ফিরে আসেননি। ফিরে আসেননি আলতাফ মাহমুদ, বদি, জুয়েল, আজাদ, বকর, হাফিজসহ অনেকে।

কয়েকটি দেশে মন্ত্রীদের পাঠাবেন ইন্দিরা

ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র ২৯ আগস্ট দিল্লিতে সাংবাদিকদের জানান, ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চারজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন।

তাঁরা ওই দেশগুলোর সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য বিশদভাবে বুঝিয়ে বলবেন এবং তাঁরা যাতে ভারতকে সমর্থন করেন, তার চেষ্টা চালাবেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজবাহাদুর এবং কে সি পন্থ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ এবং গোখলে ও ঘনশ্যাম ওঝা আফ্রিকার দেশগুলো সফর করবেন। কে সি পন্থ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতেও যাবেন।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সপ্তদশ বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান সৈয়দ আলী আহসান। এতে সভাপতি ও প্রধান অতিথি ছিলেন যথাক্রমে অশোককুমার সরকার ও অম্লান দত্ত। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান দিয়ে অধিবেশনের সূচনা হয়। ওয়াহিদুল হক, মাহমুদুর রহমান ও হাসান ইমামের পরিচালনায় সংগীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী সংস্থার শিল্পীরা।

বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে পাকিস্তান নীরব

পাকিস্তানের লাহোরে একটি বেসরকারি সূত্র সাংবাদিকদের এদিন জানায়, ৩০ আগস্ট থেকে আবার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হতে পারে। সামরিক কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। তারা শুধু বলেছে, ১১ আগস্ট শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে এবং সাবেক আইনমন্ত্রী এ কে ব্রোহি তাঁর কৌঁসুলি নিযুক্ত হয়েছেন। ২১ আগস্ট তিনি প্রথম শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আগের সপ্তাহের শেষ দিকে তিনি রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছিলেন। সেখানে সরকারপক্ষের প্রধান বেসামরিক কৌঁসুলি জেনারেল বদিউজ্জামানের সঙ্গে তিনি দেখা করেন।

মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৯ আগস্ট সাপ্তাহিক জন্মভূমি পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জন্মভূমিকে আমরা শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করবই করব।’ ২৫ মার্চের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকার এ পত্রিকা এদিন থেকে আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে। পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের শুভেচ্ছাবাণী প্রকাশিত হয়। অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী পত্রিকার সাফল্য কামনা করেন।

মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এদিন ফেনীর আমলি ঘাটে পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ঘাঁটির ওপর তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তাদের সহায়তা দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪ গার্ডস রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা শুভপুরের দিকে পালিয়ে যায়। আমলি ঘাট মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন গুরুতর আহত হন।

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একটি গেরিলা দল বিস্ফোরকের সাহায্যে রাজধানী ঢাকার কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের একটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাতে এই পথে পাকিস্তানি সেনাদের কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২ নম্বর সেক্টরের আরেকটি গেরিলা দল রাতে টঙ্গী ও জয়দেবপুরের মধ্যবর্তী এলাকায় দুটি বিদ্যুৎ লাইন উড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা একটি ঘাটে পাট বহনকারী কামচাম ফ্ল্যাট ডুবিয়ে দেয়।

একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার পশ্চিমে টি আলীর বাড়ির কাছে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের পেছনে জলপথে অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের দুটি নৌকা অ্যামবুশের আওতায় আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে পাকিস্তানি সেনাদের নৌকা ডুবে যায়। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সন্ধ্যায় লাকসাম থানার বুটচি গ্রামে শান্তি কমিটির একটি সভায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সভার নিরাপত্তায় নিয়োজিত কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগী পুলিশ ও রাজাকার হতাহত হয়।

৩০ আগস্ট ১৯৭১ তাজউদ্দীন ও ডি পি ধরের আলোচনা

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ৩০ আগস্ট মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সরকারি দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এক দিন আগে এ আলোচনা শুরু হয়। তাঁরা কয়েক দফা আলোচনা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে এই প্রথম ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধির আলাপ হলো।

ডি পি ধর নিজে এ খবর কলকাতায় সাংবাদিকদের জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার নানা দিক বোঝার জন্যই বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে এই আলোচনা। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একসঙ্গে বসে প্রস্তাব করেছেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো মীমাংসা নেই। বাংলাদেশে সরকার একটি স্বাধীন সরকার। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা গেছে, পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো রফার কথা তাঁরা ভাবছেন না। তাঁদের প্রতি ভারতের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোরও এদিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কী করতে পারে, প্রধানত তা-ই ছিল তাঁদের আলোচনার বিষয়। দমদম বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবের তিনি মুক্তি চান। এই দিন রাতেই তিনি দিল্লি চলে যান।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল্লিতে এদিন বাংলাদেশ মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। লন্ডনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিশন হিসেবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

মিশনটি উদ্বোধন করেন দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আমজাদুল হক। ইতিপূর্বে তাঁরা দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী দুই বাঙালি আবদুল মজিদ ও আবদুল করিম।

বাংলাদেশের পক্ষে সদ্য আনুগত্য প্রকাশকারী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ লন্ডনে বলেন, বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনো মিল নেই। বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথক রাষ্ট্র হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর বিচারে আইনে সংশোধনী

অ্যাসোসিয়েটস প্রেস এদিন সংবাদ পরিবেশন করে, পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন সামরিক আদালতে বিচারপদ্ধতি সংশোধন করছে। সংশোধিত পদ্ধতি অনুযায়ী সামরিক আইনের ৮৮ ধারায় বলা হয়েছে, আসামির জন্য কৌঁসুলির উপস্থিতি প্রয়োজন হবে না। সাক্ষাৎ গ্রহণের পদ্ধতিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আদালতের জন্য শুধু সাক্ষ্যের স্মারকলিপি প্রয়োজন হবে। আদালত যদি মনে করেন কোনো সাক্ষ্যে বিচার বিলম্বে হবে, তাহলে আদালত সেই সাক্ষ্য বাতিল করে দিতে পারবেন। নতুন আইনে আদালতের শুনানি মুলতবি রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু বিচার ২৪ ঘণ্টার জন্য মুলতবি রাখা যেতে পারে।

সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পর পর্যবেক্ষক মহল জানায়, এতে শেখ মুজিবের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিচারের ব্যাপারটি খুব গোপন রেখেছে। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, ১১ আগস্ট বিচার শুরু হওয়ার পরই তা মুলতবি রাখা হয়। শেখ মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাননি বলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আগের দিন চালানো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান ৩০ আগস্টও অব্যাহত থাকে। ভোরে তারা সুরকার আলতাফ মাহমুদ, কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাসহ বেশ কিছু সাধারণ মানুষকে আটক করে। দিলু রোডে হাবিবুল আলম ও রাজারবাগের আলতাফ মাহমুদের বাড়ি থেকে তারা অস্ত্র জব্দ করে। গেরিলাদের ধোলাই খাল এলাকার গোপন ঘাঁটি থেকেও কিছু অস্ত্র জব্দ করা হয়।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব ও শামসুল হকের নেতৃত্বে চালনা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ চালান। দিনব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

কুমিল্লার লাকসাম থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এই দিন চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আরেকটি গেরিলা দল ঢাকার অদূরে আড়াইহাজার থানা আক্রমণ করে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সোনাপুর ও গোপালপুরের কাছেও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মানিকগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের হরিরামপুরের ঘাঁটি থেকে রসদ নিয়ে লঞ্চে করে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার হতাহত এবং লঞ্চটির বেশ ক্ষতি হয়।

ঝিনাইদহে ভারত সীমান্তবর্তী আলফাপুর খালের পাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল বাগেরহাটের শরণখোলায় পাকিস্তান বাজারে একদল রাজাকারের ওপর আক্রমণ চালালে তিনজন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।

৩১ আগস্ট ১৯৭১ স্বীকৃতির বিরোধী নই: ইন্দিরা

 

আগস্ট মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারে কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শনের পর বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে খুবই হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, বহুবার এ কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকার যে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনকে কাজ করতে দিয়েছে, এটা কি এক অর্থে স্বীকৃতি নয়? তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকৃতির বিরোধী নই।’ তবে তিনি বলেন, এখনই স্বীকৃতি দিয়ে সস্তা বাহবা পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশকে ঠিক সময়েই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের জনগণকে উদ্ধার করা। তাদের সাহায্য করা। কারণ, জয় তাদের হবেই। সমগ্র দেশের জনগণই তাদের পেছনে।

বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন উর্দু দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকেরা এদিন মুম্বাইয়ে পাকিস্তানের উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। সেখানে একটি স্মারকলিপিও দেন।

ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী ও কমন্স সভায় লেবার পার্টির এমপি পিটার শোর দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে এখন ঘটছে পুরোনো পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা এবং একটি নতুন জাতির জন্মের প্রসববেদনা। এখন বিশ্বের কাছে প্রশ্ন, এই নবজাতকটিকে নিদারুণ দুঃখকষ্টে ফেলে রাখা হবে, নাকি গণতন্ত্র ও শান্তির পথে কিছু ব্যবস্থা করা হবে। পিটার শোর জানান, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও দুজন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধানে রাজি নন।

প্রবাসে বাঙালি তৎপরতা

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুরোধে ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু ৩১ আগস্ট রোমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করেন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরি স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

মোহাম্মদ হোসেন পরে সম্মেলনের সভাপতি সুইডেনের খ্যাতনামা অধ্যাপক অ্যালভেনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ–সম্পর্কিত দলিলপত্র ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি চিঠি তাঁর হাতে দেন। অধ্যাপক অ্যালভেন পরদিন সম্মেলনের মূল অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

অসামরিক প্রশাসন ফেরানোর অপচেষ্টা

রাওয়ালপিন্ডিতে ঘোষণা করা হয়, অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের পরিবর্তে বেসামরিক গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেছেন। টিক্কা খান একই সঙ্গে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক—দুই পদেই ছিলেন। বলা হয়, বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ করা হলেও সেনাবাহিনী আগের মতো কাজ করবে।

ব্রিটিশ হাইকমিশন ঘোষণা করে, বিদেশি পত্রপত্রিকার ওপর পাকিস্তান সরকার সেন্সর বিধি প্রয়োগ করায় হাইকমিশন সব ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার বণ্টন স্থগিত রেখেছে। পাকিস্তান সরকার যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দূতাবাসকে পাকিস্তানবিরোধী রচনাসংবলিত পত্রপত্রিকা বিলি না করার জন্য অনুরোধ করেছে।

পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল এবং কিছু রাজাকারকে এদিন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থেকে কয়েকটি নৌকায় ছিরামিসি বাজারে যায়। রাজাকারদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের ছিরামিসি উচ্চবিদ্যালয়ে জমায়েত করা হয়। এরপর সমবেত গ্রামবাসীকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে কোনো কোনো দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। এভাবে পাকিস্তানি সেনারা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া তারা জনশূন্য ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারে লুটতরাজ চালায় এবং দোকান ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালান। একটি দল ঢাকার সূত্রাপুর থানায় বোমা নিক্ষেপ করলে পাকিস্তান–অনুগত কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়। আরেকটি গেরিলা দল কলাবাগানে পাকিস্তান–অনুগত পুলিশের ওপর হামলা করলে তিন-চারজন হতাহত হয়। আরও দুটি দল যথাক্রমে কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যবর্তী বিদ্যুৎ পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। নরসিংদীতে অন্য গেরিলারা শিবপুর থানায় হামলা করলে থানা ও রাজস্ব অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত গেরিলারা পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। গেরিলারা সেতুটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়।

শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৫০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদেরও বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment