এপ্রিল মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের স্বাধীনতার এপ্রিল মাস , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
এপ্রিল মাস ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

জাতিসংঘের মহাসচিবকে নিকট ভারতের চিঠি (১ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে ১ এপ্রিল ভারতের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে সেটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে নিষ্ক্রিয় থাকার সময় নেই। আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠীর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, মানবদুর্গতির এই মুহূর্তে নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতাকে দুর্গত জনসাধারণ বহির্বিশ্বের উদাসীনতা বলে ভাববে। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সংযত না করলে এবং আন্তর্জাতিক অভিমত বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থনসূচক না হলে এ উপমহাদেশে উত্তেজনা বাড়বে।
যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে আলোচনা হয়। সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস, এডওয়ার্ড কেনেডিসহ আরও কয়েকজন আলোচনায় অংশ নেন। হ্যারিস তাঁর বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে, পৃথিবী সে সম্পর্কে জানে না। কারণ, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ রূঢ়ভাবে বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে। সম্ভবত একমাত্র এভাবেই তাদের সেনাদের পক্ষে নিশ্চিন্তে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
৩১ মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস–এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি (হ্যারিস) বলেন, ‘নয়াদিল্লির এক বিশ্বস্ত সূত্র দাবি করছে যে পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে গুলি করে মারছে এবং বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে হত্যা করছে, যাতে সেখানকার মানুষ চিরকালের মতো নিশ্চুপ থেকে যায়। বিশ্বকে অবশ্যই তার নীরবতা ভাঙতে হবে।
হ্যারিস আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যে ব্যাপক মানব ধ্বংসযজ্ঞে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে তার আর নৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় নেই, তবে তাই বলে নিষ্ক্রিয় থাকলেও চলবে না। যুক্তরাষ্ট্রকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে তারা আপাতত পাকিস্তানকে সব সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ রাখবে।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অবর্ণনীয় গণহত্যা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা সমরাস্ত্র নিরীহ নাগরিকদের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫০ হাজার উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করতে পারেন। তবে সে উদ্যোগ জাতিসংঘের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।
ব্রিটেনের কমন্স সভার সদস্য রাসেল জসটন লন্ডনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা-ই ঘটুক না কেন, দুটি বিষয় উপেক্ষা করার মতো নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেছে এবং পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। বিষয়টিকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে মেনে নিয়ে যুক্তরাজ্য নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। কমনওয়েলথের প্রবীণ সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের দায়িত্ব রয়েছে।

পাকিস্তানিদের আরও নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী মানুষের ঢল এই দিনও অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষ এই দিনও সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের আরও কিছু অঞ্চল এই দিন দখল করে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তবে দেশের বেশির ভাগ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) সদর ও কয়েকটি জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। টাঙ্গাইল শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দিনভর যুদ্ধের পর সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরে যান।
তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক সরকার ৩০ মার্চ বেলা তিনটার দিকে এক প্লাটুন সেনা নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সামরিক কনভয় অ্যামবুশ করেন। লড়াই চলাকালে রফিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর তারা তাঁকে এই দিনে হত্যা করে।

ঢাকায় সামরিক কর্তৃত্ব এবং জিঞ্জিরায় গণহত্যা (২ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
২ এপ্রিল ঢাকায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দিন বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ঢাকার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে বহু মানুষ নদী পেরিয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানীয় অধিবাসীসহ বাইরে থেকে আসা নিরীহ মানুষ সে গণহত্যার নির্মম শিকার হন।
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় (বাংলাদেশ) সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন একটি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনাগুলো হলো অনুপস্থিত সরকারি কর্মচারীরা অবিলম্বে কাজে যোগ দিলে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না; ভারতীয় নাগরিক কোনো অনুপ্রবেশকারীকে কেউ আশ্রয় দিলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং ঢাকার সব বাড়ি-গাড়ির নম্বর এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড উর্দুতে লিখতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঠাকুরগাঁও, সুনামগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই দিনেও সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়।
আরেকটি বিবৃতিতে (হ্যান্ড আউট) সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান ভারতের কাছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এই দিন সকালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
তাজউদ্দীন আহমদের দিল্লি যাত্রা
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ দেশটির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে রাতে দিল্লি রওনা দেন। তিনি যান বিএসএফের একটি পুরোনো মালবাহী রুশ বিমানে। ঘড়ির কাঁটা তখন ১ এপ্রিল দিবাগত রাত পেরিয়ে ২ এপ্রিল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং ভারতের বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদার তাঁর সহযাত্রী।
২ এপ্রিল সকালে তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে গিয়ে পৌঁছান।
ভুট্টোর সমালোচনায় বিদেশি তথ্যমাধ্যম
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তারা পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে চীনের বার্তা সংস্থা এনসিএনের প্রতিনিধি ছাড়া আর কোনো বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে দেখতে পেয়ে ভুট্টো মৃদু হেসে বলেন, ‘সে তালিকায় আপনি পড়েন না।’
ভুট্টো বলেন, ভারতের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তান বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। ভারতীয় লোকসভায় গৃহীত প্রস্তাবের নিন্দা করে তিনি বলেন, উত্তেজনা বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য।
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট চিঠি দিলেন ইয়াহিয়াকে
সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রুশ ফেডারেশন) সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ২ এপ্রিল একটি চিঠি পাঠান। চিঠিটি কূটনৈতিক মাধ্যমে ৩ এপ্রিল ইয়াহিয়ার কাছে পৌঁছায়।
চিঠিতে পদগোর্নি লেখেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করার খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী রাজনৈতিক নেতাদের জুলুম ও গ্রেপ্তারের ঘটনাতেও তাঁরা উদ্বেগ বোধ করছেন।
চিঠিতে শক্তি প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ পথে সমস্যার সমাধানের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও একটি বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের মানুষের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্দশায় তাঁরা উদ্বিগ্ন।

৩ এপ্রিল ১৯৭১ : বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ, অবরুদ্ধ ঢাকা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ঢাকা এমনিতেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ৩ এপ্রিল লোকের মুখে মুখে জিনজিরার হত্যাযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক আর ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। ‘জিনজিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’ (‘অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট মিসক্রিয়্যান্টস অ্যাট জিনজিরা’) শিরোনামে হত্যাযজ্ঞের খবরটি বেরিয়েছিল মর্নিং নিউজ–এ। পাকিস্তানি সামরিক শাসনের অধীনে প্রকাশিত পত্রিকায় সে হত্যাযজ্ঞের পক্ষেই সাফাই গাওয়া হয়।
জাহানারা ইমাম তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘মর্নিং নিউজ–এর একটা হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।…খবরে লেখা হয়েছে: দুষ্কৃতকারীরা দেশের ভেতরে নির্দোষ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রান করছে। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় সম্মিলিত এ রকম একদল দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছিল। এলাকাটি দুষ্কৃতকারীমুক্ত করা হয়েছে।’
এই দিন চট্টগ্রামে বাঙালি ইপিআর সেনারা বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি দলের ওপর গেরিলা হামলা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। বৃহত্তর সিলেটের শমশেরনগরে এবং পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে ঠাকুরগাঁওকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখে।
ঢাকাসহ বহু জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা কর্তৃত্ব নিয়ে নেওয়ার পরও পাবনা, সিলেট, নরসিংদী, রাজশাহী, লাকসাম, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাতক্ষীরা, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার এই দিন মুক্ত ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১ এপ্রিল সিনেটে বক্তব্য দেওয়ার পর ৩ এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাক প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, সরকারিভাবে এমন কোনো তথ্য তাঁদের জানা নেই। পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় পাকিস্তানের সরকারি বাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ সম্পর্কে সরকার সংযত থাকছে।
লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ৩ এপ্রিল ‘অস্ত্রের মুখে ঐক্য’ (ইউনিটি অ্যাট গানপয়েন্ট) শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব সম্ভবত হেরে গেছেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গৃহযুদ্ধের যে পথ বেছে নিয়েছেন, সে পথে না জেতার সম্ভাবনাই বেশি।’
পাকিস্তান সংকটের পটভূমি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিপন সোসাইটিও একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করে। রিপন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট লি উসপিৎজ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন এ মার্গলিন ও প্রভাষক গুস্তাভ এফ পাপেনেকের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি এই পর্যালোচনা পেশ করেন। তাতে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
প্রথম বৈঠক বাঙালি সেনাদের (৪ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রতিরোধযোদ্ধা দলের অধিনায়কেরা ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুরের মুক্তাঞ্চল তেলিয়াপাড়ায় সমবেত হন। সেখানে তাঁরা একটি বৈঠক করেন। বৈঠকটি হয় তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের ডাকবাংলোতে।
কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী (স্বাধীনতার পর জেনারেল, সাংসদ ও মন্ত্রী) বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। অংশ নেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (পরে বীর উত্তম, মেজর জেনারেল, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রদূত ও সাংসদ), মেজর খালেদ মোশাররফ (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল), মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল), মেজর শাফায়াত জামিল (পরে বীর বিক্রম ও কর্নেল), মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল) এবং ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন (পরে বীর প্রতীক ও মেজর জেনারেল) প্রমুখ। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা এবং মেজর কাজী নুরুজ্জামান (পরে বীর উত্তম ও কর্নেল)।
চট্টগ্রামে ইপিআর সদস্যদের নিয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে যাওয়ার কারণে তেলিয়াপাড়ার বৈঠকের খবর পাননি।
বৈঠকে উপস্থিত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালি সেনাদের অভিন্ন নির্দেশের আওতায় এনে পুনর্বিন্যাস করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, কিছু কিছু এলাকায় থাকা অতিরিক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে এনে যুদ্ধ–আক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী আরও সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিবাহিনীর দুটি দল অস্ত্রশস্ত্রসহ আখাউড়া থেকে ভারতের ভেতর দিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম এলাকায় যাবে। একটি দল যোগ দেবে মেজর জিয়াউর রহমানের (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে, অন্যটি ভাটিয়ারী এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করবে।
১০ এপ্রিল আবারও একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১২ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ টিক্কা খানের সঙ্গে
ঢাকায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, খাজা খয়েরউদ্দিনসহ কয়েকজন। তাঁরা টিক্কা খানকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেনাবাহিনীর তদারকিতে তাঁরা একটি নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।
চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে
দিনটিতে চট্টগ্রাম শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে থাকা বাঙালি ইপিআর সেনারা কোনো কমান্ড ছাড়াই দিনকয়েক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল। সীমিত রসদ শেষ হয়ে আসায় তারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানে অভিযান শুরু করে। শহরের উত্তর–পশ্চিম দিক দিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক ধরে একটি দল, উত্তরে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক ধরে দ্বিতীয় দল এবং চট্টগ্রামে কালুরঘাট ও কক্সবাজার সড়ক হয়ে শেষ দলটি শহর থেকে বেরিয়ে কালুরঘাটের দিকে যেতে থাকে।
বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ
বিবিসির খবরে বলা হয়, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশবাণীর বরাতে বলা হয়, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামসহ আরও পাঁচটি বেসামরিক এলাকায় নাপাম বোমা ফেলেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস–এ বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লি থেকে পাঠানো খবরের শিরোনাম ছিল, ‘এসবই খেলার রীতি: তবে ভয়ংকর ও নির্দয় এক খেলা’। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য বাল্টিমোর সান–এ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘দ্বন্দ্বের মূল’ শিরোনামে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ সেলিং এস হ্যারিসনের প্রতিবেদন বের হয়। দ্য বাল্টিমোর সান–এ জন ই উডরাফের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানিরা বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করছে’।

পশ্চিমবঙ্গের জনতা মুক্তিযুদ্ধে একাত্ম (৫ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। সভায় নেওয়া এক প্রস্তাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও অত্যাচার বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোসহ দরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হয়। সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে ১১ এপ্রিল কলকাতায় জনসভা করা নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করতে কলকাতার ভারতীয় সংস্কৃতি ভবনে অন্য সভায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করা হয় সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠন। এর সভাপতি নির্বাচিত হন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কোষাধ্যক্ষ ও যুগ্ম সম্পাদক হন যথাক্রমে সন্তোষকুমার ঘোষ ও বিনয় সরকার। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সঙ্গে যোগ রেখে এই সমিতি কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন মনোজ বসু ও প্রবোধকুমার সান্যালসহ বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এই সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংগঠন মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখা রক্তদান কর্মসূচির ডাক দেয়। ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান রিলেশনসের এক সভায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করা হয়। কলকাতা বন্দরের শ্রমিক, জাহাজমালিক, নিয়োগকর্তা কর্মকর্তা ও কর্মীদের এক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। কলকাতা বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বঙ্গীয় ব্যাংক কর্মী অ্যাসোসিয়েশনের কর্মীরা মুক্তিযোদ্ধাদের এক দিনের বেতন দেওয়ার কথা জানিয়ে বিবৃতি দেন। কলকাতার একদল মেডিকেল ছাত্র চুয়াডাঙ্গা-দর্শনায় মেডিকেল মিশনে যান।
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় আলোচনা
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়। কমন্স সভার কয়েকজন সদস্য আলোচনায় বাংলাদেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করেন। এর আগে পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব অ্যালেক ডগলাস হোম বিবৃতি দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন। পাকিস্তানের জনগণের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্দশায় তাঁরা উদ্বিগ্ন বলে জানান। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিবৃতির সূত্রে পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে পরিচালিত যেকোনো আন্তর্জাতিক মানবিক প্রয়াসের প্রতি তাঁরা সহানুভূতিশীল।
সামরিক কর্তৃপক্ষের সচলতা
পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এ দিন ঢাকায় ঘোষণা করে, প্রদেশের পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাকিস্তানবিরোধীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ এ দিন ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এ সময় নাগরিকেরা দলে দলে নগরী ত্যাগ করেন।
পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নেতাদের তৎপরতা
পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন এবং দলের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা মৌলভি ফরিদ আহমদ পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে আলাদাভাবে বেতার ভাষণ দেন। বাংলাদেশের সব বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁদের ভাষণ প্রচারিত হয়।
ভাষণে নুরুল আমিন বলেন, ভারতের লোকসভায় প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর দেশের পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রকাশ্যে উসকানি দেওয়া হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এমন হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না।
মৌলভি ফরিদ আহমদ তাঁর বেতার ভাষণে বলেন, জনগণের একটি অংশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কোনো নতুন সমস্যা সৃষ্টিতে উৎসাহিত না হলে বেদনাদায়ক শক্তি প্রদর্শনের সামান্যতম প্রয়োজনও হতো না। কিন্তু ভারতীয় বেতার থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের বহু অংশে প্রাধান্য লাভ করছে।
কাইয়ুম মুসলিম লীগের সাবেক মহাসচিব খান এ সবুর খান আরেকটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবের ৬ দফা পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার একটি অতিসূক্ষ্ম পদ্ধতি। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠাচ্ছে এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে মদদ জোগাচ্ছে।

পাকিস্তানকে চাপ দিতে কমন্স সভায় প্রস্তাব (৬ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
পূর্বাঞ্চলে (বাংলাদেশ) অস্ত্রবিরতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে ৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে দেশটির ১৮০ জনের বেশি সাংসদের স্বাক্ষর ছিল। এ প্রস্তাবের বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। তাঁর এ বক্তব্য সাংসদেরা মেনে নেন। কিন্তু তাঁরা উদ্বিগ্ন যে আর কালক্ষেপণ না করে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এদিন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) পরিস্থিতির নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র এ-জাতীয় পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হলে স্বভাবতই তাঁরা উদ্বিগ্ন হবেন।
চট্টগ্রামে যুদ্ধ
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় ৬ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দুটো দলের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) এবং লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। পাকিস্তানিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রায় জয়ের পথে, পাকিস্তানিরা তখন ট্যাংক ব্যবহার করতে শুরু করে। আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষে শহীদ হন।
সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তেও মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। আরেকটি প্রতিরোধযুদ্ধ হয় রাজশাহী শহরে।
৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও কক্সবাজারসহ জেলার বহু এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিরোধযোদ্ধাদের কর্তৃত্বে ছিল। রংপুর, সৈয়দপুর ও দিনাজপুর শহর বাদে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গও প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ঢাকায় পাকিস্তানপন্থী নেতারা
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক প্রধান গোলাম আযম, পীর মোহসেনউদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া) এবং আইনজীবী এ টি সাদী সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানান এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দমনে সামরিক বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
পরে এক বিবৃতিতে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় বলে ভারতীয় বেতার মানুষ হত্যা ও জনপদ ধ্বংসের ভিত্তিহীন প্রচারণা চালাচ্ছে। ভারত এ উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনও দিচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল আলা মওদুদি লাহোরে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেখানকার মানুষ তাদের স্বাধীনতা হারাবে। আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সমর্থন দিতে সবার প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
পদগর্নির চিঠির জবাবে ইয়াহিয়া
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নির চিঠির জবাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান কারও হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। আওয়ামী লীগ দেশকে ধ্বংস করার কোনো ম্যান্ডেট পায়নি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বমূলক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সিঙ্গাপুরের পত্রিকায় সম্পাদকীয়
সিঙ্গাপুরের দ্য নিউ নেশন পত্রিকা এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হতে হবে’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে অপসারিত বিদেশি নাগরিকদের কাছে পাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিবরণ ভয়াবহ। পরিস্থিতি গণহত্যার কাছাকাছি। পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ড বৈধ প্রয়োজনের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের পণ্ডিতি ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিশ্বমানবতার কণ্ঠ রোধ করে রাখা যাবে না।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালি কূটনীতিকের সম্পর্ক ছিন্ন (৭ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ভারতের রাজধানী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের দুজন বাঙালি কূটনীতিক শেহাবউদ্দিন আহমদ ও আমজাদুল হক ৭ এপ্রিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁরাই প্রথম কোনো বাঙালি কূটনীতিক, যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে শেহাবউদ্দিন আহমদ দ্বিতীয় সচিব হিসেবে এবং আমজাদুল হক সহকারী প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই অব্যাহত
বিমান, জাহাজ ও পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে বিপ্লবী বেতার ভবনে তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। সে আক্রমণ পাল্টা প্রতিরোধ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে তাঁরা পিছু হটে কালুরঘাটের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানে এসে জড়ো হন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন স্থানে এই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট-বড় যুদ্ধ চলে। ইপিআরের অবাঙালি ১৮ জনের একটি সশস্ত্র দলের সঙ্গে নায়েক সুবেদার আবদুল লতিফের নেতৃত্বে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলাকালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল বাঙালি ইপিআরের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়। অবশেষে ১৮ জন পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করে। তাদের রামগড়ে নিয়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার নাজিরহাটের শিয়ালবুককাতেও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয় যশোরের লেবুতলায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামান্য ক্ষতিসাধন করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেন।
পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নেতাদের তৎপরতা
মুসলিম লীগের সাবেক নেতা খান এ সবুর ঢাকায়
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমির গোলাম আযম, গোলাম সারওয়ার ও মাওলানা নুরুজ্জামান ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানান।
আরও যেসব রাজনৈতিক দল এই দিন বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা জানায়, তাদের মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ইসলামিক রিপাবলিক পার্টি।
বিশ্ব গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন
বিবিসির খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কয়েকটি দেশের নাগরিক কলকাতায় পৌঁছে জানিয়েছেন, সেখানে তাঁরা রাস্তায় মৃতদেহ স্তূপীকৃত হয়ে থাকতে দেখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, দুই সপ্তাহের লড়াইয়ে বিপুল ধ্বংস সাধিত হয়েছে।
এক মার্কিন নাগরিক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ-সংযোগ পুনঃস্থাপনের জন্য সেনাবাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি রাস্তায় বহু মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। তিনি বলেন, শহরজুড়ে এখন শুধু মৃতদেহের গন্ধ। চট্টগ্রাম এখন একটি ভৌতিক নগরী। সেনাবাহিনী, মৃতদেহ আর কুকুর ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। একজন শরণার্থী বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা দেখামাত্রই পূর্ব পাকিস্তানিদের গুলি করছে। স্থানীয়রাও চট্টগ্রাম বন্দরে অবাঙালিদের হত্যা করছে।
‘বাংলায় রক্তবন্যা’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস এই দিন একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলে, সংকট শুরু হওয়ার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে অব্যাহত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তারা কয়েকবার উদ্বেগ এবং শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে আমেরিকার করণীয় সম্পর্কে এই দিন কংগ্রেস সদস্য শিমুর হলপার্ন বক্তব্য দেন।

কলকাতায় গণহত্যার প্রতিবাদে মিছিল (৮ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ৮ এপ্রিল এক দীর্ঘ বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়াহিয়া ও তাঁর বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদাকে যখন ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা এ অবস্থায় নীরব বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।
বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতসহ পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন সবাই বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিক এবং সব রকমের সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়াক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তারা সামর্থ্যের চেয়ে বেশি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এই দিনে কলকাতায় অধ্যাপকেরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলের আগে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ারে অধ্যাপকদের প্রতিবাদ সভা হয়। সভার পর অধ্যাপকদের মিছিল বিভিন্ন পথ ঘুরে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন এবং পরে বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) দূতাবাসের সামনে যায়। মিছিল থেকে দূতাবাসে দুটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতিও বাংলাদেশকে সাহায্য করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরায় যাওয়া শরণার্থীদের জন্য ৮ এপ্রিল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নয়টি শিবির খোলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ওয়াল্টার এফ মন্ডেল এক চিঠিতে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য কর্মসূচি আবার পর্যালোচনার জন্য নিজ দেশের সরকারের প্রতি দাবি জানান।
কালুরঘাটের কৃষি ভবনে যুদ্ধ
মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে কালুরঘাটে কৃষি ভবনে অবস্থান নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন। ফলে কালুরঘাটের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই এলাকায় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা ও ইপিআরের বাঙালি সেনাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক মেজর মীর শওকত আলী (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন মুক্তিবাহিনীকে। তাঁর নির্দেশে লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম, রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রসচিব) কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেন।
তুমুল সে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হতে পারেননি। যুদ্ধে নায়েক আলী নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিজেদের অবস্থানে চলে যান।
পাকিস্তানের তৎপরতা
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে ৮ এপ্রিল একটি নোট পাঠান। নোটে তিনি অভিযোগ করেন,পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ দিচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন জানায়, দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিবাহিনী) পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন চলাচলে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য রাস্তায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, বিমানবাহিনী সেসব ধ্বংস করছে। বিমানবাহিনী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের আস্তানা ও যানবাহনের ওপর আঘাত হানছে।
ঢাকায় কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতা এই দিনও আলাদা আলাদা বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সোলায়মান, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি শামসুল হুদা, প্রাদেশিক ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মিয়া মফিজুল হক, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এ টি এম আবদুল মতিন এবং ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মাওলানা নুরুজ্জামান।

অব্যাহত লড়াই, টিক্কা খানের শপথ (৯ এপ্রিল ১৯৭১)

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে ঢাকায় শপথ নেন। শপথ পরিচালনা করেন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান মার্চের প্রথম দিকেই টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁর শপথ নেওয়ার দিন ধার্য ছিল ৬ মার্চ। গণ-আন্দোলনের তীব্রতা দেখে বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী তখন শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে পাকিস্তান ধীরে ধীরে তাদের সামরিক কর্তৃত্ব কায়েম করছিল। আবার স্থানে স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ঝটিকা গেরিলা আক্রমণও পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। ঢাকার রাস্তা ছিল পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সাঁজোয়া যানের দখলে। কার্যত ঢাকা পরিণত হয়েছিল একটি অবরুদ্ধ শহরে।
জাহানারা ইমাম তাঁর ৯ এপ্রিলের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘কারফিউয়ের মেয়াদ ধীরে ধীরে কমছে। পাঁচ তারিখে ছ’টা-ছ’টা ছিল। ছয় তারিখ থেকে সাড়ে সাতটা-পাঁচটা দিয়েছিল। গতকাল থেকে আরও কমিয়ে ৯টা-৫টা করেছে।…(ধানমন্ডি) তিন নম্বর রোডে ওয়াহিদের বাসার কাছাকাছি মিলিটারিদের চলাফেরা খুব বেড়ে গেছে।’
ঢাকার কাছে নরসিংদীর দক্ষিণে পশ্চিম শীলমন্দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে জঙ্গি বিমান ও আর্টিলারি নিয়ে আক্রমণ করে। দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর অস্ত্রের রসদ কমে গেলে সন্ধ্যার আগে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। তবে কালুরঘাটের কৃষি ভবনে ভিন্ন ঘটনা ঘটছিল। ৮ এপ্রিল সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা হটে গিয়েছিলেন। এই দিন সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কৃষি ভবনে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারা কৃষি ভবন ছেড়ে শহরের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
যশোরের বেনাপোল সীমান্তেও মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে সারা দিন ধরে সংঘর্ষ চলে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিলেট শহর দখল করে সিলেট মেডিকেল কলেজে অভিযান চালায়। তারা হাসপাতালে ঢুকে ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ (১০ এপ্রিল ১৯৭১)
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দলের হাইকমান্ডের সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল রাতে তিনি ভাষণ দেন। ভাষণটি স্বাধীন বাংলা বেতারের গোপন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তাঁর এই বেতার ভাষণ থেকে সবাই জানতে পারেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে।
পরদিন ১১ এপ্রিল আকাশবাণী থেকে ভাষণটি একাধিকবার প্রচার করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান এখন চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য বাংলাদেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করা। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণি বা দল নেই। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সব রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ কায়েমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ সংগ্রাম সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম, এ সংগ্রাম আজাদী ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। আজ আপনার–আমার একমাত্র কর্তব্য নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। আমাদের ঐক্য বজায় থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কেন, দুনিয়ায় এমন কোনো শক্তিই আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারবে না।’
তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের আবার বৈঠক
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার চা–বাগানে আবার বৈঠকে বসেন। বৈঠকে কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান রামগড় থেকে এসে বৈঠকে যোগ দেন। ওসমানী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা প্রতিহত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল নজর রেখেছিল যশোর সেনানিবাসের দিকে। রাতে সুবেদার আহাম্মেদ উল্লাহ স্বল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে প্রায় আট মাইল পথ অতিক্রম করে এসে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের বেশ কিছু কালভার্ট ধ্বংস করে দেন।
কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার (বর্তমানে উপজেলা) উত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা একটি পাকিস্তানি সেনাবহরে ঝটিকা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
১০ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে বেতার ট্রান্সমিটার অপসারণের নির্দেশ দেয়। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশনে দেওয়া নোটে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার জানতে পেরেছে, ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন কার্যালয়ে একটি বেতার যোগাযোগযন্ত্র কাজ করছে। কিন্তু সরকার ভারতের হাইকমিশন বা উপহাইকমিশনকে কোনো বেতার ট্রান্সমিটার চালানোর অনুমতি দেয়নি।
পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে টেলিফোন সংযোগ আংশিক চালু করার ঘোষণা দেয়। তারা ঘোষণা দেয়, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ব্যবস্থা ক্রমশ চালু হচ্ছে।
প্রাদেশিক জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকায় এক বেতার ভাষণে বলেন, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছেলে এবং জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য এ কে ফায়জুল হক এবং শেরেবাংলার মেয়ে ও জমিয়াতুল ইসলামীর সভানেত্রী রইসি বেগম ঢাকায় পৃথক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। আরও কিছু ইসলামি দলের রাজনৈতিক নেতা পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষে বিবৃতি দেন।
বাংলাদেশের পক্ষে সমাবেশ ও মিছিল
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে বড় একটি সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসহ সব রকমের সাহায্য দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এমএলএ দীনেশ মজুমদার। প্রস্তাব পেশ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বক্তব্য দেন বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী প্রমুখ।
কলকাতায় ছাত্র-যুবকেরা পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে মিছিল করেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মীরা পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানান।
“এপ্রিল মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এপ্রিল মাস , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
“এপ্রিল মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ – ধারাবাহিক পর্ব এপ্রিল ( ১১-১৯ ) ১৯৭১

চীনের অবস্থান পাকিস্তানের পক্ষে (১১ এপ্রিল ১৯৭১)
পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানাল চীন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ১১ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, চীন সরকার মনে করে পাকিস্তানে যা ঘটছে, সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পাকিস্তানকে তিনি আশ্বাস দেন, ভারত আক্রমণ করলে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ় সমর্থন দেবে চীন।
বাংলাদেশের সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা নিয়ে এই দিনে চীনের পিপলস ডেইলিতে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা কী করতে চাইছে’ শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার কোনো দেশের নেই। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের মন্ত্রীরা শোরগোল শুরু করেছেন। ভারত সরকার জাতিসংঘে দুই পরাশক্তি সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র আঁটছে।
ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়াম সভাপতি নিকোলাই পদগর্নি ইয়াহিয়া খানকে পাঠানো বার্তায় ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের হুমকির প্রসঙ্গ উল্লেখই করেননি, অথচ উল্টো অশিষ্টের মতো পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করেছেন। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি জাতিরই পারস্পরিক সম্মানের পাঁচটি নীতি মেনে চলা উচিত। নীতিগুলো হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা, অনাক্রমণ, পারস্পরিক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
নিয়াজির দায়িত্ব গ্রহণ, বাংলাদেশের পক্ষে কলকাতায় জনসমর্থন
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আগের রাতে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ ১১ এপ্রিল আবার প্রচারিত হয়। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও তা প্রচার করা হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে জনসভা করে। সেখানে অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর তা সমর্থন করেন।
এদিন দিল্লিতে সরকারিভাবে জানানো হয়, পাকিস্তানের সাবমেরিনে কর্মরত আটজন বাঙালি নাবিক ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ফান্সের একটি বন্দরে থাকা পাকিস্তানের সাবমেরিন থেকে পালিয়ে তাঁরা ভারতে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ১১ এপ্রিল ‘পাকিস্তান সংকট-ঘটনা ও পরিণতি’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন। তিনি টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হন। ৩ এপ্রিল তাঁর নিয়োগ হওয়ার পর ৪ এপ্রিল তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।
এদিন ঢাকায় সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভিত্তিহীন প্রচারণা অব্যাহত রাখার জন্যই নয়াদিল্লির বেতার পূর্ব পাকিস্তানে নির্যাতনের কাল্পনিক কাহিনি প্রচার করে যাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই
ঝিকরগাছার কোটচাঁদপুরে পাকিস্তানি বাহিনী আসার খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাস্তায় অ্যামবুশ পাতে। শেষ বিকেলে ১০টি গাড়ির বহর আয়ত্তে এলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিদের সামনের তিনটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খালে পড়ে যায়। কালা মিয়া নামের এক মুক্তিযোদ্ধা কাছে গিয়ে গ্রেনেড ছুড়লে চারটি গাড়িতে আগুন ধরে যায়। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণে তিনি শহীদ হন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আর্টিলারি, মর্টার, গানবোটসহ অন্য আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ করে। এ সময় দুই পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন। বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনাও নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রসচিব) গুরুতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হন।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধ হয়। ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে চরখাইয়ে চলে যান। মুক্তিবাহিনী সেখানে নতুন প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে চরখাই আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি ফুলবাড়ীর চরখাই রোডে, একটি কোম্পানি ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে অবস্থান নেয়। একটি কোম্পানি ডেপথ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দিন গোপালগঞ্জ দখল করে স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় মানিকহারে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পাকিস্তানি সেনারা মানিকহার গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সকালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী দখল করে। তারা প্রবেশের পর অবাঙালিরা নূর মহলা ও ফতে-মোহাম্মদপুর এলাকায় হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজে অংশ নেয়। তাদের হাতে ৩২ জন বাঙালি প্রাণ হারান।
যশোর-বেনাপোল সড়কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই পক্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ আটকের পর (১২ এপ্রিল ১৯৭১)

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করার পর ১২ এপ্রিল তাঁর ছবি দৈনিক পাকিস্তানসহ কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। দৈনিক পাকিস্তান-এ ক্যাপশন ছিল, ‘আটক অবস্থায় করাচি বিমানবন্দরে শেখ মুজিবুর রহমান’।
বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে এই দিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হয়। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী থাকায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব
ও কর্তব্য পালনের জন্য উপরাষ্ট্রপতি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন আহমদ হন প্রধানমন্ত্রী। এর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপনসহ যেসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কারও ওপর অর্পিত হয়নি, তাঁরও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিনি। একই সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সমন্বয় সাধন করবেন।
মন্ত্রিসভার অপর সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়), ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী (অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়)।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ
মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকায় মৌলভি ফরিদ আহমেদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির ৯ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মাওলানা নুরুজ্জামান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ব্যারিস্টার কোরবান আলী, ওয়াজি উল্লাহ খান, আজিজুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ সিদ্দিকী (চট্টগ্রাম), এ কে নুরুল করিম (স্বতন্ত্র সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ) ও মাহমুদ আলী সরকার কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে বাকি সব সরকারি, স্বশাসিত এবং আধা স্বশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের ২১ এপ্রিলের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলে, অনুপস্থিত কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হবে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি সামসুল হুদা, সাধারণ সম্পাদক এ এস এম ইউসুফ, সাবেক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি আবদুল আওয়াল এবং মোহাম্মদ হোসেন ঢাকায় গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার যুক্তি ব্যাখ্যা করে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান ঢাকায় এক সভা করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর থেকে আটক প্রায় ১৫০ জনকে রংপুর সেনানিবাসের পশ্চিম দিকের উপশহরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
নানা স্থানে লড়াই
এই দিন ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি দিয়ে যশোরের ঝিকরগাছায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে হামলা করে। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। ভারতের বিএসএফ এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুজন এবং বিএসএফের একজন নিহত হন। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তসংলগ্ন বেনাপোলের কাগজপুকুরে অবস্থান নেন।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও হাবরায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা করে। দুই জায়গাতেই মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পার্বতীপুরে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
তিস্তা সেতুতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তা সেতুর অবস্থান ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
রাজশাহীর সারদা মোড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। নাটোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে রাজশাহীর বাণেশ্বরে অবস্থান নেন।
মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল সম্মিলিতভাবে লালমনিরহাট বিমানবন্দরে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান। তবে কয়েক ঘণ্টার এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের মিঠাপুকুরিয়ায় অবস্থান নেওয়া ইপিআরের একটি কোম্পানি এবং পুলিশ ও আনসারদের নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটি দলের ওপর পাকিস্তানিরা আর্টিলারি দিয়ে আক্রমণ করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পেরিয়ে এগোতে থাকে। জয় পাকিস্তানিদের পক্ষে গেলেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ
বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে তাঁরা অবিলম্বে পূর্ব বাংলার সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বল প্রয়োগ করে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কোনো সরকারেরই নেই।
টাইম ম্যাগাজিন-এ ‘প্রথম রাউন্ডে পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়’ শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে ঢাকায় নিযুক্ত এক বিদেশি কূটনীতিকের বরাত দিয়ে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। ঢাকার বুকে ট্যাংক চষে বেড়াচ্ছে। অসংখ্য বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখন অব্দি জয়ী। তবে কিছুদিনের জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলেও ৫৫ হাজার বর্গমাইল গ্রামীণ অঞ্চল এবং বিপুল বিক্ষুব্ধ জনগণকে দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা জনগণকে (১৩ এপ্রিল ১৯৭১)
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার ১৩ এপ্রিল জনগণের প্রতি নয়টি নির্দেশনা জারি করে। এর প্রথমটিতেই চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রূষার জন্য আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসক বা কবিরাজের কাছে নিয়ে যেতে বলা হয়। বাকিগুলো ছিল সরাসরি মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে। সেসব নির্দেশনায় ঘরের শত্রুদের রুখে দাঁড়ানো, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে কর্তব্য জেনে নিতে এবং প্রশিক্ষণের জন্য তরুণদের নিকটবর্তী মুক্তিফৌজ দপ্তরে চলে আসতে বলা হয়।
সরকারের নির্দেশনায় আরও ছিল, প্রত্যেক গ্রামপ্রধান আশপাশের গ্রামপ্রধানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে খবর বিনিময় করবেন, মুক্ত অঞ্চলগুলোর সরকারি কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা নেবেন। নিজ এলাকায় মুক্তিফৌজ কমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী অসামরিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নিয়ম মেনে চলবে এবং সন্দেহভাজন লোকের খোঁজ পেলে কাছের মুক্তিফৌজ কেন্দ্রে জানাবে। ঢাকায় নদী পরিবহনকর্মীরা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশ অমান্য করায় বাংলাদেশ সরকার তাঁদের ধন্যবাদ জানায়।
বাঙালির পক্ষে জনমত
লক্ষ্ণৌ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন ভারতকে নিবৃত্ত করবে না। বাংলাদেশের ঘটনায় ভারত নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না।
ভারতের রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে ১০ লাখ রুপি অনুদানের ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অসামরিক মানুষের যথেচ্ছ হত্যার খবরে তিনি শঙ্কিত। কংগ্রেস ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানকার পরিস্থিতি জানা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বেসামরিক লোকদের যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ডের খবর অসত্য প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
সাবেক যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের যুগোস্লাভ লিগ ফর পিস, ইনডিপেনডেন্স অ্যান্ড ইকুয়ালিটি অব পিপলস বিবৃতিতে বলে, বাংলাদেশের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাকিস্তান সরকারের মেনে নেওয়া উচিত।
পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্মতা
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে শান্তি কমিটি ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলে খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, কবি বেনজীর আহমদসহ অনেকে ছিলেন।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, নগর মুসলিম লীগ, নগর কনভেনশন মুসলিম লীগ, জাতীয় যুব পরিষদ, জমিয়াতুল ইত্তেহাদ এবং ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের পক্ষে আলাদা আলাদা বিবৃতি দেন।
নানা স্থানে যুদ্ধ
বৃহত্তর রংপুরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি স্থানে যুদ্ধ হয়। সকালে তিস্তা রেলসেতুতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি সেনারা তীব্র সশস্ত্র হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তা সেতু ছেড়ে শিঙের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাটে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে বদরগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে ট্যাংক দিয়ে হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান।
তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সেনা, ইপিআর সেনা ও ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁও সীমান্তে অবস্থান নেন। সংগ্রাম কমিটির নেতারাও শহর ছেড়ে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে লিপ্ত না হয়ে খানসামার পথ ধরে পেছন দিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি খানসামার কাছে নদী পার হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজশাহী সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী আর্টিলারি, পদাতিক ও বিমান হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সরে গিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সমবেত হয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করেন।
পুঠিয়ার বানেশ্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বানেশ্বরের যুদ্ধের পর বানেশ্বর ও সারদার পতন হয়।
পাকিস্তানি সেনারা সারদা দখল করার পর কয়েক শ সাধারণ মানুষ নদীতীরে আশ্রয় নেয়। সেনারা তাদের ঘেরাও করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর অনেকের লাশ পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ‘সারদা গণহত্যা’ নামে পরিচিত হয়।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটে সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জলযান ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায়।
টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার গঙ্গাসাগর সেতুতে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সমন্বয়ে গড়া একদল মুক্তিযোদ্ধার ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ দল গোলাবর্ষণ করে। তীব্র গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ধরে রাখেন।
যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা নড়াইল শহরে পৌঁছায়। মুক্তিযোদ্ধারা তার আগেই শহর ছেড়ে যান।
চট্টগ্রামে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের নূতন চন্দ্র সিংহকে মন্দিরে প্রার্থনারত অবস্থায় পাকিস্তানিরা হত্যা করে।
বৃহত্তর সিলেটের লাক্কাতুরায় অসংখ্য চা-শ্রমিককে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে।
জনতা ও বন্ধুরাষ্ট্র এর প্রতি তাজউদ্দীনের আহ্বান (১৪ এপ্রিল ১৯৭১)
১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ছিল বাংলা বছরের শেষ দিন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বাংলার সংগ্রামী জনগণকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
তাজউদ্দীন আহমদ এই দিন বিশ্বের সব সাংবাদিক, বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি তাঁদের বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান। শত্রুসৈন্যদের অবিলম্বে বিতাড়িত করার জন্য অস্ত্র সাহায্য করার এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কোনো অস্ত্র সরবরাহ না করার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানান।
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে বাঙালিদের প্রতি ১০ দফার আরেকটি নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনার পাশাপাশি আরও বলা হয়, বাঙালিকে শোষণমুক্ত করে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে ও নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান। আর মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকারী হিসেবে রয়েছেন ত্যাগী নেতারা।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশনের মহাসচিব ম্যাকডরমট পাকিস্তানে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ের খবরে আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশন দুঃখ প্রকাশ করে।
টেলিগ্রামে আরও বলা হয়, কেবল আইনের শাসনের অধীন বেসামরিক আদালতই আন্তর্জাতিক মহলকে সন্তুষ্ট করতে পারে। বিরোধী রাজনীতিবিদদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এই সংস্থা কখনোই অনুমোদন করে না। শেখ মুজিব এবং অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা আইনের চোখে কোনো অপরাধ করে থাকলে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দেশের বেসামরিক আদালতে তাদের বিচার না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাংলাদেশের সমর্থনে সর্বভারতীয় সাহায্য সংস্থা নামে নতুন একটি জাতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। আগের দিন এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক সমর গুহ নতুন এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এম সি চাগলাকে এ সংগঠনের চেয়ারম্যান এবং বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুরকে নির্বাহী চেয়ারম্যান করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সিনেটর মাস্কি এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে চলমান দুঃখজনক ঘটনায় তিনি ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। ঘটনা পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও এর মাত্রা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস–এ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সিডনি শনবার্গের আলাদা তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাঙালিদের মন্ত্রিসভা গঠন’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাদলের আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় সবাই প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের চালচিত্র
পাকিস্তান বিমানবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জে দিনভর অব্যাহত বিমান হামলা চালায়। তাতে অগণিত মানুষ মারা যায়। পাকিস্তান সেনাদের একটি বড় দলও এই দিন কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগোয়। তারা উজানিসার সেতুর কাছে পৌঁছালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সেনা সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। দুই পক্ষের তীব্র লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় আরেকটা যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কসবা পুনর্দখল করে।
ঢাকা থেকে আসা একদল পাকিস্তানি সেনা রাজশাহী শহরের প্রবেশপথে অবস্থান নিলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশ শহরে ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন স্থান থেকে ৩০ জনের মতো সাধারণ মানুষকে আটক করে শহরের একটি স্কুলে নিয়ে গুলি করে।
ভোরে ঈশ্বরদীর পাকশি রেলসেতুর ভেড়ামারা প্রান্তে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভেড়ামারা দখল করে। ঘোড়াঘাট–হিলি রোডেও পাকিস্তান সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।
অন্য একদল পাকিস্তানি সেনা সান্তাহার রেল জংশন এলাকা দখল করে। স্থানীয় অবাঙালিরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বহু বাঙালিকে হত্যা করে। সান্তাহার হত্যাকাণ্ড নামে ঘটনাটি পরে পরিচিতি পায়।
ঢাকায় শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। নেজামে ইসলামের প্রধান মৌলভি ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে এ সভার প্রস্তাবে পাকিস্তানের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
‘পূর্ব পাকিস্তান’ হয়ে গেল ‘পূর্ববঙ্গ’ (১৫ এপ্রিল ১৯৭১, বৃহস্পতিবার)
ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা জমায়েত এবং উপর্যুপরি হামলায় পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি জানিয়ে দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের কাছে ১৫ এপ্রিল ভারত কড়া প্রতিবাদ জানায়। বহির্বিষয়ক মন্ত্রক থেকে পাঠানো এই প্রতিবাদে বলা হয়, ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে পাকিস্তান বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এ ধরনের আক্রমণাত্মক কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে যথোপযুক্ত নির্দেশ দেওয়ার জন্য ভারত আহ্বান জানায়।
কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা দিল্লি থেকে পাঠানো এক রিপোর্টে জানান, ভারত সরকারের কাছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দের স্থান করে নিয়েছে ‘পূর্ববঙ্গ’। ভারতের বহির্বিষয়ক মন্ত্রক এই প্রথম পাকিস্তান হাইকমিশনকে দেওয়া তাদের সরকারি নোটের সর্বত্র ‘পূর্ববঙ্গ’ কথাটি ব্যবহার করল। ভারতীয় এলাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে নোটটি দেওয়া হয়।
সংবাদ সংস্থা এএফপি এক খবরে বলে, ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী। সেনারা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে। তরুণদের নিয়ে যাচ্ছে আটক করে। রাস্তায় মানুষ বিরল। অনেকেই শহর ছেড়ে গেছেন। যারা ঢাকা থেকে পালাতে চাইছে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড সামরিক হামলার মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। পশ্চিমা জেলাগুলোর প্রধান শহর-বন্দর পাকিস্তানি বাহিনী আজ দখলে নেয়। বহু বাঙালি সেনা ও কর্মকর্তা নিজেদের গুছিয়ে তোলার জন্য ভারতের সীমান্ত শহরগুলোতে আবার জমায়েত হয়েছেন।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা আবার সংগঠিত হতে চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক মহলে
নিউজিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জ্যাক মার্শাল এক বার্তায় এই আশা প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান গৃহযুদ্ধের অবসানের ব্যবস্থা করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল ও সিনেটর কেস যৌথভাবে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের জন্য ২১ নম্বর প্রস্তাব পেশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র অস্ত্র সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গত অক্টোবরের ব্যতিক্রম ছাড়া পাকিস্তানে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার গানশিপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ বিমান দিয়ে ১৪ এপ্রিল থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সেনা সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে গঙ্গাসাগর কেড়ে নিয়েছিল। এই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তাঁরা এলাকাটি পুনরুদ্ধার করেন।
আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল ভৈরব রেলসেতুর কাছে মেথিকান্দায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অবস্থানে বিমান ও কামান দিয়ে হামলা চালায়। দুই পক্ষে দিনব্যাপী প্রচণ্ড সংঘর্ষের পরে ১৫ এপ্রিল ভৈরবের পতন হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরবে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
বৃহত্তর রংপুরে মুক্তিবাহিনীর চারটি দলের প্রথমটি কাকিনায়, দ্বিতীয় দল পাটেশ্বরী ঘাটে, তৃতীয় দল পাটের ঘাটের কাছে রৌমারী সড়কে এবং চতুর্থ দল ফুলবাড়ি থানায় প্রতিরক্ষা নেয়।
এই দিন বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা ট্রাক ও জিপে করে গুলি করতে করতে ঝিনাইদহ শহরে প্রবেশ করে। আতঙ্কিত শহরবাসী আগেই শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল।
চট্টগ্রামের রাজাঘাট এলাকাও এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট এজাজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সীতাকুণ্ড এলাকায় নাজিরহাট থেকে কয়েক মাইল দূরে উদালিয়া চা-বাগানে ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। মিরসরাই যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে উদালিয়া চা-বাগানের কাছে আসে। দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিসেনারা উদালিয়া চা-বাগানের ঘাঁটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের চালচিত্র
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর ও খাজনা পরিশোধ করতে সবাইকে নির্দেশ দেয়।
চাকমা রাজা এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য (স্বতন্ত্র) ত্রিদিব রায়ের আহ্বানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল রাঙামাটি শহরে প্রবেশ করে।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদ তাদের ছাত্র-কর্মীদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খতমের নির্দেশ দেন।
ব্যস্ততা শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে (১৬ এপ্রিল ১৯৭১)
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে ১৬ এপ্রিল অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সন্ধ্যায় কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, পরের দিন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান রয়েছে। যাঁরা অনুষ্ঠানে যেতে চান, তাঁদের অবশ্যই ভোরে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাপনা করবে।
ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এই দিনে একটি প্রতিবাদপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে যে পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় নেমেছে। প্রতিবাদপত্রটি তিনি উপস্থিত বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন।
বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে ভারতের এক্সপ্লোরার ক্লাব গণস্বাক্ষর অভিযান করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পেশ করার জন্য প্রস্তাবিত এই দাবিনামায় চিত্রশিল্পী যামিনী রায় নিজে স্বাক্ষর করে গণস্বাক্ষর অভিযান উদ্বোধন করেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি শঙ্করপ্রসাদ মিত্র, বিচারপতি এস এ মাসুদ প্রমুখ এক আবেদনে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের নিন্দা জানান।
কলকাতায় সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় পাকিস্তানকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এন সেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মাওলানা আজাদ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিশনের পশ্চিমবঙ্গ মোতাওয়াল্লি সম্মেলনে মুসলমান নেতারা বাংলাদেশে ধর্মস্থান ও মসজিদের ওপর বোমাবর্ষণের প্রতিবাদ জানান। ভারতের ক্ষুদ্রশিল্প ফেডারেশন বাংলাদেশ তহবিলে সাহায্য দিতে পশ্চিমবঙ্গের সব ক্ষুদ্র শিল্পপতিকে আহ্বান জানায়। কলকাতার শিখ ধর্মাবলম্বীরাও পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে এই দিন বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু প্রবেশ করে।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। বিশ শতকে এটি একটি বিরল ধরনের মুক্তি আন্দোলন। এ আন্দোলনে মানুষের সমর্থন অকুণ্ঠ, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের অভাব প্রকট। অথচ কয়েকটি শহরে মুক্তিযোদ্ধারা এখনো প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে
খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নেতারা গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে জানান, শত্রু নিধনে তাঁরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করবেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় কারফিউর মেয়াদ ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শিথিল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের কুমিরায় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে সীতাকুণ্ড এসে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেছিলেন। অবস্থানটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এর গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। পাকিস্তানি সেনারা মিরসরাই যুদ্ধ শেষে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এগিয়ে আসে। গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে তারা দফায় দফায় হামলা চালায় এবং নৌবাহিনীর কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিসেনারাও পাল্টা আঘাত হানেন।
রাঙামাটির খাগড়া রেস্টহাউসেও পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানিদের কয়েকজন হতাহত হয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র পুনর্দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে দিনভর সংঘর্ষ চলে।
পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভবানীপুরের হাওয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং অনেকে আহত হন। পঞ্চগড় দখলের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার কর্তৃত্বও তারা নিয়ে নেয়।
কুমিল্লার গঙ্গাসাগর সেতুতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে প্রবল গুলিবিনিময় হয়। কুমিল্লা-ত্রিপুরা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা প্রতিহত করে। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কসবা সীমান্তে সারা দিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলে।
চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সদর দপ্তর সরিয়ে ভৈরব নদের অপর পারে ইছাখালী বিওপিতে স্থানান্তর করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভেড়ামারার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। ময়মনসিংহের দখল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে।
বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ মুজিবনগরে (১৭ এপ্রিল ১৯৭১)
নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে শপথ নেন। শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে, বেলা ১১টায়। বৈদ্যনাথতলা তখন মুক্তাঞ্চল। সেদিনই এলাকাটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। অজস্র দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দা শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সাংগঠনিক রূপ পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। উপরাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু আটক থাকায় উপরাষ্ট্রপতি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান।
নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম ঘোষণা করেন। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম আবদুর রবকে চিফ অব স্টাফ।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মুক্তিবাহিনীর দুটি প্লাটুন সামরিক অভিবাদন জানায়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ আবদুল মান্নান। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন শরিফ থেকে তিলাওয়াত করা হয়; শেষে জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশন করা হয়।
শপথ গ্রহণ শেষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম ঘোষণা করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সমবেত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন জাতি জন্ম নিল। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব শান্তিপূর্ণভাবে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায় করতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন যে রাষ্ট্রটির সূচনা হলো, পৃথিবীর কোনো শক্তি তা মুছে ফেলতে পারবে না।’
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে দীর্ঘ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আজ যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে, পাকিস্তান সরকার তার সত্যতা গোপন ও বিকৃত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ। এ সংগ্রাম আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম, জীবনমৃত্যুর সংগ্রাম। এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, অখণ্ড পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য মানুষের লাশের নিচে অখণ্ড পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। দুনিয়ার কোনো শক্তি এ নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক, ছোট–বড় সব রাষ্ট্রকেই স্বাগত জানাতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে জাতিসংঘে।
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, রাজনীতি ও মানবতার স্বার্থে জেনারেল ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত বৃহৎ শক্তিগুলোর। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন, তা বাঙালি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও অনুরূপ সমর্থন এ সরকার আশা করে।
বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে বাঙালির জাতীয় সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও নৈতিক সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, বিশ্বের আর কোনো জাতি বাঙালির মতো স্বীকৃতি লাভের দাবিদার হতে পারে না। কেননা আর কোনো জাতি এত কঠিন সংগ্রাম এবং ত্যাগ স্বীকার করেনি।
শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল (১৮ এপ্রিল ১৯৭১)
মেজর খালেদ মোশাররফের (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জ, উজানিসর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অ্যান্ডারসন খালের পাশে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৪ এপ্রিল স্থল, বিমান ও নৌ—তিন পথেই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। মোস্তফা কামাল ছিলেন গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দরুইন গ্রামে আলফা কোম্পানির ২ নম্বর প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকে মোস্তফা কামালদের অবস্থানের ওপরও তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু হয়। সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি। প্রচণ্ড আক্রমণ সামাল দিতে শাফায়াত জামিল সেখানে ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন পাঠান। সারা দিন যুদ্ধ চলে।
পরদিন সকালে বৃষ্টির মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা দরুইন গ্রামের কাছে পৌঁছায়। মুক্তিযোদ্ধারা দরুইন গ্রাম থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেও মোস্তফা কামাল থেকে গিয়ে বলেন, তাঁর তুলনায় সহযোদ্ধাদের অনেকের প্রাণের মূল্য বেশি।
মোস্তফা কামালের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তারা মরিয়া হয়ে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মোস্তফা কামালের গুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাংকারে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ দিয়ে সম্মান জানায়।
পিপিপির ভাষ্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগ আগেই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এ লক্ষ্যে কৌশল স্থির করেছিল।
তিনি বলেন, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানিরা কেন্দ্রের ক্ষমতা অবজ্ঞা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সার্বভৌম প্রধানরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য রাতারাতি নিজেদের প্রস্তুত করেছে। ১৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ শেখ মুজিব যখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করছেন, তখন ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিটি প্রতীক ধ্বংস করা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ পুরো শহরে সরকারি ও বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয় এবং শেখ মুজিব বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন নিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌম শাসক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। পরিস্থিতি পুরোপুরি শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ এপ্রিল ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৯ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশের ভেতরে
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান রাতে এক বেতার ভাষণ দেন। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে ভারতের দাসত্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। কেউ তাদের প্রশ্রয় দিলে বিপদে পড়বে।
সামরিক কর্তৃপক্ষও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতে নাগরিকদের প্রতি আবার নির্দেশ জারি করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়ায় এবং চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দিনভর দুই পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। রাঙামাটির কুতুবছড়িতে বেলা তিনটায় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছয়টি ট্রাকে অ্যামবুশ করেন। তাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দু-তিনটি গাড়ি ধ্বংস হয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আহ্বান
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী কাশীকান্ত মৈত্র এবং সিপিআই (এম) নেতা জ্যোতি বসু আলাদাভাবে বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি না দিলে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। জ্যোতি বসু স্বীকৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশকে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সাহায্যও দিতে বলেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, প্রিন্সিপাল পি কে বোস, ড. পুরবী বসু মল্লিক, বিচারপতি শঙ্করপ্রসাদ মিত্র, বিচারপতি এস এ মাসুদ এবং ড. রমা চৌধুরীসহ পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ১৩ জন বুদ্ধিজীবী শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে এদিন এক ঘোষণায় বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্য হাইকমিশন ২১ এপ্রিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিন উদ্যাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং মুম্বাইয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহকে আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা যায় না। অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টির সভাপতি এবং সাবেক এমপি এন সি চট্টোপাধ্যায় কেনেথ কিটিংয়ের সাহসী ও সুস্পষ্ট বক্তব্যকে স্বাগত জানান এবং সহমত পোষণ করেন।
পাকিস্তান উপহাইকমিশন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে শপথ নেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় কর্মরত পাকিস্তানের বাঙালি উপহাইকমিশনার হোসেন আলী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি একা নন, উপহাইকমিশনের আরও চারজন বাঙালি কর্মকর্তা এবং প্রায় ৬০ জন কর্মচারী আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসেন।
পাকিস্তান উপহাইকমিশনের বাঙালি কর্মীরা ৯ নম্বর পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউর কার্যালয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর উপহাইকমিশনের নামফলক সরিয়ে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মিশন’ নামফলক লাগানো হয়।
১৮ দফা নির্দেশ বাংলাদেশ সরকারের (১৯ এপ্রিল ১৯৭১)
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে ১৮ দফা নির্দেশনামা জারি করেন। তিনি সরকারের নির্দেশ মেনে কাজ করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
নির্দেশনার মধ্যে ছিল শত্রুকবলিত এলাকায় বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করা, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেওয়া, নৌ চলাচলসহ সব যোগাযোগে শত্রুকে অসহযোগিতা করা, গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা, শত্রুপক্ষের গতিবিধির খবর মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দেওয়া, মুক্তিবাহিনী ছাড়া কারও কাছে জ্বালানি বিক্রি না করা, শত্রুবাহিনীর বা আত্মসমর্পণকারী সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা ইত্যাদি।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন করাচিতে এক সভায় সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে আহ্বান জানান।
টাইম ম্যাগাজিন-এর এদিনের প্রচ্ছদকাহিনি ছিল ‘দ্য ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’ শিরোনামে কুষ্টিয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে কুষ্টিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জয় ছিল লেখাটির বিষয়বস্তু। লিখেছিলেন ড্যান কগিন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও মালিক মোহাম্মদ কাশেম এদিন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এদিন ঢাকা নগরীর বিভিন্ন মহল্লার শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ অফিসারদের নাম ঘোষণা করা হয়।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের বাঙালি সেনা, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-যুবকের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাবনার সাঁথিয়ায় পাইকরহাটি গ্রামের ডাববাগানে (বর্তমানে শহীদনগর) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী একটি দলকে প্রতিরোধ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাদের এই দলটি ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের
আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে পিছু হটে নগরবাড়ী ফিরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শহীদ হন ইপিআর হাবিলদার ইমদাদ উদ্দিন, নায়েক মফিজউদ্দিন, ল্যান্স নায়েক আতিয়ার রহমান, সালেহ আহমদ, সেপাই নূর উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। নেতৃত্ব দেন ইপিআরের সুবেদার গাজী আলী আকবর।
ডাববাগান থেকে পিছু হটে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি বাড়িয়ে রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড শক্তির কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিসেনারা পিছু হটে যান। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে শতাধিক নিরীহ মানুষকে। গ্রামবাসীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। একে একে পুড়িয়ে দেয় ডাববাগানের পাশের রামভদ্রবাটি, কোড়িয়াল, বড়গ্রাম, সাটিয়াকোলা গ্রাম।
সিলেটের সালুটিকর বিমানঘাঁটির দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর দিনভর ব্যাপক যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে বিমান হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
কুষ্টিয়ার দর্শনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি লড়াই হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ভারতে চলে যান। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী দর্শনায় ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি গণহত্যা চালায়।
“এপ্রিল মাস ১৯৭১ ৩”, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের এপ্রিল মাস , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
“এপ্রিল মাস ১৯৭১ ৩”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ – ধারাবাহিক পর্ব এপ্রিল ( ২০-৩০ ) ১৯৭১
প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচালেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ (২০ এপ্রিল ১৯৭১)

খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে এই দিনে নিজে প্রাণ দিয়ে বহু সহযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা ও রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে কাপ্তাই লেক তখন গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। কাপ্তাই-রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি-জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ে যাওয়ার এটিই পথ। এই জলপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেজর মীর শওকত আলীর (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সেনা সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই জলপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য খুবই তৎপর হয়ে ওঠে। ২০ এপ্রিল দুপুরে তাদের বড় একটি দল স্টিমার ও স্পিডবোটে করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে তীব্র হামলা চালায়। স্টিমার থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে আসা তীব্র গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ অপরিসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়ে মেশিনগান চালাতে থাকেন। খালেকুজ্জামানসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। পাকিস্তানি সেনাদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মুন্সী আব্দুর রউফের শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান নিয়ে বহু জায়গায় বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। সরকারি–বেসরকারি নানা স্থানে সে তারিখ কোথাও ৮, কোথাও ১৮ এপ্রিল। ১৯৭১ সালে মুন্সী আব্দুর রউফকে নিয়ে লেখা মুজিবনগর সরকারের অভিজ্ঞানপত্র (সাইটেশন) সম্প্রতি প্রথম আলোর হাতে এসেছে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, মীর শওকত আলী এবং চৌধুরী খালেকুজ্জামান স্বাক্ষরিত সে অভিজ্ঞানপত্রে মুন্সী আব্দুর রউফের শহীদ হওয়ার তারিখ ২০ এপ্রিল। যদিও নামের বানান তাতে ছিল মুন্সী আবদুর রব। কয়েক বছর পর সে ভুল সংশোধন করা হয়।
চৌধুরী খালেকুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘২০ (এপ্রিল) তারিখে মহালছড়ির বাঘমারা নামক একটি পাহাড়ি জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করি।…আনুমানিক দুপুর ১২টার সময় অনেক দূরে পাকিস্তানি পতাকাবাহী একটি স্টিমার, কয়েকটি স্পিডবোট এবং নৌকায় সাদা পোশাকে সামরিক এবং বেসামরিক লোক আমরা দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিহত করার জন্য তৈরি হই। …যুদ্ধের জন্য জায়গাটি মোটেও অনুকূলে ছিল না। …আমার দশ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন মুন্সী আবদুর রব (রউফ)। …তাঁর গুলিবর্ষণে শত্রুপক্ষের ভীষণ ক্ষতি হয় বলে পরবর্তী সময়ে জানা যায়। …তাদের মর্টার শেলিংয়ের ফলে আমাদের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রব মারাত্মক আহত হন। …মুন্সী আবদুর রব…নিহত হন। …আমি তাঁর সাইটেশন লিখি।’
সামরিক আদালতের নির্দেশ সৈয়দ নজরুলকে, তাজউদ্দীন
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিনে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও দ্য পিপল সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার ১ নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
নেজামে ইসলাম পার্টির নেতাসহ কয়েকজন ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা বলে উল্লেখ করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা যুদ্ধে দুই পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাস্তান নগরে সরে যান। মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী মাস্তান নগর ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করে। ভোররাতে মুক্তিবাহিনী হিংগুলিতে গিয়ে অবস্থান নেয়।
উত্তরবঙ্গের হিলিতেও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। একপর্যায়ে তারা অবস্থান ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়।
মোজাফফর ন্যাপের সমর্থন বাংলাদেশ সরকারকে
মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান।
ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে এই দিন একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি–সংক্রান্ত যুক্ত কমিটির সদস্য সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।
সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়োগ (২১ এপ্রিল ১৯৭১)

প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা শুরুর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার অধিবেশনে যোগ দিতে একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গিয়েছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ পান। তাতে বিচলিত হয়ে ১৫ মার্চ ঢাকায় প্রাদেশিক শিক্ষাসচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে, বিবিসিতে সে খবর শুনে ২৭ মার্চ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন আবু সাঈদ চৌধুরী। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সামনে ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে জানান, এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। দেশে-দেশে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতা-নির্মমতার কথা বিশ্ববাসীকে জানানোর ঘোষণা দেন।
নানা স্থানে যুদ্ধ
ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদের (পরে বীর বিক্রম, মেজর ও মন্ত্রী) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০ জনের একটি দল রাতে যশোরের নাভারনে পাকিস্তানি সেনাশিবিরে হামলা করে। পাকিস্তানিদের বেশ কয়েকজন এতে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আহত হন চারজন। ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সাংবাদিক এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। এ নিয়ে পরে তিনি ‘উইথ কমান্ডোজ ইনসাইড বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লেখেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মিরসরাই ও মস্তাননগরের পতনের পর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হিঙ্গুলি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই দিন পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে সেতুটি ধসিয়ে দেন। প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ার পর রাত সাড়ে তিনটায় দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় সেতুটি ধ্বংস হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী উত্তরবঙ্গের হিলি, পঞ্চগড় ও কিশোরগঞ্জের দখল নেয়। রাঙামাটির বন্দুকভাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী গোয়ালন্দ ঘাট দখল করে। তারা হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে ছত্রীসেনা নামায়।
ভেতরে-বাইরে পাকিস্তানের
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান করাচিতে বিবৃতি দিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া পাকিস্তান সরকারের আর কোনো বিকল্প ছিল না।
ঢাকায় সাবেক প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহমদ, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর এবং সাবেক স্বতন্ত্র এমপিএ আবদুল মতিন আলাদা পৃথক বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সবাইকে আহ্বান জানান।
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক বার্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান।
ভাসানীর আহ্বান বিশ্বনেতাদের প্রতি
ভাসানী ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তাঞ্চল থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, চীনের চেয়ারম্যান মাও সে-তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভসহ আলেক্সি কোসিগিন ও নিকোলাই পদগোর্নি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদু, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আরব লিগের মহাসচিব আবদেল খালেক হাসুনা এবং আরব ঐক্য সংস্থার মহাসচিব দায়লো তেলির কাছে পৃথক বার্তা পাঠান। এসব বার্তায় অবিলম্বে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য আবেদন জানান। এ ছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা অবলোকনের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সহযোগিতা দেওয়ার আবেদন করেন।
আইরিশ শ্রমিক দলের বৈদেশিক বিষয়ক কর্মকর্তা ড. কোনার ক্রুইজ এই দিনে লন্ডনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের নেওয়া ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ও দমনমূলক যুদ্ধের এক দৃষ্টান্ত।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহযোগিতা করতে ভারতের সব রাজ্যকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানায়। কলকাতায় বাংলাদেশের সমর্থনে লেখক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী ও সমাজসেবী সংঘের এক সমাবেশ হয়। এতে বক্তব্য দেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জয়নাল আবেদীন, বিচারমন্ত্রী অজিত পাঁজা, শিক্ষামন্ত্রী শান্তি দাশগুপ্ত, স্বায়ত্তশাসনমন্ত্রী মহম্মদ রউফ এবং রাষ্ট্রমন্ত্রী (পরিকল্পনা) রথীন তালুকদার। আলোচনা করেন প্রবোধকুমার সান্যাল, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, আশুতোষ ভট্টাচার্য, দক্ষিণারঞ্জন বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ, রঞ্জিত সেন প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন মনোজ বসু এবং স্বাগত ভাষণ দেন বিনয় সরকার।
অখণ্ডতা ও ধর্মের নামে বিরোধিতা (২২ এপ্রিল ১৯৭১)
ভাসানী ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অনুগত কতিপয় স্বার্থপর ব্যক্তি ধর্ম ও অখণ্ডতার নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছে। বাঙালির বিজয় অনিবার্য।
ভাসানী বলেন, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে অবজ্ঞা করে ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ করে রেখেছে। এই সংগ্রাম হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের সব শান্তিপ্রত্যাশী রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণকে তিনি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের ভেতরে
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়রুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা—তিন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এই দিন একযোগে ফেনী আক্রমণ করে। তিনটি আক্রমণই মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী দখল করতে ব্যর্থ হয়।
উত্তরাঞ্চলের হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তরেখার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা সে আক্রমণ প্রতিহত করেন।
এ রকম দু–একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছিল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোদাগাড়ীতে বিরাট কনভয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
নগরবাড়ী ঘাট হয়ে বাঘাবাড়ীতে এসে পাকিস্তানি সেনারা শাহজাদপুর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্বারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে বিফল হন। বাঘাবাড়ী ও শাহজাদপুরের পতন ঘটে।
এই দিন বগুড়া শহরেরও পতন হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বিনা বাধায় বগুড়ায় প্রবেশ করে।
রাজশাহী থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল নওগাঁয় ঢোকে। তাদের গুলিতে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। রাতে এখানে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
মাদারীপুর শহরে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বোমাবর্ষণ করে। আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম কমিটির কন্ট্রোল রুম মিলন সিনেমা হল। কেউ নিহত না হলেও বহু মানুষ আহত হয়।
ময়মনসিংহের মধুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা হালুয়াঘাটে পিছু হটেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঃ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিন
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকম্যাহোন ২২ এপ্রিল ক্যানবেরায় বলেন, বাংলাদেশে জীবনহানির জন্য তাঁরা বেদনার্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে তিনি বলেন, আর যেন কোনো জীবনহানি না হয় এবং পাকিস্তানের সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হোক।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ১০টি দেশের বুদ্ধিজীবীদের উত্থাপিত সম্মিলিত অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন দ্য ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি (আইসিইউই) সংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, রক্তাক্ত গণহত্যায় বিদ্যাচর্চাকারীদের জীবন ও মন তছনছ হয়ে গেছে। তাদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে। তাঁরা বলেন, ‘এই অবস্থায় আমরা চুপ করে থাকতে পারি না।’
ব্রিটিশ এমপির সঙ্গে মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ (২৩ এপ্রিল ১৯৭১)
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের সাংসদ ব্রুস ডগলাস–মানকে সাক্ষাৎ দেন। যশোরের বেনাপোলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে তাঁরা এক ঘণ্টা আলোচনা করেন।
খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বৃহত্তর দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ভারত সীমান্তসংলগ্ন বেনাপোল এলাকায় সমবেত হয়ে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন। তাজউদ্দীন আহমদ এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতরে ডগলাস-মানকে সাক্ষাৎ দেন।
বেনাপোলে তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতির খবর পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিরাট দল সেখানে দ্রুত এসে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটি ছিল ভারতের সীমান্তবর্তী কাগজপুকুর গ্রামে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ হয় কাগজপুকুরে। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যুদ্ধের পর পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানিদের প্রায় ৫০ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ১৬ জন। পাকিস্তানি বাহিনী রাতে দ্বিতীয় দফা হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সরে যান।
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় এই দিন লেবার পার্টির সদস্য এবং অর্থনৈতিক সাহায্যবিষয়ক কমিটির সাবেক সচিব পিটার সোর বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকারের আচরণ নীতিবহির্ভূত ও বন্য। লেবার পার্টিকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সব রকম অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দ্রুত বন্ধ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে অনুরোধ জানান।
পাকিস্তান সরকার এদিন কলকাতায় পাকিস্তানের উপহাইকমিশন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে একই সঙ্গে ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশন বন্ধ করে দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। কার্যত কলকাতায় পাকিস্তানের উপহাইকমিশনের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮ এপ্রিল কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের উপহাইকমিশনার হোসেন আলী তাঁর সব বাঙালি সহকর্মীকে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাদেশের ভেতরে
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, ময়মনসিংহ, জামালপুর, বগুড়া ও গাইবান্ধা এলাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সিলেট শহরে এই দিনে শান্তি কমিটির মিছিল বের করা হয়। মিছিলে লোকের তেমন উপস্থিতি ছিল না।
পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রামের হিঙ্গুলিতে এই দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। ২১ এপ্রিল রাতে হিঙ্গুলি সেতু ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা মস্তাননগর থেকে পিছু হটে হিঙ্গুলিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে হিঙ্গুলি সেতুর কাছাকাছি চলে আসে। বিধ্বস্ত সেতুর কাছে তারা থেমে যায়।
ক্যাপ্টেন অলি আহমদের (পরে বীর বিক্রম, কর্নেল, সাংসদ ও মন্ত্রী) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন ধরে হিঙ্গুলিতে যুদ্ধ করছিলেন। তাদের সহায়তা করতে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) একদল মুক্তিযোদ্ধাসহ হিঙ্গুলিতে আসেন।
২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্র না থাকায় পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি আর্টিলারি আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ২৩ এপ্রিল টিকে থাকতে পারলেও পরদিন তাঁরা অবস্থান ছেড়ে মহালছড়ি চলে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল রাঙামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে যাত্রা করে। পথে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হলে তাদের মহালছড়ি যাত্রা শ্লথ হয়ে যায়।
উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনারা লালমনিরহাট থেকে কুড়িগ্রামের দিকে এগোয়। পাকিস্তানিদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। নওগাঁয় বেশ কয়েকজন বাঙালি শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী লাকসামেও নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়।
ভারত করল পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার (২৪ এপ্রিল ১৯৭১)
পাকিস্তানি সেনারা ২৪ এপ্রিল সকালে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে বনগাঁয়ের কাছে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে মর্টার হামলা চালায়। কিছু গোলা ভারতীয় এলাকার ভেতরেও পড়ে। পরদিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়, ‘ভারতীয় সীমান্ত বনগাঁর কাছে শনিবার সকালে পাকিস্তানি গোলা এসে পড়েছে। তা ছাড়া এক কোম্পানি পাকফৌজ নিষিদ্ধ সীমার পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে এসে পেট্রাপোলে রেললাইনের কাছে অবস্থান নিয়ে শনিবার বিকেল চারটে থেকে এক ঘণ্টা ধরে ভারতীয় গ্রামগুলির ওপর গুলি চালায়।’
নয়াদিল্লি থেকে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারতীয় এলাকায় পাকিস্তানের কোনো সামরিক অভিযান সহ্য করা হবে না।
এ ছাড়া ভারতের বহির্বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাকিস্তান হাইকমিশনকে ঘটনার প্রতিবাদে কড়া নোট পাঠায়।
এদিন ভারতের মুম্বাইয়ে (তখন বোম্বে) বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষদের সাহায্য করা। কমিটির চেয়ারম্যান হরিশ মহীন্দ্র। ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদা রহমান ও শর্মিলা ঠাকুর।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয়, ভারতে চলে যাওয়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যাপকদের অন্তত ছয় মাসের জন্য ‘পরিদর্শক শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ দেবে।
পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট, বাঙালিপুর, টিয়রপাড়া ও মধুপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য বাছাইপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এই দিন ভারত–পাকিস্তান একটি ফ্ল্যাগ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পাকিস্তানিরা ভারতে আশ্রয় নেওয়া ইপিআরের সদস্যদের তাদের হাতে সমর্পণ করতে চাপ দেয়। ভারতের বিএসএফের কর্মকর্তারা বলেন, ইপিআর সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না।
ব্রিটিশ এমপি: পূর্ব পাকিস্তানে যে ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত জঘন্য
ব্রিটেনের কমনস সভার সদস্য উড্রো ওয়াট এদিন কমনস সভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটছে, তা অত্যন্ত জঘন্য। পাকিস্তানি নির্মমতার বিষয়টি জাতিসংঘে কেন ব্রিটিশ সরকার উপস্থাপন করছে না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
এদিন পাকিস্তানের সরকারের এক হ্যান্ডআউটে বলা হয়, নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররমসহ ঢাকা শহরে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ চলছে। সর্বত্র, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। ঢাকার মিরপুরে এক সভায় ২৫ সদস্যের শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির ১৮টি ইউনিট আহ্বায়কের নামও ঘোষণা করা হয়।
দেশের নানা স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই অব্যাহত থাকে। পূর্বাঞ্চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের করেরহাটে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করে তাদের গতি শ্লথ করে দেয়।
রাঙামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে আসা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় কুতুবছড়িতে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়।
মধ্যাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনারা মাদারীপুর শহরে ঢুকেই বিভিন্ন বাড়িতে আগুন দেয়
পাকিস্তানকে সাহায্য না করার আহ্বান (২৫ এপ্রিল ১৯৭১)
ক্তরাষ্ট্রের ১০ জন সিনেটর ২৫ এপ্রিল এক যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার জন্য আপৎকালীন ত্রাণকাজের ব্যবস্থা করেনি। আন্তর্জাতিক রেডক্রসকেও সেখানে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্য দেশগুলো ও জাতিসংঘের উচিত হবে পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ওয়াল্টার মন্ডেল, এডওয়ার্ড মাস্কি, হিউবার্ট হামফ্রে, বার্চ বে, জর্জ ম্যাকগভার্ন, ফ্রেড হ্যারিস, হ্যারল্ড হিউস, উইলিয়াম পক্সমায়ার, টমাস এগ্রেটন ও ক্লিফোর্ড কেস।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে তাঁর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়া আরশাদ হোসেন এই দিন মস্কো যাত্রা করেন। তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বার্তা নিয়ে যান।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ খ অঞ্চলকে (বাংলাদেশ) তিনটি সামরিক সেক্টর এবং ১০টি সাব-সেক্টরে ভাগ করে। সেক্টর তিনটি হচ্ছে ঢাকা, কুমিল্লা ও বগুড়া। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য জেলা ও মহকুমা সদরে শান্তি কমিটি গঠন করতে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিদের পাঠানোর ঘোষণা দেয়। রাজশাহীতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আফাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে জেলা শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
পাকিস্তানের জঙ্গি বিমান এই দিন বরিশালের ওপর অনবরত বোমাবর্ষণ করে। হেলিকপ্টারে করে সেখানে তারা ছত্রীসেনা নামায়। এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি দল বরিশালের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। একটি দল মুলাদীর দিক থেকে বরিশালের দিকে এগোয়। অন্য দুটি দল খুলনা ও ফরিদপুর থেকে অগ্রসর হয়। বরিশাল শহরের কয়েক মাইল উত্তরে জুনাহার নামে একটি জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এ সময় দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করতে সফল হননি। পাকিস্তানি সেনারা অবশেষে এই দিন বরিশাল শহর দখল করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দিন গোপালগঞ্জ শহরেও প্রবেশ করে। পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান এবং তাঁর সহযোগীদের সহায়তায় তারা গোপালগঞ্জের খেলার মাঠ (বর্তমানে স্টেডিয়াম), ঈদগাহ মাঠ ও কলেজে শিবির স্থাপন করে।
পাবনার কাশিনাথপুর ও উল্লাপাড়ার ঘাটনা সেতুতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দুই স্থানেই পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু চেষ্টা সফল হয়নি।
পাকিস্তানি বাহিনী নওগাঁর তিলকপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গড়ের হাটে আক্রমণ করে এবং এখানে ১৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তারা কুমরিয়া, জাফরাবাজ, লক্ষণপুর, মোহনপুর, হাপানিয়া, একডালা ও মাধাইমুরী গ্রামে আক্রমণ চালায়। কুমরিয়া, জাফরাবাজ ও মোহনপুরে ১১ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা। এ ছাড়া কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়।
দিনাজপুর-রাধিকাপুর সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের যুদ্ধ হয়।
চট্টগ্রামের করেরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। তুমুল যুদ্ধে করেরহাট প্রতিরক্ষাব্যূহের পতন হলে মুক্তিবাহিনী রামগড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়।
সিলেটের গোলাপগঞ্জেও মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক অবরোধের আহ্বান (২৬ এপ্রিল ১৯৭১)
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানকে সাহায্য ও ত্রাণসামগ্রী দেওয়া সম্পর্কে ২৬ এপ্রিল প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়। কমন্স সভার সদস্যরা সে বিতর্কে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রীকে নানা প্রশ্ন করেন।
কমন্স সভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময়ে যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড বলেন, পাকিস্তানকে যেসব দেশ সহায়তা করে থাকে, তাদের সঙ্গে সাহায্য দেওয়ার শর্ত নিয়ে আলোচনা করা হবে। জুলাই মাসের আগেই এ বৈঠক হবে। একজন এমপির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির ওপর সেখানে আরও সাহায্য দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রচেষ্টায় যোগ দিতে বলা হলে যুক্তরাজ্য সানন্দে তাতে রাজি হবে।
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাস–মান কলকাতা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবরোধও স্থাপন করা দরকার। ডগলাস–মান ভারত সীমান্ত থেকে দুই মাইল ভেতরে গিয়ে দুই ঘ ণ্টা ঘুরে বাংলাদেশের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আসেন।
নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ট্রেভর জে ইয়াং কলকাতা প্রেসক্লাবে আরেক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ওপর বিশ্বের সব জাতির পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করা এখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আগের দিন ট্রেভর ইয়াং ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
পাকিস্তান ঢাকার ভারতীয় মিশনের কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সন্দেহজনক আচরণ শুরু করলে ভারত এই দিন একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানকে জানায়, অনুমতি ছাড়া কোনো পাকিস্তানি ভারত ত্যাগ করতে পারবে না। এ আদেশ দিল্লি ও মুম্বাইয়ের পাকিস্তানি মিশনের কর্মচারী, তাঁদের পরিবার ও গৃহকর্মীদের ওপর প্রযোজ্য হবে।
কলকাতার পাকিস্তানি উপহাইকমিশনার হোসেন আলী পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণার পর পাকিস্তান মেহেদি মাসুদকে নতুন উপহাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ২৫ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে কলকাতায় বিক্ষোভ হয়।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চার শ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন ভারতের রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাড়িয়া। ভারতের রাজ্যসভার বিরোধী দলের নেতা এম এস গুরুপদস্বামী পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন সংগ্রহ এবং ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ইতিহাস সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দেওয়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২৯ এপ্রিল থেকে একটি প্রদর্শনীর ঘোষণা দেন।
‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’
টাইম ম্যাগাজিন–এর এই দিনের সংখ্যায় ‘পাকিস্তান: সীমান্তের দিকে চাপ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। তাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ শহর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অধিকাংশ গ্রামের দখল এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানকে কবজা করে রাখার সংকল্পে পাকিস্তান যতই অটল থাকুক, পরিস্থিতিদৃষ্টে সিদ্ধান্তে আসতে হয়, ‘শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
আরেক প্রখ্যাত ম্যাগাজিন নিউজউইকও গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে একাধিক খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় এবং সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ইতিহাস কিছু ভোলে না’ শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, শালগড়ে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবদুল ওহাবের (পরে বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালগড়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল এই দিনে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করে। পাকিস্তান বাহিনীর তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওহাব তাঁর কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম এইচ এ আবদুল গাফফারের (পরে বীর উত্তম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) সম্মতি নিয়ে আগের দিন ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এলাকায় যান। ২৬ এপ্রিল দুপুরে কৃষকের ছদ্মবেশে অ্যামবুশের জায়গা রেকি করেন। রাতে শালগড়ে অ্যামবুশ করেন। রাত ১২টার দিকে একটি পাকিস্তানি কনভয়ের প্রথম দিককার ৮-১০টি জিপ, পিকআপ ও ট্রাক এসে পৌঁছায়। গাড়িগুলো এলাকার ভেতরে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে হামলা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের খবরে জানা যায়, এ অভিযানে পাকিস্তানিদের দুটো গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং প্রায় ১৮টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ জনের মতো হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ খান মস্কোয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সঙ্গে মস্কোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জামশেদ মারকারও ছিলেন। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি এবং প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ইয়াহিয়ার কাছে পরপর দুটো চিঠি পাঠানোর পটভূমিতে আরশাদ খান সেখানে যান।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খান পূর্ব পাকিস্তানে পরবর্তী ব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য ঢাকায় আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এক আদেশে জানায়, কেউ যোগাযোগব্যবস্থা, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কোথাও ক্ষতি করা হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সবার বিরুদ্ধে গণহারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন আরও জানায়, সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলজুড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশ্বের উদ্বেগ গণহত্যা নিয়ে (২৭ এপ্রিল ১৯৭১)
যুক্তরাজ্যের এমপি জন স্টোনহাউস ২৭ এপ্রিল বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ঢাকায় ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যা করেছে, তা নিঃসন্দেহে গণহত্যা। নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোটার যে রায় দিয়েছেন, সামরিক জান্তা সেই গণতান্ত্রিক রায়কে কেবল প্রত্যাখ্যানই করেননি, তা ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছেন। এ ব্যাপারে সবার কর্তব্য রয়েছে। কারও নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত নয়।
ব্রিটেনের কমন্স সভায় পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম জানান, ১৯৬৭ সালের পর পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন কোনো অস্ত্র চুক্তি হয়নি।
সুইডেনের বিজ্ঞানী, লেখক ও রাজনীতিকেরা স্টকহোমে বৈঠকরত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা জাতিসংঘে উত্থাপনের আবেদন জানান।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ভারত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং তাদের ভূমি দখল করতে চায় না। তবে ভারতের ওপর কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে সমুচিত জবাব দেবে।
ভারতের সমাজবাদী দলের নেতা এস এম যোশী বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্র যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সে জন্য ভারতের অগ্রণী হওয়া উচিত। ভারত এগিয়ে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সাহায্য করলে তার ঐতিহ্য রক্ষা পেত।
কলকাতায় এই দিনেও পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ এড়াতে তিনি কলকাতা ছেড়ে শহরতলিতে পুলিশ বাহিনীর একটি ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেন। বিক্ষোভের ঢেউ সেখানেও গিয়ে পৌঁছায়।
বাংলাদেশের সমর্থনে নেপালে ছাত্ররা মিছিল করে সরকারের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। নেপাল ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের জাতীয় কমিটি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করতে বিবৃতি দেয়।
বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ
লন্ডনের ডেইলি মিরর পত্রিকার প্রথম পাতায় উড্রো ওয়াট বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাজ্যের নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে যাঁরা প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা করেন, তাঁরা আজ কোথায়? পরমাণু অস্ত্র বর্জনের জন্য যাঁরা দীর্ঘ মিছিল করেন, তাঁরাই-বা কোথায় লুকিয়ে আছেন? পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা এর চেয়ে অনেক ভয়ংকর।’
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ, কানাডার মন্ট্রিয়ল স্টার, ব্রাজিলের ও প্লোবো এবং মালয়েশিয়ার সারওয়াক ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকাতেও বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এদিন বলেন, কলকাতায় ৫০ জন পূর্ব পাকিস্তানি কূটনীতিক তথাকথিত বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের হাইকমিশন গঠন এবং কলকাতায় দায়িত্ব নেওয়া নতুন উপহাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কারণে ২৬ এপ্রিল থেকে কলকাতার পাকিস্তান মিশন এবং একই সঙ্গে ঢাকার ভারতীয় মিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ঘোষণা দেন, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী (ইপিসিএফ)।
বাঙালি কূটনীতিকের আনুগত্য যুক্তরাষ্ট্রে
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তারবার্তা পাঠান। এ এইচ মাহমুদ আলীকে পাকিস্তানে বদলি করা হলে তিনি আগের দিন পদত্যাগ করে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। এরপর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
এ ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার জানায়, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করায় তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
শহীদ বীর উত্তম আফতাবুল কাদের মহালছড়িতে
খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি রামগড়ে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি মহালছড়িতে যুদ্ধে যান। পাকিস্তানি কমান্ডোরা মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরেও ফেলে। পাকিস্তানি সেনাবেষ্টনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বেরিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে আফতাবুল কাদের গোলাগুলির মধ্যেই একটি কৌশলগত অবস্থানে ছুটে গিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি শহীদ হন।
প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। তবে তাঁরা আফতাবুল কাদেরের মরদেহ রামগড়ে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর বীর উত্তম উপাধিতে সম্মানিত করে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান (২৮ এপ্রিল ১৯৭১)
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারের গোপন কেন্দ্র থেকে ২৮ এপ্রিল এক বেতারবার্তায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানান। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য নিঃশর্তভাবে অর্থ ও অস্ত্র দিতেও তিনি আবেদন জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এদিন ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দেখা করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সম্পর্কে বিশ্বজনমত গঠনের ব্যাপারে কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শিগগির জাতিসংঘে যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিকামীদের একটি দল লন্ডন থেকে পদযাত্রা করবে এবং বিভিন্ন দেশের এমপিদের একটি প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের অবস্থা সরেজমিন জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গান্ধী ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রাধাকৃষ্ণ বলেন, ভারতের গান্ধীবাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। তিনি বলেন, ভারতীয় শান্তিকামী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযান শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে যুদ্ধ প্রতিরোধকারী লিগ, আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি, আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তি কনফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবরুদ্ধ
২৭ এপ্রিল থেকে সান্ধ্য আইনের মেয়াদ রাত সাড়ে ১০টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার মিরপুরে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালায়। সেনাদের সঙ্গে স্থানীয় অবাঙালিরা অংশ নেয়। বহু বাঙালিকে সেনারা ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের বেশির ভাগই আর ফিরে আসেননি।
পাকিস্তানি সেনারা মাধবপুরে তীব্র হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান ছেড়ে সিলেটের মনতলায় চলে যান। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। খালেদ ও শাহজাহান নামের দুজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।
বাংলাদেশের পক্ষে
ব্রিটেনের কমন্স সভার লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবির পরিদর্শন শেষে নিজ দেশে ফিরে যান। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসকেরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ—কেউ রেহাই পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।’
ডগলাসম্যান জানান, তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাত দফা সুপারিশ দেবেন। সুপারিশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য বন্ধ রাখার বিষয় থাকবে।
বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে এদিন বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের রক্তগঙ্গা বন্ধ করার জন্য বিশ্ব জনমত ও বিশ্বের সর্বত্র শান্তিকামী শক্তিগুলোকে অবিলম্বে তৎপর হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা করতেই হবে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি পাঠান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের সাহায্যকারী সংস্থাগুলো ভারতে যা পাঠিয়ে থাকে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেসব দেওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রশাসনিক প্রধানদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর ব্যাপারে কথা বলেন। তবে কী ধরনের সাহায্য পাঠানো হবে, তা বলেননি। বিশ্ব খাদ্য কার্যক্রম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা সাহায্য পাঠাবে বলে জানা যায়।
ভারতের মুসলমান নেতারা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার নিন্দা জানান। দিল্লিতে জুলফিকার আলী খান এমপি মুসলিম দেশ, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর নেতাদের বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আবেদন জানান। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুসলমান নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সাহায্যের আবেদন জানান।
কলকাতায় বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির পক্ষে সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক মণীন্দ্র রায়, নীরেন্দ্রনাথ রায় এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত আসা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির সম্পাদক বীণা ভৌমিক জানান, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে একটি মহিলা বিভাগ খোলা হয়েছে।
২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের চারটি ঘটনায় ৩৩ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত, অন্তত ৮ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে তিনটি নোট পাঠানো হয়।
পাকিস্তানি সেনারা এই দিনে যশোরের বয়রার কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মালিদা গ্রামে ঢুকে গুলি ছোড়ে। বিএসএফ পাল্টা গুলি ছুড়লে তারা পালিয়ে আসে।
রাজস্থান বিধানসভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তাব (২৯ এপ্রিল ১৯৭১)
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের বিধানসভার সরকার ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সদস্য ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেন। তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি দাবি জানান। বিধানসভার প্রস্তাবে অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ইয়াহিয়া খানের জুলুম থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করা হয়।
ভারতের নয়াদিল্লিতে সিপিআই নেতা হীরেন মুখার্জি বলেন, পূর্ববঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত লোকসভার অধিবেশন ডাকা প্রয়োজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ভারতে ঢুকে ভারতীয় নাগরিক হত্যা করছে, তখন কোনো সংসদীয় রাষ্ট্র সংসদ বন্ধ রাখতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি অজয় মুখোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং দুর্গত মানুষের প্রয়োজন ওষুধ, খাদ্য, বস্ত্র, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও অর্থ। এসব প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কয়েক শ বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের হোসেন আলীকে সংবর্ধনা জানাতে কলকাতায় আসেন। তাঁরা হাওড়া থেকে মিছিল করে সার্কাস অ্যাভিনিউর মিশনে আসেন। আঞ্জুমানে মহসিনিয়াত এই মিছিল ও সংবর্ধনার আয়োজন করে।
বাংলাদেশের সমর্থনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়।
পাকিস্তানি তৎপরতা
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি চিঠি পেয়েছেন। ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এ তথ্য জানালেও চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু বলেননি।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ১ মে থেকে ফুলবাড়িয়া ও শাহজাহানপুর রেল কলোনি এবং সচিবালয় এলাকায় বসবাসকারী লোকদের সরে যেতে নির্দেশ দেয়। আরেক ঘোষণায় শহরের সব দেয়াল থেকে রাজনৈতিক স্লোগান মুছে ফেলতে বলা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান গত দুই দিন ময়মনসিংহ, যশোর ও খুলনায় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ও স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন বলে এই দিন রেডিওর এক খবরে বলা হয়।
যশোর জেলার বয়রায় থাকা পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তের খুব কাছে থেকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে (বিএসএফ) লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় দুই পক্ষে অনেকক্ষণ পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনারা উত্তরাঞ্চলের হিলি সীমান্তেও ভারতীয় সীমানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে।
পাকিস্তানি সেনারা এদিন ভারতের সীমান্তসংলগ্ন রামগড়ের কাছে হেঁয়াকুতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। লড়াইয়ের প্রথম দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিকেলে দ্বিতীয় দফায় দুই ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিকনছড়ায় সরে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রামগড় দখলের জন্য শুভপুর, নারায়ণহাট ও করেরহাট এলাকা দিয়ে ত্রিমুখী অভিযান চালায়।
পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ লন্ডনে
লন্ডনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিরা বিক্ষোভ করেন। তাঁরা বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভকারীরা ‘খুনিরা ফিরে যাও, যুদ্ধ বন্ধ করো’—এ রকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট দল অনুষ্ঠানে পৌঁছানোর আগেই বিক্ষোভকারীরা সেখানে হাজির হন। ক্রিকেট দলের সদস্যরা পৌঁছানোর পর পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে জাতিসংঘের সাহায্য করার ব্যাপারটি পাকিস্তান সরকারের ওপর নির্ভর করে।