মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি বা কবে কি ঘটেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে। এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
মার্চ মাস ১৯৭১
এপ্রিল মাস ১৯৭১
মে মাস ১৯৭১
জুন মাস ১৯৭১
জুলাই মাস ১৯৭১
আগস্ট মাস ১৯৭১
সেপ্টেম্বর মাস ১৯৭১
অক্টোবর মাস ১৯৭১
নভেম্বর মাস ১৯৭১
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
৯ ডিসেম্বর – ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড
দিল্লিতে ৯ ডিসেম্বর রাতে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কী রণকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েক দিন আলাপ-আলোচনার পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি সামরিক যুদ্ধ কমান্ড গঠিত হয়েছে।
ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণায় আরও বলা হয়, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একযোগে কাজ করছে। এ চুক্তিতে দুই বাহিনীর সমঝোতার আইনগত ভিত্তি দেওয়া হলো। দুই বাহিনী পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। দায়িত্ব থাকবে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের অপসারণের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে বিদেশি বিমান নির্বিঘ্নে অবতরণের সুবিধা দিতে ভারত সম্মতি দেয়। এ জন্য ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকা বিমানবন্দরে কোনো আক্রমণ না চালাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দিল্লির সরকারি একটি সূত্র জানায়, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে তোলা প্রচারণার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে জোর চেষ্টা চালাতে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে শক্তিশালী করার জন্য পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এবং সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি পার্থসারথীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাউল প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংও নিউইয়র্ক যেতে পারেন।
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাঁচতে চাইলে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন
দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিশন। বাংলাদেশের পতাকা তুলে উদ্বোধন করেন মিশনপ্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ভারতকে কৃতজ্ঞতা জানান।
বাংলাদেশের জনগণের হাতে ধরা পড়া পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এদিন বাংলাদেশ সরকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, ধৃত পাকিস্তানিদের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করা হবে এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ লাখ বাঙালিকে নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে।
মুজিবনগরে এদিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার এদিন সেনানিবাস বাদে মুক্ত কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করে। ৯ মাস পর সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসে। বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে কুমিল্লায় এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ৯ মাস যাঁরা পাকিস্তানি বেয়নেটের মুখে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিবাহিনী পুলিশের দায়িত্ব নেয়।
ঢাকার দ্বারপ্রান্তে চূড়ান্ত লড়াই
বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই এ সময় রাজধানী ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। একটি দল ঢুকছে আশুগঞ্জ দিয়ে ভৈরব বাজার হয়ে। আশুগঞ্জে যুদ্ধে নতি স্বীকার করে মেঘনার বিরাট রেলসেতু ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়েছে। আরেকটা দল এগোচ্ছে দাউদকান্দির দিক দিয়ে।
সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়েছে। উত্তর দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এগোচ্ছেন জামালপুর হয়ে। পশ্চিমে যৌথ বাহিনী মধুমতীর তীরে। সেটি পেরোলেই পদ্মা। কুষ্টিয়ার দিক থেকে আরেকটি বাহিনী এগোচ্ছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে মিত্রবাহিনীর সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী। চূড়ান্ত লড়াই শুরুর প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর গানবোট পদ্মা ও মেঘনায়।
চুয়াডাঙ্গা ও চাঁদপুর শহরে এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ঝিনাইদহকে পাশ কাটিয়ে যৌথ বাহিনী পৌঁছে যায় কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠে। যৌথ বাহিনী এগিয়ে চলেছে রংপুরের দিকেও। দিনাজপুরে শহরের ১০ মাইল দূরে লড়াই চলছে। কুমিল্লার সন্নিহিত ময়নামতি পাকিস্তানি সেনাদের দখলে, কিন্তু তাদের পালানোর পথ রুদ্ধ। ঢাকার উত্তর-পূর্বে আশুগঞ্জ ফেরিঘাট যৌথ বাহিনীর দখলে। যৌথ বাহিনী খুলনার দিকে এগোচ্ছে। যৌথ বাহিনী জামালপুর ঘিরে রেখেছে। পতন যেকোনো মুহূর্তে।
১০ ডিসেম্বর – ভারতকে চীনের প্রচ্ছন্ন হুমকি
চীন ১০ ডিসেম্বর ভারতকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতির আবেদন মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলে, তা না হলে ভারতকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হবে। বেইজিং বেতার থেকে খবরটি প্রচার করা হয়। চীনের সরকারি মুখপত্র পিপলস ডেইলিতেও এক সংবাদভাষ্যে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বিশ্বের মতামত উপেক্ষা করে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকলে তার পরিণতি লজ্জাকর পরাজয়। পত্রিকাটি বলে, চীন পাকিস্তানের সংগ্রাম দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
সোভিয়েত বার্তা সংস্থা তাস-এর এক প্রতিবেদনে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে একপেশে বলে ভারতবিরোধী বলে উল্লেখ করা হয়।
শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন
বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর গানবোটগুলো মংলা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছায়। এ সময় আকাশে দেখা যায় তিনটি জঙ্গি বিমান। শত্রুবিমান ভেবে মো. রুহুল আমিন সহযোদ্ধাদের সেগুলো প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। তাঁদের বহরে থাকা একটি ভারতীয় গানবোট থেকে জানানো হয়, ওগুলো ভারতীয় বিমান।
বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। আগেই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কেউ কেউ অক্ষত থাকেন। রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। বোমার স্প্লিন্টার লেগে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এক সহযোদ্ধা তাঁকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন।
আহত রুহুল আমিন কোনোমতে সাঁতার কেটে নদীর পুব পারে পৌঁছান। সেখানে ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও অনেক রাজাকার। তারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। নদীর তীরে পড়ে থাকে তাঁর বিক্ষত মরদেহ। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা নদীর তীরের একটি স্থানে তাঁকে সমাহিত করেন।
চূড়ান্ত যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নোয়াখালী শহর উদ্ধার করে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর শহর পতনের মুখে।
ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলা কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। জামালপুরে বিকেল চারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে পাঠিয়ে উত্তর দেয়, অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করেন।
ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
ঢাকায় তৎপরতা
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের একটি প্রস্তাব তাঁর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী খানের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা হয়। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্ত ছিল এ রকম:
১. পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে;
২. বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হবে না;
৩. প্রায় এক লাখ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে;
৪. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; এবং
৫. জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে অধিকৃত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি পরিকল্পনার সূচনা হয়।
১১ ডিসেম্বর – মুক্তাঞ্চলে সরকারের প্রথম জনসভা
যশোর সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল চারটি হলো মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে পৌঁছালে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায় বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন: ১. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। ২. ফেলে যাওয়া জমি ও দোকান ২৫ মার্চের আগের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চাষ হয়ে থাকলে চাষি বর্গাদার হিসেবে অর্ধেক ফলন পাবেন। ৩. যেকোনো ধর্মের যেকোনো নাগরিকের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর সাজা দেওয়া হবে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে তাঁর দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী এবং অন্য দল ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একযোগে স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করে তোলার নির্দেশ দেন।
চীন যুদ্ধে জড়াবে না
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বেইজিংয়ের কূটনৈতিক মহল বলছে, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারত আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সিনেটর ফ্র্যাংক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য পাকিস্তান অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের আবেদন
জাতিসংঘের একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশে নিয়োজিত একদল জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছেন।
তাঁরা বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমের ফরাসি প্রধান পল মার্ক অঁরির মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চান। অঁরি জাতিসংঘের মহাসচিবকে বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি মহাসচিবকে এ বার্তা গ্রাহ্য না করার অনুরোধ জানান।
কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং করপোরেশন জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনুরোধে কান না দিতে ইয়াহিয়া খানের বার্তা এলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা, ঢাকা জানান, পূর্ববঙ্গের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্য জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা নিয়ে ইয়াহিয়া খান আপত্তি জানিয়েছেন।
ঢাকায় চারদিক যৌথ বাহিনী কার্যত ঘিরে ফেলেছে। আকাশ ও জলপথে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ। বহু জায়গায় আত্মসমর্পণের পালা শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে ৬০০, লাকসামে ৪৫০ এবং মেঘনার পুবে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৮০০ পাকিস্তানি যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ এক বেতার ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় এখন শুধু অপেক্ষা
যৌথ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, জামালপুর ও ময়মনসিংহের পতনের পর ঢাকার সংকট ঘনীভূত। উত্তর–পূর্বে যৌথ বাহিনী মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকা অভিমুখী। অপেক্ষা এখন যৌথ বাহিনীর ঢাকা দখলের লড়াইয়ের।
যৌথ বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে রাতে তুমুল যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া শহর মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী ঝিনাইদহ থেকে ট্যাংক নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর ফাঁদে পড়েছিল। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এরপর ভারতীয় বিমানের হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহতদের ফেলে সকালে পালিয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর একাংশের গার্ডার ধ্বংস করে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ২০০ জন শহীদ হন।
যশোর থেকে ঢাকা অভিমুখী যৌথ বাহিনী মাগুরা শহর পেরিয়ে মধুমতি নদীর তীরে পৌঁছে যায়। নদীর ওপারে পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গেড়ে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। খুলনা অঞ্চলে যৌথ বাহিনী এদিন খুলনা জেলা শহরের ১০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
যৌথ বাহিনীর আরেক অংশ ভৈরব বাজারের দক্ষিণে সড়কপথ ধরে এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী লাকসামে ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও একটি বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
ময়মনসিংহ, জামালপুর, নোয়াখালী, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, দুর্গাদিঘি প্রভৃতি স্থান এদিন মুক্ত হয়। ভোরের আগেই পাকিস্তানি সেনারা ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে যায়। মুক্ত হয় ময়মনসিংহ শহর। পালানোর সময় পাকিস্তানিরা শম্ভুগঞ্জ সেতু ধ্বংস করে। চাঁদপুরের মতলব এদিন মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা বেশির ভাগ স্থানেই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা হয় পালিয়ে যায়, নয় আত্মসমর্পণ করে। গত ২৪ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণ করে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা।
ঢাকা থেকে এদিন বিদেশি নাগরিকদের অপসারণের কথা থাকলেও পাকিস্তানিদের বাধার মুখে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। আগে থেকে কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ দুটি ব্রিটিশ ও একটি কানাডীয় বিমানকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামতে দেয়নি। এ সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ বন্ধ রেখেছিল।
চীন যুদ্ধে জড়াবে না
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বেইজিংয়ের কূটনৈতিক মহল বলছে, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারত আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সিনেটর ফ্র্যাংক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য পাকিস্তান অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
১২ ডিসেম্বর – ঢাকা দখলের লড়াই
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত।
আগের দিন ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা ঢাকার আশপাশে মুক্ত কিছু এলাকায় নেমে পড়েন। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলছিল।
ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। ঢাকা মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে।
আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমশ ঢাকার দিকে আগুয়ান। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা।
হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলেও মোটেই রুখতে পারেনি।
যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার উপকণ্ঠে পৌঁছায়। হিলি থেকে এগিয়ে তারা বগুড়া শহর থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থান নেয়।
বগুড়ার পতন আসন্ন। চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় সেনানিবাস ও শহরের আশপাশে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে।
কক্সবাজারে ধ্বংস হয় একটি গানবোট ও দুটি জাহাজ। রাঙামাটিতে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনারা মিয়ানমারের দিকে পালাতে থাকে।
নুরুল আমিনের তৎপরতা
নুরুল আমিন এদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।
উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীন সরকারকে জানাতে তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান।
নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।
ইন্দিরার সাবধানবাণী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক জনসভায় চলমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি যেন কাজে লাগানোর চেষ্টা না করা হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এদিন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে আপসরফা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছেন।
দিল্লি ও মুজিবনগরের সূত্রগুলো এদিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
নিক্সনের অপচেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এদিন পাকিস্তানের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান।
যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন বৈঠক ডাকারও অনুরোধ জানান। নিক্সন নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে বলেন, এই লড়াই থামানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
পূর্ব বাংলা ভারতীয় সেনারা প্রায় দখল করে নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারতের এই আক্রমণ জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপরই আক্রমণ।
বিষয়টি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে আনার জন্য নিক্সন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন।
আজ সকালে তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করে সে অনুযায়ীই অগ্রসর হচ্ছেন।
এদিন রাতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের জোরালো দাবির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন জানিয়েছিল।
অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ১৩ ডিসেম্বর আবার বৈঠক শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা এদিন নিউইয়র্কে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে ভারত অস্ত্র সংবরণে রাজি হতে পারে।
নিউইয়র্কে সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলে এবং ভারতীয় এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনা সরিয়ে নিলে ভারত যুদ্ধবিরতি এবং সেনা অপসারণের প্রস্তাব বিবেচনা করবে।
যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের হাইড পার্কে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালি এক সমাবেশে বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করেন।
সমাবেশে বক্তব্য দেন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রেজাউল করিম, লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোর ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতা আসহাব-উল হক জোয়ারদার।
সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা বিরাট মিছিল নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করতেও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়।
পরদিন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই মিছিলকে ‘বিজয় সমারোহ’ বলে অভিহিত করা হয়।
লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী হলে ইন্ডিয়া লিগ আয়োজিত এক সভায় লেবার পার্টির সাবেক মন্ত্রী পিটার শোর বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং ব্যবহারিক সাহায্য দিতে যুক্তরাজ্যের তৈরি থাকা উচিত।
১৩ ডিসেম্বর – সপ্তম নৌবহরের যাত্রায় চাঞ্চল্য
ভারত মহাসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর রওনা হওয়ার খবর জানাজানি হলে দিল্লি ও মুজিবনগরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা ১৩ ডিসেম্বর জানান, সপ্তম নৌবহরের পরমাণুশক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ আরও কয়েকটি জাহাজ, ডেস্ট্রয়ারসহ ১০ ডিসেম্বর সায়গনের দরিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
হংকং উপসাগরে এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে কর্তব্যরত বিমানবাহী জাহাজ কন্সটেলেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এন্টারপ্রাইজ এবং তার সহযোগী সব জাহাজকে সিঙ্গাপুরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এন্টারপ্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী জাহাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ড ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অপসারণের ব্যাপারে তাঁর দেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এন্টারপ্রাইজের ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করার খবরটি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। ঢাকায় আটকে পড়া কয়েক শ নাগরিককে উদ্ধার করার জন্য এই শক্তি প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয়। সপ্তম নৌবহর যাত্রা করে থাকলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্যই তা করা হচ্ছে।
আবার সোভিয়েত ভেটো
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দিনের শেষে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও রাতে সেই বিতর্ক শুরু এবং এদিন আরেকটি মার্কিন প্রস্তাবের সমাধি ঘটে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তাবটি আনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
ভেটো প্রয়োগের আগে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্ক শুরু হওয়ার পরপরই ইয়াকব মালিক বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংও একই অনুরোধ করেন। এতে আপত্তি জানিয়ে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি বলেন, এ ধরনের কাজে বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি হবে এবং বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এরপর ইয়াকব মালিকের অনুরোধ নাকচ করে দেন নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি।
নিউইয়র্ক টাইমস ওয়াশিংটন থেকে আরেক খবরে জানায়, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সাহায্যার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানোর অনুমতি তৃতীয় দেশকে দিতে পারেন। খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সম্প্রতি ইরান, তুরস্ক, জর্ডান, সৌদি আরব ও লিবিয়ার কাছ থেকে অবিলম্বে অস্ত্রাদি চেয়েছে।
প্রথম চারটি দেশে বিপুল মার্কিন অস্ত্র মজুত আছে। কংগ্রেসকে না জানিয়েই প্রেসিডেন্ট এই অস্ত্র হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারেন। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র অবশ্য এভাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের কথা অস্বীকার করেন।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং ভারতের সমস্যা উপলব্ধি না করায় জাতিসংঘের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ এবং অন্য দেশগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা না করলে উপমহাদেশের ঘটনা গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
পাল্টা সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ
নিউইয়র্ক টাইমস ওই খবরে ওয়াশিংটনের একটি খবর উদ্ধৃত করে আরও বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তি জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারত মহাসাগরে একটি রাশিয়ান নৌবহর সমবেত হয়েছে। প্রায় এক ডজন যুদ্ধজাহাজ এবং আণবিক শক্তিচালিত ১০টি সাবমেরিন এ নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে
ঢাকায় তিন দিক থেকে বেষ্টিত দখলদার পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কামানের আওতায় চলে আসে। ভারতের ছত্রী বাহিনী সুসংগঠিত। মুক্তি বাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান যোদ্ধারা নরসিংদী পেরিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে।
আরেক দল টাঙ্গাইল-মির্জাপুর হয়ে ঢাকার কাছে। তাঁরা এদিন জয়দেবপুর মুক্ত করেন। চাঁদপুরের দিক থেকে আসা যৌথ বাহিনী মেঘনা পেরিয়ে দাউদকান্দিতে। তারা শীতলক্ষ্যা নদী পেরোনোর চেষ্টা করছে। যমুনা নদীর বাধাও অতিক্রান্ত। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানান, ভারতীয় সেনারা ঢাকা থেকে মাত্র ১১ থেকে ১২ মাইল দূরে।
ইয়াহিয়ার মনোবল চাঙা করার চেষ্টা
মুজিবনগরে একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় সুনিশ্চিত বুঝতে পেরে রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে আদেশ দিয়েছেন, তাদের একাংশ যেন এখনই বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। ওয়াশিংটন মস্কোকে আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে এটাও চায় না যে পাকিস্তান ভেঙে পড়ুক।
এদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে শত্রুমুক্ত জেলাগুলোয় অবিলম্বে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১৪ ডিসেম্বর – বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন আলবদর বাহিনীর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।
২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সূচনা। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখকে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে দৈহিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এ ধরনের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ কয়েকটি এলাকায়। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়।
ঢাকা অভিমুখে সাঁড়াশি অভিযান
মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢাকায় অগ্রসর হয়। একটি বড় দল ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতী নদী অতিক্রম করে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছানোর জন্য দলের দুটি ব্রিগেড পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান এড়িয়ে দুই ভাগে নদী পার হয়।
যৌথ বাহিনীর একটি ব্রিগেড মানিকগঞ্জকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে সাভারের দিকে এগিয়ে আসে। আরেক দল ঢাকার উত্তর দিকে তুরাগ নদের পারে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। পশ্চিম-উত্তর সীমানা বরাবর চন্দ্রা-সাভার-মিরপুর অঞ্চল ধরে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথ বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড।
ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ডেমরায় যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরোধব্যূহে আঘাত হানে। আরেকটি দল শীতলক্ষ্যা পার হয়ে রূপগঞ্জ মুক্ত করে।
মুক্তি বাহিনীর কে ফোর্সের অধিকাংশ দল মুড়াপাড়া পৌঁছে যায়। শীতলক্ষ্যা পার হয়ে তারা বালু নদের পারে অবস্থান নেয়।
হেলিকপ্টারে করে যৌথ বাহিনী গোমতী নদী পার হয়ে মেঘনাতীরবর্তী বৈদ্যেরবাজারে অবস্থান নেয়।
যৌথ বাহিনী কুমিরা অতিক্রম করে চট্টগ্রামের পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছায়। ভারতীয় রণতরি থেকে বিমান এসে চট্টগ্রামে আক্রমণ চালায়। কক্সবাজারেও হামলা চলে। পাকিস্তানি সেনাদের জলপথে পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
উত্তরাঞ্চলের বগুড়ায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তর ও সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। যৌথ বাহিনী বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যৌথ বাহিনীর ট্যাংক আস্তে আস্তে শহরে এগোয়। পাকিস্তানি সেনারা শহরে অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়
যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের নতুন সূত্র
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের জন্য এদিন নতুন প্রস্তাব তোলে। পরিষদের সভাপতি বলেন, বিকেলের আগে অধিবেশন শুরু হবে না। তারপরও ঢাকার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালাতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের ছয় থেকে সাতটি জাহাজ মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে যায়।
ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনাকালে সদস্যরা এ নিয়ে সরকারকে ভীত না হওয়ার পরামর্শ দেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু আজোরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে বৈঠককালে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি ঠিক নয়।
মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর দীর্ঘ আলোচনা করেন।
মালিকসহ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ
ঢাকার প্রতিরক্ষাবেষ্টনী যৌথ বাহিনীর চাপে ভাঙতে শুরু করলে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন।
এর আগে সকালে গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) মালিক মন্ত্রিসভা ও প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শুরু হয়। খবর পেয়ে ভারতীয় তিনটি জঙ্গি বিমান সেখানে হামলা চালায়। মালিক দৌড়ে এয়ার রেইড শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই পদত্যাগপত্র লেখেন। এরপর তাঁর পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস-ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।
নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের সাতজন নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা সাহায্য করতে সামান্য বিলম্ব করলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর’র আগে পাঠানো বার্তার জবাবে দুপুরের পরে আসা এক বার্তায় ইয়াহিয়া খান যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দেন। নিয়াজি সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লেখেন।
শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার যুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৩ ডিসেম্বর রাতে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে মহানন্দা নদী পেরিয়ে অবস্থান নেন রেহাইচরে।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরদের অবস্থানের অদূরেই ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত প্রতিরক্ষা। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে আক্রমণ চালান। কোনো ফল না হওয়ায় তিনি মরিয়া হয়ে ক্রল করে একটি বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। বাংকারে ছিল পাকিস্তানিদের এলএমজি পোস্ট। গ্রেনেড ছুড়ে বাংকারটি ধ্বংস করতে তিনি সেটির কাছে পৌঁছান। কিন্তু আরেক বাংকারে থাকা পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখে গুলি ছোড়ে। গুলিটি কপালে লাগলে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ উদ্ধার করে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করেন।
১৫ ডিসেম্বর – মানেকশর নির্দেশ, নিয়াজির আরজি
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বাট ডি স্পিভাকের মাধ্যমে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যুদ্ধবিরতির আরজি পাঠান। নিয়াজির বার্তায় সাক্ষী হিসেবে সই করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেটি ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশের কাছে পাঠায়। জেনারেল মানেকশ সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁর উত্তরে মানেকশ যুদ্ধবিরতির বদলে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি জানান, বিমানবাহিনীর আক্রমণ বন্ধ থাকলেও স্থলবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান চলবে। সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে আবার বিমান হামলা শুরু হবে। তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
ঢাকার উপকণ্ঠে যৌথ বাহিনী
মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন ঢাকার দুই মাইলের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনভর পাল্টা জবাব দেয়। মেঘনার দক্ষিণ তীরে দাউদকান্দি থেকে যৌথ বাহিনী নদী পেরিয়ে এসে চারদিক থেকে ঢাকা নগরীকে এঁটে ধরে।
মুক্তিবাহিনী সাভার মুক্ত করলে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে এসে ঢাকার প্রবেশপথ মিরপুর সেতুতে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। রাতে ভারতীয় বাহিনী সাভার থেকে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল থেকে আসা একটি দল পথে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। দিবাগত রাত দুইটার দিকে মীরপুর সেতুর কাছে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়। তারা সেতু দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ওপাশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে।
ঢাকার বাসাবোতে মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। যৌথ বাহিনীর আরেক দল চট্টগ্রামের পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে এসে পৌঁছায়।
আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বিকেলে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে।
সপ্তম নৌবহর মোকাবিলায় সোভিয়েত রণতরি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৫ ডিসেম্বর পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের একাংশ বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়। বহরে ছিল আক্রমণক্ষম হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ ত্রিপোলিসহ কয়েকটি রণতরি। ত্রিপোলিতে ছিল ২৩টি হেলিকপ্টার, অন্য জাহাজে ছিল ডেস্ট্রয়ার এবং উপকূলে অবতরণের উপযোগী জলযান।
সপ্তম নৌবহরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এদিন ২০টি সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা বলেন, ৯ ডিসেম্বর জাপানের দক্ষিণতম প্রান্ত এবং কোরিয়া উপদ্বীপের মধ্যবর্তী সুসিমা প্রণালির ভেতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত ফ্রিগেড এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণক্ষম ডুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরে রওনা দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরি ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিলে সপ্তম নৌবহর তার দিক পরিবর্তন করে।
ভারতের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, প্রথমে বলা হয়েছিল মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতে নৌবহর আসছে। তবে এখন বলা হচ্ছে, রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিদের অপসারণের জন্যই ওই নৌবহর আসছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর নাটক
পাকিস্তানের কোয়ালিশন সরকারের সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান ও জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন নাটকীয়ভাবে সব কয়টি খসড়া প্রস্তাব ছিঁড়ে সদলবল নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যান। এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।
আগের দিন নিরাপত্তা পরিষদের স্বল্পস্থায়ী এক বৈঠকে পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশ দিতেও বলা হয়।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জেনেভা থেকে বিবৃতিতে জানায়, লড়াইয়ে অংশ নেননি, এমন যে কারও ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে।
বাংলাদেশ সরকার একতরফাভাবে ঘোষণা করে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য না হলেও এর সনদ এবং জেনেভা চুক্তিকে সম্মান দেবে। মানবিক অধিকারসংবলিত সনদকেও বাংলাদেশ পূর্ণ মর্যাদা দিচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর – মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধে বহুপ্রত্যাশিত বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনতা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম দেয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের। হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঢাকায় আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
এর আগে নিয়াজির নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনী ভোর পাঁচটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু করে। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশনাল অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে নিয়ে একটি সামরিক জিপ ঢাকার মিরপুর সেতুর কাছে এসে থামে।
নিয়াজির জন্য নাগরার বার্তা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জিপে রওনা দেন ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন সেনা কর্মকর্তা। বার্তাটিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’
এর আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়।
বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন। নিয়াজির প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে নাগরা নিয়াজির অফিসে পৌঁছান। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর বিদেশি বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর হাজার হাজার মানুষ মুক্তির উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকায় বেলা ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বত্র আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধাদের।
বেলা একটার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ, অন্য পক্ষে জ্যাকব ও নাগরা। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর দিতে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল, একাত্তরের ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিকেল পৌনে চারটায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও পরাজিত সেনারা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল চারটা। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের এক পাশে দুটি চেয়ার। অরোরা বসেন ডান দিকের চেয়ারে, বাঁয়ে নিয়াজি। অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজিকে। নিয়াজির কাছে কলম ছিল না। ভারতীয় এক কর্মকর্তা তাঁর কলম এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।
ঢাকা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাঠানো এক খবরে বলা হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার সময় নিয়াজি অশ্রুসিক্ত ছিলেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, তাঁদের সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
‘ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী’
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো নিয়ে উত্তেজনা – ডিসেম্বর ০১
নিউইয়র্কে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা ১ ডিসেম্বর জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য পাকিস্তানের অনুরোধটি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের জন্য পাঠিয়েছেন। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, উ থান্টের অনুরোধে তাঁর কাছে লেখা ইয়াহিয়ার চিঠির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, এটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের রক্ষা করার অপপ্রয়াস। কারণ, ইয়াহিয়া খান যখন সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সবাই নীরব দর্শক হয়ে ছিল।
রাজনৈতিক মীমাংসা তিরোহিত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে বলেন, মুক্তিবাহিনী যশোরের দোরগোড়ায়। যশোরের পতন হলে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়তিনির্ধারক পথে মোড় নেবে।
ভারত সরকারের একটি সূত্র জানায়, ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা নিক্সনের চিঠির কারণে রাজনৈতিক মীমাংসার অবশিষ্ট সুযোগ শেষ। কারণ, চিঠিটি ইসলামাবাদের একগুঁয়ে মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাবটিকে দিল্লির রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘকে জড়ানোর কৌশল বলে ভাবছেন। এর পেছনে তারা ওয়াশিংটনের হাত আছে বলে মনে করছে।
মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন শমশেরনগর শহর ও তৎসংলগ্ন বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রংপুরের কুড়িগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাগেশ্বরীর দখল নিয়ে নেয়। এরপর তাঁরা ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রাম দখলের জন্য লড়াই চালাতে থাকে। পঞ্চগড়ের বোদায় তুমুল যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
খুলনার কালীগঞ্জ মুক্ত
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সাংসদ ফণীভূষণ মজুমদার, তোফায়েল আহমেদসহ বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব কে এ জামান ও পুলিশের আইজি আবদুল খালেক এদিন মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির ঢাকা অফিসে বিস্ফোরণ ঘটান।
শান্তিবাগে গেরিলাদের অভিযানে মুসলিম লীগের দুজন নেতা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
বিদেশি গণমাধ্যমের মন্তব্য
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান-এর এক সংবাদে এদিন বলা হয়, ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও জাতিসংঘের ১৩১ সদস্যদেশের একটিও এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ঢাকা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন আরও একজন উপাচার্য, আওয়ামী লীগের আটজন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং দুজন রাষ্ট্রদূত।
দ্য টাইমস ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এক খবরে বলে, ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন পূর্ণ স্বাধীনতা। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের এ মনোভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী রিচার্ড উড লন্ডনে বলেন, তাঁর ধারণা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। তবে তারা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।
সংবাদ সংস্থা এবিসির হংকং ব্যুরোর প্রধান বাংলাদেশ থেকে এক প্রতিবেদনে জানান, কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা শহরের কাছে এক গ্রামে নির্বিচার প্রায় ৭৫ জন নরনারীকে হত্যা করে। কারণ, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তিনি নিজেও পরে ঘটনাটি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা যত্রতত্র গ্রামবাসীদের হত্যা করছে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জিনজিরার লোকেরা সংবাদদাতাকে জানান, ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যা থেকে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৮৭ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অগণিত মৃতদেহ।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা রুখতেই পর্যবেক্ষক
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে চায়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন ব্যবস্থা নিতে চায়। ভারতকে আক্রমণকারী বললে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে পাঠানো এক নোটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নোটটি কবে পাঠানো হয়েছে তা বলা হয়নি।
মুজিবনগরে একটি সূত্র জানায়, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অবশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান সম্প্রতি বদলি হয়ে ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের রিয়াজ রহমানই একমাত্র কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
মুক্তিবাহিনী এদিন যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের আরও কয়েকটি থানা দখল করে। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে সরে গিয়ে যশোর ও মাগুরা শহরের দিকে সমবেত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেন। সাতক্ষীরা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভোমরা-সাতক্ষীরা সড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এদিন তুমুল যুদ্ধ হয়। সাতক্ষীরা শহর মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে ঘিরে রাখেন। কুষ্টিয়ার জীবননগরের উত্তর-পূর্বে আবদুলবাড়িয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে। চুয়াডাঙ্গার দখল নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত। দামুড়হুদার কাছে এবং দর্শনাতেও যুদ্ধ চলমান।
৬ নম্বর সেক্টরে রংপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী দখল করে এগিয়ে এসে লালমনিরহাট বিমানবন্দরটিকে ঘিরে একে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
ভারতীয় সেনা-সহায়তায় মুক্তিবাহিনী দিনাজপুরের বালুরঘাট-হিলি সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। বেলা একটা থেকে পাকিস্তানি সেনারা ভারতের ভেতরে গোলাবর্ষণ শুরু করে। তার পাল্টা জবাবও আসতে থাকে। পাকিস্তানি গোলা থামিয়ে দেওয়ার জন্য যৌথ বাহিনী হিলি সীমান্তের দিকে এগিয়ে যায়। হিলিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের তারা উত্তর দিকে ঘিরে ফেলে। বাসুদেবপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বিতাড়িত হয়। হিলির দক্ষিণে যৌথ বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী মুখোমুখি থাকে।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযান চালান। তাঁদের অভিযানে বন্দরের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েকটি বোমা বিস্ফোরিত হলে সেখানকার পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতির শিকার হয়। একটি পেট্রলপাম্পও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারে শমসেরনগর বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে যান। এ অঞ্চলে ক্যাপ্টেন আবদুর রবের নেতৃত্বে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর সদস্যরা আগের দিন কানাইঘাট দখলের অভিযান শুরু করেছিলেন। ভোর সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা লক্ষ্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সড়কের ওপর পাকিস্তানিদের একটি টহল দলের প্রতি-আক্রমণ সামলে নিয়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অবস্থানের ৫০০ গজের ভেতরে পৌঁছে যান।
অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সব দল তাদের ফর্মিং-আপ প্লেসে পৌঁছে যায়। জায়গাটি ছিল বেশ নিচু। সেখানে পৌঁছেই ক্যাপ্টেন রব উপলব্ধি করেন, দিনের আলোতে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষায় আঘাত করলে তাঁদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। তিনি সেক্টর অধিনায়ক মেজর সি আর দত্তের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি ক্যাপ্টেন রবকে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে এসে তাঁদের এক দিনের পূর্ণ বিশ্রাম দেন। বিশ্রামের পর চাঙা হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পরদিন কানাইঘাট দখলের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হন।
বগুড়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী সারিয়াকান্দি থানায় ২২ জনকে খতম করে। ২ জন পাকিস্তানি সেনা পালাতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা রুখতেই পর্যবেক্ষক – ২ ডিসেম্বর
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে চায়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন ব্যবস্থা নিতে চায়। ভারতকে আক্রমণকারী বললে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে পাঠানো এক নোটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নোটটি কবে পাঠানো হয়েছে তা বলা হয়নি।
মুজিবনগরে একটি সূত্র জানায়, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অবশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান সম্প্রতি বদলি হয়ে ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের রিয়াজ রহমানই একমাত্র কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
পাকিস্তানের আক্রমণ, সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা – ৩ ডিসেম্বর
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ভারতে একতরফা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এই দিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের পাকিস্তানি অবস্থানগুলো ঘিরে ফেলার জন্য সীমান্তের সাতটি এলাকা দিয়ে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে।
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রাসহ সাতটি স্থানে অতর্কিতে একযোগে হামলা চালায়। এরপর রাত আটটায় জম্মু ও কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছামব ও পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী স্থলে ও আকাশে আক্রমণ শুরু করায় ৩ ডিসেম্বর থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা হয়।
ইন্দিরার বেতার ভাষণ
ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু করার সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। রাতেই দিল্লিতে ফিরে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাতে বেতার ভাষণে বলেন, এই যুদ্ধ বাংলাদেশের এবং একই সঙ্গে ভারতের। ভারতবাসীকে তিনি দীর্ঘ কৃচ্ছ্রতা ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের কাছে তিনি একটি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ বন্ধ করার সমাধান চেয়েছিলেন। এ জনগোষ্ঠীর একমাত্র অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটদান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
ফরাসি যুবকের বিমান ছিনতাই
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে ৩ ডিসেম্বর সকালে জঁ ক্যা নামে এক ফরাসি যুবক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বোয়িং-৭২০ বিমানটি ৩ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে যাত্রা করে। প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে এটির করাচি যাওয়ার কথা ছিল।
প্যারিস থেকে এটিতে পাঁচজন যাত্রী ওঠেন। নিরাপত্তাব্যূহ পেরিয়ে তাঁদের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যাও বিমানটিতে উঠে বসেন। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পাইলট বিমান চালু করতেই জঁ ক্যা পিস্তল বের করে তাঁকে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্দেশ না মানলে বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধরত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দেওয়ার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি হাজির হয়। চারজন পুলিশ গাড়ির স্বেচ্ছাসেবকের পোশাকে বিমানে ঢুকে রাত আটটায় জঁ ক্যাকে আটক করেন। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর বক্তব্যে অনুপ্রাণিত জঁ ক্যা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার উপায় খুঁজতে গিয়ে জুন মাসে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিলো ফ্লাইটের সফল অভিযান
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা ভারতের কৈলাস বিমানঘাঁটি থেকে ৩ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান চালান। রাত ২টায় ৩০০ ফুট উঁচুতে উড়ে শামসুল আলম (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও আকরাম আহমদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি বিমান চট্টগ্রাম তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেয়। আবার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে সুলতান মাহমুদ ((স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও বদরুল আলমের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি হেলিকপ্টার।
সিলেটে ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে কানাইঘাটের পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে সকাল সাতটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। সাড়ে আটটায় কানাইঘাট মুক্ত হয়। যুদ্ধে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।
৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার শমশেরনগরও মুক্ত করেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ঠাকুরগাঁও শহর দখল করেন। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁওয়ে আশ্রয় নেয়। ৩০ নভেম্বর সেনারা ভুল্লি সেতু উড়িয়ে দেয়। যৌথ বাহিনী সেতু সংস্কার করে ১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরের কাছে পৌঁছে যায়। ২ ডিসেম্বর রাতে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। সকালে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করেন।
যেকোনো সময় স্বীকৃতি
মুজিবনগর, কলকাতা ও দিল্লিতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভারত যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে এবং একই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ কারণে তিনি ডেনমার্কে চলমান সফর সংক্ষিপ্ত করতে পারেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পুরো ক্ষমতা দাবির শর্তে অসামরিক যৌথ মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে তিনি রাজি আছেন।
নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক- ৪ ডিসেম্বর
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকতে ৪ ডিসেম্বর উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ জরুরি বৈঠক ডাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিয়নের রাষ্ট্রদূত ইসমাইল টেলর কামারাকে চিঠি দেয়।
চিঠিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়া। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পরিষদের সভাপতির কাছে বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক প্রতিবেদনে নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ডেনমার্ক সফররত সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সংঘর্ষ এড়াতে তাঁরা সাধ্যমতো সব চেষ্টা করেছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করে এ সংকট ডেকে আনা হয়েছে। ডেনিস সংবাদ সংস্থা তাঁর এক সফরসঙ্গীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে জানায়, এ যুদ্ধে এখনই হস্তক্ষেপ করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে না।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণই লক্ষ্য
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণই তাঁদের লক্ষ্য। ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার স্থাপনে সহায়তা করতে চায়।
দিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিশেষ অধিবেশনে জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছে। তারা বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বড় ফাটল ধরিয়েছে। কয়েকটি শহরের পতন হয়েছে।
চীন-ভারত সীমান্তের পূর্ব বা পশ্চিমে চীনা সেনা সমাবেশের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণশীল মনোভাবের অভিযোগ এনেছে চীন। ভারতকে সমর্থন জানানোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করে চীন। একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
যুদ্ধ ঘোষণার পরে
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন ছিলেন মুক্তাঞ্চলে।
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের প্রথম দিনই মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চারদিক থেকে যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা দখল এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের যুদ্ধেই বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অর্ধেকের বেশি বিমান এদিন বিধ্বস্ত হয়।
২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার দেবীদ্বার মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী দেবীদ্বারসহ কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেছিল। ভারতের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় অভিযান চলে। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংকবহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানিরা রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে চার ঘণ্টা লড়াই করে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দর্শনার ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে তারা পিছু হটে গেলে ৪ ডিসেম্বর দর্শনা শহর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী এই সেক্টরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার জীবননগরও মুক্ত করে। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেলে জীবননগর চূড়ান্তভাবে মুক্ত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী মুক্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ফুলবাড়ীর বেতদিঘী, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রানী, আমড়া ও রানীনগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে শহরের পশ্চিম পাশে ছোট যমুনা নদীর ওপর লোহার সেতুর পূর্ব অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে শালচূড়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। আহমদনগর হেডকোয়ার্টারের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাতেই ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শক্রমুক্ত হয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে পতাকা ওড়ান।
১১ নম্বর সেক্টরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কামালপুর সীমান্তঘাঁটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৩ ডিসেম্বর কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। বকশীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) সে চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যান। চিঠি পেয়ে ক্যাম্পের অধিনায়ক আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। বশীরের ফিরতে দেরি হওয়ায় আরেকটি চিঠি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জুকে পাঠানো হয়। অবশেষে বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবিসহ ১৬২ জন সেনার একটি দল ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। শত্রুমুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সোভিয়েত ভেটো – ৫ ডিসেম্বর – ৫ ডিসেম্বর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় বাংলাদেশসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
এই প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ প্রস্তাবটি পেশ করে বলেন, এ সমস্যা সমাধানে পরিষদ বলপ্রয়োগের নীতি নিতে পারে না।
সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য বলে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব আনেন।
সে প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার আগে বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের অত্যাচার বন্ধের দাবিও তোলা হয়।
সোভিয়েত বলে, অবস্থার অবনতির কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার।
বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব করে। তীব্র আপত্তি জানিয়ে চীনা প্রতিনিধি বলেন, এতে জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে।
ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বিষয়টি যথাযথ পটভূমিতে বিবেচনা করতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।
পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, পাকিস্তানকে টুকরো টুকরো করতে ভারত পাকিস্তানে হামলা করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে ভোট দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি, আর চীন ভোটে অংশ নেয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরি অধিবেশন বসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি রাষ্ট্রের অনুরোধে। স্থির হয় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা বিতর্কে অংশ নিলেও তাঁদের ভোটাধিকার থাকবে না।
চীন তাদের খসড়া প্রস্তাবে বলে, পাকিস্তানি এলাকা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে হবে।
পাকিস্তানকেও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রস্তাবে ভারতীয় আক্রমণ রুখতে সংগ্রামে লিপ্ত পাকিস্তানি জনগণকে সমর্থন করতে সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব নিয়ে সোভিয়েত ও চীনের প্রতিনিধির মধ্যে বাগ্যুদ্ধ হয়। চীনের প্রতিনিধি বলেন, এ প্রস্তাব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সমতুল্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এদিন বিশ্বশক্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। সতর্কবাণীতে বলা হয়, সোভিয়েত সীমান্তের কাছে যে অবস্থা চলছে, তাতে তাদের নিরাপত্তা-স্বার্থ জড়িত। তারা এতে উদাসীন থাকতে পারে না।
চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সানডে টাইমস পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ওয়াশিংটনে তাঁর প্রধান সহকর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁরা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের সোভিয়েত ভেটোর নানা দিক বিচার করেন।
ওয়াশিংটন থেকে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র এদিন এক সরকারি বিবরণ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, উইলিয়াম রজার্স তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করেছেন।
তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে একটি স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সত্যের অপলাপ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত।
বাংলাদেশের আকাশ মুক্ত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এদিন ভারতীয় বাহিনীর বিমানগুলো ঢাকাসহ বাংলাদেশের আকাশ দখল করে নেয়। সেগুলো আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ঢাকার তেজগাঁওসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটি ও বন্দর অচল করে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে।
ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা-রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর-রাজশাহীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ অটুট ছিল।
একটি বড় যুদ্ধ হয় লাকসামে, আরেকটি ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুই লড়াইয়েই পাকিস্তানি বাহিনী বিধ্বস্ত অবস্থায় পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। পাকিস্তানি বাহিনী একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে।
কিছু পাকিস্তানি সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালায়। এখানে প্রায় ১৬০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত হয়।
সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলোফ্লাইট এদিন সিলেট অঞ্চলে বোমা ফেলে কয়েকটি পাকিস্তানি বাংকার উড়িয়ে দেয়। জামালপুরে বিমান হামলায় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
বাংলাদেশের সত্তা স্বাধীন
ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, একটি আলাদা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ভারত স্বীকার করে নিয়েছে।
এখন বাকি আছে শুধু সরকারের স্বীকৃতি। শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এর জবাব পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশকে ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি – ৬ ডিসেম্বর
বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সংসদে এ ঘোষণা দেন।
পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে চিঠি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা দেন, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে বলেন, বিরাট বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের মন পড়ে রয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে।’
পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
স্বীকৃতির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডকেও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শাহীন সামাদ, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলা মোমেন, শারমিন মুরশিদ প্রমুখ শিল্পী ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেন।
আবার সোভিয়েত ভেটো
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করে।
প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে।
রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়।
জর্জ বুশ ভারতকে পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের তৃতীয় ভেটো – ৭ ডিসেম্বর
পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক বলেন, শান্তির জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার নীতির ভিত্তিতেই এই প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তদনুসারে প্রস্তাবটি অবিলম্বে বিচার করে দেখতে হবে। ভারতের প্রস্তাবটি তিনি ভোটে দিতে চাইলে ভারত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ যুদ্ধের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত একটা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি থাকে। আবার অধিবেশন শুরু হলে বর্তমান বিরোধের মানবিক দিক সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট একটি বিবৃতি পেশ করেন।
এরপর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি, বিপক্ষে ১১টি। ১০টি রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। কয়েকটি দেশ অনুপস্থিত থাকে। সাধারণ পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩১।
ভারতের আক্রমণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে চীন আরেকটি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি প্রস্তাব আনে। কোনোটিই ভোটে দেওয়া হয়নি।
এর আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই মর্মে দাবি জানায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণ নিয়ে আনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হলে তা বলবৎ করা যাবে না।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা শুরু হয়। আর্জেন্টিনা প্রস্তাব উত্থাপন করে দুই দেশকে অস্ত্র সংবরণ করে সীমান্তের দুই দিকে তাদের সেনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলে।
নিরাপত্তা পরিষদেও অনুরূপ প্রস্তাব তোলা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিলে প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের প্রস্তাবে বলা হয়, বিষয়টি সাধারণ পরিষদের বিচার্য হতে পারে কি না, সেটা পরিষদের কার্য পরিচালনা কমিটিতে তা বিচার করে দেখতে বলা হোক।
যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যশোর-সিলেট
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত যশোরের এদিন পতন হয়। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরাও মুক্ত হয়। পতন হয় সিলেটেরও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।
যৌথ বাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। বয়রা ও বেনাপোল থেকেও যৌথ বাহিনী যশোরের দিকে এগোয়। ততক্ষণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা যশোর থেকে পালিয়েছে। শ দুয়েক সেনা ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করে।
ঝিনাইদহ ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ঢাকার দিকে, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার দিকে।
সিলেটের পতন হয় যশোরের কিছুক্ষণ পর। যৌথ বাহিনী প্রথমে শালুটিকর বিমানবন্দর দখল করে। সেখানে যৌথ বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর চারদিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তান সেনারা পিছু হটে মেঘনা নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়।
এদিন আরও মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা, শেরপুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, বাগেরহাটের মোংলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দিরাই।
ভুটানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র সংবাদটি প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।
ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান, তিনি কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। এর প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রধান নুরুল আমিন। সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।
চীনের প্রতি সোভিয়েত সতর্কবাণী
পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভাষণে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ডাক দেন। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, তিনি বাইরের শক্তি বলতে চীনকেই বুঝিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা কলকাতা থেকে পাঠানো এক খবরে বলেন, ভারতীয় সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন, অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করাই তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাঁর বক্তব্য প্রচারপত্র হিসেবে পাকিস্তান সেনা-অধ্যুষিত এলাকায় বিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেন, ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য দুনিয়ায় সমস্ত দেশের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী দেশগুলোর কাছে আবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসভবনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ জাতীয় পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সুচিত্রা মিত্র ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গান। বক্তব্য দেন অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।
মুজিবনগরে একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে স্থির হয়েছে, ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ সরকার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর জঙ্গিশাহির নির্যাতন এবং ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার চীনের সরকারি নীতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে, তারাই একেবারে চুপ করে আছে, এটি বড়ই দুঃখের বিষয়।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানবে না ভারত – ৮ ডিসেম্বর
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র ৮ ডিসেম্বর বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কোনো চাপের মুখেই ভারত মানবে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত একটি বৈধ সরকার বলে মনে করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বৈঠকে সবাই একমত হন যে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে কোনো যুদ্ধবিরতি মানা সম্ভব নয়।
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন নতুন কোনো প্রস্তাব করেছিলেন বলে ভারতের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশকে ভারত বারবার বলেছে, রাজনৈতিক সমাধান করার একমাত্র উপায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচিত সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁকে আলোচনা করতে দেওয়া।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে দেশটির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সহকারী প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্কের পথে রওনা দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের অনুরোধে এদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহিও উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন। উ থান্ট ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানান। জাতিসংঘের লোকজন ও বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য দুই দেশের সরকারকেও অনুরোধ জানানো হয়।
মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা এদিনও অব্যাহত থাকে। বিমানঘাঁটিসহ কুমিল্লা শহর এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনামুক্ত। মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এদিন শুরু হয় ময়নামতি সেনানিবাস দখলের লড়াই। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা এখন স্বাধীন। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ করা হয়। চট্টগ্রামের রামগড় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।
যশোর শহর থেকে যৌথ বাহিনী চতুর্মুখী অভিযান চালায়। একটি দল ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা দখল করে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসংযোগ মুক্তিবাহিনীর অধিকারে আসে। যৌথ বাহিনীর তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সেনারা মাগুরা থেকে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যায়।
যশোর থেকে একটি দল এগোয় নড়াইলের দিকে। আরেকটি দল সাতক্ষীরা ও কলারোয়া দখল করে। যশোর-কালীগঞ্জ খণ্ডে খুলনার পথে লেবুতলা যৌথ বাহিনীর দখলে। কুষ্টিয়া এখনো অবরুদ্ধ।
পদ্মার উত্তর তীরে রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে মুক্তিবাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজশাহী ও পাবনার সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাটের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। চুয়াডাঙ্গা অবরুদ্ধ। মেহেরপুর মুক্ত করে যৌথ বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় গোলাবর্ষণ করে। খুলনা শহরে গোলাবর্ষণ অব্যাহত। ঝিনাইদহের কাছে পিছু হটার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি সেতু ধ্বংস করে যায়। এখানে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে রংপুর শহরের পতন আসন্ন। পীরগঞ্জ এখন মুক্ত। সৈয়দপুরের উত্তরে একটি পাকিস্তানি ঘাঁটি যৌথ বাহিনীর দখলে।
রাতের মধ্যে মুক্ত হয় সিলেটের শ্রীমঙ্গল, রংপুর-দিনাজপুরের দুর্গাপুর ও বাদুড়িয়া এবং যশোর-খুলনার রূপদিয়া ও লেবুতলা।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ জন সেনা এদিন মুজিবনগরে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী তাঁদের স্বাগত জানান। এই সেনারা লাহোরে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় চারজন কর্মকর্তাসহ ওই সেনারা অস্ত্রশস্ত্রসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এদিন মুক্ত কুমিল্লা পরিদর্শন করেন। সকালে যৌথ বাহিনী বিমানবন্দরসহ কুমিল্লা শহর দখল করে।
অরোরা বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা লাগিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছালে জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। ভারতীয় বাহিনীর পদস্থ কোনো কর্মকর্তা হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফর করলেন।
বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের কাছে এক ধন্যবাদ বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ-ভুটান বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেন, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন। ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রজ্ঞায় বাঙালি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি অন্ধতার পরিচায়ক। চীনও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
২৮ নভেম্বর – নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে বিতর্ক
মুজিবনগরে একটি মহল ২৮ নভেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমা কিছু দেশ তৎপর। ভারত উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার যে প্রস্তাব তুলতে চায়, তাতে ইতালি যোগ দিয়েছে। জাপানকেও তারা টানতে চাইছে। কিন্তু জাপান চায়, বৃহৎ শক্তিরা নেপথ্যে তৎপর হয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুক।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সমস্যার অজুহাতে বৃহৎ শক্তিদের অথবা নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ানোর চেষ্টা করা হলে তারা বিরোধিতা করবে। তারা বারবার বলেছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং এর দুই পক্ষ হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য কয়েকটি দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সপ্তাহব্যাপী মুক্তাঞ্চল সফর শেষে মুজিবনগরে ফিরে বলেন, তিনি সেখানে প্রশাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগের তালিকা কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্সের ছোটখেল এলাকায় এদিন জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানির কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধা ভোরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করেন। প্রথাগত যুদ্ধের নিয়মে আক্রমণে তিন গুণ যোদ্ধা প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সতীর্থদের লাশ ফেলে দ্রুত রাধানগরের দিকে চলে যায়।
সকালে পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) আহত হন। পাকিস্তানিদের উপর্যুপরি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবের কয়েকটি স্থান ও জয়পুরে দেওয়া ভাষণে বলেন, কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এর আগে ভারত তিনবার পাকিস্তানের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবে বলেনি যে ভারত আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কাছে সুবিচার আশা করা যায় না।
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য জ্যোতি বসু কানপুরে বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তাঁর দল সরকারকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাবে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন। পূর্ব বাংলার বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জ্যোতি বসু চীনের এই অভিমতের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ কলকাতায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে পূর্ব বাংলায় যা চলছে, তাতে পাকিস্তান সেটিকে হারাতে বাধ্য হবে। পাকিস্তানের উভয় অংশের ঐক্য আর কল্পনাও করা যায় না। শরণার্থীরা জন্মভূমিতে ফিরে গেলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
পশ্চিমা মনোভাবের নিন্দা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মনোভাবের তীব্র নিন্দা করে। প্রাভদার অভিযোগ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার উপেক্ষা করে পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে। প্রাভদায় আরও বলা হয়, পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং সংরক্ষিত সেনাবাহিনীকে তলব করে গোটা পরিস্থিতি জটিলতর করে তোলা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্সের খবরে এদিন বলা হয়, পাকিস্তানকে তার স্বীকৃত অন্যায় থেকে বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তানকে এক কোঠায় ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আবার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভারত, পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে অভিন্ন বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে; পূর্ব বাংলায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনা সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে এবং সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সেনা সরিয়ে নিতে হবে।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন আবার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। গত তিন দিনে এ নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া দুবার বৈঠক হয়। ভুট্টো জানান, প্রেসিডেন্ট তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ অবহিত করেছেন।
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র এদিন প্রথমবারের মতো স্বীকার করে। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে বলে একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন। যদিও পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের গণযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না বলে সেই মুখপাত্র মন্তব্য করেন।
২৯ নভেম্বর – ইন্দিরাকে নিক্সনের বার্তায় প্রতিক্রিয়া
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ২৯ নভেম্বর সকালে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি দেন। নিক্সন ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানকে চিঠিতে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনকেও নিক্সন এক চিঠিতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়েছেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর দিল্লি সংবাদদাতার খবরে বলা হয়, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো প্রস্তাব করা হয়নি বলে নিক্সনের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান উপেক্ষা করা হবে বলে ধারণা করা হয়।
ভারত সরকারের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানই প্রথম সেনাসমাবেশ শুরু করেছে বলে দিল্লি তার মনোভাব বদলায়নি। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বেলজিয়ামের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার প্রস্তাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও দ্বিধায়। প্রস্তাবের ব্যাপারে ভারত বেলজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
দিল্লি থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর বিশেষ সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বেলজিয়ামের প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, পরিষদের অধিবেশনে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
পাশ্চাত্যের দেশ সফরকালে ইন্দিরা বলেছেন, উপমহাদেশের বর্তমান সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে লাভ নেই। পাকিস্তান এ পর্যন্ত তিনবার ভারত আক্রমণ করলেও নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্ট ভাষায় তা কখনো বলেনি।
রাধানগরের যুদ্ধ
সিলেটের রাধানগরে দুপুর থেকে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা ও আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সদস্যসহ রাধানগরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ করার কথা ছিল। তা না হওয়ায় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) তাঁর কোম্পানি এবং আলফা ও গণবাহিনী সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ করেন। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে যায়।
রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা ছোটখেলে তীব্র আক্রমণ করে বসে। প্রবল আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণের পর রাত ১২টায় পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগরের দিকে এগিয়ে যান। রেডিও পাকিস্তান রাতের খবরে রাধানগর কমপ্লেক্সের পতনের কথা স্বীকার করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের ভারত সীমান্তবর্তী সামরিক গুরুত্বপূর্ণ নাভারন মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোয় আক্রমণ করে একটু একটু করে এগোতে থাকেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান এদিন পূর্ব পাকিস্তানে ভারত সীমান্ত বরাবর পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে নোট পাঠায়। ইয়াহিয়া খান স্বাক্ষরিত নোটটি সকালে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির হাতে দেন।
পাকিস্তানে সফররত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান ওলেকজাস রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বলেন, প্রয়োজনে তুরস্ক পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।
অধিকৃত বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে শেখ মুজিবকে মার্জনা করতে তারা এক তারবার্তায় ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়। বিচার সম্পকে৴ কমিশন পাকিস্তানকে কিছু প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট উত্তর দিতে বলে।
পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সংসদে নীতিসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে কি না, তা এখনো ঠিক হয়নি।
জাতিসংঘের একটি সূত্র জানায়, ভারত বা পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ না জানালে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসার সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লিয়েন আলবেনিয়া সফরকালে এক অনুষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তান-ভারত বিরোধ মীমাংসা করার আহ্বান জানান।
৩০ নভেম্বর – ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস: ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩০ নভেম্বর শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে সেনা ফিরিয়ে নিতে বলেন। তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফর নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শেষে ইন্দিরা প্রস্তাবটি দেন। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস। ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের তাঁরা নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারেন না।
ইন্দিরাকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক চিঠি নিয়ে এদিন মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে আলোচনা হয়। নিক্সনের যুক্তি খণ্ডন করে দ্রুত চিঠির জবাব পাঠানো হবে।
চিঠিতে নিক্সন অভিযোগ করেছেন, সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাসের প্রস্তাবে ভারত অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। নিক্সন ভারতকে সংযত হতে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিতে বলেন।
রাতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ববঙ্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে
জাপানের টোকিও রেডিওতে বলা হয়, চীন পাকিস্তানকে আবার অস্ত্র দিতে শুরু করেছে। বেইজিং থেকে তারা এ খবর পেয়েছে। পিকিং থেকে পাকিস্তানে সামরিক বিমান সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে এদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দুটো দাবিই নাকচ করে দেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনার জন্য পূর্ববঙ্গের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিনকে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর রণকৌশলে বদল
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এখন রণকৌশল পাল্টেছেন। হিট অ্যান্ড রান বা আক্রমণ করেই ফিরে আসার কৌশল ছেড়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দখল করে সেখানেই অবস্থান নিচ্ছেন। এরপর পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুত হচ্ছেন। সব সেক্টরেই এই নীতি চলছে।
বলা হয়, অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে দ্রুত সেনা নিয়ে এসে সেনানিবাস ও গ্যারিসনে সমবেত করছে। জেলাগুলোর বহু এলাকা কার্যত মুক্ত। ঢাকা-বরিশাল নদীপথে যোগাযোগ এবং ঢাকা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যশোর শহরের দিকে অভিযান এদিনও অব্যাহত থাকে। ভারতীয় সেনা সহায়তায় পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতে বোমা ফেলে তারা চাপ সৃষ্টি করে।
সিলেট অঞ্চলে নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর মুক্ত করে বিজয় উদ্যাপন করেন।
টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি নাগরপুর দখলের উদ্দেশ্যে ২৯ নভেম্বর কেদারপুরে সমবেত হন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা শান্তিবাগে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের ওপর অভিযান চালালে দুজন নিহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরে যৌথ বাহিনী পঞ্চগড়ের বোদার উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। পথে ময়দান দিঘির কাছে পুটিমারীতে পাকিস্তানি সেনাদের বাধার মুখে পড়লে সেখানেই প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে।
সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে পাঁচ মাইল দূরে লুবাছড়া চা-বাগান এলাকায় সমবেত হন। ২৬ নভেম্বর রাতে তাঁরা সেখানে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পরের রাতে বড় চাতলাপুর গ্রামাঞ্চলে অগ্রাভিযান শুরু করেন। এখানে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেন। গ্রামের সামনে ও পেছনে দুইদিকেই তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেন, যাতে কানাইঘাটের পাকিস্তানি সেনারা পালাতে না পারে, আবার বাইরে থেকে নতুন সেনারা এসে যুক্তও না হতে পারে।
পাকিস্তানি সেনারা কামান দিয়ে তাঁদের আক্রমণ শুরু করে। প্রবল আক্রমণের মুখেও তাঁরা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান ধরে রেখে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ১৮টি স্থানে অভিযান চালিয়ে আজ রংপুর ও পঞ্চগড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড় ত্যাগে বাধ্য হয়।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ভারতীয় আক্রমণের চাপে পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে পাকিস্তান সেনারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ আজ স্বীকার করে। এক সরকারি মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫ বর্গমাইল এলাকা এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খানকে তাঁর বাসভবনে নজরবন্দী এবং তাঁর গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিচ্ছে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১৯ নভেম্বর- আবার স্বীকৃতির দাবি ভারতের রাজ্যসভায়
১৯ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ৵সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য নতুন করে আবার দাবি জানানো হয়। রাজ্যসভায় সিপিআই সদস্য জি এম সরদেশাই বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবসংক্রান্ত একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারের উদ্দেশে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন পাঠানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়া।
রাজ্যসভায় এসএসপির সদস্য রাজনারায়ণ অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চাপে বাংলাদেশ উপদেষ্টা কমিটিতে কমিউনিস্টদের গ্রহণ করা হয়েছে। এর উত্তরে সরদেশাই বলেন, এই ধরনের বিবৃতি ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পছন্দ করবে। রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনা করার জন্য কমিশন গঠন করার অধিকার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের কাছে কখনোই এখানে এমন কোনো কমিশন পাঠানোর কথা চিন্তা করছে বলে জানায়নি।
পরে সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য চীনে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর অভিপ্রায় সরকারের নেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মনোভাব চীনের উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের পাকিস্তানকে তাদের দেশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সেনা পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা দিতে অস্বীকার করার সাম্প্রতিক একটি খবরকে সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় স্বাগত জানান।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার দিন খুবই কাছে।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল সাদেক হোসেন খোকার (স্বাধীনতার পর বিএনপি নেতা ও ঢাকার মেয়র) নেতৃত্বে শান্তিনগরে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের অফিসে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলাদের এই দলে আরও ছিলেন রফিকুল হক নান্টু, ইকবাল আহমেদ সুফি ও আমসল লস্কর।
ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের অনুগতদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মতিঝিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্য আরেকটি দল ডেমরায় পাকিস্তানি অনুগত ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্যাকেজিং কারখানায় বোমা হামলা চালায়।
এই সেক্টরের অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার রাজনগরে সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করলে দুজন হতাহত হয় এবং পাঁচ রাজাকার বন্দী হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর দলের সামাদের গ্রুপে ছিলেন কমান্ডো মাহবুব, কাসেমসহ কয়েকজন এবং আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিলেন ১৫ জন। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। রায়গঞ্জ সেতুর কাছে পৌঁছে সামাদের গ্রুপ বুঝতে পারে, তাঁরা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে পড়েছেন। সামাদ সবাইকে শুয়ে পড়তে বলেন। পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে গুলি শুরু করে। চলতে থাকে মরণপণ যুদ্ধ।
এই সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বড়খাতায় পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা হাতীবান্ধায় পিছু হটে। বড়খাতা পাকিস্তানি মুক্ত হয়।
ইয়াহিয়া-নুরুল আমিন সলাপরামর্শ
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনের ব্যাপারে সলাপরামর্শ করেন।
নুরুল আমিনসহ দক্ষিণপন্থী সাত দলের যুক্তফ্রন্টের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে আগের দিন বলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য দলকে যদি সরকার গঠন করতে বলা হয়, তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হবে না, এমন হুমকি দেওয়ার অধিকারও কারও নেই। বিবৃতিতে স্পষ্ট যে ভুট্টোর ঘোষণার জবাবেই এ কথা বলা হয়েছে।
২০ নভেম্বর – স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই
নিউইয়র্ক টাইমস ২০ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমৃত্যু সংগ্রাম করে হলেও বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে ঘুরে সামগ্রিকভাবে এই ধারণাই হয়। করাচি থেকে ম্যালকম ব্রাউন এই প্রতিবেদন পাঠান।
প্রতিবেদনে ব্রাউন বলেন, হোটেল, ব্যাংক, দোকান, বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বিদেশি কনস্যুলেট অফিস—সর্বত্রই রয়েছে মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জলাভূমি বেশি। সেখানে সেনাদের পক্ষে ঢোকা কঠিন। পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ভিয়েতনাম থেকে কিছু শেখেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গেরিলারা সর্বত্র রাস্তা, সেতু ও জলপথ ধ্বংস করছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ঘরের বাইরে আসা প্রায় বন্ধ।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটিতে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনাকালে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে বি অ্যান্ডারসন পূর্ববঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান।
শহীদ হলেন আশফাকুশ সামাদ
আশফাকুশ সামাদ ২০ নভেম্বর কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার রায়গঞ্জ দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। ১৯ নভেম্বর রাতে আশফাকুশ সামাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁদে পড়ে যান। এ বিপর্যয়ে বিচলিত না হয়ে সামাদ সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করেন। একপর্যায়ে একটি গুলি তাঁর মাথা ভেদ করলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শাহাদাতবরণ করেন। এ যুদ্ধে আরও শহীদ হন কবীর আহমেদ (ইপিআর সিপাহি), আবদুল আজিজসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বামনিতে রাজাকারদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। রাজাকারদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা অহিদুর রহমান অদুদ শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি এবং ভারতীয় বাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড যৌথভাবে সিলেট দখলের পরিকল্পনা করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি জেড ফোর্স তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের জালালপুর থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। এরপর তারা চারগ্রামে আগের অক্ষে ফিরে এলে পাকিস্তানি বাহিনী জকিগঞ্জ পুনর্দখল করে। জকিগঞ্জ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত করতে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার জকিগঞ্জে আক্রমণ করেন। রাতভর যুদ্ধ চলতে থাকে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সাতক্ষীরার দেবহাটার বিরাট একটি অঞ্চল মুক্ত করেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি বাহিনী সাতক্ষীরা শহরের দিকে পিছু হটে। দেবহাটার মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে সাতক্ষীরার দিকে এগিয়ে যান।
সাতক্ষীরার তালা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এ ছাড়া কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। দিনটি কালিগঞ্জ বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ঈদের দিন
১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল ঈদ। বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের জামাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ঈদের দিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা, ইকো এবং ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির সৈন্যদের নিয়ে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগরকে ঘিরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি।…নতুন জামাকাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিল।’
২০ নভেম্বর বেলা একটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নুরুন্নবী খানদের ছাত্তার গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ভয়ংকর হামলা চালায়। সুবেদার আলী আকবর ছিলেন এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। নুরুন্নবী খান বাংকারে বসে ঈদের খিচুড়ি খাচ্ছিলেন। তিনি দ্রুত সুবেদার বদি এবং তাঁর প্লাটুনের দুটি সেকশনকে সঙ্গে নিয়ে আলী আকবরের অবস্থানে পৌঁছান। বাইনোকুলারে দেখতে পান, পাকিস্তানিদের বিশাল দল তাঁদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করলে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে।
ঈদের রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে বন্দী ৩৮ জন স্বাধীনতাকামীকে শহরের পৈরতলা খালপাড়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা, তাঁর ছেলে কামাল, দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার শহিদ নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল রাজাকাররা। তাঁদের অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
২১ নভেম্বর – চীনের মন্তব্যে হতাশা
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
জাতিসংঘে চীন সরকারের প্রতিনিধির করা মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ২১ নভেম্বর মুজিবনগরে বলেন, শরণার্থীদের ব্যাপারে সামান্য সহানুভূতিও প্রকাশ করেনি চীন। শরণার্থীদের সাহায্যের কথা না বলে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন চীনের প্রতিনিধি। তবে বাংলাদেশের মানুষ একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেটি হলো মাতৃভূমির মুক্তি।
জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি পাকিস্তানি নীতিকে সমর্থন করায় ভারতের আহমেদাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্তের ঘটনাবলি সম্পর্কে এবং বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা প্রশ্নে ভারত তার সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে।
প্রসঙ্গত, ১৯ নভেম্বর চীনের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তব্য দেন।
জাতিসংঘের সমালোচনা
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রধান সম্পাদকীয়তে অভিমত ব্যক্ত করা হয়, ভারত উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাইলে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেওয়া উচিত। আরও বলা হয়, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেই কেবল জাতিসংঘ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে সফল হবে। জাতিসংঘ এ পর্যন্ত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এড়িয়ে গিয়েছে।
পূর্ববঙ্গে যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, কেবল ত্রাণে তার সুরাহা হবে না বলে মনে করেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানসহ জাতিসংঘের একাধিক কর্মকর্তা। তাঁদের অভিমত হলো, সমস্যার মূলে যেতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিতে হবে। তবেই সংঘর্ষ বন্ধ হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটেনের পার্লামেন্ট লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস এদিন লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা দেন। সেখানে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন তাদের এক সংবাদ নিবন্ধে ক্রেমলিনের অভিমতের পুনরাবৃত্তি করে বলে, পূর্ববঙ্গে সামরিক সরকারের অমানবিক উৎপীড়নের কারণেই জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এর দায় ভারতের ঘাড়ে চাপানো যায় না। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান রাজনৈতিক মীমাংসা।
পাকিস্তান অধিকৃত ঢাকা থেকে এদিন একটি বার্তা সংস্থা জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানিরা দিশেহারা। দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বিস্তীর্ণ পল্লি অঞ্চল মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। তাদের অভিযানের তীব্রতায় প্রশাসন বেসামাল। পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হতে পারে, এই আশঙ্কায় তারা সন্ত্রস্ত।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী এদিন জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ৬ জন সেনা, ২ জন পুলিশ ও ২৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার বেনাপোল, নাভারন, শার্শা শহরসহ চৌগাছার গরিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক ও কামান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। ভয়াবহ যুদ্ধে দুই পক্ষেই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এদিন সকালে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে কামান ও আর্টিলারি দিয়ে আঘাত হানে। বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা পাঁচ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে চলে যায়। এরপর শহীদ আশফাকুস সামাদসহ অন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ উদ্ধার করে জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর সামাদকে বীর উত্তম খেতাবে সম্মানিত করা হয়। স্থানীয়রা জয়মনিরহাটের নাম রাখেন সামাদনগর।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন করাচিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সম্প্রতি যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে তাঁর সেখানে যাওয়ার আর কোনো আবশ্যকতা নেই।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, গণতন্ত্রই শুধু দেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে। একনায়কতন্ত্র বা স্থায়ী সামরিক শাসন কোনো সমাধান হতে পারে না।
২২ নভেম্বর – যশোর অভিমুখে মুক্তিবাহিনী
যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চৌগাছায় ২২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী চৌগাছার বিরাট এলাকা মুক্ত করে যশোর শহরের দিকে এগোয়। পাকিস্তানি বিমান যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বয়রায় আসামাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে ওড়ে। বিমানযুদ্ধে তিনটি পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুই পাইলট খলিল আহমদ খান ও পারভেজ মেহেদি কোরেশি ভারতে বন্দী হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩টি ট্যাংক, ৩টি বিমান এবং বেশ কিছু সেনা হারিয়ে শার্শার নাভারনে আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পিছু নিয়ে শার্শা সদর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে।
২ নম্বর সেক্টরে রাতে কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় হামলা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে ছিল। চন্দ্রপুরের লাগোয়া লাটুমুড়া পাহাড়ে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখান থেকে তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ভারতীয় বাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর, তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড কর্মকর্তাসহ ৪৫ জন সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলামসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) ২২ জন শহীদ হন। আহত হন প্রায় ৩৪ জন। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে চন্দ্রপুর দখল করলেও পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর পুনর্দখল করে নেয়।
এই সেক্টরে ঢাকা শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল বনগ্রাম এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে ঘটনাটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রামপুরায় আরেক দলের হামলায় একজন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সহযোগী গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রাম-কানাইঘাট-চরখাই-সিলেট অক্ষ বরাবর অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন তারা সুরমা নদীর তীর ধরে এগিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছায়। দলটির আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি সুরমার দক্ষিণ তীরে এবং চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নেয়।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গৌরীপুরে পৌঁছালে কানাইঘাটে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সামনের দিকের দুটি কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নিয়েছিল।
সিলেট শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেন শক্তিক্ষয় না হয়, সে জন্য ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সেক্টরের একটি কোম্পানি দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে অবস্থান নিতে বলা হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানিদের শক্তি সঞ্চয়ে বাধা দেওয়া এবং কানাইঘাট থেকে পাকিস্তানিদের পিছু হটতে না দেওয়া। বাকি দুই কোম্পানি সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি আলাদা দল অমরখানা ও জগদলহাটে আক্রমণ করে। ভারতীয় আর্টিলারিও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ এবং ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে যায়। অমরখানা ও জগদলহাট মুক্ত হয়।
খুলনা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সীমান্তের বসন্তপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করের আরও এগিয়ে যায়।
নুরুল আমিন স্থায়ীভাবে লাহোরে
পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদপত্রের বরাতে ইত্তেফাক জানায়, কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে স্থায়ীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরেই বাস করতে পারেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শিয়ালকোটে সীমান্ত অঞ্চল এবং লাহোরে নিয়োজিত সেনাদল পরিদর্শন করেন। শিয়ালকোটে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনাবাহিনীর স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থার আন্তজেলা কোচ সার্ভিস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ঢাকা ও মফস্বল শহরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অভ্যন্তরীণ সার্ভিসও বাতিল করা হয়।
মানুষের প্রতি মানুষের অমানুষিক ব্যবহার
ভারতে সফররত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ রাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেন। ভারত সরকারের সামনে যে কঠিন কর্তব্য রয়েছে, তা শান্তিপূর্ণভাবেই তা সম্পন্ন হবে বলে সেখানে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দিল্লি থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক খবরে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯ নভেম্বর এক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ভারত তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনে গ্রহণ করবে। ইন্দিরা বলেন, আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে শেখ মুজিবকে প্রথমে মুক্তি দেওয়া উচিত।
২৩ নভেম্বর – জরুরি অবস্থা জারি করলেন ইয়াহিয়া
ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ নভেম্বর সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান আক্রমণের শিকার হতে পারে, এ আশঙ্কায় ইয়াহিয়া খান দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই সীমান্তে প্রচুর সেনা সমাবেশ করায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন।
এর আগে ১২ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। এর পরই তাঁর নিদে৴শে পশ্চিম সীমান্তে বিপুল সেনার সমাবেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গ সীমান্তেও সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। সীমান্ত থেকে ভারতের ভেতরে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চলছে।
ভারত সরকার খবর পেয়েছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকা তাদের আকাশসীমায় হানা দিতে পারে। এসব তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ভারতও সীমান্তে সেনাসমাবেশ করেছে।
ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিকও রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচিতে আসেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি এই দিন জানায়, ঢাকায় সবার ধারণা ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। সাংবাদিকদের যশোরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে যুদ্ধ চলছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইলে শেখ মুজিবসহ পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে, বিশ্ব সংস্থার উচিত সেটিকে সমর্থন করা।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এর সংবাদদাতার রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাঠানো খবরে এক সামরিক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, যশোর ও সিলেটের ছোট ছোট এলাকা ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতার খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এটি তাঁদের জীবনমরণ যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ভারত থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সিনেট ও কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সে পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, প্রতিনিধি সভা যে সংশোধন অনুমোদন করেছে, এই প্রস্তাবে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরার আলোচনা
পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত তাঁর শীর্ষস্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। পাকিস্তান একদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে তাদের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এসবের প্রেক্ষাপটে সবার সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো দুঃসাহস দেখালে এবার ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হবে পাকিস্তানের। এবার যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের মাটিতেই হবে এবং তার ফয়সালাও হয়ে যাবে।
তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন বেতার ভাষণে বলেন, নানা দিক থেকে সাফল্য এসেছে। স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটতর হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
২ নম্বর সেক্টরে কসবার চন্দ্রপুরের যুদ্ধে শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আবার আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এই সেক্টরে মন্দভাগ অবস্থান পুনর্দখল করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী জায়গাটির কাছে একত্র হলে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন হতাহত হন। এখানে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদীর সন্নিকটে একটি রেলসেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালায়। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর একটি বাংকার ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনী প্রবল পরাক্রমে প্রতিরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তারা বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন এবং চারজন আহত হন।
মুক্তিবাহিনীর নৌযোদ্ধারা চালনা বন্দরের মুখে মাইন দিয়ে ‘এসএস রাইজোভেলান্ডু’ নামের একটি মালবাহী গ্রিক জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এতে চালনা বন্দরে জাহাজ ঢোকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
২৪ নভেম্বর – বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ নভেম্বর দেশটির আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে বৈঠকে করেন। বিরোধী নেতা গোরে মারারি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ৬ ডিসেম্বরের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ, ইয়াহিয়া খান সে দিন পাকিস্তানের নতুন সংবিধান চালু করবেন।
পরে লোকসভায় মুক্তিবাহিনীর সাফলে৵র কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা বলেন, বর্ষার পর মুক্তিবাহিনীর সাফল্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সব পরিকল্পনা স্পষ্টত বানচাল করে দিয়েছে।
এ দিন ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের ১৪ জন নাবিক আশ্রয় নেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার এদিন সশস্ত্র বাহিনীর সবাইকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সামরিক কার্যালয়ে হাজির হতে নির্দেশ দেয়। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি চীনা প্রতিনিধিদল এদিন পাকিস্তানে পৌঁছেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করে।
আলোচনার বিষয় অজানা থাকে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের আক্রমণের প্রসঙ্গ তাড়াহুড়া করে নিরাপত্তা পরিষদে নিতে সরকারকে বারণ করেন। করাচি থেকে লাহোরে পৌঁছে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বের একমাত্র অধিকার তাঁর। কারণ, তিনি জননেতা। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার ওপর বিপুল দায়িত্ব। এই সংকটময় মুহূর্তে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।
একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রেখেছেন।
ওয়াশিংটন থেকে রয়টার্স জানায়, যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে চলায় যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ৩০০ মার্কিন নাগরিককে স্থানান্তর করার কথা ভাবছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরে আবার সান্ধ্য আইন জারি করে। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ঢাকায় দুবার সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বা কারণ জানানো হয়নি।
জাতিসংঘের বৈঠক ডাকার আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের কিছু সদস্য ভারত-পাকিস্তান সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানান।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এদিন ভারত উপমহাদেশের সংকট নিয়ে সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে আলাপ করে। আলোচনার বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি।
ভারত ও পাকিস্তানকে সামরিক উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার জন্য এই দিন আহ্বান জানায় ফ্রান্স।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রে রেখে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
পাকিস্তানিরা পালানোর পথ খুঁজছে
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ২৪ নভেম্বর বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে পাকিস্তানি সেনারা দুটি পন্থা নিয়েছে: ১. নির্বাচিত চার-পাঁচটা সেনানিবাসে আত্মরক্ষার জন্য ঘাঁটি গড়ে তোলা। ২. বাংলাদেশ থেকে দ্রুত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কিছু সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া। বিমানবাহিনীর কিছু বিমানও তারা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকাকে প্রধান ঘাঁটি করে ঢাকা বিমানবন্দর রক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর যশোর, সিলেট, দিনাজপুর প্রভৃতি শহর থেকে তারা পিছু হটছে।
পলায়নপর্বের জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের আরও দু-তিন সপ্তাহ সময় দরকার। তাদের সেনাবাহিনী প্রাণপণ লড়ে ওই সময়টুকু পাওয়ার চেষ্টা করবে।
মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দিকে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় দ্রুত এগোচ্ছে। যশোর বিমানবন্দর ক্ষতবিক্ষত। সাতক্ষীরা-নাভারন এবং চৌগাছা-কালিগঞ্জ হয়ে মুক্তিবাহিনীর আরও দল ক্ষিপ্রগতিতে সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে চলেছে। আরেকটি দল যশোর-খুলনার পথে গোলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী অর্থ ও সম্পদ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত।
নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে এদিন চট্টগ্রাম বন্দরে এক হাজার টন তেলবাহী জাহাজ, মেঘনায় চীনের বাণিজ্য জাহাজ, চাঁদপুরের কাছে চারটি বড় স্টিমার এবং পাকিস্তান নৌবহরের একটি গানবোট ডুবে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর জরুরি সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চাঁদপুরের জাহাজ চলাচল বন্ধ।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্স দখলের লক্ষ্যে জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘোরা, দুয়ারীখেল, ছাত্তারগাঁ, লুনি, জাফলং চা-বাগান, কাফাউড়া ও বাউরবাগ থেকে উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক দিয়ে রাধানগর ও ছোটখেল অবরোধ অভিযান শেষ করেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চৌগাছা মুক্ত করেন।
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাঁটি অবরোধ করে মূল বাহিনী থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
২৫ নভেম্বর – আন্তর্জাতিক বিশ্বে হঠাৎ উত্তেজনা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পৃথকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে তাঁদের দুই দেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে ২৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার খবর পাওয়ার পর দুই দেশের কূটনীতিকদের ডেকে আনা হয়। ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনার সময় উইলিয়াম রজার্স উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমনে কোনো নতুন প্রস্তাব দেননি।
তবে তিনি দুই দেশকেই সংঘর্ষে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পূর্ব খণ্ডে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েনেরও কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ব্যক্তিতভাবে আবেদন জানাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ভারত উপমহাদেশের সমস্যা বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানানোর বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, তার জন্য প্রভাব খাটাতে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। সেখানকার পাকিস্তানি হাইকমিশনার মহম্মদ ইউসুফ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি পৌঁছে দেন।
মস্কোর একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব দল আন্দোলন চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের কাছে একটি নোট পাঠিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিকে জটিল ও সংকটজনক করে না তোলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে আবার অনুরোধ করেছে। পাকিস্তান যুদ্ধের পথই বেছে নিলে তাকে সর্বনাশা পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চীনের সরকারি পত্রিকায় বলা হয়, ভারত পূর্ববঙ্গে আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়েও যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিচ্ছে চীন। কারণ, তারা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়। নিউ চায়না এজেন্সি পরিবেশিত আরেক খবরে বলা হয়, বেইজিংয়ে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক পরিস্থিতিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি চৌ এন লাইকে দেন কায়সার।
শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিন আবার ঘোষণা করে, কলম্বো হয়ে বিমানে পূর্ববঙ্গে সেনা ও অস্ত্র পাঠানোর জন্য পাকিস্তানকে তারা কখনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানিরা তাদের নাগরিকদের এক অংশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রীতিমতো ভুল করেছে। ৮০ লাখ থেকে এক কোটি আক্রান্ত নাগরিককে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা তাদের কৌশলগত ভুল। এতে ভারত গুরুভার বহন করতে বাধ্য হয়। ভারত আশ্রয় ও সামরিক শিক্ষা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান তার সংকীর্ণতার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়ান্ত্র ব্যবহার করে। পরিণামে এ যুদ্ধ।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ কলকাতা থেকে পাঠানো সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, পূর্ববঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ভারতের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল এবং নিরাপস। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও তারা মেনে নিয়েছে। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা শনবার্গকে বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না। তবে পাকিস্তান শুরু করলে তারা নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব করবে।
চীন–পাকিস্তান বন্ধুত্ব
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন তক্ষশীলায় চীনের সাহায্যপুষ্ট একটি কারখানার উদ্বোধনীতে বলেন, পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে উপমহাদেশের শান্তি বিনষ্ট করেছে ভারত। তবে বিদেশি আক্রমণ হলে চীন পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন জানাবে।
অনুষ্ঠানে চীনা প্রতিনিধি লি সুই চিং বলেন, চীন–পাকিস্তানের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর হচ্ছে। দুই দেশেই অপর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরোধী।
মুক্তিবাহিনীর যশোর দুর্গ দখলের লড়াই
মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় যশোরের ঝিকরগাছা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে তাদের ঘাঁটিগুলো দখল করে। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায়। যশোরের অনেক এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়।
ঝিকরগাছা দখলের পর যৌথ বাহিনী যশোর শহরে পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক থেকে অবরুদ্ধ করে।
তাদের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কুষ্টিয়া-খুলনা যোগাযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুলনা–উত্তরবঙ্গ রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যশোর বিমানক্ষেত্রও হয়ে পড়ে অকেজো। একটি বিমান পাকিস্তানি সেনা নিয়ে এসেও যৌথ বাহিনীর কারণে নামতে পারেনি।
বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র রাতে জানায়, এক সপ্তাহ যুদ্ধের পর রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরার কয়েকটি থানা মুক্ত।
কুষ্টিয়ার অনেক এলাকা এদিন মুক্ত হয়। মেহেরপুর দখল নিয়ে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের মহেশপুর মুক্ত করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করে ৯টি গ্রামে বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে। ভেড়ামারা থেকেও পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত। দর্শনা থেকে তারা পালাচ্ছে। জীবননগর মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত।
পাকিস্তান সেনারা দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়েছে। পঞ্চগড় ও কানপুর মুক্ত।
তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর বসিরহাট দখল করেছে; ছিনিয়ে এনেছে ফুলগাজী, আনন্দপুর আর চাঁদগাজী বাজার। পরশুরাম এলাকা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা দখলে নিয়েছে।
২৬ নভেম্বর – গৌরীপুরে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ লড়াই
সিলেটের কানাইঘাটের দুই মাইল দূরে গৌরীপুরে ২৬ নভেম্বর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট দখলের লক্ষ্যে ২২ নভেম্বর গৌরীপুরে পৌঁছান। কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তখন তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে এসে সুরমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সামনের চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে ডেল্টা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়।
তারা একই সঙ্গে সুরমার দক্ষিণে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ওপরও আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। ডেল্টা কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে পাকিস্তানিরা বারবার তাঁদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে।
এই অবস্থায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির মাঝখানের প্লাটুনের অধিনায়ক সুবেদার মুসা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক এবং অন্য প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর বাঁ পাশে ছিল সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক ও মেজর) নেতৃত্বাধীন প্লাটুন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানেন। এই সুযোগে প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা বুকে হেঁটে দ্রুত পাকিস্তানিদের ৫০ গজের মধ্যে চলে আসেন।
দুই পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ওয়াকার হাসানের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সারওয়ারসহ ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা এদিন নিহত হয়। ২৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ১৭।
যশোর শহরের উপকণ্ঠে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই এদিন অব্যাহত ছিল। হিলিতে চলে ট্যাংক লড়াই। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলস্টেশন এলাকায় প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। কুষ্টিয়ার রসুলপুর ঘাটের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা রাজাপুরের দিকে পিছু হটে যায়। খুলনা জেলার বসন্তপুরের এদিন পতন হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৬ নভেম্বর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময়ে আর কেউ ছিলেন না। পরে তাঁদের সহকারীরা এসে যোগ দেন। আলোচনার বিষয় ছিল ভারতের আক্রমণের আশঙ্কা। ভুট্টো পরে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা এটা নিয়েই উদ্বিগ্ন, অসামরিক সরকার গঠনের বিষয়ে তাঁরা এখন ভাবছেন না।
পশ্চিম পাকিস্তান সফররত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।
গোটা পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারির তিন দিন পর এদিন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের দুই অংশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ওয়ালি) কার্যক্রম বেআইনি ঘোষণা করেন। এর পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকজন ন্যাপ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া নিষিদ্ধঘোষিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মাস্টার খান গুলকে পেশোয়ারে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক এবং খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যশোর সফর করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির আহ্বান
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালদের বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যুদ্ধের হুমকি সত্ত্বেও আক্রান্ত না হলে ভারত যুদ্ধে জড়াবে না। ভারতের বিমানবাহিনী ক্ষুদ্র ন্যাট বিমান দিয়ে পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর জেট বিমান যেভাবে ঘায়েল করেছে, সেখান থেকেই তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সংবাদদাতা কেভিন রেফার্টি কলকাতা থেকে পাঠানো খবরে বলেন, অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, শিগগিরই বাংলাদেশ নামে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হবে। যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো সমাধানের কথা কেউ ভাবতে পারছেন না। সবার ধারণা, দ্রুতই যুদ্ধ শুরু হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এই দিন পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের উত্তেজনা কমাতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবার ভারতকে অনুরোধ করেন। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে এই খবর দিয়ে বলেন, ইসলামাবাদে পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গেও এমন আলোচনা চালানো হচ্ছে।
২৭ নভেম্বর – মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছেন
দিনাজপুর অঞ্চলের হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণ ২৭ নভেম্বর তীব্র আকার ধারণ করে। হিলিতে তীব্র লড়াই হয়। রংপুর সেনানিবাস থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাকে বিচ্ছিন্ন করতে যৌথ বাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তাদের কামানের গোলায় পাকিস্তানিদের পাঁচটি ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৮০ জন হতাহত হয়। যৌথ বাহিনীরও ২০ জন হতাহত হন।
সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেক্স মুক্ত করার জন্য এদিনও থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানে আক্রমণ করে। ছোটখেলে তাদের সঙ্গে ছিল জেড ফোর্সের ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির একটি প্লাটুন। নেতৃত্বে ছিলেন ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাদের দায়িত্ব ছিল গোর্খা সেনাদের বেরোনোর পথ নিরাপদ রাখা এবং দক্ষিণ দিকের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা।
আর্টিলারির গোলাবর্ষণের পর গোর্খা রেজিমেন্টের সেনারা সরাসরি আক্রমণ শুরু করেন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তাঁরা ছোটখেল দখল করেন। গোর্খা রেজিমেন্টের অন্য যে দুটি কোম্পানি রাধানগরে আক্রমণ করেছিল, তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। তাদের ৪ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পদের ৬৭ জন সেনা শহীদ হন। আহত হন শতাধিক।
ছোটখেল দখল করলেও পুনঃসংগঠিত পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় তা গোর্খা সেনাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। গোর্খা সেনারা নুরুন্নবী খানের প্লাটুনের সহায়তায় পিছু সরে আসেন। শহীদ হন ৩৬ জন।
নুরুন্নবী খানের অধীন ডেল্টা কোম্পানির অবস্থান ছিল লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, ছাত্তারগাঁ ও শিমুলতলা গ্রামে। পাকিস্তানিরা এসব অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে হিমশিম খান। পরে কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে প্রতিহত করেন।
সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল রহিমপুরের কাছে বিরাট এলাকা মুক্ত করে। দুজন কর্মকর্তাসহ ২৩ জন পাকিস্তান সেনা বন্দী হয়। ১৮৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
ফেনী দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। স্থলযুদ্ধে মার খেয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে। তবে মুক্তিবাহিনী অবস্থান ধরে রাখে।
৭ নম্বর সেক্টরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিন মাইল দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিবাহিনী মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একসঙ্গে পোড়াগ্রাম আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের একটি সূত্র এদিন জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ টেলিফোনে কথা বলেছেন। নিয়মমতো আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হলেই নিরাপত্তা পরিষদ মাথা ঘামাতে পারে। বর্তমান সংকটে পাকিস্তান যাতে ভেঙে না যায়, সে উপায় খুঁজে বের করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা করতে পারে।
তবে ভারত-পাকিস্তান সংকটে নিরাপত্তা পরিষদের এগিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা নেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করতে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে এতে টেনে আনতে চাইছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি তাদের ঢাকা সংবাদদাতার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানায়, ঢাকায় আবার কয়েকটি বিস্ফোরণের এবং কয়েকটি পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সড়ক, জলপথ ও রেল পরিবহন বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পরিখা খনন করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র দং এ লিবো এদিন জানায়, উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। অস্ত্রবোঝাই একটি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোর খবর সরকারিভাবে সমর্থিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি ভারত সরকারকে জানিয়েছে।
বাজপেয়ীর সমর্থন
জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ী এদিন বলেন, ভারতের ওপর পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে জনসংঘ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানাবে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আফ্রো-এশিয়া সংহতি কমিটির এশীয় আঞ্চলিক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৭২ সালের ১০ থেকে ১৫ জানুয়ারি মিসরের রাজধানী কায়রোয় অনুষ্ঠেয় পঞ্চম অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে তারা আলোচনা করবে। সে অধিবেশনে যাতে বাংলাদেশ যোগ দিতে পারে, তার জন্য কায়রো অধিবেশনের প্রস্তুতি কমিটিকে জানানো হবে।
রেডিও পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি
রেডিও পাকিস্তান এদিন এক খবরে স্বীকার করে, যশোরের কাছেই প্রচণ্ড লড়াই চলছে। যশোর বিপন্ন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বিভিন্ন এলাকা সফরের অংশ হিসেবে এদিন হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন করেন।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১০ নভেম্বর – ফেনীর বিরাট এলাকা মুক্ত
ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ফেনীর বিলোনিয়া অঞ্চলের পরশুরামের বিরাট এলাকা ১০ নভেম্বর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের বিলোনিয়ায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা গোটা এলাকাটি মুক্ত করতে নভেম্বরের শুরু থেকে আক্রমণ বাড়িয়ে দেন। ৭ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনারাও তীব্র পাল্টা আক্রমণ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তাদের জবাব দিতে থাকেন। ৮ থেকে ১০ নভেম্বর দুই পক্ষে কয়েকবার মুখোমুখি যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানিরা অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে চারটি জেট দিয়ে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে পাকিস্তানিদের দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে হটিয়ে দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এ সময় এগিয়ে আসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের তৃতীয় ডোগরা রেজিমেন্ট।
তারা ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঘণ্টার মধ্যে পরশুরামের বিরাট এলাকা দখল করে নেন।
দুই কর্মকর্তাসহ ৭২ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে এককভাবে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
এ যুদ্ধে হতাহত হয় ১৫০ জনের মতো পাকিস্তানি। মুক্তিবাহিনীরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা এ দিন ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে জানান, মুক্তিবাহিনী গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের সাতটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
ঢাকার কাছের মধুপুর জঙ্গল এবং দক্ষিণে সুন্দরবন এলাকা তাদের দখলে রয়েছে।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা অঞ্চলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গ্রিন রোডে রেডিও পাকিস্তানের উপপ্রধান প্রকৌশলীর অফিসে অভিযান চালায়।
তাদের গুলিতে রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্রের আঞ্চলিক প্রকৌশলী বজলে হালিম নিহত এবং দুজন আঞ্চলিক প্রকৌশলী আহত হয়।
ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দলের একটি হলিক্রস কলেজের ভেতরে এবং আরেকটি আজিমপুর গার্লস স্কুলের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পাট করপোরেশনের পাটগুদামে আগুন ধরিয়ে দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের চৌগাছার হাজীপুরে রেঞ্জারস ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করেন। পাল্টাপাল্টি যুদ্ধে কয়েকজন রেঞ্জারস ও রাজাকার হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হন।কলকাতার একটি কূটনৈতিক মিশনের একজন কনসাল জেনারেল এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, সূর্যাস্তের পর ঢাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ওই কনসাল জেনারেল কিছুদিন আগে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা গিয়ে তিন দিন অবস্থানের পর কলম্বো হয়ে ৯ নভেম্বর কলকাতা ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে কোনো বাড়িতে তিনি মানুষ দেখতে পাননি। সেখানে একটি হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে বলেন, সামরিক বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
ইন্দিরা-উইলি ব্রান্ট সাক্ষাৎ
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে বিদেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ দিন তিন দিনের সফরে পশ্চিম জার্মানিতে পৌঁছেই দেশটির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
তাঁরা একমত হন যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
ইন্দিরা গান্ধী উইলি ব্রান্টকে বলেন, ভারতের নিরাপত্তায় শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। উইলি ব্রান্ট ভারতের প্রতি তাঁর দেশের সহানুভূতির আশ্বাস দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, জাতিসংঘ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান বের করতে পারলে ভারত স্বাগত জানাবে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন রাতে পাকিস্তানে ব্রিটিশ অস্ত্র রপ্তানির কথা অস্বীকার করেন।
যুক্তরাজ্যের কিছু পত্রিকায় খবর বেরোয়, গত কয়েক মাসে দেশটি থেকে বিমান, ট্যাংক ও কামান ইত্যাদি পাকিস্তানে গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খবরটি ভিত্তিহীন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভেঙ্কর ১০ নভেম্বর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল আন্দ্রে গ্রেচকোর সঙ্গে আলোচনা করেন।
আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উদ্ভূত যুদ্ধের হুমকি নিয়েই তাঁরা আলোচনা করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে, সে সংকটে তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য ভারত পাবে।
সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মী আলী আহমদ ৯ নভেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি চৌ এন লাইকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন না করতে অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, পূর্ববঙ্গবাসী এ ব্যাপারে চীন ও অন্য সমাজতন্ত্রী দেশের সমর্থন কামনা করে।
ভুট্টোর মন্তব্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে জনসভায় বলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধলে তা শুধু এই দুই দেশের সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি এবং চৌ এন লাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পাকিস্তানকে তাঁরা পুরো সহযোগিতা করবেন।
১১ নভেম্বর – বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে বিচলিত পশ্চিম জার্মানি
পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ১১ নভেম্বর বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও স্থায়িত্বের জন্য বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
এরপরই ভারত থেকে শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন। পশ্চিম জার্মানি সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে দুই দিনের আলোচনার পর এই বক্তব্য দেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে পশ্চিম জার্মানি গভীরভাবে বিচলিত বোধ করছে বলেও উল্লেখ করেন উইলি ব্রান্ট।
একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, জাতিসংঘের উদ্যোগে শরণার্থী ত্রাণে তাঁর দেশ আরও অর্থসহায়তা দেবে।
উপমহাদেশের ঘটনাবলিতে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিম জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে এদিন এক ঘোষণায় বলা হয়, এখনো সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তারা সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এ বিষয়ে চিঠি লিখেছেন।
বন থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর সংবাদদাতা নরম্যান ক্রসল্যান্ডের পাঠানো খবরে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর অনমনীয় মনোভাব থেকে বোঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানায়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওয়াশিংটনের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, পাঁচ হাজার টন অস্ত্রবোঝাই কিছু রুশ জাহাজ ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
৩ নভেম্বর দিল্লিতে অবতরণ করা রুশ পরিবহন বিমানেও ছিল অস্ত্রশস্ত্রের জন্য যন্ত্রাংশ। এর আগেও ১০টি রুশ পরিবহন বিমান দিল্লিতে নামে।
বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ১১ নভেম্বর মুজিবনগরে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের নীতি ও কাঠামো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হবে স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজবাদী রাষ্ট্র।
কলকাতার সল্টলেকে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর আয়োজিত এক শরণার্থী সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা আশা প্রকাশ করেন, সেদিন আর বেশি দেরি নেই, যেদিন শরণার্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
ঢাকায় সফল গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন অবরুদ্ধ ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় অভিযান চালান। তাঁরা সেখানে অবস্থানরত একদল পাকিস্তানি সেনার কাছাকাছি বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
অভিযানে অংশ নেন রাইসুল ইসলাম আসাদসহ কয়েকজন। লুই অ্যান্ড ডুসেলডর্ফ প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর বাড়ি (সিদ্ধেশ্বরী) থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গাড়ি সংগ্রহ করেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় অভিযানের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয়বার গেরিলারা গাড়ি পার্ক করেন বায়তুল মোকাররমের ফ্যান্সি হাউসের সামনে।
সেখানে ছয়জন পাকিস্তানি সেনা কলা কিনছিল। ফ্যান্সি হাউসের ভেতরে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের মেজর ফতেহ মোহাম্মদ মালিকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের লোকজন কেনাকাটা করছিল।
গাড়িটি পার্ক করার পর আসাদ ছাড়া বাকি সবাই নেমে যান। এরপর আসাদ সিগারেট খাওয়ার ভান করে গাড়ির ভেতরে রাখা টাইম বোমার সেফটি ফিউজ জ্বালিয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে যান। দেড় মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সমস্ত এলাকা।
এ অভিযানে তিন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন হতাহত হয়। একজন আহত নারীকে কোলে নিয়ে মেজর ফতেহর ফ্যান্সি হাউস থেকে বেরিয়ে আসার ছবি পরদিন ঢাকার পত্রিকায় ছাপা হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে বলা হয়, বোমা বিস্ফোরণের পর শহরের দোকানপাট ও অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়।
খবরে আরও বলা হয়, গত মার্চে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ছয় হাজার পুলিশের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ স্পষ্ট।
২ নম্বর সেক্টরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা এদিন রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি অবস্থানে আক্রমণ চালান। পরদিন পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা, রেঞ্জার্স ও রাজাকার মিলে ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ হন। একজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন রাতে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে পাহারারত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গোলাবর্ষণ করলে চারজন আহত হয়।
তাদের পাল্টা আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে দামুড়হুদার রঘুনাথপুরে নদীর ঘাটে মাইন পেতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি হতাহত হয়।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবকে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কথা জানান।
লাহোরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে ঢোকার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হয়। তবে তাঁর গায়ে গুলি লাগেনি।
১২ নভেম্বর – প্রচারণার বিরুদ্ধে ভাসানীর চিঠি
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১২ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত) কাছে লেখা এক চিঠিতে ভারত তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছে বলে যে প্রচার চলছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা নিরাপদ বলে মনে করছেন না। চিঠিতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের নিঃস্বার্থ সহায়তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের এই সময় এসে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন করায় চীনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির সমর্থক এবং মাওলানা ভাসানীর কিছুসংখ্যক চীনপন্থী অনুসারী ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রচার শুরু করে। তারা বলে, বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করাই ভারতের উদ্দেশ্য। এই প্রচারণায় তারা ভাসানীর নাম ব্যবহার করে বলে, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি রোধ করতে ভারত ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছে। এ পটভূমিতে ভাসানী চিঠিটি লেখেন।
পাকিস্তানকে চীনের পরামর্শ
দ্য টাইমসকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, চীন পাকিস্তানকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। চীন বলেছে, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ করা উচিত নয়; ব্যাপারটি নিরাপত্তা পরিষদে তোলারও এটা উপযুক্ত সময় নয়। লন্ডনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হোমের আলোচনায় উপমহাদেশের সমস্যাটি বিশদভাবে আলোচিত হয়।
পশ্চিম জার্মানি সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বনে এই দিন এক ভোজসভায় বলেন, পাকিস্তান এবার ভারত আক্রমণ করলে তাসখন্দ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। ১৯৬৫ সালে অধিকৃত কাশ্মীর এলাকা থেকে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলেও তাসখন্দ চুক্তি মেনে ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি।
পশ্চিম জার্মানির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভারতের আগে বা অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। ভারতও যথাসময়ে স্বীকৃতি দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহার্স্টের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় পরিকল্পনা নিয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের একটি দল ১২ নভেম্বর রাতে একটি কাপড়ের কল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে পাকিস্তানিদের সহযোগী চাঁদ মিয়া সরদার নামে একজন নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে এ দিন বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বড় একটি যুদ্ধ হয় যশোরের চৌগাছা ও মাসলিয়ার মাঝখানে। বয়রা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ভারতের ১ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলস এতে সহায়তা করে। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা থেকে সরে গেলে এলাকাটি পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার কৃষ্ণপুর ঘাটে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
চতুর্থ যুদ্ধ হয় জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আক্রমণ করেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলা তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়।
মেহেরপুরের ধর্মদহে হয় পঞ্চম যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের ধর্মদহ অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় প্রায় ৫০ জন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন কয়েকজন এবং তিনজন বন্দী হন।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ষষ্ঠ যুদ্ধে গেরিলারা পাকিস্তানিদের অবস্থানে হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৭ জন হতাহত হয়। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। আলমডাঙ্গায় আরেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর একজন রেঞ্জার, কয়েকজন রাজাকার এবং একজন পুলিশ নিহত হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ দিন জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে সিটি অব সেন্ট আলবানস নামে যুক্তরাজ্যের একটি মালবাহী জাহাজ গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশুর নদে ঢোকার মুখে জাহাজটি গোলার মুখে পড়ে। প্রায় ৪০টি আঘাতের চিহ্ন নিয়ে জাহাজটি কলকাতায় ফিরে যায়।
১০ নভেম্বর ওই জাহাজ কলকাতা থেকে চালনা বন্দরের দিকে রওনা হয়ে সেদিনই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে। বন্দরের ছয় মাইল দূরে রাত সাড়ে ১২টায় হঠাৎ দুই দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর দুটি গানবোট এসে গোলাবর্ষণ শুরু করে। জাহাজটি গভীর সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ এদিন রাজস্থান ও পাঞ্জাবের অগ্রবর্তী গোলন্দাজ ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক জনসভায় বলেন, সংসদের শূন্য আসন পূরণের জন্য উপনির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রভাবিত সরকার গঠন করার প্রচেষ্টা তিনি মেনে নেবেন না। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে ৪০ দিনের মধ্যে সে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
১৩ নভেম্বর – যুদ্ধ ছাড়া সমাধানে ইন্দিরার সংশয়
তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর শেষে ১৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শুধু কোনো প্রস্তাব গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করতে পারেন। শেখ মুজিবকে আলোচনায় ডাকা না হলে বাংলাদেশের নেতারা ইয়াহিয়ার সঙ্গে আদৌ কথা বলবেন কি না, তাতে সন্দেহ আছে।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদিও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা বলেছে, তবু তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান আমেরিকার অস্ত্র পাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
ভারতের আসাম রাজে৵র মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ ও শরণার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে স্বার্থসিদ্ধির মতলব আঁটছে স্বার্থান্বেষীরা। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে দেরি হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ দিন প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববঙ্গে যে ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র না দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অতি সামান্য পদক্ষেপ। সেই অস্ত্রে বাঙালিদের ওপর চালানো অত্যাচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও দায়ী।
মাইন বিস্ফোরণে কূটনীতিক নিহত
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের (২ নম্বর সেক্টরের অধীন) একটি দল এ দিন ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর যান চলাচলে বাধা দিতে সোনারগাঁয়ের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মাইন পুঁতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরণে ঢাকার পশ্চিম জার্মান কনস্যুলেটের একজন কূটনীতিক এবং একজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এই সেক্টরে সালদা নদী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরের খানপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপিসিএফ) সেনাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে খানপুর সীমান্তঘাঁটি দখল করেন। অভিযানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে এসে সীমান্তঘাঁটি দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এই সেক্টরের হিলির ভারতীয় অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারাও তার পাল্টা জবাব দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম প্রহরে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোস৴ রেজিমেন্টের প্রায় এক কোম্পানি সেনাসহ রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর আহত হন। তারপরও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই যুদ্ধে ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটি মুক্ত হয়। যু্দ্ধে প্রায় ২০ জন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনায় পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলায় দর্শনা রেলস্টেশনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে
যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণসংক্রান্ত কর্মকর্তারা এদিন ঢাকায় বার্তা সংস্থা এপির প্রতিনিধির কাছে বলেন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এই প্রথম মাইন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যবাহী এই জাহাজে জাতিসংঘের পতাকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ ডলার মূলে৵র খাদ্য নষ্ট হতে বসেছে।
ঢাকা থেকে এ দিন দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনায়ত্ত এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি মনে করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্টের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করে তিনি এ দিন নিউইয়র্কে রওনা হন।
পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগীদের নিয়ে গড়া একটি বিরাট বাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটি৴র সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তান পিপলস পাটি৴র চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগের চেষ্টা না করা হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্য পূর্ব পাকিস্তানের।
১৪ নভেম্বর – ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানের হুমকির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়। মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুপস্থিতিতে দেশে সংঘটিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করতে পশ্চিমা নেতারা কতটা সাফল্য পাবেন, সে ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে।
বৈঠকটি নিয়ে দ্য টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটির সভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করানোর জন্য ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে বিশ্বনেতাদের কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত।
তাঁরা ব্যর্থ হলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ভারতের পক্ষে অসংগত হবে না। ইন্দিরার বক্তব্যে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংকটের অবসান নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।
আগামী সপ্তাহের মধ্যে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। তবে এর আগে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে এক আলোচনা সভায় বলেন, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ভারতে ঘুরে গিয়েছেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে নিরাপত্তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ হয়েছে। ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এন এম পেগোভও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
নিক্সনের নতুন উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তান আকস্মিক সংঘর্ষের শঙ্কা আছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ।
এ দিনের নিউজউইক ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনারা মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলার সংখ্যা এক লাখ।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ১৪ নভেম্বর এক ঘোষণায় জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের সব জেলাতেই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সংযোগ ধ্বংস করে ঢাকা ও কুমিল্লার সঙ্গে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করাই মুক্তিবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। ফেনী, সালদা নদী, নয়নপুর এবং খুলনা জেলার কিছু এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
ঢাকায় পাকিস্তানিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা উত্তরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে রাতে ঢাকা-আরিচা সড়কের ধামরাইয়ের ভায়াডুবি সড়কসেতু ধ্বংস করেন।
রাতের অন্ধকারে রেজাউল করিম মানিকসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর প্রতীক) অন্য গেরিলাযোদ্ধারা নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছান।
তাঁদের আক্রমণে দু-তিনজন নিহত হওয়ার পর বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
গেরিলাযোদ্ধারা তখন সেতু ধ্বংসের কাজ শুরু করেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয় সেখানে এসে তাদের আক্রমণ করে।
প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যেই রেজাউল করিম মানিকসহ কয়েকজন সেতুটি ধ্বংসের কাজ শেষ করেন।
এরপর তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া মর্টারের স্প্লিন্টার তাঁর গায়ে আঘাত করলে তিনি শহীদ হন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সহযোদ্ধারা মানিকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এলে তাঁর মা-বাবা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।
রেজাউল করিম মানিক ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এই সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান ডকইয়াডে৴ অভিযান চালায়। তাঁদের ছোড়া বোমায় ভাসমান ডকইয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে সুনামগঞ্জে একটি সড়কসেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা নদীঘাটের ফেরি ধ্বংস করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ তখন ফেরি দিয়ে নদী পার হচ্ছিল। বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। ফেরিটি ডুবে যায়।
৬ নম্বর সেক্টরের ভূরুঙ্গামারী এলাকার একাংশ এদিন মুক্ত হয়।
এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভূরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানিদের একটি অগ্রবর্তী অবস্থানে আক্রমণ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা খবর নিয়ে জানতে পারেন, কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং শুকনো খাবার ফেলে পাকিস্তানি সেনারা রাতের অন্ধকারে ওই অবস্থান থেকে পালিয়ে গেছে। ভূরুঙ্গামারীর পাশে জয়মনির হাটের একাংশ এ দিন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
১৫ নভেম্বর – ভারত হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৫ নভেম্বর দিল্লিতে বলেন, দ্রুত বা ক্রোধবশত বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত। বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি মাত্রই কথা বলে এসেছেন। সমস্যার বিভিন্ন দিক এবং বিপদের আশঙ্কা তিনি তাঁদের বুঝিয়ে বলেছেন।
এদিন সকালে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ইন্দিরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমেও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাঁর বিদেশ সফরে দেশগুলো বাংলাদেশ সংকট আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদীয় দলের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সব উপায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ সময়ে দেশে ঐকে৵র প্রয়োজন খুব বেশি।
সংসদে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সাম্প্রতিক সফর নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কোনো দেশের নেই। বহু দেশই বুঝেছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের আইনসংগত ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের না করে অন্যদের সমস্যার মীমাংসা করতে গেলে লাভ হবে না। তাঁরা বুঝেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা সেটি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বোঝাতেও চান।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতির সন্তোষজনক সমাধান এবং শরণার্থীর দেশে না ফেরা পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ভারত তার সেনা সরাবে না। ভারত আক্রান্ত হলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানেরই মাটিতে। তিনি আশা করেন, যুদ্ধের পথ ছেড়ে পাকিস্তান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবে।
সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা রংপুরের প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। সাত লাখ অধিবাসীর এই মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হচ্ছে।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, কুষ্টিয়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধে৵ তাঁরা যশোরের আলীগঞ্জ থেকে দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এটি পাকিস্তানিদের বিশেষভাবে কাবু করেছে। এলাকাটি রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিবাহিনীর মুখপাত্র আরও জানান, কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানিরা চরম আঘাত পাবে। এখানে শুধু যে রেল যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন, তা নয়; অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিয়েছে। এতে ওই এলাকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল প্রায় ভেঙে পড়েছে। রাতের বেলা সবাই শিবিরে বন্দী থাকে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, কুষ্টিয়া জেলার বেশ কয়েকটি সীমান্তচৌকি মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। ওই জেলার প্রায় ৯০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও মুক্তিবাহিনীর দখলে। জীবননগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দর্শনা-আলীগঞ্জ এবং আলীগঞ্জ-যশোর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এই দিন প্রকাশিত এক খবরে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর সংবাদদাতা জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে গেরিলারা ঢাকা আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছেন।
২ নম্বর সেক্টরের নারায়ণগঞ্জ এলাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ছুড়ে নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের জকিগঞ্জ দখল করেন। ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেডের সম্মিলিত শক্তি সিলেট দখল করার পরিকল্পনা হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি তাদের সঙ্গে জেড ফোর্স যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। তাদের এই অভিযানের অংশ হিসেবে পথিমধ্যে জকিগঞ্জের পাকিস্তানি অবস্থানটি আয়ত্তে নেওয়াটা জরুরি ছিল। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ দখল করেন।
মুক্তিবাহিনী সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর বিস্তৃত এলাকা দখল করে। যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক মাশরিক–এর ১৪ নভেম্বর সংখ্যায় লন্ডন থেকে তাদের সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, বিশ্বস্ত সূত্রের মতে, চীন পাকিস্তানকে জঙ্গি বোমারু বিমান, অন্তরীক্ষে ক্ষেপণযোগ৵ মিসাইল ও ভারী ট্যাংক সরবরাহ শুরু করেছে। চীনা সামরিক সরঞ্জামের প্রথম চালান একটি সমুদ্রগামী জাহাজে ইতিমধে৵ পাকিস্তানে পৌঁছেছে।
দ্বিতীয় চালানও কারাকোরামের পথে পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় চালানে বিমানবিধ্বংসী কামান ও ট্যাংকবিধ্বংসী রকেটও আছে।
লাহোরে সাতটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটির প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
১৬ নভেম্বর – বাংলাদেশের সমাধান মাস দুয়েকের মধ্যে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ১৬ নভেম্বর কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কর্মসমিতির সভায় বলেন, মাস দুয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
অপহৃত দুই চিকিৎসকের লাশ
ঢাকার মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের দক্ষিণে সার্কুলার রোডের সেতুর নিচ থেকে এদিন হাত-পা বাঁধা ও বিকৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক শহীদ বুদ্ধিজীবী আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবীরের লাশ পাওয়া যায়। ১৫ নভেম্বর একদল আলবদর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসের সামনে থেকে তাঁদের দুজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা এক সংবাদে জানায়, ২৭ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। অধিবেশন ঢাকায় বসবে বলে স্থির হয়ে ছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মহম্মদ খান ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দেশ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার মোকাবিলা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে ওয়াশিংটনে দেখা করার পর তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ভারতের সেনাসমর্থিত গেরিলাদের অভিযানই উত্তেজনার কারণ। পাকিস্তান সংযত বলেই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে না।
অবরুদ্ধ ঢাকার গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক এক বৈঠকে শান্তি সেনা গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি নিশ্চিত, বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যাবে। ভারতে সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা নিরসনে তাঁরা উদ্গ্রীব। যুক্তরাজ্য নিজে অথবা কমনওয়েলথ বা জাতিসংঘের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে ইচ্ছুক।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনাকালে ইন্দিরা গান্ধী দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববঙ্গ সংকট অবসানের দাবি জানান। এর মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে ভারত সমগ্র দেশে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় এ খবর উদ্ধৃত করে বলা হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি পৌঁছেছেন।
শহীদ হলেন জগৎজ্যোতি দাস
বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাস ১৬ নভেম্বর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের বদলপুরে শহীদ হন। এলাকাটি মুক্তিবাহিনীর ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত হলেও এখানে কিছু যুদ্ধ ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব-সেক্টর থেকে পরিচালিত হতো। ১৫ নভেম্বর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট থেকে নৌকায় রওনা দিয়ে ১৬ নভেম্বর সকালে বদলপুরে পৌঁছান। তাঁরা জানতে পারেন, রাজাকাররা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে বসে চাঁদা আদায় করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। জগৎজ্যোতি দাস কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন।
অদূরে জলসুখা গ্রামে ছিল জগৎজ্যোতির বাড়ি। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেদিকে রওনা হন; একটি দলকে পাঠান পিটুয়াকান্দি, আরেকটিকে আজমিরীগঞ্জে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জগৎজ্যোতি জলসুখার বদলে পিটুয়াকান্দি চলে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
জগৎজ্যোতি তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা তাঁদের গুলি করে। তিন সহযোদ্ধা শহীদ হন। জগৎজ্যোতির বাঁ পাঁজরে গুলি লাগে। আহত জগৎজ্যোতিকে পাকিস্তানিরা নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। পরে আজমিরীগঞ্জ বাজারে তাঁর লাশ খুঁটিতে বেঁধে বিক্ষত করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জগৎজ্যোতিকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়ার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। আকাশবাণীতেও প্রচারিত হয় তাঁর বীরত্বগাথা। স্বাধীনতার পর তাঁকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়।
এদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়, মুক্তিবাহিনী গত কয়েক দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রংপুর ও যশোরের বিপুল এলাকা মুক্ত করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করেছে।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের গোয়াইনঘাটসংলগ্ন রাধানগর কমপ্লেক্সকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা।
৭ নভেম্বর লুনি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৮-২০ জনের একটি টহল দল আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেখানে গেলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ৮-৯ নভেম্বর লুনি গ্রাম, ১১ নভেম্বর ঘোরা গ্রাম, ছাত্তারগাঁ, দুয়ারীখেল, ১৫ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রাম, ১৬ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও দুয়ারীখেল, ১৮ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
১৭ নভেম্বর – ইয়াহিয়াকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র লন্ডনে ১৭ নভেম্বর জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লন্ডন সফরের পর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ মন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গত মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড একই দিনে দিল্লিতে বলেন, পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তাঁর সরকার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এদিন এক খবরে বলা হয়, ভারত সফররত ব্রিটিশ মন্ত্রী রিচার্ড উড মুম্বাই পৌঁছানোর পর বলেন, পূর্ববঙ্গের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হবে। তাঁর ধারণা, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথের পক্ষে কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব নয়।
ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য হবেন
নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত এবং শেখ মুজিবের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে জানায়, চার সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলখানার আদালতকক্ষে উদাস ও শীর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে।
পত্রিকাটি জানায়, পাকিস্তানের দুই অংশের মধে৵ মীমাংসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বাংলাদেশের নেতারা তাতে বিক্ষুব্ধ। রেহমান সোবহান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম জার্মানি এ দিন দুই হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, বিপুল পরিমাণ শীতবস্ত্র এবং ওষুধ পাঠায়। এসব সাহায্যসামগ্রী কলকাতায় রেডক্রস, ইউনিসেফসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ১৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। ঢাকা শহরে সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করায় প্রমাণিত হচ্ছে যে ঢাকা শহর তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এ দিন ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। তারা ঢাকার সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাতে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বলা হয়, কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শহরকে দুষ্কৃতকারী মুক্ত করতে ১৭ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গী বাজারে ১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের অভিযানে এ দিন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহার চৌধুরী নিহত হন।
১১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে চালানো অভিযানে ঈশ্বরগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুল গণি নিহত হয়।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান পেশোয়ারে বলেন, দেশে যখন আগুন জ্বলছে, তখন কিছু লোক ক্ষমতার কথা বলছেন। তিনি প্রায় চার মাস বিদেশ সফরের পর এ দিন দেশে ফেরেন। দেশের গভীর সংকটে নেতাদের উদাসীনতায় তিনি আক্ষেপ করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত দক্ষিণপন্থী জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিরোধ করার চেষ্টা করায় ওই জোটের শরিক দলগুলোর সমালোচনা করেন। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে পুতুল সরকার গঠন করা হলে বিপ্লব অনিবার্য।
পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র চলছে। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র সফল হলে পশ্চিম পাকিস্তানও কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হবে।
পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাব্বিশা গ্রামে ৩২ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ থেকে যমুনা নদী পার হয়। এরপর দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল ছাব্বিশার পশ্চিম পাশে শালদাইর সেতুর কাছে এবং আরেক দল ছাব্বিশার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নেয়।
ছাব্বিশার পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তখন ছাব্বিশা গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়।
১৮ নভেম্বর – জাতিসংঘে বিতর্ক বাংলাদেশ নিয়ে
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাসংক্রান্ত জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ১৮ নভেম্বর সারা দিন বিতর্কের পর নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া ভারত উপমহাদেশে ওই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আলাদা দুটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি, এমন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
তিউনিসিয়ার প্রস্তাবে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার জন্য বিবদমান দুই পক্ষের কাছে আবেদন জানাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিকে অনুরোধ জানানো হয়।
ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে এই দিন বলা হয়, বিদেশি নেতাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ইয়াহিয়ার আশঙ্কা, তাঁকে মুক্তি দিলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস কমন্স সভার অধিবেশনে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ এড়াতে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে কমনওয়েলথের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেজিল্যান্ড মডলিং বলেন, যুক্তরাজ্য তা-ই করছে।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সঙ্গে প্রায় ৬ ঘণ্টা বৈঠক করেন। তাঁর সঙ্গে একজন ভারতীয় কর্মকর্তাও ছিলেন। দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছে তাঁরা সোজা মুজিবনগরে যান। তাঁদের বৈঠকের বিষয় প্রকাশ করা হয়নি।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্ণফুলী টি এস্টেটে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিলোনিয়া অঞ্চলে মুন্সিরহাট ও পরশুরাম পাকিস্তানি দখল মুক্ত করার পর এ দিন ফুলগাজীর বিরাট এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফেনীর কাছে পিছু হটে।
এই সেক্টরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি মুক্তিযোদ্ধা দল কাইয়ুমপুরে পাকিস্তানি সেনা-অবস্থানে দুটি বাংকার ধ্বংস করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
সিলেটের গোয়াইনঘাট সংলগ্ন রাধানগর এলাকার ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়।
৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের (১৪ ডিসেম্বর শহীদ এবং স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ) তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন একটি আমবাগানে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে ঘাঁটি দখল করার পর হঠাৎ পেছনের বাংকারে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে থাকে। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানিরা আবার ঘাঁটি দখল করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জীবননগরের দত্তনগর কৃষি খামার পাকিস্তানি বাহিনীর দখল মুক্ত করেন। ১৭ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল তিন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। তাঁদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা টিকতে না পেরে সকালে পিছু হটে।
উ থান্টকে ইন্দিরার চিঠি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক চিঠিতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে বলেন, সেখানকার জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি কোনো রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করলে সেটিকে স্বাগত জানানো হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের চিঠির জবাবে ১৬ নভেম্বর তিনি এ চিঠি লেখেন। লোকসভার এ দিনের অধিবেশনে চিঠিটি পেশ করা হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি রাতে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানান, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে না।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাজ্য মনে করে, বাংলাদেশ সমস্যার দায় পাকিস্তানের এবং এর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।
মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সহকারী হাইকমিশনের প্রবীণ বাঙালি কর্মী শাহজালাল মিয়া পালিয়ে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এসে পুলিশের কাছে আশ্রয় চান।
পাকিস্তানে চীনা প্রতিনিধিদল
চীন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী লি সুই চিংয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ৮ দিনের সফরে ১৮ নভেম্বর ইসলামাবাদে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গেও আলোচনা করবেন।
রাওয়ালপিন্ডির এক সংবাদপত্র জানায়, পাকিস্তানে বসবাসরত প্রায় ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরিকল্পনা করেছে। একজন বিদেশি কূটনীতিক বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব। জরুরি নয়, এমন কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারদের অপসারণ করা হচ্ছে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
২৮ অক্টোবর – শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটি দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। আগের রাতে পাকিস্তানিদের অবস্থানের প্রায় ৬০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই উপদলের একটি বাঁ দিক আর অন্যটি ডান দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। হামিদুর রহমানের দলটি থাকে মাঝখানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা আগেই গোলা ছুড়তে শুরু করে। উঁচু টিলার ওপর থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ভারী মেশিনগানের গুলির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের ডান-বাম দুই দলই এগোতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকজন গুলিতে হতাহত হন।
সে অবস্থায় হামিদুর রহমান দুটি এলএমজির কাভারিং ফায়ারের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষিপ্রগতিতে বুকে হেঁটে পাকিস্তানি মেশিনগান পোস্টের ১০ গজের মধ্যে পৌঁছে সেখান থেকে গ্রেনেড ছোড়েন। তাঁর গ্রেনেড নিখুঁত নিশানায় পড়ে মেশিনগানের গুলি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পাশের আরেকটি বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সেই গুলিতে হামিদুর রহমান শহীদ হন।
হামিদুর রহমানের মরদেহ মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন উদ্ধার করতে পারেননি। ৩ নভেম্বর ধলই মুক্ত হলে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আবার সমাহিত করা হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন দুপুরে রাজধানী ঢাকায় গভর্নর হাউসের পার্শ্ববর্তী ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) ভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। এ ভবনে তখন টেলিভিশন স্টুডিও থাকায় ভবনের গেট সেনা পাহারায় রাখা হতো। সে পাহারা ভেদ করে মুক্তিযোদ্ধারা ভবনের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটান। এতে টাওয়ারে বিরাট ফোকর এবং সপ্তম তলার মেঝেতে গর্তের সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক মীমাংসার আশা কম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, সমস্যা সমাধানের সহায়ক হলে ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি বিবেচনা করবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনা আগের চেয়ে কম।
অস্ট্রিয়ায় চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিলে বাংলাদেশ প্রশ্নে উত্তেজনা হ্রাস পাবে। সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে ভিয়েনায় আয়োজিত ভোজসভার তিনি এ কথা বলেন।
ইন্দিরা গান্ধী এদিন অস্ট্রিয়া থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার আগে ভিয়েনায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এবং সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি সম্পর্কে যেসব দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতকেও সমানভাবে দায়ী করার চেষ্টা করছে, তাদের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, এই যুক্তি অচল। পাকিস্তান যখন সীমান্তে সেনাসমাবেশ করল, তখন কেন বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তিনি বলেন, পাকিস্তান শত শত বা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
ব্রিটেনের চার্চ কাউন্সিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের ওপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ জানায়।
জাতিসংঘে ভারতে স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেন।
ভারত এদিন জাতিসংঘে অভিযোগ করে যে লাখ লাখ শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দিয়ে এবং উত্তেজনা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ঘোষণাকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শক্তিশালী করা সম্পর্কে সাধারণ পরিষদের প্রথম কমিটিতে এই অভিযোগ করেন। পূর্ববঙ্গের জনপ্রিয় নেতাদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে পাকিস্তান সরকারকে সম্মত করানোর জন্য তিনি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে আবেদন জানান।
ভারতের অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবণ দিল্লি প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা ধারণা করছেন, শরণার্থীরা এখানে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত থাকবেন। তাঁর এই ধারণার ভিত্তি অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র ২৮ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, বাংলাদেশ সরকারের ধারণা, খুব শিগগির দেশ স্বাধীন হবে। এ জন্য তারা প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসনব্যবস্থার বিস্তারিত কাঠামোও প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে। পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত হওয়ার পর বাংলাদেশে যাতে কোনো অরাজক অবস্থা সৃষ্টি না হতে পারে, সে জন্য সম্পূর্ণ ছক তৈরি করে রাখা হচ্ছে।
এই দিনও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেসব জাতীয় পরিষদ সদস্য বিদেশি প্রতিনিধি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন বা বলছেন, কমিটি তাঁদের সাবধান করে দেয়। কার্যনির্বাহী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এরপর কেউ এমন উদ্যোগ নিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিটি আরও ঘোষণা করে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো শর্তেই তারা আর কোনো আলোচনা করতে রাজি নয়। কার্যনির্বাহী কমিটি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রাখার প্রস্তাব দেয় এবং যাদের অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে, তাদের পূর্ণ তালিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানায়।
২৯ অক্টোবর – বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর ২৯ অক্টোবর কলকাতায় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক জেলে আটক রেখেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে এ কথা লিখে জানিয়েছেন। ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিবর্গসহ কিছু দেশ পাকিস্তানকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। ডি পি ধর গত তিন দিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক সেরে এ দিন সন্ধ্যায় দিল্লি রওনা দেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দিল্লিতে পররাষ্ট্রসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিকে বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে সোভিয়েত-ভারত চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জরুরি পরামর্শ নেওয়া হবে।
দিল্লিতে এ দিন সরকারি তথ্যে জানানো হয় যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৯৭।
স্বাধীনতা ছাড়া পথ নেই
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার অন্য কোনো সমাধান নেই। মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করে তুলতে বৈঠকে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কিছু লোক একশ্রেণির বিদেশির সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলায় অনেক ক্ষেত্রে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে। কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৪৩ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কমিটির ৪৯ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন মৃত। বাকি ৪ জনের অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এ দিন একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিবেশক সংস্থা বলাকা পিকচার্স জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের ভারতীয় পরিবেশনা স্বত্ব লাভ করে। ভারত সরকার ছবিটির প্রমোদ কর মওকুফ করেছে। এর বিক্রয়লব্ধ অর্থ মুক্তিসংগ্রামে ব্যয় করা হবে। অনুষ্ঠানে জহির রায়হানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রান্স প্রভাব বিস্তার করবে
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরগেস ২৯ অক্টোবর দেশটির সংসদকে জানান, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়াতে এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ফ্রান্স প্রভাব বিস্তার করবে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ইয়াহিয়া খানের কাছে এ ব্যাপারে কয়েকটি বার্তা পাঠিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এই দিন লন্ডনে আসেন। লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইন্দিরার সফরের উল্লেখ করে বলা হয়, তিনি মনে করেন, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিবন্ধে ইন্দিরার প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে ভোর চারটায় পাকিস্তানি সেনারা শালদার নয়াপুর ও ফুলগাজী থেকে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে প্রচণ্ড কামান আক্রমণ শুরু করে। তারা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা পিছু হটে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এই সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার শিমপুরে একটি সড়কে মাইন পেতে রাখে। পাকিস্তানি সেনারা সড়কপথে সেখানে টহল দিতে এলে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল দুটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। একটি দল ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) অ্যাভিনিউতে মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের কাছে একটি পাকিস্তানি টহল দলের ওপর বোমা ছোড়ে। বোমাটি মর্নিং নিউজ পত্রিকা ভবনের সীমানাদেয়ালের গেটে বিস্ফোরিত হয়। অন্য দলটি খিলগাঁও বাজারে সমবেত শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর হামলা করে। এতে দুজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।
প্রতিরক্ষা বিবেচনায় মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটির পাশে পাত্রখোলা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। স্থানটি দখল করার জন্য বড় একটি পরিকল্পনা করা হয়। অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। পাত্রখোলা চা–বাগানে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী এ দিন একের পর এক আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাত্রখোলার দুই মাইল দক্ষিণে কাট-অফ পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল পাত্রখোলার দিকে এগোতে থাকলে তারা প্রবল বাধা দেয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয়। ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।
পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল ধলইয়ের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাত্রখোলার দিকে এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দল ধলই-পাত্রখোলা সড়কের মাঝামাঝি স্থানে অ্যামবুশ করে। সেই ফাঁদে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৮ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন মেহেরপুরের ষোলটাকা অঞ্চলে হামলা করে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করেন। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দর্শনা, কোটচাঁদপুর এবং কামেদবপুরে পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে। এসব যুদ্ধে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৩০ অক্টোবর – ফ্রান্স-সোভিয়েত যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশ
পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান হবে বলে ৩০ অক্টোবর যৌথ ঘোষণায় আশা প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণায় এটি বলা হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি রক্ষার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে দুই নেতা সম্মত হন। শরণার্থীদের কারণে ভারত সরকারের সমস্যার বিষয়টিও যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের ছয় দিনের ফ্রান্স সফরে ওই যৌথ ঘোষণা আসে।
যুক্তরাজ্যের একটি মহল এই দিন লন্ডনে সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাজ্য সফরকে ঘিরে দুটি বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনতা এবং ভারতে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন।
লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে এ দিন বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
ম্যানচেস্টার, লিডস, বার্মিংহাম, এক্সেটার, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদল সম্মেলনে যোগ দেয়। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোর এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ছাত্রসংগঠনের নেতারা অধিবেশনে বক্তব্য দেন। অধিবেশনের একটি পর্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা করেন রেহমান সোবহান ও আজিজুর রহমান খান।
আন্তর্জাতিক ভারত সহায়ক সমিতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতে আসা বাংলাদেশের শরণার্থীদের ত্রাণকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কিছুটা অংশ তারা মেটানোর চেষ্টা করবে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরের উত্তরে অ্যামবুশ করে পাকিস্তানের টহল দলের কয়েকজনকে হতাহত করেন। দলটি পরে মালিবাগ ও কমলাপুরে রাজাকারদের ওপর হামলা করলে চারজন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল লালবাগের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে স্থানীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক এবং তার একজন সহযোগী নিহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর গৌরীনগর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনা ও রাজাকাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এরপর গৌরীনগর পৌঁছান। গোলাগুলির শব্দে সালুটিকর থেকে পাকিস্তানিদের একটি সাহায্যকারী দল এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীনগর ছেড়ে আসেন। এই সংঘর্ষে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর ১১ জন হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমারপুর সেতু ধ্বংস করতে এসে পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয়কে আসতে দেখে তাদের অ্যামবুশ করেন। এতে দুটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত ও কিছু সেনা হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দিন সকালে বিলোনিয়ার ভারতীয় অংশে গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়। এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রাগপুর ও দর্শনা থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে নির্বিচার গোলা ও গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন শরণার্থী আহত হয়।
ভারতে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রধান
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পি এস কুতাকোভের নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রতিনিধিদল ছয় দিনের ভারত সফরে দিল্লি এসে পৌঁছায়।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির সঙ্গে এই সফরের যোগ রয়েছে। তারা ভারতে বিমান আক্রমণের সম্ভাবনা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখবে। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আসা বিশেষজ্ঞদের নাম গোপন রাখা হয়।
মুজিবনগরে একটি ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিমান সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ কথা বলেন। তিনি জানান, মুক্তিবাহিনী হেলিকপ্টার ও বিমান এবং মুক্তাঞ্চলে কিছু বিমান অবতরণক্ষেত্র পেয়েছে। এসব শত্রুদের অবস্থান নির্ণয়, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবহন এবং তাঁদের রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের সংখ্যা কম হলেও কাজে লাগছে।
৩১ অক্টোবর – ইন্দিরা-হিথের আলাপ বাংলাদেশ নিয়ে
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
ব্রিটেন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তাঁরা দুজনই আলোচনায় একমত হন যে পাকিস্তানের শাসক এবং বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতাদের নিয়েই বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। এ জন্য কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানকে রাজি করাতে হিথ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আশ্বস্ত হতে চান।
আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা, ভারতে শরণার্থীদের বোঝা, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের নেতাদের ধারণা এখন অনেকটা স্পষ্ট।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশ সংকটের জরুরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইন্দিরা ও হিথ দুজনই পুরোপুরি একমত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য মনে করছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে দেরি করলে পাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বালিসিয়ামে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলবে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট নাকচ করে দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচি বহাল রাখতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তিনি উপদেষ্টাসহ রিপাবলিকান নেতাদের সঙ্গে আলাপে কর্মসূচিটি বহাল রাখার জোরালো দাবি জানান।
যুক্তরাজ্যে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেনও ছিলেন। আবদুল মোমেন বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সমর্থন দিতে আবদুর রাজ্জাককে অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগোলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে থাকলেও তাঁর দলের মুসলিম সদস্যদের বিরোধিতার ফলে তা পারেননি।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন রাতে সার্কুলার রোডে নির্বাচন কমিশন অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযান চালানোর আগে তাঁরা বেসামরিক লোকদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।
পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থেকে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে একই সেক্টরের চাপিতলার মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এসে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দিনব্যাপী যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর কটেশ্বর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার পশ্চিমে সাহেববাড়ীতে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন হতাহত হয় এবং তিনজন আত্মসমর্পণ করে।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ধর্মদহে একদল পাকিস্তানি সেনাকে অ্যামবুশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।
রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় এই দিন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আয়োজিত সভায় বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দানসহ জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দাবি করা হয়। কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম মধ্যপ্রদেশে এক জনসভায় বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছু করবে না। কিন্তু পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানের মাটিতে। এর আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর অনুষ্ঠানেও তিনি বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে ভারত আক্রান্ত হলে বা এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অবশ্যই যুদ্ধ করবে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১৯ অক্টোবর – ইয়াহিয়ার সঙ্গে মীমাংসা নয়
স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসবে না। একজন বাঙালি জীবিত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বড় শক্তিগুলোর দান হিসেবে নয়, বাঙালিরাই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তাতে তিনি খুবই আশাবাদী। মুক্তাঞ্চলে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য বাছাই করা গেরিলা এবং বাংলাদেশ বাহিনীতে সম্প্রতি কমিশন পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের নায়ক ও রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি রাষ্ট্রের নেতাকে আটকে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
ইন্দিরা গান্ধীর সংবাদ সম্মেলন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইয়াহিয়া খান নাকি আলোচনার জন্য উদ্গ্রীব। কিন্তু তাঁকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে নয়। হয়তো তার ভিত্তি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সমস্যা বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে। এখানে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। ভারত এই বিরোধের কারণে যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সেটা হলো ৯০ লাখ শরণার্থীর বোঝা। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো অস্ত্র ও শক্তি নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে জ্বলছে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্পৃহা। দেশপ্রেম যাদের হাতিয়ার, পরিণামে তারাই বিজয়ী হয়।
ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করছে পাকিস্তান। ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। ধর্মীয় মতান্ধতাকে উসকানি দিচ্ছে। এসব উপেক্ষা করে কি ভারতীয় বাহিনীকে সতর্ক অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব? যিনি ঘুষি পাকিয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে কি করমর্দন করা চলে?
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনের কথাই বলছেন। বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই মেটাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সীমান্তে সেনা সমাবেশের ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, সংযত থাকার অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তিক্ত করেছে মাত্র।
রাও ফরমান আলীর স্বীকারোক্তি
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১৯ অক্টোবর এএফপির প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন, মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, জুন-জুলাইয়ের তুলনায় নাশকতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। এসব কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে গেরিলা আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চা-বাগানগুলোতে। পাকিস্তানি সেনারা নিরাপত্তা জোরদার করলে তারা ব্যক্তিগত হামলায় নামে এবং পাটের সরবরাহে আক্রমণ চালায়। তিনি বলেন, দক্ষিণের জেলাগুলোতে গেরিলা নাশকতার পরিমাণ বেশি।
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, পাকিস্তানের সামরিক সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন পরিকল্পনা করছে। বর্ষা শেষ হলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুবিধা হবে বলে তারা ভাবছে।
বিভিন্ন সামরিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্তে প্রায় আড়াই লাখ এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৮০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে।
ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমা ফাটান। এতে পাকিস্তানি সেনাসহ কিছু সাধারণ মানুষও হতাহত হন।
পরদিন ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘বেলা অনুমান ১১টায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাস্থ হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সম্মুখে বোমা বিস্ফোরণের ফলে ৫ ব্যক্তি নিহত ও ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের সম্মুখে পার্ক করা ৬টি মোটরগাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়াছে। ইহা ছাড়া আরও ১৯/২০টি মোটরগাড়ি ও ৮ তলা হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের কাঁচের সার্সি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।’
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার মিয়াবাজার ও পান্নাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালান। আকস্মিক এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার, মেশিনগান ও এলএমজির সাহায্যে যশোর জেলার ঝিকরগাছার গোয়ালহাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনাদলটি ছুটিপুর থেকে বিশাহারীর দিকে যাচ্ছিল। তারা অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
২০ অক্টোবর – আওয়ামী লীগের সভা যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
মুজিবনগরে ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সকাল ১০টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শপথ নিয়ে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিবেদন করা যোদ্ধা ও দেশবাসীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ জন সদস্য তাঁর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বক্তব্য দেন।
সভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি একাধিক প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ২১ অক্টোবর।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাড়াতে সভায় আলোচনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও আলোচনা হয়।
উ থান্টের উদ্বেগ
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানাতে ২০ অক্টোবর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর দেন এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহির সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। পরিস্থিতি যাতে আর খারাপ না হয়, সে জন্য উ থান্ট তাঁদের অনুরোধ জানান।
ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী ও ভাবুক আঁদ্রে মালরো এই দিন বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, এর ফলে তাঁর বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার অধিকার আসবে।
নিউইয়র্ক টাইমস এ দিন তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, বাতাসে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছে। এ প্রসঙ্গে দিল্লির একজন মুখপাত্রের সতর্কবাণীকে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে গেরিলাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার চলছে। বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর সেনাদের অত্যাচার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ রোধে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
ভারত ও যুগোস্লাভিয়া ইশতেহারে সতর্কবাণী
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনা শেষে যুক্ত ইশতেহারে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানের প্রশ্নটি স্থগিত রাখা হলে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই এই সমস্যার একমাত্র মীমাংসা। এর ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র দিল্লিতে এই যুক্ত ইশতেহার প্রচার উপলক্ষে সাংবাদিকদের বলেন, ভারত প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে। বিশ্বসমাজ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে ভারতকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা কত দিনের মধ্যে, তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি।
এই যুক্ত ইশতেহারকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
ভারতে পূর্ব জার্মানির কনসাল জেনারেল এইচ ফিশার কলকাতায় বলেন, বাংলাদেশের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা করে পাকিস্তানকে এ সমস্যা মেটাতে হবে। এ সমস্যার যথাযথ সমাধানে শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।
কলকাতার সল্টলেকে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সনাতন ধর্মের শরণার্থী নারীরা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফোঁটা দিয়ে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
গেরিলা অভিযান
ঢাকা অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল ২০ অক্টোবর মতিঝিলে স্টেট ব্যাংক ভবনের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) পাঁচতলায় টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে আসবাব ও কাগজপত্রে আগুন ধরে যায়, তবে কেউ হতাহত হয়নি। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ অক্টোবরও মতিঝিলে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানিরা মতিঝিলসহ শহরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। এই জোরালো নিরাপত্তার মধ্যেই গেরিলাদের একের পর এক অভিযানের ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে রঘুনাথপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করেন। তারা পাটবোঝাই একটি ট্রাক পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত এবং পাটবোঝাই ট্রাকটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়।
২১ অক্টোবর – মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে মুক্তিবাহিনী
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে একজন মুখপাত্র ২১ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং সুনামগঞ্জের ছাতক শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের পর স্থির করেছে, পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে তারাও প্রতিটি সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধ করবে। গেরিলা অভিযানও চলবে। সম্মুখযুদ্ধের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। মুখপাত্র বলেন, গত এক সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বহু শত্রুসেনা নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ৬০০ এবং বহু অস্ত্র অধিকারে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ২০০ জন পাকিস্তানি সৈন্যও আটক করেছেন। তাঁদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে ৪৫০ জন রাজাকার।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দ্বিতীয় দিনের সভা এই দিন গভীর রাত পর্যন্ত চলে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সেসব জানানো হবে।
শরণার্থীদের নিয়ে পুস্তিকা
বাংলাদেশের শরণার্থীদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে ২১ অক্টোবর অক্সফাম ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদ ও সাংবাদিকের বিবরণ তাতে প্রকাশ করা হয়। অক্সফামের পরিচালক লেজলি কার্কলি বলেন, পুস্তিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, যুক্তরাজ্যের সংসদ এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া নানা দেশের প্রতিনিধিদের কাছে পুস্তিকাটি বিতরণ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট এদিন ‘উপমহাদেশে যুদ্ধের হুমকি’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কে বক্তারা পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জোরালো বক্তব্য দিলেও কেউ তা কার্যকর করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। সম্পাদকীয়তে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে লজ্জাকর বলে অভিহিত করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল এদিন চারটি আলাদা স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল ফেনীর ছাগলনাইয়ার মির্দ্দারবাজারে পাকিস্তানের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। দ্বিতীয় দলটি মির্দ্দারবাজারের কাছাকাছি দক্ষিণ যশপুরে কাট অব পার্টি হিসেবে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলটি অ্যামবুশের মধ্যে মির্দ্দারবাজারে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলের আক্রমণের মুখে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি টহল দলের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে একদল পাকিস্তানি সেনা ছাগলনাইয়া থেকে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে মির্দ্দারবাজারে রওনা দেয়। পাকিস্তানি সেনাদলটিকে দক্ষিণ যশপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। মির্দ্দারবাজার ও দক্ষিণ যশপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি ফেনীর ফুলগাজী থানা সদর এলাকায় অ্যামবুশ করলে আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদলের দুজন নিহত ও তিনজন আহত হয়। চতুর্থ দল ভারত সীমান্তের কাছে আমজাদহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। পাঁচজন রাজাকার নিহত এবং একজন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা নগরে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যায় খিলগাঁও হাইস্কুলের পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার ওপর আক্রমণ করে। রাজাকাররা পাল্টা প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ফোরকে খিলগাঁও হাইস্কুল ভস্মীভূত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলের একটি উপদল রাতে শাহজাহানপুর হাইস্কুলের পাশে টহলরত রাজাকারদের আরেকটি দলকে আক্রমণ করে। রাজাকাররা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া বিস্ফোরকে শাহজাহানপুর হাইস্কুল ভস্মীভূত হয়।
৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীর মনোহরদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন নিহত ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি মধ্যে তিনটি দল তিনটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। চতুর্থ দলটি পাকিস্তানিদের অ্যামবুশে পড়ে। প্রথম দলটি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কাছে রেললাইনে মাইন পেতে একটি বিশেষ ট্রেন অ্যামবুশ করে। ট্রেন অ্যামবুশের আওতায় আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের বিস্ফোরণ ঘটান। এতে বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়। দ্বিতীয় দলটি মেহেরপুরে হামলা করে একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। তৃতীয় দলটি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের হাসিমপুরে মিলিশিয়া ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে রাতে আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়। চতুর্থ দলটি মধুখালী গ্রামের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা বিপদে পড়েন। এখানে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাবে না
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ঘোষণা করেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতের সমরপ্রস্তুতি সামান্যও শিথিল করা হবে না।
ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন প্রতিমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা দিল্লিতে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ। ১৯৬৫ সালের পর সমরাস্ত্র উৎপাদনে ভারতের সর্বাত্মক অগ্রগতি ঘটেছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এখন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ওয়াশিংটন সফরে ইন্দিরার আলাপের মূল বিষয় থাকবে বাংলাদেশ। এর আগে ইউরোপেও তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী জি সাইস্কিন ও অস্টিয়ার চ্যান্সেলর কেইস্কির সঙ্গে একই বিষয়ে কথা বলবেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনের জন্য ৭৮টির মধ্যে ৭৫টি আসনে ১৯২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ১৪টি আসনে প্রার্থী একজন করে। বাকি ৬১ আসনে প্রার্থী ১৭৮ জন। ১৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। বাকি ৩টি আসনে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা হলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, খান এ সবুর খান, ইউসুফ আলী (মোহন মিয়া), আবদুল আলীম প্রমুখ।
২২ অক্টোবর – একমাত্র সমাধান সম্পূর্ণ স্বাধীনতা
মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনের বৈঠক শেষে ২২ অক্টোবর এক প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এই প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সব দেশ ও জাতিসংঘকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানানো হয়।
শরণার্থীদের ব্যাপারে এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ সব শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয়, এতে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনব্যাপী সভা ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভা পরিচালনা করেন। কমিটির ৫৪ জন সদসে৵র মধে৵ ৪২ জন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও সভায় ছিলেন।
জাপানি পত্রিকায় ইয়াহিয়াকে ভর্ৎসনা
জাপানের জনপ্রিয় দৈনিক আসাহি সিম্বুন এবং ইয়োমিউরি সিম্বুন–এ এদিন পূর্ব বাংলায় অব্যাহত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে। কাগজ দুটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন—এই তিন বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আসাহি সিম্বুন বলে, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ইয়োমিউরি সিম্বুন বলে, উপমহাদেশে শক্তিসাম৵ বদলে যাওয়ার শঙ্কায় বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গের গণহত্যা দেখতে চাচ্ছে না।
দিল্লি অভিমুখে শান্তিপদযাত্রা
বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জনমত গঠনে দিল্লির দিকে এদিনও শান্তিপদযাত্রা চলে। যাত্রীরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের স্বাগত জানান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্রসংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে পদযাত্রার জন্য দলটি গঠিত হয়। নেতৃত্ব দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল খালেক। ১৪ অক্টোবর তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকির পটভূমিতে দিল্লিতে সন্ধ্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ফিরুবিনের আকস্মিক দিল্লি সফরের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি। তিনি ভারতকে সংযত থাকার অনুরোধ জানাবেন। পাকিস্তানকেও তাঁরা একই কথা বলছেন।
ভারতের ১১ জন সাংসদ এক খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং কংগ্রেসের সদস্যদের প্রতি এক আবেদনে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সমবেত চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে কামান আক্রমণ চালান। প্রায় ১০ মিনিট গোলাবর্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।
এই অভিযানের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান কসবায় বোমাবর্ষণ করে। এই বিমান আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতাহত না হলেও বহু বেসামরিক লোক নিহত হন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা হরিসরদার বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা গভর্নর হাউসের (বর্তমানে বঙ্গভবন) কাছে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড (তখন এর অবস্থান ছিল বঙ্গভবনের সামনের পার্কের পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ পাশে) এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং কয়েকজন সাধারণ নাগরিক আহত হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিলির ভারতীয় অংশে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করলে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ৬ নম্বর সেক্টরের হিলির মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এরপর পাল্টা বোমা বর্ষণ করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় তাঁর দল এখন শুধু পাকিস্তানের বৃহত্তম দল নয়, জাতীয় পরিষদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।
২৩ অক্টোবর – মুক্তিযুদ্ধে গোপনে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র
লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ২৩ অক্টোবর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করতে গোপনে ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার যে প্রবল আশঙ্কা তারা করছে, সেটি এড়ানো। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আসন্ন চীন সফর বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকানো।
কূটনৈতিক সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশের কিছু নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারিভাবে যোগাযোগ করেছে। যোগাযোগ করার উদ্দেশ্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা বলানোর চেষ্টা করা।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বিচারাধীন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাঠামোর মধে৵ স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নেবেন, এই শর্তে ইয়াহিয়া বোঝাপড়ায় প্রস্তুত ছিলেন। তবে শেখ মুজিব নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া তাই শেষ পর্যন্ত সাড়া দেননি।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এই দিন কামান ও মর্টার নিয়ে কসবা ও নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মাইলখানেক উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর কালীর বাজার ঘাঁটিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন ভোরে নীলফামারীর খড়িবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণের জন্য সমবেত হন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রামনগর নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করলে দুই পক্ষে তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও তিনজন আহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মাগুরার মহম্মদপুরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করেন।
১১ নম্বর সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কালিহাতীর চারান নামক স্থানে মিলিশিয়া ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দলের ওপর হামলা করলে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তানে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর রওনা হওয়ার আগে এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আওতায় সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, এমন যেকোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পার্টি নির্বাচনী জোট গঠনের জন্য আলোচনায় রাজি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি মাহমুদ আলী ঢাকায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে পিপিপির পক্ষে বিস্ময়কর কিছু করা কল্পনাবিলাস মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে পিপিপির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই।
জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে আরও তিনজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮। ৭৮টি আসনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর মোট প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০১। এর মধ্যে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৬০টি আসনে প্রার্থী এখন ১৮৩ জন।
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তথ্যমন্ত্রী মুজিবুর রহমানসহ আরও ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লেখকদের সমর্থন
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজে৵র রাজধানী কলকাতায় এদিন এক সমাবেশে লেখকেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। বসুমতী পত্রিকা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। পত্রিকাটির দীপাবলি সংখ্যায় যেসব কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশিত হয়, তাঁরা তাঁদের লেখক সম্মানী মুক্তিযুদ্ধের জন্য দান করেন। ওই সমাবেশের সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর কাছে সম্মানীর টাকা (চেক) তুলে দেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন মনোজ বসু। বাংলাদেশের সাহিত্যিক শওকত ওসমান অনুষ্ঠানে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার ভাষণে বলেন, দেশ এখন বিপদের মুখে। প্রতিরক্ষা বাহিনী ও জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। এই বিপদের সময় দরকার ঐক্য ও শৃঙ্খলা। তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সরকারের পাশে থাকার আহ্বান জানান।
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও দিল্লির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি এবং বাংলাদেশের সংকট নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। ফিরুবিন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
২৪ অক্টোবর – কূটনৈতিক সফরে ইন্দিরা গান্ধী
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন।
এটি ছিল ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পকে৴ ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ–হুমকি নিয়ে কথা বলা। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ইন্দিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা বিদেশি নেতাদের বোঝাতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে বলবেন।
তবে পশ্চিমা মহল মনে করছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের নেতাদের সমাধানে আসতে রাজি করাতে ইন্দিরা গান্ধী সক্ষম হবেন। তাঁরা এ–ও ভাবছিলেন, ইন্দিরা এ ধরনের ভূমিকা নেবেন না কিংবা বাংলাদেশের সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবেও দেখাতে দেবেন না।
জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সরকারকে বাধ্য করতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি পত্রিকা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক দখলদারি রাজত্বের নিন্দা করা হয়।
লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, ৯০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের জীবনধারণের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইন্দিরার তিন সপ্তাহের বিশ্ব সফরকালে চলবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না–ও হতে পারে। বিশ্বশান্তি অক্ষুণ্ন রাখতে হলে শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনী
মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় মোজাফফরপন্থী ন্যাপ অভিমত প্রকাশ করে, বাংলাদেশের একমাত্র সমাধান পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সমর্থন জানিয়ে সভায় সর্বস্তরে এমন কমিটি গঠনের প্রত্যাশা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
৮ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার সাদীপুর, তীতুদহ ও বেড়াশুলাসহ কয়েকটি স্থানে এদিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল সকাল ১০টার দিকে ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাদীপুরের অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করেন। এরপর দুই পক্ষে বহুক্ষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
চুয়াডাঙ্গার সদর থানার তীতুদহ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সেনা ও কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঝিনাইদহ মহকুমার সদর থানার অন্তর্গত বেড়াশুলা গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে প্রায় ১১ জন রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে মিসরের রাজধানী কায়রোয় রওনা হন। ভুট্টো মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। দুই দিন কায়রোয় অবস্থানের পর তিনি জেনেভায় যাবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে রাত আটটায় ভারতের ত্রিপুরা রাজে৵র রাজধানী আগরতলায় গোলাবর্ষণ করলে পাঁচজন বেসামরিক লোকসহ ২০ জন আহত হয়। সেখানে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলাকালে শহর ও আশপাশে কতগুলো গোলা পড়ে। এই প্রথম কোনো রকম প্ররোচনা ছাড়াই পাকিস্তানিরা আগরতলা শহরে গোলাবর্ষণ করে। প্রায় ১০ মিনিট গোলা বর্ষিত হয়। করিমপুরেও পাকিস্তানিরা গোলাবর্ষণ করে।
২৫ অক্টোবর – বেলজিয়াম ইতিবাচক বাংলাদেশ নিয়ে
বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।
বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
ভারত আক্রমণাত্মক হবে না
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে বক্তৃতাকালে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যাকে আক্রমণাত্মক কাজ বলা যেতে পারে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে।
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে আলোচনা করেন।
পক্ষত্যাগ বাঙালি কূটনীতিকের
মিসরের রাজধানী কায়রোয় পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি প্রধান ফজলুল করিম ২৫ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাবেন।
পাকিস্তানি পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই দিন দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক তাঁকে সহায়তা করবেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে উপদেষ্টা ছিলেন। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন।
ফ্রান্সের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি এ দিন একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। ইশতেহারে বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের রায়কে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ইশতেহারে চারটি প্রস্তাব রাখা হয়: ১. জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো, ২. রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা, ৩. পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করা, এবং ৪. পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। গেরিলাদের ছোড়া বোমা বিস্ফোরণে রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। হতাহতদের মধ্যে সাধারণ নাগরিকও ছিলেন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কাজলায় একটি কারখানায় অবস্থানরত রাজাকারদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন। বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সাবদালপুর ও আনসারবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী প্রায়ই ওই রেলপথে চলাচল করত। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিন গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়েছিলেন, ওই দিন ট্রেনযোগে পাকিস্তানিদের একটি বহর যাবে। খবর পেয়ে তাঁরা দুই স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে রাখেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরণ ঘটে এবং তিনটি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।
১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জের অন্তর্গত কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
২৬ অক্টোবর – সোভিয়েত-কানাডা যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আট দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। বাংলাদেশ সমস্যার জরুরি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দুই দেশ আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত হতে অনুরোধ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে সংগত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশে৵ গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।
দুজন নোবেল বিজয়ীসহ ফ্রান্সের ৮০ জনের বেশি বিশিষ্ট নাগরিক এই দিন দেশটির সরকারের কাছে এক ইশতেহারে পাকিস্তানকে অবিলম্বে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার আহ্বান জানান। নোবেল বিজয়ীরা হলেন পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রে কাস্তলে এবং অণুজীববিজ্ঞানী আঁদ্রে লোফ। লেখক, সাংসদ ও ধর্মীয় নেতারা এই ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন।
বেলজিয়াম সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলসে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব শান্তিতে আগ্রহী বিশ্বের সব দেশের। তিন দিনের বেলজিয়াম সফর শেষে অস্ট্রিয়ায় যাত্রার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ইন্দিরা বলেন, ভারত আলোচনার ওপরই জোর দিচ্ছে। তবে আলোচনায় কিছু ভিত্তি থাকা দরকার। পূর্ববঙ্গে কিছু ঘটনার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অথচ কষ্ট ভোগ করছে ভারত।
মিসরের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসা পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক ফজলুল করিম লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতির প্রতিবাদে তিনি কাজে ইস্তফা দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে কয়েকটি স্থানে এই দিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সীমান্তবর্তী কসবা ছাড়াও কায়েমপুর, সালদা নদী, নয়নপুর ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায় মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২৭ অক্টোবর ইত্তেফাক ‘কসবায় ভারতীয় গোলাবর্ষণ অব্যাহত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন সীমান্ত এলাকার গোয়ান ও রাউত গ্রামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংসের অভিযানে যান। সেতু দুটি পাহারায় ছিল রাজাকারদের একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররা আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। দু-তিন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।
এই দিন ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলে কিছু রাজাকার অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৭ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা দর্শনা থেকে সাত মাইল দূরে আন্দুলবাড়িয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় পাকিস্তানিদের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরিত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরে আরও কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন। একটি দল যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছার গদখালী-নাভারন অংশে সড়কের পাশে টেলিফোন লাইন ধ্বংস করলে যশোর–বেনাপোল টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে। আরেকটি দল বাগআঁচড়ায় আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ঝিনাইদহের বেথুলী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৬৫ জনের দলটি অ্যামবুশের আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণও করে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই দিন কিছু রাজাকার চীনা অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৮ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এক বুলেটিনে এই দিন বলা হয়, কয়েক দিন আগে একদল নৌ মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনের কয়রায় বিস্ফোরকের সাহায্যে পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশনের লানশিয়া নামে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। রংপুর অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা লালমনিরহাট-মোগলহাটের মধ্যবর্তী এলাকায় রেললাইন তুলে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে।
২৭ অক্টোবর – সমাজতান্ত্রিক দেশের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীতে
দিল্লি ও কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র ২৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ইউরোপের তিনটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। দুই মাস ধরে এসব অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর কাছে আসছে। সম্প্রতি সরবরাহও বেড়েছে। প্রথম দিকে এসেছিল খুব হালকা অস্ত্র। এখন ভারী অস্ত্রশস্ত্র আসতে শুরু করেছে। এসব অস্ত্রের কিছু টাকা দিয়ে কেনা, কিছু সাহায্য হিসেবে পাওয়া।
পাকিস্তান সরকার এসব অস্ত্র সরবরাহের তথ্য জানার পর বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রকে বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। তারা এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ। কিছুদিন ধরে ইসলামাবাদ হয়ে কলকাতায় আসা কূটনীতিকদের কারও কারও মতে, এর পেছনে দুটি কারণ আছে: ১. সে ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের সব দায় ভারতের ওপর চাপানো যাবে না। ২. তাহলে বিশ্ব এবং দেশবাসীর কাছে স্বীকার করতে হবে, কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য দিচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর এই দিন কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ক্রমশ সাফল্য অর্জন করছে। তাদের দ্রুত জয় সুনিশ্চিত। দুই দিন ধরে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর তিনি এই মন্তব্য করেন।
মুজিবনগরে এদিন আবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শুরু হয়। সভায় দলের সাংগঠনিক প্রশ্ন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অসমাপ্ত থাকে।
বার্তা সংস্থা এপি পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াকিবহাল মহলের সূত্র উদ্ধৃত করে এদিন জানায়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যার্থে ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ ফুটবল দলের ১৮ জন খেলোয়াড় এদিন মুজিবনগর থেকে বোম্বাইয়ের পথে রওনা হন। দলের নেতৃত্ব দেন জাকারিয়া পিন্টু।
মার্শাল টিটোর সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ২৭ অক্টোবর এক টিভি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ এবং এর শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রশ্নটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরের আগে সিবিএস টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হিসেবে বাংলাদেশ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দেন।
অস্ট্রিয়ায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স জোনাস এবং চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রাইস্কির সঙ্গে আলোচনা করেন। এ আলোচনায় তাঁরা বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পান। তাঁরা সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ব্রুনো ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা রাওয়ালপিন্ডি অফিস থেকে পাঠানো এক রিপোর্টে বলে, ২৬ অক্টোবর পাকিস্তান-ভারত সংকট নিরসনে বিশ্ব শক্তিবর্গের উদ্বেগ, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের মধ্যস্থতার প্রস্তাব, কয়েকজন পাকিস্তানি নেতার বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির সুপারিশ এবং কিছু সংবাদপত্রের খবরে আরেকটি তাসখন্দ সম্মেলন অনুষ্ঠানের আভাসের প্রেক্ষাপটে এ সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উদ্বেগ সামান্য কমেছে। শেখ মুজিবের মুক্তির ফলে স্বাভাবিক