নভেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১ নভেম্বর – ভারত ও যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১ নভেম্বর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম দেখা করেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আগের দিনের আলোচনার ধারাবাহিকতায় তাঁরা ঘণ্টাখানেক কথা বলেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা শুরু করতে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করাতে যুক্তরাজ্য আরেকবার চেষ্টা করবে বলে ভারতকে আভাস দিয়েছে। তবে ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট করে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেই কেবল স্থায়ী মীমাংসা সম্ভব। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত থেকে সেনা অপসারণ করা হবে না।
ব্রিটেন এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে অর্থবহ আলোচনা ইসলামাবাদ ও শেখ মুজিবের মধ্যেই হতে পারে। এ বৈঠকের পর বাংলাদেশের দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজন যুক্তরাজ্য মেনে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনায় শেখ মুজিবের আশু মুক্তির দাবিও জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে দুটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। অথচ বিশ্বের কিছু রাষ্ট্র ইসলামাবাদের এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সে দেশের মানুষেরাই নির্ধারণ করবেন। গত বছর যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল, সেখানে আবার নির্বাচন নিছক প্রহসন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে যে মূলনীতি জড়িত, তা থেকে বিশ্ব দূরে থাকতে পারে না।
এর আগে ইন্দিরা গান্ধী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। সাংবাদিকদের তিনি প্রশ্ন করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে কি চার্চিল হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন? বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য উ থান্টের প্রস্তাব তিনি সরাসরি অগ্রাহ্য করেন।
পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা
লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ১ নভেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাদের অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকায় একাধিক সরকারি ভবনে উপর্যুপরি গেরিলা আক্রমণ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি রাজধানীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অবস্থিত।
গেরিলা আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তা খুঁটি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানের (পিআইএ) বোয়িং বিমানগুলো এখন পথ ছেড়ে যথাসম্ভব জলপথের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে, বিমানের আলোকসংকেতও জ্বালানো হচ্ছে না।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এ দিন দুটি আলাদা অভিযান চালায়। একটি দল সন্ধ্যায় কাকরাইলে একটি পেট্রলপাম্পে বোমা ছোড়ে। অন্য দলটি বেলা ১১টার দিকে শান্তিনগরে একটি ব্যাংকে অভিযান পরিচালনা করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে যশোরের ঝিকরগাছার গৌরপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালালে কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর তারা পালিয়ে যায়। এরপর ওই এলাকায় আর ফিরে আসেনি।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার অন্তর্গত গোলদড়িতে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। প্রায় ১৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যায়।
মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বিমান দিয়েই পাকিস্তানি বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ করবে; তবে অসামরিক ব্যক্তিদের যাতে ক্ষতি না হয়, সে জন্য সেনানিবাস ও পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর ওপরই বোমা ফেলা হবে।
চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবে
ইয়াহিয়া খান সাপ্তাহিক নিউজউইক-এর ১ নভেম্বর সংখ্যায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ আসন্ন। যুদ্ধ হলে চীন পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, খেয়ালখুশিমতো আমি তাঁকে মুক্তি দিতে পারি না।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা বাঙালি মাহমুদ আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি দেখে বোঝা যায় যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সন্নিকটে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীসংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে যে সংকট চলছে, তা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নীতি পাল্টানো এবং শান্তি রক্ষার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা উচিত।
সংকটের জন্য তিনি পাকিস্তানকে দোষারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৩০০ শিশু মারা যাচ্ছে। নতুন বৈদেশিক সাহায্য বিলে কংগ্রেস কোনো অর্থ মঞ্জুর না করলে তিনি শরণার্থী ত্রাণের জন্য ২৫ কোটি ডলার মঞ্জুরের জন্য একটি বিল পেশ করবেন।
জাতিসংঘের দুটি কমিটিতে ২ নভেম্বর বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক হয়। ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সামাজিক, মানবিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক তৃতীয় কমিটিতে পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতির তীব্র সমালোচনা করে। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় জাতিবৈষম্য নীতি অনুসরণ করছে। ভারতের প্রতিনিধি বি পি দাস এই বক্তব্য দেন।
এর আগে পাকিস্তানে প্রতিনিধি ফাতেমা সাদেক এই কমিটিতে বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারত আগ্রহী নয়। তাদের অবিরাম হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রকট হয়েছে। ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ করছে।
বিশেষ কমিটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবৈষম্য নীতির নিন্দা করে যে আলোচনা হয়, সেখানেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ওঠে। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, বাংলাদেশে যেখানে জনসাধারণ গৃহচ্যুত, গ্রামগুলো বিধ্বস্ত, হাজার হাজার নারী-শিশু অনাহারে মৃত্যুমুখে, সেখানে শুধু সহানুভূতি প্রকাশ করে মানুষের বিবেক ক্ষান্ত থাকতে পারে না।
মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী এই দিন মুজিবনগরে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মনোবল অটুট। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটে যেতেই হবে এবং সেটা আসন্ন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খাওয়ার কারণে ভারত আক্রমণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মাঝামাঝি এলাকায় রাতে অ্যামবুশ করেন। ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০ জনের একটি দল টহলে বেরিয়ে ফেনী-বেলুনিয়া রেললাইন দিয়ে একটি ট্রলিতে করে সেখানে উপস্থিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। আকস্মিক এ আক্রমণে একজন লেফটেন্যান্টসহ সবাই নিহত হয়।
গোলাগুলির শব্দ পেয়ে ফুলগাজী থেকে ৪০-৪৫ জন পাকিস্তানির একটি রিইনফোর্সমেন্ট দল এগিয়ে আসে। দলটি রেললাইনের পূর্ব-পশ্চিম দিক এবং রেললাইনের সমান্তরাল বেলুনিয়া-ফেনী সড়কে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এবারও তাদের ওপর আক্রমণ করলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার কাইমপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে মর্টার হামলা চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও চারজন আহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মইনপুরে অ্যামবুশ করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে শান্তি কমিটির স্থানীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। অভিযানে স্থানীয় শান্তি কমিটির এক সদস্য নিহত হয়।
৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের জুড়ী থানার লাঠিটিলায় একটি সেতুর পাশে অ্যামবুশ করেন। ভোরে একদল পাকিস্তানি সেনা অ্যামবুশ এলাকায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
১১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা শেরপুরের শ্রীবর্দী থানায় ভায়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা মোংলা বন্দরে লিমপেট মাইনের সাহায্যে দুটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
আরও কূটনীতিকের পক্ষত্যাগ
সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব ওয়ালিউর রহমান ২ নভেম্বর পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ওয়ালিউর রহমান এর আগে সুইজারল্যান্ডে পাকিস্তান মিশনের ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।
জাপানের পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন বাঙালি কর্মকর্তা প্রেস অ্যাটাশে এস এম মাসুদ এবং তৃতীয় সচিব এম এ রহিম এই দিন ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অমানবিক নির্যাতন বরদাশত করতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা জানান।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের ১১ জন বাঙালি কর্মীর মধ্যে ১০ জন এদিন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। হাইকমিশন ভবন থেকে তাঁরা সপরিবার পালিয়ে বাইরে আসেন। হোসেন আলী নামের একজন আসতে পারেননি। পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক করে রাখে। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়েও আটক ছিলেন, তবে তাঁর দুই ছেলে পালিয়ে আসে।
পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মীদের হাইকমিশন ভবন থেকে বেরিয়ে আসার খবর পেয়ে দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং তাঁর দুই সহকর্মী ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে চূড়ান্ত ঘোষণা সাপেক্ষে ৫৫ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রদেশে জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আসনগুলোতে ৫৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত থেকে চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ-টাকি সীমান্তে বিস্তৃত প্রায় ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করে। তারা শিকারপুর, বয়রা ও ভোমরা এলাকায় বারবার গোলাবর্ষণ করলে ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়।
৩ নভেম্বর – সোভিয়েত বিমানবাহিনী প্রধানের ভারত ত্যাগ

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পাভেল কুতাকভ পাঁচ দিনের ভারত সফর শেষে ৩ নভেম্বর মস্কো উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে তাঁর এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সত্যি সত্যি এ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত বিমানবাহিনী ভারতকে কী ধরনের সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে আলাপ হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল ধারণা দেয়। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুম্যান এই দিন বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক মীমাংসায় আসার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান।
৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর বিশেষ সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের ঢাকা থেকে পাঠানো এক সংবাদে বলা হয়, ৪০ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। শহরাঞ্চলে তাঁরা দিনে অন্তত ২০ জন করে পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করেছেন। জনসমর্থনপুষ্ট গেরিলাযোদ্ধারা তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছেন।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরে দুপুরবেলা দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলির ফলে দুজন পাকিস্তানি সেনা, একজন পুলিশ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।
প্রতি রাতে পুরান ঢাকায় দীর্ঘ গোলাগুলি এবং বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। পাকিস্তানি এক সামরিক কর্মকর্তা টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতাকে বলেন, দুই মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জোয়ারের পানির মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকেসদ্য পক্ষত্যাগকারী কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান
সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জেনেভায় তিনি একটি বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র খুলবেন।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে আটক একজন বাঙালি কর্মীর মুক্তির দাবিতে সেই হাইকমিশনের সামনে কয়েকজন বাঙালি দিনব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট করেন। ধর্মঘটকারীদের মধ্যে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে আগের দিন পালিয়ে আসা বাঙালি কর্মীরাও ছিলেন। তাঁরা পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ৩ নভেম্বর জানানো হয়, মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের দখল থেকে মুক্ত করেছে। মুক্তিবাহিনী কটিয়াদী, ইটনা, অষ্টগ্রামসহ কয়েকটি থানায় আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে বহু পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ ও রাজাকার হতাহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গত এক সপ্তাহে ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল এবং তিনজন পাঠান সেনা ও ৫৩ জন রাজাকারকে বন্দী করেছেন। ঢাকার মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে মুক্তিবাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।
১ নম্বর সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোদের পাতা লিমপেট মাইন বিস্ফোরণের ফলে পাকিস্তানি তেলবাহী জাহাজ মাহতাব জাভেদ নিমজ্জিত হয়। জাহাজের কয়েকজন নাবিকও হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীর আশপাশে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে ঢাকার সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি জেনারেটর ধ্বংস করে দিলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ আশপাশের এলাকা সাময়িকভাবে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
এই সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ঢাকার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালান। একটি দল দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টন এলাকায় জোনাকী সিনেমা হলের পূর্ব পাশের পলওয়েল মার্কেটে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে ঢুকে প্রহরীকে নিরস্ত্র করে অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের ১৮ হাজার ৪৫৫ টাকা লুটে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় দলটি বেলা সাড়ে ১১টায় মৌচাকে ইউনিয়ন ব্যাংকে অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৯৩১ টাকা লুট করে। তৃতীয় দল শাহজাহানপুরে শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর অভিযান চালিয়ে তিন-চারজনকে হতাহত করে। চতুর্থ দল আরমানিটোলার কাছে অভিযান চালায়।
৮ নম্বর সেক্টরে গণবাহিনী ও ইপিআর সেনার সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লেফটেন্যান্ট অলীক গুপ্তের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) নেতৃত্বে ভোরের দিকে যশোরের চৌগাছার সীমান্তঘাঁটির সামনে অ্যামবুশ পাতে। সকাল নয়টা থেকে পাকিস্তানের একটা টহল দলের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
তাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে চৌগাছা সীমান্তঘাঁটি থেকে আরও পাকিস্তানি সেনা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। খবর পেয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ইপিআরের একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
কড়া পাহারা এড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের চারটির মধ্যে তিনটি জেনারেটর বিধ্বস্ত করে দিলে ঢাকার চারপাশের শিল্পাঞ্চলগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।
৪ নভেম্বর – ইন্দিরা ও নিক্সনের বাংলাদেশ সংলাপ
যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের দুজনের আলোচনায় নানা প্রসঙ্গ এলেও বেশি প্রাধান্য পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিভিন্ন দিক এই আলোচনায় উঠে আসে।
প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনার বেশির ভাগ সময় তাঁদের সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ সাহায্য এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর তার প্রভাব আলোচনায় গুরুত্ব পায়।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষা এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য তাঁরা ইয়াহিয়াকে যথাসম্ভব চাপ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রেই বাঙালি-হনন চলছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা নয়। এটা বাংলাদেশবাসী ও ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের বিরোধ। সমাধান তাদেরই খুঁজতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাব উপেক্ষা করে ভারতের পক্ষে সেনা প্রত্যাহার করা কঠিন।
ইন্দিরা গান্ধী এ দিন যুক্তরাষ্ট্র সফররত অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদভাবে জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, সিনেট বৈদেশিক সাহায্য বিল বন্ধ করে দেওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে।
আন্তর্জাতিক একটি বার্তা সংস্থা ওয়াশিংটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অভিমত নিয়ে খবর পরিবেশন করে। খবরে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান অস্ত্র সংগ্রহের জন্য চীন ও রোমানিয়ায় জাহাজ পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশ সরকার এ দিন দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে আটক বাঙালি কর্মী হোসেন আলী ও তাঁর পরিবারের মুক্তির জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের চেয়ারম্যান এবং দিল্লির কূটনৈতিক কোরের ডিনের কাছে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানায়।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। একটি দল সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের বাসায় হামলা করে। দ্বিতীয় দল শান্তিবাগে পাকিস্তানের আরেক সক্রিয় সহযোগীর বাড়িতে অভিযান চালায়। এ অভিযানে চারজন নিহত হয়। তৃতীয় দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাঁচতলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ভোরে একসঙ্গে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের আড়পাড়া সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল সহায়তা করে। এ যুদ্ধে কয়েকজন সেনা ও মিলিশিয়া হতাহত হয়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।
এই সেক্টরে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে নেত্রকোনার বারহাট্টায় হামলা করেন। স্থানীয় মানুষও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে থানা মুক্ত হয়। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর নতুন একটি দল এসে থানা পুনর্দখল করে।
পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি
৪ নভেম্বর পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান। ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের জন্যও তাঁরা অনুরোধ করেন। লাহোরে এই বিবৃতি প্রচার করা হয়। ইয়াহিয়া এ দিনই তিন দিনের সফরে লাহোরে আসেন।
বিবৃতিদাতারা বলেন, পাকিস্তানের উদ্ভূত তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করার সেরা পথ গণতান্ত্রিক সরকার গঠন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে তা ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, পাকিস্তান টাইমস-এর সাবেক সম্পাদক মাজহার আলী খান প্রমুখ এতে স্বাক্ষর করেন।
যুক্তরাজ্যে সংগীতায়োজন
কলকাতায় এ দিন জানানো হয়, বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে যুক্তরাজ্যের নানা অঞ্চলে ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি’ শিরোনামে বাংলা গানের অনুষ্ঠান হবে। লন্ডনের স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটারে ১৪ নভেম্বর এ অনুষ্ঠান শুরু হবে। ইউরোপের কয়েকটি শহরেও সংগীতের আয়োজন করা হচ্ছে। এ সফর হবে চার সপ্তাহব্যাপী। অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা, মোশাদ আলী, শাহ আলী সরকারসহ দুই বাংলার শিল্পীরা। শিল্পীরা ৬ নভেম্বর লন্ডন যাত্রা করবেন।
৫ নভেম্বর – বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানো যাবে না

যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালে ভারতীয় ছাত্র সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাকিস্তানি সামরিক চক্র পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চাইলেও সেখানকার সাধারণ মানুষ গেরিলাদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। স্বাধীনতার স্পৃহাকে হত্যা করা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তাঁর দেশ যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। প্রায় ৭০ মিনিট আলাপের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুই দিনের আলোচনা শেষ হয়।
ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গেও আলোচনা করেন। নিক্সন ও রজার্স—দুজনকেই তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য সূত্রেই রাজনৈতিক সমাধান পেতে হবে।
সুইডেনের ৩৬০ জন সাংসদের মধ্যে ২৮০ জন এ দিন বাংলাদেশের সংকটমোচনে প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান। তাঁদের আবেদনপত্র স্টকহোমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে দেওয়া হয়।
ভারতের স্বীকৃতি শিগগিরই
মুজিবনগরে সরকারি একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ভারত সরকার শিগগিরই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে। সরকারি মুখপাত্র বলেন, একটি সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তিনটি দিক বিবেচনা করা হয়—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ ও সরকার—তার তিনটিই বাংলাদেশের আছে। উপরন্তু এ সরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত। তাঁরা আভাস পেয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ সফর শেষে ফেরার পর এ ব্যাপারে সরকারি ঘোষণা হতে পারে।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, গেরিলারা ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গেরিলাদের হাতে পাকিস্তানি সেনা হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সালদা নদীতীরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করেন। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বিত এ দলটি কাছে আসতেই তাঁরা আক্রমণ চালান। অতর্কিত এ আক্রমণে কয়েকজন হতাহত হয়।
এই সেক্টরের ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নটর ডেম কলেজের পাশে বোমা ফাটান। এতে কলেজসংলগ্ন সেতু এবং বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গেরিলাদের আরেকটি দল নারায়ণগঞ্জের কাছে হামলা করলে শান্তি কমিটির দুজন সদস্য নিহত হয়। অন্য আরেকটি দল চকবাজারে আক্রমণ চালায়। এতে একজন নিহত ও দুজন আহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ধর্মদহে রাজাকারদের ঘিরে ফেললে তারা কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করে। একপর্যায়ে চারজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
এই সেক্টরের অন্য এক দল মুক্তিযোদ্ধা দেবীনগরে রাজাকারদের অবস্থানে অতর্কিতে হামলা করলে দুজন নিহত হয়।
বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য
পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত মর্নিং নিউজ পত্রিকার সাবেক সহযোগী সম্পাদক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্ব রাষ্ট্রগোষ্ঠী স্বীকার করুক বা না করুক, বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সব রাষ্ট্রের তা স্বীকার করে নেওয়া উচিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় কলকাতায় এক আলোচনা সভায় বলেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তিনি সফল না হলে শরণার্থীদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে।
আদি কংগ্রেস বলেছে, ভারত সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশ ও এর সরকারকে স্বীকৃতি দিক। কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সভাপতি সাদিক আলী এ দাবি জানান।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ৫ নভেম্বর হঠাৎ চীনে যায়। সেখানে তারা চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে।
ইসলামাবাদে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত উপমহাদেশে শান্তি রক্ষায় উৎসাহী। পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি তাঁর সমর্থন আছে। এ কথা তাঁরা পাকিস্তানকে জানিয়েছেন।
৬ নভেম্বর – জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি ৬ নভেম্বর মুজিবনগরে দীর্ঘ বৈঠক করে।
সেখানে তারা আবারও সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের আর কোনো রফা হতে পারে না। বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবের রূপরেখা স্থির হয়। এটিই ছিল কমিটির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
মুজিবনগরে একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখায় কয়েক সপ্তাহ ধরে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে আলোচনা কার্যত বন্ধ।
পাকিস্তান সরকার তাঁকে সব কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রেখেছে। দূতাবাসের আরও চারজন বাঙালি কর্মীর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এদিন সাংবাদিকদের জানানো হয়, মেহেরপুরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে বিরাট অঞ্চল এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী সকালে পাকিস্তানি সেনাদের যাদবপুর ঘাট ও বুড়িবাকা থেকে উচ্ছেদ করে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও জানানো হয়, ভারতের নদীয়ায় বানপুর সীমান্তে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছে। এই যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে।
এদিন সকালে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তসংলগ্ন ছয়টি ভারতীয় গ্রামে বেপরোয়া গুলি চালালে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা পাল্টা জবাব দেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল মতিঝিলে পিআইএ অফিসে অভিযান পরিচালনা করে।
তাদের বোমা বিস্ফোরণে অফিসের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেক দল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগে পাকিস্তানিদের এক সহযোগীর ওপর হামলা করে।এই সহযোগী নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সাদীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর আক্রমণ চালান।
ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর এই দল সাদীপুরে পরিখা খোঁড়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে হামলা করলে তিনজন হতাহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের রাজাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এর আগে তাঁরা জয়রামপুর-চুয়াডাঙ্গার মধ্যবর্তী রেললাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
ফেনী–বিলোনিয়া রেললাইনের কাছাকাছি ৫ নভেম্বর রাত ১২টার পর বৃষ্টিতে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন এয়ার আহমদসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) একদল মুক্তিযোদ্ধা। ভোরে কমে আসা বৃষ্টিতে অনেকেই তন্দ্রাচ্ছন্ন।
এমন সময় রেলসড়কে ট্রেন চলার শব্দ। এক ক্যাপ্টেন চার জওয়ানকে নিয়ে রেলট্রলিতে করে বেরিয়েছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের খোঁজে। তারা চিথলিয়ার দিকে আসছিল।
নাগালে এলেই গর্জে ওঠে হালকা মেশিনগান। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় ওই পাঁচ পাকিস্তানি। দুঃসাহসী এয়ার আহমেদ ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ব্যাজ আর ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র আনতে ছুটে গেলে শত্রুর গুলি তাঁকে আর ফিরতে দেয়নি।
উপনির্বাচন নিয়ে সন্দেহ
পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন ন্যায়সংগতভাবে হয়েছে কি না, তা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সংবাদপত্রগুলো এদিন সন্দেহ প্রকাশ করে। জুলফিকার আলীর ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) ছয়জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেভাবে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন, করাচির ডন পত্রিকার ঢাকার সংবাদদাতা তাকে রহস্যজনক বলে বর্ণনা করেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছয় দলীয় জোটের একজন সর্বসম্মত প্রার্থী (পিডিপির সদস্য) পিপিপি প্রার্থীর পক্ষে সরে দাঁড়ান।
লাহোরের আরেকটি দৈনিক আজাদ ছয়জন প্রার্থীর জয় নিয়ে তদন্ত দাবি করে।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং নির্বাচন সম্পর্কে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজনের কথাও তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন।
নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারের সংখ্যা আরও বাড়াতে এবং তাদের আরও বেশি করে অস্ত্র দিতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওখানে অন্তর্ঘাত বেড়ে গেছে।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি এই দিন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেওয়া এক প্রস্তাবে বলে, দুই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সীমান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তারা দাবি করে, ভারত অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিক এবং সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করুক।
চারদিন ধরে নানা আলোচনার পর এদিন কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশন শেষ হয়।
সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও চণ্ডীগড়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে না দিয়ে ইন্দিরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র দেবে
যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়সহ বহু দেশ তাদের অস্ত্র সাহায্য করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারণে ভারতে উদ্ভূত পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে আন্তরিক চেষ্টাও চলছে। তবে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সমানভাবে জানতে পারছেন কি না সন্দেহ।
ওয়াশিংটনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার কোনো প্রস্তাব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
ভারতে পরিদর্শক দল পাঠানোর ব্যাপারে জাতিসংঘের প্রস্তাবও তিনি সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই পাকিস্তান সরকার সংকটের অবসান ঘটাতে পারে। আর কোনো পথ খোলা নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য এবং পার্টির মস্কো কমিটির প্রধান ভি ভি গ্রিসিন ক্রেমলিন প্রাসাদে বিপ্লব দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, প্রচণ্ড গণ–অত্যাচারের কারণে ৯০ লাখের বেশি লোক পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন।
৭ নভেম্বর – পাকিস্তানের পক্ষে চীনের অবস্থান
চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি ৭ নভেম্বর দেশটিতে সফররত পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সম্মানে বেইজিংয়ে আয়োজিত এক সরকারি ভোজসভায় বাংলাদেশ সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, সংহতি ও অখণ্ডতার কথা মনে রেখে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পাকিস্তান নিজেই এই ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই উপস্থিত ছিলেন।
রেডিও পাকিস্তান পরিবেশিত খবরে ওই ভোজসভায় চি পেং ফির বক্তৃতার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, বিদেশ থেকে আক্রমণ হলে পাকিস্তানকে চীন সমর্থন করবে।
চীন সফররত পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীন-পাকিস্তান আলোচনার কারণে এশিয়ায় আক্রমণের আশঙ্কা দমিত হবে। ভারতের হুমকি এমন গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করা পাকিস্তানের জন্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ইন্দিরার জনসংযোগ
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের দেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে এই দিন প্যারিসে পৌঁছান। প্যারিস সফরকালে তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু, প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাস এবং ফরাসি ভাবুক ও সাবেক মন্ত্রী অঁদ্রে মালরোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ভারত সফররত সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের নেতা ভি কুভারিয়াভয়েত দিল্লিতে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলির দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে।
যুক্তরাজ্যে বৃহত্তর লন্ডন এলাকার বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত ১৪টি অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হয়ে গ্রেটার লন্ডন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন। ৩০ জন প্রতিনিধি ও দর্শক সভায় যোগ দেন। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচির সমন্বয় এবং প্রস্তাবিত জাতীয় সম্মেলন সফল করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার মুরাদনগরের চাপিতলায় ৭ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই দিনব্যাপী যুদ্ধ চলে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা চাপিতলায় প্রতিরক্ষা তৈরি করে সেখানে অবস্থান নিতে থাকেন। খবর পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের সেনা সমন্বয়ে গড়া একটি বড় দল মুক্তিযোদ্ধাদের চাপিতলা অবস্থানের দুর্বল দিকে আক্রমণ করে। এই অবস্থায় পাকিস্তানিদের বিভ্রান্ত করার জন্য পি–৮০ গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূম্রকুণ্ডলী সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান থেকে পিছু হটে যান। পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। রাতে তারা আবার মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা ততক্ষণে বেশ সংগঠিত। পরদিন দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এই যুদ্ধে দুজন জুনিয়র কর্মকর্তাসহ পাকিস্তানিদের অনেক সেনা হতাহত হয়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরের বিলোনিয়া অঞ্চলে এদিন সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। রাতে তা আরও তীব্র হয়। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে দুবার বিমান হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকায় তারা মিডিয়াম মেশিনগান দিয়ে স্যাবরকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। পাকিস্তানি একটি বিমানে গুলি লেগে সেটি কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় ভূপাতিত হয়। ওই রাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীও জবাব দিতে থাকে। পরে দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে তারা পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে প্রায় ১৫ জনকে হতাহত করে। দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এ ছাড়া কাইমপুর এলাকাতেও দুই পক্ষের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল এই দিন নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে। এই লক্ষ্যে তারা নদীর ওপারে বন্দর থানার নবীগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এই গেরিলা যোদ্ধাদের আরও দুটি দলের একটির অভিযানে নারায়ণগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য সুলতান উদ্দিন খান এবং শান্তি কমিটির সদস্য আমীর হোসেন নিহত হন। অন্য দলের অভিযানে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হাজি সাহেব আলী নিহত হন।
নরসিংদীর গেরিলারা শিবপুর থানায় পাকিস্তানপন্থীদের ওপর হামলা করলে একজন আহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহীর শাহপুর সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে আক্রমণ করলে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হলে বাকিরা মহানন্দা নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার ধোপাখালীতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়।
৮ নভেম্বর – ইন্দিরার ইতিবাচক আলোচনা ফ্রান্সে

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ৮ নভেম্বর সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় বলেন, পূর্ববঙ্গ সংকটের মূল রাজনৈতিক। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলেই এর সমাধান করতে হবে। নইলে ভারত উপমহাদেশে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির ঝড় বয়ে যাবে।
ভোজসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গে যা ঘটছে, তা গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সমস্যার এমন রাজনৈতিক সমাধান দরকার, যা পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে। তা হলেই তা কার্যকর হবে।
ইন্দিরা গান্ধী আলাদা করেও প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু এবং প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী সেবান দেলমাস তাঁকে বলেন, ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং তাঁর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কানাডা সরকারের প্রতিনিধিদের আলোচনা শেষে এই দিন এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতির যাতে আর অবনতি না হয়, বিশ্বের তা দেখা উচিত। ইশতেহারে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, সমাধান বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবি ও অধিকারের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া ৩৬ লাখ ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে। তবে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানকে শুধু এই যন্ত্রাংশগুলোই দেওয়া হবে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ৪ নভেম্বর ওয়াশিংটন পৌঁছানোর আগেই ইন্দিরা গান্ধীকে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ইন্দিরার ওয়াশিংটন সফরের পর এই খবর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্তেজনা কিছুটা দূর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকেও কিছুটা শান্ত করবে। কারণ, কংগ্রেস পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পাকিস্তান সরকারের জ্ঞাতসারেই এটি করা হয়েছে। ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের বেইজিংয়ে ছুটে যাওয়ার এটাই সম্ভবত কারণ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে সফল অভিযান
নারায়ণগঞ্জে অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ধ্বংস করে।
২ নম্বর সেক্টরের অধীন গেরিলাযোদ্ধারা ঢাকা শহরের কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালান। একটি দল এ দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। অপর দল ঢাকা কলেজের ভেতর বোমা ফাটায়। আরেকটি দল আরমানীটোলায় বাওয়ানি একাডেমিতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
১ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা রামগড়-করেরহাট সড়কে পাকিস্তানের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করেন। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণে হেঁয়াকুতে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটির সেনারা ফটিকছড়ির দিকে পিছু হটে। হেঁয়াকু বাজার মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এ দিন বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। প্রথম দলটি ঘুনাথপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তিনজন হতাহত হয়। দ্বিতীয় দল সাদীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দল মেহেরপুরের গাংনীর ভারত-সীমান্তবর্তী কাথুলীতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করে। দুই পক্ষের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত হয়।
চীন হস্তক্ষেপ করবে
পাকিস্তানের বার্তা সংস্থা পিপিআই জানায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সিবিএসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে।
চীন সফর শেষে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এ দিন বিকেলে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহল এ দিন সাংবাদিকদের জানায়, ভুট্টোর চীন সফরের ফলাফল সরকারি মহলে নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে। ভুট্টোর সফরের ফল নিয়ে দুই রকম মত প্রকাশিত হচ্ছে। এক দলের ধারণা, পাকিস্তান-চীন আলোচনা মোটেই সফল হয়নি। হলে একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হতো। অন্যদের মতে, চৌ এন লাই এবং অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চে ফেং পির বিবৃতিতে পাকিস্তানের মনোবল চাঙা হয়েছে এবং ইসলামাবাদ তার প্রচারণায় বিবৃতিটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।
ভুট্টোর চীন সফর নিয়ে এ দিন দ্য টাইমস-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, বেইজিং ছাড়া আর কোনো রাজধানীতে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য প্রতিনিধি না পাঠানোয় বোঝা যায়, পাকিস্তানের অবস্থান খুব দুর্বল। ভুট্টো তাঁর ব্রিফকেসে সরকারি বিবৃতির কপি না নিয়ে বেইজিং ত্যাগ করায় মনে হচ্ছে, চীন এখনো পাকিস্তানকে সরাসরি সাহায্য দেওয়া সম্পর্কে মনস্থির করেনি।
ভুট্টোর চীন সফরের সংবাদ ইন্দিরা গান্ধীকে স্বস্তি দেবে বলে সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়।
৯ নভেম্বর – ভারতের কাছাকাছি অবস্থান ফ্রান্সের
ফ্রান্স ৯ নভেম্বর ভারতকে জানায়, বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবস্থান ভারতের খুবই কাছাকাছি। ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ফ্রান্স কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করবে।
সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রী দেলমাসের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে ফ্রান্স উৎকণ্ঠা জানায়।
ফরাসি সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান এবং অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চায়।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুর সঙ্গেও ইন্দিরার আলোচনা হয়। তিনিও জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দেশটির সিনেটে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করার জন্য যেসব অস্ত্রশস্ত্র ইতিমধ্যেই জাহাজে তোলা হয়েছে, সেগুলোও বন্ধ করা উচিত।
পূর্ব বাংলার উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মচারী আলী আহমদ এদিন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য জানান।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা নগরী এবং এর আশপাশে অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন ঢাকা নগরীর সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আরেকটি গেরিলা দল ঢাকার গেন্ডারিয়া স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এই সেক্টরের বিলোনিয়া অঞ্চলে ৯ নভেম্বরও সারা দিন যুদ্ধ হয়। বিকেলে তিনটি পাকিস্তানি বিমান মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে বোমাবর্ষণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হন। তবে মুক্তিবাহিনী তাদের একটি অবস্থান পাকিস্তানিদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করে। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর চিতলিয়া দখল করেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের রাজাপুরে রাজাকারদের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করলে দুজন নিহত এবং চারজন বন্দী হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
বেইজিংয়ে উচ্চপর্যায়ের পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে ফিরে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন। গতকাল তিনি ফিরেছেন।
শরণার্থীদের সাহায্য ও পুনর্বাসন সম্পর্কে আলোচনার জন্য ইসলামাবাদে এসে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলাপ করেন।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন এদিন ঘোষণা করে, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসনের উপনির্বাচনে ৫৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জন জামায়াতে ইসলামী, ১২ জন পিডিপি, ২০ জন মুসলিম লীগ, ৬ জন নেজামে ইসলামী ও ৫ জন পিপিপির প্রার্থী।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের বিশেষ সামরিক আদালত এক রায়ে ১৩ জন সিএসপি, ৪২ জন ইপিসিএস কর্মকর্তা ও ৪ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রত্যেককে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়।
সাজাপ্রাপ্ত অধ্যাপকেরা হলেন মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী ও আবদুর রাজ্জাক, খান সারওয়ার মুরশিদ এবং মযহারুল ইসলাম।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মাওলানা মওদুদির সঙ্গে বৈঠক শেষে ঘোষণা করেন, দেশের দক্ষিণপন্থী দলগুলো জোট গঠনে রাজি। শিগগিরই সম্মিলিত ঘোষণা দেওয়া হবে।
ভারতে যা ঘটল
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) কে সি পন্থ দিল্লিতে বলেন, বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে নতুন পর্যালোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
তিনি সফর শেষে ফিরে এলেই পর্যালোচনা হবে। পন্থ বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার মূল কথাটি অনেকেই বুঝতে পেরেছেন এবং এর রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনও স্বীকার করেছেন। পন্থ বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দু-তিন মাস খুবই সংকটপূর্ণ সময়।
ভারতে সফররত সোভিয়েত সংসদীয় দলের নেতা কুদরিয়াতসেভ বাংলাদেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দিল্লিতে বলেন, কোনো না কোনো প্রকারে বৃহৎ শক্তিকে জড়িয়ে বিশ্বের কাছে আরেকটি ভিয়েতনাম বা পশ্চিম এশিয়া এখন অসহনীয়।
পাকিস্তান একা হয়ে যাবে
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ৯ নভেম্বর সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হলে পাকিস্তান একা, পরিত্যক্ত ও নিন্দিত হয়ে পড়বে।
ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ইয়াহিয়া খানের বিপরীতে বয়ে চলেছে। যুদ্ধ বাধলে ভারতের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে নতুন প্রচেষ্টা না নেওয়া পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বহির্বিশ্বে ক্রমেই সমর্থনহীন হয়ে পড়বেন।
ভুট্টোর চীন সফরের উদ্দেশ্য সফল হয়নি বলে মনে হচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদায় এক নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার সঙ্গে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের।
পাকিস্তানের চরমপন্থী কিছু লোক বর্তমান অবস্থার জন্য ভারতকে দোষী করতে এবং সংঘর্ষ বাধাতে আগ্রহী।
মালয়েশিয়ার জাকার্তা টাইমস সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাম্প্রতিক চীন সফর পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমর্থনের যে প্রতিশ্রুতি ভারত পেয়েছে, তার তুলনায় পাকিস্তানের কাছে চীনের প্রতিশ্রুতি অনেক কম।
- বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০৯-১৬ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )
- বাংলাদেশের অগ্নিঝরা মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২৮-৩১ )
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২০-২৭ )
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ১০-১৯ )
- বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ০১ – ০৯ )
- মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ ৫০০০ ছবি উন্মুক্ত করলো
- কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি -পত্র [ amarnazrul ]