নভেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

নভেম্বর মাস ১৯৭১  , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

Table of Contents

নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

১ নভেম্বর – ভারত ও যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর

 

যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১ নভেম্বর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম দেখা করেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আগের দিনের আলোচনার ধারাবাহিকতায় তাঁরা ঘণ্টাখানেক কথা বলেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা শুরু করতে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করাতে যুক্তরাজ্য আরেকবার চেষ্টা করবে বলে ভারতকে আভাস দিয়েছে। তবে ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট করে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেই কেবল স্থায়ী মীমাংসা সম্ভব। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত থেকে সেনা অপসারণ করা হবে না।

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পাভেল কুতাকভ পাঁচ দিনের ভারত সফর শেষে ৩ নভেম্বর মস্কো উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে তাঁর এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সত্যি সত্যি এ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত বিমানবাহিনী ভারতকে কী ধরনের সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে আলাপ হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল ধারণা দেয়। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেন।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুম্যান এই দিন বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক মীমাংসায় আসার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান।

 

ইন্দিরা ও নিক্সনের বাংলাদেশ সংলাপ

 

যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের দুজনের আলোচনায় নানা প্রসঙ্গ এলেও বেশি প্রাধান্য পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিভিন্ন দিক এই আলোচনায় উঠে আসে।

প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনার বেশির ভাগ সময় তাঁদের সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ সাহায্য এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর তার প্রভাব আলোচনায় গুরুত্ব পায়।

ওয়াকিবহাল মহল জানায়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষা এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য তাঁরা ইয়াহিয়াকে যথাসম্ভব চাপ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর

যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালে ভারতীয় ছাত্র সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাকিস্তানি সামরিক চক্র পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চাইলেও সেখানকার সাধারণ মানুষ গেরিলাদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। স্বাধীনতার স্পৃহাকে হত্যা করা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তাঁর দেশ যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। প্রায় ৭০ মিনিট আলাপের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুই দিনের আলোচনা শেষ হয়।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর

 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি ৬ নভেম্বর মুজিবনগরে দীর্ঘ বৈঠক করে।

সেখানে তারা আবারও সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের আর কোনো রফা হতে পারে না। বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবের রূপরেখা স্থির হয়। এটিই ছিল কমিটির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।

মুজিবনগরে একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখায় কয়েক সপ্তাহ ধরে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে আলোচনা কার্যত বন্ধ।

পাকিস্তান সরকার তাঁকে সব কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রেখেছে। দূতাবাসের আরও চারজন বাঙালি কর্মীর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি ৭ নভেম্বর দেশটিতে সফররত পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সম্মানে বেইজিংয়ে আয়োজিত এক সরকারি ভোজসভায় বাংলাদেশ সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানান।

তিনি বলেন, সংহতি ও অখণ্ডতার কথা মনে রেখে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পাকিস্তান নিজেই এই ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই উপস্থিত ছিলেন।

রেডিও পাকিস্তান পরিবেশিত খবরে ওই ভোজসভায় চি পেং ফির বক্তৃতার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, বিদেশ থেকে আক্রমণ হলে পাকিস্তানকে চীন সমর্থন করবে।

চীন সফররত পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীন-পাকিস্তান আলোচনার কারণে এশিয়ায় আক্রমণের আশঙ্কা দমিত হবে। ভারতের হুমকি এমন গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করা পাকিস্তানের জন্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ৮ নভেম্বর সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় বলেন, পূর্ববঙ্গ সংকটের মূল রাজনৈতিক। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলেই এর সমাধান করতে হবে। নইলে ভারত উপমহাদেশে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির ঝড় বয়ে যাবে।

ভোজসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গে যা ঘটছে, তা গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সমস্যার এমন রাজনৈতিক সমাধান দরকার, যা পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে। তা হলেই তা কার্যকর হবে।

চীন হস্তক্ষেপ করবে

পাকিস্তানের বার্তা সংস্থা পিপিআই জানায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সিবিএসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে।
চীন সফর শেষে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এ দিন বিকেলে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহল এ দিন সাংবাদিকদের জানায়, ভুট্টোর চীন সফরের ফলাফল সরকারি মহলে নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে। ভুট্টোর সফরের ফল নিয়ে দুই রকম মত প্রকাশিত হচ্ছে। এক দলের ধারণা, পাকিস্তান-চীন আলোচনা মোটেই সফল হয়নি। হলে একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হতো। অন্যদের মতে, চৌ এন লাই এবং অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চে ফেং পির বিবৃতিতে পাকিস্তানের মনোবল চাঙা হয়েছে এবং ইসলামাবাদ তার প্রচারণায় বিবৃতিটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।

ভুট্টোর চীন সফর নিয়ে এ দিন দ্য টাইমস-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, বেইজিং ছাড়া আর কোনো রাজধানীতে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য প্রতিনিধি না পাঠানোয় বোঝা যায়, পাকিস্তানের অবস্থান খুব দুর্বল। ভুট্টো তাঁর ব্রিফকেসে সরকারি বিবৃতির কপি না নিয়ে বেইজিং ত্যাগ করায় মনে হচ্ছে, চীন এখনো পাকিস্তানকে সরাসরি সাহায্য দেওয়া সম্পর্কে মনস্থির করেনি।
ভুট্টোর চীন সফরের সংবাদ ইন্দিরা গান্ধীকে স্বস্তি দেবে বলে সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়।

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব নভেম্বর ( ০১-০৯ )

 

ফ্রান্স ৯ নভেম্বর ভারতকে জানায়, বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবস্থান ভারতের খুবই কাছাকাছি। ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ফ্রান্স কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করবে।

সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রী দেলমাসের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে ফ্রান্স উৎকণ্ঠা জানায়।

ফরাসি সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান এবং অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চায়।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুর সঙ্গেও ইন্দিরার আলোচনা হয়। তিনিও জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দেশটির সিনেটে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করার জন্য যেসব অস্ত্রশস্ত্র ইতিমধ্যেই জাহাজে তোলা হয়েছে, সেগুলোও বন্ধ করা উচিত।

পূর্ব বাংলার উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মচারী আলী আহমদ এদিন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য জানান।

Leave a Comment