নভেম্বর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
২৮ নভেম্বর – নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে বিতর্ক
মুজিবনগরে একটি মহল ২৮ নভেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমা কিছু দেশ তৎপর। ভারত উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার যে প্রস্তাব তুলতে চায়, তাতে ইতালি যোগ দিয়েছে। জাপানকেও তারা টানতে চাইছে। কিন্তু জাপান চায়, বৃহৎ শক্তিরা নেপথ্যে তৎপর হয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুক।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সমস্যার অজুহাতে বৃহৎ শক্তিদের অথবা নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ানোর চেষ্টা করা হলে তারা বিরোধিতা করবে। তারা বারবার বলেছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং এর দুই পক্ষ হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য কয়েকটি দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান সপ্তাহব্যাপী মুক্তাঞ্চল সফর শেষে মুজিবনগরে ফিরে বলেন, তিনি সেখানে প্রশাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগের তালিকা কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানান।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্সের ছোটখেল এলাকায় এদিন জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানির কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধা ভোরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করেন। প্রথাগত যুদ্ধের নিয়মে আক্রমণে তিন গুণ যোদ্ধা প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সতীর্থদের লাশ ফেলে দ্রুত রাধানগরের দিকে চলে যায়।
সকালে পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) আহত হন। পাকিস্তানিদের উপর্যুপরি আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবের কয়েকটি স্থান ও জয়পুরে দেওয়া ভাষণে বলেন, কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এর আগে ভারত তিনবার পাকিস্তানের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্টভাবে বলেনি যে ভারত আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কাছে সুবিচার আশা করা যায় না।
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য জ্যোতি বসু কানপুরে বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে তাঁর দল সরকারকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাবে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন। পূর্ব বাংলার বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জ্যোতি বসু চীনের এই অভিমতের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ কলকাতায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে পূর্ব বাংলায় যা চলছে, তাতে পাকিস্তান সেটিকে হারাতে বাধ্য হবে। পাকিস্তানের উভয় অংশের ঐক্য আর কল্পনাও করা যায় না। শরণার্থীরা জন্মভূমিতে ফিরে গেলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
পশ্চিমা মনোভাবের নিন্দা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মনোভাবের তীব্র নিন্দা করে। প্রাভদার অভিযোগ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার উপেক্ষা করে পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে। প্রাভদায় আরও বলা হয়, পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং সংরক্ষিত সেনাবাহিনীকে তলব করে গোটা পরিস্থিতি জটিলতর করে তোলা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্সের খবরে এদিন বলা হয়, পাকিস্তানকে তার স্বীকৃত অন্যায় থেকে বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তানকে এক কোঠায় ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আবার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভারত, পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে অভিন্ন বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ যাতে না বাধে, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে; পূর্ব বাংলায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনা সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে এবং সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সেনা সরিয়ে নিতে হবে।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন আবার রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। গত তিন দিনে এ নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়া দুবার বৈঠক হয়। ভুট্টো জানান, প্রেসিডেন্ট তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ অবহিত করেছেন।
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র এদিন প্রথমবারের মতো স্বীকার করে। পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে বলে একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন। যদিও পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের গণযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না বলে সেই মুখপাত্র মন্তব্য করেন।
২৯ নভেম্বর – ইন্দিরাকে নিক্সনের বার্তায় প্রতিক্রিয়া

ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ২৯ নভেম্বর সকালে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি দেন। নিক্সন ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানকে চিঠিতে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনকেও নিক্সন এক চিঠিতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়েছেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর দিল্লি সংবাদদাতার খবরে বলা হয়, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো প্রস্তাব করা হয়নি বলে নিক্সনের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান উপেক্ষা করা হবে বলে ধারণা করা হয়।
ভারত সরকারের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানই প্রথম সেনাসমাবেশ শুরু করেছে বলে দিল্লি তার মনোভাব বদলায়নি। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বেলজিয়ামের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার প্রস্তাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও দ্বিধায়। প্রস্তাবের ব্যাপারে ভারত বেলজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
দিল্লি থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর বিশেষ সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বেলজিয়ামের প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, পরিষদের অধিবেশনে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
পাশ্চাত্যের দেশ সফরকালে ইন্দিরা বলেছেন, উপমহাদেশের বর্তমান সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে লাভ নেই। পাকিস্তান এ পর্যন্ত তিনবার ভারত আক্রমণ করলেও নিরাপত্তা পরিষদ স্পষ্ট ভাষায় তা কখনো বলেনি।
রাধানগরের যুদ্ধ
সিলেটের রাধানগরে দুপুর থেকে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা ও আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সদস্যসহ রাধানগরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ করার কথা ছিল। তা না হওয়ায় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) তাঁর কোম্পানি এবং আলফা ও গণবাহিনী সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ করেন। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে যায়।
রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা ছোটখেলে তীব্র আক্রমণ করে বসে। প্রবল আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণের পর রাত ১২টায় পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগরের দিকে এগিয়ে যান। রেডিও পাকিস্তান রাতের খবরে রাধানগর কমপ্লেক্সের পতনের কথা স্বীকার করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের ভারত সীমান্তবর্তী সামরিক গুরুত্বপূর্ণ নাভারন মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোয় আক্রমণ করে একটু একটু করে এগোতে থাকেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান এদিন পূর্ব পাকিস্তানে ভারত সীমান্ত বরাবর পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে নোট পাঠায়। ইয়াহিয়া খান স্বাক্ষরিত নোটটি সকালে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির হাতে দেন।
পাকিস্তানে সফররত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওসমান ওলেকজাস রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বলেন, প্রয়োজনে তুরস্ক পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।
অধিকৃত বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে শেখ মুজিবকে মার্জনা করতে তারা এক তারবার্তায় ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়। বিচার সম্পকে৴ কমিশন পাকিস্তানকে কিছু প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট উত্তর দিতে বলে।
পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সংসদে নীতিসংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরোধ জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে কি না, তা এখনো ঠিক হয়নি।
জাতিসংঘের একটি সূত্র জানায়, ভারত বা পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ না জানালে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসার সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
চীনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লিয়েন আলবেনিয়া সফরকালে এক অনুষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তান-ভারত বিরোধ মীমাংসা করার আহ্বান জানান।
৩০ নভেম্বর – ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস: ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩০ নভেম্বর শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে সেনা ফিরিয়ে নিতে বলেন। তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফর নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শেষে ইন্দিরা প্রস্তাবটি দেন। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস। ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের তাঁরা নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারেন না।
ইন্দিরাকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক চিঠি নিয়ে এদিন মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে আলোচনা হয়। নিক্সনের যুক্তি খণ্ডন করে দ্রুত চিঠির জবাব পাঠানো হবে।
চিঠিতে নিক্সন অভিযোগ করেছেন, সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাসের প্রস্তাবে ভারত অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। নিক্সন ভারতকে সংযত হতে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিতে বলেন।
রাতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ববঙ্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে
জাপানের টোকিও রেডিওতে বলা হয়, চীন পাকিস্তানকে আবার অস্ত্র দিতে শুরু করেছে। বেইজিং থেকে তারা এ খবর পেয়েছে। পিকিং থেকে পাকিস্তানে সামরিক বিমান সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে এদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দুটো দাবিই নাকচ করে দেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনার জন্য পূর্ববঙ্গের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিনকে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর রণকৌশলে বদল
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এখন রণকৌশল পাল্টেছেন। হিট অ্যান্ড রান বা আক্রমণ করেই ফিরে আসার কৌশল ছেড়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দখল করে সেখানেই অবস্থান নিচ্ছেন। এরপর পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুত হচ্ছেন। সব সেক্টরেই এই নীতি চলছে।
বলা হয়, অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে দ্রুত সেনা নিয়ে এসে সেনানিবাস ও গ্যারিসনে সমবেত করছে। জেলাগুলোর বহু এলাকা কার্যত মুক্ত। ঢাকা-বরিশাল নদীপথে যোগাযোগ এবং ঢাকা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যশোর শহরের দিকে অভিযান এদিনও অব্যাহত থাকে। ভারতীয় সেনা সহায়তায় পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতে বোমা ফেলে তারা চাপ সৃষ্টি করে।
সিলেট অঞ্চলে নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর মুক্ত করে বিজয় উদ্যাপন করেন।
টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি নাগরপুর দখলের উদ্দেশ্যে ২৯ নভেম্বর কেদারপুরে সমবেত হন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা শান্তিবাগে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের ওপর অভিযান চালালে দুজন নিহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরে যৌথ বাহিনী পঞ্চগড়ের বোদার উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। পথে ময়দান দিঘির কাছে পুটিমারীতে পাকিস্তানি সেনাদের বাধার মুখে পড়লে সেখানেই প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে।
সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে পাঁচ মাইল দূরে লুবাছড়া চা-বাগান এলাকায় সমবেত হন। ২৬ নভেম্বর রাতে তাঁরা সেখানে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পরের রাতে বড় চাতলাপুর গ্রামাঞ্চলে অগ্রাভিযান শুরু করেন। এখানে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেন। গ্রামের সামনে ও পেছনে দুইদিকেই তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেন, যাতে কানাইঘাটের পাকিস্তানি সেনারা পালাতে না পারে, আবার বাইরে থেকে নতুন সেনারা এসে যুক্তও না হতে পারে।
পাকিস্তানি সেনারা কামান দিয়ে তাঁদের আক্রমণ শুরু করে। প্রবল আক্রমণের মুখেও তাঁরা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান ধরে রেখে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ১৮টি স্থানে অভিযান চালিয়ে আজ রংপুর ও পঞ্চগড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড় ত্যাগে বাধ্য হয়।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ভারতীয় আক্রমণের চাপে পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে পাকিস্তান সেনারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ আজ স্বীকার করে। এক সরকারি মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫ বর্গমাইল এলাকা এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খানকে তাঁর বাসভবনে নজরবন্দী এবং তাঁর গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিচ্ছে।
- নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব নভেম্বর ( ০১-০৯ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০৯-১৬ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )
- বাংলাদেশের অগ্নিঝরা মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২৮-৩১ )
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২০-২৭ )
- কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি -পত্র [ amarnazrul ]