নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১৯ নভেম্বর- আবার স্বীকৃতির দাবি ভারতের রাজ্যসভায়
১৯ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ৵সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য নতুন করে আবার দাবি জানানো হয়। রাজ্যসভায় সিপিআই সদস্য জি এম সরদেশাই বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবসংক্রান্ত একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারের উদ্দেশে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন পাঠানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়া।
রাজ্যসভায় এসএসপির সদস্য রাজনারায়ণ অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চাপে বাংলাদেশ উপদেষ্টা কমিটিতে কমিউনিস্টদের গ্রহণ করা হয়েছে। এর উত্তরে সরদেশাই বলেন, এই ধরনের বিবৃতি ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পছন্দ করবে। রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনা করার জন্য কমিশন গঠন করার অধিকার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের কাছে কখনোই এখানে এমন কোনো কমিশন পাঠানোর কথা চিন্তা করছে বলে জানায়নি।
পরে সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য চীনে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর অভিপ্রায় সরকারের নেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মনোভাব চীনের উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের পাকিস্তানকে তাদের দেশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সেনা পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা দিতে অস্বীকার করার সাম্প্রতিক একটি খবরকে সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় স্বাগত জানান।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার দিন খুবই কাছে।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল সাদেক হোসেন খোকার (স্বাধীনতার পর বিএনপি নেতা ও ঢাকার মেয়র) নেতৃত্বে শান্তিনগরে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের অফিসে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলাদের এই দলে আরও ছিলেন রফিকুল হক নান্টু, ইকবাল আহমেদ সুফি ও আমসল লস্কর।
ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের অনুগতদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মতিঝিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্য আরেকটি দল ডেমরায় পাকিস্তানি অনুগত ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্যাকেজিং কারখানায় বোমা হামলা চালায়।
এই সেক্টরের অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার রাজনগরে সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করলে দুজন হতাহত হয় এবং পাঁচ রাজাকার বন্দী হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর দলের সামাদের গ্রুপে ছিলেন কমান্ডো মাহবুব, কাসেমসহ কয়েকজন এবং আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিলেন ১৫ জন। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। রায়গঞ্জ সেতুর কাছে পৌঁছে সামাদের গ্রুপ বুঝতে পারে, তাঁরা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে পড়েছেন। সামাদ সবাইকে শুয়ে পড়তে বলেন। পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে গুলি শুরু করে। চলতে থাকে মরণপণ যুদ্ধ।
এই সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বড়খাতায় পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা হাতীবান্ধায় পিছু হটে। বড়খাতা পাকিস্তানি মুক্ত হয়।
ইয়াহিয়া-নুরুল আমিন সলাপরামর্শ
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনের ব্যাপারে সলাপরামর্শ করেন।
নুরুল আমিনসহ দক্ষিণপন্থী সাত দলের যুক্তফ্রন্টের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে আগের দিন বলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য দলকে যদি সরকার গঠন করতে বলা হয়, তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হবে না, এমন হুমকি দেওয়ার অধিকারও কারও নেই। বিবৃতিতে স্পষ্ট যে ভুট্টোর ঘোষণার জবাবেই এ কথা বলা হয়েছে।
২০ নভেম্বর – স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই
নিউইয়র্ক টাইমস ২০ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমৃত্যু সংগ্রাম করে হলেও বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে ঘুরে সামগ্রিকভাবে এই ধারণাই হয়। করাচি থেকে ম্যালকম ব্রাউন এই প্রতিবেদন পাঠান।
প্রতিবেদনে ব্রাউন বলেন, হোটেল, ব্যাংক, দোকান, বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বিদেশি কনস্যুলেট অফিস—সর্বত্রই রয়েছে মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জলাভূমি বেশি। সেখানে সেনাদের পক্ষে ঢোকা কঠিন। পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ভিয়েতনাম থেকে কিছু শেখেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গেরিলারা সর্বত্র রাস্তা, সেতু ও জলপথ ধ্বংস করছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ঘরের বাইরে আসা প্রায় বন্ধ।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটিতে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনাকালে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে বি অ্যান্ডারসন পূর্ববঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান।
শহীদ হলেন আশফাকুশ সামাদ
আশফাকুশ সামাদ ২০ নভেম্বর কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার রায়গঞ্জ দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। ১৯ নভেম্বর রাতে আশফাকুশ সামাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁদে পড়ে যান। এ বিপর্যয়ে বিচলিত না হয়ে সামাদ সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করেন। একপর্যায়ে একটি গুলি তাঁর মাথা ভেদ করলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শাহাদাতবরণ করেন। এ যুদ্ধে আরও শহীদ হন কবীর আহমেদ (ইপিআর সিপাহি), আবদুল আজিজসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বামনিতে রাজাকারদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। রাজাকারদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা অহিদুর রহমান অদুদ শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি এবং ভারতীয় বাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড যৌথভাবে সিলেট দখলের পরিকল্পনা করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি জেড ফোর্স তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের জালালপুর থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। এরপর তারা চারগ্রামে আগের অক্ষে ফিরে এলে পাকিস্তানি বাহিনী জকিগঞ্জ পুনর্দখল করে। জকিগঞ্জ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত করতে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার জকিগঞ্জে আক্রমণ করেন। রাতভর যুদ্ধ চলতে থাকে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সাতক্ষীরার দেবহাটার বিরাট একটি অঞ্চল মুক্ত করেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি বাহিনী সাতক্ষীরা শহরের দিকে পিছু হটে। দেবহাটার মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে সাতক্ষীরার দিকে এগিয়ে যান।
সাতক্ষীরার তালা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এ ছাড়া কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। দিনটি কালিগঞ্জ বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ঈদের দিন
১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল ঈদ। বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের জামাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ঈদের দিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা, ইকো এবং ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির সৈন্যদের নিয়ে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগরকে ঘিরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি।…নতুন জামাকাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিল।’
২০ নভেম্বর বেলা একটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নুরুন্নবী খানদের ছাত্তার গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ভয়ংকর হামলা চালায়। সুবেদার আলী আকবর ছিলেন এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। নুরুন্নবী খান বাংকারে বসে ঈদের খিচুড়ি খাচ্ছিলেন। তিনি দ্রুত সুবেদার বদি এবং তাঁর প্লাটুনের দুটি সেকশনকে সঙ্গে নিয়ে আলী আকবরের অবস্থানে পৌঁছান। বাইনোকুলারে দেখতে পান, পাকিস্তানিদের বিশাল দল তাঁদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করলে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে।
ঈদের রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে বন্দী ৩৮ জন স্বাধীনতাকামীকে শহরের পৈরতলা খালপাড়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা, তাঁর ছেলে কামাল, দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার শহিদ নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল রাজাকাররা। তাঁদের অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
২১ নভেম্বর – চীনের মন্তব্যে হতাশা

জাতিসংঘে চীন সরকারের প্রতিনিধির করা মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ২১ নভেম্বর মুজিবনগরে বলেন, শরণার্থীদের ব্যাপারে সামান্য সহানুভূতিও প্রকাশ করেনি চীন। শরণার্থীদের সাহায্যের কথা না বলে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন চীনের প্রতিনিধি। তবে বাংলাদেশের মানুষ একটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেটি হলো মাতৃভূমির মুক্তি।
জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি পাকিস্তানি নীতিকে সমর্থন করায় ভারতের আহমেদাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্তের ঘটনাবলি সম্পর্কে এবং বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা প্রশ্নে ভারত তার সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে।
প্রসঙ্গত, ১৯ নভেম্বর চীনের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তব্য দেন।
জাতিসংঘের সমালোচনা
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রধান সম্পাদকীয়তে অভিমত ব্যক্ত করা হয়, ভারত উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাইলে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেওয়া উচিত। আরও বলা হয়, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেই কেবল জাতিসংঘ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারে সফল হবে। জাতিসংঘ এ পর্যন্ত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এড়িয়ে গিয়েছে।
পূর্ববঙ্গে যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, কেবল ত্রাণে তার সুরাহা হবে না বলে মনে করেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানসহ জাতিসংঘের একাধিক কর্মকর্তা। তাঁদের অভিমত হলো, সমস্যার মূলে যেতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিতে হবে। তবেই সংঘর্ষ বন্ধ হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটেনের পার্লামেন্ট লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস এদিন লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা দেন। সেখানে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা এদিন তাদের এক সংবাদ নিবন্ধে ক্রেমলিনের অভিমতের পুনরাবৃত্তি করে বলে, পূর্ববঙ্গে সামরিক সরকারের অমানবিক উৎপীড়নের কারণেই জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এর দায় ভারতের ঘাড়ে চাপানো যায় না। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান রাজনৈতিক মীমাংসা।
পাকিস্তান অধিকৃত ঢাকা থেকে এদিন একটি বার্তা সংস্থা জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানিরা দিশেহারা। দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বিস্তীর্ণ পল্লি অঞ্চল মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। তাদের অভিযানের তীব্রতায় প্রশাসন বেসামাল। পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হতে পারে, এই আশঙ্কায় তারা সন্ত্রস্ত।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী এদিন জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ৬ জন সেনা, ২ জন পুলিশ ও ২৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার বেনাপোল, নাভারন, শার্শা শহরসহ চৌগাছার গরিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক ও কামান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। ভয়াবহ যুদ্ধে দুই পক্ষেই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এদিন সকালে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে কামান ও আর্টিলারি দিয়ে আঘাত হানে। বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা পাঁচ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে চলে যায়। এরপর শহীদ আশফাকুস সামাদসহ অন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ উদ্ধার করে জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর সামাদকে বীর উত্তম খেতাবে সম্মানিত করা হয়। স্থানীয়রা জয়মনিরহাটের নাম রাখেন সামাদনগর।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন করাচিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সম্প্রতি যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে তাঁর সেখানে যাওয়ার আর কোনো আবশ্যকতা নেই।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, গণতন্ত্রই শুধু দেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে। একনায়কতন্ত্র বা স্থায়ী সামরিক শাসন কোনো সমাধান হতে পারে না।
২২ নভেম্বর – যশোর অভিমুখে মুক্তিবাহিনী
যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চৌগাছায় ২২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী চৌগাছার বিরাট এলাকা মুক্ত করে যশোর শহরের দিকে এগোয়। পাকিস্তানি বিমান যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বয়রায় আসামাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে ওড়ে। বিমানযুদ্ধে তিনটি পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুই পাইলট খলিল আহমদ খান ও পারভেজ মেহেদি কোরেশি ভারতে বন্দী হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩টি ট্যাংক, ৩টি বিমান এবং বেশ কিছু সেনা হারিয়ে শার্শার নাভারনে আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পিছু নিয়ে শার্শা সদর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে।
২ নম্বর সেক্টরে রাতে কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় হামলা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে ছিল। চন্দ্রপুরের লাগোয়া লাটুমুড়া পাহাড়ে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখান থেকে তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ভারতীয় বাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর, তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড কর্মকর্তাসহ ৪৫ জন সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলামসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) ২২ জন শহীদ হন। আহত হন প্রায় ৩৪ জন। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে চন্দ্রপুর দখল করলেও পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর পুনর্দখল করে নেয়।
এই সেক্টরে ঢাকা শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল বনগ্রাম এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে ঘটনাটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রামপুরায় আরেক দলের হামলায় একজন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সহযোগী গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রাম-কানাইঘাট-চরখাই-সিলেট অক্ষ বরাবর অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন তারা সুরমা নদীর তীর ধরে এগিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছায়। দলটির আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি সুরমার দক্ষিণ তীরে এবং চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নেয়।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গৌরীপুরে পৌঁছালে কানাইঘাটে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সামনের দিকের দুটি কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নিয়েছিল।
সিলেট শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেন শক্তিক্ষয় না হয়, সে জন্য ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সেক্টরের একটি কোম্পানি দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে অবস্থান নিতে বলা হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানিদের শক্তি সঞ্চয়ে বাধা দেওয়া এবং কানাইঘাট থেকে পাকিস্তানিদের পিছু হটতে না দেওয়া। বাকি দুই কোম্পানি সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি আলাদা দল অমরখানা ও জগদলহাটে আক্রমণ করে। ভারতীয় আর্টিলারিও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ এবং ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে যায়। অমরখানা ও জগদলহাট মুক্ত হয়।
খুলনা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সীমান্তের বসন্তপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করের আরও এগিয়ে যায়।
নুরুল আমিন স্থায়ীভাবে লাহোরে
পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদপত্রের বরাতে ইত্তেফাক জানায়, কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে স্থায়ীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরেই বাস করতে পারেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শিয়ালকোটে সীমান্ত অঞ্চল এবং লাহোরে নিয়োজিত সেনাদল পরিদর্শন করেন। শিয়ালকোটে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনাবাহিনীর স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থার আন্তজেলা কোচ সার্ভিস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ঢাকা ও মফস্বল শহরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অভ্যন্তরীণ সার্ভিসও বাতিল করা হয়।
মানুষের প্রতি মানুষের অমানুষিক ব্যবহার
ভারতে সফররত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ রাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেন। ভারত সরকারের সামনে যে কঠিন কর্তব্য রয়েছে, তা শান্তিপূর্ণভাবেই তা সম্পন্ন হবে বলে সেখানে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দিল্লি থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক খবরে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯ নভেম্বর এক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ভারত তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনে গ্রহণ করবে। ইন্দিরা বলেন, আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে শেখ মুজিবকে প্রথমে মুক্তি দেওয়া উচিত।
২৩ নভেম্বর – জরুরি অবস্থা জারি করলেন ইয়াহিয়া
ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ নভেম্বর সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান আক্রমণের শিকার হতে পারে, এ আশঙ্কায় ইয়াহিয়া খান দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই সীমান্তে প্রচুর সেনা সমাবেশ করায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন।
এর আগে ১২ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। এর পরই তাঁর নিদে৴শে পশ্চিম সীমান্তে বিপুল সেনার সমাবেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গ সীমান্তেও সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। সীমান্ত থেকে ভারতের ভেতরে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চলছে।
ভারত সরকার খবর পেয়েছে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকা তাদের আকাশসীমায় হানা দিতে পারে। এসব তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ভারতও সীমান্তে সেনাসমাবেশ করেছে।
ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিকও রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচিতে আসেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি এই দিন জানায়, ঢাকায় সবার ধারণা ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। সাংবাদিকদের যশোরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে যুদ্ধ চলছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইলে শেখ মুজিবসহ পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে, বিশ্ব সংস্থার উচিত সেটিকে সমর্থন করা।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এর সংবাদদাতার রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাঠানো খবরে এক সামরিক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, যশোর ও সিলেটের ছোট ছোট এলাকা ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতার খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এটি তাঁদের জীবনমরণ যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ভারত থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। সিনেট ও কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সে পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, প্রতিনিধি সভা যে সংশোধন অনুমোদন করেছে, এই প্রস্তাবে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরার আলোচনা
পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত তাঁর শীর্ষস্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। পাকিস্তান একদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে তাদের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা এসবের প্রেক্ষাপটে সবার সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো দুঃসাহস দেখালে এবার ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হবে পাকিস্তানের। এবার যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের মাটিতেই হবে এবং তার ফয়সালাও হয়ে যাবে।
তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন বেতার ভাষণে বলেন, নানা দিক থেকে সাফল্য এসেছে। স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটতর হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়টিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
২ নম্বর সেক্টরে কসবার চন্দ্রপুরের যুদ্ধে শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধারে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আবার আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এই সেক্টরে মন্দভাগ অবস্থান পুনর্দখল করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী জায়গাটির কাছে একত্র হলে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন হতাহত হন। এখানে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা সালদা নদীর সন্নিকটে একটি রেলসেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালায়। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর একটি বাংকার ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনী প্রবল পরাক্রমে প্রতিরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তারা বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন এবং চারজন আহত হন।
মুক্তিবাহিনীর নৌযোদ্ধারা চালনা বন্দরের মুখে মাইন দিয়ে ‘এসএস রাইজোভেলান্ডু’ নামের একটি মালবাহী গ্রিক জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এতে চালনা বন্দরে জাহাজ ঢোকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
২৪ নভেম্বর – বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ নভেম্বর দেশটির আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে বৈঠকে করেন। বিরোধী নেতা গোরে মারারি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ৬ ডিসেম্বরের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ, ইয়াহিয়া খান সে দিন পাকিস্তানের নতুন সংবিধান চালু করবেন।
পরে লোকসভায় মুক্তিবাহিনীর সাফলে৵র কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা বলেন, বর্ষার পর মুক্তিবাহিনীর সাফল্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সব পরিকল্পনা স্পষ্টত বানচাল করে দিয়েছে।
এ দিন ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের ১৪ জন নাবিক আশ্রয় নেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান সরকার এদিন সশস্ত্র বাহিনীর সবাইকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সামরিক কার্যালয়ে হাজির হতে নির্দেশ দেয়। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি চীনা প্রতিনিধিদল এদিন পাকিস্তানে পৌঁছেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করে।
আলোচনার বিষয় অজানা থাকে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের আক্রমণের প্রসঙ্গ তাড়াহুড়া করে নিরাপত্তা পরিষদে নিতে সরকারকে বারণ করেন। করাচি থেকে লাহোরে পৌঁছে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বের একমাত্র অধিকার তাঁর। কারণ, তিনি জননেতা। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার ওপর বিপুল দায়িত্ব। এই সংকটময় মুহূর্তে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না।
একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রেখেছেন।
ওয়াশিংটন থেকে রয়টার্স জানায়, যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে চলায় যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ৩০০ মার্কিন নাগরিককে স্থানান্তর করার কথা ভাবছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরে আবার সান্ধ্য আইন জারি করে। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ঢাকায় দুবার সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বা কারণ জানানো হয়নি।
জাতিসংঘের বৈঠক ডাকার আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের কিছু সদস্য ভারত-পাকিস্তান সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানান।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এদিন ভারত উপমহাদেশের সংকট নিয়ে সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে আলাপ করে। আলোচনার বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি।
ভারত ও পাকিস্তানকে সামরিক উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার জন্য এই দিন আহ্বান জানায় ফ্রান্স।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রে রেখে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
পাকিস্তানিরা পালানোর পথ খুঁজছে
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ২৪ নভেম্বর বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে পাকিস্তানি সেনারা দুটি পন্থা নিয়েছে: ১. নির্বাচিত চার-পাঁচটা সেনানিবাসে আত্মরক্ষার জন্য ঘাঁটি গড়ে তোলা। ২. বাংলাদেশ থেকে দ্রুত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং কিছু সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া। বিমানবাহিনীর কিছু বিমানও তারা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকাকে প্রধান ঘাঁটি করে ঢাকা বিমানবন্দর রক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর যশোর, সিলেট, দিনাজপুর প্রভৃতি শহর থেকে তারা পিছু হটছে।
পলায়নপর্বের জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের আরও দু-তিন সপ্তাহ সময় দরকার। তাদের সেনাবাহিনী প্রাণপণ লড়ে ওই সময়টুকু পাওয়ার চেষ্টা করবে।
মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দিকে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় দ্রুত এগোচ্ছে। যশোর বিমানবন্দর ক্ষতবিক্ষত। সাতক্ষীরা-নাভারন এবং চৌগাছা-কালিগঞ্জ হয়ে মুক্তিবাহিনীর আরও দল ক্ষিপ্রগতিতে সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে চলেছে। আরেকটি দল যশোর-খুলনার পথে গোলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী অর্থ ও সম্পদ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত।
নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে এদিন চট্টগ্রাম বন্দরে এক হাজার টন তেলবাহী জাহাজ, মেঘনায় চীনের বাণিজ্য জাহাজ, চাঁদপুরের কাছে চারটি বড় স্টিমার এবং পাকিস্তান নৌবহরের একটি গানবোট ডুবে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর জরুরি সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চাঁদপুরের জাহাজ চলাচল বন্ধ।
সিলেট অঞ্চলে রাধানগর কমপ্লেক্স দখলের লক্ষ্যে জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘোরা, দুয়ারীখেল, ছাত্তারগাঁ, লুনি, জাফলং চা-বাগান, কাফাউড়া ও বাউরবাগ থেকে উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক দিয়ে রাধানগর ও ছোটখেল অবরোধ অভিযান শেষ করেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চৌগাছা মুক্ত করেন।
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাঁটি অবরোধ করে মূল বাহিনী থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
২৫ নভেম্বর – আন্তর্জাতিক বিশ্বে হঠাৎ উত্তেজনা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পৃথকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে তাঁদের দুই দেশের সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে ২৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার খবর পাওয়ার পর দুই দেশের কূটনীতিকদের ডেকে আনা হয়। ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনার সময় উইলিয়াম রজার্স উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমনে কোনো নতুন প্রস্তাব দেননি।
তবে তিনি দুই দেশকেই সংঘর্ষে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পূর্ব খণ্ডে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েনেরও কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ব্যক্তিতভাবে আবেদন জানাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ভারত উপমহাদেশের সমস্যা বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানানোর বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, তার জন্য প্রভাব খাটাতে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। সেখানকার পাকিস্তানি হাইকমিশনার মহম্মদ ইউসুফ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি পৌঁছে দেন।
মস্কোর একটি সূত্র এদিন জানায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব দল আন্দোলন চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার দাবি জানিয়ে পাকিস্তানের কাছে একটি নোট পাঠিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিকে জটিল ও সংকটজনক করে না তোলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে আবার অনুরোধ করেছে। পাকিস্তান যুদ্ধের পথই বেছে নিলে তাকে সর্বনাশা পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চীনের সরকারি পত্রিকায় বলা হয়, ভারত পূর্ববঙ্গে আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়েও যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিচ্ছে চীন। কারণ, তারা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়। নিউ চায়না এজেন্সি পরিবেশিত আরেক খবরে বলা হয়, বেইজিংয়ে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক পরিস্থিতিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের একটি চিঠি চৌ এন লাইকে দেন কায়সার।
শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিন আবার ঘোষণা করে, কলম্বো হয়ে বিমানে পূর্ববঙ্গে সেনা ও অস্ত্র পাঠানোর জন্য পাকিস্তানকে তারা কখনো সুযোগ-সুবিধা দেয়নি।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানিরা তাদের নাগরিকদের এক অংশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে রীতিমতো ভুল করেছে। ৮০ লাখ থেকে এক কোটি আক্রান্ত নাগরিককে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা তাদের কৌশলগত ভুল। এতে ভারত গুরুভার বহন করতে বাধ্য হয়। ভারত আশ্রয় ও সামরিক শিক্ষা দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান তার সংকীর্ণতার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়ান্ত্র ব্যবহার করে। পরিণামে এ যুদ্ধ।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ কলকাতা থেকে পাঠানো সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, পূর্ববঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ভারতের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তারা অবিচল এবং নিরাপস। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও তারা মেনে নিয়েছে। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা শনবার্গকে বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না। তবে পাকিস্তান শুরু করলে তারা নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব করবে।
চীন–পাকিস্তান বন্ধুত্ব
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন তক্ষশীলায় চীনের সাহায্যপুষ্ট একটি কারখানার উদ্বোধনীতে বলেন, পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে উপমহাদেশের শান্তি বিনষ্ট করেছে ভারত। তবে বিদেশি আক্রমণ হলে চীন পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন জানাবে।
অনুষ্ঠানে চীনা প্রতিনিধি লি সুই চিং বলেন, চীন–পাকিস্তানের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর হচ্ছে। দুই দেশেই অপর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরোধী।
মুক্তিবাহিনীর যশোর দুর্গ দখলের লড়াই
মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় যশোরের ঝিকরগাছা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে তাদের ঘাঁটিগুলো দখল করে। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায়। যশোরের অনেক এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়।
ঝিকরগাছা দখলের পর যৌথ বাহিনী যশোর শহরে পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক থেকে অবরুদ্ধ করে।
তাদের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কুষ্টিয়া-খুলনা যোগাযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুলনা–উত্তরবঙ্গ রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যশোর বিমানক্ষেত্রও হয়ে পড়ে অকেজো। একটি বিমান পাকিস্তানি সেনা নিয়ে এসেও যৌথ বাহিনীর কারণে নামতে পারেনি।
বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র রাতে জানায়, এক সপ্তাহ যুদ্ধের পর রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরার কয়েকটি থানা মুক্ত।
কুষ্টিয়ার অনেক এলাকা এদিন মুক্ত হয়। মেহেরপুর দখল নিয়ে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের মহেশপুর মুক্ত করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করে ৯টি গ্রামে বেসামরিক প্রশাসন চালু করেছে। ভেড়ামারা থেকেও পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত। দর্শনা থেকে তারা পালাচ্ছে। জীবননগর মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত।
পাকিস্তান সেনারা দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়েছে। পঞ্চগড় ও কানপুর মুক্ত।
তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর বসিরহাট দখল করেছে; ছিনিয়ে এনেছে ফুলগাজী, আনন্দপুর আর চাঁদগাজী বাজার। পরশুরাম এলাকা মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা দখলে নিয়েছে।
২৬ নভেম্বর – গৌরীপুরে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ লড়াই

সিলেটের কানাইঘাটের দুই মাইল দূরে গৌরীপুরে ২৬ নভেম্বর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট দখলের লক্ষ্যে ২২ নভেম্বর গৌরীপুরে পৌঁছান। কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তখন তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে এসে সুরমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সামনের চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে ডেল্টা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়।
তারা একই সঙ্গে সুরমার দক্ষিণে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ওপরও আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু
করে। ডেল্টা কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে পাকিস্তানিরা বারবার তাঁদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে।
এই অবস্থায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির মাঝখানের প্লাটুনের অধিনায়ক সুবেদার মুসা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক এবং অন্য প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর বাঁ পাশে ছিল সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক ও মেজর) নেতৃত্বাধীন প্লাটুন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানেন। এই সুযোগে প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা বুকে হেঁটে দ্রুত পাকিস্তানিদের ৫০ গজের মধ্যে চলে আসেন।
দুই পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ওয়াকার হাসানের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য মনোবলের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সারওয়ারসহ ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা এদিন নিহত হয়। ২৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ১৭।
যশোর শহরের উপকণ্ঠে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই এদিন অব্যাহত ছিল। হিলিতে চলে ট্যাংক লড়াই। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলস্টেশন এলাকায় প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। কুষ্টিয়ার রসুলপুর ঘাটের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা রাজাপুরের দিকে পিছু হটে যায়। খুলনা জেলার বসন্তপুরের এদিন পতন হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৬ নভেম্বর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময়ে আর কেউ ছিলেন না। পরে তাঁদের সহকারীরা এসে যোগ দেন। আলোচনার বিষয় ছিল ভারতের আক্রমণের আশঙ্কা। ভুট্টো পরে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা এটা নিয়েই উদ্বিগ্ন, অসামরিক সরকার গঠনের বিষয়ে তাঁরা এখন ভাবছেন না।
পশ্চিম পাকিস্তান সফররত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।
গোটা পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারির তিন দিন পর এদিন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের দুই অংশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ওয়ালি) কার্যক্রম বেআইনি ঘোষণা করেন। এর পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকজন ন্যাপ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া নিষিদ্ধঘোষিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মাস্টার খান গুলকে পেশোয়ারে গ্রেপ্তার করা হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক এবং খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যশোর সফর করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির আহ্বান
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালদের বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যুদ্ধের হুমকি সত্ত্বেও আক্রান্ত না হলে ভারত যুদ্ধে জড়াবে না। ভারতের বিমানবাহিনী ক্ষুদ্র ন্যাট বিমান দিয়ে পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর জেট বিমান যেভাবে ঘায়েল করেছে, সেখান থেকেই তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সংবাদদাতা কেভিন রেফার্টি কলকাতা থেকে পাঠানো খবরে বলেন, অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, শিগগিরই বাংলাদেশ নামে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হবে। যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো সমাধানের কথা কেউ ভাবতে পারছেন না। সবার ধারণা, দ্রুতই যুদ্ধ শুরু হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এই দিন পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের উত্তেজনা কমাতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবার ভারতকে অনুরোধ করেন। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে এই খবর দিয়ে বলেন, ইসলামাবাদে পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গেও এমন আলোচনা চালানো হচ্ছে।
২৭ নভেম্বর – মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছেন

দিনাজপুর অঞ্চলের হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণ ২৭ নভেম্বর তীব্র আকার ধারণ করে। হিলিতে তীব্র লড়াই হয়। রংপুর সেনানিবাস থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাকে বিচ্ছিন্ন করতে যৌথ বাহিনী তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তাদের কামানের গোলায় পাকিস্তানিদের পাঁচটি ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৮০ জন হতাহত হয়। যৌথ বাহিনীরও ২০ জন হতাহত হন।
সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেক্স মুক্ত করার জন্য এদিনও থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানে আক্রমণ করে। ছোটখেলে তাদের সঙ্গে ছিল জেড ফোর্সের ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির একটি প্লাটুন। নেতৃত্বে ছিলেন ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক এস আই এম নুরুন্নবী খান (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাদের দায়িত্ব ছিল গোর্খা সেনাদের বেরোনোর পথ নিরাপদ রাখা এবং দক্ষিণ দিকের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা।
আর্টিলারির গোলাবর্ষণের পর গোর্খা রেজিমেন্টের সেনারা সরাসরি আক্রমণ শুরু করেন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তাঁরা ছোটখেল দখল করেন। গোর্খা রেজিমেন্টের অন্য যে দুটি কোম্পানি রাধানগরে আক্রমণ করেছিল, তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। তাদের ৪ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পদের ৬৭ জন সেনা শহীদ হন। আহত হন শতাধিক।
ছোটখেল দখল করলেও পুনঃসংগঠিত পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় তা গোর্খা সেনাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। গোর্খা সেনারা নুরুন্নবী খানের প্লাটুনের সহায়তায় পিছু সরে আসেন। শহীদ হন ৩৬ জন।
নুরুন্নবী খানের অধীন ডেল্টা কোম্পানির অবস্থান ছিল লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, ছাত্তারগাঁ ও শিমুলতলা গ্রামে। পাকিস্তানিরা এসব অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে হিমশিম খান। পরে কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে প্রতিহত করেন।
সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল রহিমপুরের কাছে বিরাট এলাকা মুক্ত করে। দুজন কর্মকর্তাসহ ২৩ জন পাকিস্তান সেনা বন্দী হয়। ১৮৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
ফেনী দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। স্থলযুদ্ধে মার খেয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে। তবে মুক্তিবাহিনী অবস্থান ধরে রাখে।
৭ নম্বর সেক্টরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিন মাইল দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিবাহিনী মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একসঙ্গে পোড়াগ্রাম আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের একটি সূত্র এদিন জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ টেলিফোনে কথা বলেছেন। নিয়মমতো আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হলেই নিরাপত্তা পরিষদ মাথা ঘামাতে পারে। বর্তমান সংকটে পাকিস্তান যাতে ভেঙে না যায়, সে উপায় খুঁজে বের করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা করতে পারে।
তবে ভারত-পাকিস্তান সংকটে নিরাপত্তা পরিষদের এগিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা নেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করতে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে এতে টেনে আনতে চাইছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি তাদের ঢাকা সংবাদদাতার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানায়, ঢাকায় আবার কয়েকটি বিস্ফোরণের এবং কয়েকটি পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সড়ক, জলপথ ও রেল পরিবহন বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পরিখা খনন করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র দং এ লিবো এদিন জানায়, উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। অস্ত্রবোঝাই একটি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোর খবর সরকারিভাবে সমর্থিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি ভারত সরকারকে জানিয়েছে।
বাজপেয়ীর সমর্থন
জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ী এদিন বলেন, ভারতের ওপর পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে জনসংঘ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানাবে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আফ্রো-এশিয়া সংহতি কমিটির এশীয় আঞ্চলিক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৭২ সালের ১০ থেকে ১৫ জানুয়ারি মিসরের রাজধানী কায়রোয় অনুষ্ঠেয় পঞ্চম অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে তারা আলোচনা করবে। সে অধিবেশনে যাতে বাংলাদেশ যোগ দিতে পারে, তার জন্য কায়রো অধিবেশনের প্রস্তুতি কমিটিকে জানানো হবে।
রেডিও পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি
রেডিও পাকিস্তান এদিন এক খবরে স্বীকার করে, যশোরের কাছেই প্রচণ্ড লড়াই চলছে। যশোর বিপন্ন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বিভিন্ন এলাকা সফরের অংশ হিসেবে এদিন হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন করেন।
আরও দেখুনঃ
- নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব নভেম্বর ( ০১-০৯ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০৯-১৬ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )
- বাংলাদেশের অগ্নিঝরা মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২৮-৩১ )
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২০-২৭ )
- কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি -পত্র [ amarnazrul ]