নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নভেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১০ নভেম্বর – ফেনীর বিরাট এলাকা মুক্ত
ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ফেনীর বিলোনিয়া অঞ্চলের পরশুরামের বিরাট এলাকা ১০ নভেম্বর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের বিলোনিয়ায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা গোটা এলাকাটি মুক্ত করতে নভেম্বরের শুরু থেকে আক্রমণ বাড়িয়ে দেন। ৭ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি সেনারাও তীব্র পাল্টা আক্রমণ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তাদের জবাব দিতে থাকেন। ৮ থেকে ১০ নভেম্বর দুই পক্ষে কয়েকবার মুখোমুখি যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানিরা অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে চারটি জেট দিয়ে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা অবশেষে পাকিস্তানিদের দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে হটিয়ে দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এ সময় এগিয়ে আসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের তৃতীয় ডোগরা রেজিমেন্ট।
তারা ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঘণ্টার মধ্যে পরশুরামের বিরাট এলাকা দখল করে নেন।
দুই কর্মকর্তাসহ ৭২ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে এককভাবে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
এ যুদ্ধে হতাহত হয় ১৫০ জনের মতো পাকিস্তানি। মুক্তিবাহিনীরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা এ দিন ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে জানান, মুক্তিবাহিনী গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের সাতটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
ঢাকার কাছের মধুপুর জঙ্গল এবং দক্ষিণে সুন্দরবন এলাকা তাদের দখলে রয়েছে।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা অঞ্চলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গ্রিন রোডে রেডিও পাকিস্তানের উপপ্রধান প্রকৌশলীর অফিসে অভিযান চালায়।
তাদের গুলিতে রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্রের আঞ্চলিক প্রকৌশলী বজলে হালিম নিহত এবং দুজন আঞ্চলিক প্রকৌশলী আহত হয়।
ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দলের একটি হলিক্রস কলেজের ভেতরে এবং আরেকটি আজিমপুর গার্লস স্কুলের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পাট করপোরেশনের পাটগুদামে আগুন ধরিয়ে দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের চৌগাছার হাজীপুরে রেঞ্জারস ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করেন। পাল্টাপাল্টি যুদ্ধে কয়েকজন রেঞ্জারস ও রাজাকার হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হন।কলকাতার একটি কূটনৈতিক মিশনের একজন কনসাল জেনারেল এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, সূর্যাস্তের পর ঢাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ওই কনসাল জেনারেল কিছুদিন আগে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা গিয়ে তিন দিন অবস্থানের পর কলম্বো হয়ে ৯ নভেম্বর কলকাতা ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে কোনো বাড়িতে তিনি মানুষ দেখতে পাননি। সেখানে একটি হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে বলেন, সামরিক বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
ইন্দিরা-উইলি ব্রান্ট সাক্ষাৎ
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে বিদেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ দিন তিন দিনের সফরে পশ্চিম জার্মানিতে পৌঁছেই দেশটির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
তাঁরা একমত হন যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
ইন্দিরা গান্ধী উইলি ব্রান্টকে বলেন, ভারতের নিরাপত্তায় শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। উইলি ব্রান্ট ভারতের প্রতি তাঁর দেশের সহানুভূতির আশ্বাস দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, জাতিসংঘ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান বের করতে পারলে ভারত স্বাগত জানাবে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন রাতে পাকিস্তানে ব্রিটিশ অস্ত্র রপ্তানির কথা অস্বীকার করেন।
যুক্তরাজ্যের কিছু পত্রিকায় খবর বেরোয়, গত কয়েক মাসে দেশটি থেকে বিমান, ট্যাংক ও কামান ইত্যাদি পাকিস্তানে গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খবরটি ভিত্তিহীন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভেঙ্কর ১০ নভেম্বর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল আন্দ্রে গ্রেচকোর সঙ্গে আলোচনা করেন।
আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উদ্ভূত যুদ্ধের হুমকি নিয়েই তাঁরা আলোচনা করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে, সে সংকটে তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য ভারত পাবে।
সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মী আলী আহমদ ৯ নভেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি চৌ এন লাইকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন না করতে অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, পূর্ববঙ্গবাসী এ ব্যাপারে চীন ও অন্য সমাজতন্ত্রী দেশের সমর্থন কামনা করে।
ভুট্টোর মন্তব্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে জনসভায় বলেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধলে তা শুধু এই দুই দেশের সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি এবং চৌ এন লাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পাকিস্তানকে তাঁরা পুরো সহযোগিতা করবেন।
১১ নভেম্বর – বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে বিচলিত পশ্চিম জার্মানি

পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ১১ নভেম্বর বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও স্থায়িত্বের জন্য বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার।
এরপরই ভারত থেকে শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন। পশ্চিম জার্মানি সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে দুই দিনের আলোচনার পর এই বক্তব্য দেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে পশ্চিম জার্মানি গভীরভাবে বিচলিত বোধ করছে বলেও উল্লেখ করেন উইলি ব্রান্ট।
একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, জাতিসংঘের উদ্যোগে শরণার্থী ত্রাণে তাঁর দেশ আরও অর্থসহায়তা দেবে।
উপমহাদেশের ঘটনাবলিতে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিম জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে এদিন এক ঘোষণায় বলা হয়, এখনো সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তারা সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এ বিষয়ে চিঠি লিখেছেন।
বন থেকে দ্য গার্ডিয়ান-এর সংবাদদাতা নরম্যান ক্রসল্যান্ডের পাঠানো খবরে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর অনমনীয় মনোভাব থেকে বোঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানায়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওয়াশিংটনের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, পাঁচ হাজার টন অস্ত্রবোঝাই কিছু রুশ জাহাজ ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
৩ নভেম্বর দিল্লিতে অবতরণ করা রুশ পরিবহন বিমানেও ছিল অস্ত্রশস্ত্রের জন্য যন্ত্রাংশ। এর আগেও ১০টি রুশ পরিবহন বিমান দিল্লিতে নামে।
বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ১১ নভেম্বর মুজিবনগরে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের নীতি ও কাঠামো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হবে স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সমাজবাদী রাষ্ট্র।
কলকাতার সল্টলেকে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর আয়োজিত এক শরণার্থী সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা আশা প্রকাশ করেন, সেদিন আর বেশি দেরি নেই, যেদিন শরণার্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
ঢাকায় সফল গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন অবরুদ্ধ ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় অভিযান চালান। তাঁরা সেখানে অবস্থানরত একদল পাকিস্তানি সেনার কাছাকাছি বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
অভিযানে অংশ নেন রাইসুল ইসলাম আসাদসহ কয়েকজন। লুই অ্যান্ড ডুসেলডর্ফ প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর বাড়ি (সিদ্ধেশ্বরী) থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গাড়ি সংগ্রহ করেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় অভিযানের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয়বার গেরিলারা গাড়ি পার্ক করেন বায়তুল মোকাররমের ফ্যান্সি হাউসের সামনে।
সেখানে ছয়জন পাকিস্তানি সেনা কলা কিনছিল। ফ্যান্সি হাউসের ভেতরে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের মেজর ফতেহ মোহাম্মদ মালিকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের লোকজন কেনাকাটা করছিল।
গাড়িটি পার্ক করার পর আসাদ ছাড়া বাকি সবাই নেমে যান। এরপর আসাদ সিগারেট খাওয়ার ভান করে গাড়ির ভেতরে রাখা টাইম বোমার সেফটি ফিউজ জ্বালিয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে যান। দেড় মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সমস্ত এলাকা।
এ অভিযানে তিন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন হতাহত হয়। একজন আহত নারীকে কোলে নিয়ে মেজর ফতেহর ফ্যান্সি হাউস থেকে বেরিয়ে আসার ছবি পরদিন ঢাকার পত্রিকায় ছাপা হয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের ঢাকা থেকে পাঠানো খবরে বলা হয়, বোমা বিস্ফোরণের পর শহরের দোকানপাট ও অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়।
খবরে আরও বলা হয়, গত মার্চে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ছয় হাজার পুলিশের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ স্পষ্ট।
২ নম্বর সেক্টরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা এদিন রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি অবস্থানে আক্রমণ চালান। পরদিন পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা, রেঞ্জার্স ও রাজাকার মিলে ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের দুজন শহীদ হন। একজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা এদিন রাতে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে পাহারারত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গোলাবর্ষণ করলে চারজন আহত হয়।
তাদের পাল্টা আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অন্য আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে দামুড়হুদার রঘুনাথপুরে নদীর ঘাটে মাইন পেতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি হতাহত হয়।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবকে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কথা জানান।
লাহোরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে ঢোকার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হয়। তবে তাঁর গায়ে গুলি লাগেনি।
১২ নভেম্বর – প্রচারণার বিরুদ্ধে ভাসানীর চিঠি

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১২ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত) কাছে লেখা এক চিঠিতে ভারত তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছে বলে যে প্রচার চলছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা নিরাপদ বলে মনে করছেন না। চিঠিতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের নিঃস্বার্থ সহায়তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের এই সময় এসে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন করায় চীনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির সমর্থক এবং মাওলানা ভাসানীর কিছুসংখ্যক চীনপন্থী অনুসারী ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রচার শুরু করে। তারা বলে, বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করাই ভারতের উদ্দেশ্য। এই প্রচারণায় তারা ভাসানীর নাম ব্যবহার করে বলে, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি রোধ করতে ভারত ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছে। এ পটভূমিতে ভাসানী চিঠিটি লেখেন।
পাকিস্তানকে চীনের পরামর্শ
দ্য টাইমসকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, চীন পাকিস্তানকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। চীন বলেছে, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ করা উচিত নয়; ব্যাপারটি নিরাপত্তা পরিষদে তোলারও এটা উপযুক্ত সময় নয়। লন্ডনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হোমের আলোচনায় উপমহাদেশের সমস্যাটি বিশদভাবে আলোচিত হয়।
পশ্চিম জার্মানি সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বনে এই দিন এক ভোজসভায় বলেন, পাকিস্তান এবার ভারত আক্রমণ করলে তাসখন্দ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। ১৯৬৫ সালে অধিকৃত কাশ্মীর এলাকা থেকে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলেও তাসখন্দ চুক্তি মেনে ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি।
পশ্চিম জার্মানির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভারতের আগে বা অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। ভারতও যথাসময়ে স্বীকৃতি দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহার্স্টের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় পরিকল্পনা নিয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের একটি দল ১২ নভেম্বর রাতে একটি কাপড়ের কল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে পাকিস্তানিদের সহযোগী চাঁদ মিয়া সরদার নামে একজন নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে এ দিন বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বড় একটি যুদ্ধ হয় যশোরের চৌগাছা ও মাসলিয়ার মাঝখানে। বয়রা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ভারতের ১ জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলস এতে সহায়তা করে। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা প্রতিরক্ষা থেকে সরে গেলে এলাকাটি পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার কৃষ্ণপুর ঘাটে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
প্রতাপপুর ঘাটে তৃতীয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
চতুর্থ যুদ্ধ হয় জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আক্রমণ করেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলা তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়।
মেহেরপুরের ধর্মদহে হয় পঞ্চম যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের ধর্মদহ অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় প্রায় ৫০ জন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন কয়েকজন এবং তিনজন বন্দী হন।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় ষষ্ঠ যুদ্ধে গেরিলারা পাকিস্তানিদের অবস্থানে হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৭ জন হতাহত হয়। যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। আলমডাঙ্গায় আরেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর একজন রেঞ্জার, কয়েকজন রাজাকার এবং একজন পুলিশ নিহত হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ দিন জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে সিটি অব সেন্ট আলবানস নামে যুক্তরাজ্যের একটি মালবাহী জাহাজ গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশুর নদে ঢোকার মুখে জাহাজটি গোলার মুখে পড়ে। প্রায় ৪০টি আঘাতের চিহ্ন নিয়ে জাহাজটি কলকাতায় ফিরে যায়।
১০ নভেম্বর ওই জাহাজ কলকাতা থেকে চালনা বন্দরের দিকে রওনা হয়ে সেদিনই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে। বন্দরের ছয় মাইল দূরে রাত সাড়ে ১২টায় হঠাৎ দুই দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর দুটি গানবোট এসে গোলাবর্ষণ শুরু করে। জাহাজটি গভীর সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ এদিন রাজস্থান ও পাঞ্জাবের অগ্রবর্তী গোলন্দাজ ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক জনসভায় বলেন, সংসদের শূন্য আসন পূরণের জন্য উপনির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রভাবিত সরকার গঠন করার প্রচেষ্টা তিনি মেনে নেবেন না। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে ৪০ দিনের মধ্যে সে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
১৩ নভেম্বর – যুদ্ধ ছাড়া সমাধানে ইন্দিরার সংশয়
তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর শেষে ১৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শুধু কোনো প্রস্তাব গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করতে পারেন। শেখ মুজিবকে আলোচনায় ডাকা না হলে বাংলাদেশের নেতারা ইয়াহিয়ার সঙ্গে আদৌ কথা বলবেন কি না, তাতে সন্দেহ আছে।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদিও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা বলেছে, তবু তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান আমেরিকার অস্ত্র পাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
ভারতের আসাম রাজে৵র মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ ও শরণার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে স্বার্থসিদ্ধির মতলব আঁটছে স্বার্থান্বেষীরা। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে দেরি হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ দিন প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববঙ্গে যে ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র না দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অতি সামান্য পদক্ষেপ। সেই অস্ত্রে বাঙালিদের ওপর চালানো অত্যাচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও দায়ী।
মাইন বিস্ফোরণে কূটনীতিক নিহত
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের (২ নম্বর সেক্টরের অধীন) একটি দল এ দিন ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর যান চলাচলে বাধা দিতে সোনারগাঁয়ের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মাইন পুঁতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরণে ঢাকার পশ্চিম জার্মান কনস্যুলেটের একজন কূটনীতিক এবং একজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এই সেক্টরে সালদা নদী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরের খানপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপিসিএফ) সেনাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে খানপুর সীমান্তঘাঁটি দখল করেন। অভিযানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে এসে সীমান্তঘাঁটি দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এই সেক্টরের হিলির ভারতীয় অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারাও তার পাল্টা জবাব দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম প্রহরে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোস৴ রেজিমেন্টের প্রায় এক কোম্পানি সেনাসহ রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর আহত হন। তারপরও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই যুদ্ধে ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটি মুক্ত হয়। যু্দ্ধে প্রায় ২০ জন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনায় পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলায় দর্শনা রেলস্টেশনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে
যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণসংক্রান্ত কর্মকর্তারা এদিন ঢাকায় বার্তা সংস্থা এপির প্রতিনিধির কাছে বলেন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এই প্রথম মাইন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যবাহী এই জাহাজে জাতিসংঘের পতাকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ ডলার মূলে৵র খাদ্য নষ্ট হতে বসেছে।
ঢাকা থেকে এ দিন দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনায়ত্ত এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি মনে করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্টের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করে তিনি এ দিন নিউইয়র্কে রওনা হন।
পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগীদের নিয়ে গড়া একটি বিরাট বাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটি৴র সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তান পিপলস পাটি৴র চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগের চেষ্টা না করা হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্য পূর্ব পাকিস্তানের।
১৪ নভেম্বর – ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানের হুমকির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়। মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুপস্থিতিতে দেশে সংঘটিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করতে পশ্চিমা নেতারা কতটা সাফল্য পাবেন, সে ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে।
বৈঠকটি নিয়ে দ্য টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটির সভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করানোর জন্য ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে বিশ্বনেতাদের কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত।
তাঁরা ব্যর্থ হলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ভারতের পক্ষে অসংগত হবে না। ইন্দিরার বক্তব্যে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংকটের অবসান নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।
আগামী সপ্তাহের মধ্যে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। তবে এর আগে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে এক আলোচনা সভায় বলেন, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ভারতে ঘুরে গিয়েছেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে নিরাপত্তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ হয়েছে। ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এন এম পেগোভও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
নিক্সনের নতুন উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তান আকস্মিক সংঘর্ষের শঙ্কা আছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ।
এ দিনের নিউজউইক ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনারা মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলার সংখ্যা এক লাখ।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ১৪ নভেম্বর এক ঘোষণায় জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের সব জেলাতেই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সংযোগ ধ্বংস করে ঢাকা ও কুমিল্লার সঙ্গে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করাই মুক্তিবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। ফেনী, সালদা নদী, নয়নপুর এবং খুলনা জেলার কিছু এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
ঢাকায় পাকিস্তানিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা উত্তরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে রাতে ঢাকা-আরিচা সড়কের ধামরাইয়ের ভায়াডুবি সড়কসেতু ধ্বংস করেন।
রাতের অন্ধকারে রেজাউল করিম মানিকসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর প্রতীক) অন্য গেরিলাযোদ্ধারা নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছান।
তাঁদের আক্রমণে দু-তিনজন নিহত হওয়ার পর বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
গেরিলাযোদ্ধারা তখন সেতু ধ্বংসের কাজ শুরু করেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয় সেখানে এসে তাদের আক্রমণ করে।
প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যেই রেজাউল করিম মানিকসহ কয়েকজন সেতুটি ধ্বংসের কাজ শেষ করেন।
এরপর তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া মর্টারের স্প্লিন্টার তাঁর গায়ে আঘাত করলে তিনি শহীদ হন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সহযোদ্ধারা মানিকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এলে তাঁর মা-বাবা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।
রেজাউল করিম মানিক ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এই সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান ডকইয়াডে৴ অভিযান চালায়। তাঁদের ছোড়া বোমায় ভাসমান ডকইয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে সুনামগঞ্জে একটি সড়কসেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা নদীঘাটের ফেরি ধ্বংস করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ তখন ফেরি দিয়ে নদী পার হচ্ছিল। বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। ফেরিটি ডুবে যায়।
৬ নম্বর সেক্টরের ভূরুঙ্গামারী এলাকার একাংশ এদিন মুক্ত হয়।
এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভূরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানিদের একটি অগ্রবর্তী অবস্থানে আক্রমণ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা খবর নিয়ে জানতে পারেন, কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং শুকনো খাবার ফেলে পাকিস্তানি সেনারা রাতের অন্ধকারে ওই অবস্থান থেকে পালিয়ে গেছে। ভূরুঙ্গামারীর পাশে জয়মনির হাটের একাংশ এ দিন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
১৫ নভেম্বর – ভারত হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৫ নভেম্বর দিল্লিতে বলেন, দ্রুত বা ক্রোধবশত বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত। বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি মাত্রই কথা বলে এসেছেন। সমস্যার বিভিন্ন দিক এবং বিপদের আশঙ্কা তিনি তাঁদের বুঝিয়ে বলেছেন।
এদিন সকালে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ইন্দিরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমেও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাঁর বিদেশ সফরে দেশগুলো বাংলাদেশ সংকট আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদীয় দলের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সব উপায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ সময়ে দেশে ঐকে৵র প্রয়োজন খুব বেশি।
সংসদে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সাম্প্রতিক সফর নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কোনো দেশের নেই। বহু দেশই বুঝেছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের আইনসংগত ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের না করে অন্যদের সমস্যার মীমাংসা করতে গেলে লাভ হবে না। তাঁরা বুঝেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা সেটি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বোঝাতেও চান।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতির সন্তোষজনক সমাধান এবং শরণার্থীর দেশে না ফেরা পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ভারত তার সেনা সরাবে না। ভারত আক্রান্ত হলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানেরই মাটিতে। তিনি আশা করেন, যুদ্ধের পথ ছেড়ে পাকিস্তান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবে।
সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা রংপুরের প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। সাত লাখ অধিবাসীর এই মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হচ্ছে।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বলা হয়, কুষ্টিয়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধে৵ তাঁরা যশোরের আলীগঞ্জ থেকে দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এটি পাকিস্তানিদের বিশেষভাবে কাবু করেছে। এলাকাটি রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিবাহিনীর মুখপাত্র আরও জানান, কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানিরা চরম আঘাত পাবে। এখানে শুধু যে রেল যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন, তা নয়; অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিয়েছে। এতে ওই এলাকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল প্রায় ভেঙে পড়েছে। রাতের বেলা সবাই শিবিরে বন্দী থাকে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, কুষ্টিয়া জেলার বেশ কয়েকটি সীমান্তচৌকি মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। ওই জেলার প্রায় ৯০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও মুক্তিবাহিনীর দখলে। জীবননগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দর্শনা-আলীগঞ্জ এবং আলীগঞ্জ-যশোর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এই দিন প্রকাশিত এক খবরে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর সংবাদদাতা জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে গেরিলারা ঢাকা আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছেন।
২ নম্বর সেক্টরের নারায়ণগঞ্জ এলাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ছুড়ে নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের জকিগঞ্জ দখল করেন। ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেডের সম্মিলিত শক্তি সিলেট দখল করার পরিকল্পনা হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি তাদের সঙ্গে জেড ফোর্স যোগ দেয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট অক্ষের চারগ্রামে পৌঁছায়। তাদের এই অভিযানের অংশ হিসেবে পথিমধ্যে জকিগঞ্জের পাকিস্তানি অবস্থানটি আয়ত্তে নেওয়াটা জরুরি ছিল। ১৫ নভেম্বর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ দখল করেন।
মুক্তিবাহিনী সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর বিস্তৃত এলাকা দখল করে। যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক মাশরিক–এর ১৪ নভেম্বর সংখ্যায় লন্ডন থেকে তাদের সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, বিশ্বস্ত সূত্রের মতে, চীন পাকিস্তানকে জঙ্গি বোমারু বিমান, অন্তরীক্ষে ক্ষেপণযোগ৵ মিসাইল ও ভারী ট্যাংক সরবরাহ শুরু করেছে। চীনা সামরিক সরঞ্জামের প্রথম চালান একটি সমুদ্রগামী জাহাজে ইতিমধে৵ পাকিস্তানে পৌঁছেছে।
দ্বিতীয় চালানও কারাকোরামের পথে পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় চালানে বিমানবিধ্বংসী কামান ও ট্যাংকবিধ্বংসী রকেটও আছে।
লাহোরে সাতটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটির প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
১৬ নভেম্বর – বাংলাদেশের সমাধান মাস দুয়েকের মধ্যে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ১৬ নভেম্বর কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কর্মসমিতির সভায় বলেন, মাস দুয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
অপহৃত দুই চিকিৎসকের লাশ
ঢাকার মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের দক্ষিণে সার্কুলার রোডের সেতুর নিচ থেকে এদিন হাত-পা বাঁধা ও বিকৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক শহীদ বুদ্ধিজীবী আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবীরের লাশ পাওয়া যায়। ১৫ নভেম্বর একদল আলবদর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসের সামনে থেকে তাঁদের দুজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা এক সংবাদে জানায়, ২৭ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। অধিবেশন ঢাকায় বসবে বলে স্থির হয়ে ছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মহম্মদ খান ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দেশ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার মোকাবিলা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে ওয়াশিংটনে দেখা করার পর তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ভারতের সেনাসমর্থিত গেরিলাদের অভিযানই উত্তেজনার কারণ। পাকিস্তান সংযত বলেই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে না।
অবরুদ্ধ ঢাকার গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক এক বৈঠকে শান্তি সেনা গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি নিশ্চিত, বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যাবে। ভারতে সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা নিরসনে তাঁরা উদ্গ্রীব। যুক্তরাজ্য নিজে অথবা কমনওয়েলথ বা জাতিসংঘের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে ইচ্ছুক।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনাকালে ইন্দিরা গান্ধী দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববঙ্গ সংকট অবসানের দাবি জানান। এর মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে ভারত সমগ্র দেশে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় এ খবর উদ্ধৃত করে বলা হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি পৌঁছেছেন।
শহীদ হলেন জগৎজ্যোতি দাস
বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাস ১৬ নভেম্বর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের বদলপুরে শহীদ হন। এলাকাটি মুক্তিবাহিনীর ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত হলেও এখানে কিছু যুদ্ধ ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব-সেক্টর থেকে পরিচালিত হতো। ১৫ নভেম্বর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট থেকে নৌকায় রওনা দিয়ে ১৬ নভেম্বর সকালে বদলপুরে পৌঁছান। তাঁরা জানতে পারেন, রাজাকাররা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে বসে চাঁদা আদায় করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। জগৎজ্যোতি দাস কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন।
অদূরে জলসুখা গ্রামে ছিল জগৎজ্যোতির বাড়ি। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেদিকে রওনা হন; একটি দলকে পাঠান পিটুয়াকান্দি, আরেকটিকে আজমিরীগঞ্জে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জগৎজ্যোতি জলসুখার বদলে পিটুয়াকান্দি চলে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
জগৎজ্যোতি তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা তাঁদের গুলি করে। তিন সহযোদ্ধা শহীদ হন। জগৎজ্যোতির বাঁ পাঁজরে গুলি লাগে। আহত জগৎজ্যোতিকে পাকিস্তানিরা নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। পরে আজমিরীগঞ্জ বাজারে তাঁর লাশ খুঁটিতে বেঁধে বিক্ষত করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জগৎজ্যোতিকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়ার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। আকাশবাণীতেও প্রচারিত হয় তাঁর বীরত্বগাথা। স্বাধীনতার পর তাঁকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়।
এদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়, মুক্তিবাহিনী গত কয়েক দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রংপুর ও যশোরের বিপুল এলাকা মুক্ত করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করেছে।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের গোয়াইনঘাটসংলগ্ন রাধানগর কমপ্লেক্সকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা।
৭ নভেম্বর লুনি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৮-২০ জনের একটি টহল দল আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেখানে গেলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ৮-৯ নভেম্বর লুনি গ্রাম, ১১ নভেম্বর ঘোরা গ্রাম, ছাত্তারগাঁ, দুয়ারীখেল, ১৫ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রাম, ১৬ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও দুয়ারীখেল, ১৮ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
১৭ নভেম্বর – ইয়াহিয়াকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র লন্ডনে ১৭ নভেম্বর জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লন্ডন সফরের পর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ মন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গত মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড একই দিনে দিল্লিতে বলেন, পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তাঁর সরকার ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এদিন এক খবরে বলা হয়, ভারত সফররত ব্রিটিশ মন্ত্রী রিচার্ড উড মুম্বাই পৌঁছানোর পর বলেন, পূর্ববঙ্গের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হবে। তাঁর ধারণা, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথের পক্ষে কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব নয়।
ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য হবেন
নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত এবং শেখ মুজিবের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে জানায়, চার সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলখানার আদালতকক্ষে উদাস ও শীর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে।
পত্রিকাটি জানায়, পাকিস্তানের দুই অংশের মধে৵ মীমাংসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, বাংলাদেশের নেতারা তাতে বিক্ষুব্ধ। রেহমান সোবহান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম জার্মানি এ দিন দুই হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, বিপুল পরিমাণ শীতবস্ত্র এবং ওষুধ পাঠায়। এসব সাহায্যসামগ্রী কলকাতায় রেডক্রস, ইউনিসেফসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি
বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র ১৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। ঢাকা শহরে সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করায় প্রমাণিত হচ্ছে যে ঢাকা শহর তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এ দিন ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। তারা ঢাকার সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাতে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বলা হয়, কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শহরকে দুষ্কৃতকারী মুক্ত করতে ১৭ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গী বাজারে ১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের অভিযানে এ দিন রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহার চৌধুরী নিহত হন।
১১ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে চালানো অভিযানে ঈশ্বরগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুল গণি নিহত হয়।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী ন্যাপ) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান পেশোয়ারে বলেন, দেশে যখন আগুন জ্বলছে, তখন কিছু লোক ক্ষমতার কথা বলছেন। তিনি প্রায় চার মাস বিদেশ সফরের পর এ দিন দেশে ফেরেন। দেশের গভীর সংকটে নেতাদের উদাসীনতায় তিনি আক্ষেপ করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত দক্ষিণপন্থী জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিরোধ করার চেষ্টা করায় ওই জোটের শরিক দলগুলোর সমালোচনা করেন। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে পুতুল সরকার গঠন করা হলে বিপ্লব অনিবার্য।
পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র চলছে। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র সফল হলে পশ্চিম পাকিস্তানও কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হবে।
পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাব্বিশা গ্রামে ৩২ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ থেকে যমুনা নদী পার হয়। এরপর দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল ছাব্বিশার পশ্চিম পাশে শালদাইর সেতুর কাছে এবং আরেক দল ছাব্বিশার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নেয়।
ছাব্বিশার পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তখন ছাব্বিশা গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালায়।
১৮ নভেম্বর – জাতিসংঘে বিতর্ক বাংলাদেশ নিয়ে
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাসংক্রান্ত জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ১৮ নভেম্বর সারা দিন বিতর্কের পর নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া ভারত উপমহাদেশে ওই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আলাদা দুটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি, এমন প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
তিউনিসিয়ার প্রস্তাবে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমঝোতার জন্য বিবদমান দুই পক্ষের কাছে আবেদন জানাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিকে অনুরোধ জানানো হয়।
ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে এই দিন বলা হয়, বিদেশি নেতাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ইয়াহিয়ার আশঙ্কা, তাঁকে মুক্তি দিলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য জন স্টোনহাউস কমন্স সভার অধিবেশনে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ এড়াতে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে কমনওয়েলথের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেজিল্যান্ড মডলিং বলেন, যুক্তরাজ্য তা-ই করছে।
উ থান্টকে ইন্দিরার চিঠি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক চিঠিতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে বলেন, সেখানকার জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি কোনো রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করলে সেটিকে স্বাগত জানানো হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের ২০ অক্টোবরের চিঠির জবাবে ১৬ নভেম্বর তিনি এ চিঠি লেখেন। লোকসভার এ দিনের অধিবেশনে চিঠিটি পেশ করা হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি রাতে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, যেকোনো আক্রমণ মোকাবিলা করতে ভারত সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানান, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে না।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উড দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাজ্য মনে করে, বাংলাদেশ সমস্যার দায় পাকিস্তানের এবং এর রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।
মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সহকারী হাইকমিশনের প্রবীণ বাঙালি কর্মী শাহজালাল মিয়া পালিয়ে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এসে পুলিশের কাছে আশ্রয় চান।
পাকিস্তানে চীনা প্রতিনিধিদল
চীন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী লি সুই চিংয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ৮ দিনের সফরে ১৮ নভেম্বর ইসলামাবাদে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গেও আলোচনা করবেন।
রাওয়ালপিন্ডির এক সংবাদপত্র জানায়, পাকিস্তানে বসবাসরত প্রায় ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরিকল্পনা করেছে। একজন বিদেশি কূটনীতিক বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব। জরুরি নয়, এমন কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারদের অপসারণ করা হচ্ছে।
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নভেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব নভেম্বর ( ০১-০৯ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০৯-১৬ )
- বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )
- বাংলাদেশের অগ্নিঝরা মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২৮-৩১ )
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ২০-২৭ )
- বাংলাদেশের স্বাধীনতার মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ১০-১৯ )
- বাংলাদেশের মুক্তির মার্চ মাস | ধারাবাহিক পর্ব মার্চ ( ০১ – ০৯ )
- মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ ৫০০০ ছবি উন্মুক্ত করলো
- কাজী নজরুল ইসলামের চিঠি -পত্র [ amarnazrul ]