ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো নিয়ে উত্তেজনা – ডিসেম্বর ০১
নিউইয়র্কে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা ১ ডিসেম্বর জানায়, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য পাকিস্তানের অনুরোধটি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের জন্য পাঠিয়েছেন। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, উ থান্টের অনুরোধে তাঁর কাছে লেখা ইয়াহিয়ার চিঠির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, এটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের রক্ষা করার অপপ্রয়াস। কারণ, ইয়াহিয়া খান যখন সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সবাই নীরব দর্শক হয়ে ছিল।
রাজনৈতিক মীমাংসা তিরোহিত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে বলেন, মুক্তিবাহিনী যশোরের দোরগোড়ায়। যশোরের পতন হলে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়তিনির্ধারক পথে মোড় নেবে।
ভারত সরকারের একটি সূত্র জানায়, ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা নিক্সনের চিঠির কারণে রাজনৈতিক মীমাংসার অবশিষ্ট সুযোগ শেষ। কারণ, চিঠিটি ইসলামাবাদের একগুঁয়ে মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাবটিকে দিল্লির রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘকে জড়ানোর কৌশল বলে ভাবছেন। এর পেছনে তারা ওয়াশিংটনের হাত আছে বলে মনে করছে।
মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা
মুক্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন শমশেরনগর শহর ও তৎসংলগ্ন বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রংপুরের কুড়িগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাগেশ্বরীর দখল নিয়ে নেয়। এরপর তাঁরা ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রাম দখলের জন্য লড়াই চালাতে থাকে। পঞ্চগড়ের বোদায় তুমুল যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
খুলনার কালীগঞ্জ মুক্ত
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সাংসদ ফণীভূষণ মজুমদার, তোফায়েল আহমেদসহ বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব কে এ জামান ও পুলিশের আইজি আবদুল খালেক এদিন মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির ঢাকা অফিসে বিস্ফোরণ ঘটান।
শান্তিবাগে গেরিলাদের অভিযানে মুসলিম লীগের দুজন নেতা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
বিদেশি গণমাধ্যমের মন্তব্য
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান-এর এক সংবাদে এদিন বলা হয়, ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও জাতিসংঘের ১৩১ সদস্যদেশের একটিও এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ঢাকা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন আরও একজন উপাচার্য, আওয়ামী লীগের আটজন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং দুজন রাষ্ট্রদূত।
দ্য টাইমস ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এক খবরে বলে, ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন পূর্ণ স্বাধীনতা। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের এ মনোভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী রিচার্ড উড লন্ডনে বলেন, তাঁর ধারণা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। তবে তারা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।
সংবাদ সংস্থা এবিসির হংকং ব্যুরোর প্রধান বাংলাদেশ থেকে এক প্রতিবেদনে জানান, কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা শহরের কাছে এক গ্রামে নির্বিচার প্রায় ৭৫ জন নরনারীকে হত্যা করে। কারণ, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তিনি নিজেও পরে ঘটনাটি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ এদিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা যত্রতত্র গ্রামবাসীদের হত্যা করছে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জিনজিরার লোকেরা সংবাদদাতাকে জানান, ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যা থেকে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৮৭ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অগণিত মৃতদেহ।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা রুখতেই পর্যবেক্ষক
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে চায়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন ব্যবস্থা নিতে চায়। ভারতকে আক্রমণকারী বললে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে পাঠানো এক নোটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নোটটি কবে পাঠানো হয়েছে তা বলা হয়নি।
মুজিবনগরে একটি সূত্র জানায়, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অবশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান সম্প্রতি বদলি হয়ে ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের রিয়াজ রহমানই একমাত্র কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
মুক্তিবাহিনী এদিন যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের আরও কয়েকটি থানা দখল করে। ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে সরে গিয়ে যশোর ও মাগুরা শহরের দিকে সমবেত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেন। সাতক্ষীরা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভোমরা-সাতক্ষীরা সড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এদিন তুমুল যুদ্ধ হয়। সাতক্ষীরা শহর মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে ঘিরে রাখেন। কুষ্টিয়ার জীবননগরের উত্তর-পূর্বে আবদুলবাড়িয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে। চুয়াডাঙ্গার দখল নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত। দামুড়হুদার কাছে এবং দর্শনাতেও যুদ্ধ চলমান।
৬ নম্বর সেক্টরে রংপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী দখল করে এগিয়ে এসে লালমনিরহাট বিমানবন্দরটিকে ঘিরে একে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
ভারতীয় সেনা-সহায়তায় মুক্তিবাহিনী দিনাজপুরের বালুরঘাট-হিলি সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। বেলা একটা থেকে পাকিস্তানি সেনারা ভারতের ভেতরে গোলাবর্ষণ শুরু করে। তার পাল্টা জবাবও আসতে থাকে। পাকিস্তানি গোলা থামিয়ে দেওয়ার জন্য যৌথ বাহিনী হিলি সীমান্তের দিকে এগিয়ে যায়। হিলিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের তারা উত্তর দিকে ঘিরে ফেলে। বাসুদেবপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বিতাড়িত হয়। হিলির দক্ষিণে যৌথ বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী মুখোমুখি থাকে।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযান চালান। তাঁদের অভিযানে বন্দরের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েকটি বোমা বিস্ফোরিত হলে সেখানকার পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতির শিকার হয়। একটি পেট্রলপাম্পও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারে শমসেরনগর বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে যান। এ অঞ্চলে ক্যাপ্টেন আবদুর রবের নেতৃত্বে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর সদস্যরা আগের দিন কানাইঘাট দখলের অভিযান শুরু করেছিলেন। ভোর সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা লক্ষ্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সড়কের ওপর পাকিস্তানিদের একটি টহল দলের প্রতি-আক্রমণ সামলে নিয়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অবস্থানের ৫০০ গজের ভেতরে পৌঁছে যান।
অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সব দল তাদের ফর্মিং-আপ প্লেসে পৌঁছে যায়। জায়গাটি ছিল বেশ নিচু। সেখানে পৌঁছেই ক্যাপ্টেন রব উপলব্ধি করেন, দিনের আলোতে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষায় আঘাত করলে তাঁদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। তিনি সেক্টর অধিনায়ক মেজর সি আর দত্তের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি ক্যাপ্টেন রবকে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে এসে তাঁদের এক দিনের পূর্ণ বিশ্রাম দেন। বিশ্রামের পর চাঙা হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পরদিন কানাইঘাট দখলের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হন।
বগুড়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী সারিয়াকান্দি থানায় ২২ জনকে খতম করে। ২ জন পাকিস্তানি সেনা পালাতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা রুখতেই পর্যবেক্ষক – ২ ডিসেম্বর

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে।
পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে চায়
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, উত্তেজনা যাতে প্রশমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র তেমন ব্যবস্থা নিতে চায়। ভারতকে আক্রমণকারী বললে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে না।
রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কাছে পাঠানো এক নোটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নোটটি কবে পাঠানো হয়েছে তা বলা হয়নি।
মুজিবনগরে একটি সূত্র জানায়, দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অবশিষ্ট বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমান সম্প্রতি বদলি হয়ে ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনের রিয়াজ রহমানই একমাত্র কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন।
পাকিস্তানের আক্রমণ, সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা – ৩ ডিসেম্বর

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ভারতে একতরফা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এই দিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের পাকিস্তানি অবস্থানগুলো ঘিরে ফেলার জন্য সীমান্তের সাতটি এলাকা দিয়ে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে।
ইন্দিরার বেতার ভাষণ
ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু করার সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। রাতেই দিল্লিতে ফিরে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাতে বেতার ভাষণে বলেন, এই যুদ্ধ বাংলাদেশের এবং একই সঙ্গে ভারতের। ভারতবাসীকে তিনি দীর্ঘ কৃচ্ছ্রতা ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের কাছে তিনি একটি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ বন্ধ করার সমাধান চেয়েছিলেন। এ জনগোষ্ঠীর একমাত্র অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটদান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
ফরাসি যুবকের বিমান ছিনতাই
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে ৩ ডিসেম্বর সকালে জঁ ক্যা নামে এক ফরাসি যুবক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বোয়িং-৭২০ বিমানটি ৩ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে যাত্রা করে। প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে এটির করাচি যাওয়ার কথা ছিল।
প্যারিস থেকে এটিতে পাঁচজন যাত্রী ওঠেন। নিরাপত্তাব্যূহ পেরিয়ে তাঁদের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যাও বিমানটিতে উঠে বসেন। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পাইলট বিমান চালু করতেই জঁ ক্যা পিস্তল বের করে তাঁকে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্দেশ না মানলে বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধরত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দেওয়ার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি হাজির হয়। চারজন পুলিশ গাড়ির স্বেচ্ছাসেবকের পোশাকে বিমানে ঢুকে রাত আটটায় জঁ ক্যাকে আটক করেন। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর বক্তব্যে অনুপ্রাণিত জঁ ক্যা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার উপায় খুঁজতে গিয়ে জুন মাসে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিলো ফ্লাইটের সফল অভিযান
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা ভারতের কৈলাস বিমানঘাঁটি থেকে ৩ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান চালান। রাত ২টায় ৩০০ ফুট উঁচুতে উড়ে শামসুল আলম (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও আকরাম আহমদের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি বিমান চট্টগ্রাম তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেয়। আবার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে সুলতান মাহমুদ ((স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) ও বদরুল আলমের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম) নেতৃত্বে একটি হেলিকপ্টার।
সিলেটে ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে কানাইঘাটের পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে সকাল সাতটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। সাড়ে আটটায় কানাইঘাট মুক্ত হয়। যুদ্ধে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।
৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার শমশেরনগরও মুক্ত করেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ঠাকুরগাঁও শহর দখল করেন। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁওয়ে আশ্রয় নেয়। ৩০ নভেম্বর সেনারা ভুল্লি সেতু উড়িয়ে দেয়। যৌথ বাহিনী সেতু সংস্কার করে ১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরের কাছে পৌঁছে যায়। ২ ডিসেম্বর রাতে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। সকালে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করেন।
যেকোনো সময় স্বীকৃতি
মুজিবনগর, কলকাতা ও দিল্লিতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভারত যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে এবং একই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ কারণে তিনি ডেনমার্কে চলমান সফর সংক্ষিপ্ত করতে পারেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পুরো ক্ষমতা দাবির শর্তে অসামরিক যৌথ মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে তিনি রাজি আছেন।
নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক- ৪ ডিসেম্বর

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকতে ৪ ডিসেম্বর উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ জরুরি বৈঠক ডাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিয়নের রাষ্ট্রদূত ইসমাইল টেলর কামারাকে চিঠি দেয়।
চিঠিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়া। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পরিষদের সভাপতির কাছে বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এক প্রতিবেদনে নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ডেনমার্ক সফররত সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সংঘর্ষ এড়াতে তাঁরা সাধ্যমতো সব চেষ্টা করেছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করে এ সংকট ডেকে আনা হয়েছে। ডেনিস সংবাদ সংস্থা তাঁর এক সফরসঙ্গীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে জানায়, এ যুদ্ধে এখনই হস্তক্ষেপ করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে না।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণই লক্ষ্য
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণই তাঁদের লক্ষ্য। ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার স্থাপনে সহায়তা করতে চায়।
দিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিশেষ অধিবেশনে জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছে। তারা বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বড় ফাটল ধরিয়েছে। কয়েকটি শহরের পতন হয়েছে।
চীন-ভারত সীমান্তের পূর্ব বা পশ্চিমে চীনা সেনা সমাবেশের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণশীল মনোভাবের অভিযোগ এনেছে চীন। ভারতকে সমর্থন জানানোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করে চীন। একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
যুদ্ধ ঘোষণার পরে
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন ছিলেন মুক্তাঞ্চলে।
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের প্রথম দিনই মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চারদিক থেকে যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা দখল এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের যুদ্ধেই বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অর্ধেকের বেশি বিমান এদিন বিধ্বস্ত হয়।
২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার দেবীদ্বার মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী দেবীদ্বারসহ কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেছিল। ভারতের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় অভিযান চলে। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংকবহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানিরা রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে চার ঘণ্টা লড়াই করে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দর্শনার ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে তারা পিছু হটে গেলে ৪ ডিসেম্বর দর্শনা শহর মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী এই সেক্টরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার জীবননগরও মুক্ত করে। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেলে জীবননগর চূড়ান্তভাবে মুক্ত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী মুক্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ফুলবাড়ীর বেতদিঘী, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রানী, আমড়া ও রানীনগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে শহরের পশ্চিম পাশে ছোট যমুনা নদীর ওপর লোহার সেতুর পূর্ব অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে শালচূড়া ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। আহমদনগর হেডকোয়ার্টারের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাতেই ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শক্রমুক্ত হয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে পতাকা ওড়ান।
১১ নম্বর সেক্টরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কামালপুর সীমান্তঘাঁটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৩ ডিসেম্বর কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। বকশীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) সে চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যান। চিঠি পেয়ে ক্যাম্পের অধিনায়ক আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। বশীরের ফিরতে দেরি হওয়ায় আরেকটি চিঠি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জুকে পাঠানো হয়। অবশেষে বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবিসহ ১৬২ জন সেনার একটি দল ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। শত্রুমুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সোভিয়েত ভেটো – ৫ ডিসেম্বর – ৫ ডিসেম্বর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় বাংলাদেশসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
এই প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ প্রস্তাবটি পেশ করে বলেন, এ সমস্যা সমাধানে পরিষদ বলপ্রয়োগের নীতি নিতে পারে না।
সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকব মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য বলে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব আনেন।
সে প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার আগে বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের অত্যাচার বন্ধের দাবিও তোলা হয়।
সোভিয়েত বলে, অবস্থার অবনতির কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার।
বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব করে। তীব্র আপত্তি জানিয়ে চীনা প্রতিনিধি বলেন, এতে জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে।
ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বিষয়টি যথাযথ পটভূমিতে বিবেচনা করতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।
পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, পাকিস্তানকে টুকরো টুকরো করতে ভারত পাকিস্তানে হামলা করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে ভোট দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি, আর চীন ভোটে অংশ নেয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরি অধিবেশন বসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি রাষ্ট্রের অনুরোধে। স্থির হয় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা বিতর্কে অংশ নিলেও তাঁদের ভোটাধিকার থাকবে না।
চীন তাদের খসড়া প্রস্তাবে বলে, পাকিস্তানি এলাকা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে হবে।
পাকিস্তানকেও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রস্তাবে ভারতীয় আক্রমণ রুখতে সংগ্রামে লিপ্ত পাকিস্তানি জনগণকে সমর্থন করতে সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব নিয়ে সোভিয়েত ও চীনের প্রতিনিধির মধ্যে বাগ্যুদ্ধ হয়। চীনের প্রতিনিধি বলেন, এ প্রস্তাব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সমতুল্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এদিন বিশ্বশক্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। সতর্কবাণীতে বলা হয়, সোভিয়েত সীমান্তের কাছে যে অবস্থা চলছে, তাতে তাদের নিরাপত্তা-স্বার্থ জড়িত। তারা এতে উদাসীন থাকতে পারে না।
চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সানডে টাইমস পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে চীন পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ওয়াশিংটনে তাঁর প্রধান সহকর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁরা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের সোভিয়েত ভেটোর নানা দিক বিচার করেন।
ওয়াশিংটন থেকে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র এদিন এক সরকারি বিবরণ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, উইলিয়াম রজার্স তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করেছেন।
তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে একটি স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় সত্যের অপলাপ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত।
বাংলাদেশের আকাশ মুক্ত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এদিন ভারতীয় বাহিনীর বিমানগুলো ঢাকাসহ বাংলাদেশের আকাশ দখল করে নেয়। সেগুলো আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ঢাকার তেজগাঁওসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটি ও বন্দর অচল করে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে।
ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা-রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর-রাজশাহীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ অটুট ছিল।
একটি বড় যুদ্ধ হয় লাকসামে, আরেকটি ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুই লড়াইয়েই পাকিস্তানি বাহিনী বিধ্বস্ত অবস্থায় পালিয়ে যায়।
যৌথ বাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। পাকিস্তানি বাহিনী একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে।
কিছু পাকিস্তানি সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালায়। এখানে প্রায় ১৬০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত হয়।
সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমীন, সিপাহি সাহাব উদ্দীন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট কিলোফ্লাইট এদিন সিলেট অঞ্চলে বোমা ফেলে কয়েকটি পাকিস্তানি বাংকার উড়িয়ে দেয়। জামালপুরে বিমান হামলায় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
বাংলাদেশের সত্তা স্বাধীন
ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, একটি আলাদা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ভারত স্বীকার করে নিয়েছে।
এখন বাকি আছে শুধু সরকারের স্বীকৃতি। শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এর জবাব পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশকে ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি – ৬ ডিসেম্বর
বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সংসদে এ ঘোষণা দেন।
পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে চিঠি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা দেন, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে বলেন, বিরাট বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের মন পড়ে রয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে।’
পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
স্বীকৃতির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডকেও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শাহীন সামাদ, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলা মোমেন, শারমিন মুরশিদ প্রমুখ শিল্পী ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেন।
আবার সোভিয়েত ভেটো
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করে।
প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে।
রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়।
জর্জ বুশ ভারতকে পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
পরিষদের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক বলেন, শান্তির জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার নীতির ভিত্তিতেই এই প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তদনুসারে প্রস্তাবটি অবিলম্বে বিচার করে দেখতে হবে। ভারতের প্রস্তাবটি তিনি ভোটে দিতে চাইলে ভারত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ যুদ্ধের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত একটা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি থাকে। আবার অধিবেশন শুরু হলে বর্তমান বিরোধের মানবিক দিক সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট একটি বিবৃতি পেশ করেন।
এরপর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি, বিপক্ষে ১১টি। ১০টি রাষ্ট্র ভোট দেয়নি। কয়েকটি দেশ অনুপস্থিত থাকে। সাধারণ পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩১।
ভারতের আক্রমণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে চীন আরেকটি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি প্রস্তাব আনে। কোনোটিই ভোটে দেওয়া হয়নি।
এর আগে ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই মর্মে দাবি জানায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সেনা অপসারণ নিয়ে আনা প্রস্তাব সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না হলে তা বলবৎ করা যাবে না।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে এক জরুরি আলোচনা শুরু হয়। আর্জেন্টিনা প্রস্তাব উত্থাপন করে দুই দেশকে অস্ত্র সংবরণ করে সীমান্তের দুই দিকে তাদের সেনা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলে।
নিরাপত্তা পরিষদেও অনুরূপ প্রস্তাব তোলা হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিলে প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের প্রস্তাবে বলা হয়, বিষয়টি সাধারণ পরিষদের বিচার্য হতে পারে কি না, সেটা পরিষদের কার্য পরিচালনা কমিটিতে তা বিচার করে দেখতে বলা হোক।
যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যশোর-সিলেট
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত যশোরের এদিন পতন হয়। ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরাও মুক্ত হয়। পতন হয় সিলেটেরও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার দিকে।
যৌথ বাহিনী প্রথমে দখল করে যশোর বিমানবন্দর। তারপর সেনানিবাস। বয়রা ও বেনাপোল থেকেও যৌথ বাহিনী যশোরের দিকে এগোয়। ততক্ষণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা যশোর থেকে পালিয়েছে। শ দুয়েক সেনা ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করে।
ঝিনাইদহ ছেড়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ঢাকার দিকে, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার দিকে।
সিলেটের পতন হয় যশোরের কিছুক্ষণ পর। যৌথ বাহিনী প্রথমে শালুটিকর বিমানবন্দর দখল করে। সেখানে যৌথ বাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর চারদিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাকিস্তান সেনারা পিছু হটে মেঘনা নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়।
এদিন আরও মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা, শেরপুর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, বাগেরহাটের মোংলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দিরাই।
ভুটানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দিল্লিতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র সংবাদটি প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।
ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান, তিনি কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। এর প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রধান নুরুল আমিন। সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো।
চীনের প্রতি সোভিয়েত সতর্কবাণী
পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভাষণে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ডাক দেন। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, তিনি বাইরের শক্তি বলতে চীনকেই বুঝিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস-এর সংবাদদাতা কলকাতা থেকে পাঠানো এক খবরে বলেন, ভারতীয় সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন, অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করাই তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাঁর বক্তব্য প্রচারপত্র হিসেবে পাকিস্তান সেনা-অধ্যুষিত এলাকায় বিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেন, ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য দুনিয়ায় সমস্ত দেশের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। তিনি পৃথিবীর শান্তিকামী দেশগুলোর কাছে আবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।
এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসভবনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ জাতীয় পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সুচিত্রা মিত্র ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গান। বক্তব্য দেন অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।
মুজিবনগরে একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, ভারতের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে স্থির হয়েছে, ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। বাংলাদেশ সরকার হবে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর জঙ্গিশাহির নির্যাতন এবং ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার চীনের সরকারি নীতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যে চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে, তারাই একেবারে চুপ করে আছে, এটি বড়ই দুঃখের বিষয়।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানবে না ভারত – ৮ ডিসেম্বর
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র ৮ ডিসেম্বর বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কোনো চাপের মুখেই ভারত মানবে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকারকে ভারত একটি বৈধ সরকার বলে মনে করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বৈঠকে সবাই একমত হন যে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে কোনো যুদ্ধবিরতি মানা সম্ভব নয়।
দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন নতুন কোনো প্রস্তাব করেছিলেন বলে ভারতের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশকে ভারত বারবার বলেছে, রাজনৈতিক সমাধান করার একমাত্র উপায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচিত সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁকে আলোচনা করতে দেওয়া।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে দেশটির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সহকারী প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্কের পথে রওনা দেন।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের অনুরোধে এদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহিও উ থান্টের সঙ্গে দেখা করেন। উ থান্ট ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানান। জাতিসংঘের লোকজন ও বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্য দুই দেশের সরকারকেও অনুরোধ জানানো হয়।
মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা এদিনও অব্যাহত থাকে। বিমানঘাঁটিসহ কুমিল্লা শহর এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনামুক্ত। মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এদিন শুরু হয় ময়নামতি সেনানিবাস দখলের লড়াই। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা এখন স্বাধীন। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ করা হয়। চট্টগ্রামের রামগড় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।
যশোর শহর থেকে যৌথ বাহিনী চতুর্মুখী অভিযান চালায়। একটি দল ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা দখল করে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসংযোগ মুক্তিবাহিনীর অধিকারে আসে। যৌথ বাহিনীর তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সেনারা মাগুরা থেকে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যায়।
যশোর থেকে একটি দল এগোয় নড়াইলের দিকে। আরেকটি দল সাতক্ষীরা ও কলারোয়া দখল করে। যশোর-কালীগঞ্জ খণ্ডে খুলনার পথে লেবুতলা যৌথ বাহিনীর দখলে। কুষ্টিয়া এখনো অবরুদ্ধ।
পদ্মার উত্তর তীরে রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে মুক্তিবাহিনী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজশাহী ও পাবনার সঙ্গে গোয়ালন্দ ঘাটের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। চুয়াডাঙ্গা অবরুদ্ধ। মেহেরপুর মুক্ত করে যৌথ বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় গোলাবর্ষণ করে। খুলনা শহরে গোলাবর্ষণ অব্যাহত। ঝিনাইদহের কাছে পিছু হটার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি সেতু ধ্বংস করে যায়। এখানে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।
উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে রংপুর শহরের পতন আসন্ন। পীরগঞ্জ এখন মুক্ত। সৈয়দপুরের উত্তরে একটি পাকিস্তানি ঘাঁটি যৌথ বাহিনীর দখলে।
রাতের মধ্যে মুক্ত হয় সিলেটের শ্রীমঙ্গল, রংপুর-দিনাজপুরের দুর্গাপুর ও বাদুড়িয়া এবং যশোর-খুলনার রূপদিয়া ও লেবুতলা।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ জন সেনা এদিন মুজিবনগরে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী তাঁদের স্বাগত জানান। এই সেনারা লাহোরে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় চারজন কর্মকর্তাসহ ওই সেনারা অস্ত্রশস্ত্রসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এদিন মুক্ত কুমিল্লা পরিদর্শন করেন। সকালে যৌথ বাহিনী বিমানবন্দরসহ কুমিল্লা শহর দখল করে।
অরোরা বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা লাগিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছালে জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। ভারতীয় বাহিনীর পদস্থ কোনো কর্মকর্তা হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফর করলেন।
বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের কাছে এক ধন্যবাদ বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ-ভুটান বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে বলেন, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন। ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রজ্ঞায় বাঙালি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি অন্ধতার পরিচায়ক। চীনও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ।
আরও দেখুনঃ