ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়।  যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।

এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

Table of Contents

ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

 

ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ

দিল্লিতে ৯ ডিসেম্বর রাতে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কী রণকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েক দিন আলাপ-আলোচনার পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি সামরিক যুদ্ধ কমান্ড গঠিত হয়েছে।

ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণায় আরও বলা হয়, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একযোগে কাজ করছে। এ চুক্তিতে দুই বাহিনীর সমঝোতার আইনগত ভিত্তি দেওয়া হলো। দুই বাহিনী পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। দায়িত্ব থাকবে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে।

 

বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )

 

বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( ০১-০৮ )

যশোর সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল চারটি হলো মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম।

এর আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে পৌঁছালে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায় বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন: ১. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। ২. ফেলে যাওয়া জমি ও দোকান ২৫ মার্চের আগের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চাষ হয়ে থাকলে চাষি বর্গাদার হিসেবে অর্ধেক ফলন পাবেন। ৩. যেকোনো ধর্মের যেকোনো নাগরিকের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করলে কঠোর সাজা দেওয়া হবে।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে তাঁর দলের সদস্য ও সমর্থকদের বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী এবং অন্য দল ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একযোগে স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করে তোলার নির্দেশ দেন।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত।

আগের দিন ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা ঢাকার আশপাশে মুক্ত কিছু এলাকায় নেমে পড়েন। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলছিল।

ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। ঢাকা মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে।

আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমশ ঢাকার দিকে আগুয়ান। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা।

হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলেও মোটেই রুখতে পারেনি।
যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার উপকণ্ঠে পৌঁছায়। হিলি থেকে এগিয়ে তারা বগুড়া শহর থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থান নেয়।

বগুড়ার পতন আসন্ন। চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় সেনানিবাস ও শহরের আশপাশে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে।

কক্সবাজারে ধ্বংস হয় একটি গানবোট ও দুটি জাহাজ। রাঙামাটিতে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনারা মিয়ানমারের দিকে পালাতে থাকে।

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( )

 

ভারত মহাসাগরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর রওনা হওয়ার খবর জানাজানি হলে দিল্লি ও মুজিবনগরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা ১৩ ডিসেম্বর জানান, সপ্তম নৌবহরের পরমাণুশক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ আরও কয়েকটি জাহাজ, ডেস্ট্রয়ারসহ ১০ ডিসেম্বর সায়গনের দরিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।

হংকং উপসাগরে এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে কর্তব্যরত বিমানবাহী জাহাজ কন্সটেলেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এন্টারপ্রাইজ এবং তার সহযোগী সব জাহাজকে সিঙ্গাপুরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এন্টারপ্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী জাহাজ।

পাল্টা সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ

নিউইয়র্ক টাইমস ওই খবরে ওয়াশিংটনের একটি খবর উদ্ধৃত করে আরও বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তি জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।

যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারত মহাসাগরে একটি রাশিয়ান নৌবহর সমবেত হয়েছে। প্রায় এক ডজন যুদ্ধজাহাজ এবং আণবিক শক্তিচালিত ১০টি সাবমেরিন এ নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( )

 

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন আলবদর বাহিনীর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সূচনা। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখকে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে দৈহিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এ ধরনের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ কয়েকটি এলাকায়। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীকে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়।

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( )

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ডিসেম্বর মাস | ধারাবাহিক পর্ব ডিসেম্বর ( )

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধে বহুপ্রত্যাশিত বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনতা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম দেয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের। হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঢাকায় আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।

Leave a Comment