অক্টোবর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ৩ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
২৮ অক্টোবর – শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটি দখলের যুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। আগের রাতে পাকিস্তানিদের অবস্থানের প্রায় ৬০০ গজ দূরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই উপদলের একটি বাঁ দিক আর অন্যটি ডান দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। হামিদুর রহমানের দলটি থাকে মাঝখানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা আগেই গোলা ছুড়তে শুরু করে। উঁচু টিলার ওপর থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ভারী মেশিনগানের গুলির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের ডান-বাম দুই দলই এগোতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকজন গুলিতে হতাহত হন।
সে অবস্থায় হামিদুর রহমান দুটি এলএমজির কাভারিং ফায়ারের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষিপ্রগতিতে বুকে হেঁটে পাকিস্তানি মেশিনগান পোস্টের ১০ গজের মধ্যে পৌঁছে সেখান থেকে গ্রেনেড ছোড়েন। তাঁর গ্রেনেড নিখুঁত নিশানায় পড়ে মেশিনগানের গুলি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পাশের আরেকটি বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সেই গুলিতে হামিদুর রহমান শহীদ হন।
হামিদুর রহমানের মরদেহ মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন উদ্ধার করতে পারেননি। ৩ নভেম্বর ধলই মুক্ত হলে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আবার সমাহিত করা হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন দুপুরে রাজধানী ঢাকায় গভর্নর হাউসের পার্শ্ববর্তী ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) ভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। এ ভবনে তখন টেলিভিশন স্টুডিও থাকায় ভবনের গেট সেনা পাহারায় রাখা হতো। সে পাহারা ভেদ করে মুক্তিযোদ্ধারা ভবনের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটান। এতে টাওয়ারে বিরাট ফোকর এবং সপ্তম তলার মেঝেতে গর্তের সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক মীমাংসার আশা কম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, সমস্যা সমাধানের সহায়ক হলে ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি বিবেচনা করবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনা আগের চেয়ে কম।
অস্ট্রিয়ায় চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিলে বাংলাদেশ প্রশ্নে উত্তেজনা হ্রাস পাবে। সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে ভিয়েনায় আয়োজিত ভোজসভার তিনি এ কথা বলেন।
ইন্দিরা গান্ধী এদিন অস্ট্রিয়া থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার আগে ভিয়েনায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এবং সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি সম্পর্কে যেসব দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতকেও সমানভাবে দায়ী করার চেষ্টা করছে, তাদের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, এই যুক্তি অচল। পাকিস্তান যখন সীমান্তে সেনাসমাবেশ করল, তখন কেন বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তিনি বলেন, পাকিস্তান শত শত বা হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
ব্রিটেনের চার্চ কাউন্সিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের ওপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ জানায়।
জাতিসংঘে ভারতে স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেন।
ভারত এদিন জাতিসংঘে অভিযোগ করে যে লাখ লাখ শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দিয়ে এবং উত্তেজনা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ঘোষণাকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শক্তিশালী করা সম্পর্কে সাধারণ পরিষদের প্রথম কমিটিতে এই অভিযোগ করেন। পূর্ববঙ্গের জনপ্রিয় নেতাদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে পাকিস্তান সরকারকে সম্মত করানোর জন্য তিনি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে আবেদন জানান।
ভারতের অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবণ দিল্লি প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা ধারণা করছেন, শরণার্থীরা এখানে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত থাকবেন। তাঁর এই ধারণার ভিত্তি অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র ২৮ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, বাংলাদেশ সরকারের ধারণা, খুব শিগগির দেশ স্বাধীন হবে। এ জন্য তারা প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসনব্যবস্থার বিস্তারিত কাঠামোও প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে। পাকিস্তানি সেনারা বিতাড়িত হওয়ার পর বাংলাদেশে যাতে কোনো অরাজক অবস্থা সৃষ্টি না হতে পারে, সে জন্য সম্পূর্ণ ছক তৈরি করে রাখা হচ্ছে।
এই দিনও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেসব জাতীয় পরিষদ সদস্য বিদেশি প্রতিনিধি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন বা বলছেন, কমিটি তাঁদের সাবধান করে দেয়। কার্যনির্বাহী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এরপর কেউ এমন উদ্যোগ নিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিটি আরও ঘোষণা করে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো শর্তেই তারা আর কোনো আলোচনা করতে রাজি নয়। কার্যনির্বাহী কমিটি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রাখার প্রস্তাব দেয় এবং যাদের অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে, তাদের পূর্ণ তালিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানায়।
২৯ অক্টোবর – বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর ২৯ অক্টোবর কলকাতায় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক জেলে আটক রেখেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বৃহৎ শক্তিগুলোকে এ কথা লিখে জানিয়েছেন। ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিবর্গসহ কিছু দেশ পাকিস্তানকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। ডি পি ধর গত তিন দিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক সেরে এ দিন সন্ধ্যায় দিল্লি রওনা দেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দিল্লিতে পররাষ্ট্রসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিকে বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে সোভিয়েত-ভারত চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জরুরি পরামর্শ নেওয়া হবে।
দিল্লিতে এ দিন সরকারি তথ্যে জানানো হয় যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৯৭।
স্বাধীনতা ছাড়া পথ নেই
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার অন্য কোনো সমাধান নেই। মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করে তুলতে বৈঠকে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কিছু লোক একশ্রেণির বিদেশির সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলায় অনেক ক্ষেত্রে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে। কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৪৩ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কমিটির ৪৯ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন মৃত। বাকি ৪ জনের অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এ দিন একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিবেশক সংস্থা বলাকা পিকচার্স জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের ভারতীয় পরিবেশনা স্বত্ব লাভ করে। ভারত সরকার ছবিটির প্রমোদ কর মওকুফ করেছে। এর বিক্রয়লব্ধ অর্থ মুক্তিসংগ্রামে ব্যয় করা হবে। অনুষ্ঠানে জহির রায়হানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রান্স প্রভাব বিস্তার করবে
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরগেস ২৯ অক্টোবর দেশটির সংসদকে জানান, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়াতে এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ফ্রান্স প্রভাব বিস্তার করবে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু ইয়াহিয়া খানের কাছে এ ব্যাপারে কয়েকটি বার্তা পাঠিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এই দিন লন্ডনে আসেন। লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইন্দিরার সফরের উল্লেখ করে বলা হয়, তিনি মনে করেন, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিবন্ধে ইন্দিরার প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে ভোর চারটায় পাকিস্তানি সেনারা শালদার নয়াপুর ও ফুলগাজী থেকে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে প্রচণ্ড কামান আক্রমণ শুরু করে। তারা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা পিছু হটে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এই সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার শিমপুরে একটি সড়কে মাইন পেতে রাখে। পাকিস্তানি সেনারা সড়কপথে সেখানে টহল দিতে এলে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়ে কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল দুটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। একটি দল ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) অ্যাভিনিউতে মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের কাছে একটি পাকিস্তানি টহল দলের ওপর বোমা ছোড়ে। বোমাটি মর্নিং নিউজ পত্রিকা ভবনের সীমানাদেয়ালের গেটে বিস্ফোরিত হয়। অন্য দলটি খিলগাঁও বাজারে সমবেত শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর হামলা করে। এতে দুজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।
প্রতিরক্ষা বিবেচনায় মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তঘাঁটির পাশে পাত্রখোলা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। স্থানটি দখল করার জন্য বড় একটি পরিকল্পনা করা হয়। অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। পাত্রখোলা চা–বাগানে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী এ দিন একের পর এক আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাত্রখোলার দুই মাইল দক্ষিণে কাট-অফ পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাদের দুটি দল পাত্রখোলার দিকে এগোতে থাকলে তারা প্রবল বাধা দেয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয়। ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।
পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল ধলইয়ের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাত্রখোলার দিকে এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দল ধলই-পাত্রখোলা সড়কের মাঝামাঝি স্থানে অ্যামবুশ করে। সেই ফাঁদে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৮ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন মেহেরপুরের ষোলটাকা অঞ্চলে হামলা করে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করেন। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দর্শনা, কোটচাঁদপুর এবং কামেদবপুরে পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে। এসব যুদ্ধে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৩০ অক্টোবর – ফ্রান্স-সোভিয়েত যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশ
ব্রিটেন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। তাঁরা দুজনই আলোচনায় একমত হন যে পাকিস্তানের শাসক এবং বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতাদের নিয়েই বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। এ জন্য কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানকে রাজি করাতে হিথ যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আশ্বস্ত হতে চান।
আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা, ভারতে শরণার্থীদের বোঝা, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের নেতাদের ধারণা এখন অনেকটা স্পষ্ট।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, বাংলাদেশ সংকটের জরুরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইন্দিরা ও হিথ দুজনই পুরোপুরি একমত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য মনে করছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে দেরি করলে পাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাজ্য সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বালিসিয়ামে এক সভায় বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলবে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট নাকচ করে দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচি বহাল রাখতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তিনি উপদেষ্টাসহ রিপাবলিকান নেতাদের সঙ্গে আলাপে কর্মসূচিটি বহাল রাখার জোরালো দাবি জানান।
যুক্তরাজ্যে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেনও ছিলেন। আবদুল মোমেন বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সমর্থন দিতে আবদুর রাজ্জাককে অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগোলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে থাকলেও তাঁর দলের মুসলিম সদস্যদের বিরোধিতার ফলে তা পারেননি।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা এ দিন রাতে সার্কুলার রোডে নির্বাচন কমিশন অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযান চালানোর আগে তাঁরা বেসামরিক লোকদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।
পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থেকে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে একই সেক্টরের চাপিতলার মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এসে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দিনব্যাপী যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর কটেশ্বর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের শার্শার পশ্চিমে সাহেববাড়ীতে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন হতাহত হয় এবং তিনজন আত্মসমর্পণ করে।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ধর্মদহে একদল পাকিস্তানি সেনাকে অ্যামবুশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।
রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় এই দিন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আয়োজিত সভায় বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দানসহ জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দাবি করা হয়। কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের আছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম মধ্যপ্রদেশে এক জনসভায় বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছু করবে না। কিন্তু পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানের মাটিতে। এর আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর অনুষ্ঠানেও তিনি বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে ভারত আক্রান্ত হলে বা এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অবশ্যই যুদ্ধ করবে।
- অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “মে মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “মে মাস ১৯৭১ ১”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ] Kazi Nazrul Islam Biography [ Short ] [ আমার নজরুল ]