অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ২ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
১৯ অক্টোবর – ইয়াহিয়ার সঙ্গে মীমাংসা নয়

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসবে না। একজন বাঙালি জীবিত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বড় শক্তিগুলোর দান হিসেবে নয়, বাঙালিরাই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তাতে তিনি খুবই আশাবাদী। মুক্তাঞ্চলে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য বাছাই করা গেরিলা এবং বাংলাদেশ বাহিনীতে সম্প্রতি কমিশন পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের নায়ক ও রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি রাষ্ট্রের নেতাকে আটকে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
ইন্দিরা গান্ধীর সংবাদ সম্মেলন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইয়াহিয়া খান নাকি আলোচনার জন্য উদ্গ্রীব। কিন্তু তাঁকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে নয়। হয়তো তার ভিত্তি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সমস্যা বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে। এখানে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। ভারত এই বিরোধের কারণে যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সেটা হলো ৯০ লাখ শরণার্থীর বোঝা। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো অস্ত্র ও শক্তি নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে জ্বলছে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্পৃহা। দেশপ্রেম যাদের হাতিয়ার, পরিণামে তারাই বিজয়ী হয়।
ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করছে পাকিস্তান। ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। ধর্মীয় মতান্ধতাকে উসকানি দিচ্ছে। এসব উপেক্ষা করে কি ভারতীয় বাহিনীকে সতর্ক অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব? যিনি ঘুষি পাকিয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে কি করমর্দন করা চলে?
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনের কথাই বলছেন। বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই মেটাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সীমান্তে সেনা সমাবেশের ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, সংযত থাকার অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তিক্ত করেছে মাত্র।
রাও ফরমান আলীর স্বীকারোক্তি
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১৯ অক্টোবর এএফপির প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন, মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, জুন-জুলাইয়ের তুলনায় নাশকতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। এসব কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে গেরিলা আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চা-বাগানগুলোতে। পাকিস্তানি সেনারা নিরাপত্তা জোরদার করলে তারা ব্যক্তিগত হামলায় নামে এবং পাটের সরবরাহে আক্রমণ চালায়। তিনি বলেন, দক্ষিণের জেলাগুলোতে গেরিলা নাশকতার পরিমাণ বেশি।
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, পাকিস্তানের সামরিক সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন পরিকল্পনা করছে। বর্ষা শেষ হলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুবিধা হবে বলে তারা ভাবছে।
বিভিন্ন সামরিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্তে প্রায় আড়াই লাখ এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৮০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে।
ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমা ফাটান। এতে পাকিস্তানি সেনাসহ কিছু সাধারণ মানুষও হতাহত হন।
পরদিন ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘বেলা অনুমান ১১টায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাস্থ হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সম্মুখে বোমা বিস্ফোরণের ফলে ৫ ব্যক্তি নিহত ও ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের সম্মুখে পার্ক করা ৬টি মোটরগাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়াছে। ইহা ছাড়া আরও ১৯/২০টি মোটরগাড়ি ও ৮ তলা হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের কাঁচের সার্সি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।’
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার মিয়াবাজার ও পান্নাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালান। আকস্মিক এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার, মেশিনগান ও এলএমজির সাহায্যে যশোর জেলার ঝিকরগাছার গোয়ালহাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনাদলটি ছুটিপুর থেকে বিশাহারীর দিকে যাচ্ছিল। তারা অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
২০ অক্টোবর – আওয়ামী লীগের সভা যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে
মুজিবনগরে ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সকাল ১০টায় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শপথ নিয়ে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ নিবেদন করা যোদ্ধা ও দেশবাসীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে তিনি যুদ্ধ পরিস্থিতি, মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ জন সদস্য তাঁর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বক্তব্য দেন।
সভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি একাধিক প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ২১ অক্টোবর।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাড়াতে সভায় আলোচনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও আলোচনা হয়।
উ থান্টের উদ্বেগ
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানাতে ২০ অক্টোবর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর দেন এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহির সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। পরিস্থিতি যাতে আর খারাপ না হয়, সে জন্য উ থান্ট তাঁদের অনুরোধ জানান।
ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী ও ভাবুক আঁদ্রে মালরো এই দিন বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, এর ফলে তাঁর বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার অধিকার আসবে।
নিউইয়র্ক টাইমস এ দিন তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, বাতাসে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই ব্যাপক সেনা সমাবেশ করেছে। এ প্রসঙ্গে দিল্লির একজন মুখপাত্রের সতর্কবাণীকে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে গেরিলাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার চলছে। বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর সেনাদের অত্যাচার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ রোধে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
ভারত ও যুগোস্লাভিয়া ইশতেহারে সতর্কবাণী
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনা শেষে যুক্ত ইশতেহারে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানের প্রশ্নটি স্থগিত রাখা হলে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানই এই সমস্যার একমাত্র মীমাংসা। এর ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক হবে এবং শরণার্থীরা নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র দিল্লিতে এই যুক্ত ইশতেহার প্রচার উপলক্ষে সাংবাদিকদের বলেন, ভারত প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে। বিশ্বসমাজ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে ভারতকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা কত দিনের মধ্যে, তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি।
এই যুক্ত ইশতেহারকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
ভারতে পূর্ব জার্মানির কনসাল জেনারেল এইচ ফিশার কলকাতায় বলেন, বাংলাদেশের ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা করে পাকিস্তানকে এ সমস্যা মেটাতে হবে। এ সমস্যার যথাযথ সমাধানে শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।
কলকাতার সল্টলেকে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সনাতন ধর্মের শরণার্থী নারীরা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফোঁটা দিয়ে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
গেরিলা অভিযান
ঢাকা অভিযানের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল ২০ অক্টোবর মতিঝিলে স্টেট ব্যাংক ভবনের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) পাঁচতলায় টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে আসবাব ও কাগজপত্রে আগুন ধরে যায়, তবে কেউ হতাহত হয়নি। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ অক্টোবরও মতিঝিলে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানিরা মতিঝিলসহ শহরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। এই জোরালো নিরাপত্তার মধ্যেই গেরিলাদের একের পর এক অভিযানের ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভোরে রঘুনাথপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করেন। তারা পাটবোঝাই একটি ট্রাক পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত এবং পাটবোঝাই ট্রাকটি বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়।
২১ অক্টোবর – মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে মুক্তিবাহিনী
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে একজন মুখপাত্র ২১ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং সুনামগঞ্জের ছাতক শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের পর স্থির করেছে, পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে তারাও প্রতিটি সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধ করবে। গেরিলা অভিযানও চলবে। সম্মুখযুদ্ধের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। মুখপাত্র বলেন, গত এক সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বহু শত্রুসেনা নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ৬০০ এবং বহু অস্ত্র অধিকারে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ২০০ জন পাকিস্তানি সৈন্যও আটক করেছেন। তাঁদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে ৪৫০ জন রাজাকার।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দ্বিতীয় দিনের সভা এই দিন গভীর রাত পর্যন্ত চলে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সেসব জানানো হবে।
শরণার্থীদের নিয়ে পুস্তিকা
বাংলাদেশের শরণার্থীদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে ২১ অক্টোবর অক্সফাম ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদ ও সাংবাদিকের বিবরণ তাতে প্রকাশ করা হয়। অক্সফামের পরিচালক লেজলি কার্কলি বলেন, পুস্তিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, যুক্তরাজ্যের সংসদ এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া নানা দেশের প্রতিনিধিদের কাছে পুস্তিকাটি বিতরণ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট এদিন ‘উপমহাদেশে যুদ্ধের হুমকি’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কে বক্তারা পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জোরালো বক্তব্য দিলেও কেউ তা কার্যকর করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। সম্পাদকীয়তে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে লজ্জাকর বলে অভিহিত করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল এদিন চারটি আলাদা স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল ফেনীর ছাগলনাইয়ার মির্দ্দারবাজারে পাকিস্তানের একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। দ্বিতীয় দলটি মির্দ্দারবাজারের কাছাকাছি দক্ষিণ যশপুরে কাট অব পার্টি হিসেবে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলটি অ্যামবুশের মধ্যে মির্দ্দারবাজারে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলের আক্রমণের মুখে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি টহল দলের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে একদল পাকিস্তানি সেনা ছাগলনাইয়া থেকে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে মির্দ্দারবাজারে রওনা দেয়। পাকিস্তানি সেনাদলটিকে দক্ষিণ যশপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। মির্দ্দারবাজার ও দক্ষিণ যশপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি ফেনীর ফুলগাজী থানা সদর এলাকায় অ্যামবুশ করলে আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদলের দুজন নিহত ও তিনজন আহত হয়। চতুর্থ দল ভারত সীমান্তের কাছে আমজাদহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। পাঁচজন রাজাকার নিহত এবং একজন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা নগরে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যায় খিলগাঁও হাইস্কুলের পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার ওপর আক্রমণ করে। রাজাকাররা পাল্টা প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ফোরকে খিলগাঁও হাইস্কুল ভস্মীভূত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলের একটি উপদল রাতে শাহজাহানপুর হাইস্কুলের পাশে টহলরত রাজাকারদের আরেকটি দলকে আক্রমণ করে। রাজাকাররা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া বিস্ফোরকে শাহজাহানপুর হাইস্কুল ভস্মীভূত হয়।
৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীর মনোহরদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন নিহত ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি মধ্যে তিনটি দল তিনটি আলাদা স্থানে অভিযান চালায়। চতুর্থ দলটি পাকিস্তানিদের অ্যামবুশে পড়ে। প্রথম দলটি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কাছে রেললাইনে মাইন পেতে একটি বিশেষ ট্রেন অ্যামবুশ করে। ট্রেন অ্যামবুশের আওতায় আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের বিস্ফোরণ ঘটান। এতে বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়। দ্বিতীয় দলটি মেহেরপুরে হামলা করে একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। তৃতীয় দলটি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের হাসিমপুরে মিলিশিয়া ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে রাতে আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়। চতুর্থ দলটি মধুখালী গ্রামের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা বিপদে পড়েন। এখানে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাবে না
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ঘোষণা করেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতের সমরপ্রস্তুতি সামান্যও শিথিল করা হবে না।
ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন প্রতিমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা দিল্লিতে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ। ১৯৬৫ সালের পর সমরাস্ত্র উৎপাদনে ভারতের সর্বাত্মক অগ্রগতি ঘটেছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এখন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ওয়াশিংটন সফরে ইন্দিরার আলাপের মূল বিষয় থাকবে বাংলাদেশ। এর আগে ইউরোপেও তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী জি সাইস্কিন ও অস্টিয়ার চ্যান্সেলর কেইস্কির সঙ্গে একই বিষয়ে কথা বলবেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনের জন্য ৭৮টির মধ্যে ৭৫টি আসনে ১৯২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ১৪টি আসনে প্রার্থী একজন করে। বাকি ৬১ আসনে প্রার্থী ১৭৮ জন। ১৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। বাকি ৩টি আসনে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা হলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, খান এ সবুর খান, ইউসুফ আলী (মোহন মিয়া), আবদুল আলীম প্রমুখ।
২২ অক্টোবর – একমাত্র সমাধান সম্পূর্ণ স্বাধীনতা
মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনের বৈঠক শেষে ২২ অক্টোবর এক প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এই প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সব দেশ ও জাতিসংঘকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানানো হয়।
শরণার্থীদের ব্যাপারে এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ সব শরণার্থীকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা হয়, এতে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
কার্যনির্বাহী কমিটির তিন দিনব্যাপী সভা ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভা পরিচালনা করেন। কমিটির ৫৪ জন সদসে৵র মধে৵ ৪২ জন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও সভায় ছিলেন।
জাপানি পত্রিকায় ইয়াহিয়াকে ভর্ৎসনা
জাপানের জনপ্রিয় দৈনিক আসাহি সিম্বুন এবং ইয়োমিউরি সিম্বুন–এ এদিন পূর্ব বাংলায় অব্যাহত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে। কাগজ দুটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন—এই তিন বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আসাহি সিম্বুন বলে, পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ইয়োমিউরি সিম্বুন বলে, উপমহাদেশে শক্তিসাম৵ বদলে যাওয়ার শঙ্কায় বৃহৎ শক্তি পূর্ববঙ্গের গণহত্যা দেখতে চাচ্ছে না।
দিল্লি অভিমুখে শান্তিপদযাত্রা
বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জনমত গঠনে দিল্লির দিকে এদিনও শান্তিপদযাত্রা চলে। যাত্রীরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁদের স্বাগত জানান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্রসংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে পদযাত্রার জন্য দলটি গঠিত হয়। নেতৃত্ব দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল খালেক। ১৪ অক্টোবর তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকির পটভূমিতে দিল্লিতে সন্ধ্যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ফিরুবিনের আকস্মিক দিল্লি সফরের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি। তিনি ভারতকে সংযত থাকার অনুরোধ জানাবেন। পাকিস্তানকেও তাঁরা একই কথা বলছেন।
ভারতের ১১ জন সাংসদ এক খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং কংগ্রেসের সদস্যদের প্রতি
এক আবেদনে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সমবেত চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে কামান আক্রমণ চালান। প্রায় ১০ মিনিট গোলাবর্ষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।
এই অভিযানের পর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান কসবায় বোমাবর্ষণ করে। এই বিমান আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতাহত না হলেও বহু বেসামরিক লোক নিহত হন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা হরিসরদার বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের ঢাকা শহরের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা গভর্নর হাউসের (বর্তমানে বঙ্গভবন) কাছে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড (তখন এর অবস্থান ছিল বঙ্গভবনের সামনের পার্কের পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ পাশে) এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং কয়েকজন সাধারণ নাগরিক আহত হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিলির ভারতীয় অংশে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করলে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ৬ নম্বর সেক্টরের হিলির মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এরপর পাল্টা বোমা বর্ষণ করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় তাঁর দল এখন শুধু পাকিস্তানের বৃহত্তম দল নয়, জাতীয় পরিষদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।
২৩ অক্টোবর – মুক্তিযুদ্ধে গোপনে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র

লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ২৩ অক্টোবর জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করতে গোপনে ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার যে প্রবল আশঙ্কা তারা করছে, সেটি এড়ানো। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আসন্ন চীন সফর বিঘ্নিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঠেকানো।
কূটনৈতিক সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশের কিছু নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারিভাবে যোগাযোগ করেছে। যোগাযোগ করার উদ্দেশ্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা বলানোর চেষ্টা করা।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বিচারাধীন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বোঝাপড়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাঠামোর মধে৵ স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নেবেন, এই শর্তে ইয়াহিয়া বোঝাপড়ায় প্রস্তুত ছিলেন। তবে শেখ মুজিব নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া তাই শেষ পর্যন্ত সাড়া দেননি।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল এই দিন কামান ও মর্টার নিয়ে কসবা ও নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মাইলখানেক উত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর কালীর বাজার ঘাঁটিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন ভোরে নীলফামারীর খড়িবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণের জন্য সমবেত হন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রামনগর নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করলে দুই পক্ষে তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও তিনজন আহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মাগুরার মহম্মদপুরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করেন।
১১ নম্বর সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কালিহাতীর চারান নামক স্থানে মিলিশিয়া ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দলের ওপর হামলা করলে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তানে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর রওনা হওয়ার আগে এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আওতায় সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, এমন যেকোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পার্টি নির্বাচনী জোট গঠনের জন্য আলোচনায় রাজি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি মাহমুদ আলী ঢাকায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে পিপিপির পক্ষে বিস্ময়কর কিছু করা কল্পনাবিলাস মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে পিপিপির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই।
জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে আরও তিনজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮। ৭৮টি আসনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর মোট প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০১। এর মধ্যে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৬০টি আসনে প্রার্থী এখন ১৮৩ জন।
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তথ্যমন্ত্রী মুজিবুর রহমানসহ আরও ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লেখকদের সমর্থন
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজে৵র রাজধানী কলকাতায় এদিন এক সমাবেশে লেখকেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। বসুমতী পত্রিকা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। পত্রিকাটির দীপাবলি সংখ্যায় যেসব কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশিত হয়, তাঁরা তাঁদের লেখক সম্মানী মুক্তিযুদ্ধের জন্য দান করেন। ওই সমাবেশের সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায় কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর কাছে সম্মানীর টাকা (চেক) তুলে দেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন মনোজ বসু। বাংলাদেশের সাহিত্যিক শওকত ওসমান অনুষ্ঠানে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার ভাষণে বলেন, দেশ এখন বিপদের মুখে। প্রতিরক্ষা বাহিনী ও জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। এই বিপদের সময় দরকার ঐক্য ও শৃঙ্খলা। তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সরকারের পাশে থাকার আহ্বান জানান।
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা না হলেও দিল্লির ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি এবং বাংলাদেশের সংকট নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। ফিরুবিন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন।
এটি ছিল ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পকে৴ ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ–হুমকি নিয়ে কথা বলা। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ইন্দিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা বিদেশি নেতাদের বোঝাতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে বলবেন।
তবে পশ্চিমা মহল মনে করছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের নেতাদের সমাধানে আসতে রাজি করাতে ইন্দিরা গান্ধী সক্ষম হবেন। তাঁরা এ–ও ভাবছিলেন, ইন্দিরা এ ধরনের ভূমিকা নেবেন না কিংবা বাংলাদেশের সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবেও দেখাতে দেবেন না।
জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সরকারকে বাধ্য করতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি পত্রিকা
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক দখলদারি রাজত্বের নিন্দা করা হয়।
লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, ৯০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের জীবনধারণের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইন্দিরার তিন সপ্তাহের বিশ্ব সফরকালে চলবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না–ও হতে পারে। বিশ্বশান্তি অক্ষুণ্ন রাখতে হলে শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনী
মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় মোজাফফরপন্থী ন্যাপ অভিমত প্রকাশ করে, বাংলাদেশের একমাত্র সমাধান পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সমর্থন জানিয়ে সভায় সর্বস্তরে এমন কমিটি গঠনের প্রত্যাশা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
৮ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার সাদীপুর, তীতুদহ ও বেড়াশুলাসহ কয়েকটি স্থানে এদিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল সকাল ১০টার দিকে ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাদীপুরের অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করেন। এরপর দুই পক্ষে বহুক্ষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
চুয়াডাঙ্গার সদর থানার তীতুদহ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সেনা ও কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঝিনাইদহ মহকুমার সদর থানার অন্তর্গত বেড়াশুলা গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে প্রায় ১১ জন রাজাকার হতাহত হয়।
পাকিস্তানে তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে মিসরের রাজধানী কায়রোয় রওনা হন। ভুট্টো মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। দুই দিন কায়রোয় অবস্থানের পর তিনি জেনেভায় যাবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে রাত আটটায় ভারতের ত্রিপুরা রাজে৵র রাজধানী আগরতলায় গোলাবর্ষণ করলে পাঁচজন বেসামরিক লোকসহ ২০ জন আহত হয়। সেখানে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলাকালে শহর ও আশপাশে কতগুলো গোলা পড়ে। এই প্রথম কোনো রকম প্ররোচনা ছাড়াই পাকিস্তানিরা আগরতলা শহরে গোলাবর্ষণ করে। প্রায় ১০ মিনিট গোলা বর্ষিত হয়। করিমপুরেও পাকিস্তানিরা গোলাবর্ষণ করে।
২৫ অক্টোবর – বেলজিয়াম ইতিবাচক বাংলাদেশ নিয়ে

বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।
বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই
করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
ভারত আক্রমণাত্মক হবে না
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে বক্তৃতাকালে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যাকে আক্রমণাত্মক কাজ বলা যেতে পারে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে।
ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে আলোচনা করেন।
পক্ষত্যাগ বাঙালি কূটনীতিকের
মিসরের রাজধানী কায়রোয় পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি প্রধান ফজলুল করিম ২৫ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাবেন।
পাকিস্তানি পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই দিন দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক তাঁকে সহায়তা করবেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে উপদেষ্টা ছিলেন। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন।
ফ্রান্সের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি এ দিন একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। ইশতেহারে বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের রায়কে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ইশতেহারে চারটি প্রস্তাব রাখা হয়: ১. জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো, ২. রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা, ৩. পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করা, এবং ৪. পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। গেরিলাদের ছোড়া বোমা বিস্ফোরণে রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। হতাহতদের মধ্যে সাধারণ নাগরিকও ছিলেন।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কাজলায় একটি কারখানায় অবস্থানরত রাজাকারদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন। বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সাবদালপুর ও আনসারবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী প্রায়ই ওই রেলপথে চলাচল করত। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিন গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়েছিলেন, ওই দিন ট্রেনযোগে পাকিস্তানিদের একটি বহর যাবে। খবর পেয়ে তাঁরা দুই স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে রাখেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরণ ঘটে এবং তিনটি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।
১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জের অন্তর্গত কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
২৬ অক্টোবর – সোভিয়েত-কানাডা যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আট দিনের কানাডা সফর শেষে ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। বাংলাদেশ সমস্যার জরুরি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দুই দেশ আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত হতে অনুরোধ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়সংগত স্বার্থ এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে সংগত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশে৵ গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।
দুজন নোবেল বিজয়ীসহ ফ্রান্সের ৮০ জনের বেশি বিশিষ্ট নাগরিক এই দিন দেশটির সরকারের কাছে এক ইশতেহারে পাকিস্তানকে অবিলম্বে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার আহ্বান জানান। নোবেল বিজয়ীরা হলেন পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রে কাস্তলে এবং অণুজীববিজ্ঞানী আঁদ্রে লোফ। লেখক, সাংসদ ও ধর্মীয় নেতারা এই ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন।
বেলজিয়াম সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলসে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব শান্তিতে আগ্রহী বিশ্বের সব দেশের। তিন দিনের বেলজিয়াম সফর শেষে অস্ট্রিয়ায় যাত্রার আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ইন্দিরা বলেন, ভারত আলোচনার ওপরই জোর দিচ্ছে। তবে আলোচনায় কিছু ভিত্তি থাকা দরকার। পূর্ববঙ্গে কিছু ঘটনার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অথচ কষ্ট ভোগ করছে ভারত।
মিসরের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসা পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক ফজলুল করিম লন্ডনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতির প্রতিবাদে তিনি কাজে ইস্তফা দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরে কয়েকটি স্থানে এই দিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সীমান্তবর্তী কসবা ছাড়াও কায়েমপুর, সালদা নদী, নয়নপুর ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায় মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২৭ অক্টোবর ইত্তেফাক ‘কসবায় ভারতীয় গোলাবর্ষণ অব্যাহত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন সীমান্ত এলাকার গোয়ান ও রাউত গ্রামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংসের অভিযানে যান। সেতু দুটি পাহারায় ছিল রাজাকারদের একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররা আক্রমণ করে। এরপর দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। দু-তিন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।
এই দিন ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলে কিছু রাজাকার অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৭ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা দর্শনা থেকে সাত মাইল দূরে আন্দুলবাড়িয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় পাকিস্তানিদের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেখেছিলেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরিত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরে আরও কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন। একটি দল যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছার গদখালী-নাভারন অংশে সড়কের পাশে টেলিফোন লাইন ধ্বংস করলে যশোর–বেনাপোল টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে। আরেকটি দল বাগআঁচড়ায় আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন হতাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল ঝিনাইদহের বেথুলী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৬৫ জনের দলটি অ্যামবুশের আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণও করে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই দিন কিছু রাজাকার চীনা অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের ৮ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এক বুলেটিনে এই দিন বলা হয়, কয়েক দিন আগে একদল নৌ মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনের কয়রায় বিস্ফোরকের সাহায্যে পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশনের লানশিয়া নামে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। রংপুর অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা লালমনিরহাট-মোগলহাটের মধ্যবর্তী এলাকায় রেললাইন তুলে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে।
২৭ অক্টোবর – সমাজতান্ত্রিক দেশের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীতে