অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ , মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে।
এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালি নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
অক্টোবর মাস ১৯৭১ ১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাভদার অবস্থান – ১০ অক্টোবর
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদা ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। প্রতিবেদনে প্রাভদা বলে, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তামাশা করছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে।
প্রাভদা জানায়, ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েত জনগণ বিক্ষুব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনেরও দাবি করছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক বিতর্কে প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধি এ পর্যন্ত বক্তব্য দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫০টি দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান এবং শৃঙ্খলার প্রত্যাবর্তন কামনা করছে। তবে সে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কী, তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্রিটেন, মিসর, সিরিয়া, তুরস্ক ও জর্ডানের প্রতিনিধিরা বলেন, মীমাংসা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে হওয়া উচিত।
মিয়ানমারের প্রতিনিধিও বাংলাদেশ সমস্যার কথা এড়িয়ে যান। নেপালের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সমস্যার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, এর সমাধানের জন্য উচ্চ স্তরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দরকার। চীনের ঘনিষ্ঠ আলজেরিয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্য দেননি।
ভ্যাটিকানের পোপ জন পলের আহ্বানে রোমের বিভিন্ন গির্জায় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রার্থনাসভা আয়োজনের পাশাপাশি উপবাস পালন করা হয়। প্রার্থনাসভায় শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ১০ অক্টোবর ফেনীতে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী বাংলাবাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। অন্য দলটির সঙ্গে শুভপুর এলাকায় একদল পাকিস্তানি সেনার গুলিবিনিময় হয়।
পাকিস্তানি রেঞ্জার পুলিশের একটি দল লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাওয়ার সময় এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা তাদের অতর্কিতে হামলা করে কয়েকজনকে হতাহত করেন।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা জেলার আজনাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনে মাইন পেতে রাখেন। মাইনের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারবাহী একটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ কয়েকটি বগি রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা একদল পাকিস্তানি সেনাকে অ্যামবুশ করে। তাতে কয়েকজন হতাহত এবং দুজন রাজাকার বন্দী হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর মাধবকাঠি অবস্থানে এই সেক্টরের গোজাডাঙা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোহরাওয়ার্দী-পুত্র
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এর সাফল্য কামনা করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি জানতে পারার পর থেকেই বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ সহমর্মিতা ও সমর্থন ছিল। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ও নির্দ্বিধায় বলেন, বিগত ২৪ বছর ধরে বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও রাজনৈতিকভাবে অবদমিত হয়ে আসছে। এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যা এবং অন্যান্য ঘৃণ্য অনাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই। নিকট ভবিষ্যতে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে তাঁর এই বিবৃতি এ দিন সাংবাদিকদের কাছে বিতরণ করা হয়।
আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানান। বুয়েনস এইরেসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ঘোষণা দিয়ে বলেন, তাঁর আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পদ তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র এ দিন জানান, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা এখন মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। মুক্তাঞ্চলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে
মন্ত্রিসভার এক বিশেষ বৈঠকে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার কাছে যুদ্ধের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বর্ণনা দেন।
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এ দিন প্রকাশিত এক বুলেটিনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর কামদেবপুরের কাছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০ জন নিহত হয়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনা ও কোটচাঁদপুরের মধ্যে রেলের কয়েকটি সেতু ধ্বংস করেন। একই দিন গেরিলারা কামরাইলের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর পাঁচজন নিহত হয়।
৬ অক্টোবর দুধগুঁড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ৬ ও ৭ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ফুলবাড়ী, রাজশাহী ও ভূরুঙ্গামারী অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ও টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। এক স্থানে গেরিলারা মাইন দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ উড়িয়ে দিলে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া গেরিলারা ঢাকায় বোমা ছুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থারও কিছু ক্ষতি করেন।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কূটনৈতিক মহল সাংবাদিকদের জানায়, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি বলেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উক্তি এই মামলাকে প্রভাবিত করছে। ব্রোহীসহ অন্য কৌঁসুলিরা ঢাকায় মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দেন, তা উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। তাঁর এই অপরাধের শাস্তি হবেই। ব্রোহি বলেন, প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য সামরিক আদালতে মামলাকে প্রভাবিত করছে।
রেডিও পাকিস্তান এ দিন জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকেও ৩০ সেপ্টেম্বর একজন প্রতিনিধি মারফত এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মজুমদারহাট ও ফেনীর পরশুরামে এই দিন ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত আলাদা দুটি অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
কুমিল্লা সার্কিট হাউস ছিল পাকিস্তানিদের আঞ্চলিক মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার। ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা শহরের ভেতরে অবস্থিত এই সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষণ করলে পাকিস্তানিদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও পুলিশ হতাহতও হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অভিযানের খবর রেডিও পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সংবাদপত্র ভারতীয় আক্রমণ হিসেবে ফলাও করে প্রচার করে।
একই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণে রাজগঞ্জেও পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। এই সেক্টরের অন্য আরেকটি দল বাঞ্ছারামপুর থানার দক্ষিণ পশ্চিমে উজানচর-আসাদনগরে অ্যামবুশ রচনা করে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টারের সাহায্যে চুয়াডাঙ্গা ও সাঞ্চাডাঙ্গা, চৌগাছা ও মাসলিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। এ ছাড়া খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের বিবৃতি
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে বর্ণনা করে। বিবৃতিতে তারা এ সম্পর্কে ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই সমস্যার মূল বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করেন। বিবৃতিতে একবার শুধু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে বাকি সব স্থানেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
অপারেশন ওমেগা দলের দুজন সদস্য জেমস স্কারলেট ও স্টিফেন রিভার মুর কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের জন্য পাকিস্তানি প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে তাঁরা জেনেছেন, যাঁরা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কথা জানাচ্ছেন, শুধু তাঁদেরই ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
মিসরের সংবাদপত্র আল আহরাম-এ ১২ অক্টোবর এক নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে বিচারের ফল যা-ই হোক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হবে না। পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নিবন্ধ লেখক ড. ক্লোভিমা ম্যাক সাঈদ বিশ্বাসযোগ্য একটি পাকিস্তানি সূত্র থেকে এ তথ্য পেয়েছেন বলে জানান।
ইয়াহিয়া খান এই দিন এক বেতার ভাষণে ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। অধিবেশনের পরপরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবেন এবং পরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তিনি বলেন, ভারত শিগগিরই পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে। তবে তাঁর বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক রয়েছে।
ইয়াহিয়ার বক্তৃতায় প্রতিক্রিয়া
ইয়াহিয়ার বক্তৃতার পরপরই ভারতের প্রতিরক্ষা মহল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে
ইয়াহিয়ার যুদ্ধের হুমকি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো কথা বলার অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। কারণ, তিনি বিদেশি আক্রমণকারী এবং বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের সাবেক উপদেষ্টা এবং সদ্য পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের আরও বলেন, তিনি তাঁর আবাস ও আসবাব বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। কারণ, আইনগতভাবে তা বাংলাদেশেরই প্রাপ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে অরুণকুমার নন্দী ১২ অক্টোবর ভোররাত ২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত একটানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতরে বিশ্ব রেকর্ড করেন। অরুণ নন্দী ৮ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে চাঁদপুর সম্মিলনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বউবাজার ব্যায়াম সমিতির আয়োজনে কলকাতার কলেজ স্কয়ার পুকুরে সাঁতার শুরু করেন।
বিদেশি বন্ধুদের সহমর্মিতা
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, অপারেশন ওমেগা দলের দুজন সদস্য ৪ অক্টোবর বাংলাদেশে ঢোকার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের আটক করে যশোর জেলে পাঠায়। পাকিস্তান প্রশাসন তাঁদের দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। অপারেশন ওমেগার একজন মুখপাত্র জানান, কারাদণ্ড দেওয়া সত্ত্বেও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আবার তাঁরা সদস্য পাঠাবেন।
বুলগেরিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান মুফতি হাসান আদেমভ এবং দক্ষিণ বুলগেরিয়ার স্মলিয়ানের মুফতি ইউসেইন সেফরকভ ১২ অক্টোবর বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানান।
গেরিলা অভিযান
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে কয়েকটি দলে পাকিস্তানি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি চিলমারী বন্দরে সমন্বিত আক্রমণ চালান। দীর্ঘ যুদ্ধের পর বলবাড়ি রেলস্টেশন ও ওয়াপদা ভবন বাদে পুরো চিলমারীর নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে নেন। বহু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত ও বন্দী হয়। চিলমারীতে একটি ছোট দল রেখে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে রৌমারীতে ফিরে আসেন।
টাঙ্গাইল থেকে খাদ্য ও রসদ নিয়ে এলাসিন হয়ে নাগরপুর যাওয়ার পথে কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণের মুখে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। বাকিরা পালানোর সময় ধরা পড়ে।
১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর পরশুরামে অ্যামবুশ করে একদল পাকিস্তানি সেনার দুজন নিহত ও একজন আহত করেন।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রকেট লঞ্চার ও মেশিনগানের সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীর কালীরবাজার অবস্থানে আক্রমণ করে। এতে সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং পাকিস্তানিদের দুটি বাংকার ধ্বংস হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা জেড ফোর্সের সহায়তায় ছাতক সার কারখানা আক্রমণের লক্ষ্যে ছাতকের কাছে মহড়াটিলা ও জয়নগর টিলাতে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারাও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পর্যুদস্ত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর গড়াগড়ি ও সুলতানপুর অবস্থানে হামলা করলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ১২টার দিকে ঝিনাইদহের মহেশপুরের শ্রীরামপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। অতর্কিত এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে পাকিস্তানি সেনাদের হতাহত করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরার ভেটখালীর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করলে রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেন।
ঢাকায় পাকিস্তানপন্থীদের তৎপরতা
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), কাইয়ুম মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রতিনিধিসহ কয়েকজন কট্টর পাকিস্তানপন্থী নেতা ঢাকায় সফররত পিপিপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা পিপিপিতে যোগ দিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানান।
মোনেম খান নিহত গেরিলা অভিযানে – ১৩ অক্টোবর

দুঃসাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক কঠোর সেনা প্রহরা পেরিয়ে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খানের ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাঁকে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ মোনেম খান রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঘটনাটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোনেম খানের বনানীর বাড়ি পাহারার দায়িত্ব পড়ে বালুচ রেজিমেন্টের একটি দলের ওপর। বাড়ির মুখে বাংকার বানিয়ে তারা পাহারা দিত।
মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক তিনবারের চেষ্টায় এ অভিযানে সফল হন। প্রথমবার সন্ধ্যায় বাড়িটিতে ঢোকার পর জানতে পারেন, অসুস্থ মোনেম খান দোতলায় শোবার ঘরে চলে গেছেন। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় মোনেম খানের বাসায় ঢুকেও অভিযান পরিচালনা করা যায়নি। ১৩ অক্টোবর তৃতীয় অভিযানে মোজাম্মেল হক সহযোগী হিসেবে সঙ্গে নেন আনোয়ার হোসেনকে। সন্ধ্যার পর মোনেম খানের বাসার ভেতরে কলাবাগানের ঝোপে দুজন লুকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর গুপ্তচর শাজাহান আর মোখলেস এসে জানান, মোনেম খান তাঁর জামাতা জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল এবং শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেনের সঙ্গে বাসার নিচতলার ড্রয়িংরুমে কথা বলছেন।
মোখলেস আর শাজাহানকে আগে পালাতে দিয়ে মোজাম্মেল হক অভিযান শুরু করেন। ড্রয়িংরুমের দরজায় পৌঁছে তিনি দেখেন, দরজার দিকে ফিরে সোফায় বসে তিনজন কথা বলছেন। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই তিনি স্টেনগানের ট্রিগার টেপেন। একটি গুলি বের হয়েই স্টেনগানটি আটকে যায়, কিন্তু গুলিটি মোনেম খানের পেটে বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বালুচ সেনারা ততক্ষণে গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। আনোয়ার পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে চলে যান। মোজাম্মেলও দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়েন। একসময় পৌঁছে যান বনানী-গুলশান লেকে। অভিযান শেষে এখানেই সবার মিলিত হওয়ার কথা ছিল।
পাকিস্তানি সেনারা এদিন সন্ধ্যায় কসবায় ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধার অবস্থানে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়ভাবে তা মোকাবিলা করেন। এক ঘণ্টার এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুজন শহীদ এবং একজন আহত হন।
ইয়াহিয়ার সমালোচনায় ‘ডন’
পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ডন পত্রিকায় ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানের পুনর্গঠিত জাতীয় পরিষদ যে সংবিধানই প্রণয়ন করুক না কেন, তা গণতান্ত্রিক হবে না। কারণ, তার পেছনে জনগণের রায় নেই। আগামী ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত হবে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় তারা সংখ্যাগুরু।
ডন আরও বলে, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ৮৮ জন সদস্যের সদস্যপদ বহাল রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৫-২০ জন সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে অন্তত ৭০টি আসন শূন্য থাকবে। ওই আসনগুলো শূন্য রেখে অধিবেশন চালালে জাতীয় পরিষদের কোনো গুরুত্বই থাকবে না। কাজেই এ সংবিধান গণতন্ত্রসম্মত হবে না।
ঐক্যের আহ্বান তাজউদ্দীনের
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুর অঞ্চলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। চূড়ান্ত বিজয় না আসা পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে। তিনি বলেন, জাতীয় সংকটে রাজনৈতিক দলাদলি শত্রুর হাতকেই শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের স্বার্থে সবাইকে তিনি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আশ্বাস
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত আলোচনার ধারাবাহিকতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এদিন আবারও এই আশ্বাস দেয় যে তাদের বাংলাদেশ নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। আগের সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আলজেরিয়ার যুক্ত ইশতেহার নিয়ে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তির প্রেক্ষাপটে নতুন করে এ আশ্বাসের গুরুত্ব অনুভূত হয়। ওই যুক্ত ইশতেহারের একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পাকিস্তান ও ভারতের জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি উভয় দেশ সম্মান প্রদর্শন করছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য উভয় দেশকে আহ্বান জানাচ্ছে। সোভিয়েত কর্মকর্তারা বলেন, সোভিয়েত-ভারত চুক্তিই প্রমাণ করে যে ভারত ও পাকিস্তানকে তাঁরা কখনো এক আসনে বসাবে না।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনের একমাত্র উপায় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে পাকিস্তানের এগিয়ে আসা। বাংলাদেশের জনগণের ওপর সামরিক নিপীড়ন চালানোর কারণে পাকিস্তানে উদ্ভূত ভয়াবহ সংকট নিরসনে আপস করা ছাড়া পাকিস্তানের গত্যন্তর নেই।
ভারতে আসবেন আঁদ্রে মালরো
বার্তা সংস্থা এএফপি ১৩ অক্টোবর জানায়, ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী ও ভাবুক আঁদ্রে মালরো ভারতে এসে ১৫ নভেম্বরের পর থেকে ভারতেই থাকবেন। তবে ভারতে যাওয়ার আগে নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর প্যারিস সফরকালে তিনি তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং তাঁর ভারতে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করবেন।
ছাতকে দুঃসাহসী সম্মুখযুদ্ধ – ১৪ অক্টোবর
১৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ছাতকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি দলের সঙ্গে সাহসিকতাপূর্ণ এক সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন।
ছাতকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পশ্চিম তীরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। নদীতীরে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। ছাতক শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে সিলেট শহর। ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই পুরো এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। সঙ্গে ১২ আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স (একেএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) এবং রাজাকারদের দুই কোম্পানি শক্তিসমান জনবল।
মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাতকে আক্রমণ করার জন্য গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্প থেকে ১১ অক্টোবর ছাতকের ঠিক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে বাঁশতলায় আসে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর।
তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল)। তিনি আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। গাইড ও সহযোগী হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ৫ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের। এ ছাড়া রৌমারীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট কোম্পানিকে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির রিইনফোর্সমেন্ট ও রিয়ার প্রটেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অভিযান চলাকালে দোয়ারাবাজার থেকে এবং সড়কপথে সিলেট শহর থেকে গোবিন্দগঞ্জ হয়ে ছাতক শহরে যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে, সে জন্য চার্লি ও ডেলটা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাট অফ পার্টি হিসেবে চার্লি কোম্পানি দোয়ারাবাজারে এবং ডেলটা কোম্পানি ছাতক ও গোবিন্দগঞ্জের মাঝামাঝি মাধবপুর ও হাসনাবাদ এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে।
১৪ অক্টোবর সকাল থেকেই মূল আক্রমণকারী দল আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি এবং একটি এফএফ কোম্পানির সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দিনভর প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল এগিয়ে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাছাকাছি টিলার উঁচু স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়। আলফা কোম্পানি একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের সম্মুখবর্তী অবস্থানের ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে যায়।
পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ছাতক শহরে চলে যায়।
মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির রিকোয়েললেস রাইফেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের অনেক বাংকার ধ্বংস হয়। সন্ধ্যার মধ্যেই আলফা কোম্পানি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় ঢুকে পড়ে। ব্রাভো কোম্পানিও ওই পর্যায়ে আলফা কোম্পানির কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের আরেকটি কোম্পানি সেনারা বিকেল থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। পাকিস্তানিদের এই দলের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
১৩ অক্টোবর সন্ধ্যার পর লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে ডেলটা কোম্পানি মাধবপুর ও হাসনাবাদের উদ্দেশে রওনা করেছিল। সুরমা নদীর উত্তর তীরে পারকুল গ্রামে তাঁদের পৌঁছাতে ১৪ অক্টোবর ভোর হয়ে যায়। তাঁরা হাসনাবাদ ও মাধবপুর এলাকায় রেল ও সড়কপথ অবরোধ করে অবস্থান নেন।
সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতক শহর থেকে এসে ডেলটা কোম্পানির ওপর হামলা চালায়। তাঁরাও পাল্টা হামলা অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তানিরা বারবার চেষ্টা করেও ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে সরাতে পারছিল না। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তানিদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদী পার হয়ে পারকুল গ্রামে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা আর্টিলারি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে পারকুল গ্রামটি ঝাঁঝরা করে দেয়।
এ যুদ্ধ ১৬ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৫ অক্টোবর সকাল থেকে পাকিস্তানিরা তিনটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর মেশিনগানের গুলি চালায়।
ছাতক যুদ্ধে দুই পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। তাদের একজন কর্নেলসহ বহু সেনা, একেএফ, ইপিসিএএফ এবং রাজাকার হতাহত হয়। ৪০-৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং অনেকে আহত হন।
ছাতকের যুদ্ধে যে পাকিস্তানিরা যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সে কথা স্বীকার করেন। এই অভিযানের খবর বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য প্রচার পেয়েছিল।
সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটি ১৪ অক্টোবর রাতে দিল্লিতে ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ নিয়ে পর্যালোচনা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বোম্বাই থেকে দিল্লিতে ফিরে আসার অল্প সময়ের মধ্যে এই রাজনৈতিক কমিটির বৈঠক বসে। কমিটিকে জানানো হয়, ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা ভারতের পূর্ব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তেও পাকিস্তান ট্যাংক, কামান ও সেনা জড়ো করছে। বৈঠকের পর একজন কর্মকর্তা বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না, তবে আক্রান্ত হলে জবাব দেবে।
ভারতে সফররত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও গ্রন্থকার জন গ্রিগ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত ভালো। তবে যুক্তরাজ্য সরকার কী করবে, তা নির্ভর করছে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর। তাঁর আগামী সফরে ব্রিটিশ নেতাদের ঠিকমতো বোঝাতে পারলে যুক্তরাজ্য একাই বহু কিছু করতে পারে। গ্রিগ আরও বলেন, এখানে সফরের আগে তাঁর ধারণা অন্য রকম ছিল। কিন্তু এখন তিনি জানেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে শরণার্থীরা দেশে ফিরবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা রবার্ট জে ম্যাকলস্কি সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধে যুক্তরাষ্ট্র কারও ব্যাপারেই মধ্যস্থতায় রাজি নয়।
সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার ইয়াহিয়ার – ১৫ অক্টোবর
ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সফররত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কুর সঙ্গে তেহরানের পারসি প্যালেসে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। তাঁরা সবাই উৎসবে যোগ দিতে তেহরানে যান। নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে ইয়াহিয়া প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করেন। পদগোর্নির কাছে তিনি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সেনাসমাবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, আত্মরক্ষার জন্যই তিনি এসব করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ এই দিন সাংবাদিকদের জানান, সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের পরিমাণ পুরোপুরি কমিয়ে দিতে ভোট দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের সামনে ঘোষণা করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সব বিদেশি সাহায্য নিষিদ্ধ করার পক্ষে কমিটি ভোট দিয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ঢাকা থেকে পাঠানো এক খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সেনা নামিয়ে যে সন্ত্রাসের সূচনা করেছিলেন, বাংলাদেশে তা এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা সুদূর।
ভারতে নিয়োজিত উত্তর ভিয়েতনামের কনসাল জেনারেল নুয়েন থাট ভু এদিন দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর ভিয়েতনামের জনসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সংগ্রামে ভিয়েতনামের পূর্ণ সহযোগিতা আছে।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ১৫ অক্টোবর ফেনীর ছাগলনাইয়া, গুতুমা, পরশুরাম, চিতলিয়া, বল্লভপুর, দারোগাহাটসহ কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করে। এসব আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকাররা হতাহত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি বাংকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার দক্ষিণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে বারচর গ্রামে অ্যামবুশ পাতেন। এক ঘণ্টা পর একদল পাকিস্তানি সেনা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফেরার পথে অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ এদিনও অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী তিনটি হেলিকপ্টার দিয়ে এই দিন সকাল থেকে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে মেশিনগানের গুলি করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, সেনাপ্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এই দিন সুনামগঞ্জের বালিউরায় এসে যুদ্ধ পরিদর্শন করেন।
৭ নম্বর সেক্টরের বগুড়া অঞ্চলের একদল মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া-সান্তাহার রেললাইনের একটি সেতুর কাছে অতর্কিতে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, সেনাপ্রধান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল) নেতৃত্বে চুয়াডাঙার দামুড়হুদার ধোপাখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালান। দুই পক্ষের মুখোমুখি যুদ্ধে সেনা ও রাজাকার মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার আবদুল গফুর ও নায়েক শহীদ আলী শহীদ হন। আহত হন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা যশোরের ঝিকরগাছা থেকে দশতিনামুখী সড়কে রাজাকারদের অ্যামবুশ করেন। ঝিকরগাছায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রতিরক্ষা অবস্থান। রাজাকারেরা এদিন পাকিস্তানি সেনাদের জন্য দশতিনা থেকে কয়েকটি গরুর গাড়িতে করে খাদ্যসামগ্রী ও রসদ নিয়ে ঝিকরগাছা যাচ্ছিল। পথে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এমন আকস্মিক আক্রমণ রাজাকাররা প্রতিরোধ করতে পারেনি। অতর্কিত আক্রমণে তিনজন রাজাকার আহত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়ার চাতুর্য
স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে রাজনৈতিক চাতুর্য শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তিনি দেখাতে চাইছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ তাঁর দয়ার ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া হত্যা করবেন না, এমন তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
মিসরের আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে ক্লোভিমা ম্যাক সাউদ লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে নাকি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এই দিন বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পদযাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ৩৬ জন ছাত্র-যুবক ভোরে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কালীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে এই পদযাত্রা শুরু করেন। একনাগাড়ে ১০ মাইল হেঁটে তাঁদের সাড়ে তিন মাসব্যাপী পদযাত্রার প্রথম দিন গোকর্ণে শেষ হয়। ৩০ জানুয়ারি গান্ধী প্রয়াণদিবসে দিল্লির রাজঘাটে গান্ধীর সমাধিতে এর সমাপ্তি হবে। অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডলের সহায়তায় এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
মুক্তিবাহিনী এখন ভীষণ মারমুখী – ১৬ অক্টোবর

মুজিবনগরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র ১৬ অক্টোবর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের জানান, মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভীষণ মারমুখী। শুধু গেরিলা লড়াই, অ্যামবুশ বা চোরাগোপ্তা গুলি চালানো নয়, সম্মুখসমরের জন্যও তাঁরা তৈরি। প্রতিটি সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিরা হারছে। মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিচ্ছেন রেললাইন ও সেতু। পাকিস্তানি সেনাবাহী ট্রেনের ওপর নিয়মিত আঘাত হানছে। বিভিন্ন স্থানে এতটাই তাঁদের সফলতা যে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে চড়তে ভয় পাচ্ছে। রাতে কোনো ট্রেন চলছে না।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও দুটি খবর দেওয়া হয়। একটি হলো বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নৌবহর সংগঠিত হয়েছে। আপাতত তাতে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া পাঁচটি মোটর বোট। দ্বিতীয়টি হলো, বাংলাদেশের বিমান সেনা ও বৈমানিকদের নিয়ে বিমান ইউনিট গঠন। আগে এঁরা পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইউনিটের জন্য বিমান সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন চলছে প্রশিক্ষণ।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করেন। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনী নদীর পূর্ব তীরে চট্টগ্রামের পশ্চিম অলিনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দলকে অ্যামবুশ করেন। দুই হামলায় কিছু সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ১৬ অক্টোবর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যায়।
৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর সূচিত হওয়া যুদ্ধ ১৬ অক্টোবরও অব্যাহত থাকে। এ দিন সকালে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিতে শুরু করে। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্রাভো কোম্পানি আলফা কোম্পানিকে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। সন্ধ্যার মধ্যে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির দখলে চলে আসে।
তবে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলাগুলোতে দিনভর পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ আলফা অধিনায়ককে চিন্তিত করে রাখে। সন্ধ্যার পরই তিনি সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে পৌঁছান। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির সঙ্গে চার্লি ও ডেলটা কোম্পানির কোনো যোগাযোগ ছিল না। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় তারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সহায়তায় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গলাপানি পার হয়ে পেছনে বালিউরার উদ্দেশে রওনা দেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভারত সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর অভিযান চালায়।
৮ নম্বর সেক্টরভুক্ত এলাকার ভারত সীমান্তের কাছে সাজালিতে একটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিছুদিন আগে সাজালি গ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা মুক্ত ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। খবর পেয়ে সেনা ও রাজাকারের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল এই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাজালি ক্যাম্পে আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
আক্রমণের জন্য ভারত প্রস্তুত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ১৬ অক্টোবর নব কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় বলেন, পাকিস্তান মরিয়া হয়ে গেরিলা আক্রমণ করলে ভারতও সমুচিত জবাব দিতে পুরোপুরি তৈরি। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও কয়েকজন মন্ত্রী এবং নব কংগ্রেসের সভাপতি সঞ্জিবায়া উপস্থিত ছিলেন।
ভারত সীমান্তে বিপুল পাকিস্তানি সেনা সমাবেশের খবরটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন সাংবাদিকদের জানান। গত কয়েক দিন সীমান্ত পেরিয়ে যাঁরা ভারতে এসেছেন তাঁরা জানান, সীমান্তের দিকে প্রতিদিন বহু ট্রেন ভারী সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছে। অসামরিক গাড়িগুলোও সেনা বহনের কাছে লাগানো হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর হুঁশিয়ারি – ১৭ অক্টোবর

দিল্লিতে একটি কূটনৈতিক সূত্র ১৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো হঠকারী সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। তেহরানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বৈঠকের সময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
ইরানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা তেহরানে গিয়েছিলেন।
ভারতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এই দিন বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আহ্বান জানান, যাতে শরণার্থীরা দ্রুত নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারেন। তাঁর সম্মানে দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি আয়োজিত ভোজসভায় তিনি এ অভিমত জানান। তিনি বলেন, এই গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে পুরো উপমহাদেশে, এমনকি তার বাইরেও শান্তির পক্ষে বিপদ দেখা দিতে পারে।
ভোজসভায় ভি ভি গিরি বলেন, কেবল স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গের জনগণের মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসা না হওয়া অব্দি সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাবে না। এ ব্যাপারে ভারত কোনো আন্তর্জাতিক চাপ গ্রাহ্য করবে না।
দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ৵ সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, ২৪ অক্টোবর থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি—ইউরোপের এই পাঁচ দেশ সফর করবেন। এই সফরে তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পাবে। তাঁর বক্তব্য হবে, ‘বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। পাকিস্তানের মতান্ধতা ও অপকৌশল এশিয়া ও বিশ্বের শান্তি বিপন্ন করে তুলেছে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান চাই, শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা চাই।’
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল এই দিন ফেনীতে ভারত সীমান্তবর্তী আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। একটি দল পাকিস্তানি সেনাদলকে দেবপুরে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও গুরুতর আহত হন। দ্বিতীয় দলটি ভোরে পূর্ব দেবপুরে আরেকটি পাকিস্তানি সেনাদলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি জগন্নাথ সোনাপুর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা রাত আটটার দিকে ঢাকায় মতিঝিলের কাছে নটর ডেম কলেজসংলগ্ন সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। এ সময় টহলরত একটি ছোট পাকিস্তানি সেনাদল সেখানে হাজির হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপরও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
একই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল কুমিল্লার রমজানপুরে আরেকটি টহল দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
৫ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা টানা কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের পর সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে এদিন ভোরে পর্যায়ক্রমে বালিউরায় এসে একত্র হন। মুক্তিবাহিনীর এফএফসহ আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি অবস্থান ছেড়ে গেছে দেখে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ধাওয়া করতে জোড়াপানি-মৌলা হয়ে ভারত-সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। তখন আলফা, ব্রাভো ও এফএফ কোম্পানি বালিউরায় অবস্থান নিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিন বিকেল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। ২৫-৩০ জন মারাত্মক আহত হন। আহতদের বহু কষ্টে বাঁশতলায় পাঠানো হয়। সেখানে তাঁদের সমাহিত করা হয়। বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতকের দিকে ফিরে যায়।
৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের আলাদা দুটি স্থানে এদিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন দশাতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশের আওতায় পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিচক্ষণতার সঙ্গে সে হামলা মোকাবিলা করে নিরাপদ স্থানে সরে যান। তবে এর আগে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত ছিলেন। গোলন্দাজ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।
ভারত সীমান্তবর্তী বিশাহারীতে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও ভারী অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হন, অবশ্য বড় কোনো ক্ষতি তাঁদের হয়নি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়ার দম্ভ – ১৮ অক্টোবর
বিখ্যাত ফরাসি দৈনিক লা মঁদ পত্রিকায় ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনগণ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য মার্জনা চায়, তাহলে তিনি তা মঞ্জুর করবেন। লা মঁদ-এর সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, যে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গোপনে শেখ মুজিবের বিচার করছে, তারা যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তাঁর মার্জনা করার অধিকার প্রয়োগ করবেন কি না। প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহিয়া ওই কথা বলেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে নিরপরাধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত পাকিস্তানকে হুমকি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ নিয়ে টিটো-ইন্দিরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটিতে সফররত যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে দিল্লিতে আলোচনাকালে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো অভিপ্রায় ভারতের নেই। তবে ভারত আক্রান্ত হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা মোকাবিলা করবে। টিটোর সঙ্গে ইন্দিরার প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনায় মুখ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশ।
আলোচনায় মার্শাল টিটো কিছু বিষয়ে ইন্দিরার সঙ্গে একমত হন। ১. বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। ২. বাংলাদেশে শরণার্থীদের নিরুদ্বেগে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। ৩. প্রত্যেক মানুষেরই উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার আছে। ৪. দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার ভারতের আছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ১৮ অক্টোবর আলাদা তিনটি স্থানে অভিযান চালান। প্রথম দল ফেনীর গুতুমা সীমান্তঘাঁটিতে, দ্বিতীয় দল গুতুমা নদী এলাকায় এবং তৃতীয় দল মাতুয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করে। তিন স্থানেই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মিলে কয়েকজন হতাহত হয়। গুতুমা সীমান্তঘাঁটির যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। একজন পরে মারা যান।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী দল মর্টার ও রিকোয়েললেস রাইফেলের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর চৌদ্দগ্রামের বাডিসা ঘাটের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। প্রায় একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাসার দীঘির অবস্থানে হামলা করলে পাকিস্তানি বাহিনীর দু-তিনজন হতাহত এবং কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দভাগ বাজারের পশ্চিম দিকে দেউশে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চাপিতলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের পেছন দিকে অ্যামবুশ পাতে। ভোর চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি দল তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে এসে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ২৫টি নৌকায় করে গৌরীনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণের উদ্দেশে রওনা দেয়। তারা গৌরীনগরের কাছাকাছি এলে পাকিস্তানি বাহিনী গৌরীনগর থেকে তাদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। অকস্মাৎ এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ছয়জন গুরুতর আহত হন।
এই সেক্টরের সুনামগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী সংঘবদ্ধ হয়ে ছনখাইড় এলাকায় এসে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরা আর এগোতে না পেরে ছাতকের দিকে ফিরে যায়। তবে পাকিস্তানি সেনারা ছনখাইড়, রাজারগাঁও, মৌলা, জয়নগর, জোড়াপানি, নোয়ারাই ইত্যাদি গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি দল ঝিনাইদহের ফতেহপুর ও ধেনকিপাতায় পাকিস্তানি বাহিনীর আলাদা দুটি দলকে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সাদীপুরে একদল পাকিস্তানি সেনাকে আক্রমণ করে।
- অক্টোবর মাস ১৯৭১ , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “মে মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “মে মাস ১৯৭১ ১”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “এপ্রিল মাস ১৯৭১ ৩”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- “এপ্রিল মাস ১৯৭১ ২”, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিবস ভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ
- কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ] Kazi Nazrul Islam Biography [ Short ] [ আমার নজরুল ]